প্রেমতৃষা পর্ব ১৩
ইশরাত জাহান জেরিন
চোখে সূর্যের আলো পড়তেই ঘুমটা তখন হালকা হয়ে আসে তৃষার। সে উঠে বসতেই দেখল ৯ টা বাজে বেলা। হায় আল্লাহ প্রথম দিনেই এত লেট? তৃষার স্পষ্ট মনে আছে ভোরের দিকে তার ঘুম ভেঙেছিল। তখন সে উঠে ওই জঙ্গলের দিকটায় যায়। হঠাৎ কেউ একজন তাকে পেছন থেকে চেপে ধরে। ব্যাস তারপর কী হয়েছিল মনে নেই। তৃষা তখনো চোখে ঝাপসা দেখছে। উঠে বসতেই একজন মহিলা নক করে রুমে ঢুকে বলল, ‘আপা আপনার ঘুম কি ভাঙছে? এই বাড়ির মানুষ সকালে একলগে খাওয়ান খায় । আপনারে বড় মেডাম ডাক পারে।’
তৃষা কাজের মহিলা জুনুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসছি। জাস্ট পাঁচ মিনিট।’
‘আইচ্ছা।’
তৃষার মাথাটা এখনো ঘুরাচ্ছে। সে বারান্দায় গিয়ে ডানপাশের সেই জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে জলদি ভেতরে ঢুকে পড়ল। স্বপ্ন নাকি সত্য কি দেখেছে এখন নিজেরই মনে পড়ছে না। নাস্তার টেবিলে এসে বসতেই হেতিজা হেসে বলল, ‘শরীর অসুস্থ নাকি?’
‘না। তবে কেমন যেন একটা লাগছে।’
‘নাস্তা করে নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তৃষা টেবিলে প্রত্যুষকে খুঁজল। অথচ পেল না। এখন মুখ ফুটে জিজ্ঞেস তো করতে পারে না হবু শাশুড়ীকে, ‘ওগো মা শুনছেন আপনার ডাউনলোড করা ওই হ্যান্ডসামটা সকাল সকাল তার চাঁদমুখ খানার দর্শন না দিয়েই কম্মে গেল?’
প্রেমা এসে বসতেই তৃষা বলল, ‘আজ থেকে পড়ালেখা শুরু করতে হবে কিন্তু।’ সেই কথায় প্রেমা বিশেষ খুশি হতে পারল কিনা বলা দায়। সে ফোন এনে গ্লাসের সঙ্গে হেলান দিয়ে ফোনটা রেখে কোরিয়ান ড্রামা ছাড়ল। তৃষা ভেতর ভেতর তা দেখে বলল, ‘খাওয়ার টেবিলেও ফোন এনে এই ড্রামা দেখা?’ তবুও সে মুখে হাসি বজায় রেখে বলল, ‘তো কী ড্রামা আজকাল দেখা হচ্ছে?’
‘লাভলি রানার। নায়কটাকে আমার যা লাগে না। তবে যতই সুন্দর হোক না কেন কই সে আর কই প্রেম ভাই।’
শেষের কথাটা একটু ধীরেই বলল প্রেমা। তৃষা তাতে বিশেষ পাত্তা দিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচতলার ঘর থেকে সিদ্দিক নেওয়াজ এসে টেবিলে বসতেই হেতিজা তৃষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তৃষা তখনো বুঝতে পারছেন না এই লোকের পদবী দেওয়ান না হয়ে নেওয়াজ কেন হয়েছে। সিদ্দিক একবার চারিদিকে তাকিয়ে মোখলেসকে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রেম কোথায়? আজকে শুক্রবার। সে কী ভুলে গেছে শুত্রুবার যে সবাই একসঙ্গে মিলে খাবার খাই আমরা? আর এই হেতিজা! প্রত্যুষ কোথায়?’
