প্রেমপিপাসা পর্ব ৩

প্রেমপিপাসা পর্ব ৩
সুমাইয়া সুলতানা

সকালের হালকা মুহূর্ত যেন প্রকৃতির এক নীরব উৎসব। সূর্যের প্রথম কিরণ মিষ্টি কুয়াশার চাদর ভেদ করে ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে আসে। চারপাশে শীতল বাতাসের হালকা ছোঁয়া, যা গায়ে মাখলেই এক অদ্ভুত শীতল প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয়। গাছে গাছে শিশিরবিন্দু, সূর্যের আলোয় মুক্তোর মতো ঝলমল করে। পাখির কিচিরমিচির আর দূর থেকে ভেসে আসা নামাজের আজানের সুর মিলে তৈরি করে এক আবেগময় পরিবেশ।
মানুষের শরীরে মিহি সোয়েটার কিংবা চাদর জড়িয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপে দিনের কাজ শুরু হয়। চায়ের কাপে ধোঁয়ার মেঘ যেন এ শীতের সকালকে আরও উপভোগ্য করে তোলে। এমন শান্ত, স্নিগ্ধ, এবং সজীব শীতের সকালে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে হারিয়ে যেতে মন চায়।

সকালের স্নিগ্ধকর পরিবেশে, হাঁটু ভাঁজ করে তাতে থুতনি ঠেকিয়ে, চুপ করে মনমরা হয়ে বসে আছে অরু। কল্পনার জগতে ডুব দিয়ে কতশত ভাবনায় বিভোর। রাতে হ্যাভেনের জড়িয়ে ধরার দৃশ্য চোখের সম্মুখে দৃশ্যমান হতেই, ক্রোধের দাবানল পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। পেটের মধ্যে গ্রুম গ্রুম শব্দ হচ্ছে। ক্ষুধা পেয়েছে তার।
অরু বড়ো বড়ো পাপড়ি যুক্ত নয়ন জোড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হ্যাভেনের বড়সড় কক্ষটা অবলোকন করছে। রুমটা বেশ পরিপাটি লাগছে। কত সুন্দর দামী দামী আসবাবপত্র। দেয়ালের এক পাশে চমৎকার কারুকাজ করা। বাইরের থেকে বাড়ির ভিতরের দৃশ্যপট বেশি নজরকাড়া লাগছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরু যখন কক্ষে নজর বুলাতে ব্যস্ত, তখন ওয়াশরুমের দরজা খুলে হ্যাভেন বেরিয়ে আসে। অরু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কোমরে টাওয়াল প্যাঁচিয়ে খালি গায়ে হ্যাভেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। মাথা থেকে টপটপ করে বৃষ্টির ফোঁটার মতো পানি পড়ছে। সেই পানি গড়িয়ে পড়ছে উন্মুক্ত পিঠ, বুকে। ফর্সা শরীরের পানিকণা গুলো রুমের সাদা রঙের লাইটের আলোতে, মুক্তোর দানার মতো চকচক করছে। অরুর ঘোর লেগে যাচ্ছে। কেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল সম্মুখের ব্যক্তিটিকে সে অপছন্দ করে। আনমনে গুটিগুটি কদমে এগিয়ে গেল। হ্যাভেনের পেছনে এসে দাঁড়ায়। আপনা-আপনি বেহায়া পেলব হাত হ্যাভেনের পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করল। আচমকা পৃষ্ঠদেশে নরম তুলতুলে কিছুর ছোঁয়া লাগতেই, হ্যাভেনের শরীর শিরশির করে উঠল। ত্বরিত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে চায়। অরু’কে কেমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে ফেলল।
হ্যাভেন আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে অরুর মনোযোগ পাওয়ার প্রয়াস চালালো। অরুর তৎক্ষনাৎ সম্ভূতি ফিরল। তুরন্ত বাড়ন্ত হাত গুটিয়ে নিলো। এক্ষুনি কি করতে যাচ্ছিল সে? মনে মনে কয়েকটা নিজেকে গা’লি দেয়। আমতা আমতা করে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করলো,

