প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ২৫+২৬
পুষ্পিতা প্রিমা
মেহেদী সন্ধ্যা উপলক্ষে দলদলে অতিথিদের আগমনে মুখরিত সুলতান মহলের আঙিনা। বহুদিন পর সুলতান মহল জমকালোভাবে সেজেছে। শবনমের জন্য মেহেদী বাটা হয়েছে। মহলের মেয়ে-বউদের জন্য যেসব পোশাক-আশাক, সাজগোছের জিনিসপত্র কেনা হয়েছে তা যার জিনিস তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো হামিদা আর শাহানা। অপরূপাও আছে উনাদের সাথে। শাহানা অপরূপা আর তটিনীর জন্য আনা শাড়িগুলো তাদের ভাগ করে দিয়ে দিল। তাদের পোশাক অন্যদের চাইতে আলাদা। তারপর আয়শা, সায়রা, সোহিনী আর হুমায়রার পোশাকগুলো একে একে দিয়ে দিল তাদেরকে। আলিজার জন্যও শাড়ি কেনা হয়েছে। তার শাড়িটা দেখে সবাই হেসে কুটিকুটি। সেও ভীষণ খুশি শাড়ি পেয়ে। সেটা নীচে গিয়ে সবাইকে দেখিয়েও আনলো। সন্ধ্যার দিকে নাদিরের বাড়ি থেকে কয়েকজন লোক এসেছিল বউয়ের জিনিসপত্র নিয়ে। সেখানে বিয়ের শাড়ি, গহনা আর সাজগোজের জিনিসপত্র ছিল। মেহেদী সন্ধ্যায় পড়ার জন্যও শাড়ি পাঠিয়েছে তারা। সুরমা, আতরসহ আরও ছোটখাটো নানান জিনিস।
শবনম তার চেহারা নিয়ে চিন্তিত। আরশির সম্মুখে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো তার সারামুখ দাগে ভর্তি। দাগগুলো এখনো তাজা। এগুলো ফিকে হতে মাস কয়েক সময় লাগবে। নাদিরের বাড়ি থেকে আগত সবাই বালুচরী দ্বীপের ঘটনাটি জানায় শবনমকে অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়নি কিন্তু যখন সে ওই বাড়িতে যাবে তখন তো অনেকেই তাকে দেখবে। তখন বলবে, নতুন বউয়ের মুখে কি শ্রী গো ভাবা! কত দাগ! তখন সে কত লজ্জায় পড়বে ভাবতেই গা শিউরে উঠলো। নাদিরের সামনে তাকে কেউ কুৎসিত বললে সে তা সহ্য করতে পারবে না। নিজেকে খুব ঘৃণিত, অসুন্দর মনে হবে তার। কিন্তু যখন সে মেহেদী সন্ধ্যায় হলুদাভ সাজে সাজলো তখন দেখলো তার মুখভর্তি কাটাছেঁড়ার দাগ ফিকে হয়ে গিয়েছে তার বধূ সাজের কাছে। আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে মনে মনে আওড়ালো, আমি মোটেও অসুন্দর নই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তটিনী আর অপরূপার ভাগে বেনারসি শাড়ি পড়েছে। দুজনের শাড়ির রঙ লাল টকটকে। দুজনের শাড়ির রং লাল হওয়ার পেছনের কারসাজি খোদেজার। তিনি শেহজাদকে বলেছেন যাতে বউদের শাড়ির রং লাল হয়। দুজনের নিকাহ হওয়ার পর তাদের কখনোই লাল শাড়ি পড়তে দেখেননি উনি। মহলের দুই বেগম এবার লাল শাড়ি পড়বে। অপরূপার শাড়ি পছন্দ হয়েছে। তার মনে আছে এইরকম শাড়ি সে প্রথম পড়েছিল যখন তার জীবনে নেমে এসেছিল চরম দূর্বিষহ। কি এক অদ্ভুত মায়াজালে বন্দিনী সে আগপিছু কিছু না ভেবে এমন একটা লাল রঙা শাড়ি গায়ে দিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল। আর কাকতালীয়ভাবে এসে পড়েছিল এই সুলতান মহলে। কেমন এক টানাপোড়েনের দিন ছিল সেসব। ভাগ্য তাকে কোথা হতে কোথায় গড়িয়ে এনেছে।
সেই কুহেলিকাবৃত দিনগুলির কথা মনে পড়লেই তার বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে, চোখ ঝাপসা হয়। ওই দেবদূতের মতো মানুষটা তার জীবনে না এলে কি হতো? সেই চরম দুর্দিনের কথাগুলো সে ভাবতে চায় না। স্মৃতিটুকুও রাখতে চায় না। যে মায়াজাল তাকে এই সুলতান মহলে নিয়ে এসেছিলো, সেই মায়াজাল কাটিয়ে আজ সে সুলতান মহলের এক সুযোগ্য বেগম। কাঁটার আঘাতে ছিন্নভিন্ন তার আজ পুষ্পের বুকে বাস। আল্লাহপাক তার জীবনে এমন একটা মানুষকে দিয়ে তার সমস্ত অপূর্ণতা ঘুচিয়ে দিয়েছেন, তার আর পিছু ফিরে তাকানোর প্রয়োজন পড়েনি কখনো। না কখনো মনে পড়েছে সেইসব দিনের কথা। এতটা সুখী সে আজ, দুঃখ তাকে ছুঁতেই পারে না।
দুরুদুরু বুকে যে মানুষটার হাত সে ধরেছিল সারাজীবন পথ চলবে বলে, যে মানুষটা তার জীবনের সমস্ত আঁধার দূর করে দিয়েছে, তাকে সম্মান দিয়েছে, শান্তি দিয়েছে, নিজেকে চিনতে শিখিয়েছে সেই সূর্যমানবকে সে এখন নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে, সম্মান করে, চোখবুঁজে বিশ্বাস করে। আজ বলতে বাঁধা নেই, উপরওয়ালা তার জন্য যে মানুষকে লিখে রেখেছিল সেই মানুষটিই তার জীবনে শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দর মানব। সেই মানবকে ভালো না বাসতে পারাটাই হতো তার জীবনের সবচাইতে বড় ব্যর্থতা। কিন্তু সে আজ জয়ী। সে এক ন্যায়পরায়ন, সৎ, বীর সম্রাটের প্রিয় বধূ, আর তার দুই সন্তানের মমতাময়ী মা। তার জীবনের কোনো অপূর্ণতা আর অবশিষ্ট নেই। সে আজ নির্ধিদ্বায় নিঃসঙ্কোচে নিজেকে সবচাইতে সুখী একজন মনে করতে পারে।
