প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১১
সাইয়্যারা খান
“সব-কয়টা ব্রাশ কর। আজ গ্রিল খাব নান দিয়ে। স্থান হলো ছাদ। সময় রাত ১২ টা।”
পৌষ’র কথা শুনে সবগুলো বেশ উৎসাহী হলো কিন্তু মন থেকে ততটা খুশি না তারা। পৌষ ওদের চোখ মুখ দেখেই বুঝলো কিছু। নিজের কান চুলকে শুধালো,
“আরে আরে পাক বাহিনীর মুখ এমন ইন্দুরের মতো চুই চুই দেখাচ্ছে কেন, হ্যাঁ? মুরগী আসবে আন্ডা দিবে কাহিনী খতম। আমি কি যাচ্ছি নাকি?”
এবারে যেন নিশ্চিত হলো সবাই। ইনি, মিনি পৌষ’র কোলে ঝাপ দিলো। টাল সামলাতে না পেরে ধপ করে খাটে পড়লো পৌষ। তার উপর লাফিয়ে পরলো পিহা। দুই পাশে চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য। তাদের আপা যখন খুশি থাকে তখন কিভাবে যেন তারাও খুশি হয়ে যায়। আপার হাসিতে একটা জাদু আছে যা কান্নারত মানুষকেও হাসিয়ে মা’রবে।
পৌষ খ্যাঁকালো,
“কিরে চামচিকার দল, ব্যথা পাই না আমি? আমার ওপর লাফ দিস ক্যান তোরা? আমি কি তোশক?”
পৌষ’র প্রশ্নের উত্তরে ইনি, মিনি ওর বুকে থেকেই উত্তর দিলো,
“তুমি তো আপা, আপা।”
পৌষ ত্যাছড়া দৃষ্টি ফেলে দেখলো ওদের। চৈত্র’র দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোর মা’কে আজ ঘুমের ঔষধ খাওয়াবি। রাতে ছাদে দেখলেই বেটির মাথা খারাপ হয় এরপর আমার নামে বদনাম তুলে। ইশ, একটাবার যদি বদনাম তুলে আমাকে সম্রাটের বউ করে দিতো রে জৈষ্ঠ্যমাস, দেখতি তুই তোর মা’কে ঠেসে দু’টো উম্মা দিতাম।”
পৌষ’র প্রথম কথায় দুই ভাই সহ পিহা যথেষ্ট কষ্ট পায়। সেঝ চাচি যে কেন এমন করে তা বুঝে না ওরা। তার আচার-আচরণ পৌষ আপার প্রতি সবসময়ই কঠিন। বড় চাচি তো তাও কিছুটা মানে কিন্তু সেঝ চাচির যেন চোখের কাটা পৌষ। মন খারাব ভাব ওদের রইলো না অবশ্য। পৌষ’র শেষের কথায় হু হা হাসির সরোব পড়লো ছোট্ট এই কামড়া জুড়ে।
দ্রুত কদম ফেলে কারো আগমনের শব্দে একসাথে তিন জোরা চোখ দরজায় তাকালো। সবার চোখেই সামান্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আতঙ্ক। খাটের উপর শুয়ে বসে তখনও সবগুলো। হেমন্তের আগমন মূলত কেমন হয়? তার উত্তরে পৌষ কবিতা বানায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” কৃষকের মুখের হাসি তুমি,
ঢেঁকিতে ভাঙা ধান।
নরম রোদের কনা তুমি,
প্রকৃতিরই প্রাণ।
নতুন চালের গন্ধ তুমি,
পাকা ধানের ঘ্রাণ।
নব্য শীতের সূচনা তুমি
সকল ঋতুরই জান।”
এত সুন্দর একটা কবিতা পৌষ বানালো যে দশটা হাত তালি দিলো। তাদের চোখ মুখের আতঙ্কের মেঘ সরে গিয়ে ভর করলো সোনালী আভা কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হেমন্তের চোখের পরিবর্তন হলো না৷ বাজখাঁই গলায় সে ধমকালো,
“থাপ্পড় তো আমার হাতে খাস নি জা’নোয়ার। যেদিন খাবি সেদিন বুঝবি আমি কে।”
পাঁচ ভাই-বোন ভয়ে সিটকে গেলো অথচ পৌষ’র মুখটা হাসি হাসি। হাসি মুখেই তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। হেমন্তের রাগ তরতরিয়ে বাড়ে। দুই পা এগিয়ে এসে দাঁত খামটি মে’রে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো প্রায়,
” চোখ নামা! চোখ নামা বলছি। বেয়াদব হয়েছিস। খায়িয়ে পড়িয়ে বেয়াদব বানালাম তোকে? অ্যই তুই বুঝিস না কিছু? বুঝিস না?”
