প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৮ (২)
জান্নাত নুসরাত
স্টেজের আশপাশ জুড়ে বসে আছে সৈয়দ বাড়ির লোকজন। ইসরাত আর জায়িন বসে আছে সজ্জিত সাদা ফুলের কারুকাজ করা আরামদায়ক সোফায়। তাদের সামনের টাইলসের কারুকাজ তোলা মেঝেতে আসন পেতে বসেছে নুসরাত, সৌরভি, আহান, মমো আর ইরহাম। গোলাকার স্থানের মাঝ বরাবর রাখা আছে ফুল দিয়ে সজ্জিত পানির গোল পাত্র। পাতিলের তৈরি গোলাপি জলের বাটিটায় ফুলের সমারহে টইটুম্বুর। ফ্রেশ ফুলের ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছে সুরসুর করে। চারিপাশ মো মো করছে অস্বৈর্গিক সেই সুগন্ধিতে। হাতে থাকা ফুলের পাপড়ি বাটিতে ছিটিয়ে দিল সবাই। সবার শেষে নুসরাত কোলে থাকা অবশিষ্ট কিছু ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিল পাত্রে। নিজের হাতের ছোট্ট পাথরের কারুকার্য করা ব্যাগ হতে সাদা পাথরের আংটি বের করে উচিয়ে সবাইকে দেখাল। এরপর তা পানিতে ছেড়ে দিল সবার সম্মুখে। মাহাদি আরশের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শুধাল,”এটা আবার কী রিচুয়্যাল?
আরশ নিজের নির্লিপ্ত মুখখানি ঘোরাল মাহাদির দিকে। ঝাঁঝিয়ে উঠে জানতে চাইল,”আমার মুখ দেখে তোর কাছে মনে হয় আমি জানি এটা কোন রিচুয়্যাল?
মাহাদি আরশের ঝাঁঝিয়ে উঠা দেখে ঠোঁট টিপে হাসল৷ জ্বালানোর জন্য আবারো তোষামোদ করে বলে ওঠল,”জেনে থাকলে বল না ভাই..!
আরশ কড়মড় করে দাঁতের পাটি চাপল। হিসহিসিয়ে বলে ওঠল,”আমি যদি জানতাম কী রিচুয়্যাল, তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে এসব দেখতাম না? গবেট একটা!
“তা তো ভালো করেই জানি!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
মাহাদি শেষের কথাটা মিনমিন করে বললেও তা স্পষ্ট শ্রবণ হলো আরশের। তবুও ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করে নিল, কিছু বললেই আবার এটার শুরু হবে প্যানপ্যান.! আর এই মুহুর্তে কানের কাছে এসব সহ্য করার মোটেও ধৈর্যশক্তি নেই। তাই পকেটে হাত পুরে টানটান হয়ে দাঁড়াল।
জায়িন কিৎকাল সামনে উৎসাহী মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পুরো পরিবারের মানুষের পানে একবার চেয়ে নিল। এক ভ্রু উচিয়ে শান্ত কন্ঠে জানতে চাইল,”এটা কী?
শব্দে মারাত্মক গম্ভীরতা। নিষ্প্রাণ বলয়ের আমন্ড কালার চোখের দিকে সরাসরি নিজের দৃষ্টি নিয়ে তাকাল নুসরাত। কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই হেলাল সাহেবের কন্ঠ ভেসে আসলো,”পানিতে থাকা আংটিটা তোমাদের মধ্যে যে আগে পাবে তার রাজত্ব চলবে সংসারে, তার কথায় হবে সব, তোমাদের পূর্ব পুরুষেরা এমন মনে করেন।
জায়িন নাকচ করতে নিবে চোখে ভাসল আরশ, মাহাদি, অনিকার উৎসাহী। নাকচ করার ইচ্ছেটা থাকলেও নিজের ভেতর গুটিয়ে নিল।
সৈয়দ পরিবারের মানুষের চাপাকলে পড়ে একপাশে মুখ চুপসে এসে দাঁড়িয়েছে মৃন্ময়। চোখ-মুখে দেখার প্রবণতা, কিন্তু মুখের ভাবটা এমন এসব জোর করে ধরে দেখানো হচ্ছে তাকে। আসলেই কী তাই.! উঁহু না, মানুষ জানলে হাসবে মৃন্ময় তুষার নাকি এই পাগল লোকদের ভীরে থাকতে আজ বেশ পছন্দ করছে। এরা যতই উল্টাপাল্টা কাজ করুক পারিবারিক বন্ধন অটুট কাঠামো দিয়ে তৈরি। বিয়েতে আসা আত্মীয়ের সাথে ব্যবহার কী অমায়িক! মৃন্ময় দেখে আর অবাক হয়, দূর থেকে দেখলে বোঝা যায় এদের দম্ভে পা মাটিতে পড়ছে না, কিন্তু কাছে আসলে সেই দম্ভকে মনে হয় ধোঁয়াশা, সবগুলো মানুষ নিজেদের মতো মিশুক, আর ভদ্র!
জায়িন নিজের মাতা লিপি বেগমের দিকে তাকাল, এরপর তাকাল মা সমান মেঝ মায়ের দিকে। দু-জনেই চোখের ইশারায় বলছেন শুরু করতে। আহান গলায় ঝোলানো ক্যামেরা চোখের সামনে চেপে ধরল। নুসরাত নড়েচড়ে বসে বলে ওঠল,”আমি শুরু করছি কাউন্ট। তিন গুনার পর দু-জনেই খোঁজে বের করবে ওটা।
নুসরাত নিজের কথা শেষ করে পাত্রে থাকা ঘোলাটে পানিগুলো নাড়িয়ে দিল চারিদিকে৷ একই সাথে গণনা শুরু করল,”ওয়ান, টু, এন্ড থ্রি…
ইসরাত আর জায়িন পানির ভেতর হাত রেখে খুঁজতে ব্যস্ত হলো সাদা পাথরের আংটিটা। ইসরাত চারিদিকে হাত দিয়ে খুঁজলেও জায়িন নির্বিকার ভাবে খুঁজছে। এমন ভাব না পেলেই বাঁচে। দু-দলে বিভক্ত হয়ে মা চাচিরা জায়িন ইসরাত বলে চিৎকার করছে। নুসরাত সবথেকে বেশি অবাক হলো যখন দেখল তার মা জায়িনের পক্ষে। প্রশ্ন জাগল মনে এটা তার মা নাকি শত্রু! নিজের মেয়ের পক্ষে না দাঁড়িয়ে মেয়ে জামাইয়ের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে।… নুসরাতের অবাকতা বাড়িয়ে দিতে হয়তো আরো একটা কান্ড চোখে পড়ল তার। এখানে বসা কারোর চোখে না পড়লেও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রকোপ থেকে বাঁচতে পারল না সেই দৃশ্য। পানিতে অবস্থান রত পুরুষালি হাতটা আলগোছে নিজের হাতে থাকা আংটি হস্তান্তর করছে মেয়েলি হাতের মুঠোয়। সবার চোখের অগোচর হলেও এই সামান্য বিষয়টা নুসরাতের দৃষ্টির অগোচর হলো না। কয়েক মুহুর্ত পার হতেই ইসরাত নিজের হাতের মুঠোয় আংটি চেপে ধরে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠল। হাস্যজ্বল মুখে চিৎকার করে উঠে বলল,”আমি পেয়ে গেছি, আমি পেয়ে গেছি!
