প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৭ (৩)

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৭ (৩)
জান্নাত নুসরাত

এতক্ষণের শান্ত পরিবেশ ভেদ করে কনভেনশন হলের চারিদিকে হট্টগোল বেঁধে গেছে। বাহিরে বৃষ্টির ঝাপটা ভেতরে মানুষের সমাগমে হুরোহুরি চলছে প্রায়। চারিদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খুঁজছে সবাই বিয়ের কনেকে,কিন্তু সে কোথায়! নেই কোথাও নেই..! জায়িন হতবাক, স্তব্ধ, হয়ে নিজের জায়গায় অটল দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের আগায় তাচ্ছিল্য ভর করেছে। ভেতরে ভেতরে ক্রোধের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে। হাতের কাছে যাকে পাবে তাকেই খুন করে ফেলবে তার অবস্থা দেখে এমন সম্ভবনা আছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। কনে রুপে সেজে আসা মেয়েটা কাচুমাচু ভঙ্গিতে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। ভয় ডর মুখে তেমন একটা নেই কিন্তু চোখে শঙ্কা স্পষ্ট। জায়িন ঘাড় বাঁকিয়ে দু-দিকে মটমট করে শব্দ করল। চোখ দুটো তীক্ষ্ণ করে এক পা এক পা করে আগাল সামনের মেয়েটার দিকে। হিসহিসিয়ে জানতে চাইল,”কোন সাহসে এখানে বসেছ?

মেয়েটা নিজেও পিছিয়ে গেল জায়িনের সাথে। মুখে এতক্ষণের শঙ্কা উবে গিয়ে ভর করল ভয়। নিষ্পাপ মুখটা খুলে কিছু বলতে যাবে জায়িনের হাতের থাবা পড়ল তার বুকের কাছের কাপড়ে। তখন কারোর দৃষ্টি তাদের দিকে নেই। একহাতে ঘাড়ের চুলগুলো খিঁচে চেপে ধরতেই মেয়েটার সব চুল খুলে হাতে চলে আসলো জায়িনের। জায়িন একবার দেখল মেয়টাকে একবার দেখল হাতের চুলকে। বিস্ময়ে, রাগে, মাথা দপদপ করে উঠল। মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে কঠোর কন্ঠে জানতে চাইল,”এসব কার আইডিয়া আহান?
আহান কাঁদো কাঁদো মুখ বানাল।মিনমিনে সুরে বলল,
“ছোট আপু আর ছোট ভাইয়ার, আমি কিছু জানি না।
কথা শেষে ভ্যা করে কেঁদে দিল সে। দূর হতে আরশের গলার স্বর ভেসে আসলো,” সবাই যান গিয়ে বসুন, আমি দেখতেছি। প্লিজ ভাইয়া এদিকে আসো..!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সবাই চিন্তিত মুখে ফিরে আসলো নিজ নিজ স্থানে। আরশ দ্রুত ভঙ্গিতে ইসরাতের এন্ট্রি যে পথ দিয়ে হয়েছিল তা ক্রস করে চলে গেল করিডোরের দিকে। আকস্মিক কী মনে হলো নিজের জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার কাছে ঠেকল ভেজানো দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মেয়েটাকে সে চিনে, যে এই মুহুর্তে দু-হাত উপরে তুলে নাচছে, কোমর দোলাচ্ছে, এমনকি মুক্ত জড়া হাসি হাসছে। বারংবার নাচের তালে খিলখিল করা হাসি ঠোঁট চেপে ঢাকার বৃথা প্রচেষ্টা করছে। তার হৃদয়ে ঝড় উঠল। নিজের কাছে মনে হলো একবার ফিরে যাওয়া উচিত, দেখা উচিত ওই ভেজানো দরজার আড়ালে কে, আর হাসছেই বা কে, একবার ফিরে যা আরশ, শুধুমাত্র একবার দরজার ওপাশে কে সেটা দেখ, এরপর নাহয় চলে যাবি যাকে খুঁজছিস তাকে খুঁজতে। নিজের মনের দোলাচালে নিপীড়িত হয়ে আরশ পা বাড়াল৷ তড়িৎ গতিতে নয়, ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে৷ আস্তে ধীরে যখন পা বাড়িয়ে গিয়ে থামল চরণ দু-খানা দরজার নিকট তখন চোখদুটো সেখানেই স্তব্ধ রইল। বুকের কাছের নরম মাংসপেশি ধুকপুক করে উঠল। কালো গ্রাউন পরা নৃত্যরত মেয়েটা নিশ্চুপ। সাউন্ড সিস্টেমে খুব হালকা সুরে গান বাজছে

Tere liye~ jhumu diwana banke tere liye
Vaada hai mera main hoon tere liye
Hona kabhi tu judaa ….।