” ও-ই আমি… ”
হ্যাভেন ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল,
” হ্যাঁ, তুমি কি? চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে বৈধ বর’কে দেখছিলে! মুখ ফুটে একবার বললেই হয়, এভাবেই তোমার সামনে সারাক্ষণ বসে থাকবো।”
অরু ঠোঁট বাঁকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” আসতাগফিরুল্লাহ! সেটা কখন বললাম? আজব! ”
হ্যাভেন আড়ালে একপেশে হাসল। অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” এ’মা তাই তো! তুমি তো বলোনি! আমি মনেহয় বেশি বেশি ভাবছি। ”
অরু মুখ ঝামটি মেরে সামনে থেকে সরে আসে। হ্যাভেন অফিসে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ রেডি হয়ে নিলো। অরুর হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
অরু ক্ষিপ্ত মেজাজ সহিত মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে বলল,
” আপনার সমস্যা কি? যখন-তখন কোলে তোলা, হাত ধরাধরি করেন কেন? আমি কি বাচ্চা? ”
হ্যাভেনের শান্ত জবাব,
” বয়স হলেও স্বভাব তো বাচ্চাদের মতো। ”

অঙ্কিতা গভীর মনোযোগ দিয়ে রেফারেন্স বইটা পড়ছিল। সকালের হালকা ঠাণ্ডা বাতাস জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছিল। হঠাৎ একটা টুকটুক শব্দে চমকে উঠল সে। জানালার কাঁচে ইটের ছোট একটা টুকরো ঠোকা দিয়ে পড়ে গেল নিচে। বই বন্ধ করে ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে গেল অঙ্কিতা। পর্দা সরিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সায়র দাঁড়িয়ে আছে।
সায়র নিচে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে বলল,
” ডিয়ার হবু বউ, কোথায় তুমি? খুঁজে পাচ্ছি না তো!”

অঙ্কিতা দরজায় নজর বুলিয়ে, পর্দার আড়ালে লুকিয়ে মুখ শক্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয়,
” আপনি এখানে কি করছেন? কেন এসেছেন? সকাল সকাল এসব পাগলামি করার মানে কি?”
সায়র চমকে উঠল। তাড়াহুড়ো করে গ্রীবা উঁচু করল। ঠোঁটের কোনায় মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে বলে,
” তোমাকে দেখতে এসেছি। সারারাত মিস করেছি তো। তুমি একটু নিচে আসবে, প্লিজ? ”
এমন সময় পাশে থেকে টুটুল চিৎকার করে উঠল,
” চাচ্চু চলো না, আমার শীত করছে! আব্বু যদি জানে, আমাদের দু’জনকেই পিট্টি দিবে! ”
সায়র চোখ পাকিয়ে বলল,

” চুপ কর টুটুল, সবকিছু মাটি করে দিবি! কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে থাক, আমার বাপ! তোর জন্য আরেকটা আম্মু আনার ব্যবস্থা করছি। ”
টুটুল শিশুসুলভ গোল গোল চোখে তাকায়। আরেকটা আম্মু? টুটুল খুশি হয়। দুই আম্মু হলে টুটুল আম্মুদের বেশি ভালোবাসা পাবে।
অঙ্কিতা ওদের দৃষ্টির অগোচরে হাসে। নিজের মুচকি হাসি লুকিয়ে কঠিন গলায় বলে ওঠে,
” আপনার এসব নাটক আমি একদমই পছন্দ করি না, বিরক্ত হচ্ছি! আর টুটুলকে নিয়ে আপনার এইসব কাজে যোগ দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। বাচ্চা ছেলেটাকে দাবার গুটি বানাচ্ছেন! ”
সায়র নিচ থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় শুধায়,
” গুটি কোথায় বানিয়েছি? চাচ্চুর ভালোবাসা পেতে সাহায্য করবে না? তাহলে কেমন ভাতিজা হলো? আচ্ছা, তোমার পছন্দ কী? জানাও, সেটা করে দেখাবো। ”
অঙ্কিতা আর কথা বাড়াল না। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে ভেতরে চলে গেল।
সায়র হতাশ মুখে বলল,

” এত রাগ দেখাচ্ছে, অথচ ভেতরে ঢুকে এখন নিশ্চয়ই হাসছে! ”
টুটুল হাত ধরে টানতে টানতে বলল,
” চলো, চলো! দেরি করলেই বিপদ! ”
ফিরে যাওয়ার পথে সায়র একবার পেছন ফিরে সোনালী রঙের পর্দাটানা জানালার দিকে তাকাল। মনের ভেতর একটা মিষ্টি অনুভূতি জানালো,
” তোর অঙ্কিতা যতই পাত্তা না দিক সায়র, একদিন সে হাসিমুখে তোর প্রেমের জালে ফাঁসবেই! শুধু সময়ের অপেক্ষা। ”

