প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১৫+১৬
পুষ্পিতা প্রিমা
সারারাত সকলেই জেগে ছিল। কেউ দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি চিন্তায়। খাওয়াদাওয়া কারো মুখে উঠেনি। সায়রা বাচ্চাদের সবাইকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। শোহরাব আর শোইয়াব ঘুমালেও আলিজা ভোররাত পর্যন্ত জেগে ছিল। তার আব্বা না ফেরা অব্দি সে ঘুমোতে যায় না, আম্মা পাশে না শুলে সে ঘুমায় না। তারপর ভোররাতে সিভানের সাথে বকবক করতে করতে ওর কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তটিনীকে কাঁদতে দেখে বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, কালু ভাইচানেল আব্বা তাকে বকা দিয়েছে কিনা। সকলেই তটিনীকে বকেছে, কেন সে শেরহামের কথা শুনে সবাইকে ইমরানের ব্যাপারটা জানায়নি। শাহানা শুধু রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, একটা কথাও বলেনি। অনুশোচনায় তটিনী সারারাত গুমরে গুমরে কাঁদলো এই ভেবে তার জন্য তার বোনটার না কোনো কিছু হয়ে যায়। নইলে সে জীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
ফজরের আজানের পর শেহজাদ, সাফায়াত আর তাঈফ বাড়ি ফিরে এল। তটিনী পাগলের মতো ছুটে গেল তাদের কাছে। সাফায়াতকে বলল,
” ভাইজান শবনম? ”
সাফায়াত কেদারায় চুপটি করে বসে রইলো। সাফায়াতের কাছে উত্তর না পেয়ে শেহজাদকে বলল,
” কেউ কিছু বলছো না কেন? শবনম কোথায়? শোহরাবের আব্বা কোথায়? ”
তাঈফ বলল,
” আসলে শবনম যে জাহাজে ছিল সেই জাহাজটা নিখোঁজ। ওটার নিশানা পাওয়া যায়নি এখন অব্দি। আর বড় ভাইজান ইমরানদের এলাকায়। উনি বলেছেন, শবনমের খোঁজ না পাওয়া অব্দি উনি ফিরবেন না। ”
সকলেই স্তব্ধ। শাহানা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
” নিখোঁজ মানে? জাহাজটা নেই? ডুবে গেছে? ”
সাফায়াত ছুটে এসে মাকে ধরতেই শাহানা তাকে ঝাঁকিয়ে বলল,
” আমার মেয়েটার উপর এ কেমন বিপদ এল? সবসময় ওদের উপরেই কেন এত বিপদ আসে? ”
শাহানা কাঁদতে লাগলো। ইতোমধ্যে তার গলা ভেঙে এসেছে। কথা আটকে আটকে আসছে। সাফায়াত মাকে জড়িয়ে ধরে রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” শবনমের খোঁজ পাওয়া যাবে। আল্লাহ অবশ্যই তাকে হেফাজত করবেন। আল্লাহর উপর ভরসা রাখা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। রূপনগরে চিঠি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সৈন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে জাহাজ নিয়ে। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো খোঁজ পাব। ”
শাহানা করুণসুরে কেঁদে বলল,
” শুধু খোঁজ না, গোটা মেয়েটাকে চায় আমার। আমার সুস্থ সবল মেয়ে আমার চোখের সামনে দিয়ে মেলায় গেল হেসেখেলে। তোমরা এতজনের মধ্য থেকে তাকে নিয়ে গেল কি করে? তোমার আব্বা জেনেশুনে আমার মেয়েটাকে জাহান্নামে ঠেলে দিচ্ছিলো। তার নাকি জহুরী চোখ, কেন সে ভালো করে খোঁজ নিল না ছেলেটার? ”
আয়শা মায়ের সাথে সাথে কাঁদতে লাগলো মাকে শান্ত করতে না পেরে। সাফায়াত বলল,
” আপনাকে শান্ত হতে বলেছি তো আম্মা। কাঁদলে কি শবনম চলে আসবে এখন? আব্বাকে দোষারোপ করে কি হবে? ”
সোলেমান মাহমুদ এলেন তখন। বললেন,
” তোমার মা শুধু আমার দোষ দেখছেন। আমি কি জেনেশুনে আমার মেয়েকে বিপদে ফেলে দিয়েছি? কোনো বাবা তার সন্তানদের ক্ষতি চাইতে পারে? ”
সাফায়াত চিৎকার করে বলল,
” আপনারা কেন মাথা খাচ্ছেন? নিজেরা তর্ক করলে কি শবনম ফিরে আসবে? ইমরান কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে সেটা ভাইজান ছাড়া কেউ জানতো না। ”
” তোমার ভাইজান কি বলতে পারতো না ইমরান তার আগের কুকর্মের সঙ্গী ছিল?”
