প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২২

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২২
সাইয়্যারা খান

পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে পলক। জাল ফেলে পাড়ে তোলা হয়েছে তুহিনকে। উপুড় হয়ে দেহটা উল্টে আছে। সামান্য ফুলে ওঠা একটা দেহ। মাত্রই বোধহয় তোলা হয়েছে। তুরাগ সহ আদিত্যও এসেছে। ওপাশ থেকে খবর তাহমিনার কানে পৌঁছানোর মাত্রই সাহারা সহ আসছে। তৌসিফের বাহু ছেড়ে মাটিতে বসে পড়লো পলক। তাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই তার। তুহিনটাকে সে ভালোবাসে কিছু তুহিন বুঝি নেশাকে বেশি ভালোবাসলো পলক থেকে? পলক মাটিতে ঘাস খামচে ধরে। চিৎকার করে। আহাজারি করতে করতে ছোট বাচ্চার ন্যায় তৌসিফের পায়ের কাছে কাপড় টেনে ধরে। বিলাপের স্বরে বলে,

“মেঝ ভাইয়া.. মেঝ ভাইয়া, ওকে ডাকো। আমার তুহিনকে দেখো। ও এখানে কি করে মেঝ ভাইয়া৷ তুমি একটু দেখো। তোমার কথা শুনবে। আমাকে আর কত শাস্তি দিবে ও? তুমি ডাকো না মেঝ ভাইয়া। একটাবার ডাকো।”
তৌসিফ তাকালো পলকের দিকে। মেয়েটা পাগলের মতো কাঁদছে। এদিকে পৌষ মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তৌসিফ ঘাড় বাকিয়ে ওর দিকে তাকাতেই কিছুটা বিস্মিত হলো। এই মেয়ে কি ভয় পায় না? এতগুলো মানুষ ভয় পাচ্ছে কাছে যেতে অথচ পৌষ এক দুই পা করে এগিয়ে যাচ্ছে লা’শটার নিকট। তৌসিফ ওকে ডাক দিবে ঠিক এমন মূহুর্তে পৌষর কথায় গুমোট পরিবেশের ছন্দপতন হলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপু, আপু এটা তুহিন ভাইয়া না।”
বলেই দৌড়ে এসে তৌসিফের পায়ের কাছে থাকা পলককে ঝাপ্টে ধরলো। নিজের বুকের মাঝে খুব সহজেই স্থান দিলো পলককে। এতক্ষণ এই ভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে নি পলককে। একটু স্বান্তনা বানীও শোনায় নি। কথাটা এসেই শুনলো তাহমিনা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে। তৌসিফ শান্ত দৃষ্টিতে দেখলো ওকে। তুরাগ বিরক্ত হয়ে এগিয়ে আসছে। পলক পৌষের বুকে থেকেই অবিশ্বাস্য গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবী, ভাবী তুমি দেখেছো? ওটা তুহিন না? আ..আমি জানি তো। আমার তুহিনের সাদা শার্টই নেই।”
“সাদা শার্ট না থাকলেও তো মাথা ভর্তি চুল আছে তাই না? গতরাত বেশ রাত করে বেরিয়েছেন আমাদের ওখান থেকে। কয়েকঘন্টার ব্যবধানে তো আর লা’শের চুল ঝড়ে যাবে না। তারচাইতে বড় কথা তুহিন ভাইয়া তো ফর্সা কিন্তু এই লা’শটা ফর্সা না বরং শ্যামলা। নিশ্চিত এত অল্প সময়ে এমনটা হয় নি। এটা তুহিন ভাইয়াই না। আপনি নিজে দেখুন।”

“আ আমি? আমি দেখব?”
“সত্য চোখে দেখা উচিত। মানুষের মুখের কথায় বিশ্বাস করা মোটেই উচিত নয়।”
কথাটা পলককে বললেও তৌসিফ তাকালো পৌষের দিকে। তার বউ বাচাল, উড়নচণ্ডী কিন্তু এতটা মেধাবী তাতো জানতো না। এই যে একজনের বছরের পর বছর সাজানো পরিকল্পনা সে এক মিনিটের পর্যবেক্ষণে নিঃশেষ করে দিলো তা কি কেউ জানো? পলককে টেনে তুলে পৌষ। জাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে কিছুটা জোরেই বলে,
“এদিক মুখ ধুরান।”

