প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১
ফিজা সিদ্দিকী
বিছানা জুড়ে তাজা রক্তের ছোপ দাগ দেখে আঁতকে ওঠে তুর্জয়। রক্তের দাগ যেভাবে বিশ্রী ভঙ্গিতে লেপ্টে রয়েছে চাদরের সাথে, ঘটনার প্রবাহ জানতে আর বাকি থাকে না তার। হাতে থাকা ভারী ব্যাগটা ধপাস করে কখন যে মেঝেতে পড়ে গেল, খেয়াল নেই। মাথার মধ্যে ভনভন করে ঘুরছে বেশ কিছু অযাচিত দৃশ্য, বিশ্রী কল্পনা।
মাস খানেক আগেই পরিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে তাদের। বিয়েটা যে শুধুমাত্র পরিবারের চাপে, এ বিষয়ে নন্দিতাকে সাফ সাফ জানিয়েছে তুর্জয়। আর সেদিন থেকেই অদৃশ্য এক সীমারেখা তাদের মাঝে বিশাল এক দেয়াল তুলে রেখেছে। একই ছাদের তলায়, একই বিছানায় থাকলেও দুজনের মাঝে দৈত্যাকারে দাঁড়িয়ে বিস্তর এক সীমারেখা। যা লঙ্ঘন করতে নারাজ তুর্জয়। নন্দিতারও যে এ বিষয়ে খুব একটা আপত্তি প্রকাশ করেছে এমনটা নয়।
কর্মসূত্রে বাড়ি থেকে বেশ দূরে একাকীত্ব তার জীবনযাপন। বাড়ন্ত বয়স্ক মায়ের এ নিয়ে ছিলো ঢের চিন্তা। তাইতো একদিন হুট করে অসুস্থতার বাহানায় তাকে বাড়িতে ডেকে একপ্রকার জোর করেই আইনিভাবে তার গলায় গছিয়ে দেয় এক মেয়েকে। ভারী ভারী চোখের পাতা ফেলে মেয়েটা শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল তাকে।
বিয়ের দুইদিনের মাথায় জানতে পারে মেয়েটার নাম নন্দিতা। তাদেরই উপরতলায় নতুন ভাড়াটিয়া হয়ে উঠেছিল তারা স্বপরিবারে। আকস্মিক বাস দুর্ঘটনায় বাবা মাকে একই সাথে হারিয়ে তার শুন্য দুনিয়ার একমাত্র আশ্রয় হন তুহিনা বেগম। চঞ্চল স্বভাবের মিষ্টভাষী মেয়েটাকে বেশ পছন্দ করতেন তিনি। সে থেকেই এক স্নেহাতুর মাতৃসুলভ টান জন্মে ওঠে তার নন্দিতার প্রতি। চার কক্ষের দ্বিতল বাড়ীতে থাকার মত মানুষ বলতে তুহিনা বেগম ও আশরাফ সাহেব। তাদের দুই ছেলের মধ্যে বড়ো তুর্জয়, পেশায় একজন উকিল। যার ধ্যান জ্ঞ্যান সবটুকু কাজের প্রতি। এ নিয়ে বাবা মায়ের যতো অভিযোগ থাকুক না কেন, কোনো কথাই ধোপে টেকে না তার কাছে। যুক্তি তর্কের মারপ্যাঁচ জানে কিনা!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ছোটো ছেলে স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডনে পড়াশোনা করতে গিয়ে সেখানেই সংসার গড়ে সেটেল্ড। নিয়মিত ভিডিও কলে কথা হলেও মনের ভেতরের হাহাকার আর মেটে কই?
