প্রিয় বেগম পর্ব ১১

প্রিয় বেগম পর্ব ১১
পুষ্পিতা প্রিমা

সেদিন আমরা দর্জিবাড়ি গিয়েছিলাম। মেয়ে দর্জি। স্কুলবাড়ির পাশেই তার দোকান। অপু দুটো কাপড় সেলাই করতে দিয়েছিল। ফেরার পথে রহমানের সাথে দেখা হয়। ও তখন রহমানকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। শুরুর দিকে রহমানকে উপেক্ষা করে চলেছে বেশ। রহমান ওকে এড়িয়ে যেতে দেখে আমাকে বলল, সুভা অপাকে জিজ্ঞেস করো আমি কি ভুল করেছি?
আমি উত্তর দিলাম, আপনি ওকে চিঠি লিখুন তা ও পছন্দ করছে না। ওর দাদীজান চিঠি দেখে ফেলেছে। ওকে বকেছে। বলেছে খুব শীঘ্রই ওর নিকাহ দেবেন। আর পড়াশোনা করাবেন না। অথচ ওর ইচ্ছে ছিল ও মাস্টারনী হবে। আপনার জন্য ওর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।

রহমান সেদিন চুপ করে অপুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর অসহায় দৃষ্টি দেখে সেদিন আমারও খুব খারাপ লেগেছিল। যার দুকূলে কেউ নেই সে হয়ত অপুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। তাই আমি আর কটু কথা বলতে পারিনি। বিশ্বাস করুন সাহেব আমিও চেয়েছিলাম যাতে অপু রহমানকে ভালোবাসুক। কিন্তু ওর দাদীজান এটা চাননি। উনি আমাকে বলে রাখেন যে রহমানের সাথে কোনোরকম দেখাসাক্ষাৎ যদি হয় তাহলে যেন বলে দিই আর অপুর পাশ না ঘেঁষতে। আমি রহমানকে বলেও ছিলাম এটা। সে প্রায় আমাদের বাড়ির পেছনে আসতো অপুর খোঁজ নিতে। তখন ভরদুপুর নয়ত সন্ধ্যে, যখন আঁধার নামে। আমি বারণ করলে বলে অপার মুখ থেকে শুনবো, তোমার কথা বিশ্বাস করিনা। তারপর আমাকে আরও একটি চিঠি দেয়। নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমি কোনোদিনই ওদের চিঠিগুলো পড়িনি। চিঠির সাথে ফুলের মালাও দিত। রহমান বয়সে আপনাদের সমবয়সী হবে তাই আমি তার সাথে তর্কে যেতে ভয় পেতাম। অপুর জন্য তার অনুভূতিগুলোকে আমি সম্মান করতাম। তাদের দুজনের জন্যই আমার খারাপ লাগতো। বাড়িতে এ নিয়ে অনেক বকাঝকা শুনেছি। কিন্তু তারপরও আমি চিঠি আদান-প্রদানে সাহায্য করতাম। অপু রহমানকে বত্রিশটা চিঠি লিখেছিল। ওই বত্রিশটা চিঠিতেই ও লিখেছিল ” আমাকে ভুলে যান। আপনার আমার পথ আলাদা । আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারব না। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রহমান দমে যায়নি। হয়ত এ-কারণেই অপুও আর তাকে ফেরাতে পারিনি। তেত্রিশতম চিঠি থেকে শুরু করে আর কোনো চিঠিই অপা আমাকে দেখাতো না। আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলতো “দেখবি না কিন্তু, আমিও দেখতাম না। এভাবে তাদের শত শত চিঠি আদান-প্রদান হয়। তাদের সম্পর্কে আমিও খুশি ছিলাম। কারণ রহমান অপুকে ভালোবাসতো।

