প্রেমসুধা পর্ব ৩৯
সাইয়্যারা খান
গাড়ির এক কোণায় লেগে বসে আছে পৌষ। শেষ বেলায় তাদের থাকাটা হলো না। ইনি, মিনিকে কোন এক জাদু বলে বুঝ দিয়েছে তৌসিফ। পৌষ তো মুখে তালা দেয়া সেই কখন থেকে। মনটাও তার ভার ভার।লোকটা রেগে তার উপর। কথা বার্তাও ততটা বলছে না। শেষবার মনে হয় বুঝি সিট বেল্টটা লাগালো। এই তো। পৌষ তখনকার চোখ গরমই এখনও ভুলতে অক্ষম। ঢোক গিলে জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো ও। সারি সারি কাশফুল দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে অবশ্য ততটা দেখা গেলো না। তৌসিফকে নিয়ে ঘুরতে মন চাইলেও পৌষ কথা বললো না। মূলত সাহসটাই হচ্ছে না।
একমনে ড্রাইভিং করছে তৌসিফ। তার নজর সড়কে। একটুও হেরফের হয় নি। মনোযোগ সম্পূর্ণ ড্রাইভিং এ হলেও তার ধ্যান আছে পৌষ’র উপর। চুপচাপ থাকার মেয়ে পৌষ না। তখনকার ধমকে এখনও থমকে আছে ও। তৌসিফ ভেবে নিলো বাসায় গিয়েই মানিয়ে নিবে। সেটা মুশকিল কিছু না অবশ্য।
গাড়িটা বাড়ীর সামনে থামতেই তৌসিফ নামলো। দারোয়ান এসে আগেভাগে পৌষ’র সাইডে ডোর খুলে দিতেই বেরিয়ে এলো পৌষ। সোজা হাটা দিলো উপরে। তৌসিফ সেদিকে নজর দিয়ে ফোন বের করে কাউকে কল লাগালো। কথা বলতে বলতে হাটা দিলো উপরে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রুমে এসে পোশাক বদলে বারান্দায় চলে এলো পৌষ। শরৎ কাল চলমান। শারদীয় বাতাসে বুনো এক গন্ধ। বাড়ীটার চারপাশই গাছ গাছালিতে ভরপুর। কৃষ্ণচূড়া গাছটা নজর কাড়ার মতো বটে। রাতের আকাশপানে তাকিয়ে পৌষ৷ মেঘগুলো ফুলা ফুলা। ঠান্ডা বাতাস বইছে হঠাৎ ই। বৃষ্টি বৃষ্টি একটা ভাবও বিরাজমান৷ তবে আদৌ বৃষ্টিপাত হবে কি না বুঝা দায়। ঠিক যেমন বুঝা দায় তৌসিফ তালুকদার’কে। এবছর কাশফুল দেখা হয় নি পৌষ’র। প্রতি বছরই এসময় হেমন্ত সব ভাই-বোন নিয়ে বিকেলে বেরিয়ে যায়। দুপুরের রোদ গড়িয়ে যখন বিকেল তখন থেকে সন্ধ্যা অবদি ওর কাঁশবনে ঘুরে। পৌষ’র অবশ্য দিয়া বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো যা কোনদিন পূরণ হয় নি। ইনি, মিনি এতদূর যেতে পারবে না। ওদের নিয়ে সর্বোচ্চ সারিঘাট অবদি যায় হেমন্ত। সেখানেই সারা বিকেল ঘুরে ওরা। খাল জাতীয় জায়গাটাতে নৌকা ভাড়া করে চড়ে বেড়ায়। এবছর বুঝি ঐ আনন্দটা মাটি চাপা যাবে। কথাগুলো ভেবেই ভেতর থেকে চাপা শ্বাস ছাড়লো পৌষ।
সম্মুখে রাখা কেদারায় গা এলিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। পুকুর ভরা কচুরিপানা ছিলো যা আজ নেই। হয়তো তারা পরিষ্কার করালো। নৌকাটাও আজ একদম এই সাইডে কিণারায় বাঁধা। পৌষ ততটা ভাবলো না। দেখা যাবে তৌসিফ’কে কিছু বললে দিবে আবার এক ধমক। এমনিতেই লোকটা রেগে আছে। যদিও পৌষ নিজের দোষ স্বীকার করে তবুও অবুঝ মনটা বড়ই লোভী। সে আহ্লাদ পেলেই আহ্লাদী হয়ে উঠে। এই যেমন তৌসিফে’র প্রেমসুধা পানের পর থেকে তার মনে গভীর লোভ জাগ্রত হয়েছে। নিজের দোষ জানা সত্ত্বেও অভিমান জমেছে মনের কোণে। এই অভিমান তালুকদার বাড়ীর ছোট ছেলে ছাড়া কেউ ভাঙতে পারবে না। কিন্তু কথা হলো সেই তৌসিফ তালুকদার কি আদৌ রাগ ভাঙাবে? সে তো নিজেই টম্বুস হয়ে আছে ফুলে।
তৌসিফ রুমে ঢুকলো রাত দশটা নাগাদ। ক্ষুধা লেগেছে তার। কাল বাসায় গেস্ট আসবে তার জন্যই মূলত দেড়ী হলো একটু। বউটা সেই কখন থেকে তার অপেক্ষায় আছে। নিশ্চিত নিজেও খায় নি। এতটুকু তো তৌসিফ চেনে তার বউকে। আজ আবার তার উপর অভিমানও করেছে নিশ্চিত। মুখ দেখেই বুঝা যায়। তৌসিফ অবশ্য এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না। বেয়াদবি করবা তো ধমক খাবা। মাঝেমধ্যে ধমক খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো আর তৌসিফ খুব করে চায় তার বউ সুস্থ থাকুক।
রুমে ঢুকবে ঠিক সেই সময় আবারও মুঠোফোন টা বেজে উঠলো। ওর পিএ ইমু কল দিয়েছে। রিসিভ করে কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকে তৌসিফ। সারা রুম জুড়ে নীরবতা। তৌসিফ কানে ফোনটা ধরেই ডাকলো,
— হানি? আর ইউ দেয়ার?