দুই ছেলে থেকেও না থাকার যে একাকিত্ব, সেই তপ্ত খরখরে খাঁ খাঁ করা হৃদয়ের জমিনে ঝমঝমে বর্ষা হয়ে ধরা দেয় নন্দিতা। সর্বক্ষণ মুখে লেপ্টে থাকা হাসির ঝলকে তাদের দুজনকে প্রাঞ্চল করে রেখেছিল সবটা দিয়ে। তাইতো সর্বহারা মেয়েটাকে যেন তেন ভাবে ফেলে দিতে পারেননি তিনি। বরং পাকাপাকিভাবে তার পরিবারের একজন করে বেঁধে দিয়েছেন তুর্জয়ের সাথে। তার বিশ্বাস, বিপরীতমুখী এই দুইয়ের সংসার খুব একটা মন্দ জমবে না।
ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ ভেসে আসছে। তুর্জয় সন্দিহান কদমে সেদিকে এগিয়ে গেল। বাইরে থেকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো ভেতরে কি শুধু নন্দিতা নাকি তার সাথে অন্য কেউও আছে। কিন্তু অনবরত পানির শব্দে কিছুই ঠাহর করা গেল না। আচমকাই তুর্জয়ের স্বামীসুলভ মন জেগে উঠলো। চারিদিকের কোনকিছুই এলোমেলো নেই, তবুও কেন যেন মন তার কু ডাকলো। তবে কি তার এমন দূরত্বে নন্দিতা অন্য কারোর সাথে! নাহ এসব ভাবতেই পুরুষালী মন তার শক্ত হয়ে উঠল। অদম্য এক রাগ, জেদ চেপে ধরলো শরীরে। অতঃপর ওয়াশরুমের দরজার সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো নন্দিতার।
ভেজা শরীরে এলোমেলোভাবে প্যাঁচানো শাড়ি। এই প্রথম নন্দিতা শাড়ি পরেছে আজ। দরজা খুলতেই আচমকা সামনে দাঁড়ানো তুর্জয়কে দেখে বেশ খানিকটা চমকে ওঠে সে। তবে মনে মনে বেশ খুশিই হয়। রোজ লেট করে বাড়ি ফেরা মানুষটা যদি কোনোদিন সময়ের আগে বাড়ি ফেরে, তবে ঘরের প্রতি কিংবা ঘরে থাকা মানুষের প্রতি তার খানিকটা টান তো জন্মেছে। এই টান যদি ধীরে ধীরে ভালোবাসায় রূপ নেয়, ক্ষতি কি?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি করে শাড়ি পরার বৃথা চেষ্টা চালাতে চালাতে তুর্জয়কে উদ্দেশ্য করে নন্দিতা বলল,
“মিস্টার সাইলেন্সারের কি আজ বউয়ের কথা বেশি বেশি মনে পড়ছিল নাকি?”
নন্দিতার মুখে এই নাম শুনে বরাবরের মতোই বিরক্ত হলো তুর্জয়। তবুও মুখে কিছু প্রকাশ না করে আগের মতোই চুপ থাকলো সে। তাকে নিরুত্তর দেখে খুব বেশি অবাক হলো না নন্দিতা। এই গম্ভীর, নিরুত্তর মানুষটার ব্যবহারে সে অভ্যস্ত। তাই নিজ উদ্যোগে আবারও বলে উঠলো,
“ইশ, ভাবলাম শাওয়ার থেকে বের হয়ে একটা ভিডিও বানাবো। কিন্তু আপনি যখন এসে গেছেন, আসুন তো একসাথে একটা ভিডিও বানাই। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যাব তাহলে। হ্যাশট্যাগ দেব, মিস্টার সাইলেন্সার উইথ ননস্টপ নন্দিতা।”
তুর্জয় একপলক উপর থেকে নীচ অবদি নন্দিতাকে দেখলো। কোমরের নীচ অবদি নেমে শাড়ি। উন্মুক্ত পিঠ সহ কোমর। আঁচলটা গোছানোর চেষ্টা করতে করতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে প্যাঁচিয়ে কাঁধে তুলে দেওয়া। যার জন্য উন্মুক্ত হালকা মেদযুক্ত পেট। কুঁচিটাও কোনরকম গুঁজে দিয়েছে মনে হয়। সদ্য গোসল থেকে বের হওয়ায় ভেজা লম্বা চুল হতে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়া পানিতে কোমরের কাছের সবটুকু শাড়ি ভিজে একাকার। পিঠে জমে বিন্দু বিন্দু জলকনা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে অবদেনময়ী লাগার জন্য যা যা প্রয়োজন, সবটাই আজ তার শরীর জুড়ে বিদ্যমান। তুর্জয়ের রাগের বাঁধ ভাঙলো এবার নন্দিতার এই অবস্থায় ভিডিও বানানোর কথা শুনে। তাও নাকি আবার সোশাল মিডিয়ায় আপলোড দেবে!