অঙ্কিতা অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সায়র যেই ভার্সিটির ছাত্র, অঙ্কিতা সেখানে ভর্তি হয়েছে। সায়র ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। নবীন বরণের দিন কালো শাড়ি পরিহিত পাতলা গড়নের লতানো শরীরের মেয়েটাকে দেখে এক মুহূর্তে থমকে গিয়েছিল। চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট হৃৎপিণ্ডটা ছিটকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। ভালো লাগা আরও কয়েকগুণ বেরে গিয়েছিল, যখন জানতে পেরেছে অঙ্কিতা কারো সাথে রিলেশনে নেই। বুকের বাম পাশে হাত রেখে বলেছে, এই মেয়েকে আমার লাগবে। অথচ সায়র নিজে আস্তো একটা মেয়ে-বাজ!

অরুর হাত ধরে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল হ্যাভেন। অরু হা করে তাকিয়ে থাকল। ডাইনিং জুড়ে কতরকমের খাবার।
স্বাস্থ্যকর অ্যাভোকাডো স্যালাড, চিয়া সিড পুডিং, ফ্রেঞ্চ বাটারি পেস্ট্রি। পোচড ডিম, ইংলিশ মাফিন হল্যান্ডাইস সস সহ।
হট ড্রিঙ্কস এবং জুসে আছে স্পেশালিটি কফি, অর্গানিক গ্রিন টী, ফ্রেশ প্রেসড জুস।
অরুর দেখার মাঝে রুবিনা পরোটা আর বাটার নিয়ে আসলেন। অরু পলক ঝাপটিয়ে সবকিছু দেখে চলেছে। ব্রেকফাস্টে কেউ এত খাবার খায়? নাকি সবার খাবার আলাদা বলে, এতগুলো আইটেম তৈরী করা হয়েছে? পরপরই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মনেমনে ব্যঙ্গ করে বলল,
” বড়োলোক বাড়ীর মানুষদের ঢঙের শেষ নাই! খেতে পায় বলে এত এত খাবার রান্না করে অপচয় করছে। আর কত গরিব মানুষ দু’মুঠো ডাল-ভাত খেতে পারে না, দরিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে! ”
পরোটা, ডিম পোচড, কিছু সবজি দিয়ে মুড়ে রোল করে অরুর হাতে ধরিয়ে দিল হ্যাভেন। গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ ছুড়ল,
” ফিনিশ ইট। ”

অরুর প্রচন্ড খিদে পেয়েছিল, তাই বাক্য বিনিময় না করে চুপচাপ খাচ্ছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছে তাতে কি? না খেয়ে নিজের শরীর খারাপ করার কোনো মানে হয় না!
হ্যাভেন স্যালাড খেতে খেতে গলা উঁচিয়ে ডাকল,
” কাকীমা, কাকু কি চলে গিয়েছে? মনে করে ফাইল নিয়েছে নাকি ফোন করে জিজ্ঞেস করো একবার। ”
সায়রা রান্নাঘর থেকে আওয়াজ দিলেন,
” চলে গিয়েছে আর ফাইল নিয়েছে। তোমাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। ”
হ্যাভেন পুনরায় ডাকল,
” রুবিনা খালা, টুটুল কোথায়? ওকে দেখছি না কেন? আজকে স্কুল নেই? ”
রুবিনা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন। মাথা নিচু করে উত্তর দিলেন,
” টুটুল দাদু ভাই তার চাচ্চুর সঙ্গে বাইরে গিয়েছে। এখনো ফিরে নি। ”
হ্যাভেন ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কোথায় গিয়েছে? ”
” জানি না। ”
আরও কিছু সময় পর সায়র বাড়ি আসে। এসে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল। জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে লম্বা শ্বাস টানল, যেন কোনো বিরাট যুদ্ধ জিতে এসেছে।
হ্যাভেন গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল,
” কোথায় গিয়েছিলি? ”
সায়র উত্তর দেওয়ার আগে টুটুল ঠোঁট পাতলার পরিচয় দিল,
” আম্মু আনতে গিয়েছিলাম। চাচ্চু ইটের….. ”
তুরন্ত টুটুলের মুখ চেপে ধরল সায়র। হ্যাভেনের দিকে চেয়ে মেকি হেসে বলে উঠলো,
” সকালের স্নিগ্ধকর পরিবেশে হাঁটলে শরীরের জন্য উপকারী। সেজন্য হাঁটতে বেরিয়ে ছিলাম। ”
” টুটুল আম্মু আনতে গিয়েছিল বলল কেন? ”

