প্রেমতৃষা পর্ব ৪০

প্রেমতৃষা পর্ব ৪০
ইশরাত জাহান জেরিন

রাতটা স্বামীর বুকে কেটে গেল অজান্তেই। প্রেম বাইক রেসার। প্রথম থেকেই আন্দাজ করেছিল তৃষা। তারপর অংকুর সব খুলে বলল। এই যে একটু আগে ঘুমিয়েছে লোকটা ক্লান্ত শরীর নিয়ে। ঘুমানোর আগে এই যাবৎ তার সকল বাইক রেস নিয়ে কথা বলল। শুনতে ভালোই লাগছিল। মজার বিষয় হচ্ছে এত বড় একটা বাইক রেসারের বুকে এই মূহূর্তে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। আহা আর কি চাই? তবে বাইক রেসের জন্য এতদূর তৃষার আসা। যদি সব মেনে নিয়ে সেদিন যুবরাজ সরকারের বউ হতো তাহলে আজকের প্রেম নেওয়াজকে কখনোই পাওয়া হতো না। তৃষা চোখটা বুজল পরম তৃপ্তি নিয়ে। এবার একটু ঘুমানো আবশ্যক।
সকালে ঘুম ভাঙল তৃষার খাবারের গন্ধে। প্রেম এসে তাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দেয়। কাজ শেষ করে তৃষার পাশে বসতেই মুচকি হেসে বলল, ‘ দু’টো সারপ্রাইজ আছে। কোনটা আগে শুনবে?’

‘দুটোই শুনব। তবে এক নম্বরটাই আগে বলুন।’
প্রেম ফোনটা বের করে কলে তৃষার সামনে ধরতেই ভিডিও কলের ওপাশে তৃষা তার বাবা মাকে দেখতে পেল৷ তৃষা মুহূর্তেই ইমোশনাল হয়ে গেল৷ কতদিন পর বাবা-মাকে দেখতে পাচ্ছে। প্রেমের মনে হলো এখন তৃষাকে একটু বাবা-মায়ের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে দেওয়া উচিত। নিজেদের ঝামেলা শেষ করুক। তারপর সে রুমে ফিরবে। সে তৃষাকে স্পেস দিয়ে দাঁড়ালো। নিচ থেকে আপেল কাটার জন্য ছুড়িটা এনেছিল। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছুড়িটাকে ছুঁয়ে দেখল। হাত ছুঁইয়ে দিতেই সামান্য একটু লেগে রক্ত বের হলে এলো। সে রক্তটার দিকে তাকালো। একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বিশ্বাসঘাতকদের মরে যাওয়াই ভালো। আজ হোক, কাল হোক তাদের দিন ফুরিয়ে। সময়ের চক্রের এবার মোড় পাল্টানো দরকার।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তৃষা ফোন রেখে ডাকতেই প্রেম রুমের ভেতর এলো। তৃষা সঙ্গে সঙ্গে তাকে জড়িয়ে বলল, ‘আপনি এত কিছু করে ফেললেন আর আমি জানতেও পারলাম না।’
‘আমি সময় নিয়ে জানাতে পছন্দ করি। তো ঝামেলা মিটল? আমার বাবা শশুর বাড়িতে জামাই আদরের ব্যাস তাড়া ছিল তাই সাবমিটমাট করে দিলাম। এসব আর মেনে নেওয়া যাচ্ছিলো না৷’
‘তাই বলে এতোসব কি করে করলেন? বাবা-মায়ের মত কি করে পাল্টে দিলেন?’
‘তাহলে শুনো বলছি।’

তৃষাকে নিয়ে বিছানায় বসল প্রেম। তারপর বলল, ‘যেই রাতে আমি বাসা ছাড়ি সেই রাতে আমার এক্সিডেন্ট হয়। ফিরে আসতে চেয়েছিলাম তোমার কাছে তবে ব্যাড রেস্টে ছিলাম। তারপর মাথায় এলো তোমায় একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত। একেবারে হৃদয়ে যে আঘাত করলে একটু কষ্ট তো তুমিও ডিজার্ভ করো। ব্যাস পড়ে রইলাম হাসপাতালে। তোমার সঙ্গে কথা হয়নি এর মানে এই ছিল না তোমায় ভালোবাসতাম না। তোমার ওপর পুরো দমে নজর ছিল আমার। কোথায় কি করতে, কি খবর সব আমার কানে আসত। পুরো বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরা আমার ফোনের সঙ্গে সংযুক্ত৷ যাক প্রত্যুষের সঙ্গে কতবার বাইরে গিয়েছো, ঢং করেছো তার খবর পরে একদিন নিবো। এখন কথা হচ্ছে আমার পরিকল্পনায় যেই মানুষটা সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল সে ছিলেন সিদ্দিক নেওয়াজ। হু দাদা ভাই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তাই না? তুমি সেদিন তার কাছে গিয়ে কুত্তার মতো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কান্না করেছো মনে আছে সোনা?