জায়িন নিজেও ইসরাতের সাথে মাথা নাড়াল। নুসরাত আহানের দিকে তাকাতেই আহান ফিসফিসিয়ে আওড়াল,”আপুকে ভাইয়া নিজের হাত থেকে আংটিটা দিয়ে দিয়েছে, আমি আমার এই গুণাহগার চোখে দেখেছি।
নুসরাত নিজেও সহমত পোষণ করে বলল,
“আমিও দেখেছি, চেপে যা এখন।
নুসরাত আর আহানের কথার মধ্যে ভুতের মতো তাদের মাথার মাঝখান দিয়ে উদয় হলো ইরহামের মাথা। দু-জনের কানের কাছে মুখ রেখে বলে ওঠল,”ওদের লুকোচুরি খেলা আমিও দেখে নিয়েছি।
পরপর তিনজন একসাথে আওড়াল,
“আল্লাহ শকুনের দৃষ্টি দিয়েছেন, এই দৃষ্টি হতে কেন মানুষের জিনিস যে রেহাই পায় না আল্লাহ ভালো জানে..!
সবাই মিলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। নিজেদের শরীর ছেড়ে দিল একে অপরের উপর। অবশ শরীর নিয়ে বসে থেকে আলসী ভঙ্গিতে তিনজন তিনজনকে মিনমিন করে বলল,”কবে না জানি কার বাসর টাসর দেখে ফেলি এই চোখ দিয়ে, আল্লাহ..! আমাদের দৃষ্টিশক্তি এত ভালো হতে কে বলেছিল!
নুসরাতদের হাই হুতাশ দু-মিনিটের মাথায় থেমে গেল। কিছু একটা মনে হতেই উঠে তিনজন ভোঁ করে দৌড় দিল নিজেদের কাজে। সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল তাদের যাওয়ার পানে। দৃষ্টি যতক্ষণে ফিরিয়ে আনবে ততক্ষণে সবাই ফিরে আসলো হাতে ট্রে নিয়ে। সেই ট্রে এর উপর আছে বিভিন্ন রঙ বেরঙের পাইপ বিশিষ্ট গ্লাস। নুসরাত তা নিয়ে গিয়ে সরাসরি সামনে বসল জায়িনের। পাঁচটা কালো সানগ্লাস হাতে নিয়ে পিছু পিছু হাজির হলো ইরহাম আর আহান। একটা ইসরাতের চোখে, একটা নুসরাতকে, একটা আহানকে, একটা মমোকে আর একটা ইরহাম নিজে পরিধান করল। সাউন্ড সিস্টেমে হল ওয়েতে বাজা শীতল সুরে গানের সাথে গা দুলিয়ে নুসরাত ইরহাম একসাথে বলে ওঠল,”এখান থেকে আপনাকে একটা গ্লাস নিতে হবে, যদি গরুর দুধের গ্লাস পেয়ে যান তাহলে আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে না..
লিপি বেগম তেরছা সুরে পেছন থেকে জানতে চাইলেন,”আর না পেলে?
নাছির সাহেব সেই কথার বিপরীতে বাড়ির বাচ্চাদের হয়ে উত্তর দিলেন,”জায়িনকে পয়সা কড়ি খোয়াতে হবে।
নুসরাত নাছির সাহেবের কথার লেজ ধরে বলে ওঠল,
“আব্বার মতামতে পয়সা কড়ি আমাদের পকেটে ঢালতে হবে।
জায়িন ঠাট্টা করল নুসরাতকে। মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠল,” টাকা গাছে ধরে? বললেন আর ওমনি বের হয়ে আসলো?
নুসরাত হেসে দু-পাশে মাথা নাড়াল। নির্মিশেষ দৃষ্টি জায়িনের পানি নিবিষ্ট করে বলল,”গাছে নয় আপনার ওই ক্রেডিট কার্ডে ধরে।
“ওগুলো পরিশ্রমের ইনকাম আমার, ওদিকে চোখ কেন আপনার?
“ আমার তো সব দিকে চোখ, টাকা যেখানে আমরা সেখানে।
শেষের কথায় সুর মিলাল আহান, ইরহাম। মমো আর সৌরভি ভদ্র ভঙ্গিমায় বসে রইল, তাদের মুখে কুলুপ আঁটা। মানুষের ভেতর বসে অস্বস্তি বোধ করছে বেচারিরা। মাহাদির কাছে রীতিনীতি গুলো দারুণ লাগল। সে জায়িনকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠল,”ভাইয়া দেখো তোমার ভাগ্যে কী আসে? আমি দেখতে চাই তোমার কী টাকা খসানো পড়ে!
মৃন্ময় বুকে আড়াআড়ি হাত বেঁধে নীরবতা পালন করল। ইসরাত চোখে চশমা পরে এদিক সেদিক দৃষ্টি ঘোরাচ্ছে, কনে হয়েও ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বিয়েতে আসা সবাইকে অবলোকন করছে! নুসরাত ভ্রু উচিয়ে জানতে চাইল,”কোনটা নিবেন আপনি?
জায়িন নিজের বুদ্ধিদীপ্ত চোখগুলো দিয়ে দেখল চারটা গ্লাসকে। দুটো লাল রঙের আর দুটো কালো রঙের। সবগুলোর মুখ ঢাকা র্যাপিং পেপার দিয়ে। জায়িন সামনে থাকা লাল গ্লাসটার দিকে ইশারা করতেই নুসরাত সেটা তুলে ধরল তার সামনে। সেটা মুখে ঢুকিয়ে এক ছিপ খেতেই মুখের আকার, ভাব ভঙ্গি বিচ্ছিরি রকম হয়ে গেল। কপাল কুঞ্চন করে হজম করে নিতে নিতে শুধাল,”ভিনেগার কে বলেছে রাখতে?
