প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ২১+২২
পুষ্পিতা প্রিমা
সকাল আটটার দিকে জয়পুর থেকে সবাই রূপনগর এসে পৌঁছালো। সুলতান মহল বউ বাচ্চায় ছেলেমেয়েই মেতে উঠলো পুনরায়। শবনমের জ্বর পুরোপুরি যায়নি। সে আসার পর সিভানকে জিজ্ঞেস করেছিলো, নাদির মেহমাদের কথা। সিভান তাকে জানিয়েছে তিনি এখন প্রাঙ্গনে বসে আছেন। বাবুদেরকে নিয়ে খুনসুটি করছেন। শবনম তা শুনে প্রাঙ্গনে চলে এল। তার হরিণছানাটি কোথায় তার জবাবদিহিতা উনাকে করতেই হবে। সে প্রাঙ্গনে আসামাত্রই নাদির তাকালো। শবনম বলল,”
” শুনুন, আমার হরিণছানাটা কোথায়?”
হনহনিয়ে এসে পড়তেই সে দেখলো নাদিরের বিপরীত পাশে শেরহাম বসা। সে শেরহামকে দেখামাত্র লজ্জায় পড়ে গেল। বলল,
” মানে হরিণছানাটা..
শেরহাম জিজ্ঞেস করলো,
” তোর জ্বর কমেছে? ”
” জ্বি, ভাইজান। ”
শেরহাম নাদিরকে বলল, ” আমি কক্ষে যাচ্ছি। তুমি বসো। গল্প করো। ”
শেরহাম চলে গেল। নাদির গা এলিয়ে বসে বলল,
” আপনি জয়পুর থেকে ভেবে এসেছেন যে আসার পর থেকে আমার সাথে ঝগড়া করবেন? আপনার জন্য হাতে ব্যাথা পেলাম তার খোঁজ নিলেন না? ”
শবনম বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” দুঃখীত। শুরুতেই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
বনে-বাদাড়ের বীরপুরুষরা যুদ্ধ করেই বাঁচে জানি। তাই খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। বলুন, আমার ছানাটা কোথায়? ”
” ওখানে। ”
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল নাদির। শবনম আঙুলের ইশারায় ফিরতেই দেখলো অতিথিশালার সামনেই শোহরাব, শোইয়াব আর আলিজা হরিণছানাটির সাথে খেলছে। শবনমের ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে পড়লো তখুনি। নাদিরের দিকে ফিরে বলল,
” ধন্যবাদ। অনেক খুশি হয়েছি। ওটাকে আমি খুব যত্নে রাখবো। ”
তখন কাশিফ এল সেখানে। শবনমকে দেখামাত্র বলল
” কি অবস্থা আপনার? শরীর ঠিকঠাক? ”
” হ্যা। আপনাদের কি অবস্থা? ‘
” এই তো ঘুরছি, ফিরছি,খাচ্ছি। আর চমৎকার সময় কাটাচ্ছি। কাল রওনা দেব। ”
শবনম মিহিস্বরে বলল,
” কাল? ”
কাশিফ বলল, ” জ্বি। ”
শবনম নাদিরের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই দেখতে পেল নাদির হাতের পট্টিটা নিয়ে ব্যস্ত। শবনম চলে এল সেখান থেকে।
রসাইঘরে তাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল। এতদিন সে কোথায় ছিল, কিভাবে ছিল তা নিয়ে। যদিও সে সবাইকে সবটা খুলে বলেছে। কিন্তু অতগুলো ছেলের মধ্যে কিভাবে সে এতগুলো দিন থেকেছে তা নিয়ে বারংবার শিহরিত হচ্ছে শাহানা। ভাগ্যিস ছেলেগুলো ভালো।
সোলেমান মাহমুদ সিদ্ধান্ত নিলেন এবার বেশ যাচাই-বাছাই করে ছেলে দেখবেন তারপর শবনমের নিকাহ ঠিক করবেন। এবার কোনোপ্রকার ভুল করবেন না। শেহজাদ আর সাফায়াতকে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে তবেই সম্বন্ধ আনতে বলেছেন। ভুল হলো উনাদের, ঝড় বয়ে গেল মেয়েটার উপর দিয়ে। এবার আর কোনোপ্রকার ভুল হবে না।
