প্রেমতৃষা পর্ব ২৫
ইশরাত জাহান জেরিন
ফজরের আজানের প্রতিধ্বনি বদ্ধ ঘরের চারপাশে গুঞ্জর করছে। কালো হুডি পরা মানুষটি সোফায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। সামনের টেবিলে রাখা গাঢ়, টকটকে লাল গোলাপের গুচ্ছ যেন রুমের অন্ধকারে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। লোকটি নাকের কাছে গোলাপের ঘ্রাণ টেনে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মুখোশটি টেবিলের ওপর রেখে সে ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে পুরো ঘরে ছড়িয়ে দিল। পাপড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে হেসে উঠল।
ফোন থেকে বাজছে গান। লোকটি সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাইতে লাগল,
~তুমি ছাড়া আজ একা এ মন
স্বপ্নের লাশঘর
ভেঙ্গে যাওয়া এই বুকের পাঁজর
ধু ধু মরু প্রান্তর
তবু প্রেম এসে ভালোবেসে
আজও দেখা দিয়ে যায়
যেই ছুঁতে যাই, আমি হাত বাড়াই
কেন দূরে সরে যায়?
প্রেম আমার
ও প্রেম আমার…~
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গান গাইতে গাইতে সে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে সব জামাকাপড় খুলে ফ্রিজ থেকে বিরাট বরফের চাকা বাথটবের ঠাণ্ডা জলে রাখল। গোলাপের পাপড়িগুলোও সেই জলে বিছিয়ে দিল। তারপর ছুরি হাতে বাথটবে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শান্তি যেন এখনও তার কাছে আসে না। অনিশ্চিত ও বিক্ষিপ্ত মানসিকতায় সে হাতের ওপর ছুড়ি চালাল। রক্ত মিশে গেল বরফের জলে। তৃপ্তি যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠল। একই গান বারবার বাজছে। বাথরুমের দেয়ালে ঝুলানো অসংখ্য ছবি। সবই মেয়েদের ছবি। পাশের দেয়াল থেকে একটি ছবি টেনে হাতে নিয়ে সে হেসে বলল,
“তুমি আমায় কেন ছেড়ে চলে গেলে? দেখো, তুমি চলে গেছো বলেই তোমার মতো সব মেয়েদেরকে আমি নিজ হাতেই ‘সাফাই’ করি। ওরাও যে তোমার মতোই কাউকে ভালোবেসে অন্য কারো সঙ্গে ঘর বাঁধেছে, ওদেরও তো শাস্তি প্রাপ্য।” বলেই সে হেসে উঠল। কিন্তু হাসি যেন তার হৃদয়ের ভাঙা টুকরোগুলোকে আরও প্রকটভাবে প্রকাশ করল। চোখের কোণে অল্প অশ্রু ঝরে তার। যা হাসি ও দুঃখের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ হয়ে তার মুখের রেখা মিহি করে দিল। হাসি আর কান্না দুটি অনুভূতি একত্র হয়ে তার জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেছে। তার প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি কম্পন, অতীতের দীর্ঘ একাকীত্বের গল্প বলছে।মহঠাৎ সে অনুভব করল, তার ঠিক পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই চোখ স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হলো। মেয়েটি ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত রাখল, কোমলভাবে কপালে ঝুঁকে চুমু দিল।
ছেলেটি চোখ বন্ধ রেখেই তার মাথার পেছনে হাত রাখল। ধীরে ধীরে মেয়েটি তার সামনের দিকে চলে এলো। চোখ খোলার সঙ্গে ঠোঁটের কোণে মৃদু মুচকি হাসি ফুটল।
মেয়েটি হেসে বলল,
“তুমি আমাকে কতখানি মিস করেছো?”