নুসরাত খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল। নিমেষে চোখ দুটো আশাবাদী হয়ে উঠে টাকা পাওয়াএ আশায়। জ্বলজ্বল করতে থাকা দৃষ্টি জায়িনের পানে নিবিষ্ট করে বলল,”দেন এবার টাকা, কড়কড়ে পঞ্চাশ হাজার চাই!
জায়িন নিজের মুখ স্বাভাবিক করে নিয়ে বলে ওঠল,
“কী? পঞ্চাশ হাজার, অসম্ভব!
পরপর নুসরাতের আশায় দীপ্ত হওয়া চোখগুলোকে, আশাহীনতায় ধূলিসাৎ করতে বলে ওঠল,”এক টাকাও দিব না।
নুসরাত বলে ওঠল,
“এমন কথা ছিল না ভাইয়া, আপনি ভিনেগার খেয়েছেন তাই টাকা দিবেন আপনি!
জায়িন নুসরাতের শক্ত করে রাখা মুখের পানে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,” আমি কথা দেইনি আপনাকে টাকা দিব বলে। তাছাড়া টাকা না দিলে কী করবেন আপনি?
নুসরাত রাগে ফোঁস করে উঠল। নাকের ডগা হাতের তালু দিয়ে ঘষে মুছে নিয়ে বলে ওঠল,”দিবেন না আপনি টাকা?
জায়িন নুসরাতের মতো গলা উচিয়ে জেদি সুরে বলল,“জ্বি না! কী করবেন আপনি? আমার জুতো লুকোবেন?
নুসরাত জায়িনের দিকে বিস্মিত নজরে চাইল। পরমুহুর্তে ঠাট্টা করে হেসে উড়িয়ে দিল সেই বিস্ময়। শব্দ করে হেসে ফেলে বলল,”জুতো লুকোবো না, আপনার পুরো বউকেই লুকিয়ে ফেলব। শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, টাকা দিবেন না আপনি?
জায়িন নিজেও নুসরাতের মতো হিসহিসিয়ে বলে ওঠল,”আমিও শেষবারের মতো বলছি টাকা দিব না, কী করার করে নিন!
নুসরাত উঠে দাঁড়াল গা ঝাড়া দিয়ে। সাথে উঠে দাঁড়াল তার সাঙ্গ-পাঙ্গ দু-জন। সে কোমরে হাত দিয়ে ঝুঁকে আসলো সোফায় বসে থাকা জায়িনের দিকে। চোখের কালো সানগ্লাস নিচের দিকে নামিয়ে নাকের ডগায় এনে স্থির রাখল। হাত চশমার কাছে রেখে স্বঃস্থবির কন্ঠে বলল,”কী করি তাতো অবশ্যই দেখবেন! দেখবেন আর আঙুল চুষবেন, করার মতো কিছুই থাকবে না। যদি কিছু না করি নাম বদলে দিবেন আমার।
মাহাদি পেছন থেকে নুসরাতের কথার জের ধরে হুল্লোড় করে বলে ওঠল,”হ্যাঁ বদলে ছকিনা রাখা হবে আপনার নাম।
নুসরাত মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে মেনে নিল। চোখের সানগ্লাসটা ঠেলে অক্ষিপটে অন্তরগত করে বলে ওঠল,”সেটা সময় বলে দিবে, নিজেদের বউকে সামলে রাখবেন। না হয় দেখবেন হঠাৎ তেলাপোকা এসে ছু মেরে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে।
ঘড়ির কাটায় তখন রাত একটা ছুঁই ছুঁই। সারাদিনের ক্লান্তি হয়তো এসে সবাইকে চেপে ধরছে তাই কনভেনশন হলে উপস্থিত বয়স্ক লোকেরা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। তারা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে পড়লেও বসে নেই উড়চন্ডী সৈয়দ বাড়ির ছেলে মেয়েরা। একজন এদিক দিয়ে বাতাসের মতো উড়ে দৌড়াচ্ছে তো ওদিকে একজন। মানুষের সাথে ধাক্কা খাবে সেই চিন্তায় নেই, নিজ নিজ গতি অব্যাহত রেখে বাদুরের মতো দু-হাত মেলে দৌড়াচ্ছে। নিজাম শিকদার নিজের পরণে থাকা স্যুটের বোতাম খুলে বসলেন সজ্জিত সাদা মখমলের চেয়ারে। বসতেই পায়ের হাঁটুর ব্যথায় মুখ দিয়ে দুটো ব্যথাতুর শব্দ নিসৃত হলো। চোখ দুটো কুঞ্চন করে সামনে তাকাতেই ব্যথাতুর মুখটায় গোমড়তায় ভর করল। নিজের দুঃখে ভারাক্রান্ত মনটা বিষিয়ে উঠল সকলের খুশিতে।
কত করে বললেন তার গাধা নাতিকে পটিয়ে নেয় মেয়েটাকে, কিন্তু সে তো অটল, পটাবে না। আজ কুকিলা সুরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, আর তা দেখতেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নিজাম শিকদারের। হেলাল আর নাছিরের তোষামোদে এখানে এসেছেন তিনি, নাহলে সৌরভি বিয়েতে শুধু আসতো সে আসতো না। বাপ মরা ছেলেগুলোর কথা রাখতে নিজের দুঃখ একপাশে ফেলে এসেছেন এই বিয়েতে। মাথা ব্যথায় কপাল টনটন করে উঠল। কাঁপা হাত তুলে নিয়ে কপালে দু-বার ঘষলেন। কিছু একটা নেই নেই মনে হলো বুকের ভেতর। ঝুঁকে থেকে মাথায় চাপ দিতেই টনক নড়ল সৌরভিকে অনেকক্ষণ যাবত দেখছেন না। সৌরভির কথা মাথায় আসতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার হতে। চেটাইলসের কারুকার্য খচিত মেঝের সাথে চেয়ারের ঘর্ষণ লেগে ক্যাচক্যাচ করে শব্দের উৎপত্তি হলো। দু-পা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন কিছু একটা চোখে ভাসতেই।
দূরের জিনিস চোখে স্পষ্ট দেখতে না পাওয়ায় চশমা খুলে টিস্যুর সাহায্যে প্রথমে পরিস্কার করে নিলেন। চশমা দৃষ্টিপটে ধীরে ধীরে স্পর্শ হতেই গায়ে ধাক্কা লাগল নিজাম শিকদারের। অপ্রস্তুত থাকার ধরুন পেছনের এক ধাক্কায় হুমড়ি খেলেন সামনের দিকে। পড়তে পড়তে বাঁচায়, রাগে মস্তিষ্ক দপদপ করে উঠল। চোখের শিরা উপশিরা দিয়ে বয়ে গেল রঞ্জিত তরল। ক্ষোভে ফেটে পড়ে পিছু ফিরতেই রাগের সাথে এসে ভর করল বিরক্তি। নাক উচিয়ে খেঁকিয়ে উঠে শুধালেন,”সমস্যা কী আপনার? ধাক্কা দিলেন কেন গায়ে?