তটিনী চোখ তুলে তাকালো। সাফায়াত বলল,
” ভাইজান তখন ইমরানের নামে কিছু বললেও আপনি বিশ্বাস করতেন না আব্বা। ভাইজান তারপরও তনীকে বলেছে। কিন্তু তনী বিষয়টাকে জরুরী মনে করেনি। দোষ তো আপনার মেয়ের। ”
তটিনী বলল,
” আজ শবনমের বিয়েটা ইমরানের সঙ্গে হয়ে গেলেও কি আপনি শেরহাম সুলতানকে ধরে গালি দিতেন আব্বা? আপনি আমাকে বকছেন না অথচ সর্বক্ষণ ওকে যা নয় তা বলে যাচ্ছেন। একটা মানুষের খারাপ অতীত আছে বলে সবসময় তা নিয়ে খোঁটা দিলে কি সব সমস্যা মিটে যাবে? আমি আমার আব্বাকে অনেক সম্মানের চোখে দেখি। আমি এটা আশা করিনা আমার আব্বার কাছ থেকে। যার থেকে আমি সুশিক্ষা পেয়েছি ছোটবেলায় সে নিজেই উল্টো গান করলে আমার খারাপ লাগে। আমাকে বকুন, মারুন। যা ইচ্ছে হয় তা-ই করুন। দোষ আমার আমি মানছি কিন্তু ওই মানুষটাকে কথায় কথায় তার পূর্বের কাজ নিয়ে খোঁচা মারলে সেটা আমার দুধের শিশুর উপর গিয়েও পড়ে। আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। আমি যথেষ্ট ভালো আছি, আর সঠিক মানুষকেই বেছে নিয়েছি। আপনি তার মতো দুজন সঠিক মানুষ খুঁজে, তাদের হাতে কিভাবে আপনার বাকি দুই মেয়েকে তুলে দেবেন তা নিয়ে ভাবুন। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
আমি খুব ভালো আছি। আর আমি কেন কাউকে কিছু বলিনি তা জানতে চাইছেন না সবাই? আমি কাউকে কিছু বলিনি কারণ আমি চাইনি এইসব ঝামেলায় শোহরাবের আব্বা জড়িয়ে পড়ুক, ও যেহেতু ইমরানকে তাড়িয়েছিল ভয় দেখিয়ে আমি ভেবেছিলাম ইমরান ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু বিষয়টা এত গুরুতর হয়ে যাবে আমি তা ভাবিনি। দোষ যদি কেউ করে থাকে তাহলে সেটা আমি করেছি, ও নয়। আপনি আমাকে শাস্তি দিন, আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু আমি ওকে নিয়ে কোনো কথা শুনতে চায় না। একটা মানুষ দোষ না করেও সারাক্ষণ মন্দ কথা শুনে চুপ করে থাকে বলে এ নয় তার ধৈর্যের বাঁধ কখনো ছিঁড়বে না। হুট করে মুখ ফস্কে আপনাকে কিছু বলে দিলে আপনার মান থাকবে? যেটুকু সম্মান দিচ্ছে সেটুকু সম্মান না পেলে আপনার ভালো লাগবে? আমাকে মাফ করুন আব্বা। আমি ভুল করেছি আমাকে যা ইচ্ছা বলে যান আমি সহ্য করব, কিন্তু ওকে টেনে কুকথা বলবেন না। আমি আমার আব্বা আর স্বামীর মধ্যে কোনো দূরত্ব চাই না, না কারো নামে বদনাম শুনতে চাই। আমি দুজনকেই সম্মানের জায়গায় রাখতে চাই। দুজনেই আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। দুজনেই আমার ঢালস্বরূপ। ও যখন বলেছে ও শবনমের খোঁজ না নিয়ে ফিরবে না, তারমানে ও ওর কথা রাখবেই। ”
সাফায়াত বলল,
” তনী তুমি যাও। আব্বা আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন। ”
সোলেমান মাহমুদ তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
” না থাক। তোমার সাথে সাথে ছেলেমেয়েরাও আমার দোষ দিচ্ছে শাহানা। এখন সব দোষ আমার। আমি আমার শবনমকে বিপদের দিকে ফেলে দিয়েছি। ”
শেহজাদ বলল,
” ফুপুআব্বা আমরা কেন নিজেদেরকে দোষারোপ করছি। শবনমের জন্য দোয়া করুন যাতে সে যেখানেই থাকে ভালো থাকে। আমরা আবার বেরিয়ে পড়বো কিছুক্ষণ পর। রূপা সবাইকে খেতে দাও। আর তনী, ভাইজানের জন্য খাবার দিয়ে দাও। ভাইজান আপাতত ফিরবে না। ফুপুআব্বা আপনি..
গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেলেন সোলেমান মাহমুদ।
তটিনী উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ভাবলো, জন্মের পর বোধহয় আব্বার সাথে এই প্রথম এত রূঢ় ভাষায় কথা বলেছে সে। আব্বার সমস্ত ভুল একদিন ভাঙবে আর রাগ একদিন গলবে। সে গলিয়ে ছাড়বে।
তাড়াহুড়ো করে পেট ভরে মতো খেয়ে শেহজাদ আর সাফায়াত বেরিয়ে পড়েছে। তাঈফও বেরিয়েছে তাদের সাথে। সবার চোখের কোটরে একরাতের মধ্যে কালি জমে গেছে। বাড়িতে নাওয়াখাওয়ার ঠিক নেই কারো। কারো হাতে কাজও উঠছে না। আনন্দহীন, নির্জীব হয়ে রয়েছে পুরো বাড়ি। বেলা দশটায় ঘুম থেকে উঠে আলিজা হাঁটতে হাঁটতে সদরকক্ষে এসে দেখলো তটিনীর বুকে লেপ্টে আছে শোহরাব। সে জিজ্ঞেস করলো,
” অ্যাই কালু ভাইচানেল আম্মা কালু ভাইচানেল আব্বা এখুনো আচেনি? ”
তটিনী দু’পাশে মাথা নাড়লো। আলিজা আয়েশার কাছে গেল। আয়েশার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” অ্যাই আচাফুপ্পী চববমফুপ্পী আচেনি?”