তন্মধ্যে একদিন অপুর দাদী মারা যায়। ঘুমের মধ্যে মারা যান উনি। সকালে উঠে অপু দাদীর মরা লাশের উপর শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারায়। দাদীই একমাত্র অভিভাবক ছিল ওর। দাদীকে হারানোর পর ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপর আমি আমার মাসির বাড়িতে গেলাম দু’দিনের জন্য। ফিরে এসে দেখি ওর অবস্থা খুব খারাপ। নাক আর ঠোঁটের মাঝ লালচে হয়ে গিয়েছে। যেন ওখানে রক্তজমাট বেঁধে আছে। হাতের তালুতে পোড়া দাগ। বুঝতে পারলাম ওর চাচী অত্যাচার করেছে ওকে। আমি ওকে তারপরের দিন আমার ডাক্তার কাকুর কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার কাকু ঔষধ দিল। নাকের নীচে জমাট রক্ত দেখে বলল, সেড়ে যাবে, ঠিকমতো ঔষধ খাও।
সেড়েও গেল কিন্তু তারপর থেকে অপু কেমন যেন হয়ে গেল। খোলাচুলে খালিপায়ে হেঁটে বেড়ায় সারাক্ষণ। আমি জিজ্ঞেস করলে বলে ওর নাকি মাথার তালু জ্বলে যায়, পায়ের তালু জ্বলে যায়। সারাক্ষণ মাথায় তেল দেয়ার জন্য পাগলামি করে।

ওকে খোলাচুলে এর আগে ওর পাড়াপড়শিরাও দেখেনি। একদিন তো আমাদের বাড়ি চলে এল খোলাচুলে, খালিপায়ে, গায়ে কোনোমতে ওড়না জড়িয়ে । ওকে ওই অবস্থায় দেখে কেউ সহজেই চিনতে পারেনি। মায়ের কাছ তেল খুঁজলো। মা ওর আচরণে অবাক হয়ে বলল, কি হলো রে তোর? অপু মাথায় হাত চেপে বলে, তালুতে খুব জ্বলে কাকী। তেল দাও। একটু বেশি করেই দাও।
ওকে দেখে আমার কান্না পেল।
আমি ডাক্তার কাকুর কাছে গেলাম রেগেমেগে। বললাম,
কি ঔষধ দিলে যার কারণে ও এমন আচরণ করছে? ঔষধ গুলো তো অনেক ভারী।
ডাক্তার কাকু ভয়ে চুপসে গেল। বলল, আজব কেস দেখছি! এতো হালকা পাওয়ারের ঔষধ।

আমি সেইদিন সন্ধ্যায় রহমানের সাথে ওকে দেখা করাতে নিয়ে গেলাম বিলের পাড়ে। রহমানকে দেখে ও একদম চুপচাপ, শান্ত বালিকার মতো গিয়ে আমার সামনেই রহমানকে জড়িয়ে ধরলো। রহমানও ওর আচরণে অবাক হলো। লজ্জায় পড়ে গিয়ে ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আমাকে বলল, তুমি কি ওর পাগলামি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে চাও?
আমি সরে গেলাম। ওরা বিলের ধারে কতক্ষণ ছিল আমি জানিনা। দাদীজানের হঠাৎ মৃত্যু মৃত্যু ওকে এতটাই আঘাত করেছে ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। ঔষধের পাওয়ারও বোধহয় ওকে সংক্রমিত করেছে।
দিনদিন ওর ছটপটানি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল পাড়া পড়শীও বিচলিত হয়ে পড়লো। সবার পরামর্শে ওর চাচা ওকে ঘরবন্দী করে। জ্বিনের আছরে পেয়েছে ভেবে ওর ঝাড়ফুঁক করায়। ডাক্তারের কথামতো ওর ঘরটা পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখে। নিকাহের জন্য সম্বন্ধ দেখতে শুরু করে ওর চাচা। বিয়ে দিয়ে দিলে নিস্তার পাবে এই ভাবনা ছিল উনাদের।

প্রায় দু সপ্তাহের ঘরবন্দী থাকায় অপার সাথে আমি কথাবার্তা বলতে পারিনি। ঠাকুমা বলল, ওই ছেলেটা মেয়েটাকে লায়লি বানিয়ে ফেলেছে। আহা ভালোবাসা! সত্যি বলতে অপুর এমন পরিণতির কেন তার সঠিক উত্তর আমার জানা নেই কারণ তারপরেই শোনা গেল ও আগের মতো তেলের জন্য পাগলামি করছে না। কান্নাকাটি করছে না। আগের মতো স্বাভাবিক হচ্ছে।
রহমানও এদিকে পাগল হয়ে যাচ্ছিলো দেখা করার জন্য। আমি বললাম,
ও পুরোপুরি সুস্থ হোক। তারপর আমি ওকে গিয়ে বলব দেখা করার জন্য।
রহমান অধৈর্য গলায় বলল,
না। তুমি দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও। আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যাব।
আমি বললাম,
কোথায় নিয়ে যাবেন? বলল,