সুফি খাতুন ওসব কথা কানেই তুললেন না। নতুন সাদা শাড়ির সাথে মিলিয়ে পরা কালো রঙের ইয়া বড় সাইট ব্যাগের চেইন খুলে পান সুপারি বের করলেন। তা খিল্লি করে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে পরপর সন্দেহজনক চাহনি ইসরাত আর নিজাম শিকদারের পানে নিবিষ্ট করে জিজ্ঞেস করলেন,”চক্কর কী চলছে?
“চক্কর কী চলবে? এখানে চক্করের কী দেখলেন আপনি?
নিজাম শিকদারের খ্যাকখ্যাক করে ওঠা কথায় দমে গেলেন সামান্য সুফি খাতুন। বুঝলেন আজ আর এই লোকের সাথে কথা বলা সম্ভব হবে না, তাই নিজের পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে আশ্চর্যজনক একটা কাজ করে বসলেন। নতুন শাড়ির লম্বা আঁচল দিয়ে নিজাম শিকদারের গায়ে বারি মেরে নিয়ে গেলেন। নিজাম শিকদার বুড়ি মহিলার এমন কান্ডে নির্বাক, নিরুত্তাপ হলেন। অস্বাভাবিক মুখ চোখ বানিয়ে সুফি খাতুনের যাওয়ার পথে চেয়ে কানায় কানায় বিতৃষ্ণাপূর্ণ কন্ঠে আওড়ালেন,”বুড়ো বয়সে এই মহিলার ভীমরতি হয়েছে। যত্তসব ফাজিলের দল!
নিজাম শিকদার নিজের বিড়বিড় ঝাড়ি রাখলেন। স্মরণে সৌরভিকে খোঁজার কথা মনে পড়লে বিড়বিড় ঠোঁটের আগায় রেখে সামনে পা বাড়ালেন। দ্রুত পায়ে হলওয়ে পাড়ি দিয়ে বুফে তে প্রবেশ করতেই রিনরিনে মেয়েলি গলার স্বরের সালাম ভেসে আসলো। নিজাম শিকদারের কাছে ঠেকল এই তো আবারো তার কুকিলা সুরীর কন্ঠস্বর শ্রবণ হওয়ার তৈওফিক হয়েছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে হাসি মুখে পিছু ফিরতেই অন্য একটা মুখ দেখে দপ করে নিভে গেল বয়স্ক কুঁচকানো মুখের হাসিটা। কিছু বলতে নিবেন শালিন পোশাক পরিহিত, বিদেশি ধাঁচের মুখাবিশিষ্ট ফর্সা ধবধরে মেয়েটি বলে ওঠল,”দাদু আপনার কিছু প্রয়োজন?
নিজাম শিকদারের মুখে প্রজ্বোল হাসি ফুটে উঠল নিমেষেই। মনে পড়ল সৈয়দ বাড়ির একটা মেয়ের কথা, যে তাকে সম্মানের সহিত দাদু বলত, আর সবগুলো বিচ্চু বদমায়েশেরা তাকে বুড়ো বলে ডাকে। ওই নুসরাত নামক গুন্ডাটা তো তার সামনে বসে তাকে কখনো কখনো এই নিজাম বলে ডেকে উঠে। কোথা থেকে নুসরাতটা শুনেছে তার ছোটবেলার কাহিনি এরপর থেকে ওর এ ব্যবহার।
নিজাম শিকদারের মরুহুম বাবা তাকে ধরে চ্যালাকাঠ দিয়ে যৌবনকালে অনেক পিটিয়েছেন। যুতসই কারণ ও আছে অনেক। এজন্য নিজাম শিকদারের বাবার প্রেই কোনো রাগ, বা অভিমান নেই। যেদিন বাবা তাকে ধরে পিটাতেন সেদিন ড্রয়িং রুমে এসে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকতেন। সেই গায়ে হীম ধরানো কন্ঠে ডাকতেন, এই নিজাম শিকদার, এই বাচ্চাছেলে বলে। ওই নুসরাতটা ও তার সাথে এমন করে। সোফার উপর এসে বসবে ধুপ করে। তারপর তাকে ভেঙ্গিয়ে ভেঙ্গিয়ে উরুর উপর পা তুলবে। পা নাচিয়ে নাচিয়ে ডাকবে, এই নিজাম শিকদার, এই বুড়ো..! ছোটবেলার সেই কাহিনি এসে পুর্নারাবৃত্তি করছে এই মেয়ে বয়স্ককালে, আগে বাচ্চাছেলে ছিল আর এখন বুড়ো হয়ে গিয়েছে। বাপের অত্যাচার থেকে রেহাই পেলেও নুসরাত নামক ভূমিকম্পের হাত থেকে সে রক্ষা পাচ্ছেনা। আটার মতো লেগে আছে তার সাথে।
“দাদু, এই দাদু, শুনছেন আপনি?
অনিকার কয়েক ডাকে এতক্ষণের চিন্তাকরণে আঘাত পড়ল নিজাম শিকদারের। কেঁপে উঠে ফিরে চাইলেন মেয়েলি মুখটায়। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন,”কিছু কী বলবে দাদু?
অনিকার বাংলা পুরো পরিস্কার নয়। বাংলা কথা বললে আকস্মিক এসে যায় ফরাসি। সে ফরাসি এক্সেন্টে বাংলায় আবারো বলল,”আপনার কিছু লাগবে দাদু?
মনে করল বয়স বাড়ায় হয়তো কানে সমস্যা আছে তাই শুনেননি। কিন্তু বেচারি এটা জানতে পারল না নিজাম শিকদার অজানা এক গুম খেয়ালে ডুবে গিয়েছিলেন। অনিকার কথায় আবারো বাস্তব জগতে ফিরে এসে থমথমে চেহারায় অপরিচিত মেয়েটাকে সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করে বসলেন,”বিয়ে হয়ে গিয়েছে?
অনিকা আশি ঊর্ধ্বে বয়স্ক লোকের এমন কথায় ভ্রু কুঞ্চন করল। মনে করল মাথায় হয়তো কিছু সমস্যা আছে, তাই ভদ্র আচরণ করবে ভেবে নিল। বলল,” জ্বি না, এখনো না!
“কাউকে দেখেছেন তোমার জন্য?
অনিকা প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করা দেখে বিব্রত হলো। বিভ্রান্ত নজরে আশপাশ অবলোকন করে বলে ওঠল,”জ্বি হ্যাঁ!