আয়েশা চেয়ে রইলো ওর মুখের দিকে। অপরূপা এসে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” ফুপীদের মন খারাপ। এত কথা বলতে কে বলেছে? ”
” আমাল আব্বা কুথায় ? ”
” এসেছিল তো। আপনাকে অনেক আদর করেছে তারপর আবার চলে গেছে। ”
আলিজার তার কথায় সন্তুষ্ট না হয়ে চেঁচিয়ে বলল,
” নয় নয়। আম্মা ভানো না। ”
অপরূপা বলল,
” আহা চেঁচাবে না। সবার মন খারাপ। চুপচাপ বসে খাও, আর খেলা করো। ”
আলিজার কান্না শুরু হলো তখনি। ধস্তাধস্তি করে কোল থেকে নেমে গেল। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে বলল,
” আব্বা কুথায়? ”
অপরূপা কোমরে হাত দিয়ে চেয়ে রইলো তার কান্ড। শোইয়াব আর শোহরাব এসে দাঁড়ালো অপরূপার পাশে। শোইয়াব তাকে এই অবস্থায় দেখে বলল,
” ফুচা মেয়ে। ”
আলিজা মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। শোহরাব মিটিমিটি হাসছে দেখে গড়াগড়ি থামিয়ে দিল হঠাৎ । শোয়া থেকে উঠে খোদেজার কাছে চলে গেল দৌড়ে দৌড়ে। মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” ডাডুউ কালু ভাইচান হাচচে কেন? তাচতাচ মালো কালু ভাইচানকে। ”
খোদেজা বলল,
” আচ্ছা হাসতে বারণ করব কালু ভাইজানকে। ”
শবনমের ঘুমটা দেরীতে ভাঙলো। চোখ ছোটার সাথে সাথে সে শুনতে পেল ছেলেগুলোর হৈচৈ, ছোটাছুটি, চেঁচামেচি। আড়মোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠলো সে। তাঁবুর ভেতরে বাইরের আলো ঢুকে পড়েছে। শোয়া থেকে উঠামাত্রই সমস্ত শরীরে ঠনঠনে ব্যাথা অনুভব হলো। শিরা-উপশিরায় ব্যাথা। মাথাটাও ব্যাথা হয়ে আছে। এমতাবস্থায় গরম চা হলে তার মাথা ব্যাথাটা ছেড়ে দিত। অসহ্য ব্যাথা নিয়ে চোখমুখ কুঁচকে পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। পা খুঁড়িয়ে হেঁটে তাঁবুর ভেতর হতে বের হতেই এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করলো। গতরাতের পরিবেশ যেমন অদ্ভুত ভুতুড়ে ঠেকছিলো, দিনের আলোয় তার রেশটুকু নেই। কি সুন্দর ফকফকা সাদা আকাশ মাথার উপর, চারপাশে সবুজবিথী। উচুনীচু সবুজ ঢিবি, ছোট-বড় অসংখ্য গাছ। জলাধারের পাশে অল্পবয়স্কা ছেলেগুলো লাটিম খেলছে। নাদির আর কাশিফকে দেখতে পেল না শবনম। তাঁবুর কাছে ফিরে আসতে যাবে ঠিক তখনি তার চোখ পড়লো ঠাঙিয়ে রাখা রশির দিকে। ভেজা কাপড় শুকোতে দেয়া হয়েছে। শবনম অবাক হলো রশিতে তার কাপড়গুলো অর্ধভেজা দেখে। চট করে তাঁবুতে ঢুকলো সে। তার কাপড়গুলো নেই! তাঁবুর বাইরে এসে কাপড়গুলো দেখে কপাল চাপড়ালো সে। চেঁচিয়ে ডাকলো,
” এই ছেলে, উনারা কোথায়? ”
” কে আপামণি? ”
” ক্যাপ্টেন আর উনার বন্ধু। ”
শবনম তাদের স্মরণ করতে না করতেই তারা চলে এল। কাশিফ ছেলেদের তাঁবুর পেছনে দাঁড়িয়ে সকালের খাবার প্রস্তুত করছে। নাদির এসে বলল,
” রাতের ঘুম ভালো হয়েছে? ”
শবনম বলল,
” আমার কাপড় ধুঁয়েছেন কেন? ”
নাদির কপাল কুঞ্চিত করে বলল,
” কোনো সমস্যা? ”
শবনম লজ্জায় কি আর বলবে। তার লজ্জাবনত মুখটা দেখে নাদির মজা করে বলল,
” ওই চাদরটাও ধুয়ে দিয়েছি। ”
শবনমের কানদুটো গরম হয়ে এল। নাদিরের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাতেই দিনের আলোয় মানুষটাকে অন্য একটা মানুষ মনে হলো। আগে স্বাস্থ্য কম ছিল, এখন আগের চাইতে আরও সবল লাগছে। শবনম ভাবলো, এই বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো এত সবল থাকে কি করে? কাশিফ এসে বলল,
” কি ব্যাপার? কি নিয়ে কথা হচ্ছে? ”