লাঠির সাহায্য দু’জন লা’শ উল্টাতেই আশ্চর্য হলো কতগুলো চোখ। পলক কাঁদছে খুশিতে অথবা আতঙ্কে। পৌষ জড়িয়ে আছে ওকে এখনো। তৌসিফ বাদে বাকিদের মুখে রা নেই। লাশটার মুখ থেকে শুরু করে হাত-পায়ের বেশিরভাগ অংশই আধ খাওয়া। অভুক্ত কিছু মাংসাশী প্রাণীকে তাকে খাবার হিসেবে দেওয়া হয়েছিলো। ভয়ংকর এই দৃশ্য যেন উপস্থিত সকলের গা হিম করে দিলো। মীরা দেখতে পারলো না। তুরাগ ওকে ধরে মুখটা নিজের দিকে ঘুরালো।
লাশটা তাদের অতি পরিচিত একজনের। তাহমিনার পদচারণ দ্রুত হলো। এগিয়ে এসে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো শক্ত হয়ে। পৌষ কপাল কুঁচকে তাকালো একবার অতঃপর হঠাৎই বললো,

“আরে এটা ল্যাদা না? শাখী খালার ছোট ছেলে।”
তৌসিফ এবার ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো। তার বউ যে এতদূর জানে তা সে জানতো না। অবশ্য এলাকার মেয়ে, সবাইকে জানবে, চিনবে এটাই তো স্বাভাবিক। তুরাগ কঠিন স্বরে ধমকালো,
“এইসব হাবিজাবি ম’রার জায়গা নেই? তালুকদার বাড়ীর পুকুরে কেন মরতে হবে? এর বাড়ী পাঠা লাশ। যতসব নেশাখোর!”
অতঃপর মীরা সহ বাকিদের ভেতরে যেতে বললো। পৌষ পলককে ধরে নিচ্ছে। পলকের শরীর কাঁপছে তখনও। তুহিন তাহলে কোথায়? তৌসিফের দিকে যেতে নিলেই পৌষ আটকালো। নরম স্বরে বললো,
“বাসায় চলুন আপু।”
নিজেদের ফ্ল্যাটেই পলককে এনেছে ও। নিশ্চিত সকালে খায় নি। গায়ে এখনও রাতের পোশাক। পৌষ নিজে খাবার বেড়ে দিলো। পলক খাবে না দেখে মুখে তুলে দিলো। তৌসিফ ঢুকেই এই দৃশ্য দেখে একটু থামলো। এই মেয়ে এতটা কঠোর অথচ এখন দেখো মায়া উথলে পড়ছে। তৌসিফ রুমে যেতে নিলেই পলক ডাকলো,

“মেঝ ভাইয়া।”
তৌসিফকে এগিয়ে আসতে না দেখে পৌষ বিরক্তই হলো। নিজে থেকেই বললো,
“তুহিন ভাইয়া কোথায় তাহলে? তাকে খুঁজুন। ওনার ফোনই বা ওখানে গেলো কিভাবে?”
তৌসিফ বউয়ের কথার উত্তর দিতে এদিকে এসে বললো,
“তুহিনের ফোন চুরি করেই ল্যাদা পালিয়ে যাচ্ছিলো। নেশায় বুদ ছিলো তাই পানিতে পড়েই আর টিকে নি। নেশাখোড়রা অল্প পানিতেই ঢুবে মরে আর এটা তো গভীর পুকুর।”
তৌসিফ পলকের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুহিন একটু বাইরে আছে। যোগাযোগ করবে পরে।”
কথাগুলো বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো ও। পৌষের আরো কিছু প্রশ্ন ছিলো কিন্তু তৌসিফ তা করার সুযোগ দিলো না।