কানে হেডফোন লাগানো সবার, পনিটেল করা চুলগুলোও নাচছে নিজের মালিকের সাথে তাল মিলিয়ে। কপালে, কানে, হাতে ছোট্ট সাদা পাথরের অর্নামেন্ট গুলো চকচক করছে। হাতের মধ্যে ধরে রাখা ওড়নাটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেদিকে বিশের কৌটায় পা দেওয়া মেয়েটার কোনো ধ্যান নেই। আরশের হাফসাফ লাগল। বুক ধড়ফড় করল, জ্বালা হলো, নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল, এটা সত্যি কী তার বউ, উত্তর আসলো ভেতর থেকে হ্যাঁ..! এটা তার বউ, আরশের বউ, একান্ত, শুধুমাত্র তার বউ। এতটা গোছাল নুসরাত নাছিরকে আরশ কখনো দেখেনি। তার বুকে আবারো সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা উঠল, স্বস্থি মিলছে না। গলার কাছ পর্যন্ত বন্ধ করে রাখা বোতাম টেনে টুনে খুলল, দু-পাশে মাথা ঝাঁড়ল মাতালের মতো করে। নাক টেনে শ্বাস নিল, হাফসাফ করল শ্বাসকষ্টের রোগীর মতো। শ্বাস ফেলে চোখ তুলে তাকাতেই আবারো বুকে ব্যথা উঠল। আরশ দু-পাশে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে মাথা নাড়াল। ইচ্ছে করল হাত চেপে ধরে নিয়ে যেতে সবার সামনে। চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে নুসরাত নাছির তার স্ত্রী, তার সহধর্মিনী, তার একান্ত ব্যাক্তিগত মালিকানা শুধু এই মেয়েটার উপর, আর কারোর নেই। কিন্তু তার মুখ ফুটে একটা শব্দ বের হলো না, এমনকি অনুভূতির ছাপগুলো ভেসে উঠল না মুখের উপর, কারণ আরশের ভীষণ অস্বস্তি নিজের অনুভূতি মানুষের সামনে তুলে ধরা, মানুষকে বলে বেড়ানো মোটেও তার ধাঁচে নেই। তাই তো নুসরাতের সাথে তার ঝগড়া বেধে যায় কথায় কথায়। ভেজানো দরজা সামান্য খুলে নিজের সুঠাম দেহি শরীরটা জায়গা করে নিল। আড়াআড়ি দু-হাত বুকে বেঁধে দেখতে লাগল হিন্দি গানের তালে নাচে রপ্ত থাকা মেয়েটাকে। চোখ সরে গেল না একবারের জন্য অন্যপাশে।

আহানকে কিছু বলতে হলো না জায়িন নিজেই হলওয়ে থাকা মাইকের লাইন চিহ্নিত করে এগোলো সামনের পথে। কালো রঙের মাইক্রোফোনের লাইনটা চলে গেল সরাসরি রেস্ট রুমের দিকে। সে যখন পৌঁছাল নির্দিষ্ট স্থানে,তখন দেখল তার দিকে পিঠ ঠেকিয়ে আরশ দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে কিছু শব্দ বের করতে যাবে তখন চোখ পড়ল সামনের দিকে। ইরহাম এক হাত ইসরাতের কোমরে রেখেছে অন্য হাত নিজের হাতে নিয়ে ঘোরে ঘোরে নাচ করছে। পরপর আবারো আঙুল চেপে ধরে গোল গোল ঘোরাচ্ছে। দু-জনের কানে হেডফোন। জায়িন নিজেও বুকের কাছে হাত বেঁধে নিজের জায়গায় দাঁড়াল নৃত্য শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। আরশের তখনো কোনো নড়চড় নেই। সাউন্ড সিস্টেমে তখনো গান বাজছে। নুসরাত দু-হাত দিয়ে কান থেকে হেডফোন খুলে নিয়ে কিছু বলতে যাবে কানে ভেসে আসলো হাতের তালির শব্দ। সেই শব্দের সাথে জায়িনের গলা ভেসে আসলো,”আমাদের চিন্তার উপর রেখে এদিকে ভালোই নাচা হচ্ছে, আই লাভ দেট, প্লিজ ক্লেপ..! নাইস..!

সবাই বুঝল জায়িন তাদের উপহাস করে কথাগুলো বলেছে৷ মুখ খুলে নুসরাত কিছু বলতে যাবে জায়িন তর্জনী আঙুল তুলে নিজের ঠোঁটের উপর রাখল। হিসহিসিয়ে বলে ওঠল,”আপনি কিছু না বললেই আমি বেশি খুশি হবো। যা দেখিয়েছেন তাতেই চোখ ঝাঁঝিয়ে উঠেছে, এর থেকে বেশি কিছু দেখতে গেল না চোখ গলে যায়।
নুসরাত ঘাড় বাঁকাল। জিভ দিয়ে গাল ঠেলে হাসল সামান্য। জায়িন নিজের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,”নৃত্য করবেন আপনি? চলুন আজ রাতে আপনাকে নাচানো হবে, যত ইচ্ছে নাচবেন, আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আমার রুমে, আর আমি বসে বসে দেখব তা।

ইসরাত কিছু বলতে নিবে জায়িন শক্ত হাতে তাকে কোলে টেনে নিল, পা বাড়াল এন্ট্রেন্স এর দিকে, তখন ইরহাম বলল,”ভাইয়া প্লিজ এক মিনিট, আমরা আবারো সুন্দর করে আপুকে নিয়ে এন্ট্রি নিয়।।
জায়িন ইসরাতকে কোলে রেখে ঘাড় বাঁকিয়ে, স্পষ্ট, রগরগে কন্ঠে বলল,”কোনো প্রয়োজন নেই।
জায়িন আবারো হাঁটা ধরতেই দরজার ওপাশ থেকে হেলাল সাহেবের গলা ভেসে আসলো। তিনি হাপিয়ে ওঠা কণ্ঠে গলা ফাটিয়ে জিজ্ঞেস করছেন,”ইসরাতকে পাওয়া গিয়েছে?
ইসরাত সামনের দিকে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকাল। আরশকে দরজার সামনে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাফসাফ করে উঠল। জায়িনের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে বলে ওঠল,”প্লিজ ছেড়ে দিন, নাহলে সবার সামনে লজ্জা পেতে হবে।