বিকেলবেলা মহলে ফজল সাহেবের উপস্থিতি নাদিরকে ভড়কে দিয়েছে। সে জানতেই পারলো না তাঈফ কখন খবর পাঠিয়ে দিয়েছে। ফজল সাহেব নাদিরকে দেখামাত্র একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। অপরূপা কদমবুসি করে বলল,
” আপনি কখন এলেন ডাক্তার বাবু? মা কেমন আছে? ”
ফজল সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে নাদিরের দিকে চেয়ে উত্তর দিলেন,
” তোমার মা ভালো আছে। এই বাঁদরকে নিয়ে যেতে এসেছি। ”
নাদির এগিয়ে এল। কদমবুসি করতেই উনি নাদিরের গালে কষে চড় বসিয়ে বললেন,
” তোর বিন্দুমাত্র ধারণা আছে যে তোর বোন তোর খোঁজ না পেয়ে কেমন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছে। মেয়েটাকে শান্তিতে সংসার করতে দিচ্ছিস না তুই। কোন জগতে থাকিস তুই যে তোর কোনো খোঁজ পেলাম না আমরা। ”
নাদির উনাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” আমি যাব ভেবেছিলাম কিন্তু বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে নিয়ে এত চিন্তার কি দরকার? ”
ফজল সাহেবের চোখদুটো ভাগ্নেকে অনেকগুলো দিনপর অক্ষত দেখায় চিকচিক করছে। নাদিরের কান চেপে ধরে বললেন,
” এবার তোকে আমি জালে বাঁধবো তুই চাইলেও বেরোতে পারবি না। ”
নাদির জানতে চাইলো,
” কি করবে? ”
” মেয়ে ঠিক করেছি। নিকাহ করবি। তারপর দেখি কোথায় যাস। ”
নাদির হতাশ চোখে তাঈফের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ মামু পাগল হয়ে গেছে। আমার দ্বারা এসব হবে না একটু বুঝা। ”
ফজল সাহেব কর্কশ গলায় বললেন,
” অবশ্যই সম্ভব। এখান থেকে গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আসবি, নিকহার দিন তারিখ ঠিক করে আসবো আমি। মেয়েটাকে আমরা সবাই দেখেছি। তোর বাবাকে চিনতো। ভালো পরিবারের মেয়ে। ”
নাদির বলল, ” নিকাহর কথা বললে আমি তোমার সাথে যাব না। ”
বলেই সেখান থেকে চলে গেল। ফজল সাহেব রেগেমেগে বললেন, ” না গেলে আমার মরা মুখ দেখবি তুই। তোর মা তোকে আমরা দুই ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। কথা শুনবি নয়ত…
নাদির হতাশ চোখে চেয়ে বলল,” কেন আমাকে জ্বালাচ্ছ? আমার দ্বারা সংসার টংসার ওসব হবে না। ”
অপরূপা বলে উঠলো,
” সংসার জোর খাটিয়ে করতে হয় না ভাইজান। আপনাআপনি সংসারী হয়ে উঠে মানুষ। ”
” আপনি অন্তত আমার পক্ষে কথা বলুন। ”
অপরূপা হাসলো। বলল, ” আমি না সবাই চাই আপনার একটা গোছানো জীবন হোক। এভাবে আর কতদিন? একটা সময় গিয়ে ঠিক নিজেকে একা লাগবে। একটা আশ্রয় লাগবে। তখন কিন্তু অনেক দেরী হয়ে যাবে। ”
তাঈফ বলল, ” চাচ্চু ওর সাথে কথা বলার দরকার নেই। বাড়ি নিয়ে চলো। নাদিয়া আপা দেখে নেবে। ওকে একমাত্র আপা সামলাতে পারে। ”