হক বাড়ীতে আজ-কাল আবহাওয়া কিছুটা ছন্নছাড়া। হেমন্ত কাজে যাচ্ছে আসছে। রুমে থাকছে বাড়ী থেকে ফিরে। শ্রেয়াকে সময় দিতে ওকে নিয়ে বেরিয়েছিলো গতকাল। সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যায় ওদের বাসা থেকেও ঘুরিয়ে এনেছে। শ্রেয়ার মনটা উৎফুল্ল এখন। বাসায় আসার সময় বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। হেমন্ত বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পরই গুটিগুটি পায়ে সবগুলো এগিয়ে এসে জড়ো হয় ভাইয়ের দরজায়। কেউ দরজায় টু শব্দ করে না কিন্তু ভেতর থেকে তাদের হেমু ভাই ঠিকই বুঝে তাই তো কিছুক্ষণ যেতেই বেরিয়ে আসে। ইনি,মিনিকে কাঁধে তুলে হাঁটা দেয় পৌষের রুমে।

তারা ঘন্টা খানিক সময় কাটায়। বিগত দুইদিন এটাই হয়ে আসছে। বাড়ীর বড়দের সাথে কথাবার্তা হেমন্তের বন্ধ। বাবা আজ ডেকে পাঠিয়েছে চৈত্রকে দিয়ে। চৈত্র বলে গেলো মাত্র। হেমন্ত যাবে বলেও খবর নেই। বড় চাচা নিচে সোফার ঘরে বসে সাথে বাকি দুই ভাই। আলোচনা চলছিলো বিশেষ এক বিষয়ে। হেমন্তের উপস্থিত এখানে একান্ত কাম্য অথচ ছেলেটার খবর নেই। ছোট চাচা এবার নিজেই উঠে গেলেন। হেমন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে ভাই-বোন নিয়ে। ছোট চাচা এসে বসলেন হেমন্তের গা ঘেঁষে। ইনি,মিনি বাবাকে দেখেই মুখ ঘুরে তাকালো। তাদের অভিমান চলছে বাবার সাথে। বাবাকে দুই দিন ধরে বলছে আপার কাছে নিয়ে যেতে। বাবা আশ্বাস দিয়েছে নিবে কিন্তু কই এখনও তো নিচ্ছে না। ছোট চাচা মেয়েদের পায়ের তালুতে আঙুল বুলালেন। দুইজন গুটিয়ে গেলো ভাইয়ের কোলে। হেমন্তের বুকে থেকেই বললো,

“তুমি এথান থেতে যাউ।”
ছোট চাচা জোর করে টেনে নিলেন কোলে। দুই বোন মুচড়ে বাবার কোল থেকে নেমে হেমন্তের কোলে আসলো। হেমন্ত ওদের ঝাপ্টে ধরে বললো,
“তোমাদের ভাইদের মাঝে আমরা যাই? তুমি কেন আমাদের মাঝে আসছো?”
ছোট চাচা হেসে হেমন্তের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
“নিচে আয়। তোর আব্বু ডাকছে।”
“ডাকুক।”
“কথা শুনে যা হেমু৷ উকিল বড় ভাইকে আবার ফোন দিয়েছিলো।”
“তাতে আমার কি চাচ্চু? ফোন দিয়েছে, কোর্টে যাক। জায়গা, সম্পত্তি বাট হোক।”

“তুই তো ছোট না হেমন্ত। সবই তো বুঝিস, নিচে আয়। কথা বলে যা।”
হেমন্ত গা ছাড়া ভাব দেখালো। ছোট চাচা ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,
“নিচে আয়। কথা শুনে যা। পৌষের শশুর বাড়ীও তো কিছু পাঠাতে হবে।”
হেমন্ত চোখ তুলে তাকালো। ইনি, মিনিকে কাঁধে তুলে পিহাকে বললো,
“তোর ভাবীকে চা বসাতে বল। গরম চায়ে ঠান্ডা আড্ডা হবে তোর বাপ-চাচার সাথে।”
পিহা দৌড়ে গেলো। শ্রেয়া চিন্তিতই বটে। হেমন্ত ঠান্ডা মাথায় থাকলেই হলো। পৌষের বিষয়ে যথেষ্ট গরম ও।
বাবার সামনাসামনি বসা হেমন্ত। বড় চাচা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“তুমি উকিলকে ফোন দিয়ে সরাসরি জানাও যে সম্পত্তি বাটোয়ারা হবে না।”
“যেহেতু বাটোয়ারা হবে তাহলে কেন না করব?”
” না বুঝে তর্ক করো না।”
“শ্রেয়া চা দিয়ে যাও!”
গলা উঁচু করে বললো হেমন্ত। বড় চাচা সহ মেঝ চাচা থমকালেন। হেমন্ত যে তাদের কথায় বিশেষ মনোযোগী না তা বুঝলেন। তিন চাচি পাশেই দাঁড়িয়ে। শ্রেয়া চা রাখতেই হেমন্ত চায়ে চুমুক দিলো। বড় চাচা পুণরায় বললেন,
“উকিলকে না করো।”
“প্রশ্নই ওঠে না।”

