প্রিয় বেগম পর্ব ১৬
পুষ্পিতা প্রিমা
দু রাত নির্ঘুম থেকে টুপিটা তৈরি করতে গিয়ে অপরূপা আর চোখ মেলতে পারছে না। সিভান এসে তাকে ডাকাডাকি করছে বুঝতে পেরেও সে চোখ মেলতে পারছেনা। সাথে দুর্বলও লাগছে। ফুলকলি তার গায়ে কাঁথা ঝাঁপিয়ে দিয়ে বলল, ছোট ভাইজান, সুন্দর বউ ঘুমাইতেছে। উঠতে পারবো না এখন।
সিভান জেদ ধরে বলল,
নাহ। মামা এসেছে। মামাকে দেখতে চেয়েছে সুন্দর বউ। এই বউ ওঠো।
কাঁথা নিয়ে ফেললো সিভান। অপরূপার গা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
এই সুন্দর বউ! ওঠো।
অপরূপা পিটপিট তাকিয়ে আমর্ষ গলায় বলল,
কি হয়েছে? ঘুমাচ্ছি না?
সিভান ধমক খেয়ে চুপসে গেল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। ঠোঁট ফুলালো। অপরূপা বুঝতে পেরে উঠে বসলো। চোখ ঢলে বলল,
কি হয়েছে?
মামা এসেছে। দেখবে না?
মামা!
অপরূপা তড়াক খেয়ে বলল, তোমার মামা মহলে এসেছে?
হ্যা।
অপরূপা তড়িঘড়ি করে খাট থেকে নেমে মাথায় ওড়না জড়িয়ে বলল
চলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সিভান খুশি হয়ে তার হাতের আঙুল ধরে টেনে টেনে নিয়ে গেল।
মহলের কোনো এককোণা হতে জিকিরের শব্দ ভেসে আসছে হয়ত বেতার যন্ত্র চলছে। সারামহল রঙবেরঙের আলো আর লোক সমাগমে ঝলমল করছে। মেহমানদের বাচ্চাগুলো দৌড়াদৌড়ি করছে। রান্নাবান্নাও পরিবেশনের কাজে রত কাজের বুয়াগুলো লাল রঙের শামীয়ানায় ঢাকা খাবারের তালা হাতে সারি বেঁধে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে। সবার পড়নে আজ নতুন পোশাক। অপরূপা নিজের পোশাকটির দিকে তাকালো। দুপুরবেলা গোসল সেড়ে যেটা পড়েছিল সেটা। জলপাই রঙের । ফুলকলি দিয়েছে। ফুলকলি তাকে দুটো কাপড় দিয়ে দিয়েছে। কাপড়গুলো নতুন। লম্বা হওয়ায় সে তা কখনো পড়েনি। অপরূপার গায়ে তা ভালোই মানিয়েছে। সে অদলবদল করে পড়তে পারবে।
সিভান বলল,
তুমি ভাইজানকে কিছু দেবে না?
কি দেব?
উপহার?
আমার কাছে তো কিচ্ছু নেই।
আচ্ছা, চলো। ওইদিকে মামা আছেন।
ভীড় দেখা যাচ্ছে দ্বিতল ভবনের কক্ষপথটিতে। সিভান ভীড় ঠেলে অপরূপাকে নিয়ে ছুটলো। সবাই সিভান আর অপরূপাকে দেখে সরে দাঁড়ালো। সবার দৃষ্টি তখন তাদের দিকে। অপরূপা বলল,
আরেহ কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
সিভান থেমে গিয়ে বলল, মামা সুন্দর বউ চলে এসেছে। তোমাকে দেখবে। এদিকে ফিরো।
হামিদা, খোদেজা আর শাহানার সাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে কথা বলছিল লোকটা। সিভানের কথায় সামনে ফিরলো। সবার শাণিত দৃষ্টি অপরূপার দিকে। কটকটে হলদু রঙের পাঞ্জাবি পড়া লোকটার গায়ে লম্বা পাঞ্জাবি, লম্বা মুখ, জমিদারদের মতো লম্বা গোঁফ, বয়স পয়ত্রিশ ছত্রিশের মতো হলেও দেখতে অতটা মনে হচ্ছে না। অপরূপা লোকটাকে দেখে ঠোঁট টিপে হাসি চেপে রাখলো।
লোকটা সামনে ফিরেই অপরূপাকে আপাদমস্তক দেখলো। অপরূপার এতে অস্বস্তি লাগলো। লোকটা তুখোড় দৃষ্টিতে অপরূপাকে দেখে রসিকতা করে বলল,
এ তোমার সুন্দর বউ?
সিভান হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,
হ্যা।
হামিদা বলল,
হাবীব ও অপরূপা। আশ্রয়ে আছে।
হাবীব নামক লোকটা নিমগ্নকন্ঠে শুধালো,
মানুষের সাথে নামের এত মিল থাকতে তো দেখিনি।
আমি আসছি।
অপরূপা দ্রুতপদে ওখান থেকে চলে এসে হাসিতে ফেটে পড়লো। এই লোক সিভানের মামা? হাসতে হাসতে তার চোখে জল নেমে এল। পেছন পেছন সিভান দৌড়ে এসে বলল,
এই সুন্দর বউ তুমি চলে এলে কেন? মামা জিজ্ঞেস করছিল সুন্দর বউয়ের বর কোথায়?
