প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৩

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৩
সাইয়্যারা খান

চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে গোসল করে বেরিয়ে আসতেই তৌসিফকে খালি গায়ে দেখে পৌষ কিছুটা বিব্রত হলো। চোখ নামিয়ে হাতের কাপড়ের বালতি নিয়ে বারান্দার দিকে যেতে নিলেই তৌসিফ ওর হাত ধরে আটকালো। হাত অবশ্য ধরে নি, ধরেছে বালতিটা। কপালে তিনটা ভাজ দৃশ্যমান৷ কিছু হলেই এই ভাজ পড়ে তার কপালে। ভাজের সাথে সাথে চোখ দুটো ছোট হয়ে আসে, তাতে ঘুরপাক খায় অগনিত প্রশ্ন। তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এগুলো কেন ধুয়েছো?”
পৌষের কপালে গুনে গুনে দ্বিগুণ ভাজ পড়লো। ইচ্ছে করে চোখ দুটো তৌসিফের মতো ছোট ছোট করে উত্তরে প্রশ্ন করলো,

“তাহলে কি ময়লা কাপড়ই আবার পরব?”
নাক কুঁচকালো তৌসিফ। অসন্তুষ্ট গলায় বললো,
“বুয়া আছে। বুয়াদের বেতন দেই আমি। এসব কাজ তোমার না।”
“বেতন আমি আসার আগেও দিয়েছেন। নিজের কাজ আমি নিজে করতেই পছন্দ করি।”
তৌসিফ বালতিটা কেড়ে দিলো। আচমকাই জোড়ে বুয়া বুয়া ডাকছে ও। হঠাৎ হওয়াতে পৌষ একটু চমকালো। বুয়া এসেছে দৌড়ে। তাকে দেখেই বিছানা থেকে ওরনা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পৌষ। তৌসিফ বালতিটা বুয়ার হাতে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এরপর থেকে যাতে পৌষরাতের কাপড় ওর না ধুতে হয়। আমার বাথরুম থেকে ডিটারজেন্ট পাউডার সরিয়ে নিয়ে যাও।”
বুয়া একটু অবাক হয়েই বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনার বাথরুমে তো ডিটারজেন্ট পাউডার থাকেই না মামা।”
তৌসিফ পৌষের দিকে তাকালো। ইশারায় বুয়াকে যেতে বলেই পৌষকে বললো,
“গোসলের সাবান দিয়ে কাপড় ধুয়ে ফেললে?”
“পাগল আমি? গোসলের সাবান দিয়ে কেউ কাপড় ধোয়? সাবানের দাম জানেন আপনি? আমি তো ঐ লাল রঙের বোয়ামে লিকুইড ওয়াসার দিয়ে ধুয়ে ফেললাম। গন্ধটা বাজে। চেরীর মতো। এরপর থেকে আনবেন না, ঠিক আছে?”
দুঃখে কথা বলতে ভুলে গেলো তৌসিফ। পৌষ বারান্দায় গিয়ে চুল মুছে ঝাড়ছে। এক দুই পা করে বাথরুমে দৌড়ে ঢুকে লাল শাওয়াল জেলটা হাতে তুললো তৌসিফ। বুকটা ধ্বক করে উঠলো যেন। তার নতুন শাওয়ার জেল তার বউ লিকুইড ওয়াসার ভেবে কাপড় ধুয়েছে। এই জিনিসগুলো তার খুব সখের। দোষটাও দেওয়া যাচ্ছে না। ইংরেজি কোন লেবেল করা নেই, পুরোটাই জাপানিজ ভাষায় লিখা। দুঃখে তৌসিফ বোতলটা বুকের কাছে নিয়ে দরজা আটকালো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখে একটু রূপচর্চায় মনোযোগ দিলো। বউ কি করে দিলো তার? কোন বউ নিজের স্বামীর এতবড় ক্ষতি করে?

টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে সেখানে তৌসিফ হাজির হলো। পৌষের ভেজা চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে হঠাৎই বললো,
“চুল ঝাড়বে না এরপর থেকে। ভেঙে যাবে।”
“আমার ঠ্যাটা মার্কা চুল। জীবনেও ভাঙবে না।”
“এত কথা বলো তুমি পৌষরাত। উত্তর ঠোঁটের আগায় থাকে সবসময়।”
“আপনার মেহমান এলো না?”
“আপা এসেছে সেই কখন। রুমে আছে। তুমি যাবে ডেকে আনতে?”
“না ভাই। মাফও চাই দোয়াও চাই। আপনার বোন ভাবী নিয়ে খুবই বাজে অভিজ্ঞতা আমার।”
তৌসিফ টেবিলে একবার নজর বুলিয়ে নিলো। পৌষকে জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি কোনটা রেঁধেছ?”
“ভাত বাদে সব।”
“কিহ!”
টেবিলে ছয় সাত পদ খাবার রাখা সাথে ভর্তা রাখা কয়েক পদের। এই সব ও একা কেন করেছে? তৌসিফ না করেছিলো। বারণ শুনলো না এই মেয়ে। কিছুটা রাগত স্বরে তৌসিফ বললো,
“না করেছিলাম।”
“সারাক্ষণ ভালো লাগে না আমার ল্যাটকা মেরে পরে থাকতে। কাজ করতে ভালো লাগে।”
“পৌষ?”
পেছন থেকে নারী কণ্ঠের ডাক আসতেই পৌষ ঘুরে তাকালো। সুন্দর দেখতে এক নারী দাঁড়িয়ে। পোশাক আর চেহারার অদ্ভুত এক মিল দেখেই পৌষ বুঝে নিলো এটা তায়েফা। এগিয়ে এসে হাসিমুখে সালাম জানালো,
“আসসালামু আলাইকুম আপা। ভালো আছেন আপনি?”

“ওয়ালাইকুমস সালাম বাচ্চা। কেমন আছিস তুই? কত বড় হয়ে গিয়েছিস। সেই ছোট্ট পৌষটাকে দেখেছিলাম।”
তায়েফা জড়িয়ে নিলো পৌষকে। পৌষের কায়া সামান্য কেঁপে ওঠে। ও ঠাই দাঁড়িয়ে রয়। একটা নরম বুক তাকে জায়গা দিয়েছে। তার মাথায় হাত রেখে হাসি হাসি গলায় কি কি জানি বলছে। সেসব পৌষের কানে ঢুকছে না। পৌষ নিজেও দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। বুকের ভেতর তখন অদ্ভুত এক অপরিচিত অনুভূতি। পৌষ তার নাম জানে না। শুধু জানে তাকে কেউ এভাবে আগলে জড়িয়ে ধরে না। কেউ না। কখনোই না। ছোট বোন গুলোকে পৌষ জড়িয়ে রাখে বুকের মাঝে। পৌষকে জড়িয়ে রাখার মানুষ নেই। অপরিচিত অনুভূতির সাগরে হাবুডুবু খাওয়া পৌষ ডেকে ওঠে হঠাৎ,

“আপা।”
“হ্যাঁ, বাচ্চা বল। আপা তোকে দেখার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছি। আমার তুসুটা বিয়েতে রাজি হয়েছে। মেয়ে যে চাঁদের টুকরো তা তো আমি আগের থেকেই জানি।”
পৌষ ডাকলো তো ঠিক কিন্তু কি বলবে জানে না। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
“ঠিক মতো আসতে পেরেছেন?”
“তা আবার না। আমার তুসুর বউ দেখতে এলাম। ঠিক মতো না আসলে হয়।”
তৌসিফ পৌষের সূক্ষ্ম পরিবর্তন দেখে একটু অবাক হয়। মেয়েটা আদর পাগল বিষয়টা বুঝতেও তার জহুরি দৃষ্টির সময় লাগে না। পৃথিবীর এক অদ্ভুত অলিখিত নিয়ম এটা। যোগ্যরা বঞ্চিত হয় যদি বটগাছের মতো মাথার উপর মা-বাবা নামক ছায়াটা না থাকে।

