প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৫+৬

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৫+৬
পুষ্পিতা প্রিমা

সুলতান মহল ভোরবেলায় জেগে উঠে। জেগে উঠে বয়স্ক থেকে শুরু করে বাচ্চাগুলোও। ফজরের আজানের পরপর ভোরের কাক ডাকার আগেই ভোরের প্রার্থনার জন্য সকলের ঘুম ছুটে যায়। প্রার্থনা শেষে সকলেই নেমে পড়ে যে যার কাজে। অপরূপার কাজ বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে পড়তে বসিয়ে দেয়া। মুখের কথা ফোটার সময় তাদের হাতে বই ধরিয়ে দিলে কথা স্পষ্ট হতে হতে বাচ্চারা অনেককিছু আয়ত্ব করে নিতে পারে। সিভান সবাইকে আরবি হরফ শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে।

তার কোরআন হেফজ সম্পন্ন করার পথে। তার শ্রুতিমধুর তেলওয়াতের জন্য সে মাদ্রাসায় নানান সম্মাননাও পেয়েছে। বর্তমানে হুমায়রা, আলিজা, শোইয়াব আর শোহরাব তার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে পড়ে। এছাড়া মাঝেমধ্যে মরিয়মও তার কাছ থেকে অনেককিছু শেখার চেষ্টা করে। তার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে বাধ্য ছাত্রী হচ্ছে হুমায়রা। তার এক কথায় যে উঠে আর বসে। ছোট সাহেবকে হুমায়রা বড্ড ভয় পায়।
ছাত্র দুজনেই মোটামুটি ভালো। কিন্তু পড়বে না বললে সেদিন তাদের আর পড়ায় কে? সবচাইতে অবাধ্য ছাত্রী হচ্ছে আলিজা। সে তো পড়বেই না। বরং সবার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটাবে। সিভান বকলে আঙুল তুলে বলবে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” সুপ সুপ চিভানি। আমাল আব্বাকে বুলে দিবো।”
তার কথা শুনে সবাই হেসে উঠে। সিভান একদৃষ্টে তার মুখপানে তাকিয়ে ভাবে, এমন বিচ্ছু কি করে হলো ভাই জানের মেয়ে?
আজও তার ব্যতিক্রম নয়। শোহরাব আর শোইয়াব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলো। তার কথায় সকলে হেসে উঠার সাথে সাথে আলিজা ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলো। রাগত স্বরে শোহরাবকে বলল,
” কালু ভাইচান ,কালু কালু। ”
বলতে দেরী তার পাশে বসা শোইয়াবের হাতের চড় খেতে দেরী নেই। ঠাসঠাস করে বোনের মাথায় চড় মেরে ক্ষান্ত হলো শোইয়াব। ওদিকে শোহরাব নির্বিকার। আলিজার কালু ভাইচান ডাকাতে তার এখন খারাপ লাগে না। আম্মা কাল রাতে বুকে জড়িয়ে তাকে বলেছে কালো মানে খুব সুন্দর। আব্বা কালো কিন্তু খুব সুন্দর। সেও কালো কিন্তু খুব সুন্দর।

শোহরাবের চোখে তার আম্মা সবার চাইতে সুন্দর মানুষ। তাই আম্মা যাকে সুন্দর বলবে সেও অবশ্যই সুন্দর। আর আব্বা তার খুব কাছ থেকে দেখা একজন বীর । আব্বার তীর ছোঁড়া সে কাছ থেকে দেখেছে, বন্দুক ছুঁড়ে শিকার করতে দেখেছে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটতে দেখেছে। আব্বা অসুন্দর হতেই পারে না। আম্মা বলেছে সে আব্বার মতো। আব্বা সুন্দর মানেই সেও সুন্দর। বোন তাকে কালো বলছে এটার মানে বোন তাকে সুন্দর বলছে। তার কষ্ট পাওয়ার কোনো দরকার নেই।
শোইয়াব বোনের দিকে তাকিয়ে চোখ লাল করে বলল,
” ভাইচানকে কালু বুলেচ কেন? মারি লাল করে দেব। ”
আলিজা ক্ষেপে উঠলো। চোখে জল টলমল করছে। শোহরাব বইয়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে পড়তে লাগলো। সিভান বলল,

” বোনকে মেরেছ কেন শোইয়াব? ”
শোইয়াব বলল, ” ও ভাইচানকে কালু বুলেছে। ভাইচানকে কালু বুললে আমি আবাল মাববো। ”
সিভান বলল,
” আম্মু তুমি কালু বলেছ কেন? এটা তো বেয়াদবি। বড় ভাইজান ডাকবে। ”
আলিজা ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
” কালু ভাইচান ডাববো। ”
হুমায়রা বলল,
” আলিজা বেশি বেড়েছ। শোহরাব তোমাকে কালু ভাইজান ডাকলে তুমি এবার থেকে ওকে খুব মারবে। ”
শোহরাব চুপ করে রইলো। সে স্বভাবগত গম্ভীর। আলিজা সারাক্ষণ তাকে ক্ষেপালেও সে কিছু বলবে না। আর শোইয়াব মেজাজি। সে আগপিছ না ভেবে আলিজাকে মেরে বসে। ভাইজানের হয়ে সে বোনের সাথে মারপিট করে। কালু ভাইচান ডাকলে শোইয়াবের মনে হয় ভাইজান কষ্ট পাচ্ছে। তাই আলিজাকে ইচ্ছেমতো মারে।
সিভান এসে আলিজাকে কোলে নিয়ে নিল। গালে আদর করে তার পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল,