নাদির বলল, ” কাপড় ধোঁয়া নিয়ে। ”
শবনমের ভীষণ অস্বস্তি কাজ করছে। নাদিরের দিকে দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। কাশিফ হো হো করে হেসে উঠে বলল,
” আরেহ জাহাজ না আসা অব্ধি আপনাকে এখানেই থাকতে হবে। ততদিনে আমাদের সেবা করে পুষিয়ে দিবেন। যেমন, কাপড়চোপড় ধোঁয়া, রান্না-বান্না করা। ”
নাদির বলল, ” কাকে কি বলছিস? উনাদের তো বুয়ারা রেঁধেবেড়ে খাওয়ায়। রান্না-বান্না ওনাদের কাজ নয়। ”
শবনম বলল, ” কে বলেছে আপনাকে। আমি মোটামুটি সব কাজই পারি। ”
নাদির বলল,
” তাহলে তো বেশ ভালো। আপনি সুস্থ হলে রান্না আপনিই করবেন। আপাতত কাল পর্যন্ত মাংস দিয়ে চলবে। ”
কাশিফ বলল, ” আচ্ছা, সকালের খাবার প্রস্তুত। এই সবাই খেতে আয়। কাজ আছে। বেরোতে হবে সবাইকে। তাড়াতাড়ি আয়। ”
ছেলেগুলো তার কাছে চলে গেল।
শবনম তেরপাল দিয়ে বাঁধা খোলা শৌচাগারের দিকে চলে গেল। গর্ত খুঁড়ে, জাহাজের কয়েকটা বড়সড় অংশ দিয়ে, রড ব্যবহার করে খুবই দক্ষ হাতে টয়লেটের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। মলমূত্র সাপ্লাই দেয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে যা একটা নল বেয়ে সরু নালার মতো জায়গায় গিয়ে পড়ে। আসার পর থেকে শবনমের এটা নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু অতটা অসুবিধে নয় বলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। অতটাও স্বাস্থ্যকর না হলেও এমন নিঝুমপুরীতে এর চাইতে ভালো শৌচাগার কোথায় পাবে সে?
সকালের খাবার হিসেবে শবনম পেল, কয়েকটা কাঁচা পেয়ারা, বন্য লাল আলু সিদ্ধ আর লেবুপানি তাও গরম। যা চায়ের বিকল্প হিসেবে আবিষ্কার করেছে নাদির। মুখে তৃপ্তি না লাগলেও শবনম খেল। আর খেতে খেতে জানতে পারলো, তারা সবাই ঘুরেবেড়ানোর জন্য এখানে এসেছে ঠিক কিন্তু এতদিন থাকার কোনো ইচ্ছে ছিল না। তারা এখানে আসার পরদিনই জংলীদের হাতে তাদের জাহাজটা ভাঙচুর হয়। ভেঙেচুরে জাহাজটাকে তার খন্ডবিখন্ড করে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়। তারা তা দেখতে পায় তার একদিন পর। ততক্ষণে বেশকিছু অবশিষ্ট জাহাজের অংশবিশেষ ছিল নেয়ার মতো। তাদের উপরও জংলীরা হামলা করে। তাদের কাছে অস্ত্র ছিল বিধায় তাদের রুখতে সক্ষম হয়েছে। তারা এখন পালিয়ে গিয়েছে কিন্তু কখন আবার আক্রমণ করে বসে তা বলা যায় না। তারা অনেক ভয়ংকর এবং শক্তিশালী। আল্লাহ সহায় ছিল বলে সেদিন তারা রেহাই পেয়েছে। কিন্তু বলা যায় না বিপদ কোন সময় চলে আসে। শবনম সবটা শুনে চিন্তিত হলো মেয়েগুলোর জন্য। তারা যদি জংলীদের হাতে পড়ে?
দুপুরের খাবার কাশিফ রান্না করেছে। শবনম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে।
তাদের আনা মশলাপাতি সব খাওয়া শেষ। শুধু লবণমরিচ বাকি আছে। তা দিয়ে সব রান্না চলছে। নাদির ছেলেগুলোকে নিয়ে ওই মেয়েগুলোকে খুঁজতে বের হয়েছে। আর ফিরে এসেছে খালি হাতে। শবনম ভেবেছিল একজনকে হয়ত খুঁজে পাবে কিন্তু নাদির তাদের দেখা পায়নি। শবনম চিন্তিত হয়ে পড়লো। কোথায় যেতে পারে তারা? নাদির আরও বললো, ” ওখানে যে জাহাজটা দাঁড়িয়েছিল সেটা করে আপনারা এসেছেন? ”
শবনম জানালো ” হ্যা। ওটাতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা গিয়েছে। ওটা প্রায় ডুবে যাচ্ছিলো। ”
নাদির কাশিফকে বলল, ” আমি দেখে এসেছি কি সমস্যা হয়েছে। চেষ্টা করে দেখবো সারানো যায় কিনা?”