“কথা এগিয়েছে?
নিজাম শিকদার প্রশ্নাতীত চোখে চেয়ে রইলেন। অনিকা সহজ চোখে চেয়ে থেকে দু-পাশে মাথা নাড়াল। নিজাম শিকদার লাফিয়ে উঠলেন প্রায়। এই তো আয়মানের জন্য পাত্রি পেয়ে গিয়েছেন এবার আর এটাকে মোটেও হাতছাড়া করবেন না তিনি। প্রয়োজন হলে গলায় দা চেপে ধরে আয়মানের সাথে বিয়ের পীড়িতে বসাবেন এই মেয়েকে। অনিকাকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে বগলদাবা করে নিলেন। অনিকা কিছু বলতে নিলে সাদা চুলের টাক মাথাটা দেখে আর কিছু বলতে পারল না। মায়া জন্মাল বয়স্ক কুঁচকে যাওয়া মুখটার প্রতি। নাকচ করতে গিয়ে দ্বিধাবোধ হলো। হাসিমুখটায় হাসির বাহার খেলে নিয়ে নিজাম শিকদারকে কিছু বলবে অনিকা বয়স্ক লোকটা তার কথা কেটে দিলেন। বলে ওঠলেন,”তোমার বাবা মা এসেছে?
অনিকা সরল চোখে তাকিয়ে বলল,
“এই একটু আগে এসেছেন উনারা।
“ তাহলে চলো উনাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দাও তো দাদু। শুভ কাজে দেরি কীসের?
অনিকা অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কীসের শুভ কাজ?
নিজাম শিকদার কানেই তুললেন না তার কথা। নিজের বয়স্ক নরম হয়ে আসা শরীরটার সকল শক্তি প্রয়োগ করে ফর্সা মেয়েটাকে টেনে নিয়ে চলে গেলেন সামনে। অনিকার কথার বিপরীতে ঝাড়ি মেরে বললেন,”তোমাকে এত না বুঝলেও চলবে। বাচ্চা মেয়ে বাচ্চার মতো থাকো।
জায়িন আর ইসরাতের অনেকক্ষণ যাবত কাপল পিক তোলা হলো। নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। যখন সৈয়দ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় আসলো তখন শোহেব সাহেব আর সোহেদ সাহেবের আর্জিতে পারিবারিক ফটো তোলার জন্য সকল সদস্য নিজেদের তৈরি করে নিলেন৷ বাড়ির মহিলারা নিজেদের পেস্টেল গ্রিন কালার শাড়ীর ভাঁজ ঠিক করে, আঁচল ঠিক করে নিলেন। এক এক নিজেদের জন্য জায়গা দখল করে নিলেন। জায়িন আর ইসরাত নিজেদের জন্য সজ্জিত সোফায় বসে রইল। হেলাল সাহেব আর লিপি বেগম জায়িন আর ইসরাত কে মাঝে রেখে দু-পাশে নিজেরা বসলেন। সোফার দু-হাতে বসল আহান আর ইরহাম। শোহেব সাহেব ঝর্ণা বেগম জায়িন ইসরাতের পেছনে দাঁড়ালেন। নাছির সাহেব উনার সহধর্মিণী নিজেদের জায়গা দখল করে নিলেন শোহেব সাহেবের নিকটস্থে। সোহেদ রুহিনী সোফার ডান পাশে স্থির হয়ে দাঁড়াতেই নুসরাত বাঁ-পাশে দাঁড়াল। সকলের জায়গা ঠিক হতেই ক্যামেরা ম্যান চোখের সামনে নিজের এইচ ডি ক্যামেরা চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল,”সবাই রেডি তো!
সমসুরে একই শব্দ ভেসে আসতেই, দেখা মিলল আরশের গম্ভীর চেহারার। ধীর পদক্ষেপে, গম্ভীর মুখে এদিকে আসছে সে। সকলে মিলে তাড়া দিতেই নির্বিঘ্নে এসে নিজের জন্য জায়গা দখল করে নিল নুসরাতের পাশে। ক্যামেরা ম্যান বলে ওঠল,”স্যার একটু ম্যামের সাথে ক্লোজ হোন।
আরশকে বলতে দেরি হলো তার গা লাগিয়ে দাঁড়াতে দেরি হলো না। এতক্ষণ যা গায়ে ঘষা লাগছিল এখন তো নুসরাত স্পষ্ট ওই লোকের কোষের চলাচল উপলব্ধি করতে পারছে। নিজের গা দূরে সরাতে নুসরাত সেটে গেল ইরহামের সাথে সামান্য, তবুও আরশের গায়ের স্পর্শ, এমনকি কড়া কুস্তুরির ঘ্রাণ সুরসুরিয়ে নাসারন্ধ্র বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরণে সেই সুগন্ধি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে শুরু হলো অঅনুভূতির জোয়ারে ভাসা হৃদয়ে বিচিত্র চলাচল, উত্তাল নদীর খৈই হারানো ডিঙ্গি নৌকার ন্যায়। চোখ নিচের দিকে নামাতেই,ভুলবশত দৃষ্টি উদরের দিকে যেতেই দেখল কালো কাপড়ের উপর ফর্সা হাতের দখল দারিত্ব। এই হাত কখন এখানে আসলো তা নুসরাত টেরও পায়নি। মেয়েলি শরীর ঝাঁকি দিয়ে কেঁপে উঠল, শ্বাস আটকে আসলো নিমেষে, অক্সিজেনের অভাব হতে দেখে নাক টেনে শ্বাস ভেতরে পুরে নিল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার বৃথা চেষ্টা প্রয়াস রেখে মাথা ঘুরিয়ে সটান হয়ে, একহাত পকেটে পুরে একপেশে ভঙ্গিতে টানটান দাঁড়ানো আরশকে উদর হতে হাত সরানো কথা বলতে নিবে তার পূর্বেই আলো জ্বলে উঠল সকলের সম্মুখে। শব্দের সাথে ক্যামেরা বন্দী হলো কয়েক যুগল কপোত-কপোতীর মিষ্টি ছবি।
বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ছন্দ থেমেছে বহক্ষণ আগে। রাতের নিস্তবধতা চিড়ে দূর হতে ভেসে আসছে হুতুম পেঁচার গুতগুত করে ডাক। জোনাকিপোকারা দলবেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে কনভেনসহন হলের বাহিরে। কৃত্রিম আলোর কারণে জোনাকি পোকার রঙ্গিন আলো ঢাকা পড়েনি, কিন্তু হঠাৎ করে সাদা রঙের এক গাড়ির ইঞ্চিনের শা শা শব্দে সেই রঙ্গিনতায় ঢাকা পড়ল। সকল জোনাকি পোকারা নিজেদের উড়ো পাখা উড়িয়ে চলে গেল আধারে। গাড়ির দরজা খুলে বের হলেন শাহেদ খান, ফ্রন্ট সিট হতে লাস্যময়ী এক নারী বের হলেন। দেখে ঠাওর করার উপায় নেই এই লাস্যময়ী শাহেদ খানের স্ত্রী রুমি খান। বয়সের তুলনায় দু-জনেই একটু বেশি সতেজ। কাতান শাড়ীর আঁচল গুটিয়ে রাখা কাঁধের কাছে। হাতা লম্বা ব্লাউজ গায়ে চড়িয়েছেন। শাড়ির ফাক গলে বুক পিঠ বের হওয়ার কোনো নাম নিশানা নেই। ভদ্র মহিলা ও ভদ্র লোককে দেখে বোঝার উপায় নেই দু-জনেই দু-সন্তানের বাবা মা।
আকস্মিক দ্রুত পায়ে দো-তলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা গেল সৈয়দ বাড়ির কর্তা সৈয়দ হেলালকে। পায়ের চলন দেখে বোঝার উপায় নেই মাটিতে পা ঠেকছে, এক পায়ে যেন উড়ে উড়ে আসছেন বন্ধুর সাথে কুশল বিনিময় করতে। পিছু পিছু দেখা গেল নিহাল মির্জাকে আসতে। ভুঁড়ি সামান্য বেশি হওয়ায় হেলাল সাহেবের মতো তড়িৎ গতিতে হাঁটতে পারেন না। তিন বন্ধুর মধ্যে নিহাল মির্জা একটু বেশিই অলস তার ধরুণ দু-বন্ধুর ভেতর তাকেই বয়স্ক বেশি ঠেকে। হেলাল সাহেব বিদেশ যাওয়ার পর থেকে খাবারের প্রতি সদা সতর্ক। যখনই বন্ধুদের সাথে কথা হতো ভিডিও কলে তখনই শাহেদ খান হেলাল সাহেব মিলে নিহাল মির্জার ভুঁড়ি নিয়ে খোঁচা দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না। হেলাল সাহেব বন্ধুকে আগেভাগে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করে নিলেন। হেসে শাহেদ খানের স্ত্রীর সাথে সালাম দেওয়া নেওয়াও করে নিলেন। কিন্তু তখনো নিহাল মির্জা এসে পৌঁছাতে পারেননি তাদের নিকট।
হেলাল সাহেব দেশে আসার দু-দিন পর শাহেদ খান দেশে এসেছেন ছেলে মেয়ে নিয়ে। দেশে আসার দু-দিন পর ছেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সরাসরি সিলেট চলে আসছে। এর এক মাস পর অনিকা ও সুরসুর করে ভাইয়ের লেজ ধরে এসে ঠেকছে সৈয়দ বাড়িতে। জায়িনের বিয়ে উপলক্ষে আজ সকালে এসেছেন শাহেদ খান মাহাদির দাদা বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট। সারারাত ড্রাইভিং করে আসায় এসেই ঘুম দিয়েছিলেন নিজের কেয়ার টেকারের দায়িত্বরত থাকা বাসায়। অত্যাধিক ক্লান্তি থাকায় ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ার ধরুন এখানে উপস্থিত হতে অল্প দেরি হয়েছে।
বন্ধুকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করার আগেই শাহেদ খান পেটে তর্জনী আঙুল দিয়ে সূক্ষ্ম গুতো দিয়েছেন। হেসে ওঠে জড়িয়ে ধরে উপহাস করলেন নিহাল মির্জার পেট নিয়ে। বন্ধুদের খোশগল্পের মধ্যেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এসে প্রবেশ করলেন হলওয়েতে সবাই। সবার আগে দেখা হলো শাহেদ খানের নুসরাতের সাথে। নুসরাত লোকটাকেই দেখে বুঝে নিল কে হতে পারে! মুখের অবোকাঠামো হুবহু অনিকার মতো। প্রফেশনাল ভঙ্গিতে নিমেষে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নিল। শাহেদ খান শ্যামলাটে মেয়েটাকে দেখে নাক উঁচুতে তুলতেই দেখলেন হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে মেয়েটা তার দিকে। কিন্তু আসলে তেমন কিছু হলো না, সে বাড়ানো হাত শাহেদ খানের দিকে না বাড়িয়ে নিয়ে গেল সরাসরি নিহাল মির্জার দিকে। কী এক অমায়িক ভঙ্গিতে ডেকে উঠল,”আঙ্কেল..!
হেলাল সাহেব তড়াক করে নুসরাতের পানে দৃষ্টি নিবিষ্ট করলেন। গোল গোল চাহনি নিক্ষেপ করলেন অমায়িক হাসা মেয়েটার দিকে। কত্ত বড় ধড়িবাজ মেয়ে, জীবনে তার দিকে তাকিয়ে হেসেছে! উঁহু আর আজ কী দাঁত কেলানো হচ্ছে আঙ্কেল বলে। হেলাল সাহেবকে এরকম ঘোলাটে চোখ মুখে চেয়ে থাকতে দেখে নিহাল মির্জার উদ্দেশ্যে বলল,”আঙ্কেল কেমন আছেন? আমি নুসরাত নাছির, মৃন্ময় তুষারের গারদ হতে চব্বিশ ঘন্টা আগে ফিরত কয়েদি। আপনি নিশ্চয়ই মৃন্ময় তুষারের বাবা?
নিহাল মির্জা খুশিতে গদগদ করে উঠলেন। সামনে থাকা দু-জনকে একদম না দেখা করে বলে ওঠলেন,”হ্যাঁ আমি মৃন্ময়ের বাবা, তুমি কীভাবে আমায় চিনলে? আগে তো কখনো দেখিনি তোমায় মা।
ভদ্রলোকের কথায় নুসরাত দাঁত বের করে হাসল। বলল,”দেখবেন কী করে, এই পৃথিবীতে আপনার আমার মতো ভালো লোকের বড্ড অভাব।
নিহাল মির্জা সহমত পোষণ করলেন। মেয়েটার কথায় যুক্তি আছে মনে মনে বললেন। তারপরও জানতে চাইলেন,”মৃন্ময়ের বাবা হিসেবে ধারণা করলে কীভাবে?