নিকাহ করব। ওকে এখানে পঁচতে দেখতে পারব না আমি।
আমার কিছু করার ছিল না। তাই রহমান আর আমার সাথে দেখা করতে আসেনি।
তার দুদিন পর রূপা আমাদের বাড়িতে আসে। তখন সে একদম স্বাভাবিক আগের মতো। খোলাচুলে নেই, চোখমুখে অশান্ত ভাবটা নেই, মাথা ঢাকা। হঠাৎ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে কেঁদে উঠে বলল,
আমি চলে যাচ্ছি সুভু। আমি বললাম, কোথায় যাবি? সে বলল, আমি উনার সাথে চলে যাব। উনি বলেছেন আমাকে নিকাহ করবেন।
সে জানালো রহমান নাকি মধ্যিরাতে তার জানালার কাছে এসে জানালায় কারাঘাত করেছিল। আর তখন সবটা বলেছে। আমি বললাম’ তুই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নে কি করবি।
কেন যেন আমার মন সায় দিচ্ছিলো না সেদিন। আমি বললাম, রহমান সম্পর্কে তো কিছুই জানিস না। তোর চাচাকে বল রহমান সম্পর্কে খোঁজ নিতে। রহমানকেও বল তোর চাচার কাছে প্রস্তাব পাঠাতে। এভাবে যাস না। বিপদে পড়বি।

আমি যেভাবে বলেছিলাম অপু হয়ত সেভাবেই বলেছিল রহমানকে কিন্তু তারপর থেকে না রহমান, না অপু কারো সাথে আমার কথা হয়নি।
এক সকালে ঘুম ভাঙতেই শুনতে পেলাম অপু পালিয়েছে। একথা শুনে আমি চমকায়নি কিন্তু আহত হয়েছি খুব। ও আমার খুব কাছের বন্ধু। আমার কথা না শুনে ও যদি কোনো বিপদে পড়ে এই ভয়টায় পাচ্ছিলাম। এখন আমি জানিনা রহমান কেন ওকে ফেলে কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছে। আমি আপনার কাছ থেকে কিচ্ছু লুকোয়নি সাহেব । যা জানি তা বলে দিয়েছি।
বলা শেষেই লম্বা দম ফেললো সুভা। সাফায়াত জলের পাত্র বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
খাও।

সুভা ঢকঢক করে পানি খেয়ে শেহজাদের দিকে তাকায়।
শেহজাদ নিমগ্ন হয়ে ভাবে একটা মেয়ের উপর এতটা ঝড় বয়ে গেল? মেয়েটা বেঁচে আছে এইতো বেশি। তারউপর সে আঘাত করলো।
তোমার কি মনে নয়? রহমান কেন রূপাকে ঘাটে রেখে চলে গেল? এটা কি ইচ্ছাকৃত হয়েছে?
আমি সঠিক জানিনা সাহেব। তবে মনে হচ্ছে রূপার মানসিক সমস্যা হয়ত বুঝতে পেরেছে রহমান। তাই নিকাহ করবেনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর পালিয়েছে।
সাফায়াত বলল,
কিন্তু তুমি যে বললে রহমান ওকে ভালোবাসতো।
আমি সঠিক জানিনা সাহেব। আমার কতকিছু মনে হয়। আমার ধারণাটাই বললাম।
শেহজাদ দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল,

আমার মনে হচ্ছে অন্য কিছু।
সুভা তার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে বলল,
সাহেব রাতের খাবারটা। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। না খেয়ে যাবেন না।
নাহ সুভা। আমাদের রওনা দিতে হবে। ফিরতে ফিরতে আরও দেরী হয়ে যাবে। আসি। সামনেই তোমার বিবাহ, না হলে তোমাকে নিয়ে যেতাম। রূপার বোধহয় এসময় তোমাকে বেশি প্রয়োজন ছিল।
সুভা নিরুপায় হয়ে বলে,
আমাকে যেতে দিলে সত্যিই যেতাম সাহেব। কিন্তু উপায় নেই। একটা অনুরোধ করি আপনাকে। অপুকে দেখে রাখবেন। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। ও আমার অনেক কাছের বন্ধু।
শেহজাদ ওর মাথায় হাত রেখে তারপর বেরিয়ে যায় মল্লিক বাড়ির আঙিনা হতে।