“পাগলামি করো তুমি? দেখেশুনে ভালো বাড়ীতে বিয়ে দেই নি? ওখানে রাণী সেজে আছে। খাওয়া-দাওয়া সব দিক থেকে সুখে আছে। ও কি করবে এই বাড়ীর বাট দিয়ে? সামলাতে পারবে এসব?”
হঠাৎ হেসে ফেললো হেমন্ত। পরিবেশ বদলে গেলো তাতে। হেমন্ত হাসতে হাসতেই চৈত্র আর জৈষ্ঠ্যকে দিয়ে বোন গুলোকে নিয়ে যেতে বললো। ওরা যেতেই হেমন্ত হাসি থামিয়ে বললো,
“দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছো? চমৎকার বললে তো। ওকে ভরা মজলিসে কাদা মেখে বিদায় করেছো। এমন দেখা আল্লাহ না করুক তোমরা যাতে আর কাউকে না দেখো। কিসের নজরে যে আমার পৌষটাকে দেখলে তাই বুঝলাম না। তোমাদের নজরেই নজর লেগে গেলো।”

“হেমন্ত!”
“বাটোয়ারা হবেই আব্বু। আর মেঝ চাচি, যা করেছেন বিশেষ ভালো করেন নি।”
মেঝ চাচি নিজের নাম শুনে চমকালেন। বাকি সবাইও তাকালো তার দিকে। ভরকে গেলেন তিনি। হড়বড়িয়ে বলে ফেললেন,
“আমি একা করিনি। বড় ভাবীও জানতেন৷ আর তৌসিফের সাথে আটকানোর বুদ্ধি উনিই দিয়েছিলেন। আমি তো অন্য ছেলে ঠিক করেছিলাম।”
হেমন্ত হয়তো এতবড় সত্যিটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। অবাক দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। বড় চাচি নিজেও হয়তো বুঝতে পারেন নি এভাবে ফেঁসে যাবেন। ছেলের নজরে নজর দেওয়ার সাহস টুকু হচ্ছে না। পরিকল্পনা পুরোটা ছিলো মেঝ চাচির কিন্তু বড় চাচি পৌষের ভালো চান বলেই তো সুযোগ বুঝে তৌসিফের মতো বড়লোক একজনের সাথে ফাঁসালো নাহয় তার মেঝ জা যেই ছেলের বদনাম করতে চাইছিলো সেই ছেলের না সুরত ভালো না বংশ।
হেমন্ত উঠে মায়ের কাছে এলো। অগোছালো দৃষ্টি ফেলে জিজ্ঞেস করলো,

“মেঝ চাচি কি বলছে আম্মু? এটা কি সত্যি?”
মায়ের কাছে জানা সত্যিটা আরেকবার জানতে চাইলো হেমন্ত। বড় চাচি ছেলের এই অবিন্যস্ত চোখে তাকিয়ে মিথ্যা বলতে পারলেন না। শুধু বললেন,
“তৌসিফ ভালো ছেলে।”
“আমার প্রশ্নের উত্তর এটা না আম্মু।”
বড় চাচি চুপ করে গেলেন। মেঝ চাচা মাঝ থেকে বললেন,
“যা হওয়ার হয়েই তো গিয়েছে…”
ওনাকে কথা সম্পূর্ণ করতে দিলো না হেমন্ত। শান্ত নদীতে যেন জোয়ার এলো। উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়লো নীরব নদীর মাঝে। হেমন্ত হুংকার ছেড়ে গর্জে উঠলো,
“মেয়ে আছে? মেয়ে আছে আপনার? নেই। যার মেয়ে নেই সে কেন কথা বলছে? আমার মেয়ে নিয়ে ছলাকলা করা হয়েছে। আমার বুক পুড়ছে। মেয়ে নেই বুঝবেন আপনি সেই জ্বালা? যেই ব্যথা বুঝবেনই না সেই কথা বলতে আসছেন কেন?”