জায়িন ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। মেনে নিল ইসরাতের কথা তার পানে চেয়ে। ক্রোধপূর্ণ কন্ঠে বলল,”এখন ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু রাতে কোনো ছাড়াছাড়ি হবে না।
বলেই জায়িন ইসরাতকে মেঝেতে নামিয়ে দিল। ধুপধাপ পায়ে বের হয়ে চলে গেল বাহিরে। জায়িন চলে যেতেই নাজমিন বেগম, রুহিনী বেগম এসে প্রবেশ করলেন ভেতরে। নাজমিন বেগম নিজে খেঁকিয়ে উঠে বললেন,”বিয়ের দিনও তোমাদের এসব মজা করতে হবে? আজ বাড়ি চলো, জুতো দিয়ে পিটিয়ে যদি পিঠের ছাল তিনজনের না তুলি তাহলে আমার নাম নাজমিন বেগম নয়।
নুসরাত ভুল সময়ে মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে ফেলল,
“সত্যি?

নাজমিন বেগম নুসরাতের দিকে তেড়ে আসলেন। চিৎকার চেপে নিয়ে হিসহিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” দেখবি তুই?
আরশ তখন পেছন থেকে এসে টেনে ধরল নাজমিন বেগমকে। মাথা গরম হয়ে থাকা নাজমিন বেগমকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল আরশ। রুহিনী বেগম সবাই চলে যেতেই এসে পায়ের হাই হিল এর শক্ত খোঁড়া দিয়ে নুসরাত আর ইরহামের পিঠে দুটো বসালেন। কটমটিয়ে উঠে ভৎসনা করলেন,”বেবাকুফের দল।,বাড়িতে যাওয়ার পর আজ হবে তোমাদের।
চোখ রাঙিয়ে দু-জনকে দেখে রুহিনী বেগম বেরিয়ে গেলেন। নুসরাত শ্বাস ফেলতে যাবে আবারো দরজা খুলে কেউ একজন ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরের শ্বাস ভেতরে চেপে যেতেই আহানকে কেউ ধাক্কা মেরে ভেতরে প্রায় ফেলে দিয়ে গেল। নুসরাত ভ্রু উচাতেই আহান ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে বলল,”আম্মু আমায় উনার খাটাশ জুতো দিয়ে পিটিয়েছে সবার সামনে।

নুসরাত ঠোঁট চোখা করে এগিয়ে গেল। তার নিজেরও জুতোর বারি খেয়ে পিঠে জ্বালা হচ্ছে৷ আহানকে নিজের বাহুডোরে আগলে নিতে নিতে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করল,”ওলে আমার বাবুটা, ওলে লে..!
দু-মিনিট পর তাদের দুঃখের অন্তিম হলো। আহান নিজের কাপড় চেঞ্জ করার জন্য ওয়াশরুমে চলে যেতেই ইসরাত ধীরে সুস্থে জিজ্ঞেস করল,”সেম কাপড় কোথায় পেলি তুই?
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ইসরাত প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে দু-নমুনার দিকে চেয়ে রইল।
কিছুক্ষণ আগের কথা…..

সে তখন ব্রাইড এন্ট্রির এর জন্য তৈরি হচ্ছিল হঠাৎ আগমন ঘটে নুসরাত, আহান, ইরহামের। আহানের গায়ে তখন সেম তার কাপড়ের মতো কাপড়। অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াতেই নুসরাত হইচই বাঁধিয়ে দিল। ইসরাতকে বাহবা দিয়ে বলল,”তোকে বলার আগেই দেখি তুই দাঁড়িয়ে পড়েছিস।
ইসরাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেনে এনে দাঁড় করাল আহানের সান্নিধ্যে। ইসরাতকে মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নিজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলাল দু-জনের উপর নিচ। ইরহামের পানে নিজের নেত্র নিবিষ্ট করে ঠোঁট তর্জনী আঙুল স্থির করল। মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে বলে ওঠল,”উচ্চতা ঠিকই আছে দু-জনের। দেখতেও একই রকম ফর্সা। আহান সামান্য একটু, স্যরি টু সে কিন্তু একটু বেশিই মটু আর ইসরাত এভারেইজ।
ইরহাম নিজেও সহমত পোষণ করে ইসরাতের উদ্দেশ্যে বলল,”আপু তোমার হাত সামনে নিয়ে আসো।
মেয়েলি হাত দুটো কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সামনে চলে আসলো। ইরহাম আহানকে বলতেই সে নিজেও হাত এগিয়ে আনলো দু-জনের নেত্রের সামনে। নুসরাত দুঃখি সুরে বলে ওঠল,”এই আহাইন্নার তো হাতের আঙুল থেকে শুরু করে নখ পর্যন্ত ইসরাতের মতো। এরা ভাই বোন না হয়ে আমি আর ও বোন-বোন হলাম কেন?

ততক্ষণে আহানের মাথায় নকল চুল লাগিয়ে মাথায় বড়সড় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা হয়ে গিয়েছে। সৌরভি আর মমোর গলার আওয়াজ বাহির হতে পেতেই নুসরাত ইসরাতকে ওয়াশরুমের ভেতর ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। ওদের প্রবেশ করতে দেখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ওদের সামনে নুসরাত ইরহাম দাঁত কেলিয়ে হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু দু-জনের একজনের কাছে লাগল না স্বাভাবিক হাসি। সন্দেহ জনক কিছু আশেপাশে না দেখে পেছনে গিয়ে চেপে ধরল তারা কনে রুপী আহানকে। নুসরাত আহানের হাত চেপে ধরে হাঁটা ধরল। তার নিজের কাছেই ঠেকল তার হাতের থেকে আহানের হাত মোলায়েম। ভালোই হয়েছে কেউ আহানকে সন্দেহ করবে না। কিন্তু নুসরাত সবাইকে বোকা বানাতে পারলেও জায়িনকে বোকা বানাতে পারল না। সে প্রথম থেকেই সন্দেহ করতে লাগল, শেষ মুহুর্তে একবার কবুল বলেই এসে চেপে ধরল আহানকে।