ছেলেটি গভীর কণ্ঠে উত্তর দিল,
“যতখানি মিস করা উচিত।”
শব্দগুলো ঘরে প্রতিধ্বনি করল, এবং সেই প্রতিধ্বনি তাদের মধ্যে অদৃশ্যভাবে একটি বন্ধন রচনা করল।
তারপর ছেলেটি মেয়েটিকে বাথটবের মধ্যখানে বসিয়ে ফিসফিস করল,
“মাই ব্লাডরুট কাম।”
মেয়েটি ধীরে তার কাছে এগোলে, তাদের ঠোঁট একে অপরকে স্পর্শ করল। ঠোঁটের স্পর্শে স্নায়ু ছুঁয়ে গেল, হৃদয় গাঢ়ভাবে কম্পিত হলো। হাতের স্পর্শ, নিঃশ্বাসের মিলন, চোখের দৃষ্টি সব মিলিয়ে ঘরে অদ্ভুত আবেশের ছায়া নেমে আসে। ছেলে তার হাতে মেয়েটিকে ধরল, তার গাঢ় চোখের গভীরতায় মেয়েটি হারিয়ে গেল। তাদের শরীর, হৃদয়, মন সব মিলিয়ে এক অনন্ত সংযোগে পরিণত হলো।
যুবরাজের প্রথম দেখায় ওই রাজনীতিবিধের মেয়েকে পছন্দ হয়ে যায়। দেরি না করে সেই রাতেই কাজি ডেকে এনে বিয়ের কাজটা জলদি সারল সে। আগের বার একজন ঠ্যাঙ্গা দেখিয়ে গেছে। বউকে বিয়ের পর জেনেছে এই মেয়ে নাকি আগের থেকেই যুবরাজকে পছন্দ করত। মানে কি আর বলবে? একেবারে লটারি পাওয়ার মতো খুশি হয়েছিল সেই কথা শুনে। এখন সুখে শান্তিতে সংসার করে তৃষাকেও দেখিয়ে দেবে কোন সোনা সে হাত ছাড়া করেছে। সকাল সকাল তৃষার বাব-মা যুবরাজের কাছে এসেছিল। মেয়ের বিষয়ে সাহায্য চেয়েছে। যুবরাজের ইচ্ছে হচ্ছিলো না। তবুও বলল, ‘দেখব।’
বাসায় আসার পর থেকে তৃষার মনটা ছটফট করছে। কিছুই আর তার ভালো লাগছে না। এখন কাউকেও আর ভালো লাগছে না। কারো কথা মনে করতেও ইচ্ছে করছে না। চোখের সামনে বার বার শতবার একটি মুখই ভাসছে। রাতে বলা প্রতিটি কথা কানে কেউ যেন ফিসফিস করে আওরাচ্ছে। এভাবে কি ভালো থাকা যায়? মন বলছে প্রেম ভাইয়ের মধ্যেও অন্য রকম কিছু একটা আছে। মন কেন বার বার চুম্বকের মতো প্রেম নেওয়াজের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? এসব কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। একেবারেই ঠিক হচ্ছে না। বাসায় আসার পর সারাটা দিন কেমন যেন মনটা ব্যাকুল ব্যাকুল লেগেছে। কি নেই কি নেই এমন একটা মনে হচ্ছে। যখন মনকে জিজ্ঞেস করল, মন বলল প্রেম ভাই নেই। ধ্যাৎ এমন তো কখনো কারো জন্য অনুভব হয়নি।
এখানে এসেছে ঠিক করে পড়ালেখা করতে। কিন্তু ওই পড়ালেখা বাঁধে সব হচ্ছে। যা না হওয়া উচিত সেই সকল কিছু হচ্ছে। রুমের মধ্যে অনেক ক্ষণ এভাবে বসে ছটফট করে অবশেষে তৃষা না পেরে সুন্দর করে তৈরি হলো। সুন্দর একটা জামা পরে সাজল। ওই যে গত রাতের প্রেম ভাই তাকে একটা জামা দিয়েছিল না? সেথায় এখনো তার পারফিউমের গন্ধ লেগে আছে। তৃষা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকলো। তারপর জামা রেখে এক পা দুই পা করে নিচে নেমে হাঁটা শুরু করল প্রেম নেওয়াজের হাউজ ওফ লাভের দিকে। এই লোকের বাড়ি নাম এমন, নিজের নামটাও এমন। তাও বলবে ভেতরে নাকি প্রেম-ভালোবাসা নেই। ওইসব নিয়ে নাকি তার কোনো ধারণা নেই। তৃষা প্রেমের বাড়ির কাছে যায়। দরজাটা খোলাই। টুকটুক করে ভেতরে প্রবেশ করে সিড়ি বেয়ে দোতলায় প্রেমের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল তৃষা। দরজায় তো পাসওয়ার্ড মারা থাকে। আজকেও কি আছে? আল্লাহর নামে দরজা খুলতেই তৃষা চিৎকার করে উঠে।
“আল্লাহ প্রেম ভাই আপনার লজ্জা নেই।”
প্রেম জলদি প্যান্টটা উপরে তুলে ভাবলেশহীন ভাবে বলে, ” কারো রুমে আসলে নক করতে হয়। এখন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে কেমন মজা লাগল?”