হেমন্ত মায়ের দিকে তাকালো। এগিয়ে এসে হাত দুটো ধরে নিজের বুকে রাখলো। তার মায়ের হাত দুটো কাঁপছে। হেমন্ত কান্নারত চোখে তাকিয়ে বললো,
“এই হাত দুটো কাঁপে নি আম্মু যখন দরজা বন্ধ করলে? একটুও কাঁপে নি? নিজের মেয়েকে বদনাম করতে পারতে? পারতে না তো। তাহলে আমার মেয়ের বেলায় এতটা অন্যায় কেন? আরেক জনের প্রতি আমার আক্ষেপ নেই। সে আমার কেউ না আম্মু কিন্তু তুমি তো আমার মা হও কিভাবে করলে এমনটা?”
মায়ের হাত দুটো ছেলে দিলো হেমন্ত অতঃপর দুই কদম দূরে সরে বললো,
“তুমি যেভাবে আমার সন্তানকে আমার থেকে দূর করলে ঠিক সেভাবেই আজ থেকে তোমার বড় সন্তান নিজে তোমার সাথে দূরত্ব তৈরী করলো।”

বড় চাচি কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু হেমন্ত সুযোগ দিলো না। এই বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবেও পিছিয়ে গেলো। ও নাহয় গেলো কিন্তু একই সাথে পৌষকে হারিয়ে তাদের হেমু ভাইকে হারালে বাচ্চাগুলো খেই হারিয়ে ফেলবে। হেমন্ত নিজেও টিকতে পারবে না। বাপ-চাচার সাথে আলোচনা মাঝ পথে ইতি টেনে হেমন্ত শ্রেয়ার হাত ধরে চলে গেলো। যাওয়ার আগে শুধু বললো,
“কলোনির ভাড়া এমাস থেকে পৌষের হাতে যাবে। কথা নয় ছয় হওয়ার সুযোগ নেই। তৌসিফ তালুকদার ওর স্বামী। নিজের অধিকার নিয়ে খুব সচেতন।”

সময়টা দুপুর দুইটা বেজে বারো মিনিট। ঘেমে-নেয়ে একাকার পৌষ মাত্র রুমে এসেছে। ঐ দিকে কলিং বেল বাজতেই মিনু দরজা খুলেছে। তৌসিফ তায়েফাকে নিয়ে ঢুকেই পৌষরাত বলে ডাকে। উত্তর না আসতেই মিনুকে জিজ্ঞেস করে,
“মামী কোথায় তোমার?”
“উনি তো ঘরে। মনে হয় ঘুমায়।”
তৌসিফ একটু কপাল কুঁচকালো। আপা আসছে এটা তো পৌষ জানে। আর এই অসময় ঘুমাচ্ছে? তায়েফা গিয়ে সোফায় বসা মাত্রই বুয়া দুই গ্লাস শরবত আনলো। তৌসিফ বোধহয় অবাক হলো। বুয়ারা নিজ থেকে এক গ্লাস পানিও আনে না। আদেশ করলে তারা তা পূরণ করে। তৌসিফ নিজে শরবত পান করতেই বুয়া বললো,
“মামা, মামী শরবত বানিয়ে রেখে গেলো মাত্র। বলেছে আপনারা আসলেই যাতে দেই। উনি গোসলে গিয়েছেন মাত্র।”