” ভাইজানদের দিকে তাকাবেন না। পড়ুন তা, ছা।
” টা, শাহ। ”
সিভান বলল, হচ্ছে না। তা, ছা।
আলিজা সিভানের মুখে দু-হাত দিয়ে মেরে বলল,
” ওলোকম বনবো না। ”
সিভান হেসে ফেললো। বলল,
” এরকমই বলতে হবে। না হলে মার চলবে। ”
আলিজা নাক টেনে বলল,
” কালু ভাইচান আর ভাইয়েকে তাচতাচ মালো। ”
হুমায়রা ধমকে বলল,
” একদম চুপ। তোমাকে দেব ঠাসঠাস। না নিজে পড়ছে, না কাউকে পড়তে দিচ্ছে। ”
আলিজার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো এবার। গাল ছেড়ে দিল । হুমায়রা কানে আঙুল দিয়ে রাখলো। শোইয়াব উঠে গেল। সিভানের পাশ থেকে হ্যাঁচকা টান মেরে আলিজাকে তুলে মাথায় আরেকটা চড় দিয়ে বলল,

” চলি যাও তুমি। ফুচা মেয়ে। ”
আলিজা আরও জোরে কাঁদতে লাগলো। সিভান বলল,
” আচ্ছা আম্মি আমার কোলে আসো। শোইয়াব তোমাকে কে মারতে বলেছে এভাবে? ”
আলিজা সিভানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সময় হুমায়রার হিজাব টেনে দিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল। রসাইঘর হতে অপরূপা তটিনী খোদেজা শাহানা সকলেই বেরিয়ে এল। অপরূপা বলল,
” আরেহ আবার কি হয়েছে? ”
আলিজা চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলো। তটিনী বলল,
” এমা, কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছো কেন আম্মু? ”
সায়রা এসে কোলে তুলে নিল। বলল,
” কি হয়েছে মা? কে বকেছে? ”
সিভান এসে বলল,

” ওখানে ঝগড়া করছে। শোইয়াব মেরেছে তাই। ”
সায়রা বলল,
” কতবড় সাহস! শোইয়াব কেন মারলো? ”
আলিজা কাঁদতে লাগলো। সিভান বলল,
” কালু ভাইজান ডেকেছে শোহরাবকে তাই শোইয়াব মেরেছে। তার ভাইজানকে কালো ভাইজান ডাকা যাবে না। ”
হামিদা বলল,
” তুমি ছিলে তারপরও ওরা মারামারি করলো কিভাবে?”
সিভান বলল, ” আজব! আমি কাকে আটকাব? ”
” হুমায়রা তুমি কি করছিলে? বসে বসে তামাশা দেখছো? ”
হুমায়রা মাথা নামিয়ে বলল,
” আসলে…
” হয়েছে। ”

হুমায়রা চুপসে গেল। সিভান মহা বিরক্তি নিয়ে অপরূপাকে বলল,
” আচ্ছা বউ তোমার মেয়েটা এমন ঝগড়ুটে কোথা থেকে হলো? ”
অপরূপা হতবাক। হামিদা বলল,
” অদ্ভুত! তুমি জানো না কোন প্রশ্ন কাকে কিভাবে করতে হয়? বোধবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে সিভান? ”
” দুঃখীত আম্মা। ”
সিভান চলে যাচ্ছিলো। পেছনে হুমায়রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে বলল,
” তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? ওদের নিয়ে পড়তে যাও। ”
” জ্বি যাচ্ছি। ”
হুমায়রা শোইয়াব আর শোহরাবকে নিয়ে চলে গেল।
আলিজার কান্না থামানোর জন্য সায়রা শেহজাদকে ডেকে এনেছে।
বাবাকে পেয়ে আলিজা সবার নামে বিচার দিচ্ছে। চিভান, হুমা, ভাইজান সবাই তাকে মারে। খোদেজা বলল,
” শেহজাদ ওকে প্রশয় দিওনা পুত্র। খুব বাড় বেড়েছে। পড়তে বসালে যত দুষ্টামি। নইলে শবনমের সাথে সাথে ওকেও বিয়ে দিয়ে দাও। বজ্জাত একটা। ”
আলিজা নাক টেনে বলল, ” আবাল বুকা দেয়।
শেহজাদ হেসে বলল,

” আচ্ছা সবাইকে বকা দেব আমি। কিন্তু আপনাকে তো বারণ করেছি কালো ভাইজান না ডাকতে। বড় ভাইজান ডাকবেন। কেন কালু ভাইজান ডাকতে যান? ভাইজান তো কত ভালো। ”
” কালু ভাইচান মারে না। ভাইয়ে মারে। ”
” সেজন্যই তো কালু ভাইচান ডাকবেন না। বড় ভাইজান আপনাকে কত দেখতে পায়, আপনি কালো ভাইজান ডাকলে তো ভাইজানের মনে দুঃখ পাবে। ”
” ডুক্কু পায় না। ”
শেহজাদ হতাশ চোখে চেয়ে রইলো। অপরূপার দিকে চেয়ে বলল,
” কার মতো হয়েছে? ”
অপরূপা বলল,