শবনমের মেহেদী সন্ধ্যাটা বেশ ভালোভাবে কেটে গেল। শেহজাদ, সাফায়াত আর শেরহাম বিয়ের দিনের বন্দোবস্ত নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এবারে অনেক মানুষকে দাওয়াত করা হয়েছে। বহুদিন পর সুলতান মহলে বিয়ের ধুম নেমেছে। সিভান রসাইঘর আর ভাইজানদের মধ্যে বার্তাবাহকের মতো কাজ করে যাচ্ছে।
রসাইঘরে মেহমানদের জন্য খাবার-দাবার পাক করা হচ্ছে। চার-পাঁচজনের মতো নতুন বুয়া আনা হয়েছে। হূমায়রা অপরূপা, তটিনী আর সায়রার সাথে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। বয়স কম হলেও মোটামুটি রান্নাঘরের সব কাজ সে পারে। বুদ্ধি হওয়ার আগ থেকেই সে কাজ করতো দাদীর সাথে। এই মহলে তাকে রেখে দিয়েছিলো তটিনী। তার সন্তানকে শত্রুদের মুখ থেকে যে মেয়ে নিজের প্রাণ বাজি রেখে বাঁচিয়েছিলো সেই মেয়েকে সে নিজের কাছে রেখে বড় করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। তার সমস্ত ভরণপোষণের দায়িত্ব শেরহাম নিয়েছিলো। যদিও তারপরেই হূমায়রাকে মহলের সকলেই সাদরে গ্রহণ করেছিলো। শেহজাদ বলেছিলো, সে সিভানের বোনের মতো হয়ে থাকবে এই মহলে। কাজের মেয়ে হয়ে নয়। তাকে মহলের মেয়েদের মতো করে শিক্ষাদীক্ষা নিতে হবে, অস্ত্র চালনা শিখতে হবে। তার কোনোদিন কোনোকিছুর অভাব হবে না। হূমায়রাও অল্পদিনে মহলের সবাইকে আপন করে নিয়েছিলো। বাচ্চাগুলো তার প্রাণ। বাচ্চাগুলো না থাকলে বোধহয় এই মহলটা তার কাছে অতটাও প্রিয় হয়ে উঠতো না। শোহরাব, আলিজা আর শোইয়াবের কাছে সে প্রিয় হুমাফুপ্পী।
তখন এই ঝগরুটে শেরফাত সুলতানের খেলার সাথী হলেও এখন সে তার ছাত্রী। বছর দুয়েকের পার্থক্য থাকলেও তারা দুইজন বন্ধুর মতো। গৎবাঁধা নিয়ম অনুযায়ী তাকে ছোটসাহেব ডাকতে শেখানো হলেও সিভান সেই সম্বোধনটি পছন্দ করেনা বিধায় হুমায়রাকে নাম ধরে ডাকতে হয় নইলে সিভান উত্তর দেয় না।
আলিজা শাড়ি পড়ার পর থেকে কোলে কোলে চড়ে বেড়াচ্ছে। কারণ সে শাড়ি পড়ে হাঁটতে পারছেনা। কিছুক্ষণ সিভানের কোলে, কিছুক্ষণ হুমায়রার কোলে, কিছুক্ষণ সাফায়াতের কোলে, নয়ত আয়শার কোলে চড়ে বেড়াচ্ছে। শেহজাদ মহলে আসার পরপরই সে শেহজাদের কোলে ঝাঁপ দিয়েছে। শেহজাদ তাকে উপরে তুলে বলল,
” ওহবাবা এটা কে রে? এটা কি আমার আম্মা?”
আলিজা খিকখিক করে হাসতে লাগলো। শেহজাদ গালে,মুখে,কপালে অসংখ্য আদর করে বলল,
” আব্বার আজকে অনেক কাজ মা। তুমি হুমার কাছে থাকো। কেমন?”
হুমায়রার কোলে দিয়ে দিল তাকে। আলিজা হাত নেড়ে টা টা দিল তাকে। হুমায়রা গালে আদর করে বলল, ” পাকনি। ”
আলিজা কোল থেকে নামার পায়তারা করলো। হুমায়রা তাকে নামিয়ে দিতেই সে হাঁটতে হোঁচট খেল, আবারও দাঁড়ালো। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে তটিনীর কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। হুমায়রা তার পিছু যেতে যেতে বলল, ” তোমার কালুআব্বা নাই তো। ”
আলিজা তার দিকে ফিরে আঙুল নেড়েনেড়ে বলল, ” সুপ সুপ হুমা। ”
শেহজাদ তার কক্ষের দিকে এগুলো। দেখলো শোইয়াব হেঁটে হেঁটে আসছে। গায়ে জড়ানো চাদর। চাদরটা শেহজাদের। সেটি শোইয়াবে গায়ে জড়িয়েছে। অনেক বড় হওয়ার দরুন চাদরটি মেঝেতে গড়াচ্ছে। শোইয়াব সেটিকে গড়াতে গড়াতে হাঁটছে। শেহজাদের হাসি পেল। শোইয়াব তাকে দেখামাত্র দৌড়ে এল। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে তক্ষুনি শেহজাদ তাকে ধরে চাদরটা দিয়ে জড়িয়ে কোলে নিয়ে গালে আদর করে বলল, ” কি হচ্ছে এসব? ”
শোইয়াব জবাব দিল, ” ফুচা মিয়ে কুথাও নাই।”
” ফুচা মেয়েকে দিয়ে কি করবেন? ”
” আম্মা ডাচচে। ”
” আম্মা ডাকছে? সে তো হুমাফুপীর সাথে ঘুরছে। আপনি এই চাদর কেন নিয়েছেন? ”
শোইয়াব লাজুক হাসলো। শেহজাদ হেসে তাকে কাঁধের একপাশে তুলে নিয়ে গেল কক্ষে। অপরূপাকে ডেকে বলল,
” রূপা এটা কি? ”
অপরূপা ফিরে চাইলো। হেসে বলল,
” হ্যা আব্বার চাদর পড়ার বায়না ধরেছে, তাই দিয়েছি।”
শেহজাদ চোখ ছোট ছোট করে শোইয়াবের দিকে তাকাতেই শোইয়াব খিক করে হেসে তার গলা জড়িয়ে ধরতেই শেহজাদ মুখ দিয়ে সুড়সুড়ি দিল তার বুকে। শোইয়াব হাসতে লাগলো জোরেজোরে। আলিজা তৎক্ষনাৎ দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে বলল,
” অ্যাই কালু ভাইচানেল বুন্ধু, কালু ভাইচান আল কালুআব্বা কুথায়?”
