প্রেমপিপাসা পর্ব ৩২

প্রেমপিপাসা পর্ব ৩২
সুমাইয়া সুলতানা

নিশীথের ঘুটঘুটে আঁধার ঠেলে, হ্যাভেনের প্রাইভেট গাড়িটা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই অকস্মাৎ ধরণি জুড়ে ঝুম বৃষ্টির বিচরণ। ভারী বর্ষণে সবকিছু ভিজে কাক ভেজা হওয়ার জোগাড়। সন্ধ্যা থেকেই নীলিমার অবস্থা শোচনীয় ছিল। ঘনকালো মেঘের অন্তরালে লুকায়িত স্বচ্ছ আকাশ। আশেপাশে অল্প ঝড়ো হাওয়ার আভাস তখন। গুরুম গুরুম মেঘ ডাকছিল। রাস্তার ধুলোবালিতে মাখোমাখো হয়ে ঝাপসা দৃশ্যপট। অবশেষে বৃষ্টি তার রূপ জানান দিতে ধরিত্রীতে হামলে পড়ল। গগনে কালো মেঘের উপস্থিতির দরুন চাঁদের দেখা তো দূর, একটা তারকারও দেখা মিলল না। পবনে মিলছে অদ্ভুব কর্দমক্ত বৃষ্টির ঘ্রাণ।

দারোয়ান গেট খুলে দিতেই, গেট পেরিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি পার্ক করে, সায়র দৌড়ে আগেভাগে ভেতরে চলে গিয়েছে। অল্পস্বল্প নেশা সেও করেছে। ঘুম প্রয়োজন। চোখ মেলে রাখা দুঃসাধ্য। ড্রাইভিং করেছে বহু কসরতে। তাছাড়া, প্রত্যাশের কানে নেশার কথা গেলে আস্ত রাখবে না। বাবা দেখার আগে লেবুর শরবত খেয়ে, ভদ্র ছেলের মতো রুমে থাকা ঢেরবেশি ভালো। ভেতরে যেতে অসুবিধা হয়নি। সায়রা জেগে ছিলেন তাদের জন্য।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অ্যালকোহলের ঝাঁঝ অতিরিক্ত থাকলেও হ্যাভেন নেশায় তেমন বুঁদ হয়নি। সে অ্যাভেইলেবল এসব খায়। অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। রাশিয়ায় থাকাকালীন ফ্রেন্ডদের পাল্লায় পড়ে খেয়েছে অগুনিতবার। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে মোটামুটি নেশা কেটেছে কিছুটা। গাড়ি থেকে ধীর কদমে নামল। শরীর টলছে এখনও। স্লো মোশনে গ্রীবা বাঁকিয়ে নজর বোলালো আশেপাশে। কাঙ্ক্ষিত রমণীর সন্ধান পাওয়া গেল না। অরু কি নামেনি? হ্যাভেন গাড়ির ভেতর উঁকি দিল। দেখল, অরু নেই। তৎক্ষনাৎ ধড়ফড়িয়ে নেত্রদ্বয় টানটান করে অরু’কে খুঁজতে লাগলো।
অরু বাগানে স্থির মূর্তি মানব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে, আর এই মেয়ের কোনো হুঁশ নেই। হ্যাভেন একগাদা ক্ষোভ নিয়ে অরুর নিকট তেড়ে এলো। পেলব হাত টেনে ধরে নিঃসঙ্কোচে। জরানো গলায় মুখনিঃসৃত ঘটলো ঠান্ডা ধ্রুব স্বর,

” বৃষ্টি পড়ছে, দেখছো না? ঠান্ডা লাগবে, অসুখ বাঁধবে। ”
অরু বিভ্রম কাটিয়ে নড়েচড়ে উঠে। পিটপিটিয়ে চাইল একপল। অতঃপর শশব্যস্তে মিনমিন করলো,
” আমি ভিজব। ”
হ্যাভেনের কন্ঠ শক্ত,
” অরু জ্বর আসবে, চলো। ”
” না, আমি ভিজবই। ”
মেয়েটির ত্যাড়া উত্তর। হ্যাভেন চটে গেল খুব। ধানিলঙ্কার তেজের সাথে পেরে উঠা মুশকিল! তীক্ষ্ণ ব্লেডের মতো ধারালো কথার বাণ ছুড়তে পারে অবলীলায়।
ইতোমধ্যে হ্যাভেনের হাঁচি আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। হাতের বন্ধনে দৃঢ়তা টানল। তিরিক্ষি মেজাজ সহিত দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
” ঠান্ডায় আমার সমস্যা হয়। ”
অরু স্বর অপরিবর্তিত রেখে একই ভঙ্গিতে জানায়,
” আপনি চলে যান। আপনাকে ভিজতে কে বলেছে? ”