” আমার পূর্বপুরুষের মধ্যে কেউ এমন ছিল বলে মনে পড়ছে না। ”
তটিনী শোহরাবকে কোলে করে নিয়ে এল। বলল,
” বাবা বলো তো কালো ভাইজান ডাকলে তোমার কষ্ট হয়? ”
শোহরাব দু’পাশে মাথা নাড়লো। তটিনী হেসে শেহজাদ আর অপরূপাকে বলল,
” দেখেছ। এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করো না। ও কালো ধলা কি বুঝে? কালো মানে সুন্দর মা। ”
আলিজা হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,
” ছুন্দল। কালু ভাইচান কালু ভাইচান। ”
শেহজাদ কপাল চাপড়ালো।
অপরূপা শোহরাবের গাল টেনে বলল,

” একদম সোনা বাচ্চা। এমন বাঁদর মেয়ে কোথা থেকে যে হলো আমার। ”
তটিনীর কোল থেকে শোহরাবকে কোলে নিয়ে চলে গেল সে। তটিনীকে আলিজাকে কোলে নিয়ে শেহজাদকে বলল,
” তুমি কাজে যাও। ওকে আমরা সামলে নেব। ”
শেহজাদ রুমাল দিয়ে আলিজার চোখের পানি মুছে দিয়ে হাত নেড়ে টা টা দিয়ে চলে গেল। তটিনী আলিজাকে বলল,
” দেখো চোখমুখ লাল করে ফেলেছে। আঙুর খাবে? ”
আলিজা ঠোঁট ফুলিয়ে রাখলো। তটিনী কক্ষে চলে গেল। আলিজাকে আঙুর দিল। তৎক্ষনাৎ শেরহাম কক্ষে প্রবেশ করলো। আলমিরা থেকে জরুরি জিনিসপত্র খোঁজাখুঁজি করতে করতে বলল,
” তোর বাপ তো সকাল সকাল ওয়াজ শুরু করে দিয়েছে। তার মেয়ের জামাই এমন চায়, ওমন চায়। ”
তটিনী বলল,

” সব বাবারাই চায় উনার মেয়ে জামাই ভালো হোক। তুমি হলে চাইতে না? তাছাড়া শবনম নরমতরম গোছের। ওকে ভালো পাত্র দেখে নিকাহ দিতে হবে না? তোমারও তো একটা দায়িত্ব আছে ওর প্রতি। একদিকে তোমার ফুপাতো বোন হয়, অন্যদিকে শালী। তুমি একটা ভালো পাত্রের খোঁজ এনে দাও। ”
” কোনো দরকার নেই। তোর বাপের ওয়াজ শোনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি আছি আমার জ্বালায়। আমার ছেলে কই? কোলে এটা কে?”
” তটিনী আলিজাকে ফিরালো। আলিজা চোখ পিটপিট করে শেরহামকে দেখে বলল,
” কালু আব্বা। ”
শেরহাম কপাল কুঁচকে বলল,

” এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে? ”
” শোইয়াব ওকে ধরে মেরেছে শোহরাবকে কালু ভাইজান ডেকেছে তাই। ”
শেরহাম নিকটে এগিয়ে গিয়ে আলিজার গাল টেনে দিয়ে বলল,
” আবার কালু ভাইজান ডেকেছ?”
আলিজার নাক কাঁপতে লাগলো। তটিনী বলল,
” আহা বহুকষ্টে কান্না থামিয়েছি। আর কাঁদিওনা।”
আলিজা বলল,
” চিভান বুকা দিচে, ভাইয়ে তাচতাচ মালচে। ”
বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। শেরহাম চোখ পাকিয়ে চেয়ে বলল,
” এমা তনী দেখ কেঁদে দিয়েছে। ”
তটিনী জড়িয়ে ধরে বলল,
” আচ্ছা সবাইকে মারবো মা। ”
আলিজা ফোঁপাতে লাগলো। তটিনী বলল,

” কি খুঁজছো?”
” চাদরটা দে। ”
” ওকে একটু নাও। ”
শেরহামের কোলে দিয়ে দিল আলিজাকে। আলিজা শেরহামের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। শেরহাম ভুরু উঁচিয়ে বলল,
” কি? ”
আলিজা হাসলো। শেরহাম মুখের সামনে হাত রাখতেই শেরহাম হাতের আঙুলে ঠোঁট দিয়ে চাপ দিতেই আলিজা খিকখিক করে হেসে উঠলো। শেরহাম তার হাসির ধরণ দেখে নিজেও হেসে উঠলো। শূন্যে ছুঁড়ে খপ করে ধরে নাকে নাক ঘষে গালে টুপ করে আদর বসিয়ে তটিনীকে দিয়ে চাদর নিয়ে বেরিয়ে গেল। তটিনীর চোখে সেই দৃশ্যটা বারংবার ভাসতে লাগলো। কি সুন্দর! আলিজা হেসে তটিনীকে বলল,
” কালু আব্বা ভালু। ”
তটিনী তার গালে ঠেসে চুমু দিয়ে বলল,
” খুববব। যাক তুই অন্তত চিনতে পারলি। ”