শেহজাদ আর অপরূপা তার কথা শুনে হেসে ফেললো। অপরূপা তাকে কোলে তুলে নিয়ে এল। শোইয়াবের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,
” ভাইজান ডাকবেন। কতবার বলেছি? ”
আলিজা দুঃখ পেল। ঠোঁট টানলো। শেহজাদ চট করে তাকে বুকে চেপে ধরে বলল,
” রূপা তোমাকে কিন্তু খুব খুব মারবো। ”
অপরূপা হাসতে লাগলো। দুই ভাইবোন চলে যেতেই অপরূপা জানতে চাইলো, ” আপনার খাওয়াদাওয়া হয়েছে নাকি শুধু কাজ করে চলেছেন? ”
শেহজাদ গায়ের পোশাক পাল্টে নিতে নিতে বলল,
” খেয়েছি। তোমার খাওয়া-দাওয়া হয়েছে? ”
” হ্যা। ”
” কাল ভালোই ভালোই বিয়েটা মিটে গেলেই হলো। এখন ঘুমাবো। চোখদুটো জ্বলছে। ”
অপরূপা বলল, ” আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি আলো কমিয়ে দিচ্ছি। ”
শেহজাদ শুয়ে পড়লো। বলল,
” মলম দাও তো একটু। চোখদুটো আর কপালটা টানছে। ”
অপরূপা মলম নিয়ে এল। পাশে বসে কপালে আলতো করে মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বুকে থুঁতনি ঠেকাতেই গরম অনুভব হলো। কপালে হাত দিয়ে দেখলো কপালটা খুব গরম।
” এ কি আপনার তো ভারী জ্বর এসেছে। আমি ডাক্তার বাবুকে বলি দাঁড়ান। ”
শেহজাদ তার হাত ধরে রেখে বলল,
” কিছু লাগবে না। একটা ভেজা কাপড় দাও কপালে। কমে যাবে। ”
অপরূপা জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ঔষধ এনে খাইয়ে দিল। ভেজা কাপড় এনে গা, হাতের তালু পায়ের তালু মুছে দিয়ে কপালে পট্টি চেপে ধরে বলল,
” আপনি এমন কেন? ”
শেহজাদ মিহিস্বরে জানতে চাইলো।
” কেমন? ”
” বড্ড অদ্ভুত! নিজের কথা একটুও ভাবেননা। ”
” তো কার কথা ভাবি? ”
” কারো কথা ভাবেন না। আমাদের কথা ভাবলে কি নিজের এতটা অযত্ন করতেন? ”
শেহজাদ বলল,
” জ্বর সবেমাত্র উঠেছে। আগে শুধু কপালটা টানছিল। আমি সত্যি তোমাদের কথা ভাবিনা? ”
” ভাবেন না। ”
শেহজাদ ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
” তুমি এত চিন্তিত হচ্ছো কেন? ভালো তো বাসো না। ”
অপরূপার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। শেহজাদের চোখে ঘুম। অপরূপা তার কপালের পট্টি সরিয়ে কপালে, গালে, চোখের পাতায় ঠোঁট চেপে বলল, ” শুনছেন?”
” বলো। ”
” আমি কি আপনাকে সত্যিই ভালোবাসিনা? ”
শেহজাদ মৃদু চোখ খোলা অবস্থায় জবাব দিল,
” সেটা আমি জানবো কি করে? ‘
” আপনি না আমাকে পড়তে জানেন। তাহলে এটা কি মিথ্যে বলতেন? ”
” তোমার মুখ থেকে শোনার জন্য যদি নিজেকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করতে হয় তাহলে তাই হোক। ”
অপরূপা চোখদুটো এবার কানায় কানায় ভরে উঠলো। শেহজাদের মুখের দুপাশে হাত রেখে বলল,
” আমার কথা শুনছেন? ”
” হুম। ”
অপরূপা কথা বলতে পারছেনা। তার কন্ঠ থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। সে কপালটা শেহজাদের বুকে ঠেকিয়ে নীরবে চোখের জল বিসর্জন দিল।
মাথা তুলে কান্না দমিয়ে সে বলে ফেললো,
” আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি কি করে বুঝাই। কিভাবে বললে আপনি আর কখনো আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না? ”
কথাটা শেষ করে ঝাপসা চোখদুটো মুছতেই সে দেখতে পেল শেহজাদ ঘুমিয়ে পড়েছে। ফুঁপিয়ে উঠে শেহজাদের পোশাক খামচে ধরে বলল,
” আপনি সব বুঝতে পারেন, এটা বুঝেন না কেন?”