হেতিজা বাবার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘বাবা সে ভোরে বের হয়েছিল শুনলাম। রুমে আছে। ফ্রেশ হয়েই নিচে নামবে।’
‘যাও কালুর বাপ প্রেমকে নিয়ে আসো।’
তৃষা ভ্রু কুঁচকে সিদ্দিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এমা উনি এই বয়সে প্রেম ভালোবাসাকে ডেকে আনতে বলছে কেন? আচ্ছা ডাকুক। ভালোবাসার তো বয়স হয়না।’
মোখলেস যাওয়ার জন্য দরজার সামনে যেতেই চোখ আঁটকে গেল এদিকটায় এগিয়ে আসা পুরুষের দিকে। মোখলেসের মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, ‘আরে আপনার জন্যই অপেক্ষা করতাছে সবাই।’
প্রেম একটা মুচকি হাসি নিয়ে বলল, ‘চলো তাহলে। অনেক ক্ষুধা পেয়েছে।’
প্রেমের পড়নে সাদা একটা প্যান্ট। আজকে আর গলায় কোনো লকেট নেই। কেবল হাতে একটা রোলেক্সের ঘড়ি। হালকা নীল রঙের শার্টে তাকে ওই আকাশের মতোই অপূর্ব লাগছে। গায়ের রঙটার সঙ্গে জামার রঙটা যে কি দারুণ মানিয়েছে। সানগ্লাসটা চোখেই ছিল ভেতরে যাওয়ার সময় খুলেছে। প্রেম ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ের সেই রোজা ব্রেন্ডের পারফিউমের গন্ধটা ছড়ায়। তৃষা খাবারটা মাত্র মুখে তুলেছিল। ওমা প্রেমকে দেখতে পেয়ে নাক-মুখে সেই খাবার নিমিষেই উঠে গেল। প্রেমা তাকে পানি এগিয়ে দিবে নাকি প্রেমকে দেখবে নিজেই বুঝতে পারছে না। তবুও পানি এগিয়ে দিলো। তৃষার মাথা তখনো কাজ করছে না। সে তৃষাকে দেখেও না দেখার একটা ভঙ্গিমা করে একেবারে তৃষার পাশের চেয়ারে বসে জুনুকে বলল, ‘ পাউরুটিগুলো মাখন দিয়ে টোস্ট করেছো তো?’
‘জ্বী।’
‘আর স্ট্রোবেরি এবং চকলেট? শুনো সকাল সকালই এত গরম পড়েছে আজ। কোল্ড কফি দিবে সঙ্গে।’
‘আর কিছু?’
‘ডিম হাফ বয়েল। পুরো সিদ্ধ ডিম যেন না হয়।’
তৃষা নিজের নাস্তার দিকে তাকায়। সে সকাল সকাল পরোটার সঙ্গে চা আর সবজি খাচ্ছে। ডিম ভাজিও আছে। আর প্রেমকে দেখো কি সব বড়লোকি খাবার খাচ্ছে। কিন্তু কথা সেটা নয়। তৃষা নেশা তো করেনি তবে চোখের সামনে প্রেমকে কেন দেখছে। আর এই ছোকরাকে আজ একটু বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে না? এ কোথায় এসে পড়ল? মাথার ব্যথাটা দ্বিগুণ হয়ে গেল। তৃষা হাবার মতো চায়ে চুমুক দিতেই সিঁড়ি বেয়ে প্রত্যুষ নেমে আসে। কালো একটা ব্লেজার পড়া। ভেতরে সাদা শার্ট। গলায় টাই। একেবারে খাঁটি জেন্টেলম্যান যাকে বলে। তৃষার তো এবার মাথাটা ঘুরে যাওয়ার পালা। গায়ের পারফিউমটা মাথা হ্যাং করে দিচ্ছে। প্রত্যুষ মুচকি হেসে তৃষার পাশের সিটটায় বসল। তৃষার বামে প্রেম আর ডানে প্রত্যুষ। একজন একটু কম সুদর্শন হলে পারত না? শ্বাসকষ্ট উঠে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে এই কেউ এম্বুলেন্সের খবর দে নয়তো, নয়তো কিছু একটা কর। এভাবে আর কতদিন অবিবাহিত হয়ে বাঁচব? যৌবন তো চলে যাচ্ছে সুপুরুষ দেখতে দেখতেই।
সন্ধ্যার দিকে প্রেমাকে পড়াতে বসে তৃষা জানতে পারল আসলে এই বাড়ির ছেলে হচ্ছে প্রেম নেওয়াজ। আর প্রত্যুষ তো দেওয়ান বাড়ির ছেলে। তবে এখানেই মানুষ হওয়া। তৃষা এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। প্রত্যুষ আর সে এক বাড়িতে আছে সেই খুশিতে লুঙ্গি ডান্স করবে নাকি প্রেমের বাড়িতে তাকে থাকতে হবে এই ভেবে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলে থাকবে? এই প্রেম নেওয়াজের জন্য কোথাও শান্তি নেই। তৃষা প্রেমাকে ওদিকের জঙ্গলটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। সেধে সেধে জিজ্ঞেস করাটা কেমন যেন হয়ে যাবে না? এত ছোটলোক নাকি সে? পড়া শেষ হতেই তৃষা নিজের রুমের বারান্দায় গিয়ে আবারও উঁকি ঝুঁকি মারল জঙ্গলটার দিকে। আচ্ছা ওইখানে কে থাকে? আর সকাল সকাল প্রেম নেওয়াজ এমন জামাই সেজে বাইরে থেকে কেন এলো? গেটের দিকে চোখ যেতেই দেখল প্রত্যুষ গাড়ি বের করে কোথাও একটা যাচ্ছে। ইশ একবার যদি তার দিকে তাকাতো। তৃষা মনে মনে গেয়ে উঠল,