সায়র পড়ল বিপাকে! এরকম ভাতিজা থাকলে প্রেমের শত্রুর দরকার হবে না! কোথায় ভাবলো, ভাতিজা’কে সাথে নিয়ে গিয়ে কিভাবে প্রেম করতে হয় সেটার ট্রেনিং দেওয়াবে। যেন ভবিষ্যতে সায়রের নাম রাখতে পারে। লোকে যেন বলতে পারে, সায়রের মতোই তার ভাতিজা লাভ-গুরু। কিন্তু দুষ্টু ভাতিজা তো চাচ্চু কে ফাঁসাতে চাইছে!
টুটুল আঙুলে কামড় দিতেই সায়র হাত সরিয়ে নিলো। সহসা শুষ্ক ঢোক গিলল। নিষ্পাপ মুখশ্রী বানিয়ে বলল,
” ভাই ওই হয়েছে কি! আমি টুটুল’কে বলেছিলাম, কথা শুনলে সুন্দরী আম্মু পাবে। ওটাকে টুটুল ভেবেছে আম্মু এনে দিবো। বাচ্চা মানুষ যা খুশি বলে। ওর কথা ধরতে আছি নাকি? ”

টুটুল হা করে কিছু বলার প্রয়াস করতেই, পরোটা ছিঁড়ে সায়র ওর মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। অমনি টুটুলের কথা গলায় আটকে গেল। সায়র আড়চোখে টুটুল’কে শাসালো। বোঝাল, মুখ বন্ধ রাখ, নয়তো ঘুরতেও নিবো না, চকলেটও খেতে দিবো না!
সায়র তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। এখানে থাকা যাবে না! ভাইয়ের সামনে থাকলে জহুরি চোখে পরখ করা শুরু করে দিবে। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে অরুর দিকে চেয়ে চনমনে কন্ঠে বলল,
” ওহ্ ভাবী! এখন কথা বলতে পারছি না, সরি। ভার্সিটি যেতে লেট হয়ে যাবে। ফিরে এসে সাক্ষাৎ করবো। আপাতত পরিচয় পর্ব তোলা থাকুক। ”

অরু কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। মুখে কোনো শব্দ করল না। সায়র ব্যস্ত কদমে চলে গেল। টুটুল গোমড়া মুখে অরুর দিকে চায়। কিন্তু অরুর কাছে গেল না। হ্যাভেন বলেছে, আম্মু যখন নিজে থেকে টুটুল’কে ডাকবে তখন যেন সে যায়। মূলত অরু যদি টুটুলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, বাচ্চাটা কষ্ট পাবে। সেজন্য হ্যাভেন নিষেধ করেছে।
টুটুল এক দৌড়ে বাবার কাছে চলে যায়। হ্যাভেন হাত প্রসারিত করে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরল। টুটুল মুখ বেজার করে বাবার কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়। হ্যাভেন ছেলের ফুলিয়ে রাখা ঠোঁটে আলতো চুমু খেল। আদুরে সহিত জিজ্ঞেস করলো,

” আমার সোনার কি মন খারাপ? ”
টুটুল উত্তর দিল না। বাবার গালে গাল ঘষে। হ্যাভেন হাসল।
” আব্বুর সাথে কথা বলবে না? ”
টুটুল মৃদুস্বরে আওড়াল,
” তুমি অফিসে যাবে? ”
” যাবো। তুমি স্কুলে যাবে না? ”
” আজকে যাবো না। ”
” কেন কলিজা? ”
” মুড নেই। ”
” আমার আব্বুর আবার মুড সুয়িংও হয়? ”