তয়েফা পৌষকে নিজের পাশে নিয়ে বসেছে। খেতে বসেই যেন চমকেছে। রান্নাটা বুয়াদের করা নয় বুঝতেও বেগ পেতে হয় নি তার। তৌসিফের দিকে গরম চোখে তাকিয়ে ধমকালো,
“তুই ওকে দিয়ে কেন বাঁধিয়েছিস? দুই দিন হয়েছে বিয়ের? এখনও কাজে লাগিয়ে দিয়েছিস?”
“আমার রান্না করতে ভালো লাগে আপা। নিজ থেকেই করেছি।”
নিচু স্বরে উত্তর করলো পৌষ। সন্তুষ্ট চিত্তে তৌসিফ তাকিয়ে রইলো। ওর খাওয়া দেখে তায়েফা খুশি হলেও কিছু বললো না। সেই ছোট বেলার তৌসিফ যেন খাচ্ছে। একেবারে পেট পুরে খেতো। মায়ের খুব কাছের ছিলো ও। মা চলে যাওয়ার পর তৌসিফটা একেবারেই একা হয়ে গেলো। চাইলেও তো ভাইয়ের সাথে থাকতে পারে না তায়েফা। বোনদের সংসার হলে আর বাবার বাড়ী ফেরা যায় না। এখনও স্বামী, সন্তান রেখে এসেছে। খেতে খেতে তৌসিফ বললো,

“বিকেলে তিশা আর তাহিয়া আসবে আপা।”
“কথা হয়েছে। তোর সাথে কথা আছে তুসু। তুহিনকে ডেকে আনবি।”
খাওয়া রেখে পৌষ কান খাড়া করলো। কোথায় তুহিন? কোথা থেকেই বা আনবে ওকে? তৌসিফ ছোট্ট করে ‘হুঁ’ বাদে আরকিছুই বললো না। পৌষ চিন্তিত হয়ে রইলো। শাখী খালার কথা মনে পরছে বারবার। চোখের সামনে ওনার ছেলের লাশ দেখে এলো পৌষ। ভাবলেই গা কাটা দিয়ে ওঠে কেমন।
ফোনটাও হাতে নেই যে কাউকে ফোন দিয়ে কিছু জানবে। তখন রাগে শোকে ফোন রেখে আসাটা উচিত হয়নি। মনে মনে ধ্যাত বলে পৌষ উঠে গেলো প্লেট হাতে নিয়ে। তায়েফা ওকে যেতে দেখেই গমগমে গলায় বললো,

“কিরে, পৌষ তুমি কি খেলি?”
পৌষ কিছু বলার আগেই তৌসিফ খেতে খেতে বললো,
“দিনে রোজা রাখে ও আপা। রাত হলেই পেটের ইঁদুর বাদর চু চু করে ওর।”
মজার ছলে বলা কথাটায় তায়েফা ধমকালো। পানির গ্লাস নিতে নিতে বললো,
“শরীরে হাড় বাদে কিছুই নেই মেয়েটার। ওভাবে খেলে হবে?”
প্লেট রেখে ডালের বাটি নিয়ে আসতেই কথাটা পৌষের কানে ঢুকলো। আগে-পরে কিছু না শুনেই রেগে গেলো হঠাৎ। মাত্রই তো তায়েফা আপাকে ভালো ভেবেছিলো অথচ দেখো অবস্থা, ঘুরেফিরে একই দশা। নজর এদের শরীরেই যেতে হবে। হাড় কি তোর ভাই দেখে বিয়ে করে নি? এতই শখ তাহলে বোটকা দেখে বিয়ে করাতি। কে বলেছিলো হাড্ডি ওয়ালা পৌষকে বিয়ে করতে? রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ডালের বাটি নিয়ে চলে গেলো ও। বিরবির করে বললো,