“আরে আঙ্কেল তুষার তো আপনার মতোই হ্যান্ডসাম হয়েছে, আপনার জোয়ান বয়সের রুপ তুষারের উপর প্রতিফলিত হয়েছে।
নুসরাত হেসে নিহাল মির্জার গায়ে ধাক্কা দিল আস্তে ধীরে৷ নুসরাতের অমায়িকতা আর প্রশংসায় নিহাল মির্জা নামের পঞ্চাশ ঊর্ধ্বে লোকটা খুশিতে ডগমগিয়ে উঠলেন। এতক্ষণের খোঁচানোর প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়ে ওঠে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে শুধালেন,”দেখো তো মা আমাদের ভেতর সবথেকে বেশি কে হ্যান্ডসাম?
নুসরাত আর নিহাল মির্জার কান্ড মুখ বুজে চুপচাপ সহ্য করতে লাগলেন হেলাল সাহেব আর শাহেদ খান। কপালে দুটো ভাঁজও পড়েছে তাদের। এর মধ্যে নুসরাতের কথা কানে আসলো,”আরে আঙ্কেল আপনার উনাদের সাথে যায়, উনারা হলেন ঝড়ে পড়া বুড়ো পাতা আর আপনি হলেন বসন্তের সজীব জন্ম নেওয়া পাতা।
নুসরাত শেষের কথাটা নিহাল মির্জার সাথে লেগে গিয়ে ফিসফিস করে বলল। ঠোঁটের কোণ জুড়ে দৃষ্টতার হাসি। হেলাল সাহেব তা অক্ষিপটে আলগোছে জুড়ে নিলেন। বুঝলেন এই মেয়েটা তাদের জ্বালানোর জন্য এসেছে এখানে। নিহাল মির্জা ডগমগিয়ে উঠলেন খুশিতে। চোখে সীমাবিহীন হাসির স্থায়িত্ব রেখে শুধালেন,”মা বিয়ে হয়ে গিয়েছে তোমার?
নুসরাত হু হু করে হেসে উঠল। হেলাল সাহেব আর শাহেদ খান হাসির কিছু খুঁজেই পেলেন না। নুসরাতের সাথে মিলিয়ে নিহাল মির্জাও গদগদ করে হাসলেন। প্রশ্নাতীত চোখে চেয়ে থাকলেন উত্তরের আশায়। নুসরাত ধীরে সুঃস্থীর হয়ে উত্তর দিল,”জ্বি না একদম সিঙ্গেল। আপনি চাইলে বায়োডাটা দিয়ে দিতে পারি! দিব?
“তোমার সাথেই কী বায়োডাটা থাকে আম্মা?
নিহাল মির্জার অবাক কন্ঠে করা প্রশ্নে নুসরাত হাসল ঈষৎ। বলে ওঠল,”জ্বি, সিভি সাথেই থাকে কখন না জানি প্রয়োজন পড়ে যায়। হি হি হা হা..!
নুসরাত নিজের মোবাইলের কভার খুলে বের করে দিল সিভি। নিহাল মির্জা, শাহেদ খান, এমনকি হেলাল সাহেব তিনজন একপ্রকার টানাটানি লাগিয়ে দিলেন সিভি দেখার জন্য। নুসরাত তিনজনকে শীতিল করতে বলে ওঠল,”আমার কাছে আরেকটা আছে সিভি।
হেলাল সাহেব নিহাল মির্জার হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সিভি দিয়ে দিলেন। অধীর আগ্রহে নিয়ে জানতে চাইলেন নুসরাতের কাছে,”সিভি দিয়ে কী করিস তুই?
“অফিসিয়াল কিছু কাজ গ্যাচাং ফু করি।
শাহেদ খান নিজের আটা মুখ খুলে জানতে চাইলেন,
“তা কি কাজ করো শুনি?
নুসরাত হে হে করে হেসে উঠল। বলল,
“ ওই তো ফেইক বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রোমার্স ছড়াই।
হেলাল সাহেব অক্ষিপট দুটো বড় বড় করে তাকালেন। কিছু বলতে যাবেন নিহাল মির্জা বললেন,”আমারও যৌবন কালে অনেক গার্লফ্রেন্ড ছিল। তা মা বলো তো শুধু কী কাজের সূত্রে ওদের বি এফ বানাও তুমি?
“ধূরো, আঙ্কেল আপনি আমায় অবিশ্বাস করছেন। শুধু কাজের জন্য, যদি সত্যি হতো তাহলে ওই বাআয়া কথা আমি বলতাম!
নিহাল মির্জা মেয়েটার ন্যায়পরায়ণতা দেখে আবেগে আপ্লূত হয়ে গেলেন। একইসাথে মুগ্ধ হলেন, এই খারাপ যুগে এসেও মেয়েটা কী সুন্দর সত্যি কথা বলে!
হেলাল সাহেব উঁকি ঝুঁকি মেরে সিভিখানা দেখে কিছুই বুঝলেন না। হাতে লিখা মুরগীর বাচ্চার পায়ের মতো ছোট ছোট। লিখার পানে চেয়ে থেকে, ভ্রু উচিয়ে শুধালেন,“এই লিখা কার?
নুসরাত দম্ভ ভরা কন্ঠে বলে ওঠল,
“আমার!
তার দম্ভ চুর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে হেলাল সাহেব উপহাস করে বলে ওঠেন,” লিখা দেখে মনে হচ্ছে খাতার উপর তেলাপোকা পটি করে দিয়েছে।
নুসরাত ভেঙে গেল না। দেমাগ দেখিয়ে বলে ওঠল,
“ওই পটিটুকু আমি তো লিখেছি, আপনি তো তা ও লিখতে পারেননি! হুহ…
নুসরাতের অবজ্ঞাতে থেমে গেলেন না হেলাল সাহেব। নতুন উদ্যোমী হয়ে, নুসরাতকে খোঁচাতে জানতে চাইলেন,”কী লিখা এখানে আছে?
নুসরাত তখনো নিজের পার্স, মোবাইলের উপর নিচ খুঁজছে আরেকটা সিভি। ব্যস্ত কন্ঠে বলে ওঠল,”আমার জীবন বৃত্তান্ত।
“একটু বল তো শুনি!
নুসরাত হেলাল সাহেবের তাচ্ছিল্যতায় ভীষণ বিরক্ত হলো। বিরক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে আঁখিপট তুলে ধরল উপরে। হিসহিস করে ওঠে বলল,”নাম, বয়স, কেজি, উচ্চতা, স্কুল, কলেজ, কয়টা এক্স, কয়টা প্রেম এসব..!
হেলাল সাহেব নির্লজ্জ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। জানতে চাইলেন,”নাম কী?
নুসরাত তেরছা কন্ঠে উত্তর দিল,
“সৈয়দ নুসরাত নাছির।
হেলাল সাহেব কপাল কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন,“বয়স?
“ঊনিশ বছর সাতমাস বাইশ দিন।
“কেজি?