নাদির মেজাজ দেখিয়ে বলল,” এরকম করলে আমি যাব না। ”
বলেই গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। ফজল সাহেব কেদারায় বসে পড়লেন। অপরূপা নাশতা পানি দিল। সোলেমান সাহেব, শেরতাজ সাহেব এলেন বাইরে থেকে। ফজল সাহেবকে দেখে উত্তেজিত হলেন। খুশি হলেন শেরতাজ সাহেব। সোলেমান মাহমুদের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়ার কয়েকমুহূর্তের মধ্যে ভালোই গল্প জমে উঠলো তাদের মধ্যে। আলিজাও এসে যোগ দিল সেখানে তার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করার জন্য। তার আলোচনার মূল কথা হলো, হরিণছানাটাকে তাকে ধরতে দিচ্ছে না কালু ভাইচান আর কালু ভাইচানের বুন্ধু। ফজল সাহেব তাকে কোলে তুলে আদরে ভরিয়ে দিয়ে অপরূপার উদ্দেশ্যে বললেন, ” তোমার মা সারাক্ষণ এটার কথা বলে। ”
অপরূপা বলল, ” মাকে নিয়ে আসবেন এরপরের বার। আমি তো ভেবেছিলাম এবার আসবে। ”
” আসবে। আমি নিয়ে আসবো। ”
অপরূপা মিষ্টি হাসলো। তন্মধ্যে সদরকক্ষে শেরহামের প্রবেশ। তাকে দেখামাত্রই ফজল সাহেব বলে উঠলেন,
” আরেহ বাড়ে সুলতান। কি খবর আপনার? ”
অপরূপা চলে গেল। শেরহাম ফজল সাহেবের হাতে হাত মিলিয়ে বলল,
” এইতো আছি। কখন এলেন? ”
শেরতাজ সাহেব সোজা হয়ে বসলো। ছেলেটা সবার সাথে হেসেমেতে কথা বললে উনার ভালো লাগে। শান্তি পান। মনে হয় আর কিছু চাওয়ার নেই এ জীবনে। নাতির মুখটা দেখলে তো বুকটা ভরে উঠে খুশিতে। এই ছেলেটাকে হারিয়ে কি তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভালো ছিলেন? উত্তর আসবে না, এক মুহূর্তও উনি আনন্দ পাননি, শান্তি পাননি, তার কর্মের কথা মনে হলে বুক পাথর হতো ঠিক, কিন্তু ভালো কিছু খেতে নিলে, মহলে কোনো মেলা মজলিশ হলে নিজের রক্তের কথা মনে পড়তো উনার। ভাবতেন, ছেলেটারও একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ হতে পারতো। উনার সেই দীর্ঘশ্বাস বোধহয় উপরওয়ালা সইতে পারেননি। কত বড় রহম করলেন উনি। জায়নামাজে বসলে শুকরিয়া জানিয়ে শেষ করে উঠতে পারেন না উনি।
আলিজা এতক্ষণ শেরহামকে দেখছিলো। ওমা এটাতো তার কালুআব্বা। সে খুশি হয়ে চিক্কুর দিয়ে বলল,
” অ্যাই কালুআব্বা! ”
শেরহাম ভুরু নাচালো। দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,
” আসি আপনারা গল্প করুন। ”
সে পা বাড়াতেই আলিজা দৌড়ে এল। তার সামনে পথ আটকে দাঁড়ালো। কোমরে হাত দিয়ে বলল,
” দিরি কচচো কেন আবাল? কালু ভাইচানেল আম্মাকে বোকা দিচো কেন? আল কলবে?”
শেরহাম তার সামনে হাঁটুভেঙে বসে বলল,
” কি করবে তুমি?”
আলিজার তার কাছে এগিয়ে এল। গলা জড়িয়ে ধরলো। শেরহাম তাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। গালে টাপুসটুপুস আদর করে উপরে তুলে বলল,
” আঙুর খাবে?”
আলিজা মাথা নাড়লো। তারপর যেতে যেতে শেরহামের মুখ তার দিকে ফিরিয়ে জানতে চাইলো,
” আল দুচতুমি কলবে?’
