প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৯+১০

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৯+১০
পুষ্পিতা প্রিমা

মহল প্রাঙ্গনে ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। জাহাজ ঘাটে এসে থেমেছে সেই কখন, মেয়েরা এখনো মহল থেকেই বেরোতে পারলো না। ঘাটে পৌঁছুতে অনেক দেরী। সাফায়াত আর শেহজাদের চেঁচামেচি শুনে সকলেই ছোটাছুটি করা শুরু করলো। সাজগোছে ব্যস্ত ছিল সকলেই। অপরূপা আলিজাকে কাপর-চোপর পড়িয়ে সিভানের কোলে তুলে দিয়েছে। শোইয়াবের দেখা নেই। সে ভাই জানের সাথে মিলিয়ে পোশাক পড়বে। এখন কোথায় অপরূপা জানেনা। তার হিজাব পড়া বাকি। আয়শা, শবনম এখনো হিজাব পড়েই চলেছে। টুনু আর ফুলকলি গাঢ় করে ঠোঁট রাঙাচ্ছে। তাদের সাজগোছ দেখে অপরূপা হাসলো।

তটিনী তার কক্ষে। সে একটা সাদা রঙের পোশাক পড়েছে। বহুদিন পর বাপের বাড়ি যাচ্ছে। তাই সে খুব আনন্দিত। সবচাইতে বেশি খুশির কারণ হচ্ছে শেরহাম সুলতান যেতে রাজী হয়েছে তাই। কিছুক্ষণ আগেই নতুন পাঞ্জাবি পরিধান করে বেরিয়ে পড়েছে সে। তটিনী আপাতত কোনো ঝামেলা করবে না বলে পণ করেছে। কোনো কথাও বলবে না। আগে তার বাপের নিয়ে যাক, তারপর দেখাবে মজা। তটিনী মাহমুদার সাথে পেরে উঠা অত সহজ নয়। দুইরাত তাকে অন্য ঘরে ঘুমোতে হয়েছে। জয়পুরে গেলে এবার কি করবে শেরহাম সুলতান? ভাবতেই তটিনীর হাসি পেল।
সব জিনিস ঠিকঠাক নিয়েছে কিনা সবকিছু আরও একবার দেখে নিয়ে শাহানা খোদেজা আর অসুস্থ মরিয়মকে নিয়ে মহল থেকে বের হলো। শেহজাদ এসে মরিয়ম আর খোদেজাকে গাড়ির দিকে নিয়ে গেল। বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” জাহাজে উঠে গেলে আর কষ্ট হবে না আম্মা। ”
খোদোজা বলল,
” আমার কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু তোমার মায়ের শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। ”
” ডাক্তার সাহেব আসছেন। চিন্তা নেই। মা কোনো কষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে। ঠিক আছে? ”
মরিয়ম মাথা নেড়ে হাসলো। বলল,
” তোমার বুড়ি কোথায়? ”
শেহজাদ এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,
” আছে আশেপাশে। কোথায় আর যাবে? ”
খোদেজা বলল,

” দেখো। এখন হাঁটতে জানে। কোথায় না কোথায় গিয়ে বসে থাকে। সবাইকে বিপদে ফেলে দেবে। ”
” আমি দেখছি। আপনারা গাড়িতে বসুন। ”
সায়রা, শবনম, আয়শা সকলেই দাঁড়িয়েছিল। শেহজাদ তাদের পাশ কেটে যেতে যেতে বলল,
” রূপা, তনী এখনো বেরোচ্ছে না? কোথায় ওরা? আর কতক্ষণ লাগবে?”
শাহানা বলল,
” রূপা তো এখানে। ”
শেহজাদ ঘাড় ফিরিয়ে চাইলো। দেখলো সায়রার পাশেই রূপা দাঁড়িয়ে আছে। নিকাব পড়ায় তাকে ঠাহর করতে পারেনি শেহজাদ। চোখ দেখে এবার নিশ্চিত হলো। এটাও বুঝতে পারলো অপরূপা হাসছে তার কান্ড দেখে। সকলেই তার পাশ কেটে চলে যেতেই শেহজাদ কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,
” মারাত্মক। ”
অপরূপা সশব্দে হেসে উঠে বলল,
” আপনার মাথা। ”
শেহজাদ মাথার পেছনে চুলকে বলল,
” মাথা বটে। ”

তটিনী মহল থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে শাহানা বলল,
” তোমাকে তো শাড়ি পড়তে বললাম। পড়োনি কেন?”
” আমি সামলাতে পারিনা আম্মা। আমি ওসব পড়ে আরাম পাই না। দয়া করে আমাকে ওসব পড়তে জোরাজোরি করবেন না। ”
সায়রা বলল,
” থাক না ফুপু। আপুকে এসব পোশাকে মানায়। ”
” অদ্ভুত! বিয়ের পর মাঝেমধ্যে শাড়িটাড়ি পড়তে হয়। সামলাতে না জানলে সামলানো শিখবে। ”
তটিনী বলল,
” আমি যা পারিনা তা কেন করতে যাবো আম্মা? আর শাড়ি পড়তে জানতেই হবে এটা কোন হাদিসে লেখা আছে? আমি শাড়ি পড়ব না মানে পড়ব না।”
খোদেজা বলল,

” আহা শাহানা থাক ওকে জোরাজুরি করো না। ও যেভাবে চলতে চায় চলুক। ”
মরিয়ম বলল,
” ওর বর ওকে এভাবে পছন্দ করলে ঠিকই আছে।”
তটিনী হেসে বলল,
” ধন্যবাদ মামীমা। ”
সকলে হাসলো। মরিয়ম বলল,
” সত্যিই এভাবে পছন্দ করে? ”