আহান তো ভয়ে প্রথমে ওখানে যেতেই চাইছিল না কিন্তু নুসরাতের ভরসায় সে ওখানে গিয়েছে। সবার চোখে ধুলো দিয়ে ইরহাম মাইকের লাইন টেনে এনেছিল রেস্ট রুমে। যখন কবুল বলার সময় আসবে তখন যেন ইসরাতই মাইকে কবুল বলে। আহানের হাতে এমনি লাইন বিশিষ্ট মাইক্রোফোন তারা ধরিয়ে দিয়েছিল যাতে কোনো সন্দেহ না হয়। আর সন্দেহ হবে কেন? গত পনেরোদিন যাবত এই প্ল্যান করেছে তারা দু-জন মিলে। শেষ মুহুর্তে মেয়ে হিসেবে এড করেছে আহানকে। আর ইসরাতকে এসব কান্ড ঘটানোর আগেই মাত্র জানিয়েছে। ইসরাত অনেকবার না করতে গিয়ে থেমে গিয়েছে কারণ এই দু-জনের প্রতি সে অনেক দূর্বল। মার্বেলের মতো নিষ্পাপ দুটো চোখ দিয়ে তাকে যে এরা ম্যানোপুলেট করেছে তা বেচারি বুঝলই না। কোনোভাবে প্ল্যান ভেস্তে গেলে তারা বিপরীত প্ল্যান এ, বি, চি, ডি, রেডি রেখেছিল, শুধুমাত্র জায়িনের জন্য পুরো প্ল্যান বিগড়ে গেল। তবুও যতটুকু মজা পেয়েছে অতটুকুই অনেক বেশি। কিন্তু এবার যা পিঠে পড়বে তাও দারুণ মজার হবে।

ইসরাত কবুল বলার পর মাইক অফ করা হয়নি তাই বাহিরে কী হচ্ছে তা সব ধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছে এই রুমে। আতঙ্কিত চোখ-মুখ নিয়ে ওদের পানে ফিরে চাইতেই দুটো তার কানে হেডফোন লাগিয়ে দিল। বলল,’”নো টেনশন, জাস্ট চিল ব্রো..!
ইসরাত কিছু বলতে নিবে ইরহাম তার কোমর টেনে ধরে নিজের সাথে হেলেদুলে পা মিলাতে বাধ্য করল। এমনকি নুসরাত ইরহামের কানে হাই ভলিউম ব্যবহার করে গান বাজিয়ে দিল। কানের কাছে বাহিরের হইচইপূর্ণ পরিবেশ আঘাত হানতে পারল না। নুসরাত নিজেও কানে হেডফোন লাগিয়ে রেপারদের মত মাথা নিচের দিকে নামিয়ে, কোমর দুলিয়ে, নাচতে ব্যস্ত হলো।

ইসরাতের গভীর চিন্তাকরণে ব্যাঘাত ঘটল ইরহাম আর নুসরাতের হাসিতে। দু-জনে হাইফাইভ করল। হাতের তালুর ঘর্ষণে শব্দ হলো। তা রুমের ভেতর প্রতিধ্বনি হয়ে আবারো ফিরে আসলো। নুসরাত বলল,“অনেক কষ্ট জোগাড় করেছি। পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, কিন্তু প্ল্যান তো সফল হয়েছে ওইটাই মেইন কথা।
ইসরাত না চাইতেও সামান্য হাসল। আবারো দরজায় কড়াঘাতে তাদের কান সজাগ হলো। অক্ষিকোটর ঘুরিয়ে পেছন ঘাড় বাঁকাতেই সৌরভি আর মমো ফুসিয়ে ফুসিয়ে এসে প্রবেশ করল। মমো নিজের দু-হাতের লম্বা লম্বা নখগুলো উঁচু করে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ইরহাম আর নুসরাতের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে চিৎকার করল,”আজ ও তোদের খবিশিগিরি করতে হবে। বেয়াকুফ..!

ইরহাম মমোর কথায় কর্ণপাত করল না। তার দু-নয়ন তো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সামনের সৌন্দর্য্যে। পেস্টেল গ্রিন কালার শাড়ি পরিহিত সৌরভির পানে। কপালে ছোটোখাটো সাধারন একটা টিকলি। হাতে ব্রেসলেট, তা ও আবার সৈয়দ চয়েসের মোস্ট এক্সপেন্সিভ। হয়তো নুসরাত দিয়েছে। এটা মনে হতেই আনমনে হেসে উঠল ইরহাম। নুসরাতের মতো কিপ্টামি করা মেয়েও সৌরভিকে এটা দিয়েছে ভাবতে গেলেই ইরহামের কী রকম একটা অনুভূতি হয়। শুভ্র মুখে কৃত্রিম মেকআপ এর ছড়াছড়ি। টানা টানা চোখদুটো আজ আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে৷ কারণ কী! সৌরভি আজ চোখে আইল্যাশ লাগিয়েছে। ইরহাম আরেকটু পরখ করল। মেয়েটা কাজল দিয়েছে চোখে। শুভ্র বর্ণের মুখে, চোখে পরিহিত কাজলটা যেন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ইরহাম কখনো নুসরাত বা ইসরাতকে কাজল দিতে দেখেনি। সে দেখল মেয়েটাকে, আর শুধুই দেখল। কারণ কী সে নিজেও জানে না..! এটা শুধু জানে ভালো লাগে দেখতে মেয়েটাকে তার। পরে এই ভালোলাগা কতদূর গড়াবে তা সে জানে না, কিন্তু এখন শুধু মেয়েটার প্রতি ভালোলাগা কাজ করে।