বলেই ছেলেকে হাসানোর জন্য কাতুকুতু দিল। টুটুল খিলখিল করে হেসে উঠল। ছেলের ছোট্ট নাকে টুপ করে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অরুর দিকে চেয়ে, ধমকে বলল,
” খাচ্ছো না কেন? একটা পরোটার অর্ধেক শেষ করেছো মাত্র। বাকিটুকু খাবে কখন? ”
ধমকে মৃদু কেঁপে ওঠে অরুর সত্তা। রাগী লুক নিয়ে ত্যাড়া গলায় জবাব দেয়,
” আমার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে খাবো। দরকার হলে একটা পরোটা সারাদিন সময় নিয়ে খাবো। তাতে আপনার কি? ”
হ্যাভেন কটাক্ষ করে বলল,

” খাও। কিন্তু বর অফিসে যাবে, আর তুমি তাকে আদরে সোহাগে বিদায় দিবে না, সেটা কি ঠিক? ”
অরু ব্যঙ্গাত্মক করে বিড়বিড় করে বলে,
” এক ছেলের বাবা হয়েও পুলকে নাচে! ”
ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে হ্যাভেন চওড়া গলায় বলল,
” কি বিড়বিড় করছো? আস্তে বলো। সবই তো শুনতে পারছি। ”
পরমুহূর্তে অরুর খোঁচা মারা অপমান করা বাক্য হজম করতে পারলো না। হ্যাভেন মুখ ফসকে বক্র চোখে চেয়ে গমগমে আওয়াজ তুলল,

” ভাবা যায়, কত ভাগ্যবতী তুমি? পূর্বে বিয়ে করা সত্বেও পিউর ভার্জিন একজন স্বামী পেয়েছো! তোমার উচিত সেই খুশিতে, নিয়মিত তিন বেলা খাবার খাওয়ার থেকে আমাকে চুমু খাওয়া! ”
অরু পানি খাচ্ছিল। হ্যাভেনের কথায় বিষম খায়! খুকখুক শব্দ তুলে কেশে উঠল। মাথায় দু’বার থাপ্পড় মেরে ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, ব্যাপক মুডে থাকা হ্যাভেনের দিকে। চোখ ছোট ছোট করে সন্দেহী গলায় শুধাল,
” বিয়ে করেছেন, বাচ্চা আছে! আর আপনি নিজেকে ভার্জিন দাবী করছেন? হাউ ফানি! ”
হ্যাভেন প্রতিত্তোর করল না। হালকা রক্তলাল ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যময় হাসি দিল। ছেলের গালে আদর দিয়ে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।

হ্যাভেনের হাসি যেন অরুর ভেতর কিছু একটা ফাটিয়ে দিল। হাসিটার ভেতর লুকানো ছিল এমন কিছু, যা অরু ধরতে পারলো না, আবার ছাড়তেও পারলো না। কথাগুলো যেন মনের মধ্যে হাতুড়ি মারছে।
অরু এক হাতে গালে ছুঁয়ে বসে রইল, চোখের পলক পড়ছে না, যেন হ্যাভেনের পেছনে তার চিরস্থায়ী উত্তর খুঁজছে। তার চোখে তখন শুধু একটাই দৃশ্য ভাসছিল, হ্যাভেনের মিষ্টি কিন্তু রহস্যে মোড়া হাসি।
” উনি কি মজা করলেন? নাকি…”

অরু নিজের ভেতরই প্রশ্ন করল। অরুর মনে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। সত্য-মিথ্যার সীমানায় দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল, হ্যাভেন যেন এমন এক চরিত্র, যে সহজে ধরা দেয় না। তার ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে থাকা রহস্য যেন এক অলৌকিক জগতের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। হ্যাভেনের প্রস্থানের শব্দ মিলিয়ে যেতে যেতে অরুর মন আরও গাঢ় ধাঁধায় জড়িয়ে গেল। সত্যি, এই মানুষটাকে ঠিকঠাক বোঝা কি আদৌ সম্ভব?

প্রেমপিপাসা পর্ব ২

অরু বোকার মতো গালে এক হাত ঠেকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে হ্যাভেনের প্রস্থানের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকল। ভাবনায় মশগুল হয়ে অসম্ভব, অবাস্তব চিন্তায় ডুব দিল। কানে বারংবার বারি খাচ্ছে কথাগুলো। বারবার মনের ওপর আঘাত করছে। হ্যাভেন কি বলল তখন? সত্যি ছিল কি? নাকি মজা করে বলেছে?

প্রেমপিপাসা পর্ব ৪