তটিনী ভ্যাবাছ্যাঁকা খেয়ে গেল। সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো তাকে আমতাআমতা করতে দেখে। তটিনী মনে মনে আওড়ালো, “ব্যাঙের মাথা, বেয়াদব লোক আমার সাথে কথায় বলে না। ছাতার পছন্দ করে। যদি সে একটু সাজগোছ করে তার সামনে প্রশংসা না করে উল্টো বলে বসে, তনীর বাচ্চা তোকে আবার কে নিকাহ করবে বলেছে? বুড়ো বয়সে এত রঙচঙ মাখার কি আছে?
সে যে মস্তবড় বেয়াদব লোক তা একমাত্র শুধু তটিনীই জানে। আবার দিনশেষে এই বেয়াদব লোকটাকেই সে ভালোবাসে। তারই প্রশস্ত বক্ষের উঠানামায় তার চোখে ঘুম নামে, গায়ের উম আসে। ওই বেয়াদব লোকটাকে ছাড়া তার সবকিছু অসহ্য লাগে। উফ উফ কি যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তার দিন কাটে কেউ জানে না।

ঘাটে পৌঁছে সবার আগে শেরহামের খোঁজ নিল তটিনী। সাফায়াত কথা বলছিল তার আব্বার সাথে। তটিনী ডাকলো,
” ভাইজান কথা আছে। ”
সাফায়াত এগিয়ে এল। বলল,
” বলো। ”
” শোহরাবের আব্বা এখনো আসেনি?”
সাফায়াত চারিদিকে চোখ বুলালো। কপালে আঙুল বুলিয়ে বলল,
” আসেনি। এলে তোমাকে জানাবো আমি। তাছাড়া ভাইজানকে না নিয়ে তো যাব না আমরা। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। ”
তটিনী বলল, ” আপনি নিশ্চিত ও যাবে?”
” আম্মাকে নাকি কথা দিয়েছে। আম্মা তো তাই বললো। ”

তটিনী চিন্তিতমুখে রাস্তার পথে চেয়ে রইলো। মন খারাপ হয়ে এল তার। সোলেমান মাহমুদ তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একপলক তাকালেন মেয়ের মুখপানে। তারপর আবারও হাঁটা ধরলেন। তটিনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পথপানে পুনরায় চেয়ে জাহাজে চলে এল। জাহাজটি বিশাল। আরাম করার সুবিধার্থে আলাদা কেবিন বরাদ্দ আছে। সবাই একসাথে আছে আপাতত। শোহরাব, আর শোইয়াব ছোটাছুটি করছে। কারো কথা শুনছে না। তাদের ছোটাছুটি দেখে সামির খুশিতে আয়শার কোলে বসে হাত তালি দিতে দিতে চিক্কুর পাড়ছে। তার কথাগুলো কিছুই বুঝা যায় না এখনো।
জাহাজে সব জিনিসপত্র তোলা হলো। মহলের সবাইও উপস্থিত। শুধুমাত্র শেরহাম আসেনি এখনো। শাহানা চিন্তিত। ছেলেটা এখনো এল না। শেরতাজ সাহেব বোনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন,

” ও আসবে না বোধহয়। কি বলেছিল তোকে?”
” তেমন কিছু বলেনি ভাইজান। আমি বলেছিলাম, তুমি যাচ্ছ আমাদের সাথে। হ্যা না কিছুই বলেনি আমাকে। কিন্তু ওর চুপ করে থাকাটাকেই আমি সম্মতি ধরে নিয়েছি। ”
” এটা কোনো কথা হলো? ওই ছেলের কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারিনা। আল্লাহ জানে, না গেলে এখানে খাবে কি। একা একা থাকবেই বা কি করে।”
শাহানা বলল,

” আচ্ছা চিন্তা করোনা ভাইজান। দেখি কি হয়। ও না গেলে তনীও যাবে না। তনীকে রেখে যাব। দরকার পড়লে শোহরাবকে আমরা নিয়ে যাব। তনী থেকে যাবে। ”
” এটা কোনো কথা হলো? সবাই যাচ্ছে মেয়েটা যাবে না। ”
তাদের ভাইবোনের কথাবার্তার মধ্যে ভাটা পড়লো সোলেমান সাহেবের ডাকে।
” সবাই তো হাজির। জাহাজ চলুক। ”
শেহজাদ রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জাহাজে উঠে এল। কেদারায় বসে অদূরে চোখ রেখে বলল,
” আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি মামা। ভাইজান তো এখনো এল না। ”
সোলেমান মাহমুদ বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,
” না এলে ছেড়ে দিতে বলো। আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো?”
ঠিক তখনি ধপ করে এসে মুখ থুবড়ে পড়লো শোহরাব। শোইয়াব ভয় পেয়ে থমকে গেছে। ভাইজান পড়ে গেল?
শোহরাব ঠোঁট টেনে কান্না করার আগেই শেহজাদ ছুটে এল। বলল, ” ব্যাথা পেয়েছ? কতবার বলেছি ছোটাছুটি না করতে। ”

শোইয়াবের মুখ পানসে হয়ে এল।
শেহজাদের আগেই সোলেমান মাহমুদ শোহরাবকে তুললো। বলল,
” ব্যাথা পেয়েছ? হাতে লেগেছে? ও বাবা কত ছোট হাত দুটো! ”
বলতে বলতে উনি হাতের তালু দুটোতে নিজের হাতের তালু মিলালো। তারপর শোহরাবের দুগালে হাত রাখলো। বলল, ” ব্যাথা চলে যাবে। ”
শোহরাব খুশি হয়ে ডাকলো,
” নান্নুভাই। ”

সোলেমান মাহমুদ শেহজাদের দিকে তাকালো। শেহজাদ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তিনি সেইদিকে তাকাতেই সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত শেরহাম সুলতানকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। শোহরাবকে তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিলেন উনি। শোহরাব বাবার কাছে দৌড়ে গেল। তার আগেই আলিজা গিয়ে শেরহামের পথ আটকালো। কোমরে হাত রেখে বলল,
” অ্যাই কালু আব্বা দিরি কচচো কেন?”
শেরহাম ভুরু উঁচিয়ে বলল,
” তোমাকে কেন বলব? ”
আলিজা তার কাছে ছুটে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” কুলে কুলে। ”
শেরহাম কোলে তুলে নিয়ে পকেট থেকে কয়েকটা আঙুর দিল। আলিজা হাতে নিয়ে মাথা দুলিয়ে বলল,