বলেই পুনরায় কপালটা বুকে ঠেকালো। তারপর আচমকা মাথা তুলতেই দেখতে পেল শেহজাদের চোখদুটো খোলা। চালাকি ধরতে পেরে রেগেমেগে হাত ছুঁড়তেই শেহজাদ হাতদুটো ধরে ফেললো। হেসে উঠলো অপরূপার রাগ দেখে। তার বুকের নীচে চাপা দিয়ে কপালে গালে অজস্র চুম্বন করে বলল, ” তোমার বিলম্বিত ভালোবাসা কবুল, কবুল, কবুল। ”
অপরূপা হাত বাড়িয়ে তার বুক জড়িয়ে ধরে শেষ কান্নায় বুক ভিজিয়ে তুললো ক্রমশ।
হাঁটতে হাঁটতে আলিজার শাড়িটা প্রায় খুলে গেছে। সে শাড়িটা কোনোমতে জড়িয়ে ধরে মন খারাপ করে হেঁটে চলে আসছিলো। শেরহামকে দেখামাত্র খুশি হয়ে চিক্কুর দিয়ে ছুটে আসতেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। শেরহাম ছুটে এসে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল
” কেঁদোনা। ”
আলিজা ঠোঁট টানলো। কেঁদে বলল,
” চাড়ি খুনে গেচে। ”
শেরহাম গালে আদর করে শাড়িটা কোনোমতে প্যাঁচিয়ে দিয়ে ঘোমটা পড়িয়ে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” বউ? ”
আলিজা কান্না চেপে হাসলো। বলল,
” দিরি কচচো কেন? ”
শেরহাম অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল,
” আর দেরী করব না। ”
আলিজা আঙুল নেড়ে বলল,
“আল দিরি কললে তুমাকে আমাল আব্বা তাচতাচ মালবে। ”
শেরহাম হো হো করে হেসে উঠে তার পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল,
” হ্যা হ্যা তোর বাপ সবাইকে খালি মারে। ”
আলিজাও তার তালে তালে হাসতে লাগলো ।
শবনমের ঘুম ভাঙতে দেরী হয়েছে। চোখ মেলার সাথে সাথে দেখতে পেল তার আশেপাশে এখনো আয়শা, আর হুমায়রা ঘুম। হুমায়রার পাশে বসে আলিজা বকবক করছে। গাদাফুলের মালা পড়া তার হাতে। সেটা নেড়েচেড়ে বকবক করে যাচ্ছে। শবনম চোখ ঢলে জিজ্ঞেস করলো,
” মা কি করে? ”
আলিজা তার দিকে ফিরে চাইলো। হাত নেড়েচেড়ে দেখিয়ে বলল,
” ইতা। ”
শবনম হাত বাড়িয়ে ডাকলো, ” ফুপীর কোলে আসো তো। ”
আলিজা চলে এল। শবনমের কোলে বসতেই, শবনম তাকে জড়িয়ে ধরে গালে কপালে আদর দিয়ে বলল
” ভাইজানদের ডেকে আনুন। যান। ”
” আচচা। তা তা চবনমফুপ্পী। ”
দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল সে।
শবনমের বুক ভার। এদের ছেড়ে সে কিভাবে থাকবে?
শোইয়াব আর শোহরাব খেলছিলো।
আলিজা শোহরাবের পেছনে গিয়ে বলল,
” অ্যাই কালু ভাইচান আচো আমাল চাথে। অ্যাই ভেইয়া আমাল চাথে আচো। ”
শোহরাব শোইয়াবের দিকে তাকালো। দুপাশে মাথা নেড়ে জানালো সে যাবে না। শোইয়াব বলল,
” আমলা যাবুনা। ”
আলিজা কান্নাচোখে চেয়ে থাকলো। চলে যাওয়ার সময় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পারে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। শোইয়াব আর শোহরাব ছুটে এল। দুই ভাই তাকে টেনে তুললো। শোহরাব বলল,
” তুমি বিথা পাইচো?”
শোইয়াব মুখ দু-হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
” কানিওনা কিমন?”
আলিজা পিটপিট করে চেয়ে হাতের তালু দ্বারা গাল মুছে শোহরাবের মুখের দিকে ঝুঁকে বলল,
” তুমি আমাল চাথে কথা বুলচো? আল লাগ কলবে কালু ভাইচান?”
শোহরাব চুপ করে রইলো। শোইয়াব বলল,
” তুমি ফুচা। কালু ভাইচান ডাকচো কেন আবাল? তুমাল চাথে কথা বুলবে না ভাইচান। ”
আলিজা ভয়ংকর রেগে গেল। দু’হাতে দুই ভাইকে ঠাসঠাস মেরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দৌড়ে দৌড়ে চলে এল শবনমের কক্ষে। আয়শা আর হুমায়রার মাঝখানে কাঁথার মধ্যে ঢুকে চুপটি করে ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইলো। বিড়বিড় করলো,
” কালু ভাইচান ফুচা, কালু ভাইচানেল বুন্দু বুচা। ”
আয়শা তাকে বুকে টেনে নিয়ে ভাবলো, ওমা পাখি আজ তাড়াতাড়ি উঠলো না কেন ঘুম থেকে? অন্যদিন তো ভোরের কাক উঠার আগে সে উঠে যায়।
মহল প্রাঙ্গনে খাওয়া দাওয়া চলছে। শবনমের সাজগোছ এখনো চলছে। তার পাশাপাশি সবাই সাজগোছ করছে। তারমধ্যেই খবর এল বরযাত্রীর জাহাজ ঘাটে এসে পৌছে গেছে। কাজীও হাজির। শবনমের সাজ সম্পন্ন করার তাড়া দিল শেরহাম। তটিনী সাজঘরের ভেতর হতে জবাব দিল, ” হয়ে গেছে।”
শেরহাম বলল, ” শোহরাবকে কাপড়চোপড় পড়িয়ে দিসনি কেন? তোর বিয়ে যে তুই সকাল থেকে সেজে চলেছিস?”