বউয়ের গোমড়া মুখের মিহি কথায় হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। বৃষ্টির পানিতে মদের নেশা কেটে যাচ্ছে আস্তে-ধীরে। প্রকট সূঁচালো চাউনি নিবদ্ধ মেয়েটির উপর। মুহুর্তে চাহনিতে ভিন্ন নেশা হানা দিল। ক্ষণিকের লহমায় ভিন্ন জগতে পদার্পণ করে বসলো প্রেমিক পুরুষ। চক্ষুমণিতে একাগ্র নিবেশন তার কোমল ফুলের মতো ফুটফুটে বউটির। শান্ত, মাতাল দৃষ্টিতে অবলোকন করছে অরুর আপাদমস্তক। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না, চট করে নজর সরিয়ে নিলো। বৃষ্টির তালে তালে ওর মনের প্রণয়নের তান্ডবও বেড়ে চলেছে। জোরে শ্বাস টেনে বেহায়া দৃষ্টি বর্তায় ভেজা শাড়িতে লেপ্টে থাকা অরুর পানে।
কিয়ৎক্ষণ পর বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু ঘায়েল করা রমণীর দিকে তাকিয়ে মত পাল্টালো নিমিষে। বেমালুম ভুলে গেলে নিজের অসুস্থতা। চাহনি অবিচল রেখে হ্যাভেন হাত ছেড়ে দূরত্ব বাড়াল। বাধা দিল না চঞ্চল রমণীকে ভিজতে। নিজেও গেল না। ইচ্ছে পোষণ করল বউয়ের সঙ্গে বৃষ্টি বিলাস করবে।

অরু খুশি হলো। চকচকে দন্তপাটি দেখিয়ে প্রাণবন্ত হেসে জুতো খুলে পুরো বাগানে চক্কর কেটে ভিজতে থাকল আপন ছন্দে। একটা সময় চোখ বুজে দু’হাত মেলে দেয় দু’দিকে। বুক ভরে লম্বা শ্বাস টানল। বৃষ্টির পানি হাতে নিয়ে নাচাতে লাগলো। এতে মজা পায় সে। অন্যরকম আনন্দ লাগে। বৃষ্টি তার খুব পছন্দ। বৃষ্টি এলেই ভিজতে মন চায়।
বুকে হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বউয়ের বাচ্চামি দেখছে হ্যাভেন। এতটা উৎফুল্লতা, উচ্ছ্বাস অরুর মধ্যে আগে দেখেনি। সময় গড়ালো কিয়ৎপরিমাণ। বাগানের মৃদু আলোয় মেয়েটার ভেজা স্নিগ্ধ মুখের দৃশ্যটা হ্যাভেনের কাছে নিদারুণ লাগছে। প্রণয় পুরুষের প্রস্ফুটিত আবেগের জোয়ার বাঁধন হারায় তখন, যখন আচানক অরুর সিল্কের শাড়ি ফর্সা উদর হতে সরে যায়। একে তো শাড়ি ফিনফিনে পাতলা। সবই সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তার উপর বৃষ্টিতে ভিজে চিপকে জড়োসড়ো হয়ে গায়ের সঙ্গে একপ্রকার লেগে রয়েছে।

অরুর কাপড়ের আস্তরণ খানিক উপরে উঠে দৃশ্যমান হচ্ছে পা। অনাবৃত মোম নরম পা দু’টোতে আলো পিছলানো দ্যুতি। শাড়ি ভেদিয়ে নারীদেহের প্রতিটি স্তরে সন্তোর্পনে দৃষ্টি বোলালো হ্যাভেন। এই মুগ্ধতার মোহজাল ভেঙে গুড়িয়ে যায় রমণীর কাচের ন্যায় স্বচ্ছ শরীরের প্রতিটি ভাঁজে নজর পড়তেই। তার সর্বস্ব স্থির হয়ে যায়। বৃষ্টিতে সানন্দে ভেজা রমণীকে দেখে হরণ হলো শরীরের সমস্ত ক্রিয়া প্রক্রিয়া। বক্ষঃস্পন্দন বাড়তে বাড়তে পাহাড় ছোঁয়। সংযম, জগৎ, টানাপোড়ো সব ভুলিয়ে ভ্রান্ত করে মস্তিষ্ক। প্রেমের দমকা হাওয়ার তোড়ে পুরুষালি চিত্ত এলোমেলো করে দিল সবটা। অশান্ত, অস্থির ঢেউ আছড়ে পড়ে ভেতরে।