” কালু আব্বাল আঙুল?”
” আঙুর। ”
” নয় আঙুল। ”
” আচ্ছা আঙুল। ”
শেরহাম আরও সামনে এগোতেই দেখলো টলমলে চোখে অভিমানী শোহরাব তার দিকে চেয়ে আছে। শেরহাম ডাকতেই সে ঠোঁট টেনে তটিনীর কাছে চলে এল দৌড়াতে দৌড়াতে। আলিজা খিকখিক করে হাসতে হাসতে শেরহামকে বলল,
” অ্যাই কালু আব্বা আল দিরি কববে?”
শেরহাম বলল,
” করবো। কি করবে তুমি? ”
” আমি আমাল আব্বাকে বুলে দিবো।”
বলতে বলতে কোল থেকে নেমে ভোঁ দৌড়ে।
এদিকে তটিনীর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেই চলেছে শোহরাব। কেন তার আব্বাকে ফুচা মেয়েকে কোলে নিল? আদর করলো?

তটিনী কিছুই বুঝতে পারলো না। দুগালে অসংখ্য আদর দিয়ে বলল,
” বোন কালু ভাইজান ডেকেছে আবার? বলেছিনা কালো মানে সুন্দর। ”
শোহরাব মাথা তুলে বলল,
” নয়। ”
” তো কি? দেখো কিভাবে কাঁদে। আমার তো খারাপ লাগে। ”
” আব্বা ফুচা বুনকে কুলে নিচে। ”
তটিনী হেসে বলল,
” বোন তো। কি হয়েছে তাতে? তোমারও বোন। ”
শোহরাব আরও সশব্দে কাঁদতে লাগলো। তটিনী কপালে, মুখে আদর দিতে দিতে বলল,
” আচ্ছা আমরা মা ছেলে কেউ ওই লোকের সাথে কথা বলব না। ”
পেছন থেকে শাহানা বলে উঠলো,

” কি শেখাচ্ছ ছেলেটাকে? ”
” শুধু আমিই তো ঝগড়া করি, এখন আমার ছেলেও ঝগড়া করে এটা বলবেন না আম্মা। আমার ছেলেকেও কাঁদিয়েছে।”
” অদ্ভুত! এমন কিছু ওর সামনে বলে বসো না যেন ও কষ্ট পায়। চলে গেলে আটকে রাখতে পারবে না কিন্তু। নানুভাই নানুমণির কোলে আসো। ”
শোহরাব মায়ের বুকে মুখ গুঁজে না না করে উঠলো। তটিনী বলল,
” ও আমার কাছে থাক আম্মা। কান্না থামুক। ”
শাহানা শেরহামকে আসতে দেখে খুশি হলো। বলল,
” আচ্ছা। ”

তটিনী বসে থাকলো শোহরাবের মাথায় মুখ ঠেকিয়ে। আলিজার পেছন পেছন শেরহাম জাহাজে উঠে এল। জাহাজের ইঞ্জিন শব্দ করে উঠলো তক্ষুনি। আলিজার কি আনন্দ! সে এদিকওদিক ছুটে হেসেখেলে বলল,
“কালু আব্বাল আঙুল মুচা মুচা। ”
হুমায়রা ফিক করে হেসে উঠে বলল,
” যেমন মাস্টার তেমন তার ছাত্রী। আঙুরটাও ভালো করে বলতে পারে না। ”
সিভান ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই হুমায়রা চুপসে গেল। কিন্তু মিটমিট করে হাসতে লাগলো। সায়রা বলল,
” আম্মা কি খাচ্ছেন? ”
আলিজা ঘুরতে ঘুরতে জবাব দিল,
” কালু আব্বাল আঙুল মুচা মুচা। ”
খোদেজা কপাল চাপড়ে বলল, ” কালো সেটা কেউ আজ অব্দি বলতে পারলো না, আর সে কালু আব্বা ডেকে ফেললো। হায় আল্লাহ!”
শাহানা হেসে বলল, ” পাকা বুড়ি একটা। কাকে কি ডাকতে হবে তাকে বলতে হয় না। ”
সায়রা হেসে বলল,

” সকাল সকাল আমার ঘরে এসে বলল, ফুপ্পী আমাল আব্বা তুমাকে মাচচে?তুমি বিথা পাইচো?”
সবাই একসাথে আবারও হেসে উঠলো।
তটিনীর বিপরীত পাশে কিছুটা সামনে শেরহাম এসে বসলো। বসে আড়চোখে একপলক তাকালো তটিনীর দিকে। শোহরাবকে ওভাবে মুখ লুকিয়ে রাখতে দেখে মনে অসংখ্য প্রশ্ন উদয় হলো। তটিনীর সাথে চোখাচোখি হয়ে যাওয়ায় তৎক্ষনাৎ চোখ ফিরিয়ে নিল।
তটিনী শেরহামের কাছাকাছি সিটে গিয়ে ধপ করে বসলো। সে শোনেমতো বলল,

” আজকাল অনেকেই শ্বাশুড়ির কথা শুনে চলছে। বউটউ দরকার নেই। বাহ বাহ, দারুণ উন্নতি। ”
শেরহাম শুনতে পেল কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না তার মাঝে। তটিনী পুনরায় বলল,
” আমাকে কাঁদিয়ে মজা পেয়েছে এখন আবার আমার ছেলেকে কাঁদানো শুরু করেছে। পাষাণ লোক। এসব মানুষের বউ বাচ্চা না হওয়ায় ভালো। কোনো মায়াদয়া নেই। ঘাড়ত্যাড়ামিতে সেরা। ”
শেরহাম গা এলিয়ে বসে হাতের তালু মুঠো করে, তার উপর মুখ ঠেকিয়ে বসে রইলো। টু শব্দও করলো না। সোলেমান মাহমুদ আঁড়চোখে তাকে কয়েকবার দেখে নিলেন।
জাহাজ চলতে শুরু করলো। মাঝপথে খাওয়া-দাওয়া হলো। শোহরাব কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ায় তটিনীর মন খারাপ। সেও কিছুই খায়নি তাই। শোহরাবকে নিয়ে তাদের বরাদ্দ কেবিনে চলে এল সে। শেরহাম তার যাওয়া দেখলো কিন্তু সবার সামনে উঠে যেতে পারলো না।

সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। পশ্চিমের কোলে ঢলে পড়তে যাচ্ছে রক্তিমবর্ণ সূর্য। গোধূলী আলোয় চকচক করছে সমুদ্রের নোনাজল। অদূরে বনের ঝোপঝাড়, দূর পাহাড়ের কোণে কোণে আঁধার নেমেছে। বিকট শব্দ করে ঘাটে জাহাজ থামতেই সকলের ঘুমঘুম চোখ সতেজ হয়ে এল। জিনিসপত্র নামানামিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো শেহজাদ, সাফায়াত আর সিভান। শেরহাম দূরবীন দিয়ে দূরবর্তী একটা জাহাজ দেখতে ব্যস্ত। জাহাজটি এদিকেই আসছে।
শেহজাদ ডাক দিয়ে বলল,

” ভাইজান তনীদের নামাও সাবধানে। ”
তটিনী আগেভাগেই শোহরাবকে নিয়ে নেমে গেল। অপরূপা শোইয়াবকে নিয়ে নামতে নামতে হঠাৎই হোঁচট খেল। শোইয়াব আম্মা বলে ডেকে উঠলো। সকলেই থেমে গিয়ে পিছু ফিরে চাইলো। অপরূপা নিজে নিজে উঠে দাঁড়ালো। হাত ঝেড়ে অদূরে উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকা শেহজাদকে আশ্বস্ত করলো। শেহজাদ চিন্তামুক্ত হলো। অপরূপা যে ইটের সাথে লেগে পড়ে গিয়েছে শেরহাম সেই ইটটা এক লাথিতে পানির মধ্যে ফেলে দিয়ে শবনমকে বলল,
” এবার যাও। ”

ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে সামনে তাকাতেই দেখলো তটিনী চেয়ে আছে। তার চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে নিল। তক্ষুণি তাদের পাশের জাহাজে কর্মরত একজন হাঁক ছেড়ে অপরূপাকে ডেকে বলল,
” আমাগো অপু নাকি রে? আমি তোর রহিম চাচা।”
অপরূপা থমকে গেল। রহিম চাচা! এতগুলো বছর পর দেখা। গ্রামে গিয়ে চাচীর মুখে সে শুনেছিল যে রহিম চাচা ফিরে এসেছে কিন্তু অপরূপার সাথে দেখা হয়নি। রহিম চাচাকে দেখে অপরূপার খুব ভালো লাগলো। বলল,
” কেমন আছ তুমি? এখানে কাজ করো নাকি? ”
রহিম চাচা মাল বোঝাই করে আরেকজনের কাঁধে তুলে দিয়ে এসে বলল,

” আমার কথা ছাড়। কাজ করে খাই। তোর চাচীর মুখে হুনছি তোর নাকি রূপনগরের সম্রাটের লগে নিকাহ হয়ছে? ভালা হয়ছে ওই ডাকাত রহমানরে ছাইড়া দিছিস। শ্লা ধান্ধাবাজ আমারে ভয় দেখাইয়া কম কাম করেনাই। তোর জীবনডা শ্যাষ কইরা দিত। যার জীবনে যাবে তারে ছারখার কইরা দিবে শ্লা। জাদুকর,ডাকাত, ভন্ড লোক। আমার তো তোরে নিয়া বহুত চিন্তা হইতাছিলো। তো এইহানে তোর লগে কারা কারা আইছে? ”

অপরূপা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। অপরূপার পেছনে শবনম, সায়রা, আয়শা আর তারপরেই শেরহাম। শেরহামকে না দেখেই এতগুলো কথা একনাগাড়ে বলে ফেলেছে রহিম চাচা। অপরূপা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। অপরূপার কিছুটা সামনেই তটিনী শোহরাবকে কোলে নিয়ে স্তম্ভিত চোখে চেয়ে আছে রহিম চাচার দিকে। তটিনীর পেছনেই শেহজাদ। সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চুপটি করে রইলো। শবনম, আয়শা, সায়রা সকলে নেমে যেতেই শেরহামও সিঁড়ি বেয়ে দু’পা নেমে এল। আর তক্ষুণি রহিম চাচার চোখে পড়লো শেরহামকে। রহিম চাচার চক্ষু ছানাবড়া! শেরহামের চাহনিতে না রাগ, না ক্রোধ কোনোকিছুই স্পষ্ট না। সে তটিনীর দিকে তাকালো শুধু। তটিনী, অপরূপা দুজনেই কেউ কারোর দিকে তাকালো না। টলমলে চোখ নিয়ে দুজনেই দু’দিকে সরে পড়লো। শেহজাদ কিছু বলতে চাইলো অপরূপা পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

জয়পুরের সবচাইতে বড় বাড়িটি মোহকুঞ্জ বাড়িটি। বাড়িটির পথের ধারে ধারে অসংখ্য ফুলের গাছ, বাহারি রকমের ইটা পাথরের তৈরি কৃত্রিম জলাধার। জলাধারেও নানানরকম পুষ্প ফুটে রয়েছে। যিনি বাড়িটির দেখভাল করতেন তিনি বছর কয়েক আগে মারা গিয়েছেন। তাই উনার পুত্র আর পুত্রবধূ মাঝেমধ্যে এসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিয়ে যান। শাহানা এলে টাকা-পয়সা হাতে দেন। খুব ইচ্ছে ছিল শ্বশুরবাড়িতে থাকবেন ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে। কিন্তু সন্ত্রাস-হামলায় জয়পুরের মানুষ অস্থির। এখনো সেই হাঙ্গামা কমেনি।