‘কুত্তার মতো?’
‘ইয়ে মানে। বাদ দাও না। পরে কি হয়েছে শুনো। আসলে ওইদিন দাদু অসুস্থ হননি৷ একটু নাটক করেছিলেন আর কি। তার সঙ্গে শুরু থেকে আমার যোগাযোগ ছিল। তুমি শুরুতে না জানলেও ওই মানুষটা জানতেন আমি তোমায় কতখানি ভালোবেসেছি, আজও বাসি । আমি অংকুরকে অনেক আগেই তোমার পরিবারের খবর জোগাড় করতে বলেছিলাম একবার। সে করেছেও। সে তোমার বাড়ির খবর জোগাড় করল। দাদা ভাইকে সব খুলে বললাম। সে বলল সে নিজে গিয়ে তোমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলবে। তাই হলো। মাঝে অংকুর আর দাদা সহ মোখলেস চাচা তোমার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। আমিও তাদের সঙ্গেই ছিলাম।

তবে তোমার পরিবারের সাথে কথা বলার আগে আমি কথা বলেছিলাম যুবরাজ সরকারের সঙ্গে৷ মানে তোমার হয়েও না হওয়া স্বামী৷ মানুষটা ভালোই ছিলো। সব খুলে বলতে সে বললেন সাহায্য করবে। যদিও ক্ষোভ ছিলো তোমার প্রতি। সম্মানটা নষ্ট করে পালিয়েছো। তোমার মা-বাবা নাকি অনেকবার তোমাকে খুঁজে দেওয়ার জন্য সাহায্য চেয়েছিলো তার কাছে৷ সে মুখে সাহায্য করবে বললেও পরে আর করেনি। আমি কথা বলার পর একটু ভবল। তারপর সাহায্যটা করেই ফেলল। তোমার বাবা-মায়ের কাছে সে গেল। বলল, তোমায় পাওয়া গেছে। কিন্তু কাছে পেতে হলে একটা কাজ করতে হবে। তোমার বাবা-মায়ের তখন তোমায় দরকার ছিল, তোমায় পেলেই হলো। রাজি হলেন তারা সব শর্ত মানবে। তবে শর্ত এত কঠিন কিছু ছিল না।

দাদা গেলেন, আমরাও গেলাম। কাজী বাড়ির মেয়ে নেওয়াজ বাড়ির বউ হোক এই টুকুই চাই। আমাদের পরিবার, তোমার এখানে আসা সবই খুলে বলা হলো তাদেরকে। সময় দিলাম ভাবার জন্য। শেষে দুই দিনের মাথায় তারা বিয়েতে রাজি হলো। পারিবারিক ভাবে তোমায় আমার বউ করার কথা ছিল। কিন্তু মাঝে দিয়ে তুমি বাল পাকনা কি করলে? প্রত্যুষের সঙ্গে বিয়ের পিড়িতে বসতে রাজি হয়ে গেলে? একটু ধৈর্য্য নেই শালীর ঘরের বউ? তোমার বাল পাকনামির জন্য আমার সাজানো পরিকল্পনা সব নষ্ট হলো। শেষে ভালোতো বাসতে তবুও তোমার মতো আটার বস্তাকে আমার কিডন্যাপ করতে হলো! নাটক সব। আর কবুল বলার সময় যখন এত বাহানা করছিলে বিশ্বাস করো মন চাইছিলো লাগিয়ে দিতে এক চড়। কতবড় নাটকবাজ তুমি ভাবা যায়?’

‘তাহলে সেদিন যে তৈমুরকে জিম্মি করলেন? ওইসব?’
‘শালা আমার কড়া মাল। তোমার ভাই তো, তাই তোমার থেকেও বড় ধান্দাবাজ। এই শুনো কি করে তোমায় বিয়ে করতাম তখনো বুঝতে পারছিলাম না। শেষে শশুড় আব্বাই কিন্তু তুলে এনে বিয়ের প্রোসেসটা বললেন। কঠোর শিক্ষা দিতে বলেছিলেন কিন্তু দিয়েছি কি? তো শুনো মিসেস, তুমি ভেবেছো তোমার টানে কিডন্যাপ করেছি। তবে শুনে রাখো প্রেম একটা নিশ্বাসও ফেলে পরিকল্পনা করে। মাইন্ড ইট। তোমায় এমনি এমনি পাইনি। বহুত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। যাকগে সেসব কথা এখন অতীত। ব্যাগ প্যাকিং করে নাও, আজকে কক্সবাজার যাব। সেখান থেকে সোজা যাব নেওয়াজ বাড়িতে। তোমার বাবা-মাও আসবেন। মা-বাবার ভালোবাসা সবার কপালে জুটেনা। ওটা পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। ভাগ্যকে এভাবে লাথি মারতে হয় না সুন্দরী।’ বলেই প্রেম তৃষার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘অনেক কথা হলো, অনেক ভাঙন হলো। এবার নতুনের গল্প নতুন ভাবে শুরু করা যাক। শুরুটা খারাপ হয়েছে তো কি? শেষটা সুন্দর হয়েছে কিনা তার ওপর গোটা জীবনটা নির্ভর করবে।’
তৃষা প্রেমকে জড়িয়ে ধরে। ‘বিশ্বাস করুন আমি পালাতে চাইনি। বাইক রাইডিং স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন পূরণ করতে এতদূর সব ছেড়ে চলে আসা।’

প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯ (২)

‘আমি আছি তো? স্বপ্ন তোমার তবে পূরণ করার দায়িত্বটা আমি নিলাম।’ তৃষা প্রেমের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। প্রেম তার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। হ্যাঁ এটাই বোধহয় জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত। আপনার জীবনে যতই কষ্ট থাকুক না কেন। আপনার জীবন সঙ্গী যদি আপনার জন্য কমফোর্টেবল হয়, আপনাকে বুঝে, আপনার সবকিছুতে আপনাকে সাপোর্ট করে তাহলে দুনিয়ার কোনো ভয়কে ভয় মনে হবে না, জীবন তখন সহজ ও সুন্দর হবে আপনার নিজের রচিত গল্পের মতোই।

প্রেমতৃষা পর্ব ৪০ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here