এ কয়েক বছরে শেরহাম সুলতানের অনেক বিশ্বস্ত সৈন্য তার সাথে বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে আসছে। তার মধ্যে মানিক, আনোয়ার আর লাট্টু অন্যতম। শেরহাম তাদের চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। কাঁচা সবজির ব্যবসাকে শেরহাম এখন তার আয়ের একমাত্র উৎসস্থল হিসেবে বেছে নিয়ে। তার এই ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বেশ ভালো অভিজ্ঞতা আছে তাই সহজে নামতে পেরেছে। তাছাড়া প্রথম দিকে সে নিজেও খুব দ্বিধা-দ্বন্ধে পড়েছিল। নতুন চোখ দিয়ে যখন নতুন করে পৃথিবীর রঙ চেনা শিখলো তখন থেকে চারপাশটা তারকাছে সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগৎ। এই জগতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, নতুন করে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে, আয়ের পথ খুঁজে বের করা তার পক্ষে অনেক কঠিন ছিল। সে কারো সাহায্য নিতে চায়নি। শেহজাদ তাকে অনেক বলেছিল তাদের পারিবারিক ব্যবসায় নিজেকে নিয়োগ করতে, কিন্তু সে নিজে কিছু করতে চেয়েছিল। তাই তটিনী তাকে বলেছে তার কাছে যেটা খুব সহজ লাগে সেটা দিয়ে শুরু করতে একদম অল্প অল্প করে। একদিন তা অনেক বড় হবে। এখনো অনেক বড় হয়েছে তা নয় তবে এখন তার হয়ে অনেকগুলো গ্রামে কাঁচা সবজি বিক্রি দেয় তার লোকেরা। আগে ছোট একটা নৌকায় হয়ে যেত, এখন পুরো একটা জাহাজে করে সে কাঁচামাল বয়ে নিয়ে যায়।

সেই কাজেই সমুদ্রের পাড়ে এসেছিল আজ। হঠাৎ একটা জাহাজ থেকে কয়েকজন ভিনদেশী নেমে এল। সবার পড়নে পাঞ্জাবি। গালে ছাঁটা দাঁড়ি। মাথায় পাগড়ি। ভাষার ধরণ একটু অন্যরকম। লাট্টুকে খবর নিতে পাঠিয়েছে শেরহাম। লাট্টু এসে বলল,
” সাহেব ওরা তো সুলতান মহলের অতিথি। ”
শেরহাম ভুরু কুঁচকালো। ” অতিথি?”
লোকগুলো তার দিকে এগিয়ে এল। মানিক নিয়ে এসেছে তাদের। শেরহামকে দেখিয়ে বলল,
” সুলতান মহলের বাড়ে সুলতান শেরহাম সুলতান।”
লোকগুলো হাত বাড়িয়ে কুশলাদি বিনিময় করার পর কথাবার্তার এক-পর্যায়ে শেরহাম বুঝতে পারলো এরা শবনমের পাত্রপক্ষের লোক। যে ছোট চুলদাড়ি ওয়ালা ছেলেটা আছে, সে পাত্র। শেরহাম বলল,
” আপনারা যান। সেখানে সবাই আছে। আমার সাথেও সন্ধ্যায় দেখা হবে। ”
লোকগুলো হাসলো। হাত মিলিয়ে রওনা দিল সুলতান মহলের উদ্দেশ্য। তারা যেতে যেতেই শেরহাম হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের পথ পানে তাকালো। তাকে ওভাবে তাকাতে দেখে আনোয়ার বলল,

” হুজুর কি দেখছেন ওভাবে? ”
শেরহামের মনে হচ্ছে সেখানে একজনকে সে বেশ ভালো করে চেনে। শেরহাম দ্বিগুন অবাক হলো তখন যখন দেখলো সেই লোক গুলোর মধ্যে একজন যেতে যেতে তার দিকে ফিরে তাকালো। শেরহাম কপাল ভাঁজ করে চেয়ে রইলো তাদের দিকে। লাট্টুকে বলল,
” আজ দ্রুত মহলে ফিরবো। যা করার সন্ধ্যার আছরের আজানের আগে শেষ করবি। আমি দুপুরে মহলে যাব না। একেবারে তখন যাব। আর আসবো না। ”
কাজকর্ম শেষ করে শেরহাম মহলে ফিরে এসে দেখলো জমজমাট আয়োজন। পাত্র-পক্ষের সাথে ধুমসে খাওয়াদাওয়া আলাপ-আলোচনা চলছে। সে পাত্রের দিকে পুনরায় তাকিয়ে কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। শেহজাদ বলল,
” উনি আমার বড় ভাইজান। শেরহাম সুলতান। কাঁচামালের ব্যবসায় আছেন। আপনারা যার কথা বলতে এসেছেন তার বড় বোনের স্বামী। ”