তাই শাহানা ছোট ছোট তিনটা মেয়ে আর একমাত্র ছেলের প্রাণের মায়ায় এই বিভীষিকাময় জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সুলতান মহলে। আর কখনো ফেরা হয়নি। জয়পুর যদি কখনো পুরোপুরি সন্ত্রাসমুক্ত হয় তাহলে সাফায়াত তার বউ ছেলে নিয়ে এখানে থেকে যাবে বছরের কয়েকটা মাস। তটিনী, শবনম আর আয়শার যদি কখনো মনে হয় বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকা যাবে তাহলে তারাও এসে থাকতে পারে। তিন মেয়ের জন্যও আলাদা আলাদা বাসস্থান তৈরি করে রেখেছেন শাহানা। অন্যকিছুর অভাব হলেও একটা ঘরের অভাব মেয়েদের কখনোই হবে না। বাড়ির দেখভাল করা লতিফ চাচা সবাইকে বাড়িতে নিয়ে এলেন সসম্মানে। শাহানা জানালো তারা সবাই ঘুরতে এসেছে। খাবার-দাবার সাথে নিয়ে এসেছে। সবাই একসাথে রেঁধেবেড়ে খাবে। মেয়েরা পাহাড়ে ঘুরতে যাবে, সমুদ্র দেখবে। বাড়ির বাইরে যেন রান্নার চুলা বসানো হয়। বাড়ির ভেতরের চুলা নিয়ে কাজ করতে গেলে সবাইকে অনাহারে থাকতে হবে। লতিফ চাচা সবকিছুর বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শবনম আর আয়শা সবাইকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে ইতোমধ্যে। আলিজা শেহজাদের কোলে চড়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

” কালু ভাইচানের নানুল বাড়ি? ”
শেহজাদ বলল,
” হ্যা। হুমার সাথে থাকুন। আমি আপনার আম্মা কোথায় গিয়ে দেখে আসি। ”
আলিজা কোল থেকে নেমে টা টা দিয়ে বলল,
” আচচা। ”
শেহজাদ শবনমকে জিজ্ঞেস করে রূপা কোন কক্ষে আছে তা জেনে সেই কক্ষের দরজা ঠেলতেই দেখতে পেল কক্ষটা অন্ধকার। দরজা ঠেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। চোখে আলো সয়ে যেতেই অপরূপাকে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিতেই অপরূপা সামনে ফিরলো। শেহজাদকে কিছু বলতে না দিয়ে বুকে এসে হামলে পড়লো। শেহজাদ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,
” আমরা এখানে আনন্দ করতে এসেছি। কান্না করতে কিংবা দেখতে নয়। ”
অপরূপা বলল,

” আপনি নিশ্চয়ই এসব মন থেকে বলছেন না। আমার উপর অনেক অভিযোগ। আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার হাতে তো কিছু ছিল না। আমি এসব কোনোকিছুই চাইনি। আমি শুধু ভালো থাকতে চেয়েছি, একটা ভালো মানুষের সাথে। আর কিচ্ছু না। ”
শেহজাদ তার কপালে চুম্বন করে বলল,
” আমরা ভালো আছি এটা কি অনেক বেশি কিছু নয়? সাদাকালো অধ্যায় দিয়েই তো জীবন। ”
অপরূপা মুখ তুলে অশ্রুসজল নয়নে চাইলো। বলল,
” আপনি আমাকে একবার অন্তত পাপী বললে হয়ত আমার সব পাপ ঘুঁচে যেত। আপনি তা একবারও বলেন না। ”
” যা তোমার গায়ে ছিটাবো তা সেই মানুষটার গায়ে গিয়েও পড়বে যাকে আমি অনেক কষ্টের পর ফিরে পেয়েছি। আল্লাহর কসম আমার কারো উপর কোনো রাগ, অভিযোগ নেই। তুমিও রেখো না। রাখা উচিত নয়। আমরা কেউ ভুলের উর্ধ্বে নই। কেউ ভুল গাঁথি, আর কেউ ভুলের সাথি। ”

” আপনি কেন আমাকে এত ভালোবেসে আগলে রাখেন? আমি আপনাকে অতটাও ভালোবাসিনা। একসাথে কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকতে থাকতে যেরকম ভালোবাসা হয়ে যায় ওরকমটা হয়েছে, সন্তান হয়েছে, সংসার হয়েছে। এর বাইরে আপনাকে আমি আপনার মতো করে ভালোবেসে উঠতে পারিনি। আমি আমার ব্যর্থতা লুকোতে পারিনা আর। আপনার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় আপনি শুধু আমাকে দিয়েই গেলেন, আর আমার খাতা শূন্য। ”
” তাড়া কিসের? আমরা আরও একশো বছর বাঁচবো। মৃত্যুর একসেকেন্ড আগেও যদি তোমার মনে হয় তুমি আমাকে ভালোবেসে উঠতে পারোনি তাহলে ওপাড়ে গিয়ে বেসো। তোমার চেষ্টা আমার কাছে ভালোবাসার চাইতেও বেশি। ”
অপরূপা তার বুকে মুখ লুকিয়ে নিল। তার শরীরটা বারংবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো কান্নার চোটে।