তটিনী বের হয়ে এল। শেরহামের চোখাচোখি হওয়ার সাথে সাথে মুখ মোচড়ে দিয়ে বলল,
” ফকিন্নির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি এখনো। শুধু বড় বড় কথা। আমাকে ছাড়া কিছু পারো না? দশটা তো না, একটামাত্র ছেলে। সেটাকে কাপড়চোপড় পড়িয়ে দিতে পারছে না। ঢং। ”
বলেই হনহনিয়ে কক্ষের দিকে এগুলো। শেরহাম তার পেছন পেছন গেল। শোহরাব উদাম গায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনো। তটিনীকে দেখামাত্রই হাসলো। তটিনীও হাসলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আগে আদর-সোহাগ করে নিল। তারপর তার নতুন পাঞ্জাবি-পায়জামা পড়িয়ে দিয়ে আতর মেখে দিল। বলল,
” যাও ভাইয়ের কাছে। ”
শোহরাব শেরহামের সাথে গলাগলি করে চলে গেল। তটিনী শেরহামের পাঞ্জাবি পায়জামা বের করে দিয়ে বলল,
” তোমাকেও পড়িয়ে দিতে হবে? ”
শেরহাম বলল,
” যাহ, দূর হ। ”
তটিনী জিভ দেখিয়ে বের হয়ে গেল। সে গোসলখানায় ঢুকেছে সবে তারমধ্যেই শেরহামের ডাকাডাকি। তাড়াহুড়ো করে গোসল শেষ করে এসে বলল
” সমস্যা কি? ”
” আমার আতরটা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না। বরযাত্রী এসে পড়বে এখন। ”
তটিনী আতর খুঁজে দিল। বলল,
” চোখ হাতে রেখে ঘুরো? ”
শেরহাম আতরটা নিতে চাইলো। তটিনী দিল না। বলল,
” কান ধরো। আমাকে অনেক গালাগালি করেছ। ”
” তনীর বাচ্চা রাগাবি না। তাড়াতাড়ি দে। ”
” কানে ধর শেরহামের বাচ্চা। ”
শেরহাম হা করে চেয়ে রইলো। তটিনী তাকে পিছু করে দাঁড়িয়ে চুল থেকে গামছা ছাড়িয়ে চুল ঝাড়লো। ইচ্ছে করে এমনভাবে চুলগুলোকে পেছনে নিয়ে গেল যাতে শেরহামের মুখে পানির ছিটে পড়ে। শেরহাম তার বাহু চেপে ধরে বলল,
” এক চড় মেরে দাঁত সবকটা ফেলে দেব। আতরটা দে।”
তটিনী জেদ ধরে বলল,
” দেব না। কি করবে করো। ”
শেরহাম তার কোমর টেনে কাছে নিয়ে এল। শক্ত করে ধরে হাতটা চেপে ধরে আতরটা কেড়ে নিয়ে হেসে উঠে বলল,
” সিংহের সামনে তুই পুঁচকে ইঁদুর। ”
তটিনী আতরটা কেড়ে নিল পুনরায়। গায়ে মাখিয়ে দিতে দিতে নাকেও ঢলে দিল। শেরহাম কপাল কুঞ্চন করতেই তটিনী বলল, ” আমি ইঁদুর? তাহলে ইঁদুরের দাঁতের কামড় খাও।”
বলেই শেরহামের বাহুতে দাঁত বসিয়ে দিল। শেরহাম ঘাড় ধরে ঠেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল কক্ষ হতে।
নাদির প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়েছিলো শেহজাদ, সাফায়াত আর শেরহামের সাথে। তাদের সাথে কথা বলছিলো। শাহানা সাফায়াতকে ডেকে বলল,
” নতুন বরকে আমি মিষ্টিমুখ করাবো না? তোমরা সকলেই ওখানে দাঁড়িয়ে আছ। আজব! ”
সাফায়াত নাদিরকে নিয়ে এল। শাহানা তাকে মিষ্টিমুখ করিয়ে বলল,
” আসার সময় কোনো অসুবিধে হয়নি তো বাবা? ”
” না। ”
কাশিফ প্লেট থেকে মিষ্টি তুলে মুখে পুরে বলল,
” অসুবিধে হবে কেন? বরঞ্চ পথ কেন ফুরোচ্ছে না এ নিয়ে বেচারা কি যে অস্থির। ”
নাদির তার পিঠে কিল বসিয়ে বলল, ” চুপ থাক। ”
উপস্থিত সকলেই হো হো করে হেসে উঠলো। কাশিফ মিষ্টি খাওয়া শেষে আয়শাকে ডেকে বলল,
” জনাবা লাইশা খাতুন, এক গ্লাস পানি হবে? ”
আয়শা হতভম্ব।
” লাইশা খাতুন কে? ”
” কেন, আপনি। ”
” আমার নাম আয়শা। ”
” আচ্ছা, আয়শা খাতুন, এক গ্লাস পানি দিয়ে এই অধমের প্রাণ বাঁচান। ”
আয়শা রেগে বলল,
” আমার নাম আয়শা মাহমুদা। খাতুন নয়। ”
” আগে পানি খাওয়ান তারপর শেখাবেন খাতুন নাকি ফাতুন। ”
আয়শা হনহনিয়ে চলে গেল। হুমায়রা পানি নিয়ে এল। কাশিফ তাকে মজা করে বলল,
” তোমার নাম কি? তুমি কয় নাম্বার বোন? ”
হুমায়রা বলল,
” আমি তো আয়শা বুবুর ছোট। ”
” তারমানে আয়শা খাতুনের বোন লাইশা খাতুন। ”
হুমায়রা ফিক করে হেসে উঠে বলল,
” আমি হুমায়রা। লাইশা খাতুন নয়। ”
কাশিফ হেসে উঠে তার মাথা নেড়ে দিয়ে বলল, ” পানির জন্য ধন্যবাদ পুঁচকি। ”
পর্দার এপাশওপাশ বরকনে বসা। কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। শবনমের পাশে, তটিনী অপরূপা আর সায়রা বসেছে। বরের পাশে বরের মামারা আর কনের বাবা, মামারা বসা। পেছনে শেহজাদ, শেরহাম, সাফায়াত বসেছে।
কাজীসাহেব বিবাহের খুতবা পাঠ শেষে ইজাব পেশ করে নাদিরের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ সোলেমান মাহমুদের সুকন্যা শবনম মাহমুদাকে একশ এক পয়সা মোহরানায় আপনার কাছে বিবাহ দিলাম, আপনি বলুন ‘কবুল’। ‘
শবনমের বুকটা ধুকপুক করছে। বর এসেছে সে শুনেছে। কিন্তু এখন অব্দি চোখের দেখায় বরবেশে নাদির মেহমাদকে সে দেখেনি। সত্যিই কি সেই মানুষটার সাথে তার নিকাহ হচ্ছে? সেই মানুষটা? যার মৃত্যুর খবর শোনার পর ছটপট করতে করতে তার অগুনতি নির্ঘুম রাত কেটেছে। কি এক অবিমিশ্র যন্ত্রণা! কোনো নাম নেই, কারণ নেই। নিজেও নিজেকে বুঝ দিতে পারছিল না তখন। যে তার কেউ হয়না, যার সাথে তার কিচ্ছু নেই তার অমন দুঃসংবাদটা শুনে কেন তার অমন লেগেছিল সে কাউকে তা বলতে পারেনি, না নিজেকে বুঝাতে পেরেছে। অথচ আজ সেই মানুষটিই ঘুরেফিরে তার জীবনে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। যে হবে চিরসঙ্গী। কিন্তু এত সময় নিচ্ছে কেন?