শেরহাম হো হো করে হেসে উঠলো তার কথায়।
,,,,,,
মহলের মেহমান আর পুরুষ লোকেদের জন্য রাতের খাবার সাজানো হয়েছে। সায়রা, শবনম, আয়শা মিলে টেবিল সাজিয়েছে। তাদের সাথে ছোটাছুটি করে কাজ করছে আলিজাও। তার কাজ ছিল রসাইঘর থেকে একটা একটা করে গ্লাস আনা। যদিও সেই দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়নি। কেঁদেকেটে জোরজবরদস্তি করে সেই দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সানন্দে কাজ করে যাচ্ছে। তার হাত থেকে গ্লাস পড়ে ভেঙে যাবে এই ভয়ে বারংবার সতর্কবাণী এলেও সে মনের আনন্দে কাজ করে যাচ্ছে। গ্লাস এনে দেয়ার পর তার দায়িত্ব পড়লো, সবাইকে ডেকে আনা। সদরকক্ষে তার বাপ, চাচা, জেঠা, দাদা, মেহমান, ভাই সকলেই উপস্থিত। সে নেচে-কুঁদে সদরকক্ষে গিয়ে বলল তার আব্বাকে বললো, খেতে যাওয়ার জন্য। তারপর সাফায়াতকে বললো। তারপর নাদিরকে, তারপর কাশিফকে। তারপর তার দাদাদের। তারপর এল কালু ভাইচানের আব্বার কাছে। আঙুল তুলে নেড়েনেড়ে সে তার প্রিয় কালু আব্বাকে শুধালো,
” তুমি আমাল চাথে ভাতু খাবে? ”
সকলেই ইতোমধ্যে প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত। তার কথায় সকলেই পরোক্ষ কর্ণপাত আর দৃষ্টিপাত করলো তাদের দিকে। শেরহাম তার পা লম্বা করে টেনে কেদারায় হেলান দিয়ে বসতেই আলিজা তার পায়ের উপর ভর দিয়ে গা বেয়ে উপরে উঠে গলা জড়িয়ে গালে গাল ঘষে টুপ করে চুমু দিয়ে বলল,
” তুমি আমাল আব্বাল চাথে ভাতু খাবে? ডাডাভেইয়ার চাথে খাবে? মোজা মোজা কলে মাংচো দিয়ে ভাতু খাবে? ”
শেরহাম ভুরু কুঁচকে বলল,
” না খেলে কি করবে? ”
দুহাত দিয়ে তার গালটা নিজের দিকে ফিরিয়ে আঙুল নেড়ে নেড়ে আলিজা জিজ্ঞেস করলো,
” আবাল কালু ভাইচানেল আম্মাল চাথে খাবে? ”
শেরহাম তার এরূপ প্রশ্ন শুনে হো হো করে হাসতে হাসতে বলল,
” কে বলেছে এসব কথা? ”
আলিজা তাকে হাসতে দেখে নিজেও খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
” আলিচা বুলছে। ”
শেরহাম তাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল, আলিজার সাথে খাব।
যেতে যেতে শেহজাদ হাসিমুখে আরও একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো তাদের দিকে।
আলিজার আদুরে আবদারে, মেহমানদের ডাকাডাকিতে শেরহাম বহুদিন পর এক টেবিলে সবার সাথে বসে খেল। আর খাবার টেবিলে তার উপস্থিতিতে সবার চোখমুখে যে অদ্ভুত দীপ্তি, আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছে যা নজর এড়ানোর মতো নয়। শেরতাজ সাহেবে বহুবছর পর যেন অন্যরকম তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন। আড়ালে যে উনার চোখদুটো বারংবার ভিজে ভিজে উঠছিলো তা শেহজাদের কাছে আড়াল ছিলনা । ভাইজানের অবস্থার জন্য মনে মনে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করা সেও আজ নিষ্কৃতি পেল যেন। ভাইজান মহলে আসার পরও তারা একসাথে বসে খেয়েছে, অথচ তখন একে অপরের প্রতি কত রোষ, ক্রোধ, ক্ষোভ। সে এক অচেনা শেরহাম সুলতান ছিল। আর আজকের মানুষটা একাই সুলতান বংশের দীপাধার। গর্বে, উল্লাসে, আনন্দে, শৈশবের স্মৃতি রোমন্থনে শেহজাদ বুক ভার হয়ে আসে। গলায় ভাত আটকায়। এমন একটা দিনই তো সে চেয়েছিলো তার জীবনের সমস্ত পূণ্যের বিনিময়ে।
তটিনী বিছানায় চাদর বিছিয়ে দিতে দিতে বলল
” আব্বা তোমাকে কিছু বলেছে? ”
শেরহাম কেদারায় ভাবুক হয়ে বসেছিলো। জবাব দিল, ” না। কেন?”