শবনম বলল, ” ওটা দস্যুদের। ওরা আশেপাশেই আছে। ওদের জাহাজের দিকে হাত বাড়াবেন না। ”
তার কথা শুনে নাদির আর কাশিফ একসাথে হাসলো। কাশিফ বলল,
” জলদস্যুদের সাথেই আমরা থাকি জনাবা। ”
শবনম অবাক চোখে চেয়ে বলল,
” কি? আপনারাও কি দস্যু? ”
দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলো। নাদির পাথরের উপর বসে উনুনে আগুন নেড়েচেড়ে দিতে দিতে বলল,
” দস্যুদের আশেপাশে থাকতে ভয় হচ্ছে? ”
শবনম মৃদু হাসলো। বলল,
” মোটেও না। ”
নাদির বলল, ” আপনাকে তো আমরা এত সহজে ছাড়ছিনা। আপনার ভাইজানদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করব। মুক্তিপণ না দেয়া অব্দি ছাড়বো না। ”
কাশিফ বলল, ” একদম ঠিক। ”
শবনম বলল,
” আমি থেকে যেতে চাইলেও মুক্তিপণ চাইবেন?”
নাদির চট করে কাশিফের দিকে ফিরে তাকালো। কাশিফ খুক খুক করে কাশার ভান করে কেটে পড়লো।
সন্ধ্যায় ছেলেগুলোর সাথে বসে গল্পগুজব করছিলো শবনম। নাদির আর কাশিফ নতুন তাঁবু টাঙাতে ব্যস্ত। শবনম তাদের হাতে হাতে অনেককিছু এগিয়ে দিয়েছে। এখন ছেলেগুলোদের সাথে গল্প করছে। আলিজা, শোইয়াব আর শোহরাবের কথা বলে বলে হাসছে। নাদির তাঁবুর পর্দা টাঙাতে টাঙাতে হঠাৎ দেখলো কতকগুলো লোক এদিকেই এগিয়ে আসছে। যেন তারা ক্ষুদার্ত পশু। সে শবনমকে ডেকে বলল,
” শবনম তাঁবুতে যান। বের হবেন না বলা অব্ধি। ”
শবনম বলল, ” কেন? ”
” যেটা বলেছি সেটা করুন। ”
শবনম তাঁবুর ভেতর চলে গেল।
জলদস্যুরা ক্ষুদার্ত ছিল। ক্ষিদের তাড়নায় তাঁবু দেখামাত্র ছুটে এসেছে। আসামাত্র খায় খায় করছে। এমনকি হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো উঁচুনীচু সমতল ভূমিতে। তাদের সবার সাথে কাশিফ অনেকক্ষণ মজা উড়ালো। গতবার আনন্দনগর যাওয়ার পথে এরা তাদেরকে বাগে পেয়ে কতবড় বিপদে ফেলে দিয়েছিল। নাদির অনেক হাসিঠাট্টা করার পর তাদেরকে খেতে দিল। অর্ধসেদ্ধ করা মাংস তারা গপাগপ খেল তৃপ্তি নিয়ে। তারপর ঢকঢক করে পানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে নাদিরের দিকে সন্তুষ্টির চোখে চেয়ে বলল, তাদের অনেকেই অনাহারে আধমরা হয়ে পড়ে রয়েছে। হাঁটতে পারছেনা। তাদের জন্যও কিছু খাবার দরকার।
নাদিরের মায়া হলো তাই দিয়ে দিল। আর বলে দিল, এদিকে যেন আর না আসে। নিজেদের খাবার নিজের যোগাড় করে খায়, আর তাদের সাথে আনা মেয়েগুলোকে যদি খুঁজে দিতে পারে তাহলে তাদের রোজ খাওয়াবে। তারা নাদিরের কথা মেনে খাবার নিয়ে চলে গেল। শবনম তাদের দেখে অবাক হলো এই ভেবে, ক্ষুধার তাড়নায় জঘন্য মানুষও নাদান-বাচ্চার মতো হয়ে যায়। কে বলবে এরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মানুষের প্রাণ নিতে দুবার ভাবেনা। নাদির জানে তারা আবারও আসবে। এমনকি এই তাঁবুতে গেঁড়ে বসতেও চাইবে। ক্ষুধার চোটে বেড়ালছানার রূপ নিলেও ক্ষুধা মিটে গেলে পশুতে রূপান্তরিত হতে সময় লাগবে না। সে চিন্তিত হয়ে পাথরের উপর বসে রইলো চুপচাপ। শবনম গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বের হলো তাঁবু থেকে। তার পায়ের ব্যাথা এখনো কমার নয়। বেশি জোর দিয়ে হাঁটতে পারছে না।
সে কাশিফকে দেখামাত্র বলল,
” ওরাই আমাদের নিয়ে এসেছিলো। কত জঘন্য ওরা। অথচ খেতে না পেয়ে দেখুন কেমন অবস্থা হয়েছে। ”
কাশিফ নাদিরের উদ্দেশ্য বলল, ” হ্যা এরা পয়সা ছাড়া কিছু বুঝে না। ক্ষিধে মিটে গেলে দেখবি সবকটা এখানে হামলা করে বসবে একসাথে। এদের সাথে মহান হতে গেলি কেন? ”
নাদিরের মেজাজ বিগড়ে আছে এদের দেখার পর থেকে। সেবার একজন জাহাজ যাত্রীর বউ বলামাত্র অলংকার খুলে না দেয়ায় গলায় চাকু চেপে দিয়েছিল তাদের সামনে। সে কিচ্ছু করতে পারেনি। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে সে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো, ” উটকো ঝামেলা। ”
শবনম তৎক্ষনাৎ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। অবাককন্ঠে চক্ষু বিস্ফোরিত করে জিজ্ঞেস করলো, ” আপনি আমাকে উটকো ঝামেলা বললেন?”