সমস্ত প্রতীক্ষা, অপেক্ষার অবসান ঘটলো অবশেষে। শবনম গম্ভীর কণ্ঠে শুনতে পেল,
‘ কবুল। কবুল। কবুল। ‘
কাজী হাসিমুখে তাকে বললেন,
‘ কন্যা আপনি বলুন ‘ কবুল’।
অপরূপা আর তটিনী তার কাঁধে হাত রেখে ভরসা যুগিয়ে বলল, ” কবুল বলো। ”
শবনম তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তটিনী বলল,
” এমন সুন্দর সময়, সুন্দর মুহূর্ত সবার জীবনে আসেনা। আমার জীবনে আসেনি। তুমি ভাগ্যবতী। বলো। ”
শবনম ঠোঁট ভেঙে কান্না আটকে বলল,
” কবুল, কবুল, কবুল। ”
সকলেই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।
তটিনীকে জড়িয়ে ধরলো শবনম। কেঁদে উঠলো দুই বোন।
কাজী সুন্নতি দোয়া পাঠ করলেন তাদের দাম্পত্য জীবনের জন্য।
‘ আল্লাহ তোমাদের ওপর বরকত দিক ও তোমাদের দুজনকে কল্যাণের সঙ্গে মিলিত করুক।”
বিবাহকার্যাদি মিটে যাওয়ার শেষে শবনম স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নতুন জীবনের দিকে এগিয়ে চললো। দুয়ারে দাঁড়িয়ে সজলনেত্রে সবাই তাকে বিদায় জানালো।
জাহাজ করে আসার পথে পুরোটা পথ শবনম ঘুমিয়ে ছিল। নাদির পাশে বসায় মাথাটা হেলে পড়েছিলো তার বাহুতে। নতুন বউকে যদিও আলাদা করে বসানো হয়েছিলো তাই সেখানে কারে হস্তক্ষেপ ছিল না। তাই নাদির তাকে আগলে রেখেছে পুরোটা পথ। ঘুমিয়ে পড়ায় ভালো হয়েছে। নইলে সারাটা পথ কেঁদেকেটে ভাসাতো। মাঝপথে শবনমের ঘুম ভেঙেছে, আর তখন সে দেখতে পেল নাদির নিজেই ঝিমুচ্ছে। মাগরিবের আজান পড়েছে সেই কখন। এশার আজানের সময় হয়ে এসেছে। শবনম নাদিরের দিকে চোখ রেখে বাইরে একবার চোখ রাখলো। বড়বড় সাহাজ, ট্রলার দেখা যাচ্ছে। অসংখ্য মশাল জ্বলছে। কি জোড়ালো ভাবে বাতাস বইছে। অথচ জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে করছেনা ওর। নাদিরের হঠাৎ চোখ খুলে যেতেই সে দেখলো শবনম শুকনো মুখে তার দিকে চেয়ে আছে। শবনমের শীত লাগছে বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, ” শীত?”
শবনম উপর-নীচ মাথা নাড়লো। নাদির উঠে গেল। নাদিয়ার কাছে একটা চাদর নিয়ে এল। শবনমের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল,
” ওখানে কি দেখছেন? ”
শবনম উত্তর দিল ” মাছের ট্রলার। দেখুন কতগুলো মাছ। ”
” হুমম। ”
শবনম পুনরায় তার দিকে ফিরলো। বলল, ” আর কতদূর? ”
” বেশি না। ”
” রূপনগর থেকে অতদূর? আমি কি বছরে ছমাসেও রূপনগরে আসতে পারবো না? ”
” কেন পারবেন না? যখন ইচ্ছে তখন আসতে পারবেন। ”
” সত্যি? ”
তার জিজ্ঞেস করার ধরণ দেখে নাদির হেসে ফেললো। বলল,
” আমি আপনাকে বন্দী করে রাখবো বলে মনে হয়? ”
শবনম তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর বলল,
” না। ”
নাদির হাসলো। শবনমের বাম হাতটা তার দু হাতের জিম্মায়। দুহাতের মাঝখানে শবনমের ঠান্ডা হাতে উম ঢেলে দিতে দিতে সে ভাবতে লাগলো আর কতক্ষণ লাগতে পারে। শবনম হাতের দিকে একপলক চেয়ে পুনরায় বাইরে দৃষ্টি রাখলো। ডান হাতে গাল মুছ নিতে নিতে আবারও গাল ভিজে উঠলো। একদিনও হয়নি সে সুলতান মহল ছেড়েছে অথচ মনে হচ্ছে কতকাল সবাইকে সে দেখেনা। বুকের ভেতর ফাঁকাফাঁকা লাগছে। মেয়েদের এত বড় বিসর্জনের কথা কেন আলোচিত হয় না? এর চাইতে বড় বিসর্জন কি হতে পারে? নিজের মা বাবা, ভাই বোন, আপনজনদের ছেড়ে অচেনা, অজানা, অল্পদিনের চেনাপরিচিত মানুষদের সাথে অন্য জীবনে পা দেয়া এ চাট্টিখানি কথা নয়। সে তো জীবনটাকে এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি। তার চাইতে সায়রা, বড় আপু কত ভাগ্যবতী। তাদের আপনজনদের ছেড়ে যেতে হয়নি। আজ শবনম বুঝতে পারছে, কেন সোহিনী প্রত্যেকবার যাওয়ার সময় কান্নাকাটি, আসার পরও। তার বুকে বোধহয় এমন জ্বলুনি হয়? ছুটে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে সবাইকে। শেহজাদ ভাইজানের পাখিটা তার সাথে চলে আসবে বলে কেমন কাঁদছিলো! আর শোইয়াব আর শোহরাব শুধু নীরব চোখে চেয়েছিলো। আব্বাও কেমন নীরব হয়ে গিয়েছিলো। কোনো কথা বলেননি। আম্মার কথা থাকুক। মায়েরা তো সন্তানদের দূরত্ব কখনোই সইতে পারেন না।
নাদিরের হাতের বাঁধন আরও মজবুত হয়ে এল। হৈচৈ শোনা যেতেই নাদির বলল,
” আপনার শ্বশুরবাড়ি চলে এসেছে। ”