” বাহ! বেশ ভালো খবর। ”
পাত্রের মামা বললো, মেয়ের খোঁজখবর দিয়েছে পাত্রের ফুপু। তিনি সুলতান মহলের এই কন্যাটি সম্পর্কে জেনেশুনে সম্বন্ধ আনতে বলেছিলেন। যদি সব ঠিক থাকে তাহলে পাত্রের মা বোন এসে পাত্রীর মুখ দেখবেন আর আংটি পড়িয়ে দেবেন। তারপর বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করা যাবে। সোলেমান মাহমুদ পাত্রের কাছে হাজারো প্রশ্ন রাখলেন। পাত্র বুদ্ধিমত্তার সাথে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সোলেমান মাহমুদের মন জয় করে নিলেন।
শেরহাম কক্ষ এসে চেয়ারে বসে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে রয়েছে। তটিনী এসে চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ রেখে জিজ্ঞেস করলো, ” এই পাত্র দেখেছ? কেমন হবে শবনমের সাথে? ”
শেরহামের মুখ চিন্তিত দেখালো। তটিনী সামনে ফিরে হাঁটভেঙে বসে ওড়নার কোণায় ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল,

” গোসল করে আসো। খাবার দিচ্ছি। যাও। ”
শেরহামের মুখাবয়ব শক্ত। তটিনী ভীতকন্ঠে জানতে চাইলো,
” কি হয়েছে বলো। ”
শেরহাম দাঁড়িয়ে পড়লো। পায়চারি করতে গেল। তটিনী তার সামনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ঠেকিয়ে রেখে বলল,
” আমাকে বলো সবটা ”
শেরহাম বলল,
” আরও কত ভালো ভালো পাত্র পাওয়া যাবে। এটাতে না বলতে বল শবনমকে। ”
তটিনী মুখ তুলে চাইলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,
” কি হয়েছে? কি লুকোচ্ছ? ”

দোতলার চত্বরে দাঁড়িয়ে মহলের মেয়ে বউরা আড়াল থেকে পাত্রকে দেখেছে। শাহানা খুশি হলো এই ভেবে পাত্র দেখতে ভালো। আর সাফায়াত এসে জানিয়েছে ছেলের শিক্ষাদীক্ষাও আছে। আব্বা শুরুতেই ভালো পাত্রের সন্ধান পেয়ে মহাখুশি। শাহানার বুকের উপর থেকে যেন একটা পাথর সরে গেল। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন উনি। সায়রা শবনমকে টানতে টানতে নিয়ে এল। পাত্রকে দেখিয়ে বলল, ” পছন্দ হয়েছে? বেশ দেখতে কিন্তু। পছন্দ না হয়ে উপায় নেই। ”
শবনম মৃদু হাসলো শুধু। কিছুই বলল না। তটিনী সবার পেছনে দাঁড়িয়ে। সে ক্রমশ হাত মোচড়াচ্ছে। শেরহাম হুট করে মহল থেকে বেরিয়ে গেল কেন? কেন চিন্তিত দেখাচ্ছিল? শবনমের বিয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তটিনীর হাঁসফাঁস লাগছে সত্যিটা জানার জন্য। আয়শা তাকে দেখে বলল,

” বড় আপু বর দেখো। এসো না। ”
তটিনীকে টেনে নিয়ে গেল সে। তটিনী দেখলো তার আব্বার চেহারায় সন্তুষ্টি, আনন্দ, উত্তেজনা। পাত্রের সাথে বেশ জমিয়ে গল্প করছেন তিনি।
কি এমন হলো যে শেরহাম তাকে শবনমকে বিয়েতে না বলতে বলে গেল? সে কি করে শবনমকে একথা বলবে? কেনই বা বলবে? কি কারণ জিজ্ঞেস করলে শবনম কিংবা আম্মাকে কি বলবে সে? সত্যিটা জানা অব্দি সে কাউকে কিছু বলতে পারবে না। সে সেখান থেকে চলে এল। তাকে লক্ষ্য করলো শবনম। আপুকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? পাত্র দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না? তটিনী হাঁটতে হাঁটতে শোহরাবকে খুঁজলো। দেখলো সে শোইয়াবের সাথে তীর ধনুক খেলছে। তীর ধনুকগুলি তাদের খেলার সামগ্রী।
তাকে দেখে শোইয়াব উঁচু স্বরে বলল,

” বাড়েআম্মা। ”
তটিনী হাসলো। শোহরাব এসে হাঁটু জড়িয়ে ধরলো। তটিনী বলল,
” দেখো এসো তো তোমার আব্বা কোথায়। বলবে, আম্মা এখন ডাকছে। যদি আব্বা চিল্লাপাল্লা করে, কাউকে বকাবকি করে তাহলে চুপিচুপি চলে আসবে। ঠিক আছে ? ”
শোহরাব মাথা নাড়লো। তটিনী শোইয়াবকে আদর করে বলল,
” ভাইজানের সাথে যাও। ”
শোইয়াব দু’পাশে মাথা নেড়ে চলে গেল শোহরাবের সাথে।