নুসরাত গলা খাঁকারি দিতেই ইরহাম চমকে উঠল। ভ্রু উচিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে যাবে নুসরাত বলল,”ইসরাতের ওড়না..!
বাকিটুকু আর বলতে হলো না কারণ ইরহাম বুঝে নিল। এগিয়ে গিয়ে তা তুলে নিল একপাশ থেকে। মমো নিজেও ইরহামের সামনে এসে দৈর্ঘ্যে বিশ ফিট লম্বা ওড়নাটাকে মুঠো বন্ধি করে নিল। অন্যপাশ থেকে আহান আর সৌরভি তুলে নিল নিজেদের হাতের তালুতে। এন্ট্রেন্স এর দরজা শব্দ করে খুলে যেতেই আবারো আলো নিভে গেল। পাতলা ওড়নার আবরণে ঢাকা স্নিগ্ধ মুখখানা সামান্য রশ্নির আলোয় চকচক করে উঠল। ফর্সা গায়ে অফ হোয়াইট কালার কাপড়ে আইভরি কালার শ্যাম্পেইন এর কাজ, স্কিন টোন অনুযায়ী মুখে খুবই সামান্য মেকআপে তাকে রুপসী করে তোলেছে। ইসরাত ধীর পায়ে যত এগিয়ে গেল তত তার চারিদিক হয়ে বাপ চাচারা এসে আবার প্রথম বারের মতো ঘিরে ধরল। তাদের বাড়ির একটা রীতি আছে। এটা তাদের দাদার নিজের তৈরি। বাড়ির কোনো মেয়ের বিয়ে হলে সকল পুরুষ এসে চারদিক হতে তার পাশে দাঁড়াবে যেন বরপক্ষ বুঝতে পারে তাদের মেয়ে কোনো অবলা, লাচার নয়, তাদের মেয়ে শক্তিশালী। মাথার উপর দিয়ে সাজানো ভিন্ন ভিন্ন আলোর উপর দিয়ে শব্দ করে ড্রোন উড়ছে৷ মমোর হাতে ওড়নার দায়বার ছেড়ে দিয়ে ইরহাম, আহান, চলে গেল সামনে। আরশ সহ বাড়ির সকল পুরুষ দাঁড়াল ইসরাতের পাশে। কালো পাঞ্জাবি আর শার্টের ভাঁজে মেয়েলি অফ হোয়াইট কালার পরিহিত লেহেঙ্গাটা জ্বলমল করে উঠল। ক্যামেরা ম্যান নিজের ভঙ্গিতে সবার সামনে দাঁড়িয়ে, ক্যামেরার লেন্সে নিজের এক চোখ স্থির রেখে নুসরাতকে বলল,”আপনি ও এসে দাঁড়িয়ে যান আপু।

নুসরাত কোনো শব্দ ছাড়াই লেহেঙ্গার পেছনের অংশ ছেড়ে দিয়ে সামনে চলে আসলো। আরশের পাশে দাঁড়াতেই সে শোহেব সাহেবের কাছ হতে নিজের জায়গা থেকে সরে এসে নুসরাতকে বুঝিয়ে দিল ওখানে যেতে, তখনো সে একদম নীরব। কালবৈশাখী ঝড় আসার আগে যেমন পরিবেশ বাতাসের ঠান্ডবে প্রথমে নিস্তব্ধ হয় কিছু মিনিটের জন্য তেমনি এই মুহুর্তে সে হয়ে আছে। মুখের ভাবভঙ্গি শক্ত, ক্লিনসেভ ধারালো চোয়ালে অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে সামান্য দাড়ির। হয়তো কয়েকদিন যাবত ছাটাই করেনি তাই এমন অবস্থা..! নুসরাত আনমনে স্বীকার করল ভালোই লাগছে বলে। ক্যামেরা ম্যান যখন বলল,ফোকাস করুন এদিকে তখন ধ্যান ভাঙল৷ ক্ষীণ হাসি রেখে সামনে ফিরে চাইতেই অনুভব হলো একটা হাত তার পিঠ স্পর্শ করছে। পরপর তা টেনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে নিজের বুকের কাছে। পুরুষালি বুকের কাছে মাথা ঠেকতেই নিজের কোমরে একহাতের অস্তিত্ব বুঝল। ক্যামেরা ম্যান আরশের পানে চেয়ে সামান্য চোখ টিপে বলে ওঠল,”পারফেক্ট শট স্যার..!