এই যে হেমন্ত এতটা রাগ করছে তাতে কিন্তু মোটেই পৌষ’র ভেতরে কোনরূপ খারাপ লাগা কাজ করছে না। ও তাকিয়ে আছে ওর ভাইয়ের পানে। ভাই রাগ করছে কিন্তু কেন? পৌষ সেটা জানতে মুখ খুলে জিজ্ঞেস করলো ছোট্ট করে,
“কি বুঝব?”
রাগে, ক্ষোভে হাত উঠে গেলো হেমন্তের। পাঁচটা দেহ যখন একটা দেহকে বাঁচাতে ম’রিয়া হয়ে তাকে পেঁচিয়ে ধরলো, যখন সেই একটা দেহের সুরক্ষায় পাঁচটা দেহ ঢাল হিসেবে রইলো তখন হেমন্তের তোলা হাতটা নিমিষেই নেমে গেলো। পৌষ বাদে বাকি পাঁচজনই এখানে আতঙ্কিত। ভয়ে ইনি, মিনি পৌষ’র বুকে মুখ লুকিয়ে আছে। তাদের ছোট বেলা থেকেই এটা অভ্যাস। চাচাতো বোন অথচ বোনের বুকটায় তারা ঘুমায়, মন চাইলে বমি করে, এই বুকেই মায়ের বকা খেয়ে ভীষণ মন খারাপ নিয়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখে। মায়ের পর বোন মায়ের রূপ ধারণ করে, কথাটা বোধহয় সত্য নাহয় সাপ নেউটে হয়েও কিভাবে যেন ওদের ভাই-বোন গুলোর সম্পর্কটা শক্ত শেকলে বাঁধা। এত ঝড়ঝাপটা যায় কিন্তু ভীত নড়ে না।
হেমন্ত অপলক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলো পৌষ’র দিকে। ডান হাত বাড়িয়ে দিলো বোনের মাথায়। পৌষের হাসি মুখটা তখন দ্যুতি ছড়ালো। সেই আলোক ছটা গিয়ে বিঁধলো হেমন্তের চোখে। ওদের মাঝে বসেই বললো,
“তুই কিভাবে রাজি হলি পৌষ? তোকে দেখতে আসতে চাইলো আর তুই হ্যাঁ বলে দিলি? আমাকে একটাবারও বলার প্রয়োজন বোধ করলি না?”
“তুমি এত কেন ভাবছো হেমু ভাই? দেখতে এলে কি হবে?”
এক ভ্রুঁ উঁচু করে হেমন্ত প্রশ্ন করে,
“কি হবে?”
পৌষ যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। খাট থেকে নেমে অভিনয় করে বললো,
“এই ধরো চা নিয়ে যাব। তারা খাবে। আমি একটু শরম পাব। ওও সালাম দিব। এরপর হাঁটতে বললে হেঁটে দেখাব। চুল দেখাব। নাচতে বললে তাও সই। আফটার অল তারা আমাকেই তো দেখতে এসেছে। একটু রবীন্দ্র সংগীতও শুনাব যদি জানতে চায়। সূরাও তো পারি। আর কি? এইত্তো। মেইন পার্ট কিন্তু এখনও মিসিং। এত সব আয়োজনের পরে তারা তো কিছু-মিছু দিবেই, ঐ আরকি।”
পৌষ তাকালো সবার মুখের দিকে। টান টান উত্তেজনা তখন। সেই উত্তেজনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যখন হেমন্ত হেসে ফেললো তখন বাকিগুলোও এবার বড় ভাইয়ের গায়ে পড়ে হাসতে লাগলো। হেমন্ত মাথা নাড়লো। নিজেকে সামলে আস্তে করে বললো,
“তুই কি শুধরবি না?”
“একটু শুধরবো নে।”
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হেমন্ত পৌষ’কে বসালো নিজের মুখোমুখি। পৌষ হাঁটু ভেঙে বসেছে। বাকি সবাই খাটে। হেমন্ত একটু ভেবে বললো,
” শাহরিয়ার তালুকদারের নাম শুনেছিস কখনো?”