বৃষ্টির পানিতে হোয়াইট, গ্রীন কম্বিনেশনের সিল্কের শাড়ি ভিজে লেপ্টে আছে মেয়েটির কোমল শুভ্র অঙ্গে। নিঁখুত ভাবে মিশে রয়েছে সেথায়। পিঠময় লেপ্টানো ভেজা চুল, মুক্তো দানার মতো ভেজা বদনখানি। হ্যাভেনের গলবিল শুকিয়ে কাঠ। তারা যেন হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছে। অরু’কে কোনো মেঘ কন্যা লাগছে। হ্যাভেনের জন্য মেয়েটা এক জ্বলন্ত অগ্নি। সেই অগ্নিতে পুড়ছে এক প্রেমিক পুরুষ। মুহূর্তে হ্যাভেনের সর্বস্ব ঝলসে দিচ্ছে। শ্বাস নেওয়া কষ্টসাধ্য। গলা শুকিয়ে আসছে। শুষ্ক ঢোক গিলল সে। চোখের তারায় মাদকতা। নেশার অতল গহ্বরে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। শক্তি ক্ষয় হয়ে এসেছে। নিয়ন্ত্রণহীন করে দিচ্ছে তার সকল আয়ত্ত। বিবশ করে দিচ্ছে তার সকল স্নায়ুতন্ত্র।
অরুর চিবুক চুইয়ে পড়া পানি গলা বেয়ে বুকের ভেতর বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ব্যস! এই মুহুর্তে স্মৃতি থেকে ইহজগৎ মুছে হ্যাভেন খেই হারাল। পুরুষালি সেল্ফকন্ট্রোল ধূলিসাৎ হলো। বউয়ের থুতনিতে সে বরাবরই পরাস্ত। চিরচেনা জেলাসি ফিরে এলো মুহূর্তে। এই সুন্দরী মেয়েটা কে? অবশ্যই ওর বউ। যার প্রতি একটু না, অনেকটা উন্মাদ সে। তাহলে এই নির্লজ্জ বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর সাহস কীভাবে হয় ওর বউকে ছোঁয়ার? হ্যাভেনের অনুমতিবিহীন ছুঁয়ে দিচ্ছে তার নারীকে!
বুকের বাম পাশে হাত রেখে বিলম্বহীন স্বগতোক্তিতে বিড়বিড়াল সে,

” হৃদয়হরণী, কি নেশা ছড়ালে? কি মায়ায় জড়ালে? আজকে তুমি শেষ! ”
বাক্য শেষ করে নিঃশব্দে অরুর পেছনে এসে দাঁড়াল। বেহায়া হাত দুটো বউকে ছুঁতে উদগ্রীব। হ্যাভেন আলগোছে পিঠ থেকে চুল সরিয়ে কাঁধে রাখল। চক্ষু সম্মুখে উন্মুক্ত হলো অরুর ফর্সা মসৃন পৃষ্ঠদেশ। খোলা পিঠ হ্যাভেনের অন্তঃস্থলে শিহরন তোলে। টুপ করে নিরদ্বিধায় ঠোঁট ছোঁয়াল সেথায়। অপেক্ষা করল না, এক ঝটকায় তাকে নিজের দিকে ঘোরালো। বৃষ্টি উপভোগ করায় মগ্ন মেয়েটাকে হম্বিতম্বি করার ফুরসত দিল না। কোনোরূপ দ্বিধান্বিত না হয়েই একটানে তুলে নিলো কাঁধের উপর। হকচকিয়ে যায় রমণী। ভয়ার্ত মুখে খামচে ধরে হ্যাভেনের পরিহিত ওয়েস্টার্ন কোটের একাংশ। তন্মধ্যে কুন্ঠায় বিমূর্ত। বিস্মিত হয়ে তৎক্ষনাৎ গলার আওয়াজ খাদে নামিয়ে চ্যাঁচাল,
” অসভ্য লোক! নামান৷ কেউ দেখে ফেলবে। ”
শুনল না সে। ভেতরে যেতে যেতে বলল ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে,