নাদির তার প্রশ্ন শুনে নিজেই বিস্ময় নিয়ে তাকালো। কাশিফের দিকে চেয়ে ফের শবনমের দিকে তাকিয়ে বলল,
” অদ্ভুত! আপনাকে কেন… আর বললেও ভুল তো কিছু বলিনি। ”
সূক্ষ অপমানে শবনমের মুখটা ছোট হয়ে এল। ঢোক গিলে ভীষণ দুঃখের সাথে ছোট করে বলল,
” আপনাদের ঝামেলায় ফেলে দেওয়ায় আমি দুঃখীত। আমার হাতে তো কিছু নেই। আমি ইচ্ছে করে আপনাদের ঝামেলায় ফেলিনি। ”
কাশিফ বলল, ” মাহমুদা ব্যাপারটাকে এত জটিল করে তুলবেন না। দেখুন আপনি আসায় আমরা কোনো অসুবিধেয় পড়িনি। আর আলাদা করে কিছু রান্না করছি এমনও না। আপনি নিজেকে ঝামেলা মনে করবেন না। ও কি বলতে কি বলে ফেলেছে। আরেহ তোর কি মাথাটা গেছে নাকি? ”
কাশিফ নাদিরের পিঠ চাপড়ে কথাটা বললো। শবনম ততক্ষণে তাঁবুর ভেতরে চলে গেল। নাদির সেদিকে একপলক তাকালো। বলল,
” আজব! কাদের বলেছি কে গায়ে টেনে নিল! আমি উনার নাম নিয়ে বলেছি? ”
” মেয়েমানুষ দু’লাইন বেশি বুঝে এটা জেনেও এমন কথা বলিস কেন? ”
” আচ্ছা, যাহ ডেকে নিয়ে আয়। ”
” আমি কিছু পারব না। তুই ঝামেলা বাঁধিয়েছিস তুই সমাধান কর। ”
নাদির কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। কাশিফ প্রস্থান নিতেই নাদির শবনমকে ডাক দিয়ে বলল, ” শবনম!”
শবনম উঁচু স্বরে উত্তর দিল, ” আমার নাম উটকো ঝামেলা। ”
নাদির হেসে উঠলো তার কথায়। বলল, ” যথাআজ্ঞা। নামটা আপনার পছন্দ শুনে ধন্য হলাম। ”
শবনম রাতে আর কিছু খায়নি। তাঁবু থেকেও বের হয়নি। নাদির কাশিফকে দিয়ে খাবার পাঠিয়েছে। শবনম তাঁবুর পর্দা ভেতর থেকে এমনভাবে বেঁধেছে ভেতরে প্রবেশ করতে পর্দা ছিঁড়ে ফেলতে হবে। কাশিফের কথা না শোনায় নাদির নিজেই গেল। তাকে আঘাত করে কথা বলার জন্য দুঃখ প্রকাশও করলো, শবনম জানালো সে রাগ করেনি, তার এমনিই খেতে ইচ্ছে করছে না। না খেয়ে থাকলে তার কষ্ট হয় না। নাদির তারপরও খাবারের থালা হাতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল কিন্তু শবনম ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।
পরদিন সকালে শবনমের যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রায় ভোর। তাঁবু থেকে বের হওয়ামাত্র দেখলো ছেলেপেলেরা সব কটা ঘুম থেকে উঠে গেছে। শবনম উনুনের ওদিকে যায়নি। ছেলেগুলো বসে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছে। শবনমকেও কয়লা এনে দিল একটা ছেলে। শবনম দাঁত মেজে মুখ ধুঁয়ে নিল জলাধারের পানি দিয়ে। মুখ ধোঁয়ার সময় জলাধারের স্বচ্ছ পানিতে নিজের মুখে শত আঘাতের চিহ্ন, দাগ দেখে নিজেই ভড়কে গেল। কি জঘন্য বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে তাকে! এই চেহারা দেখলে তো তার নিজেরই ভয় লাগছে। কেমন কাঁটাছেড়া অসংখ্য দাগ ভর্তি মুখ। দু-রাতের মধ্যে গায়ের রঙটাও কেমন ময়লা ময়লা ঠেকছে। লজ্জায়, আড়ষ্টতায় পাথরের উপর বসে রইলো সে চুপচাপ। কাশিফ এসে বলল,
” শুভ সকাল মাহমুদা। কাল রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে অন্যায় করেছেন। রাগ করে না খাওয়া ভালো না।”
শবনম হেসে বলল, ” আমার খেতে ইচ্ছে করেনি, আমি একটুও রাগ করিনি। ”
” তা মানলাম। এখন খেতে আসুন।”
শবনম নড়লো না। নাদির নিজেই তার খাবার নিয়ে এল। তার সামনের পাথরটাতে গিয়ে বসতেই ওড়না টেনে মুখ ঢাকলো শবনম। নিজের মুখ আড়াল করে বলল,
” রেখে যান, আমি খেয়ে নেব। ”
নাদির বলল, ” কালকের জন্য আমি দুঃখীত। আমি মোটেও আপনাকে উটকো ঝামেলা বলিনি। দস্যুদের বলেছি। ”
” দস্যু আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি? ওদেরও যেমন খাওয়াতে হলো, আমাকেও তো খাওয়াতে হচ্ছে। ”
” পার্থক্যটা খাওয়া নিয়ে নয়, স্বভাব নিয়ে। ওদের স্বভাব মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখা। আপনি নিশ্চয়ই কারো কাছে আতঙ্কের কারণ নন?”