“ডাল খাওয়াব নে ভালো করে একদম। আমার হাতের রান্না খেয়ে আমকেই হাড্ডি বলে। সবগুলো বোন এক পদের। আজ নাকি বাকি দুই বিচ্ছু আসবে। একদম দেখিয়ে দিব পৌষ কি জিনিস।”
রাগে গজগজ করা পৌষ বুয়াকে দেখে বললো,
“খালা খাবার বেড়ে দিচ্ছি। নিয়ে একটু পলক আপুকে দিয়ে আসবেন।”
বুয়ার দৃষ্টিতে চমকানো ভাব কিন্তু মুখের উপর পৌষকে না করার সাধ্য তার নেই। পৌষ সুন্দর করে সাজিয়ে খাবার বাড়লো। বুয়ার হাতে দিয়ে পাঠাবে তখনই তৌসিফ এসেছে এদিকটায়। এমনি সময় না আসলেও বউ আসার পর থেকে সে আসে কারণ তার বউ রান্নাঘরেই থাকছে বেশি। বুয়ার হাতে ঢাকা খাবার দেখেই ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো,

“কি নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
“ছোট মামার ফ্লাটে দিতে যাচ্ছি।”
শক্ত চোয়ালে তৌসিফ বললো,
“রাখো। লাগবে না।”
“কেন লাগবে না। একশত বার লাগবে। খালা আপনি দিয়ে আসুন।”
পৌষ খিটমিট করে ওঠলো। তৌসিফ কড়া চোখে তাকাতেই বুয়া খাবার গুলো রেখে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। পৌষের রাগে দুঃখে গান গাইতে মন চাইলো। এমন উদ্ভটতম সময় প্রায়ই তার গান গাইতে মন চায়। হাজার চাইলেও গান থামাতে পারে না। কি গান গাওয়া যাবে ভাবতে ভাবতে পৌষ নিজেই খাবার গুলো হাতে নিলো। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ই আচমকা তৌসিফ পেছন থেকে ওর কনুই চেপে ধরলো। রাগে হিসহিসিয়ে কানের কাছে বললো,

“বাড়াবাড়ি করবে না একদম।”
“বাড়াবাড়ি আমি করছি? আপু কি আজ রান্না করতে পারবে? ভাইয়াও তো বাসায় নেই আর… ”
ওকে থামিয়ে তৌসিফ ধমকে বললো,
“আর ভাবার দায়িত্ব তোমার না।”
” মনুষ্যত্ব নেই আপনার।”
“পৌষরাত!”
নিজের নামটা এত জোরে শুনে বুকটা লাফিয়ে উঠলেও বাইরে থেকে পৌষ কঠোর ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। তার স্বভাবই এটা। বারংবার ভেতর ভেঙে চুরমার হওয়া মানুষ গুলো এক সময় কঠিন হয়ে যায়। তারা অবশ্য কঠিন হয় না। তাদের কঠিন বানিয়ে দেওয়া হয়। কথা দ্বারা হৃদয়ের কোমলতম স্থানটাকে এমনভাবে ঝালাই দেওয়া হয় যে সেই কঠিন স্তর ভেঙে কেউ তাদের বুকের ত্রিকোণাকার নরম স্থানটাকে স্পর্শই করতে পারে না। ছুঁয়ে দিতে পারে না অন্তঃপট।