পৌষ ঋণাত্মক সূচক মাথা নাড়ে। হেমন্তের মন চাইলো নিজেকেই নিজে জুতা পেটা করতে। পৌষটা মানুষ হলো না। আবারও প্রশ্ন করলো,
“তাহলে হ্যাঁ বললি কেন?”
“কাকে হ্যাঁ বললাম?”
পৌষ অবাক দৃষ্টি ফেলে তাকালো। হেমন্ত সন্দিহান গলায় বললো,
“সেঝ চাচি তোকে বলতে এসেছিলো। তুই নাকি হ্যাঁ বলেছিস?”
“বলেছে, দেখতে আসবে। আমি বললাম, ঠিক আছে।”
হেমন্ত ক্ষুদ্র শ্বাস ছাড়লো। সেঝ চাচি পৌষ’র ব্যাপারে ভালো কথা বলবে না সে জানে কিন্তু এত ঝটপট এভাবে মিথ্যা বলবে তা জানতো না। আজ নাহয় তাও জানা হলো। হেমন্ত বিরক্ত হওয়া কণ্ঠে বললো,
“চিনিস না তাহলে দেখতে আসতে বললি কেন?”
“টাকার জন্য।”
ছয়টা মানুষ এক উত্তর দিলো। হেমন্ত ধমকালো,
“কেন, আমি দেই না।”
” আদিত্য’কে ফোন দিলেই জানা যাবে, কে শাহরিয়ার তালুকদার। ওদের বংশ বিরাট বড়। মনে হয় একসাথে সাতটা করে বাচ্চা জন্মায়।”
“সাতটা বাচ্চা তো কুকুর দেয় আপা।”
চৈত্র’কে বিশাল এক ধমক দিলো হেমন্ত। পৌষ হাসতে হাসতে বললো,
“তাও আবার চৈত্র মাসেই দেয়।”
“পৌষ!”
হেমন্তের ধমকে পৌষ থামলো। হেমন্ত উঠতে উঠতে বললো,
‘তোকে দেখতে আসলে দেখবে এরপর ঘটনা ওখানেই সমাপ্ত। এটা টানবি না খবরদার! আমি না করলাম। দেখতেই দিতাম না কিন্তু ওনাদের হ্যাঁ বলা হয়েছে এখন আব্বু না করবে কিভাবে? সেঝ চাচির সাথে বোঝাপড়া পরে হবে আমার।”
পৌষ মুখটা বোথা করে বললো,
“সম্রাটের সাথে অদল বদল করে দিও হেমু ভাই।”
হেমন্ত চোখ গরম দেখিয়ে বেরিয়ে গেলো। পৌষ ঠোঁট উল্টে তাকালো। এতটুকু জীবনে এক সম্রাট চাওয়া কি খুব বেশি কিছু? পৌষ গান গাইলো,
“আমি চাইলাম যারে,
খুঁজে পাইলাম না তারে….
সে এখন বাস করে,
অন্যর ঘরে।”
খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে তুহিন। তার পাশেই এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে পলক। ঘাড় কাত করে একবার ওকে দেখে নিজের পকেট হাতালো ও। সকাল সকাল মূলত নেশা তুহিন ধরে না কিন্তু আজ মন চাইলো। চাইলো না অবশ্য, নেশা তাকে টানলো। একসময় এভাবে পলক টানতো তাকে। পকেট থেকে দুটো কাগজের লম্বা স্টিপ বের করে তা খুলে যখনই টান দিবে তখনই ঝড়ের বেগে তাতে খাবলা বসায় পলক। হাত থেকে পড়ে গেলো সেটা। পলক দেখলো সাদা ফ্লোরে সাদা সাদা গুড়ো কিছু। তুহিন ধমকালো না। হাতের আরেকটা খুলতে লাগলো। খুব দক্ষ হাতে লাইন করছে সে সেগুলো। পলকের গা হিম হয়ে এলো। ঠোঁট কাঁপতে লাগলো। এটা কি করবে তুহিন? পলক এতটুকু অন্তত জানে কিন্তু মন মানে না৷ অ্যালকোহল পান করতো, মাতলামি করতো তা তো পলক মেনেই নিয়েছে তাহলে এসব কি? হাতেরটাও পলক ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি করবেন আপনি?”