শবনম গাল মুছলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,
” আপনি আমাকে একা রেখে কোথাও যাবেন না কিন্তু। ”
” ভুলেও যাব না। আবারও বলছি আমার কিন্তু বড় রাজপ্রাসাদ নেই। ”
” আমার শুধুই রাজাকে দরকার। রাজার রাজপ্রাসাদ হতে কতক্ষণ? ”
নাদির হাসলো। বলল,
” আপনি আর কতক্ষণ কাঁদবেন? ”
” আপনি যতক্ষণ না থামাবেন। ”
নাদির বলল, ” আচ্ছা। ”
মাটির দোতলা ঘরটা নাদিরের বাবার। বহুদিন ধোয়ামোছা না থাকায় কালশিটে দাগ আর আশপাশের বহু ঝাড়ঝোপ গজিয়েছে। বিয়ের দুদিন আগে থেকে কাজ শুরু হয়েছিল। নাদিয়া নিজ হাতে সব দায়িত্ব নিয়েছিলো। তার শ্বশুরবাড়ি বাপের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। কাছেই। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার থেকে ভাইয়ের বউয়ের সাথে বাপের ভিটেতে থাকবে। যদিও জানেনা শবনম এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা। নতুন বউকে দেখার জন্য অসংখ্য মেয়ে মহিলাদের ভীড় জমেছে। সম্রাট সলিমুল্লাহর নাতনি এনেছে শুনে তারা নতুন বউ দেখার জন্য আরও কৌতূহলী। অনুপমা আর তাইয়্যেবা বেগম বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল শবনমকে। কক্ষে বসিয়ে মুরব্বিদের দেখতে দিল। সবাই নতুন বউয়ের মুখ দেখে দোয়া করে দিল, কেউ কেউ হাতের মুঠোয় বখশিশও ধরিয়ে দিল। নাদিরকে বলল,
” যাক, বউয়ের জন্য হলেও এবার অন্তত ঘরেদুয়ারে তোর ছায়া পড়বে। ”
একজন বলল, ” বিয়ে করবে না করবে না বলে একদম ছক্কা মেরে দিয়েছে। সম্রাট সলিমুল্লাহর নাতনি বিয়ে করে এনেছে। ”
নাদির বলল, ” তাতে কি হয়েছে? সে তো আমাদের মতোই মানুষ। ”
নাদিয়া হেসে উঠে বলল, ” তোমরা ওর সাথে তর্কে যেওনা তো। ওর সাথে পেরে উঠবে না। ”
সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো। নতুন চুলোয় খাবারদাবার গরম করে রাতে অল্পস্বল্প খাওয়া-দাওয়া হলো সবার। যদিও রাত অনেক গভীর হয়ে গিয়েছিলো। শবনম নাদিয়ার হাতে দু লোকমা খেয়ে আর খায়নি। মানুষের ভীড় আর হৈচৈ কমে এলে শবনমকে তার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। কক্ষটি ছোটখাটো সাজানো-গোছানো। একটা বড় জানালা আছে। জানালার দরজা কাঠের। সেখানে গোলাপি রঙের পর্দা ঝুলছে। নতুন আসবাবপত্রের দেখা মিলছে। মনে হয় নতুন কেনা হয়েছে। বড়সড় যে দর্পনটি বসানো হয়েছে দেয়াল জুড়ে সেটিও নতুন। একটা নতুন আলমিরা। কাপড় রাখার আলনা। দেয়ালজুড়ে কয়েকটা অঙ্কনকাজ। বিছানার চাদরও গোলাপি রঙের। তা ফুলের পাপড়ি দিয়ে ভর্তি। আরও হরেক রকমের ফুল দিয়ে বিছানার চারপাশটা সাজানো।
শবনমের অনুভূত হলো, আজ তার বাসর। এই রাতটি প্রতিটা মেয়ের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকে। দুরুদুরু বক্ষে, অচেনা, অজানা অনুভূতির সাথে, নতুন স্পর্শের সাথে প্রথম পরিচয়। অপর একটা মানুষের সাথে সম্পূর্ণ রূপে জড়িয়ে যাওয়া, নিজের মনকে সমর্পণ করা। সেই মানুষটা যদি প্রিয় মানুষ হয় তবে পৃথিবীটাকে স্বর্গ মনে হয়। আর অপ্রিয় হলে? তার এখনো মনে আছে সেই দিনের কথা। যেদিন বড় আপুর সাথে বড় ভাইজানের জোরপূর্বক নিকাহ হয়েছিলো। সেই রাতটা এতটাই দীঘ ছিল মনে হচ্ছিলো আর কখনো বোধহয় ভোর হবে না। শবনম নিজেই স্বাক্ষী ছিলো আপুর কষ্টের দিনগুলোর। তারপর আচমকা এক ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল সম্পর্কের সমীকরণ। ঘৃণিত, অভিশপ্ত সেই পুরুষ আপুর প্রাণভোমরা হয়ে উঠলো। তাদের দেখে ভালোবাসার প্রতি যেমন একটা বিতৃষ্ণা জন্মেছিল শবনমের মনে, ঠিক তেমনি ধীরেধীরে ভালোবাসার মতো মধুর সম্পর্কের প্রতি তার আস্থা জন্মেছে, সম্মান জন্মেছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কতটা মধুর হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ভাইজান আর আপু। বাইরে থেকে তাদের দেখলে মনে হয় তাদের সংসার দুদিনও টিকবে না। অথচ ওদের সম্পর্কের ভীত কতটা মজবুত তা একপলকে দেখে বুঝা সম্ভব নয়।
” আসতে পারি? ”
শবনম খানিকটা চমকালেও অভিব্যক্তিতে তা প্রকাশ না করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। নাদিরকে দেখামাত্র মৃদু হেসে বলল,
” ঘরটা আমার হয়ে গেছে?”