~আমার দিকে চাইয়া দেখেন বয়স কত অল্প
সারারাত জেগে আমরা করব অনেক গল্প।~
দুই লাইন গেয়েই তৃষা থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আব্বে শালা রাত জেগে গল্প কেন করব। করার মতো তো বহুত কাজ আছে। বংশবিস্তার রেখে গল্প? টু মাচ ফকিরা কাজকারবার।’
তৃষা ভালো করে সন্ধ্যা নামতেই তিরিং বিরিং করে চোরের মতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। আজ তো ওই জঙ্গলে যাবেই যাবে সে। ওইখানে কেমন ফাঁকা স্পেস আছে দেখে আসতে হবে না? নইলে পরের বার প্রত্যুষ জানেমানকে নিয়ে জঙ্গলে মঙ্গল করবে কেমন করে? তৃষা সুন্দর ভাবে তৈরি হয়ে গায়ে একেবারে পারফিউম মেরে জঙ্গলের দিকে হাঁটা ধরল। এইবার ফোনটা সাথেই ছিল। সেখানে যেতে সময় লাগেনি। তবে তৃষা এখনো বুঝতে পারছে না ভোরে কি সে সত্যি এখানে এসেছিল নাকি সবটা ভ্রম। আর যদি সত্যি হয়? তাহলে কে তাকে রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে? ওমা আশিক জ্বীন নয় তো? এমনিতেই তৃষা একটু সুন্দর মানুষ। একদিকে মানুষ তাকে বিরক্ত করে অন্যদিকে ভূতে। কি ননসেন্স বিষয়!
তৃষা জঙ্গল পেরিয়ে শেষে গিয়ে দেখল একটা কাঠের বাড়ি। নিচের দিকে তার আবার থাইগ্লাস দেওয়া পুরোটা। একটা বাতি জ্বলছে। নইলে তো অন্ধকারের গুদাম হয়ে যেত এই জায়গাটা। তৃষার কেন জানি বাড়িটার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হলো। আচ্ছা সে রিলসে দেখেছে এমন পরিত্যক্ত বাড়িতে অনেক টাকা-পয়সা পাওয়া যায়। খুঁজে দেখবে নাকি? তৃষা থাইগ্লাসের সামনে গিয়ে খোলার চেষ্টা করতেই সেটা খুলে গেল। সে কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরের সব ফার্নিচার কালো রঙের। অদ্ভুত সব এন্টিকের জিনিসপত্র। তৃষা পানির শব্দ পেল। সেই সঙ্গে আরো বেশ কিছু শব্দ কানে এলো তার। আরেকটু সামনে যেতেই একটা ওপেন কিচেন দেখল। একটা লোক কিচেনে কি সব করছে। পেছন থেকে কেবল পিঠময় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। লম্বাচওড়া কাঁধ। পেশীগুলো কি নিখুঁত আর সুঠাম।
কালো রঙের একটা ট্রাউজার পড়া। বুকটা নগ্ন। পিঠে উইংড স্ক্যাপুলা দেখা যাচ্ছে। কাঁধের কাছে, পিঠেরহাড়ের উপর থেকে স্পাইন পর্যন্ত উঁচু এবং আলতো সরে থাকা হাড়ের ছাপগুলো পিঠে ছোট্ট বাটারফ্লাইয়ের আকৃতি ধারণ করেছে। লোকটা মৃদু নড়তেই সেই ছাপগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। তৃষা আরেকটু কাছে যেতেই বুঝতে পায় লোকটা মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে। পরিচিত একটা পারফিউমের গন্ধ নাকে আসতেই সেই লোকটি এবার পেছন ফিরে তাকালো। মুহূর্তেই তৃষা জমে উঠল। ওমা এ তো দেখি প্রেম নেওয়াজ! প্রেম কেবল তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল, ‘প্রথমে ভার্সিটি, তারপর বাড়ির মধ্যে, এখন এখানেও। নেক্সট কোথায় যাবে? প্রেম নেওয়াজের বিছানায়?’
‘মুখ সামলে কথা বলুন।’
প্রেমতৃষা পর্ব ১২
‘মুখ তো সামলেই রাখব। কিন্তু নিজেকে কতক্ষণ সামলাতে পারব জানা নেই।’
‘প্রেম ভা…ই!’ তৃষার চোখে স্পষ্ট ভয়।
প্রেম ছুড়িটা হাতে নিয়ে তুলে নিয়ে বলল, ‘এসে যখন পড়েছোই ছাড়ি কি করে?’ সে গুনগুনিয়ে ওঠে,
~ওয়ালকাম টু মাই ডার্কসাইড।~