মধ্যিরাতে মহলের সম্মুখভাগে সৈন্য উপস্থিতিতে সবাই খানিকটা হকচকিয়ে তাকায়। সায়রা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
ভাইজানদের সাথে আপনারা ইন্দিরাপুর যাননি?
সৈন্য প্রধান কামীল উত্তর দেয়,
না। আপনার সাহেব চাননি আমরা যাই। আমরা অপরূপার ঘরে তল্লাশি চালাবো। ঘুরেফিরে সব অপরূপার দিকে যাচ্ছে।
ভাইজান না আসা অব্দি অপেক্ষা করুন। অপরূপা যদি নির্দোষ হয় তাহলে ওর উপর অন্যায় হবে।
হামিদা শেরতাজ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
আমার মনে হয় না অপরূপা এসবের সাথে জড়িত। বেচারীকে শুধু শুধু কষ্ট দেয়া হচ্ছে। ওর হাতে আঘাত তারমধ্যে ওর উপর এসব অত্যাচার একদম ভালো হচ্ছে না। শেহজাদ বাড়ি ফিরে এসব জানতে পারলে আপনাদের উপর ক্ষেপে যাবে।

সায়রা আর সোহিনী সমর্থন জানালো। সৈন্য প্রধান বলল,
কিছু করার নেই। তল্লাশি করতে হবে।
সায়রা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
চলুন।
দুজন সৈন্য অপরূপার ঘরে গেল। সায়রা আর সোহিনী তাদের পেছন পেছন গেল। সৈন্যরা অপরূপার কক্ষে তার পুটলিটা খালি পড়ে থাকতে দেখলো। সায়রা সেটি কুড়িয়ে নিয়ে বলল,
ওর সব শাড়ি গহনা নিয়ে গিয়েছে। আর আপনারা বলছেন ওর এসবে হাত আছে? এই দেখুন এটাতে ওর শাড়ি গহনা ছিল।

সৈন্য প্রধান পুটলিটা তুলে নেয়। তারপর নিজেদের কাছে রেখে দেয়। সারাকক্ষে তল্লাশি চালিয়ে তারা বিশেষ কিছুই পেল না। অপরূপার বালিশের পাশে একটা আতর, কয়েকটা মোমবাতি যেগুলো হারিকেনের তেল ফুরিয়ে গেলে জ্বালাতে হয়, একটা গাঁদাফুলের মালা যেটা অপরূপার হাতে পড়া ছিল ওইদিন, আর বালিশের নীচে কয়েকটা মাদুলি। যুবতী বাঙালি মেয়েদের হাতে পায়ে এরূপ অসংখ্য মাদুলি এমনিতেই পড়া থাকে।
সায়রা বলল,

কামীল ভাইজান আব্বাজানদের গিয়ে বলুন অপরূপাকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। হাতজোড় করছি। ওর হাতে আঘাত। বেচারি এতক্ষণ কাঁদছিল এখন চুপ হয়ে গিয়েছে। আমার খুব ভয় করছে।
শেরতাজ সাহেবের কাছ থেকে চাবি নিয়ে ওই অন্ধ কুঠুরির দরজা মেলতেই সবাই অপরূপাকে দেখে বিচলিত হয়ে পড়লো। অপরূপা শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে হাত পা গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। দেখেই মনে হচ্ছে কোনো জড়বস্তু। তার ভেতরে প্রাণ নেই। সায়রা আর সোহিনী ছুটে গিয়ে অপরূপার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখতেই ঢলে পড়ে অপরূপা। সায়রা আঁতকে উঠে তাকে ধরে।
সোহিনী পানি এনে মুখে ছিটায়। কাজের বুয়া কুমু আর টুনু বাতাস করতে থাকে। সৈন্যরা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে
আমরা আসবো?
সায়রা কড়া গলায় বলে,