শক্ত পৌষরাত কনুই ছাড়িয়ে যেতে নিতেই খাবার গুলো আচমকা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো। তৌসিফ নিজে ফেলেছে সেগুলো। পৌষ এই দফায় যেন হতবুদ্ধ হয়ে গেলো। একজনকে মানুষকে খাবার দিবে দেখে সেই খাবার এভাবে ফেলে দিতে হবে? খাবারের মূল্য এখানে এত নগন্য? কই, পৌষতো জানতো না। পৌষতো জানতো খাবার খুব দামী একটা জিনিস। সহজে তো খাবার পাওয়া যায় না। ছোট থেকেই খাবার সে সহজে পায় নি। হেমু ভাই না থাকলে তো দিনে খাবারই পেতো না। সেই ছোট থেকে নিয়ম করে সকালে হেমন্ত জোর করতো বিধায় সকালে খাবারের অভ্যাস তার। দুপুরে তো বাসায় ভাই থাকতো না অগত্যা কতশত দুপুর পৌষ না খেয়ে কাটিয়ে দিলো। পাতিল ধরতে তো মানা, তাহলে পৌষ স্কুল থেকে এসে খাবেটা কি? চাচি তো ঘুমিয়ে থাকতো। সেঝ চাচি তো ছোট থেকেই দেখতে পারতো না। বড় চাচি ঘুমিয়ে থাকলে তো ডাকাও নিষেধ। কত দামী খাবার, খাবারের ডোলায় তালা ঝুলানো থাকতো।

ফ্রিজটাও তালা দিয়ে চাবি থাকতো দুই চাচির কাছে। ছোট চাচা তো বিয়েই করে নি তখন। ছোট পৌষের সরকারি স্কুল ছুটি দিতো দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর। তার খাবারটা টেবিলে রাখলেই তো হতো কিন্তু কেউ রাখতো না। রাখার প্রয়োজনই মনে করতো না। করার তো কথা ছিলো, পৌষটাতো মানুষ ছিলো। তার ক্ষুধা লাগাটাও তো স্বাভাবিক ছিলো। সেই ছোট থেকে দুপুরে না খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেলো। শুক্রবার দুপুরে হেমন্ত নিয়ে বসতো তাই তো খাওয়া হতো কিন্তু ছয়দিন না খেয়ে সাত দিনের দিন পাকস্থলী অভ্যাস ছাড়তে চাইতো না। পৌষ কতবার চাইতো এক শুক্রবারেই বাকি ছয়দিনের খাবার গিলে নিতে কিন্তু হতো না।

পাকস্থলী বেইমানী করতো। খেতেই পারত না। ছোট বেলায় উট হওয়ার ইচ্ছে ছিলো পৌষের কারণ উট পানি জমিয়ে রাখতে পারে, পৌষও চাইতো খাবার জমিয়ে রাখতে কিন্তু তা কখনোই সম্ভব হয় নি বরং ধীরে ধীরে খাওয়া ভুলেছে পৌষ। কলেজে উঠতে উঠতে সকালের নাস্তা ছুটেছে। চা ছাড়া চলে না অথচ দুধ বেশি যায় বলে চাচি খিটমিট করতো। অগত্যা ইনি, মিনির খাওয়া শেষে পাতিলে বেঁচে যাওয়া দুধটুকু ছোট চাচি পৌষকে দিয়ে দিতো। তাতে পানি দিয়ে অনায়াসে পাতলা চা পৌষ খেয়ে নিতো। ধীরে ধীরে সময় গড়ালো। শরীর বাড়লো অথচ ঘাটতি রয়ে গেলো কতকিছুর। বাড়িতে রাতে হেমন্ত ফিরতেই রোজ রাতে খাওয়া হতো। আধ রাতে ভাইয়ের কাছে বায়না ধরতো। সেই থেকেই তো গলাটা সকাল থেকে গিলতে চায় না আর রাত হলেই হুর হুর করে ক্ষুধা বেড়ে যায়। তখন না খেয়ে থাকাটা দায় হয়ে যায়।