” সাইলেন্ট থাকো। ”
মাথায় মেজাজ চড়ে গেল অরুর। কটমটিয়ে দাঁতে দাঁত পিষল। পেলব দু’হাতে হ্যাভেন’কে কিল, খামচা-খামচি দিয়ে, নামার জন্য বৃথা চেষ্টা অব্যাহত রেখে বলতে লাগলো,
” কাকীমা মেবি জেগে আছেন। এভাবে দেখলে আমি লজ্জা পাবো। আমার পা আছে। নামিয়ে দিন। আমি হেঁটে যেতে পারবো। ”
তার একঘেয়ে ভাবলেশহীন জবাব,
” না, মানে না। ”
” বেহায়া, অসহ্যকর লোক! ”
নিজেকে ছাড়ানোর পাঁয়তারা জারি রেখেছে মেয়েটা। একরাশ লজ্জা সমেত আরক্ত নেত্র ঘুরিয়ে ড্রয়িংরুম সহ আশেপাশে দেখছে। ভাগ্য ভালো সায়রা’কে নজরে আসছে না। আশাকরা যায় সকলে নিজেদের রুমে ঘুমোচ্ছে। তবে ক্ষুদ্ধ হয়ে খামচির দরুন তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে হ্যাভেনের ঘাড়ে সরু রেখার ন্যায় কত জায়গায় ছিঁড়েফেড়ে গিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। ব্যথা অনুভব হলেও হ্যাভেন থামল না। নিরুদ্বেগ সহিত জোরজবরদস্তি করে অরু’কে সমেত বেড রুমে পা বাড়াল।

রুমে প্রবেশ করে এক মূহুর্তের জন্যেও এদিক সেদিকে তাকালো না হ্যাভেন। অরু’কে নামিয়ে দরজা আটকে মেয়েটাকে রাগ প্রকাশ করার সুযোগ দিল না, দরজার সঙ্গে চেপে ধরল। লোকটার ওই তীব্র নেশা ভরা কঠিন হৃদকম্পিত চাহুনি দেখে থমকে গেল অরু। যে চাহুনি ঝঙ্কারিত করে দিল তার অন্তর্দেশ। কাঁপল মেয়েলি কায়া। চক্ষু সম্মুখে নিজের আসন্ন ধ্বংস দেখতে পারছে সে। নিষিদ্ধ অনুভূতি গ্রাস করল তৎক্ষনাৎ। হাঁ করে কিছু বলতে যাবে তক্ষুনি অরুর অধর ভাঁজে হামলে পড়ল এক জোড়া শুষ্ক পুরুষালি উষ্ণ ওষ্ঠপুটের অতর্কিত আক্রমণ।
হতভম্ব হয়ে গেল অরু। শক্ত জীর্ণ দেহশ্রী মিইয়ে আসে। নিমিষে খিঁচে বুজে ফেলল চক্ষুদ্বয়। ওষ্ঠপুটে নিয়ন্ত্রণহীন, বেসামাল পুরুষের নিগূঢ় স্পর্শে অচিরেই শ্বাসরোধ হয়ে আসে মেয়েটার। দুর্বল হৃৎস্পন্দন গতি হারায়। দেহশ্রী জুড়ে আগমন ঘটলো কম্পনের। স্পর্শের গভীরতা মাত্র ছাড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। ঠোঁটের অমৃতসুধার নমনীয়তার লাগাম টেনে মুখগহ্বরে চলছে পুরুষালি অধরের উন্মোচিত বিচরণ। কিয়ৎক্ষণ বাদে মুক্তি মেলে অধর যুগলের। ঘনঘন শ্বাস টানছে দুজন।