রাতের খাবার রান্না করে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাই তার গরম করার চুলা বসানো হয়েছে। খাবার গরম করে যার যার খাবার তার তার কক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সবাই ক্লান্ত। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নেবে। কাল সকালে বেড়াতে বেরোবে। শেরহাম পায়ে-পায়ে হেঁটে তটিনীর কক্ষ খুঁজছিলো। সোলেমান মাহমুদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আর পা বাড়ায়নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যা শুনতে পেল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলে যা হয় তা হচ্ছে, উনার মতো এত নামীদামী মানুষের মেয়ের জামাইকে কেউ ডাকাত বলছে, কেউ জাদুকর বলে ব্যঙ্গ করছে, কেউ ধান্ধাবাজ ডেকে হাসাহাসি করছে। উনার ফুলের মতো পবিত্র মেয়েকে কেন এত এমন একটা কলঙ্ক নিয়ে সংসার করতে হবে? কেন সামান্য খেটে খাওয়া মানুষের মুখে গঞ্জনা শুনতে হবে? কেন মানুষের টিটকারি শুনতে হবে? শাহানা উনাকে শান্ত করাতে পারছেন না। চেঁচামেচি শুনে তটিনীও চলে এল। যতটা না মা বাবার কথা কাটাকাটি শুনে অবাক হলো, তার চাইতে বেশি অবাক হলো শেরহামকে দেখে। দুরুদুরু বক্ষে শেরহামের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো সে। সোলেমান মাহমুদ গর্জে বললেন,

” জোরাজোরি করে যখন বিয়ে করেছে তখন সাথে সাথে ছাড়িয়ে নাওনি কেন? রাস্তাঘাটে বেরোবে কি করে সে কথা ভাবোনি? মানুষকে মুখ দেখাতে পারছি এখন। ”
শাহানা বলল,
” দোহাই লাগে। ভাইজান এসব শুনলে কষ্ট পাবেন। উনার শরীর খারাপ। আপনার গলার আওয়াজ ছোট করুন। নিজের বাড়িতে এনে এসব কেমন ব্যবহার? ”
” কথা ঘুরাবে না। বাড়িটাড়ির কথা কে বলছে?”
” উনারা তো সেটাই মনে করবেন। ওদের বাচ্চা হয়ে গেছে, সংসার হয়ে গেছে। আপনি এখন এসব নিয়ে মাতামাতি করে অশান্তি করছেন কেন? মানুষ যা বলার বলুক। ”
” বলবে কেন? বললেও আমি শুনবো কেন? আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করেছ তোমরা সবাই মিলে। ”
তটিনী শেরহামকে দেখা না দিয়ে দ্রুত কক্ষে চলে এল। কিছুক্ষণ পর শেরহাম কক্ষে এল। ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে পাঞ্জাবির পকেটে রেখে গায়ে চাদর জড়াতেই তটিনী একটানে চাদর নিয়ে নিল। বলল,

” তুমি আজ রাতে বেরোবে না। ”
শেরহাম অন্যদিকে মুখ করে শান্ত গলায় বলল,
” আমার কাজ আছে। ”
” থাকুক কাজ। পিস্তল নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? কোনো ঝামেলায় জড়ানোর দরকার নেই। ”
শেরহাম কপাল ভাঁজ করলো।
” তোর এত ভয় কিসের? আমি মানুষ মারবো বলে? ”
” আমি কি বুঝতে পারছিনা তুমি কোথায় যাচ্ছ? তুমি ঘাটে যাবে। ওখানে কর্মীগুলোকে মারবে। ”
শেরহামের হাতের মুঠো, চোয়াল শক্ত হয়ে এল। বলল,
” হ্যা মারবো। তো?”

তটিনী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। সে তো আন্দাজে বলেছে তারমানে সত্যি সত্যি তাদের মারতে যাচ্ছে?
” তুমি সত্যি সত্যি? ”
” হ্যা সত্যি সত্যি মারতে যাচ্ছি। একজন ডাকাত, জাদুকর, ধান্ধাবাজ লোকের কাছ থেকে তুই এর বেশিকিছু কি আশা করিস? ”
তটিনী দরজা বন্ধ করে দিল। সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমাকে মেরে তারপর যাও। ”
বলেই সজলনেত্রে চেয়ে রইলো মুখ কঠিন করে। শেরহাম এগিয়ে গিয়ে তার বাহু খামচে ধরে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলতে যাবে ঠিক তখনি তটিনী তার বাহুতে কামড় বসিয়ে দিল। শেরহাম কষে চড় বসাতেই তটিনী ছিটকে পড়লো। কেঁদে উঠতেই শেরহাম দ্রুত তাকে তুলে নিয়ে চাদরে নীচে ঢাকতেই তটিনী গা কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। শেরহাম বলল,

” দেখ, আমার সাথে ধস্তাধস্তি করবি না। ”
তটিনী ধাক্কা দিয়ে বলল,
” একদম দরদ দেখাবি না। পিস্তলটা দিয়ে আমাকে মার তারপর যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাহ। বের কর পিস্তলটা। ”
শেরহাম রাগান্বিত চোখে চেয়ে পিস্তলটা বের করলো। তটিনীর হাত শক্ত করে টেনে ধরে এনে তটিনীর হাতে ধরিয়ে দিল। বলল,

” তোর জীবনের সব চাইতে বড় ভুলটা শোধরে নে। বেশ সময় আছে। ”
তটিনী পিস্তলটির দিকে তাকিয়ে সশব্দে কেঁদে উঠলো। শেরহাম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” কি হলো? ওইদিন বলেছিস না আমি শয়তান, আমি জানোয়ার, আমি খুনী। আমাকে বিশ্বাস না করলে এই লোকদেখানো সংসার করছিস কিসের জন্য?”
তটিনী তার দিকে এগুতেই শেরহাম বলল,
” দূরে যাহ। তোর লোক দেখানো সংসারের আজ ইতি টানবি। ”
তটিনী দু’পাশে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,
” আমি.. আমি তো অত ভেবে বলিনি। ”
” ভেবে না বললেও আমি এককালে কি ছিলাম তার তোর বেশ মনে ছিল। তুই আমাকে বিশ্বাস করিসনি সেখানে তোর বাপ কোথাকার ছাই! ”
” না না আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। ”
শেরহাম গর্জে বলল,