না। ও হুশে নেই। টুনু আপা কখন ওর কান্না বন্ধ হয়েছে?
রাতের খাওনর পর আপা।
তারমানে তারপর থেকে ও অজ্ঞান হয়ে আছে। বড় চাচার এ কেমন নিষ্ঠুরতা! ভাইজান আপনারা এখন সদর ঘরে গিয়ে বসুন। অপা কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
সোহিনী পানির ছিটকে দিতে দিতে ডাকে,
অপা চোখ খোলো।
সায়রা খেয়াল করলো অপরূপার কেটে যাওয়া হাতের বাহুর ব্যান্ডেজটা রক্তে ভেজা। তারমানে রক্তপাত বন্ধ হয়নি। মেয়েটার পান্ডুর মুখখানা দেখে তার বড় মায়া হলো। কুমুকে বলল
কুমু আপা দ্রুত লেবুপাতা নিয়ে এসো বাগানের গাছ থেকে।
কুমু “আইচ্ছা” কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।

মহলে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। তাই অন্দরমহলে আলো নেই। হারিকেনের তেল ফুরিয়ে আসছে। তেল আনার জন্য মালি কুদ্দস মিয়া বাজারে গিয়েছিল। এখনো ফেরেনি। সদর ঘরে বসে খোদেজা তার কাণ্ডজ্ঞানের কথা ভেবে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।
কুমু আজলা ভরে লেবু পাতা নিয়ে হাজির হলো। সায়রা লেবু পাতা কচলে অপরূপার নাকের কাছে ধরে। বলে,
কুমু আপা টুনু আপা অপার হাত পা মালিশ করো।
তারা কথামতো কাজ করতে লাগলো। হাত মালিশ করতে গিয়ে কুমু আঁতকে উঠলো। সায়রা আর সোহিনী চমকে উঠে বলল,

কি হলো?
কুমু অপরূপার হাতের তালু দেখালো। তারা দেখতে পেল হাতের তালুতে আগুনে পোড়ার ক্ষত। এখনো পুরোপুরি শুকিয়ে উঠেনি। সোহিনী চোখ বন্ধ করে ফেলে বলল,
এই মেয়ে এই ক্ষত নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিল দেখেছিস?
সায়রা বলল,
তাই তো। কিন্তু পুড়লো কি করে?

মহলে ডাকাত আক্রমণ হয়েছে শুনে শাহানা রওনা দিয়েছিল, কিন্তু পথিমধ্যে জাহাজের ত্রুটির কারণে আটকে থাকতে হয়েছে। মাত্রই মহলে ফিরলো আর তাদের সাথে সাথে বিদ্যুৎ ও এল। সকাল থেকে বিদ্যুৎ মিস্ত্রিরা কাজ করছে। বিদ্যুৎ আসায় সারামহল আলোয় জ্বলমলিয়ে উঠলো। তন্মধ্যে শাহানা আর তার তিন কন্যাকে পেয়ে কিছুমুহর্তের জন্য আনন্দে মেতে উঠলো সবাই। সবার ছোট আয়শা বলল,
ভাইজানরা কোথায়? তাদের জন্য খুবই চিন্তা হচ্ছিল।
সায়রা বলল,
ভাইজানরা ইন্দিরাপুরে গিয়েছে। এতক্ষণে বোধহয় ফিরেও আসছে।
শাহানা বলল,
খোদা তাদের যাত্রা সহজ করে দিক। কারো কোনো ক্ষতি হয়নি তো?
সবাই চুপ করে থাকে। সায়রা চুপিসারে বলে,
ফুপু ফুলকলির ক্ষতি হয়েছে। এসব প্রশ্ন করবেন না। কালু মিয়া আর মফিজের গায়েও গু*লি লেগেছে। তাদের জন্য দোয়া করুন।

শাহানার বুক কেঁপে উঠে। তন্মধ্যে কুমু আর টুনু ছুটে আসে।
আপা ওই ছেমড়িডা চোখ মেলছে। তার মাথায় নাকি যন্ত্রণা করতাছে। কানতেছে। তাড়াতাড়ি আহেন।
সায়রা আর সোহিনী ছুটে যায়। তটিনী, শবনম, আর আয়শা প্রশ্ন করে
মহলে কি নতুন মানুষ এসেছে নাকি?
হামিদা বলে, হ্যা, দেখে এসো। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে ভাগ্যের পরিহাসে এখানে এসে পড়েছে।
তটিনীরা আর দাঁড়ায় না। সোপান বেয়ে দ্বিতল ভবনে যেতে যেতে সিভানের কন্ঠস্বর শুনতে পায়।
ভাইজানরা চলে এসেছে। ইয়ে ইয়ে। নতুন বউকে আর আটকে রাখতে পারবে না আব্বাজান।