অরুর নাকে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল হ্যাভেন। ঘোরলাগা গলায় অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল কপালে কপাল ঠেকিয়ে,
” এ কোন রূপ দেখালে মেয়ে! আমি শান্ত থাকতে পারছি না। ধৈর্য রাখতে পারছি না। বেসামাল হয়ে যাচ্ছি। নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে এনেছো। আজ আমায় কীভাবে আটকাবে? ”
পরিচিত কম্পনে বুকখানা লাফ-ঝাঁপ তুলল রমণীর। হ্যাভেনের হৃদস্পর্শ বাক্যবহরে শিউরে উঠল। রুগ্ন মানবীর ন্যায় থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর সর্বাঙ্গ। ভেজা লম্বা চুলগুলো মুখের উপর পড়ে আছে। উতলা দৃষ্টিতে চোখ খুলল অরু। পরপর স্পর্শ পায় একটি হিম শীতল হাতের। হ্যাভেন একহাতে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। নেশালো একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে অন্য হাতের আঙুল দিয়ে অরুর মুখের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলো আস্তে করে সরিয়ে দিল কানের পিঠে। শিহরণে ফের চোখ বুজে নিলো অরু। নৈঃশব্দের আঁচ পেতে নিভু নিভু অক্ষিপট তুলে তাকায়। নেত্রদ্বয়ে ভেসে উঠল একজোড়া মাদকবেষ্টিত নিগূঢ় ভাসা ভাসা নয়ন।
হ্যাভেন পলকহীন তাকিয়ে রয়েছে অরুর দিকে। লোকটার পূর্ণ দৃষ্টি ওর রক্তজবা অধর পানে। আবারও সেই ভয়ংকর সুনামির ইঙ্গিত! মেয়েটা নিমিষে বুঝে ফেলল স্বীয় পুরুষের মনোভাব। বিরতিহীন কেঁপে উঠল দেহখানা। ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে উজ্জ্বল মুখশ্রী।
মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখল অরু। তাৎক্ষণিক মেয়েটার তোতলানো, ভীতিগ্রস্ত, কম্পিত, রুক্ষ আওয়াজ শোনা গেল,

” এমন করছেন কেন? সরুন, চেঞ্জ করবো। ”
” একবারে সকালে করো। ”
স্ফূর্ত কন্ঠে প্রত্যুত্তর করে হ্যাভেন। মেয়েটা বলল স্বর নামিয়ে,
” হাত সরান। অযথা পাগলামো কেন করছেন? ”
বিন্দু পরিমাণ টলল না সে। সুঠাম, বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত দেহটা খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে। অরু এযাত্রায় তীব্রভাবে অস্থির হলো। এই অসহনীয় অনুভূতি থেকে পালাতে চাইল। যেন পালাতে পারলেই বাঁচে। তবে হ্যাভেনের হাত থেকে পালানো বুঝি এতই সহজ? সম্ভব না তার পক্ষে।
অরু নরম হাতে ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে সরাতে ব্যস্ত। হৃদয়ের সুপ্ত প্রণয়ের মিশলে জর্জরিত হয়ে যখন আপন কাজে মগ্ন, তক্ষুনি পুরুষালি গভীর আবেগ মেশানো ভয়েস শুনতে পেলো,
” আমার ঠান্ডায় সমস্যা হয়। তবুও বৃষ্টিতে এতক্ষণ ভিজিয়েছো! শাস্তি পেতে হবে। ”
হাতের কার্য লাগাম টেনে চকিতে তাকাল অরু। কপাল কুঁচকালো নিমিষে। মিহি কন্ঠটা নির্লিপ্ত থমথমে,
” আমি বলিনি। আপনি নিজের ইচ্ছায় ভিজেছেন। ”

আমলে নিতে অনিচ্ছুক হ্যাভেন। ভেজা চুল সরিয়ে অরুর কাঁধে মুখ নামিয়ে আলতো চুমু খেল। শিরশির করে উঠল মেয়েটির সর্বাঙ্গ। ঝড় বইয়ে দিল লোম কূপে কূপে। নিঃশ্বাসের গতি জোড়াল হয়। তীব্র অনুভূতির জোয়ারে সামলাতে ব্যর্থ নিজেকে। হ্যাভেন তখনো কাঁধে ঠোঁট ছুঁইয়ে আছে। অধরের অমায়িক বিচরণ থামল গলার ভাঁজে এসে। পরপরই দাঁত দাবিয়ে শক্ত কামড় বসাল সেথায়। ব্যথায় চিনচিন করে উঠে। অরু ধাক্কা মেরে আলগোছে ছাড়িয়ে নেয়।
চঞ্চল পদযুগল থামে ড্রেসিং টেবিলের কাছে এসে। হ্যাভেনের কী তা সহ্য হয়? ত্বরিত গতিতে অরুর নিকটে চলে আসে। জাপটে ধরল পেছন থেকে। মেয়েটা ছাড়া পেতে ছটফট করছে। ওর অধৈর্য কর্মকাণ্ড, নড়েচড়ে ওঠা শরীরে এবার শক্তি প্রয়োগ করল হ্যাভেন। উদরে চাপ প্রয়োগ করে দৃঢ় ভাবে। অরুর ঘাড়ে পুরুষালি উষ্ণ ওষ্ঠপুটের অমায়িক বিচরণ বিদ্যমান। দম আটকে আসছে তার।
আনমনা হ্যাভেন স্লেজ স্বরে জানান দিল নিজস্ব অভিব্যক্তি,