তায়েফা শরবত পান করেই মুচকি হাসলো। তৌফিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভাইয়ের বউ এত ভালো? কিরে তুসু, কপাল খুলে গেলো আমার।”
তৌসিফ আপার কথায় হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“ফ্রেশ হও তুমি। পৌষরাতকে নিয়ে আসছি।”
“নাহ। ও আরামে গোসল করুক। ছোট মানুষ, বেশি চাপে রাখবি না খবরদার।”
তৌসিফ আপার হাত ধরে উঠালো। তাকে ঘরে দিতে দিতে বললো,
“ও নিজেই এসব করছে আজ সকাল থেকে। আমি শুধু বলেছি তুমি আসছো।”
“তুই একদমই চাপ দিবি না।”
“দিব না।”

তৌসিফ তায়েফাকে রেখেই নিজের রুমে এলো। এসে দেখলো পৌষের কাপড় বিছানায় রাখা। হঠাৎ পায়ে কিছু বাজতেই চাপা শব্দ শুনে ও। নরম অনুভব হতেই ঝুকলো। খাটের নিচ থেকে একটা পা বের হয়ে আছে। সাথে সাথেই তৌসিফ অস্থির হয়ে ডাকলো,
“পৌষরাত?”
“মেজাজ খারাপ করবেন না? পায়ে পাড়া দিলেন কেন? কানা আপনি? আল্লাহ আমার পা। লুলা টুন্ডা বানিয়ে ছাড়লো আমাকে। হাতে না মেরে ভাতে মারবে, ভাতে না মেরে এখন পায়ে মারবে।”
তৌসিফ মেঝেতে ঝুঁকে পৌষের পা দুটো টেনে বের করলো। পৌষের হাতে একটা ক্লিপ। খুলে রাখার সময়ই হাত থেকে পড়ে খাটের নিচে গিয়েছে। তা বের করতেই পৌষও ঢুকেছিলো তখনই তৌসিফ পায়ে পারাটা দিয়েছে। বের করতেই দুই হাত ধরে টেনে দাঁড় করায় তৌসিফ। ঘেমে জুবুথুবু অবস্থা পৌষের। তৌসিফ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি কি করতে ঢুকেছো খাটের নিচে?”
“ম’রা গাড়তে গিয়েছিলাম। আমার পায়ের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। জানের উপর দিয়ে যেই হারে বালা যাচ্ছে। জানের ছতকা দিতে হবে মসজিদের সামনে।”
তৌসিফ নিজের হাত দিয়ে পৌষের কপালটা মুছে দিলো। নরম স্বরে বললো,
“কাউকে বললেই তো বের করে দিতো। মিনুকে ডাকতে।”
“ওই মিনমিনা শয়তানটাকে আমি ডাকব? কুত্তা কামড়েছে আমাকে?”
“আহহা পৌষরাত, এভাবে কথা বলে না।”
“এমনিতেই গরমে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ঐ শয়তানটাকে পেলে একদম টেনে দুটো থাপ্পড় মারব। বেয়াদব একটা। ওর কতবড় আমি, আমাকে আজ বলে ওর কোন আপা নাকি আসছে, আমার নাকি বিচার করবে। আমিও তো দেখি কে আসে ওর।”
তৌসিফ কথা কাটালো। বললো,

“ঘেমে গিয়েছো। যাও গোসল করে এসো।”
পৌষ বিছানার উপর ওরনা রেখে বাকি কাপড় নিয়ে ঢুকে যেই না দরজা লাগাবে তখনই আটকালো তৌসিফ। নিজেও ঢুকলো সাথে। পৌষ বড় বড় চোখ করে বলে,
“কি চাই?”
তৌসিফ কথা বলে পৌষের হাত ধরে। টেনে কলের সামনে নিয়ে দেখায় কিভাবে কল চালু হয় অতঃপর শাওয়ার চালু করে নব ঘুরিয়ে বললো,

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২১

“গরম পানি লাগলে এটা ঘুরালেই হবে।”
“বুঝেছি।”
“যাব তাহলে?”
“জি জাঁহাপনা, এখান থেকে বেরিয়ে আমাকে ধন্য করুন। কু’ত্তাম’রা গরমে আমি ম’রে যাচ্ছি, এই গরম পানি আমার কোন কাজে আসবে না৷”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৩