এরপরের সময়গুলো কেটে গেল হুরহুরিয়ে। নুসরাত বোনের হাত চেপে ধরে তা তুলে দিল সামনে সঠান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জায়িনের সৌষ্ঠব হাতে। জায়িন মেয়েলি হাতখানা নিজের খড়খড়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে বসাল ফুলের ওপারের সোফায়। মৌলভী সাহেব তখনো খাতা হাতে স্তব্ধ বসে আছেন। অদ্ভুত এক বিয়েতে এসেছেন ভদ্রলোক যেখানে ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে বসিয়ে দিয়েছে এরা। জায়িন নিজেও গিয়ে সামনের সোফায় জায়গা দখল করে নিল। মৌলভী সাহেব আবার মাইক হাতে নিয়ে জোরে জোরে বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন, ততক্ষণে নিস্তব্ধ পুরো কনভেনশন হল। শোনা গেল শুধু মৌলভী সাহবের গলার মিষ্টি স্বর,”সৈয়দ হেলাল আহমেদ এর প্রথম পুত্র, সৈয়দ জায়িন হেলালকে সাঁইত্রিশ লক্ষ দেনমোহর দার্য করিয়া, কোনোপ্রকার চাপের সম্মুখীন না হয়ে এই বিয়েতে রাজী থাকলে বলো মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।

ইসরাত তখন যতোটা ফটাফট কবুল বলতে পারল, এখানে বসে ততোটা তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করতে পারল না শব্দগুলা। ওড়নার আড়ালে ঢাকা মুখটায় হাজারো অস্বস্তির সঞ্চার হলো, আশেপাশের মানুষের জন্য। এত মানুষের ভীড়ে কবুল বলতে তখনোর মতো নিরুদ্বেগ থাকতে পারল না। ইসরাতের অস্বাভাবিক, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে মমো তার হাত দিয়ে চেপে ধরল বোনের বরফ শীতল হাতখানা । তবুও না চাইতে ইসরাতের চোখের কোণে পানি জমা হলো, বুকে তীক্ষ্ণ ব্যথার উদ্বেগ হলো। চোখের কোণ বেয়ে ঝড়ে পড়া এক ফোটা জল আঙুলের সাহায্যে মুছে নিতেই কানে ভেসে আসলো জায়িনের কন্ঠ। সেই কন্ঠে হাজারো আকুতি মিনতি। রাশভারী পুরিষালি পুরু কন্ঠে জায়িন বলে ওঠল,”আপনি টেনশন করবেন না, ঘরের সকল কাজ আমি করে দিব। আপনার পা টিপে দেওয়া থেকে শুরু করে কাপড় ধোঁয়া পর্যন্ত আমি করব, তবুও দয়া করে তাড়াতাড়ি কবুল বলুন ইসরাত।
জায়িনের কথা শুনে একটু দূরে দাঁড়ানো নুসরাত, ইরহাম, আহান খিটখিট করে হেসে উঠল। পারলে একজন আরেকজনের উপর গড়াগড়ি খায়। ইসরাত ভেতরে নিজের অধম হাসি চেপে রেখে হাতের মাইক মুখের সামনে তুলে ধরে বলে ওঠল,”আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
মৌলভী সাহেব আবার বললেন,

“এই বিয়েতে রাজী থাকলে বলো মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল!
ইসরাত একই সুরে আবারো আওড়াল,
“ আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
পরপর তিনবার কবুল বলা শেষে জায়িনের পালা আসলো। ইসরাত চোখের কোণে আবারো জমা হওয়া পানি হাত দিয়ে মুছে নিতেই উপলব্ধি হলো মাথায় পরম স্নেহের ভরসাযোগ্য হাতটা স্পর্শ করছে। মুখ উচিয়ে চাইতেই বাবা নামক লোকটা চোখ দিয়ে ভরসা দিলেন সাথে আছেন বলে। ইসরাত সামান্য হাসতেই মৌলভী সাহেবের গলা কানে ভেসে আসলো। তিনি বললেন,”সৈয়দ নাছির উদ্দিনের প্রথম মেয়ে সৈয়দা ইসরাত নাছিরকে নগদ সাঁইত্রিশ লক্ষ দেনমোহর দার্য করিয়া, কোনোপ্রকার চাপের সম্মুখীন না হয়ে এই বিয়েতে রাজী থাকলে বলো বাবা আলহামদুলিল্লাহ….

পরেরটুকু শেষ করার আগেই সে বিনা দ্বিধায় নিজের গম্ভীর পুরুষালি সুরে বলে ওঠল,”আলহামদুলিল্লাহ, কবুল, কবুল, কবুল।
মৌলভী সাহেব হাতের মাইকে বলে ওঠলেন,
“আমাদের বর বিয়ের জন্য মনে হচ্ছে একটু বেশিই অধৈর্য্য, উনাকে একবার বলতে বলা হলোই না কবুল বলার জন্য আর উনি তিন তিনবারই বলে ফেললেন।
মৌলভীর কথায় সবাই ঠোঁট টিপে হেসে উঠল। নাছির সাহেব রেজিস্ট্রি পেপার এগিয়ে দিতেই সেখানে জায়িন সিগনেচার করল তড়িৎ গতিতে। পরপর তা হস্তান্তর করা হলো ফুলের অপাশে বসে থাকা ইসরাতের নিকট। সে কাঁপা হাতে নিজের নাম লিখতেই উকিল নিজের হাতে রেজিস্ট্রি পেপার নিয়ে ঘোষণা করলেন,”আজ থেকে আইনত সম্পূর্ণভাবে সরকারের দৃষ্টিতে এই বিয়ে বৈধ্য।