একটানে বিছানার চাদর নীচে ছুঁড়ে ফেলে নন্দিতাকে টান দিয়ে ফেলে দেয় বিছানায়। আচমকা আক্রমণে ভয়ে, আতঙ্কে আঁতকে ওঠে নন্দিতা। প্রচণ্ড ব্যথায় ক্ষীণ ব্যাথাতুর শব্দ করে ওঠে। কিন্তু তুর্জয়ের কান অবদি এই শব্দ পৌঁছলো না। কেউ যেন খুব যত্ন করে প্রশ্ন তুলেছে তার পুরুষত্বে। উপরের কালো ওভারকোর্টের বোতামটা খুলে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দূরে। অতঃপর বাঘের মতো তেড়ে গিয়ে ডানহাতে চেপে ধরে নন্দিতার চিবুক। ব্যথায় চোখ বেয়ে পানি গড়ালেও ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা টেনে নন্দিতা বলে ওঠে,
“আজ কি ওই ধরনের চকলেট খেয়ে এসেছেন নাকি? এতো কন্ট্রোললেস যে! একটু তো কন্ট্রোল করুন ডিয়ার হাসবেন্ড।”
“আমার কন্ট্রোল পাওয়ার তো প্রচুর। কিন্তু আমার বিয়ে করা বউ আমারই বিছানায় অন্য কারোর সাথে নিজের চাহিদা পূরণ করবে, স্বামী হিসেবে তাকেও তো দেখাতে হয় যে তার স্বামী বাইরের পুরুষের থেকে একটু বেশীই তৃপ্তি দিতে পারে তাকে।”
“আপনার পক্ষে এসব সম্ভব নয়, সো লিভ ইট। মাঝে মাঝে তো সন্দেহ হয় আমার, আপনি আবার ছেলেদের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করেন না তো?”
“মাইন্ড ইওর ওয়ার্ডস।”
“দেন প্রুভ ইট”
তুর্জয় কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই পায়ের কাছে তরল কিছু একটা অনুভব করে নন্দিতাকে ছেড়ে পায়ের দিকে তাকায়। নন্দিতার পা বেয়ে তাজা রক্ত ভেসে এসে মেঝেতে পরছে টপ টপ করে। ভয় পায় তুর্জয়। ভয়াতুর চোখে নন্দিতার দিকে তাকাতেই হো হো করে হেসে ওঠে সে। এখনও তার চোখের কোল চিকচিক করছে। অতঃপর শরীর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
“তেমন কিছু না। সামান্য পা কেটেছে।”
তুর্জয় এবার অবাক না হয়ে পারে না। এই মেয়ে এতো হাসে কিভাবে তার জানা নেই। ব্যথা পেলেও যে কোনো মানুষ এভাবে হাসতে পারে তার জানা ছিল না। মাঝে মাঝে তার নিজেকেই পাগল মনে হয় এই মেয়ের ভাবমূর্তি বুঝতে গিয়ে।
বাম পায়ের দিকে শাড়ি খানিকটা উপরের দিকে তুলতেই স্পষ্ট হলো রক্তে ভেজা সাদা ব্যান্ডেজের কাপড়। হাঁটুর খানিকটা নীচে প্যাঁচানো ব্যান্ডেজটা। ক্ষত থেকে এতো পরিমাণ রক্ত বের হচ্ছে যে ব্যান্ডেজ ভিজে চুঁইয়ে পড়ছে তা মেঝেতে। এদিকে নন্দিতার ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন নেই। আগের মতই সে শরীর কাঁপিয়ে হেসে যাচ্ছে।
তুর্জয় পায়ের কাছ থেকে উঠে নন্দিতার মাথার পিছন দিকে হাত দিয়ে তাকে ঠিক করে উঠিয়ে বসালো বিছানায়। পা দুটো টানটান করে মেলে দুটো বালিশ ঠেস দিয়ে রাখলো নন্দিতার পিঠের কাছে। নন্দিতার মুখে এখনও সেই আগের হাসি লেপ্টে। তুর্জয়কে এভাবে চিন্তিত ভঙ্গিতে দেখে তার বেশ মজাই লাগছে। তাই রসিকতার সুরে বললো,
“মিস্টার হাসবেন্ড তাহলে হেরে গেলেন। প্রমাণ হয়ে গেল আপনি ওই ছেলেদের প্রতিই আসক্ত।”
নন্দিতার দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তুর্জয় দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,
“ব্যান্ডেজটা জাস্ট করে নিতে দিন। এরপর আপনি যেন নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগটুকুও না পান, আই উইল মেক শিওর মিসেস আহসান।”