” ইতোমধ্যে। কোনো সন্দেহ আছে?”
” যা ছিল তাও দূর হয়ে গিয়েছে। ”
নাদির ভুরু উঁচিয়ে বলল,
” বেশ ভালো। আপনি কি এই শাড়ি নিয়ে রাতটা পার করবেন? ”
” মোটেও না। আপনার জন্যই তো বসেছিলাম। উনারা বলছিলো যে, বধূ সাজে বউকে একা মনভরে দেখা লাগে। ”
নাদিরের ভুরু দ্বিগুণ কুঞ্চিত হলো। চোখদুটো সরু করে বলল
” কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনতেই পারছিনা। কে এই মেয়ে? শবনম তো এরকম না। ”
শবনম বলল, ” যাহ। আপনি ভীষণ পাজি। ”
নাদির হেসে উঠে বলল,” ওই শাড়িটা পড়ে নিন। আমি আসছি। ”
শবনম মাথা নাড়লো। শাড়িটা পাল্টে নিয়ে মুখহাত ধুঁয়ে নিতেই নিজেকে অনেকটা হালকা লাগলো। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে আঁচড়ে নিল হালকা করে। দর্পনের সামনে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে নিজেকে দেখে ভারী একটা নিঃশ্বাস ফেললো। কক্ষে নাদিরের প্রবেশ দেখে এবার ভারী অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। কিভাবে সহজ হবে সে? এমন তো আগে কখনো লাগেনি। সে ফিরলো না। নাদির পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” শাড়িটা আপনাকে মানিয়েছি। ”
প্রশংসা শুনে লাজে লাল হওয়া শবনমকে অবাক করে দিয়ে নাদির বলে উঠলো,
” পছন্দ তো আমার। ”
শবনমের কানটা আবারও গরম হয়ে এল। আয়নায় তাকাতেই সে পুনরায় লজ্জা পেল কারণ নাদির এতক্ষণ আয়নায় তাকে দেখে কথাগুলো বলছিলো। ছিঃ কি লজ্জা! শবনম আঁচল তুলে মাথা ঢাকবে তাও পারছেনা। ঘরের এককোণে লন্ঠন জ্বলছে। সেই লন্ঠনের আলোর তীব্রতা ক্রমশ কমে আসতেই শবনম অনুভব করলো পেছন থেকে দুটো হাত ক্রমশ তাকে বেঁধে নিচ্ছে। চুলের উপর তপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়তেই শবনম একপাশে হেলে গিয়ে চোখ বুঁজে বিড়বিড় করলো। কানের কাছে নিঃশ্বাসের শব্দটা ঘনীভূত হতেই শবনম তাকে জড়িয়ে ধরা হাতদুটো নিজ হস্তদ্বারা চেপে ধরলো। নাদির ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো
” ঘরটা কি বেশি ছোট হয়ে গেল?”
খানিকটা পর জবাব এল।
” তাঁবুর চাইতে অনেকটা বড়। ”
” তাঁবুতে রাখলে আপত্তি থাকতো না? ”
” একটুও না। ”
নাদির তাকে তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
” তাঁবু এত পছন্দ? ”
শবনম তার দিকে ধীরেধীরে চোখ তুলে চাইলো। বলল,
” খুব। ”
” আর আমি? ”
শবনম কপাল কুঞ্চন করে তাকে সরিয়ে পালাতে যাবে ঠিক তখনি নাদিরের দুবাহুর মধ্যে ফের বন্দী হলো সে। বুক থেকে মুখ তুলে বলল,
” আগে বলুন আমি কে? আমি কে হই আপনার? ”
নাদির গর্ব করে বলল,
” আমার ঘরওয়ালী। ”
শবনমের চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তক্ষুণি। অদ্ভুত একটা আনন্দে বুকের ভেতরটা ক্রমশ লাফিয়ে চলেছে। তারপর চোখ দুটো বুঁজে এল তার। কপালে হতে গড়াতে থাকা কয়েকটা উষ্ণ চুম্বনের প্রলেপ ছড়িয়ে পড়লো তার সমস্ত শিরা উপশিরায়। বাকি অর্ধরাত্রিজুড়ে সে তার প্রিয় মানুষটিকে স্বামীরূপে অনুভব করেছে।
আচ্ছা আমি কি কাজগুলো করব না? তুই একটু গিয়ে মানা কর না ভাই। নতুন বউ কাজ করছে ব্যাপারটা কেমন না?
নাদির কক্ষের দিকে চলে এল। দেখলো কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে শবনম খাটের তলা থেকে শুরু করে সারাঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুলের পাপড়িগুলো একএক করে কুড়িয়ে নিয়ে ঘরটা ঝাড়ু দিচ্ছে। নাদির দরজার পাশে এসে দাঁড়াতেই শবনম বলল,
” এসব উনি পরিষ্কার করলে বুঝি আমার লজ্জা করবে না? ”
” লজ্জার কি আছে? ”
” আপনার না থাকতে পারে। আমার আছে। ”
ধুলোবালিগুলো এক জায়গায় করে শবনম হা ঝাড়লো। নাদির এসে পেছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরে খানিকটা উঁচুতে তুলে বলল,
প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ২৩+২৪
” আমি আজই বেরোচ্ছি। সন্ধ্যায় ফিরবো। ”
শবনম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
” আমিও যাব। ”
নাদির হেসে বলল,” ঘুরতে যাচ্ছি না। কাজে যাচ্ছি। ঘুরতে গেলে আপনাকে নিয়ে যাব। ”
” কবে ঘুরতে যাব? ”
” শীঘ্রই। ”
” আবার কোনে দ্বীপে? যেখানে খোলা আকাশ থাকবে। মস?