সামির ঘুম থেকে উঠে বিছানায় কাঁদছিল। আলিজা শুনতে পেয়ে সেখানে দৌড়ে গেল। দেখতে পেল বাবু উঠে বসেছে। কাঁদছে। সে বিছানায় উঠে গেল। সামির তাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। আলিজা বলল, বাবু আম্মুল কাছে যাবে?”সামির হামাগুড়ি দিয়ে তার কাপড় টেনে ধরলো। কোলে উঠার পায়তারা করলো। আলিজা বিছানা থেকে নেমে একটা বেতের মোড়া টেনে টেনে নিয়ে এল। তারপর ওটার সাহায্যে সামিরকে বহুকষ্টে বিছানা থেকে নামিয়ে নিল। তার পেটের সাথে সামিরকে জড়িয়ে ধরে হেঁটে হেঁটে কক্ষ হতে বের হলো। বহুকষ্টে সামিরকে ধরে রেখেছে সে। আর পারছিল না তাই বসে গেল মেঝেতে। সামিরকেও মেঝেতে শুয়ে দিল। শুয়ে দিয়ে গালে ঠাস করে মেরে বলল,
” কান্না কচচো কেন? আফুহ আল তুমাকে কুলে নিবেনা। টা টা বাবু। আফুহ ডুক্কু পাচি। ”

বলেই দৌড় দিল। সামির শোয়া থেকে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে তাকে অনুসরণ করলো। চেঁচিয়ে কেঁদে আলিজার পিছুপিছু হামাগুড়ি দিয়ে ছুটতে লাগলো সে। আলিজা পিলারের পেছনে আড়াল করে দাঁড়ালো। বলল,
” বাবু আফুহ নাই। তুমাল আম্মাল কাছি চলি যাও।”
তারপর পেট ছুঁয়ে বলল,
” আফুহ ইখানে ডুক্কু পাচে। ”

সামির কাঁদতেই লাগলো। আলিজাকে না দেখতে পেয়ে আরও জোরে কাঁদতে লাগলো। আলিজা এবার বেরিয়ে এল। সামনে এসে আবারও কোলে নেয়ার চেষ্টা করতে যাবে তখনি খপ করে তার চুল মুঠোবন্দী করলো সামির। আলিজা ব্যাথা পেয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। দুজনেই একসাথে কাঁদতে লাগলো চিৎকার করে।
তটিনী তার কক্ষে যাচ্ছিলো। দুজনের কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এল সে। এসেই দেখতে পেল আলিজার চুল টেনে ধরে কাঁদছে সামির। আলিজা তার চুল ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কাঁদছে। তটিনী দৌড়ে এসে চুল ছাড়িয়ে নিয়ে সামিরকে কোলে নিল। আলিজাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল,

” আচ্ছা আর কাঁদেনা। ”
আলিজা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” বাবু মাচচে। ”
তাদের কান্নার শব্দে, তটিনীর ডাকাডাকিতে সায়রা, অপরূপা, আয়শা, শবনম সকলেই হাজির। সায়রা এসে বলল,
” কি হয়েছে আপু? ওরা এখানে কেন? কাঁদছে কেন?”
তটিনী রাগত স্বরে বলল,
” একটা বাচ্চা মেয়ের হাতে একটা বাচ্চাকে ছেড়ে দিয়েছ? তোমার আক্কেল হবে কবে?”
সায়রা সামিরকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করাতে করাতে বলল,

” ও তো বিছানায় ঘুমন্ত ছিল। আলিজার কাছে কি করে এল? তুমি ওকে কোথায় পেয়েছ আম্মা? ”
আলিজা কেঁদে কেঁদে সবটা খুলে বলার সাথে সাথে অপরূপা তার গালে ঠাস করে মেরে বলল,
” কতবড় সাহস! বিছানা থেকে নামিয়ে নিল। পড়ে গেলে কি হতে অতটুকুন একটা বাচ্চা। কে বলেছে এত পন্ডিতি দেখাতে? ”
তটিনী বলল, ” আহা ওকে মেরোনা তো। ছাড়ো। ”
অপরূপা বলল, ” না অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দুঃসাহসিক কাজ করছে আজকাল। আজে বেঁধে পিটাবো। চলো। ”
আলিজাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল সে। কোথাথেকে সিভান ছুটে এল। অপরূপার হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল আলিজাকে। আলিজার কান্না থামলো না। সে কাঁদতেই থাকলো।

শোহরাব তার আব্বাকে পেল না। তাই ফিরে এল। নতুন মেহমানের সাথে বসে গল্পগুজব করছে সকলে। শেহজাদ জিজ্ঞেস করলো,
” কোথায় গিয়েছে বাবা? ”
শোহরাব মাথা নেড়ে জবাব দিল, ” আব্বা কুথাও নাই। ”
শেহজাদ সবার সাথে সৌজন্যেতা দেখিয়ে হেসে বলল, ” আমি একটু আসছি। ”
সোলেমান মাহমুদ সম্মতি দিলেন। শেহজাদ শোহরাবের কাছে ফিসফিস করে বলল,
” আব্বা বাইরে গিয়েছেন। ফিরে আসবে। চিন্তার কিছু নেই। ”
শোহরাব হাসলো। শেহজাদকে দেখে আলিজা ছুটে এল সিভানের কোল থেকে। থমকে গেল ভাইজানদের দেখে। শোহরাব আর শোইয়াব চলে যাচ্ছিলো। আলিজা তাদের পিছুপিছু ছুটলো। ডেকে বলল,
” অ্যাই অ্যাই কালু ভাইচান। ”
শোহরাব ঘাড় ফিরালো। রেগেমেগে তাকিয়ে বলল,
” মুটু মুটু। ”
শোইয়াব হেসে উঠলো শোহরাবের কথা। আলিজা চোখ জলে ভরে উঠলো। চিৎকার করে কান্না করার আগেই দুই ভাই পালালো।