উকিলের কথা শেষ হতেই জায়িন উঠে দাঁড়াল নিজের জায়গা থেকে, ধীর পা এগোলো সামনে বসে থাকা দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ে করে নেওয়া মেয়েটার কাছে। ফুলের পাতলা আবরণ দু-হাতে সরিয়ে দিয়ে সুঠাম দেহি শরীর নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সহধর্মিণী সম্মুখে। আলতো হাতে ইসরাতের বাহু চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে মুখের উপর ওড়না দ্বারা ঢাকা স্তর সরিয়ে দিল। দেখল লজ্জায় চোখদুটো নিচের দিকে স্থির করে রেখেছে মেয়েটা। জায়িন একহাতে পিঠ চেপে শক্ত করে নিজের বাহুডোরে প্রথমে আটকে নিল, জড়িয়ে ধরল আষ্টেপৃষ্টে। নিস্তব্ধ কাটল দুয়েক মিনিট, অতঃপর বাহুবন্ধনী হতে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের সামনে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ইসরাতের মুখে নিজের দৃষ্টি স্থাপন করল। তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের সাহায্যে থুতনি উপরের দিকে উচিয়ে কপালে চুমু খেল খুবই সূক্ষ্মভাবে। বাড়ির বড়রা ততক্ষণে বুফের দিকে চলে যেতে অগ্রসর হলেন, যাতে পর্যাপ্ত স্পেস মিলে তাদের। নুসরাত, ইরহাম, আহান তখনো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে জায়িনের দিকে। জায়িনকে তাদের দিকে ফিরে তাকাতেই নুসরাত তড়িঘড়ি করে হোস্টের মতো হাতে মাইক নিয়ে বলে ওঠল,”খাবার দেওয়া হয়েছে, আপনারা যে যার মতো বুফে হতে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করুন।

নুসরাতকে হোস্টের মতো মুখ বানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরহাম গলা খাঁকারি দিল। নুসরাতের দিকে জায়িনের স্থির আগ্রাসী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল নিজের দিকে। বলল,“আপুকে নিয়ে ওই টেবিলে চলুন ভাইয়া।
ইসরাত নিজের মুখের উপর দেওয়া বড় ঘোমটা প্রথমে সরিয়ে ফেলল। তা হস্তান্তর করল মমোর কাছে। মমো সুন্দর করে নিজের কাছে সামলে নিল ওড়নাটা। বলল,”সবাই যান আমি গাড়িতে এটা রেখে আসছি।
মমো চলে গেল বাহিরে হাতের বিশ মিটার লম্বা দৈর্ঘ্যে ওড়নাটা রাখতে। ইসরাত সামনে হাঁটা ধরতেই জায়িন তার লেহেঙ্গার পেছন নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। খাবার এড়িয়ায় যেতে যেতে যার যার সাথে দেখা হলো কুশল বিনিময় করল, ততক্ষণ পর্যন্ত তার লেহেঙ্গার দায়বার পুরোটা সামলালো জায়িন।

ইসরাত সামনে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে যেতেই জায়িন তার লেহেঙ্গা সুন্দর করে গুছিয়ে নিজেও চেয়ার টেনে বসল। ততক্ষণে সৌরভি, ইরহাম, আহান প্লেট সাজিয়ে এনে রাখল সবার সামনে। শাড়ি নিয়ে হাঁটতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে সৌরভির, সেটা কতক্ষণ যাবত লক্ষ করল ইরহাম। এবার টেবিলে খাবার রেখে ফিরে যেতে নিবে, শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে ইরহাম চেয়ার টেনে বের করল। কোমলতা মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠল,”তুমি বসো, আমি আর আহান আনতে পারব।

সৌরভি দ্বিধা নিয়ে না করতে যাবে ইরহাম তার পূর্বেই আদেশ দিয়ে বলে ওঠল,”বসো..! আমরা পারব!
ধমক মিশ্রিত কন্ঠ ইরহামের। সৌরভি আর কোনো দেনামোনা করল না। ইরহামের অস্বাভাবিক দৃষ্টি নিজের ওপর ঘূর্ণনমান দেখে বসাই শ্রেয় মনে হলো তার নিকট। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তো এই দৃষ্টির হাত থেকে সে মুক্তি পাবে। সৌরভি চেয়ারে বসতেই ইরহাম চেয়ারের হাতল হতে হাত সরিয়ে নিল। ইন করে পরিহিত শার্টের অন্য হাতের হাতা গুটিয়ে নিয়ে বুফের দিকে হাঁটা ধরল।

মৃন্ময় নিজের বাবা নিহাল মির্জা সাথে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। তাদের কানে পৌঁছায়নি এখনো খাবারে কথা।বিয়ে বাড়িতে এসে কনের জায়গায় নকল চুল পরিহিত ওই ছেলে রুপী মেয়েকে দেখে মৃন্ময় আর তার বাবা দু-জনেই স্তব্ধ, নির্বাক। হঠাৎ তাদের সম্মুখীন হলেন হেলাল সাহেব। প্রথমে তিনি খেয়াল করলেন না মৃন্ময়কে। পরম কাছের বন্ধু নিহাল মির্জাকে দেখে দু-হাতে জড়িয়ে নিলেন বুকের কাছে। এরপর খেয়াল হলো মৃন্ময়কে। ভ্রু কুটি করে কিৎকাল তিনি চেয়ে রইলেন পুলিশ অফিসারের দিকে৷ নিহালের পানে নেত্র নিবিষ্ট করতেই তিনি হ্যাঁ ভঙ্গিতে স্বীকারক্তি দিলেন মৃন্ময় তারই ছেলে। হেলাল সাহেব চশমার আড়ালে ঢাকা ছোট ছোট চোখে পরিলক্ষণ করলেন ছেলেটাকে। পরপর দু-হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন মৃন্ময়কে নিজের বুকের মধ্যে। বলে ওঠলেন,”এই জন্যেই বলি চেনা চেনা কেন মনে হয় এই ছেলেকে। গতকাল সকালে এই ছেলেকে দেখে তোমার কথা মনে হয়েছিল, পরে মনে হলো মনের ভুল। এমন মাথামোটা, গোবরঠাসা ছেলে আমার বন্ধুর পুত্র হতেই পারে না।