” তোমার নরম শরীরের প্রতিটি খাঁজে আদর মাখতে চাই অরু। আমার ভালোবাসার সূক্ষ্ম চিহ্ন রাখতে চাই। ”
অরু দিশেহারা হর্ষণে। রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধ চালাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। দোনোমোনোর অঙ্গারে অকস্মাৎ মস্তিষ্কে এক সূক্ষ্ম চিন্তা জেগে উঠল। অনুভব করল সেটা ওর গাফিলতি ছিল। কিন্তু মগজ হার স্বীকার করতে চাইল না। তাগিদ দিল কথার বহরে জিততে হবে। ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায় রমণী। হ্যাভেন’কে জ্বালাতে গজগজিয়ে চড়া কন্ঠে আঙুল তুলল,
” মিস্টার হ্যাভেন তালুকদার, আমাকে আপনি রিজেক্ট করেছিলেন মনে আছে? হ্যাঁ, রাগের মাথায় আপনার সঙ্গ চেয়েছিলাম। তাই বলে আমায় ফিরিয়ে দিবেন? যেই জ্ঞানের বাণী সেদিন শুনিয়ে ছিলেন, তা আমাকে কাছে টানার পরেও শোনাতে পারতেন। হাসব্যান্ডের কাছ থেকে অমন মুহুর্তে রিজেক্ট হওয়া একজন মেয়ের পক্ষে কতটা অপমান, লজ্জার আপনি জানেন? ”
পুরোনো তিক্ত অভিজ্ঞতাসমপন্ন রমণীর ঝাঁঝালো বাক্যে হ্যাভেন’কে তিল পরিমাণ বিভ্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে না। সে পরিতোষ নিরুদ্বেগ! চোখ ছোট করে তাকাল অরুর ব্যঙ্গাত্মক মুখবিবরে। অতঃপর ঠোঁট কামড়ে হাসল। নিটোল অধর নেড়েচেড়ে বলল সিরিয়াস ভঙ্গিতে,

” তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা একটা জ্যামিতিক ছায়াচিত্র। যেখানে কেন্দ্র তুমি, আর আমি কেবলই ঘূর্ণায়মান ব্যাসার্ধ। তোমাকে আপন করার পর বোঝালে ততটা বুঝতে সক্ষম হতে না, যতটা ওই সময়ে বুঝতে পেরেছো। নিখিলের প্রতি কোনটা ভালোবাসা, কোনটা মোহ যখন বুঝিয়েছি, তখন তুমি শান্ত হয়ে শুনেছো। পরক্ষণে তোমার ভাষাহীন শূন্য ছলছল ডাগর আঁখি যুগলে আমি নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখেছিলাম। যা ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে পেলে দেখতে পেতাম না৷ তুমি স্বইচ্ছায় নিজেকে আমার নিকট উন্মুক্ত করলে, যদি আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিতাম, তখন লজ্জার হতো। তোমাকে সঠিক রাস্তা দেখাতে সময় দিয়েছি। ”
এতটুকু বলেই ভারিক্কি অতিষ্ঠ শ্বাস ফেলল সে। বিলম্বহীন পুনরায় বলতে থাকল,