শবনম মুখটা অন্যদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে নিজেও খানিকটা ঘুরে গেল। নাদির গলা বাড়িয়ে বলল,
” একি, আপনার মুখে কি হয়েছে? এভাবে মুখ ঢাকছেন কেন? ”
শবনম এবার তাকে পুরোপুরি পিছু করে বসলো। চোখের পলকে দাঁড়িয়ে পড়লো আর চট করে থালাটা নিয়ে তাঁবুর দিকে হেঁটে চলে যেতে যেতে থমকালো নাদিরের প্রশ্নে,
” আপনি কিছু না বললে তো আমার নিজেকে অপরাধী মনে হবে। ”
শবনম ধীরেধীরে খানিকটা ফিরলো নাদিরের দিকে। ছোট্ট করে বলল,
” আমাকে দেখে আপনার ঘৃণা লাগছেনা? ”
” কারণ? ”
শবনম সামনে ফিরে দাঁড়ালো। ওড়না মুখে টেনে নিয়ে তাঁবুর ভেতরে চলে গেল কোনো উত্তর না দিয়ে। নাদির কপাল কুঞ্চন করে চেয়ে রইলো।
অতিরিক্ত কোনো পোশাক না থাকায় শবনম গতকাল গোসল করেনি। তার নিজেকে নিজের কাছে বড়ই ভয়ংকর আর ঘেন্না লাগছিলো। বাড়িতে থাকলে সে কত পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন থাকে। আজ তার গোসল না করলে চলবে না। আজ কাপড়গুলো শুকিয়েছে।
নাদির আর কাশিফের সাথে ছেলেগুলো সবাই একসাথে গল্প করছে। কাল সবাই জলাধারের পানি দিয়ে গোসল সেড়েছে কিন্তু সে তো আর সবার সামনে গোসল করতে পারবে না। ওইদিন অন্ধকারে শৌচাগারের পাশেই গোসল করেছিল। আজ দিনের আলোয় কিভাবে সে গোসল সাড়বে? শৌচাগারে যেতেই দেখলো সেখানাকার একটা ছেলে নোংরা করে এসেছে। সে নাক সিটকে চেঁচাতে চেঁচাতে বেরিয়ে এসে বলল,
” কে করেছ ওসব? এক্ষুণি পরিষ্কার করে এসো। ইয়াক। ”
সেই ছেলেটা দৌড়ে এসে বলল,
” আপামণি আমি পরিষ্কার করে আসতেছি। ”
শবনম রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। কাশিফ আর নাদির তার কান্ড দেখে হাসতে লাগলো। শবনম তাদের হাসাহাসি দেখে আরও ফুলতে লাগলো। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
শবনম বালতির সাহায্যে জলাধারের পানি টেনে গোসল সেড়ে নিল। আসার পরদিনই নাদির তাকে একটা সুগন্ধি সাবান দিয়েছিলো। সেটা শবনম এমনভাবে ঘষামাজা করেছে সেটা প্রায় শেষ হওয়ার পথে। ভেজা কাঁপড় নিয়ে শবনম তাঁবুর দিকে চলে এল গায়ে ওড়না জড়িয়ে।
শবনমের সবরকমের অসুবিধা, অস্বস্তি, সমস্যার কথা চিন্তা করে কাশিফ নাদিরকে বলল,
” আর কতদিন এখানে থাকতে হবে। সব জিনিস ফুরিয়ে যাচ্ছে। ”
নাদির ভাবুক হয়ে বসে রইলো। এখানে আটকা পড়ার পর উদ্ধার হওয়ার কোনো চিন্তায় মাথায় আসেনি তার, কিন্তু শবনম আসার পর চিন্তা ঝেঁকে ধরেছে তাকে। এখানে আর বেশিদিন থাকা যাবে না। যেকোনে উপায় বের করতেই হবে। কিন্তু আপাতত কোনো পথ তার সামনে খোলা নেই।
ভেজা চুল খোলা রেখে, মাথা ওড়না দিয়ে ঢেকে শবনম কাপড়চোপড় ধুঁয়ে রশিতে বিলিয়ে দিল। বড় বড়শী দ্বারা সামুদ্রিক মাছ ধরে এনেছে কাশিফ। সেটা নাদির কাটাকুটির পরিকল্পনা করছিলো এতক্ষণ। শবনম গুটিগুটি পায়ে হেঁটে সেদিকে গেল। একেবারে হাত পা গুটিয়ে বসে বসে খাবার গিলা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তাই সে আবদার করে বসলো,
” ভাইয়া আজকে আমি রাঁধি? ”
কাশিফ তার প্রশ্ন শুনে চোখ তুলে তাকালো। হেসে উঠে বলল,
” পারবেন? ”
শবনম মৃদু হেসে বলল, ” চেষ্টা তো করতে পারি। মসলাপাতি আছে? ”
কাশিফ সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ আসুন। মশলা-লবন যা আছে তা দিয়ে কোনোমতে রাঁধবেন। বন্যমানুষের খাবারে লবণ মরিচ হলেই হয়ে যায়। অত মশলাপাতি কোথায় পাবে? ”
নাদির মাছটা দু’ভাগ করতেই মাছের রক্তে ভরে উঠলো তার দু-হাত। মাছের পেট পরিষ্কার করে, মাছটাকে মাঝখান দিয়ে কেটে ফেললো। শবনম কাশিফকে বলল,
” মাছটাকে আমাকে দিতে বলুন। ওটা পরিষ্কার করতে হবে। পরিষ্কার না করে পোঁড়ালে আমি খাব না। ”
কাশিফ গলা খাঁকাড়ি দিল। নাদির সরু চোখে তাকিয়ে রইলো। কাশিফ মাছটা টেনে এনে শবনমকে দিতেই শবনম মাছটা পরিষ্কার করার জন্য খাঁজকাটা ইট খুঁজে নিয়ে মাছটা পরিষ্কার করতে লাগলো। নাদির কাশিফের দিকে দৃষ্টি ফিরাতেই কাশিফ হেসে বলল,
” মেয়েমানুষ!”