শেহজাদ আর সাফয়াত ফিরেছে শুনে তটিনী আর শবনম অপরূপাকে দেখে সদর ঘরে নেমে আসে।
উত্তেজিত দেখায় তাদের। চোখেমুখে নিদারুণ কৌতূহল আর আগ্রহ। সাফায়াত কেদারায় গা এলিয়ে বসেছে। শেহজাদ শাহজাহান সাহেব আর শেরতাজ সাহেবের সাথে টুকটাক কথা বলে হালকা চালে এপাশ ওপাশ হাঁটতে হাঁটতে পানির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলো। তটিনীদের দেখে থেমে যায়। পানি খেয়ে বলে,
তোমরা কবে এসেছ?
তটিনী উত্তর দেয়,
কিছুক্ষণ আগেই।
ফুপু কোথায়?
আম্মাজান আরাম করছেন। তোমাকে তো খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

ও তেমন কিছু না।
সাফায়াত বোনদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আমি আম্মাজানের সাথে দেখা করে আসি।
সাফায়াত যেতেই শবনম কিছু বলতে যায়। তটিনী থামিয়ে দেয়। শেহজাদ আরেক চুমুক পানি খেতে যেতেই দেখে তটিনী শবনমের আঙুল চেপে ধরেছে।
ওর আঙুল ছাড়ো।
তটিনী চটজলদি আঙুল ছেড়ে দেয়। লজ্জা পায়।
শবনমের দিকে তাকিয়ে শেহজাদ প্রশ্ন করে,
কিছু বলবে?
ভাইজান আসলে। অন্দরমহলে রূপাকে দেখলাম। ওকে আমরা দেখেছি তাই চিনতে পেরেছি।
আমিও দেখেছি।
শাহজাহান সাহেব কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
তোমরা ওকে চেনো?
শেহজাদ বলে,
হ্যা। শবনম, আর কিছু বলতে চাও?
ও কেমন যেন করছে। ছটপট করছে। ওর শরীর খুব খারাপ।
খোদেজা এসে বলল,
পুত্র ওই মেয়ে আজই ম*র*বে। মরার আগে মানুষ ছটপট করেনা মেয়েটা ওইরকমই করছে। খোদা তুমি তাকে শান্তির মওত দাও।

শেহজাদ গ্লাসটা রাখে শব্দ করে তারপর সবেগে পা ফেলে ওই কক্ষের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়।
গিয়ে দেখে কুমু আর টুনু বাতাস করছে অপরূপাকে। সে ছটপট করছে বালিশে হেলান দিয়ে বসে। তার অক্ষিকোটর বেয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। অস্ফুটস্বরে আল্লাহ আল্লাহ শব্দ করছে।
ঠিক তখনি মাথার উপর জপজপ করে ঠান্ডা কদুর তেল পড়ায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অপরূপা শান্ত হয়ে গেল কি এক অদ্ভুত ভোজবাজিতে । তার মাথার উপর তেলের বোতল ধরে তেল ঢালতে থাকা মানুষটার দিকে নয়নজোড়া মেলতেই স্তব্ধ হয়ে গেল অপরূপা। আধোআধো ঝাপসা নয়নে সে দেখতে পেল তার মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা সুঠামদেহী পুরুষ।
সায়রা আর সোহিনী ঠান্ডা পানি আর বোল আনতে গিয়েছিল অপরূপার মাথা ধুঁয়ে দেয়ার জন্য। এসেই শেহজাদকে দেখে ডাকলো
ভাইজান।

প্রিয় বেগম পর্ব ১০

শেহজাদ তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলল,
জ্বি। ওর মাথায় তেলগুলো মালিশ করে দাও। আর পা দুটোতেও তেল মাখিয়ে দাও।
সায়রা আর সোহিনী তাই করলো। আর ভাইজানের দৃষ্টির অগোচরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় প্রশ্ন ছোড়াছুড়ি করলো
অপার সম্পর্কে জানতে গিয়ে ভাইজান কি ডাক্তারি শিখে এসেছে নাকি?

প্রিয় বেগম পর্ব ১২