” তাহলে এখন আটকাচ্ছিলি কেন? মার। ”
তটিনী পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
” আমার তোমাকে নিয়ে ভয় হয় তাই এমন করি। কিছু না করেও তোমার ঘাড়ে দোষ চেপে বসে তাই এমন করি। আমি কেন এমন করি তুমি বুঝতে চাও না। নাকি বুঝার চেষ্টা করো না? তোমাকে কেউ কিছু বললে আমার খারাপ লাগে, আমার কষ্ট হয়।”
শেরহাম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। পিস্তলটা তুলতে যেতেই তটিনী ফের হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেই শেরহাম আজব চোখে চেয়ে ধমকে বলল
” চুপ। আমি এটা রেখে দিচ্ছি। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করবি না। ”
তটিনী চুপ হয়ে গেল। শেরহাম পিস্তলটা রেখে দিল। চাদর নিতে যেতেই তটিনী চাদরটা কেড়ে নিয়ে লুকিয়ে ফেললো নিজের পেছনে।

শেরহাম উপায়ান্তর না দেখে লাথি দিয়ে ব্যাগটা সরালো। চোখের উপর হাত রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায় । তটিনী তার কঠিন মুখাবয়ব পরখ করে হারিকেনের আলো কমিয়ে দিয়ে বসে রইলো চুপটি করে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর শেরহামের ঘুম চলে এসেছে মনে হতেই গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে কপাল হতে হাতটা সরিয়ে দিল।
কপালে, চোখের পাতায় গভীর চুম্বন করে, পুরুষ্টু গালে নিজের দুঠোঁট চাপলো। শেরহাম চোখ মেলে তাকাতেই তটিনী চমকে গেল। টলমল করা চোখদুটো লুকিয়ে পাশ ফিরে গেল। শেরহাম বলল,
” শোহরাব কোথায়?”
” ও ওর খালামণির কাছে ঘুম। ”

তটিনী ফিরে তাকালো তার দিকে। শেরহাম তাকাতেই ফিরে গেল।
অনেকক্ষণ পর শেরহাম একহাত দিয়ে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তটিনীর কুঁকড়ে উঠলো। শেরহামের মুখোমুখি হতেই প্রশ্ন করলো,
” আমি নিয়ে আসি ওকে? ”
” একদম ঢং দেখাবি না। ”
তটিনী বলল,
” আমি ঢং দেখাই?”
শেরহাম তার বুকের কাছে টেনে এনে বলল,
” হ্যা। এসব আমার সামনে কম দেখাবি। ”
তটিনী তার হাতের স্পর্শে শিউরে উঠলো। মুখটার দিকে চেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। শেরহাম বলল,
” তোর কান্না থামাবি?”
তটিনী কান্না আটকে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল,

” তাহলে ভালোবাসো। ”
শেরহাম রাগান্বিত চোখে চেয়ে রইলো। তটিনী তার গলা জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে কেঁদে বলল,
” নইলে ছাড়ো। আমি চলে যাই। ”
শেরহাম ধীরেধীরে চুল সরিয়ে কানে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
” আচ্ছা এখন ঘুমা। পরে। ”
তটিনী বলল,
” নাহ ভালোবাসো এখনি।”
শেরহাম রাতভর তাকে ভীষণ ভালোবাসলো।

সকালবেলা সবাই একসাথে সদরকক্ষে বসে সকালের নাশতা খেতে বসেছে। সোলেমান মাহমুদের পাশে বসে আলিজা পরোটা খাচ্ছে। শোইয়াব শোহরাবকে ডাকতে গিয়েছে। শোহরাব মায়ের কোলে। তটিনী তাকে দেখে বলল,
” ওমা দেখো ভাই চলে এসেছে। আর তুমি এখনো আম্মার কোলে চড়ছো? চা খাবে না? ”
শোহরাব শোইয়াবকে দেখে হাসলো। শোইয়াব বলল,
” আলিচা সব খায় ফিলচে। তালাতালি আসো। ”
তটিনী হেসে বলল,
” দুই ভাই সারাক্ষণ ওর সাথে ঝগড়া করো? ”
শোহরাব আর শোইয়াব একসাথে হাসলো। তটিনী তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল,
” যাও। খেতে যাও। ”
শোহরাব কোল থেকে নেমে বলল,
” আব্বা? ”
তটিনী ভেবে বলল,
” তোমার আব্বাও যাবে। তুমি যাও। ”
” আচচা। ”

দুইভাই চলে গেল। তটিনী বিছানা গুছিয়ে কক্ষ থেকে বেরোনোর সময় শেরহাম কক্ষে এসে বলল,
” আমি বিকেলে ফিরবো। খবরদার কাউকে খোঁজে পাঠাবি না। ”
” ঠিক আছে। এখন খেতে চলো। ”
শেরহাম অবাকদৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
” কোথায়? ”
” সদরকক্ষে সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে। তোমার জন্য বসে আছে। ”
” তো?”
তটিনী তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
” আমি তোমার সব কথা শুনবো। কিন্তু তোমাকেও আমার সব কথা শুনতে হবে। ”
শেরহাম পিস্তলে গুলি ভরতে ভরতে বলল,
” তো? ”

” আমার সাথে চলো। এটা তো আর সুলতান মহল না। তোমার শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে জামাই আদর হবে না? ”
শেরহাম চোখ তুলে চাইলো। তটিনী মৃদু হেসে বলল,
” চলো চলো। না করো না। ”
শেরহাম ধমক দিয়ে বলল,
” সর। কাজ করছি। অত আদর খাওয়ার সময় নেই। তুই খা জামাই আদর। ”
তটিনী ফিক করে হেসে উঠে ধুপধাপ কিলঘুষি মেরে বলল,
” খেয়েছি। এবার তুমি খাবে চলো। ”
শেরহাম বলল,
” চড় খাবি নাকি যাবি?
তটিনী তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” চলো চলো। নইলে আমি এখন…
” আরেহ ছাড়। আমি যাব না। ”