“কি যে বলেন প্রেম ভাই? দেখার আর সুযোগ কই পেলাম? নিচে তো ব্রান্ডের জিনিস পড়েছেন।’
‘কেন তুমি পড়বে নাকি? চাইলে ট্রাই করতে পারো সোনা।’
‘না জানু তোমারটা তুমিই পড়ো। তুমি পড়বে আর আমি সেই দৃশ্য দেখব তাতেই আমার চলবে।’
প্রেম ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই তৃষা চুপসে যায়। তৃষা পারফিউমের বোতলে হাত দিতেই প্রেম বলে উঠল, ‘ এক লাখ বিশ ওইটা। আগামী পাঁচ বছর নেওয়াজ বাড়িতে কামের ব্যাটির সকল কাজ করলেও তো ওই টাকা উসুল হবে না।’
‘এত বড় অপমান না করলেও পারতেন।’
‘প্রেম নেওয়াজের আবার ছোট জিনিসে পোষায় না।’
তৃষা লজ্জায় মুখে হাত দিতেই প্রেম মুখটা কুঁচকে বলল, ‘তৃষা শরীর সুস্থ আছে? চলো ডাক্তারের কাছে যাই।’
‘মনের অসুখ ডাক্তারের ঔষধে ভালো হয় না গো প্রেম ভাই।’
‘তাহলে ঝাড়ু এনে দেই দু’টো বারি।’
‘প্রেম ভাই!’
‘বলো সোনা…..’
‘আচ্ছা আমি এখন আসি। অনেক কাজ আছে।’
তৃষা মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতে নিয়ে মনে মনে সুধায়, ‘একবার জিজ্ঞেস করুন কোথায় যাচ্ছি। থামতে বলুন প্রেম ভাই।’ তৃষা যাওয়ার জন্য ঘুরতেই প্রেম পেছন থেকে তার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে আনতেই তৃষা প্রেমের চোখে চোখ রাখল। কেমন জানি অন্য রকম অনুভূতি হলো তার। প্রেম তৃষার চুলে হাত বুলিয়ে নাকের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে গন্ধ শুকলো। তারপর বলল, ‘কোথাও যাওয়া হচ্ছে?’
‘জাহান্নামে। ‘
‘ওখানে তোমায় একা ছাড়ি কি করে?’
‘তাহলে চলুন।’
‘ঠিকানা প্লিজ।’
‘বাংলাবাজার বইয়ের দোকানে।’
‘বই কিনতে যাবে? আমার কাছে সব বই তো আছে। এখান থেকে নিয়েই পড়তে পারো।’
‘উপন্যাসের বইয়ের কথা বলছিলাম।’
‘টাকা আছে? আচ্ছা টাকা লাগবে না। প্রেম নেওয়াজ তো নিজেই একটা টাকার গোডাউন। সেই না হয় তোমার সঙ্গে যাবে।’
‘আপনি যাচ্ছেন।’
‘যাই যদি কারো উপকারে আসতে পারি। তবে বদলে কি দিবে?’
‘যা আপনার খুব দরকার।’
‘কি দরকার?’ প্রেম আরো কিছু বলার আগেই তৃষা পা উঁচু করে প্রেমের শার্টের কলার টেনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ঠোঁটে মুহূর্তেই একে দেয় ভালোবাসার পরশ। ভালোবাসার উষ্ণতায় হারিয়ে যায় সে। প্রেমও তাকে শক্ত করে চেপে ধরে। কোমরে হাত রেখে টেনে জড়িয়ে নেয় বুকে।
প্রেমতৃষা পর্ব ২৪
‘এই আমার কি দরকার বিটারহার্ট?’ তৃষার মুখের সামনে প্রেম তুরি বাজাতেই হুঁশ ফিরল তার।
‘এই মেয়ে মুখে কয় কেজি লাল রঙ লাগিয়েছো? নিশ্চিত কম দামি বেজাল প্রোডাক্ট। নইলে মুখ এমন লাল হচ্ছে কেন হঠাৎ? ‘ তৃষা ভালো করে প্রেমকে দেখল। তার মানে কিছুই হয় নি তাদের মাঝে? ছ্যাহ কি বাজে কল্পনা ছিল। প্রেম ভাই জানলে কি হবে? কি লজ্জা কি লজ্জা!