” আজ তুমি মুখে কটাক্ষ শব্দ উচ্চারণ করলেও, তোমার চোখে নিজেকে আমার নিকট সঁপে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখতে পারছি। কথায় বলে না, চোখ হচ্ছে মনের আয়না। যার দ্বারা অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়। তোমার গভীর দৃষ্টি বলে দিচ্ছে তুমি আমাকে চাও। কিন্তু সেদিন মুখে আমার হওয়ার আহ্বান জানান দিলেও, চোখে তা প্রকাশ পায়নি। একরাশ বিতৃষ্ণা, জবরদস্তি দেখেছি। বাকি রইল অপমানের কথা? হিসেব অনুযায়ী আমায় তুমি একাধিক-বার রিজেক্ট করেছো। শক্তি দিয়ে না হোক, নীরব ঘৃণা দিয়ে করেছো। ফর গড সেইক, ইউ টেল মি? তোমার সঙ্গে জবরদস্তি ইনটিমেট হলে তুমি আমায় মন থেকে মেনে নিতে পারতে? ”
অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে অরু কাচুমাচু ভঙ্গিতে মস্তক নিচুতে নামায়। জবাব দিতে ব্যর্থ। নির্বিকার হয়ে রইল। হ্যাভেন পুনরায় কাছে আসে। আগলে নেয় অরু’কে। চিবুকে আঙুল ছুঁয়ে ফের বলে,
” পারতে না। বরঞ্চ বিতৃষ্ণা, ঘৃণার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতো। ”
মেয়েটা মলিন নজর ফেরাল হ্যাভেনের পানে। ঘটলো দৃষ্টির বিনিময়। আচানক কন্ঠনালি হতে বেরিয়ে এলো ভঙ্গুর অথচ নিগূঢ় বাক্য,

” আমি কি অপয়া হ্যাভেন? ভুলটা বেশি ছিল কি? ”
অতর্কিতে ওর গলার ভাঁজে মুখ ডোবালো হ্যাভেন। ছলকে উঠে অরু। কর্ণগহ্বরে ভেসে আসে হিমশীতল মোহনীয় হাস্কিস্বর,
” অরু পাখি? ”
অমনি অরুর শরীর ঝাঁকুনি দিল। মোহঘোর বাক্য আচ্ছাদন করে ফেলল তাকে। থরথরিয়ে কাঁপল হাঁটু দুটো। সরে যেতে উতলা। দ্বিধা, ভয়, শঙ্কা, সবকিছুর জোয়ারে গুটিসুটি মেরে পিছিয়ে যায় ক্রমশ। পিছিয়ে কি লাভ? বাহুবন্ধনী থেকে তো ছুটতে পারেনি।
হ্যাভেন মুখ তোলে। পলক ছাড়ে না কামুক অক্ষিপটে। নিষ্প্রভ মাতাল চোখে চেয়ে মস্তক নুইয়ে অরুর কানের নিকট ফিসফিস করে,

” একদিকে সফল বিজনেসম্যান, অন্যদিকে…..! যাকগে, হ্যাভেনের মতো একজন ব্যক্তির বউ কখনো অপয়া হতে পারে? আর মানুষ মাত্রই ভুল। ”
তার উষ্ণ শ্বাসের তোপে অরুর দেহ এমনিতেই শিরশিরে। অশ্রুসিক্ত লোচনে অনিমেষ চেয়ে থাকল। কম্পিত ঠোঁট নেড়ে ধরাশায়ী গলায় শুধায়,
” আপনার মনে কি আছে, বলুন? আমাকে নিয়ে আপনি কি ফীল করেন? সত্যিটা বলুন। তাহলে আপনি যা চাইছেন তাতে বাধা দেবো না। ”
চোখে চোখ রেখে ব্যগ্র গলায় বলে ওঠে হ্যাভেন,
” পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূরত্ব কোনটি জানো? মৃত্যু? নাহ! জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, উত্তরটা সঠিক নয়। সবচেয়ে বড়ো দূরত্ব হলো যখন আমি তোমার সামনে থাকি , কিন্তু তুমি জানো না যে আমি তোমাকে কতটা ভা…….! ”
ওর চঞ্চলতা মুখাবয়বে জানার প্রবল আগ্রহ,
” কতটা কি? কথা শেষ করুন। ”
তপ্ত শ্বাস ঝাড়ে সে। এড়িয়ে যায় অযাচিত প্রশ্ন। মুহূর্তে প্রসঙ্গ পাল্টায়,