তটিনী শক্ত হয়ে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইলো এবার। শেরহাম ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই তটিনীকে দেখে বলল,
” ওরেহ জ্বালা। তোর সমস্যা কি ভাই? আমার সাথে ঝগড়া না করলে তোর চলে না? ”
তটিনী গোমড়ামুখে বলল,
” চলো। ”
শেরহাম কোমরে দু-হাত রেখে ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে বলল,
” উফফ। ”
তটিনী হেসে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। শেরহাম দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
” নাটকবাজ। ”
তটিনী মুখ তুলে তাকিয়ে বলল,
” হ্যা হ্যা তাও চলো। বউ আদর অনেক খেয়েছ, জামাই আদর খাবে চলো। ”
বলেই শেরহামের হাত ধরে টানতে টানতে কক্ষ থেকে বের করে আনলো।
সদরকক্ষে তাকে দেখে সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো। শেহজাদ গলা বাড়িয়ে বলল,

” ভাইজান কোথায়? ”
শাহানা বসা থেকে দাঁড়াতে যাচ্ছিলো নিজেই শেরহামকে ডেকে আনবে বলে। কিন্তু তার আগেই মন্থর গতিতে তটিনীর পেছনে হেঁটে এল শেরহাম। শোহরাব তাকে দেখামাত্র ডেকে উঠলো,
” আমাল আব্বা। ”
আলিজা শেহজাদের হাত থেকে মাংস পরোটা খেতে খেতে জোরে ডাক দিল,
” অ্যাই কালু আব্বা আবাল দিরি কচচো কেন? আমাল আব্বা তুমাকে তাচতাচ মালবে। ”
শেহজাদ হেসে ফিসফিস করে বলল,
” আল্লাহ, এসব কি আম্মি?
আলিজা দাঁত দেখিয়ে হেসে মাথা একপাশে কাত করে বলল,
” কালু আব্বাকে মালবে? এত্তু করে মালিও কেমন? ”
শেহজাদ, সাফায়াতসহ উপস্থিত সকলেই হেসে উঠলো তার কথায়। তটিনী বলল,
” পাকনির খাওয়া হয়েছে?”
আলিজা মাথা দুলালো। বলল,

” অ্যাই কালু ভাইচান তুমাকেও আমাল আব্বা মালবে। তুমি আমাল সাথি কথা বোলোনা কেন?”
শোহরাব খেতে খেতে আঁড়চোখে তাকালো। শাহানা বলল,
” আহারে, বোনের সাথে কেন কথা বলো না ভাই? ”
শোহরাব আলিজার দিকে ক্ষেপাটে চোখে তাকালো।
শোইয়াব তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
” আব্বা চলি গেলে ওকে তাচতাচ মালবো। ”
শোহরাব বলল,
” চুল ছিড়ি দিবে, কেমন?”
শোইয়াব মাথা নেড়ে বলল,
” আচচা। ”

তটিনী শেরহামকে খেতে দিচ্ছে। সে আসতেই সবাই খাওয়াদাওয়া শুরু করলো। শাহানা বলল,
” শেহজাদ ওদের কি খবর? পৌঁছুবে কখন? মেয়েটা অসুস্থ। খবরাখবর নিয়েছ? ”
” রাতটা ওদের জাহাজে কেটেছে। বেলা দশটার দিকে হাজির হবে আশা করছি। ”
সাফায়াত বলল,
” ডাক্তার সাহেব যেহেতু আসছে ভালোমন্দ রান্না করতে হবে আম্মা। ”
শেহজাদ বলল,
” এখানকার স্থানীয় বাজারে সব পাওয়া যাবে তো? ”
” হুম। ”
” তাহলে বাজার করে পাঠিয়ে দেব। রূপা?”
” জ্বি। ”
” বাজারে তালিকটা। ”
রূপা বলল,
” আমি ফুপুর কাছ থেকে জেনে নিয়ে লিখে দেব। আলিজা খাওয়া শেষ হলে চলে আসো। তোমার আব্বাকে খেতে দাও। ”

আলিজা শেহজাদের গালে গাল ঘষে, চুল ঘেঁটে দিয়ে আদর করে শেরহামের কাছে চলে এল। শেরহামের পাশে পা দুটো গুটিয়ে বসে আঙুল নেড়ে নেড়ে বলল,
” অ্যাই কালু আব্বা, বলো আল দিরি কলবে?”
তটিনী হাসলো। শেরহাম কপাল ভাঁজ করে তাকিয়ে বলল,
” নাহ। ”
আলিজা খিকখিক করে হেসে দাঁড়িয়ে শেরহামের পেছনে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে দুলতে দুলতে শেহজাদকে ডাকলো,
” আব্বা! ”
শেহজাদ ফিরে তাকালো। আলিজা বলল,
” কালু আব্বা ভালু আব্বা। ”
বাকি সবাই ফিরে চাইলো তার কথা শুনে। সোলেমান মাহমুদও। শেহজাদ আর সাফায়াত একসাথে হাসলো।
তটিনী হেসে আলিজার গাল টেনে দিয়ে বলল,
” সোনা বাচ্চা। ”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ৭+৮

দুপুর নাগাদ সোহিনী আর তাঈফ হাজির হলো তটিনীদের বাসভবনে। বাইরে তখন কাঠের আগুনে ধুমচে রান্না হচ্ছে। চারিদিকে মাংসের ঘ্রাণ। গোলাপ জলের সুগন্ধি। বাচ্চাদের হৈচৈ, দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি। তখনি সোহিনীর আগমন আনন্দ আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সে সবাইকে একসাথে দেখে শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিকাতরতায় ঝরঝরে কেঁদে ফেললো। সবাইকে একে একে জড়িয়ে ধরলো। কেঁদেকেটে বলল,
” চারটা ভাই আছে। কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে যায় না। সবাই আমাকে পর করে দিয়েছে। তোমাদের কে বলেছে আমাকে নিকাহ দিতে? আমি এখানে থেকে গেলে কি হতো? ”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১১+১২