অপরূপা হাসছে। তার হাসি থামছে না। আশেপাশের সবাই তাকে দেখছে। কাজের বুয়াগুলো তাকে এর আগে এভাবে প্রাণখুলে হাসতে দেখেনি।
সিভান বলল, তুমি হাসছো কেন? হাসি থামাও।
ওই দেখো শেহজাদ ভাইজানরা আসছে। বেশি হাসা পছন্দ করে না ভাইজান।
অপরূপা হাসির গতি কমালো কিন্তু হেসেই যাচ্ছে।
সিভান বুক ফুলিয়ে বলল,
সে বড় সম্রাট আর আমি ছোট্ট সম্রাট। এই থালাটা নাও। ভাইজানের মাথায় ফুল ছিটাও।
অপরূপা হাসতে হাসতে থালাটা হাতে ওদিকে তাকালো। অতি ব্যস্ত পায়ে হেঁটে শেহজাদ মহলে আমন্ত্রিত মেহমানদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কুশলাদি বিনিময় করতে করতে চত্বরের দিকে পা বাড়ানোর সময় সাফায়াতকে ডেকে বলল,
এখানে কি কোনে সার্কাস চলছে? এত হাসাহাসির কিসের?
সাফায়াত চারপাশে তাকিয়ে বলল,
কোথায় হাসাহাসি হচ্ছে? সবাই তো দেখি ফুল ছিটাচ্ছে।
তুমি দেখবে না কিছু।
ঠিক তখনি একটি থালাভর্তি ফুলের পাঁপড়ি এসে শেহজাদের মুখ বরাবর পড়লো। গোলাপের পাঁপড়িতে ঢেকে গেল তার মাথার চুল, মুখ।
থুহ করে ঠোঁটে লেগে যাওয়া পাঁপড়ি ঝেড়ে ফেলে কটমট গলায় হুংকার ছাড়লো শেহজাদ।
মুখের উপর এভাবে ফুল ছুঁড়লো কে?
ফুলকলি আর মতিবানুসহ সবাই মিলে ঘাড় ঘুরিয়ে অপরূপাকে দেখলো। অপরূপা মস্তক নামিয়ে থালাটা পেছনে লুকিয়ে সিভানের হাত চেপে ধরে মিনমিন করে বলল,
দেখলে তো।
সিভান হাসিতে ফেটে পড়ে বলল,
তুমি ফুলও ছুঁড়তে জানো না বউ?
আমি জানতাম নাকি মুখে গিয়ে পড়বে।
শেহজাদ চুল থেকে, মাথা থেকে গোলাপের পাপড়ি ঝেড়ে ফেলে অপরূপার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে চাইলো। অপরূপা চোখ তুলে তাকিয়ে আবার নামিয়ে ফেললো।
কিছু না দিয়ে শেষমেশ ফুল দিল। তাও আবার ছুঁড়ে!
অপরূপা সেখান হতে সরে পড়লো ধীরেধীরে। তটিনীরা সবাই তাকে ঘিরে ধরলো। সোহিনী বলল,
তোমার ঘুম হয়েছে?
হ্যা।
তটিনী বলল,
তোমার টুপিটা সম্রাটের পছন্দ হয়েছে। এই নাও পয়সা বাড়িয়ে দিলাম।
অপরূপা পয়সাগুলো নিয়ে হাসলো। তার প্রথম পারিশ্রমিক। হাতের মুঠোয় পয়সাগুলো চেপে ধরে দাদীজানকে স্মরণ করলো।
তটিনী বলল,
খুশি হয়েছ? আমি একটা চাদরে কিছু ফুল তুলবো। ও চাদর পড়ে তাই। তুমি করে দেবে?
জ্বি। চেষ্টা করব।
তটিনী তার গাল টেনে দিয়ে বলল,
তুমি খুব ভালো মেয়ে রূপা।
অপরূপা হাসলো। বলল,
আপনাদের সবাইকে অনেক সুন্দর লাগছে।
শবনম হেসে বলল,
লজ্জা দিওনা এভাবে।
অপরূপা মৃদু হাসলো। বলল,
আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমোবো। খুব ঝিমাচ্ছে।
সোহিনী বলল,
আচ্ছা তুমি যাও। খাওয়ার সময় আমরা ডেকে নেব। আরেকটা কথা তোমাকে হাসলে খুব ভালো লাগে। এভাবে হেসো।
অপরূপা মাথা নেড়ে বলল,
যাই?
হুমম।
অপরূপা তার কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। তাদের কক্ষটি রসাইঘরের ঠিক বাম পাশেই। কক্ষপথে পা বাড়াতেই একটি সাদা ধবধবে খরগোশকে ছোটাছুটি করতে দেখলো সে। থেমে গেল। ভাবলো,
সম্রাটের খরগোশ এখানে কি করে এল?
অপরূপা সেটির পেছনে ছুটলো।
প্রিয় বেগম পর্ব ১৫
তাকে দেখতে পেয়ে খরগোশটি পালাতে চাইলো। পালাতে পালাতে একসময় তাদের কক্ষের ভেতর ঢুকে পড়লো। মুখের ভেতর কিছু একটা। অপরূপা তাকে কোলে নিতেই মুখে আটকে থাকা জিনিসটি টেনে বের করলো। হাতে নিয়ে নিয়ে দেখলো, পুরোনো লোহার দুটো চাবি। চাবি দুটো টেনে নেয়ার সময় খরগোশের মুখ ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত ঝড়ছে। চাবিতে রক্ত লেগে গিয়েছে। রক্ত দেখে অপরূপার হাত পা কেঁপে উঠলো। এখন কি করবে সে?
সম্রাট তো তার আস্ত রাখবে না।