এই এত দামী খাবার কি না চোখের সামনে মেঝেতে পড়ে আছে। পৌষ চুপচাপ সেগুলো তুলতে লাগলো। তৌসিফ এবারেও ধমক দিলো,
“বুয়া করবে। ওঠো। পৌষরাত, কথা শুনছো না তুমি। আপা বাড়িতে, আমার কণ্ঠ উঁচু করতে বাধ্য করো না।”
পৌষ মুখটা হাসলো। মুখ উঁচু করতেই তৌসিফ থতমত খেয়ে গেলো। সরল দেখতে মুখটা হাসছে। এই মেয়েটা মায়াবী চাইলেও কিছু বলা যায় না। পৌষ ভাতের দানা গুলো তুলতে তুলতে বললো,
“আমি তুলে নিচ্ছি। খালা মুছে দিবে নে।”
কিছুতো ছিলো, তৌসিফের কিছুতো হলো। ও নিজের পায়ে ভর দিয়ে বসে বাটিগুলো তুললো। পৌষ হাসতে হাসতে বললো,

“আরেকটা ধমক দিলেই থেমে যেতাম। এভাবে খাবার ফেলে কেউ?”
তৌসিফের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তার মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে। ভুল হয়েছে অনুভূতি তার সহজে হয় না। অপরিচিত অনুভূতি নিয়ে দ্বিধায় ভুগলো তৌসিফ। পৌষ সব তুলে রাখতে রাখতে বললো,
“আপনি যান। আমি গুছিয়ে রেখে আসছি।”
“ওগুলো বুয়াকে..”
“না থাকুক। আমি রাতে খাব।”
“পাগল হয়েছো তুমি? এগুলো খাবে কেন? বুয়া কুকুরে দিয়ে দিবে।”
“আমি তার থেকে বিশেষ কেউ নই।”

তৌসিফের বুঝতে সময় লাগলো। পৌষ বেরিয়ে গিয়েছে। এই মেয়ে মাত্রই কি বললো ভাবতেই তৌসিফ চোখ বুজলো। জোরে বুয়াকে ডেকে পরিষ্কার করতে বলে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। তায়েফা তখন ভাতঘুমে। তৌসিফ ভেবেছে পৌষ বোধহয় রুমে কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে পৌষ বাইরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাচ্ছে। দ্রুত পা ফেলে কোন বাক্যব্যয় না করে ওকে নিয়ে সোজা রুমে এসে দরজা আটকে দিলো তৌসিফ। কি হয়েছে বুঝার আগেই তৌসিফ ওর হাত ধরে বিছানায় বসালো। গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

“কোথায় যাচ্ছিলে?”
“আপুকে দেখতে।”
“ওর সাথে মিশবে না।”
“কিন্তু কেন? কি সমস্যা মিশলে?”
নিজেকে সামলে তৌসিফ শুধু বললো,
“কারণ আমি না বলেছি।”
দাঁড়িয়ে গেলো পৌষ। হাত মুঠ করে চোয়াল শক্ত করে বললো,
“কেন যাব না? একটা মানুষ সকাল থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিলো। মানুষ হিসেবে তাকে দেখতে যেতেই পারি। সে ভালো না তাহলে কে ভালো? আপনার বোনেরা যারা কিনা নিজে মেয়ে হয়ে আরেক মেয়েকে অসম্মান করে? ভাইয়ের বউয়ের শরীরে হাড্ডি না গোস্ত তা দেখে? তারা ভালো? আপনার বোনকে তো আমি…”
আচমকা শক্ত হাতটা নরম ভাবে ওর চোয়াল চেপে ধরলো। একটু চাপ দিয়ে দাঁতের পাটি আলাদা করে বললো,

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২২

“দাঁত চেপে কথা বলে না হানি।”
পৌষ জোরে জোরে শ্বাস টানলো। নিজেকে ছাড়িয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলো। এলোমেলো দৃষ্টি দিলো এদিক ওদিক। আস্তে করে বললো,
“সম্ভব হবে না।”
তৌসিফ না বুঝেই বললো,
“কি সম্ভব হবে না?”
“আপনার সাথে সংসার। কিছুতেই হবে না। দুইয়ে দুইয়ে চার না কোন সংখ্যাই মিলছে না। আমি কিছুতেই থাকতে পারছি না।”
কথাগুলো এক নাগাড়ে বললো পৌষ। তৌসিফ তখন আগুন চোখে তাকিয়ে ওর দিকে।

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here