পাত্রপক্ষের জন্য খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়েছে। তটিনী কথায় কথায় জানতে পারলো উনারা আজ রাতটা মহলে থাকবেন। সকাল সকাল খুশির সংবাদ নিয়ে রওনা দেবেন। পরশুর মধ্যে মহিলারা এসে শবনমকে আংটি পড়িয়ে নিকাহর দিন পাকা করে যাবেন। শবনমকে নিয়ে সবাই হাসি মজা আওড়াচ্ছে। শবনম নির্বিকার। সে কারো কথার জবাব দিচ্ছে না। তটিনী জিজ্ঞেস করলো, ছেলে কি করে আম্মা? ”
” উনাদের পারিবারিক ব্যবসা আছে। জমিজমাও আছে। তারউপর খানদানি বংশ। সুশিক্ষিত। ছেলে দেখতেও ভালো। ”
” কিসের ব্যবসা? ”
” ফলের ব্যবসা। উনাদের নাকি নিজেদের বাগান আছে। ওখানকার পরিচিত ব্যবসায়ী ছেলের বাবা। বেশ নামডাক আছে। শেহজাদ যখন ভালো বলেছে, তোমার আব্বার যখন মনে ধরেছে তখন আর কি বলার থাকে?”
” আর শবনম? ”
শবনমের হাত আচমকা কেঁপে উঠলো। বললো,

” জ্বি? ”
তটিনী বলল,
” তোমার কোনো মতামত নেই? জীবনটা তো তোমার। ”
শাহানা বলল,
” এখানে আবার মতামতের কি আছে তনী? ”
” ওকে বলতে দিন না আম্মা। শবনম কিছু বলার থাকলে বলো। ”
শবনম চোখ নীচে নামিয়ে বলল,
” আমার কোনো মতামত নেই। ”
” হ্যা না কিছুই না? ”
শবনম চোখ তুলে চাইলো। তটিনী বলল,
” হ্যা বলাটাও মতামত। ”
শাহানা বলল,
” ওকে এভাবে জেরা করছো কেন তনী? মেয়েরা কি মুখফুটে হ্যা বলে? এর চাইতে ভালো ছেলে আর কোথায় পাব? ”
” আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত আম্মা। আপনারা আরও জানুন তারপর কথা পাকা করুন। ”

” আমি আর ঘাঁটাঘাঁটি করার মতো কিছুই দেখছিনা। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। শেহজাদ আর সাফায়াত তো আছেই। তারা সমস্তটা জেনেই তবে নিকাহ পাকা করবে। ”
রসাইঘরে আয়শা প্রবেশ করে বলল,
” আপু ভাইজান এসেছে। তোমাকে ডাকছে। ”
শাহানা বলল,
” ওর খাবারটা নিয়ে যাও একসাথে। নাকি টেবিলে সবার সাথে খেতে বলবে। ”
” খাবে না। দিয়ে দাও।”
শাহানা থালা সাজিয়ে দিল ভাত তরকারি দিয়ে। তটিনী মাছটা রেখে দিয়ে বলল,
” ওরা বাপ ছেলে মাছ খেতে চায় না এমনিতেও। মাংস দিয়ে খেয়ে নেবে। এটা রেখে দাও। ”
শাহানা বলল, ” আচ্ছা রেখে যাও। ”
তটিনী খাবারের থালা হাতে কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল। শোহরাব ছুটে এসে বলল,

” আম্মা আব্বা আসি গেচে। নানুল কাচে যাই?”
” নানুর হাতে খাবেন?”
শোহরাব মাথা দুলিয়ে বলল, ” ভাইয়ের সাথি খাবো। ”
” আচ্ছা যাও। ”
তটিনী কক্ষে প্রবেশ করামাত্রই জিজ্ঞেস করলো,
” হুট করে কোথায় চলে গিয়েছিলে? ”
শেরহাম আলমিরা থেকে বন্দুকটা বের করে দেখছিলো। তটিনীকে দেখে সেটি রেখে দেওয়ার আগেই তা তটিনীর চোখে পড়ে গেল। সে থালা হাতে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি বন্দুক কেন বের করেছ এখন? ”

শেরহাম বলল, ” না এমনি। খেতে দে। খিদে লেগেছে। শবনমকে বলেছিস? ”
তটিনী পেছনে ফিরে বলল, ” নাহ। ”
শেরহাম রাগত স্বরে বলল, ” কেন বলিসনি কেন?”
” আজব! কোনো কারণ ছাড়া কেন বারণ করব? কেন করব সেটা তো বলো। ”
শেরহাম দাঁত কটমট করে বলল, ” কোনো কারণ বলতে পারব না। যেটা বলেছি সেটা কর। ”
তটিনী বলল, ” পারব না আমি। ”
” বেশ। ”
গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল শেরহাম। তটিনী তার পেছন পেছন দৌড়ে গেল। শেরহাম মহলের বাইরে বেরিয়ে গেল। তটিনী কক্ষে এসে পায়চারি করতে লাগলো। শাহানা খেতে ডাকলে খেতে চলে গেল। খেয়ে এসে শোহরাবের পাশে শুয়ে পড়লো।
অনেকক্ষণ পর চোখ লেগে এসেছে প্রায়। হঠাৎ ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে চোখ খুলতেই অনুভব করলো তাকে শক্তপোক্তভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে শেরহাম। উদরে ঠেকছে ঠান্ডা হাতটা। তটিনী জিজ্ঞেস করলো,