” এমনি। ”
তটিনী চাদর বিছানো শেষে তার পেছনে এসে গলা জড়িয়ে ধরে গালে ফটাফট কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল,
” আজকে একসাথে খেয়েছ তাই আমি খুব খুশি। তুমি জানো, সবাই কত খুশি হয়েছে। ”
” জানি। তুই সর। আমি ঘুমাবো। মাথা-ব্যাথা করছে। ”
” তেল মালিশ করব? এতদিন ঘুম হয়নি তাই হয়ত। দেব? ”
” হ্যা। ”
তটিনী তেল এনে তার মাথায় মালিশ করে দিল। শেরহাম চোখ বুঁজে এলে তটিনী বলল,
” বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো। ঘুম আসছে তোমার। উঠো। ”
শেরহাম বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। তটিনী পায়ে হাত দিতেই শেরহাম বলল,
” পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিস কেন? ”
তটিনী তার পা দুটো কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” চুপ। একশো বার দেব। ”
পায়ের তালুতে তেল মালিশ করে দিয়ে আঙুলগুলো টেনে টেনে দিতে দিতে বলল,
” তোমাকে একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হচ্ছে না। নাদির মেহমাদকে তোমার কেমন লাগে?”
শেরহাম চোখ বুঁজা অবস্থায় বলল,
” ভালো। ”
তটিনী হঠাৎই উত্তেজিত চিত্তে বলল,
” শবনমের সাথে কেমন হবে? ”
শেরহাম ফট করে চোখ মেললো। সেও তো তা ভেবে আসছে গতকাল হতে। কিন্তু বলার সুযোগ পাচ্ছেনা। তটিনী তার পাশে শুয়ে চুলে হাত দিল পুনরায়। কপাল ও চুলে মালিশ করতে করতে বলল,
” বলো। শবনমের সাথে কিন্তু আগে উনার নিকাহর কথা হয়েছিল কিন্তু তখন কেউ রাজী ছিল না। ”
শেরহাম বলল, ” তুইও আমার মতো ভাবছিস? ”
তটিনী জিজ্ঞেস করলো, ” তুমিও তা ভাবছিলে? ”
” হ্যা, ছেলে ভালো। যদিও একটু গোঁড়ামি আছে। ”
” তোমার মতো আর কি। ”
বলামাত্রই তটিনী জিভে কামড় খেল। শেরহামের চোখদুটো বড়বড় হয়ে এল। তটিনী তার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে বলল,
” ওরেবাপরে আর বলব না। মাফ করো ভাই। ”
শেরহাম হেসে ফেললো নিঃশব্দে। তটিনীকে বুঝতে না দিয়ে বলল,
” ছাড়। ”
তটিনী ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে চাইলো। যখন দেখলো বিপদসংকুল কেটে গিয়েছে তখন ফিক করে হেসে বলল,
” আমি এই ঘাড়ত্যাড়াটাকে নিয়ে খুব খুব সুখে আছি। তাহলে শবনম কেন নয়? আর তুমি জানো মনে হচ্ছে শবনমও সেটা চায়। আমি সিভানের কাছ থেকে নাদির মেহমাদের খবর নিতে শুনেছি। কিন্তু ওর তো মা বাবা কেউ নেই। আব্বা বোধহয় এটা মানবেন না। নাদির যেখানে চায় না সেখানে..
” ও চায় না তোকে বলেছে। ”
তনী মুখ গোমড়া করে বলল, ” ডাক্তার বাবুই তো বলছিলো ওই বিয়েশাদি করতে চায় না। ”
” শবনম হলে করবে। ”
তটিনী অবাক গলায় বলল, ” তুমি কি করে বুঝলে? ”
” জানিনা মনে হলো। ”
তটিনী তার চুল মালিশ করে দিয়ে কপালে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল,
” ঘুমাও। আমি শোহরাব কোথায় দেখি। ওদের ব্যাপারটা আম্মার কানে তুলে দেব। বাকিটা যা হয় হবে। ”
শেরহাম বলল,
” আর কিছুক্ষণ থাক। ঘুম এলে চলে যাস। ”
বলেই তটিনীকে বুকের নীচে টেনে নিল। তটিনী তার বুকে লেপ্টে বলল,
” ঘুমিয়ে গেলে নিজেকে ছাড়িয়ে নেব কি করে? ”
” দরকার নেই। ”
পরম শান্তিতে চোখ বুঁজলো তটিনী।
ঘুমের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষের দিকে পা বাড়িয়েছিলো নাদির আর কাশিফ। শবনম, সায়রা আর আয়শা সেই পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো। দেখা হয়ে যাওয়া সায়রা আর আয়শার সাথে নাদির আর কাশিফকে পরিচয় করিয়ে দিল শবনম। কাশিফ বলল,
” মহলে আসার পর এতগুলো মেয়ে দেখছি, কার কি নাম সব ভুলার পথে। ”
সবাই হেসে ফেললো। সায়রা বলল,
” এই বয়সে এত ভোলা হলে চলবে? ভালোভাবে খাওয়াদাওয়া করেছেন?”