অপমানে মৃন্ময়ের মুখ থমথমে হয়ে গেল। নিহাল মির্জা বন্ধুর স্বভাব ভালোই জানেন। যে তার কাজে ঠ্যাং ঢোকায় তাকে দু-চোখে দেখতে পারেন না তিনি৷ আর এটা বুঝতে বাকি রইল না তার একমাত্র গুণোধর ছেলেকে বন্ধুর মোটেও পছন্দ হয়নি। বন্ধুর কথায় সামান্য হেসে নিলেন। নিজেও ভাবলেন এই সুযোগে তার ক্যাটক্যাট করা ছেলেকে একটু আকটু অপমান করা যায়। যে ছেলে তার একটা কথা মাটিতে ফেলতে দেয় না সে ছেলে আজ মুখে বুজে আছে, জবাব দিচ্ছে না,নীরবে হজম করে যাচ্ছে হেলালের কথা। তাই তিনিও সহমত পোষণ করে বললেন,”ঠিক ঠিক..!

হেলাল সাহেব এবার বন্ধুর পানে চাইলেন। বন্ধুর উৎসাহী মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে বললেন,”তুই তো আরো বড় গাধা, মৃন্ময়ের মাকে বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে যে প্রেম নিবেদন করেছিস তা বলেছিস ওকে..
নিজের ছেলের সামনে বন্ধুর পার্সোনাল অ্যাটাকে হাস্যরস মুখ একদম চুপসে গেল। মৃন্ময় বাবার মুখের পানে চেয়ে ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে জানতে চাইল, “আর কী কী কান্ড করেছেন বাবা?
হেলাল সাহেব গল্পের ঝুড়ি খুলে বসলেন। তার উৎসাহ দেখে কে! বন্ধুর সকল রহস্য ফাঁস করে দিতে গিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলেন। বললেন,”তোমার বাবার তো অনেকগুলো প্রেমিকা ছিল। তো, সে কী করেছ জানো, ওই প্রেমিকা গুলোকে কবিতা লিখে দিত চিঠির মাধ্যমে। আর তার সাপ্লাইয়ার হতাম আমি..!
মৃন্ময় নিজেও হিহি করে সৌজন্যতার ভঙ্গিতে দাঁত কেলাল। বাবার দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল,”তাই নাকি? আম্মু তো জানে ওসব, তাই না?

নিহাল মির্জা দু-পাশে মাথা নাড়ালেন না ভঙ্গিতে, আবারো হ্যাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। ছেলের মুখ বন্ধ করাতে কিছু বলতে যাবেন তার পূর্বেই আরেকটা বোমা ফাটালেন হেলাল সাহেব। বললেন,”আরে তোমার মা জানবে কী করে? আপা তো একটু বোকাসোকা টাইপ ছিলেন, তাই তোমার বাবা বিবাহের
পরেও দুটো প্রেমিকা পেলে রেখেছিল।
উত্তেজনায় উঠে বন্ধুকে সব বলে দিতে দেখে একহাতে বন্ধুর সুঠাম দেহি হাত চেপে ধরে দ্রুত পদক্ষেপে টেনে নিয়ে গেলেন নিহাল মির্জা। বাবা চলে যেতেই মৃন্ময় ঠোঁট টিপে হেসে উঠল। আশপাশে নজর বুলিয়ে নিজের হাসি সংযত করে নিবে তার পূর্বেই গলার আওয়াজ ভেসে আসলো নুসরাতের।
“আরে আপনি, বিনা দাওয়াতে চলে আসছেন?

মৃন্ময়ের মাথা ঝাঁঝিয়ে উঠল। একজন চলে যেতেই আরেকজনের আগমন। ভ্রু উচিয়ে কিছু বলতে নিবে, নুসরাত তার মুখে সূক্ষ্ম চোখ বুলিয়ে নিয়ে শুধাল,”আরে বাহ্ আপনি হাসতেও জানেন? আমি তো মনে করেছিলাম আপনি শক্ত চামড়ার জেদি একজন মানুষ, যে হাসতেও জানে না।
মৃন্ময় কপালে তীক্ষ্ণ পরিধির ভাঁজ ফেলে বলে ওঠল,
“আপনার থেকে সামান্য কম জেদি..!
নুসরাত স্বীকার করে নিল সে জেদি। বলে ওঠল,
“ আমি জেদি বলেই আমি নুসরাত নাছির, জেদি নাহলে অন্য কিছু হতাম।
মৃন্ময় বলে ওঠল,

“আপনাদের সবার মুখ কেঁচির মতো চলে..!
“শুকরিয়া। খাবার দেওয়া হয়েছে, যান খেয়ে ফেলুন।
মৃন্ময় কথা না বাড়িয়ে চলে যেতে নিল, নুসরাত ফির ডেকে উঠল। নাম ধরেই ডাকল,”এই যে মৃন্ময়, এদিকে…!
মৃন্ময় ঘাড় বাঁকিয়ে ফিরে চাইতেই নুসরাত হাসল। ডার্ক রেড কালার পরিহিত শার্টের দিকে ইশারা করে বলল,”আই হেট রেড, বাট ইউ্যের আউটফিট…

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৭ (২)

তর্জনী আঙুল আর বুড়ো আঙুল একত্রিত করে দেখাল গর্জিয়াস। মৃন্ময় চোখে মুখে অবাকতা ফুটিয়ে তুলে ঠাট্টা করে বলল,”মিসেস নুসরাত নাছির দেখছি প্রশংসা করতে জানেন!
নুসরাত নির্দ্বিধায় বলে ওঠল,
“আমি কখনো ভালোকে ভালো বলতে কার্পণ্য করিনা।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here