মাছগুলোকে ঝকঝকে তকতকে করে নিয়ে এল শবনম। হেসে বলল,
” এই দেখুন। এবার খেতে কোনো অসুবিধে নেই। ”
কাশিফ বলল,
” হুমম দেখতেই তো পাচ্ছি। ”
শবনম মরিচ লবণ দিয়ে মাছটাকে ভালমতো মেখে, কাঁচামরিচ ফালা ফালা করে মাছের গায়ে আঁচড় কেটে তার মধ্যে দিয়ে দিল আর সাথে কয়েকটা লেবুপাতা সুগন্ধির জন্য। নাদির তার কাজ চেয়ে রইলো চুপচাপ। শবনম মাছটা পুরোপুরি প্রস্তুত করার পর রডের উপর যে থালাটা রয়েছে তার উপর তুলে দিল। ছোট ছেলেগুলো কয়েকটা বড় বড় সাইজের বেগুন নিয়ে এসেছে। সেগুলো ঝাল ঝাল করে ভর্তা করলো শবনম। ভাত হলে পুরো জমে যেত। মনে হয় কতদিন ভাত খায় না সে।
নাদির আর কাশিফ ছেলেগুলোকে সাথে নিয়ে গোসল সাড়তে চলে গেল। গোসল শেষে এসে দেখলো প্রত্যেকের জন্য খাবার সাজিয়ে রাখছে শবনম। বড়সড় মাছের টুকরো আর সাথে বেগুন ভর্তা! ধোঁয়া উঠছে ভর্তা আর মাছের উপর হতে। লেবুও কেটে দিল শবনম। লেবুগুলো টক কম, মিষ্টি বেশি। অনেকগুলো খাওয়া যায়। কাশিফ সবাইকে বলল,
” আজ কিন্তু তোদের আপামণি রান্না করেছে। খাওয়ার পর নাম্বার দিবি। ক্যাপ্টেনদের রান্না সেরা নাকি তোদের আপামণির। ”
শবনম হাসলো। ছেলেগুলো নাদিরের জন্য অপেক্ষা করছিলো। কাশিফ বলল,
” তোরা খা। আমি আছি। ”
ছেলেগুলো খাওয়া শুরু করলো। খেতে খেতে বলল,
” আপামণি সেই রেঁধেছ। ”
শবনম বলল,
” হ্যা, খেয়ে টয়লেট নোংরা করবে এবার। ”
সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো। কাশিফ কাশতে কাশতে বলল,
” শবনম নাদিরকে ডেকে আনুন দয়া করে। ”
শবনম হাসি থামিয়ে বলল,
” ডেকে আনতে হবে? ”
” কালকের পর মনে হয় আপনি তার সাথে আর কথা বলেননি তাই সে মনে করছে আপনি তার কথায় আঘাত পেয়েছেন। আর যে তার সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে তার হাতের রান্না সে খাবে কেন?”
শবনম কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” এটাও সত্যি মানতে হবে? ”
কাশিফ জোর দিয়ে বলল, ” এটা সত্যিই। আপনি মানুন আর না মানুন আপনি কিন্তু কাল ওর কথায় কষ্ট পেয়েছিলেন। ”
শবনম হাত ঝেড়ে বলল,
” বেশ। ডেকে আনছি। ”
সে ডাকার জন্য পা বাড়াতে যাবে তার আগেই গামছা রশিতে শুকোতে দিয়ে হেলেদুলে হেঁটে এল নাদির। কপালের পাশ দিয়ে চুল হতে চুপসে চুপসে জল পড়ছে। তার জন্য বেড়ে রাখা খাবারটা নিয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো। কাশিফ ভুলেও শবনমের দিকে তাকালো না। খেতে খেতে বিড়বিড়িয়ে বলল,
” শালা সব বরবাদ করে দিলি। ”
প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ১৩+১৪
শবনম ছেলেগুলোর পাশে খেতে বসলো। খেতে খেতে হঠাৎই নাদিরের চোখাচোখি পড়তেই ওড়না টেনে মুখ ঢেকে নিয়ে পাশ ফিরে খেতে লাগলো। নাদির সরু চোখে তাকিয়ে খেতে লাগলো। কাশিফ বলল,
” শালা তুই একটা হাঁদারাম। ”
নাদির ভ্র-কুটি করে তাকিয়ে বলল,
” ফালতু কথা রাখ। ”