” আমাকে আট ঘন্টা নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছো! প্যাঁচানো কথার জালে বিভ্রান্ত করেছো। ”
এপর্যায়ে ক্ষেপে উঠল অরু। দূরত্ব বাড়িয়ে খিটখিটে মেজাজে ভ্রু উঁচায়,
” পাল্টিবাজ লোক! বাকিটুকু বলুন? কবে, কীভাবে বিভ্রান্ত করেছি? কিছুই বুঝে পারছি না! ”
” বোঝা লাগবে না৷ জাস্ট ফোকাস অন মি৷ ”
অরু দূরে সরে যাওয়ায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে হ্যাভেনের উৎকন্ঠিত বক্ষঃস্থল। মস্তিষ্ক হয়ে উঠেছে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য। চোয়াল কাঠিন্য করে হ্যাঁচকা টানে পুনরায় কাছে নিয়ে এলো তাকে। উচ্চারণ করল মেঘমন্দ্র কন্ঠে,
” কোথায় পালাবে মাই ধানিলঙ্কা? আজ ছাড়ছি না! মিথ্যা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করো! কি ভেবেছো? এমনি এমনি ছেড়ে দেবো? তোমায় পানিশমেন্ট পেতে হবে। যার ডোজ সামলাতে আগামী এক-দুই সপ্তাহ বেড রেস্ট থাকতে তুমি বাধ্য! আমাকে অনেক দৌড়ঝাঁপ করিয়েছো! ”
বিরক্ত ছেয়ে গেল অরুর ব্যাকুল সুশ্রী আদলে। কঠোর চোখে উপেক্ষাপূর্ণ হ্যাভেন’কে দেখল। পরক্ষণে গর্জে উঠে। কন্ঠে ঢালল নিদারুণ তেজ,

” কিসের বিভ্রান্ত? স্টেট দ্য কারেক্ট পয়েন্ট? ”
অরুর ঘাড়ে অধর বোলাচ্ছে হ্যাভেন। মেয়েটার শক্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। মুগ্ধতার বাণে ডুবে মরার মাঝেই ছুটে এলো একটি নরম স্বর,
” আজ আমার উন্মাদনায় ঝলসে যাবে তুমি, এটাই মেইন পয়েন্ট! ”
অরু ছাড়াতে চাইল না। আরক্ত আদলে কুণ্ঠা ঠেলে জিজ্ঞেস করল রিনরিন শব্দে,
” ভালোবাসেন? ”
অধর ক্রিয়া বজায় রেখে হৃষ্ট চিত্তে জানালো সে,
” জবাব তোমার কাছেই আছে। আর ভালোবাসি একবার মুখে বললে কিয়ামত ঘটে যাবে। আমার প্রণয়নের দংশনে ধ্বংস হয়ে যাবে। পারলে এখন আমাকে সামলে দেখাও। ”
অরু তিরস্কার করে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু কটিদেশ ছাপিয়ে উদরে থাকা পুরুষালি উষ্ণ হাতের স্পর্শ গভীর হতেই, কথা গলায় আটকে গেল। নিভু স্বরে রয়েসয়ে মুখ খুলল,

” গিভ মি মাই অ্যানসার ফার্স্ট? ”
হ্যাভেন প্রকট চাহনি ধরে রেখে কপাল গোছায়,
” দ্য অ্যানসার টু হোয়াট? নিজের পছন্দের ছেলে, একটু একটু ভালোবাসার মানুষটাকে চোখের সামনে দেখেও চিনতে পারছো না? ”
মেয়েটা চোখ কপালে তুলে জানতে চায়,
” হোয়াট ইজ দ্য মীনিং অব ইয়োর ওয়ার্ডস? ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ৩১

হ্যাভেন বুঝে নিলো তার অস্থিরতা। কোমরে চাপ প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। বুকের আঁচল ফেলে দিয়েছে আরও আগে। লম্বা সিল্কের আঁচলটা অবহেলায় পায়ের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অরুর হৃৎস্পন্দন জোড়াল হয় লোকটার সান্নিধ্যে। দৃষ্টি অবিচল রেখেছে শার্টের বোতামে।
অরুর অপ্রতিভ, অপ্রস্তুত চেহারা মন দিয়ে দেখল হ্যাভেন। রাশভারী কন্ঠে তৎক্ষনাৎ বোমা ফাটাল,
” তোমার পছন্দের ছেলে আমিই। যদিও তুমি আমায় ভালোবাসো কি না মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট কথাটা ধোঁয়াশায় থেকে যাচ্ছে। বাট নো প্রবলেম। আজ না হোক, কোনো একদিন বাসবে। ”

প্রেমপিপাসা শেষ পর্ব