“নাকের কাছে নিয়ে টান দিব।”
খুব স্বাভাবিক এবং সত্য একটা উত্তর। পলক এতে অস্বাভাবিক হলো যেন। খেই হারিয়ে প্রশ্ন করলো,
“তাতে কি হবে?”
“মাথার ব্রেইনে গিয়ে লাগবে বুঝলে, ইউফোরিক। ইউ নো না জান? তীব্র থেকেও তীব্র আনন্দ পাই তখন।”
আতঙ্কিত হয়ে পলক তুহিনের বাহু খামচে ধরলো। লাল হওয়া চোখ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আপনি এসব কেন খাচ্ছেন? কবে থেকে নিচ্ছেন? এটা কি ছিলো তুহিন? কেন ছিলো?”
“কোকন এটা জান৷”
“কিহ!”
“গ্লুকোজ খাচ্ছি না এভাবে নাক দিয়ে টেনে এটা ফর শিওর।”
পলকের পেট মুচড়ে উঠছে। বমি পাচ্ছে। তা চেপে রেখে প্রশ্ন করে ও,
“আর কিসের নেশা করেন তুহিন?”
“নারী বাদে সব।”
“মানে?”
“এই যেমন ধরো ডিএমটি, ক্রিস্টাল মিথ, কিটামাইন। কাল রাতে ক্রিস্টাল মেথ নিয়েছিলাম তাই বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম।”
তুহিনের এসব স্বাভাবিক কথাবার্তা নিতে পারলো না পলক। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে হরহর করে বমি করে দিলো। তুহিন এক দুই পা করে এগিয়ে এলো। পলকের বমি থামছে না৷ এখন শুধু পানি আর লালা বের হচ্ছে। তুহিন ওকে ধরলো পেছন থেকে। নাভি বরাবর আঙুল দিয়ে চাপ দিতেই কিছুটা কমে এলো বমি তবে গা ছেড়ে দিলো পলক। পাজা কোলে করে ওকে খাটে আনলো তুহিন। মুখটা মুছে দিতে দিতে বললো,
“এভাবে তো অসুস্থ হয়ে যাবে জান।”
“তাতে ক্ষতি কি? আমার মৃত্যু আপনার মুক্তি।”
“ভুল।”
“তাহলে সত্যি কোনটা?”
“সত্যি তুমি, আমি এই পৃথিবী।”
” তাই বুঝি এসব নেশায় সত্যি লুকিয়ে মিথ্যায় বাঁচেন?”
তুহিন উত্তর করে না। পলক কথা বাড়ায় না। নীরবতায় কাটলো ঘন্টা খানিক সময়। তুহিন সেই নীরবতার চাদর তুললো,
“নেশা আমাকে নিজের গোলাম করে ফেলেছে পলক। সেই গোলামী কিভাবে ছেড়ে দেই?”
“নেশাকে বলুন আপনার মুক্তি চাই।”
“মুক্তির বিনিময়ে যে তার আমার জান চাই।”
“এমন জান যা দশ জনের জানকে আঘাত দেয়, সেই জান না থাকাই শ্রেয়।”
“আজকাল তুমি অনেক কঠিন কথা বলো। তুমি এমন ছিলে না।”
“আমি কে? নিজের পরিচয় ভুলে গিয়েছি।”
তুহিন বলতে চাইলো, “তুমি পলক। পলক চৌধুরী।” কিন্তু বলা হলো না। মাঝেমধ্যে কিছু কথা না বলাই শ্রেয়। উঠে যেতে যেতে শুধু বললো,
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১০
” কলিকে আর মা’রবে না পলক।”
” বে’শ্যার বোন বলে গা’লি দেন অথচ কলির হয়ে সাফাই গাইছেন?”
“স্বেচ্ছায় আর অনিচ্ছায় পার্থক্য প্রচুর।”
” ভেবে নিন কারো অনিচ্ছা তার ক্ষতি করতে চায় তাই তাকে বাঁচাতে প্রহার করেছি।”
“তুমি কারো দায় বয়ে বেড়ানোর দায়িত্ব নাও নি।”
“দায়মুক্ত করুন তাহলে আমাকে?”
“সে সুযোগ নেই।”
বলেই তুহিন চলে গেলো। পলক তাকিয়ে রইলো। নির্বাক দৃষ্টিতে অপলক শুধু চেয়ে রইলো।