উত্তর এলো না। তৌসিফ লাইন অন করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। বিছানা খালি। ওয়াশরুম ও খালি। ইমুকে গম্ভীর কণ্ঠে তৌসিফ বললো,
— কাল সকাল সকাল পার্লার গার্ল বাসায় পাঠিয়ে দিবে। আর হ্যাঁ, তুমিও চলে এসো। কাজ আছে। আর এখন কল দিবে না।
উত্তরের আশা না করেই খট করে কলটা কেটে দিলো তৌসিফ। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে পরণে থাকা শার্টের বোতাম খুললো দুটো। বারান্দায় যেতেই দেখা মিললো পৌষ’র। রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে সে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেদিকে এগিয়ে এলো তৌসিফ। ঘুমন্ত ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কৃয়ংকাল। নিজির অজান্তেই হাত চলে গেল ওর মাথায়। পৌষ’র চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ক্ষীণ শব্দ করে ডাকলো তৌসিফ,
— তোতাপাখি উঠবে না?
ডাকটা শুনলো না। শুনানোর জন্য অবশ্য পৌষ’কে ডাকে নি। নিজে ওর পাশে গা এলিয়ে বসে আলতো হাতে বউকে টেনে নিলো বুকে। অল্প ঘুমে থাকা পৌষ হয়তো কিছুটা সজাগ হলো। নাকে ঠেকলো তীব্র পুরুষনালী গন্ধ। সেই বুকটার উপরের দিকে দুটো বোতাম খোলা। খোলা বুকে তখন লোম উঁকি দিচ্ছে যা আস্কারা দেয় পৌষ’কে। সে মুখটা ঠেকায় উন্মুক্ত স্থানে। বুকে মুখ গুজে চুপ করে রয়। তৌসিফ বউকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। কিছুটা শক্ত করে। কিছুটা নরম হাতে।
মৃদু মৃদু বাতাস বয়ে চলছে তখন। নড়চড় নেই পৌষ’র। তৌসিফ অনুভব করলো বুকে থাকা নারীটিকে যার চাওয়া পাওয়া অতি নগন্য। ওর সিঁথিতে চুমু দিলো তৌসিফ। ডাকলো,
— পৌষরাত?
— হুউ।
— উঠো খাবে না?
— উহু।
— ক্ষুধা লেগেছে হানি।
পৌষ সরে যেতে চাইলো তবে তৌসিফ না ছাড়ায় পৌষ বলে উঠলো,
— ছাড়ুন। আমি রুমে যাই। আপনি খেয়ে আসুন।
— আমি খেয়ে আসব মানে? তুমি খাবে না?
— না।
— কারণ?
— ক্ষুধা নেই।
— মিথ্যা কাকে বলছো?
— সত্যি….
— চুপ!
অতি ঠান্ডা ধমক। পৌষ সরে যেতে চাইলো তবে ছাড়া হলো না তাকে। এক টানে নিজের উপর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তৌসিফ। রুমে নিয়ে ধপ করে ফেললো খাটে। নরম তুলতুলে গদিতে ব্যথার ব টাও লাগলো না পৌষ’র কিন্তু তৌসিফ যখন ওর উপর চড়াও হলো তখন একটু ব্যথা পেলো বটে।
তৌসিফ’কে নিজের উপর দেখে মুখ ঘুরায় পৌষ। অনীহা তাও কি না তৌসিফে’র প্রতি? সেটা আবার এক রাতে? মানা যায়? উহু। তৌসিফ মানে না। ঘুরানো মুখটা হাত দিয়ে নিজের বরাবর করে ও। দৃষ্টি পৌষ’র চোখের দিকে। পৌষ বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না। অল্প স্বরে বললো,
— উঠুন। ব্যথা পাচ্ছি আমি।
— ব্যথা পাচ্ছো? কই কাল রাতে তো এরচাইতেও বেশি ওজন সহ্য করেছো?