কাশিফ মাথা চুলকে বলল, ” কি যে বলেন না। কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছি। শবনম তো জানে আমরা কি খেয়ে বেঁচে আছি। ”
শবনম হাসলো। বলল,
” শুভ রাত্রি। ”
নাদির মৃদু হাসলো। কাশিফ বলল,
” শুভ রাত্রি। ”
তারা যে যার কক্ষপথে চলে গেল। নাদির কক্ষে গিয়ে দেখলো তাদের কক্ষে জগ রাখা নেই। অথচ কাশিফের সেকেন্ড পানি খাওয়া লাগে। সে পানির জগের খোঁজে বের হতেই শবনমকে দেখতে পেল। শবনম তাকে দেখে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
” কিছু দরকার? ”
” এক জগ পানি। গ্লাস আছে এখানে। ”
” আনছি। ”
শবনম পানির জগ নিয়ে এল। নাদিরের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
” আপনার হাতের ক্ষতের জন্য ঔষধ খাচ্ছেন? ”
” হ্যা, না খেলেও অত ক্ষতি হবে না। ”
শবনম ভুরু কুঞ্চন করতেই নাদির বলল,
” ব্যাপার না। ”
শবনম স্বাভাবিক হয়ে বলল,
” আপনার পোশাক গুলো দিয়ে দেব। যাওয়ার পূর্বে দেখা করবেন। অন্যের জিনিস রাখতে চাই না নিজের কাছে। ”
নাদির বলল,
” কিছু জিনিস রেখে দিলে সমস্যা হয় না। ”
” আমি রাখতে চাইনা জনাব মেহমাদ। ”
বলেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। কয়েক পা গিয়ে আবারও কেন যেন থামলো। ঘাড় ফিরিয়ে জানতে চাইলো,
আরেকটা কথা, ” আমার ভাইজানদের কাছে মুক্তিপণ চাইলেন না? ”
নাদির তৎক্ষনাৎ জবাব দিল,
” আপনি থেকে যেতে চাইলে দাবী করতাম। ”
” উল্টোটা কেন? ”
” দাবী হালাল হতো। ”
শবনম অব্যক্ত মনোবাসনা তার চোখদুটোতে চকচক করছে তখন। ঢোক গিলে মিহিস্বরে বলল, ” থেকে যাব। আপনার দাবী পেশ করুন। ”
হঠাৎ চোখ ছুটে যাওয়ায় নিজের বুকের সাথে তটিনীকে লেপ্টে থাকতে দেখে শেরহাম খ্যাঁক করে উঠে বলল,
” ওই তুই আমার ছেলেকে কোথায় রেখে এসে এসে ঘুমাচ্ছিস তনীর বাচ্চা?’
তটিনী ঘুমজড়ানো চোখে বলল,
” নাই। ”
শেরহাম বলল,
” ওঠ। ওকে নিয়ে আয়। ”
তটিনী তার গায়ের উপর পা তুলে দিয়ে আরাম করে ঘুমাতে ঘুমাতে জবাব দিল,
” যাহ ব্যাটা, চুপ থাক। ”
শেরহাম হো হো করে হেসে উঠে তটিনীর গালে দাঁড়ি ঘষতে ঘষতে বলল,
প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১৯+২০
” তোর ঘুমের মাইরে বাপ। ওঠ। ”
তটিনী চোখমুখ কুঁচকে বিড়বিড় করছে। শেরহাম হেসে যাচ্ছে। হাসির চোটে সে বুঝতেই পারলো না তার গালে কখন বিষদাঁত বসে গিয়েছে।