” খেয়েছ?”
” হ্যা। ”
তটিনী সামনে ফিরে জড়িয়ে ধরলো। বুকে মাথা চেপে রেখে চুপটি করে রইলো খানিক্ষন। তারপর মুখ তুলে চেয়ে ধীরেধীরে বলল,
” আমাকে সত্যিটা বলছো না কেন?”
শেরহাম তার চোখে চোখ রাখলো। মুখ খোলার আগেই দরজায় ঠোকা পড়লো। তটিনী বলল,
” কে? ”
ওপাশ থেকে উত্তর এল।
” আমি আয়শা। পাত্র হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছেন। সেটা জানাতে এলাম। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ”
তটিনী স্তব্ধ। শেরহামের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত চোখে চেয়ে থেকে বিড়বিড়িয়ে বলল,
” ওহহ। ”
আয়শার আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তটিনী জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে বলল,

” তুমি আবারও? ”
শেরহাম রাগত স্বরে বলল,
” তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস? ”
তটিনী বলে উঠলো।
” না না। আমি আমার নিজের চাইতেও বেশি তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু তোমার জন্য আমার কতটা দুশ্চিন্তা হয় সেটা তুমি বুঝবে না। সবাই যদি জানতে পারে তুমি এই কাজটা করেছ? তখন? ”
শেরহাম তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল,
” সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘুমা। ”
তটিনী আবারও মাথা তুললো। টলমলে চোখে চেয়ে বলল,
” শেহজাদ ভাই ঠিক খুঁজে বের করতো সব। তুমি কেন এসব করতে গেলে? ”
শেরহাম তাকে ঠেলে দিয়ে বলল,

” যাহ বলে আয় আমি বেঁধে রেখেছি। কাল মেরেও ফেলবো। যাহ বলে আয়। যাবি না? তাহলে আমি বলে আসি। সব কু*ত্তা**র বাচ্চাকে একএক করে মার*বো।”
তটিনী তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখে শেরহামের মুখটা হাত দিয়ে চেপে কেঁদে উঠে বলল,
” আচ্ছা আচ্ছা আমি আর কিছু বলছি না। ”
শেরহামের মেজাজ চড়ে গেল তটিনীর ভয় দেখে। মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
” তুই আবার কাঁদছিস কেন? ছাড় আমাকে। ”
তটিনী হু হু করে কেঁদে বলল,
” আমি অনেক কষ্ট করে সবটা স্বাভাবিক করছি। তারপরও একেকটা মুসিবত লেগেই থাকে। আমার কপালে সুখ নেই আমি বুঝে গেছি। ”
তার কান্নায় শেরহাম শান্ত হয়ে এল। রাগ সংবরণ করে হাতটা তুলে ধীরে ধীরে তটিনীর গাল মুছে দিতে দিতে বলল,

” তনী দেখ, আমি সব ঠিক করে দেব। কে বলেছে তোর কপালে সুখ নেই? আমি এনে দেব সব সুখ। তুই আমার উপর বিশ্বাস রাখ। তুই আমাকে বিশ্বাস না করলে আর কে করবে? ”
তটিনী তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো। শেরহাম দুহাতে জড়িয়ে ধরে কানের পাশে চুমু দিয়ে বলল,
” তুই দুনিয়ার সবার কাছে বুঝদার। আমার কাছে এলে ল্যাদাবাচ্চা হয়ে যাস কেন? ”
তটিনী মুখ তুলে জ্বলজ্বলে চোখমুখে চাইলো। শেরহাম ভুরু উঁচিয়ে বলল,
” অবৈধ অস্ত্র চালানের ব্যবসা করে। তুই ওদের জন্য কেঁদেকেটে মরে যাচ্ছিস। ”
তটিনী বুকে পুনরায় মুখ, চোখের জল লুকোলো। শেরহাম তার কপালের চুল সরিয়ে কপালে, চোখের পাতায়,মুখে চুম্বন করে বলল,

” ঘুমা তনীর বাচ্চা। ”
তটিনী নাক টেনে বলল,
” বড়সড় কান্ড ঘটিয়ে রেখে বলে ” ঘুমা তনীর বাচ্চা। ”
শেরহাম তার কথায় হেসে ফেললো আচমকা। তটিনী তার হাসি দেখে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল,
” নিমকহারাম। আমাকে এতবড় চিন্তায় ফেলে হাসছে। ”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৩+৪

শেরহাম তার হাতদুটো চেপে ধরে রেখে ওষ্ঠপুটে দীর্ঘ চুম্বন করতেই তটিনী স্থির হয়ে এল। শেরহাম তার নরম হয়ে আসা শরীরটাকে দু’হাতের বাঁধনে বেঁধে গলায় মুখ গুঁজে বলল,
” ঘুমের ঔষধ খেয়েছিস। এবার ঘুমা। ”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৭+৮