“ আগে আটচল্লিশ ছিল এখন সাতচল্লিশ!
“উচ্চতা কত?
“ফাইভ ফিট ফাইভ পয়েন্ট ইলিভেন, সিক্স বলতে পারেন। জিরো পয়েন্ট ওয়ান এদিক সেদিক।
“গায়ের রঙ?
“ ব্রাউন!
“প্রেম কয়টা করেছিস?
“বেহিসাব।
“এক্স কয়টা?
“ একটা! তা ও আবার কমিটমেন্টের।
নিহাল মির্জা নুসরাতের সিভি দেখা শেষে তা ফিরিয়ে দিলেন নুসরাতের কাছে। এতক্ষণ যাবত চোখ সিভিতে থাকলেও কথা শুনছিলেন নুসরাত আর হেলাল সাহেবের। শেষের কথার জের ধরে জিজ্ঞেস করলেন,”প্রেম বেহিসাব করলে একটা কেন এক্স? আর কমিটমেন্ট কীসের?
নুসরাত গলা ঝেড়ে পরিস্কার করে নিল। বয়স্ক লোকগুলোকে নিজের কথা সুন্দর মতে বোঝানোর জন্য সময় নিয়ে বলে ওঠল,”আরে ওগুলো তো ফেইক বয়ফ্রেন্ড, এসব অন্য একদিন বলব, আজ মুড নেই। কমিটমেন্টের বিষয়টা বলি, আসলে আরশ ভাইয়ের অ্যাসিস্টেন্ট আমার এক বান্ধবীর কাজিন ছিল, ও নাকি আমাকে পছন্দ করে আমি সরাসরি না করে দিলাম প্রেম টেমে ঝড়াবো না, ও বলে বিষ খাবে। আমি বললাম বিষ খা, খেয়ে নিল, এরপর দু-দিন না এক সপ্তাহ ছিল হসপিটালে, বান্ধবীর মন রক্ষার্থে আর দেশের ভবিষ্যৎ অকর্মাকে বাৃচাতে ওই পাগলটার সাথে কমিটমেন্টে গেলাম যে আমার যখন ইচ্ছে হবে তখনই ব্রেক-আপ করতে হবে। ও মেনে নিল, তখনো তো আবেগের জোয়ারে ভাসছিল, যা বলেছি মেনে নিয়েছে। আল্লাহর কসম করে বলছি এইটারে পেছন ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করছি, পেছন ছাড়েনি, একদিন এসে ওইটা নিজেই আমাকে গাইয়া, ভুত, খ্যাত, এসব বলে ব্রেক-আপ করে দিল। বেচারা আমার ছিঁড়া ফাঁটা কাপড় পরা দেখে মনে করত আমি বস্তিতে থাকি, তাই আরকি বস্তির মেয়ে বলে ফেলেছিল। আমি নুসরাত নাছিরকে ও বলে বস্তির মেয়ে, রাগে গজগজ করে উঠে ঠাঁটিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলাম গালে কয়েকটা।
নিহাল মির্জা চোখের আকার বড় বড় করে বললেন,
“তারপর কী হলো?
“ তারপর আর কী, একদিন সে জেনে গেল আমি এই বাড়ির মেয়ে, তখন কুত্তা পানি না পেলে যেমন শুকনো মুখ হয়ে যায়, তেমনি মুখ হয়ে গিয়েছিল।
নুসরাত তার থেকে দ্বিগুণ বয়সের লোকদের সাথে হাবিজাবি গল্প করতে থাকল। তাদের প্রেম কীভাবে শুরু ,কীভাবে কী, একে এক সব, ফাউ, আর উল্টাপাল্টা কথা। শাহেদ খান নুসরাতের কথায় বিরক্ত হলেও হেলাল সাহেব নিহাল মির্জা খুবই মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে। হঠাৎ হঠাৎ কথার মধ্যে থামিয়ে জিজ্ঞেস করছেন এই সেই।
মৃন্ময় দূর হতে এতক্ষণ যাবত নিহাল মির্জা, হেলাল সাহেব আর নুসরাতের খোশগল্প দেখছিল। আকস্মিক মাথা চাড়া দিয়ে উঠল একটা কথা। নিহাল মির্জার একটা বদ অভ্যাস আছে, বিবাহিত হোক অবিবাহিত জিজ্ঞেস না করে বিয়ের সম্বন্ধ দিয়ে বসেন। তাদের পারিবারিক ফাংশনে এমন অঘটন এই লোক অনেক ঘটিয়েছেন। আজ এখনো ঘটান্নি এই কান্ড কিন্তু ঘটাতে কতক্ষণ। মিসেস নুসরাতকে না আবার বিয়ের জন্য প্রপোজ করে বসেন তার বাবা। নিজের শার্টের হাতা গুটিয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল গোল মিটিং করতে থাকা বাবার দিকে। নুসরাতের খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসছে। সে যে বয়সে বড় লোকদের সাথে কথা বলছে বেমালুম ভুলে বসেছে। কখনো নিহাল মির্জাকে হাসতে হাসতে ধাক্কা দিচ্ছে তো হেলাল সাহেবকে। নিহাল মির্জার একই অবস্থা, শুধু শাহেদ খান চুপচাপ অবলোকন করছেন সব।।মুখের উপর ফুটে আছে বিরক্তির ছাপ। মৃন্ময় নিহাল মির্জার কাছে পৌঁছানোর পূর্বেই ভদ্রলোক অঘটন ঘটিয়ে দিলেন। নিজের চিরাচরিত হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে নুসরাতের উদ্দেশ্যে বলে ওঠলেন,”মা তুমি কী মৃন্ময়কে বিয়ে করবে……
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৮
মৃন্ময়ের আর বাকিটুকু শোনা হলো না বাবার সকল কথা কানের পাশ দিয়ে শা শা শব্দে উড়ে চলে গেল। মনে হলো কানের মধ্যে কেউ সীসা ঢেলে দিয়েছে। বাবার,’ মা তুমি কী মৃন্ময়কে বিয়ে করবে, এই কথা কানের কাছে একবার, দু-বার, করে শতবার প্রতিধ্বনি হলো। চোখ মুখ খিঁচিয়ে কিছু বলতে নিবে আবারো সুরসুর করে শ্রবণেন্দ্রিয় প্রবেশ করল নিহাল খানের কথা, “ও কিন্তু সরকারি চাকরি করে, সামনে প্রমোশন পেয়ে গেলে খুব তাড়াতাড়ি পদের উন্নতি হয়ে যাবে..! আম্মু তুমি রাজী থাকলে আজই আকদ পড়িয়ে নিব..! ওর বয়স বেশি না এই মাত্র ঊনত্রিশ বছর….