লজ্জায় লাল রঙা হতে পারলো না পৌষ। অতটা ফর্সা সে না। তৌসিফ ওর এক গালে হাত দিয়ে বললো ভেজা নরম স্বরে,
— তখনকার ধমকটা তোমার পাওয়া ছিলো পৌষরাত। আশা করি এটা তুমিও জানো। আমি তোমার কত বড় তা তো জানো। সেই সুবাদেও তোমার আমাকে চোখ তুলে উচ্চবাচ্য তাও কি না ওমন ফালতু কথা বলার সাহস থাকা উচিত না। আর কি বলেছিলো নাইটি? সিরিয়াসলি হানি? এতটা বছর নারী ছাড়া ছিলাম আমি। কখনো চরিত্র খারাপ করি নি অথচ একরাত তোমার কাছে আসাতে কি বললে তুমি?
অনুমতি তো তুমি অনেক আগেই দিয়েছিলে আমি সময় দিয়েছি তাতেও তবুও তুমি এই কথা বললে আমাকে? স্বামী’কে এসব বলা কি বেয়াদবি না? আর বেয়াদবি করলে কি তোমাকে শাসন করার অধিকার আমার নেই? বাকিসব স্বামীদের মতো এখন তোমার কাছে নিচু হয়ে সরি বলতে পারছি না পৌষরাত। ক্লান্ত লাগছে। ঘুমাব আমি।
টলমলে চোখ দুটি দিয়ে তাকিয়ে রইলো পৌষ। ওর দোষ তো ও জানে তবুও মনটা বড্ড বেইমানি দেখালো আজ। তৌসিফ যে এতটা হার্ট হয়েছে তা ও বুঝতে পারে নি। বুঝলে অন্তত নিজে অভিমান করে থাকতো না। তৌসিফ ওর উপর থেকে সরে যেতে নিলেই পৌষ আটকালো। তৌসিফ অবশ্য ছাড়িয়ে নিলো। বিছানা ছাড়তে নিলেই আচমকা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পৌষ। পিঠে চুমু দিয়ে ক্ষীণ স্বরে জানায়,
— সরি।
তৌসিফ উত্তর দেয় না অথচ ওর ঠোঁটে চোরা হাসি। তৌসিফে’র উত্তর না পেয়ে হতাশ হলো পৌষ। লোকটা কি বেশিই রেগে আছে? পৌষ ওকে ছেড়ে সামনে এলো। শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে বললো,
— ফ্রেশ হবেন না?
তৌসিফ নিরুত্তাপ। ওর উদাসীনতা আঘাত করে পৌষ’কে। ওর জামাই যে একটা ধরিবাজ তা ধরতে পারে না পৌষ। তাই তো জামাই এর মন মানাতে এত কাজ করছে। শার্ট খুলে দিতেই হাটু গেড়ে বসে পৌষ। তৌসিফে’র সু আর মুজা খুলে রেখে আসে। তৌসিফ ততক্ষণে ওয়াশরুমে। টাওয়াল হাতে দাঁড়িয়ে থাকে পৌষ। কপাল একটা। জামাই কি মান ভাঙাবে উল্টো জামাই এর মান ভাঙাতে তৎপর পৌষ।
তৌসিফ বের হতেই টাওয়াল এগিয়ে দিলো পৌষ। নিজের চুলগুলো খোঁপা করে বললো,
— চলুন খাবেন।
তৌসিফ ভাবশালীন ভাবে তাকিয়ে গা ঝাড়া ভাবে বললো,
— তুমি যাও।
পৌষ হতাশ হলো। এ কেমন মেয়েদের মতো জেদ? তেল না দিয়ে পৌষ বেরিয়ে গেলো। তৌসিফ হতবাক হলো। বউ কি তাকে পাত্তা দিলো না? এটা কিছু হলো? পাত্তা পেতে তখন মরিয়া তৌসিফ তালুকদার ঠিক তখনই তার ছটফট করা হৃদয় শান্ত হলো। খাবার হাতে পৌষ এসেছে। টেবিলে বসে তৌসিফে’র হাত ধরে বসালো। মেখে মুখে তুলে দিলো তো গিললো তৌসিফ। পৌষ হতাশ! খুবই হতাশ! জামাই পেয়েছে একখানা। পুরাই চমলোক্ক।
খাওয়া শেষ হতেই নিজে খেয়ে রুমে এলো পৌষ। তৌসিফ আধ শোয়া হয়ে বসা বিছানায়। পৌষ চুপচাপ গিয়ে তার পাশে বসলো। লাইট অফ করে তৌসিফে’র পাশে শুতেই হঠাৎ টের পেলো ওর পা দুটো কারো শক্ত পা দ্বারা বদ্ধ। মৃদু শ্বাস ফেললো পৌষ। তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করলো,
প্রেমসুধা পর্ব ৩৮
— বুকে এসো।
পৌষ মাথাটা বুকে রাখতেই তৌসিফ আচমকা বো’ম ফাটালো,
— কাল সোহার বিয়ে। মেহেদীর সাথে। পারিবারিক ভাবেই আপাতত বিয়ে সেরে তুলে দিব কাল।
বাকরুদ্ধ, হতভম্ব, বিস্মিত পৌষ। আচমকা খুশি সে এতটাই হলো যে কথা বলার ভাষা পেলো না।