প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৯

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৯
ফিজা সিদ্দিকী

চাতক পাখির মতো দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন তুহিনা বেগম। আজ কতোগুলো মাস পর এই ঘরটা কারোর হাসির গুঞ্জনে হইহই করে উঠবে। একাকিত্বে অভ্যস্ত দুটো মানুষকে খুব বাজে অভ্যাসে ফেলে দিয়েছিল মেয়েটা। কথায় কথায় খিলখিল করে হেসে ওঠা, খোশমেজাজে তাদের যত্ন নেওয়া, একটু এডিট সেদিক হলেই কোমরে হাত দিয়ে তার শাসন, কখনও টের পেতে দেয়নি তাদের সাথে না থাকা কোনো সম্পর্কের কথা। অথচ সময়ের ফেরে আত্মিক সেই সম্পর্ক থেকে আজ গভীর সম্পর্কে আবদ্ধ তারা।

ছেলের চেয়েও ছেলের বউয়ের প্রতি গভীর টান তার। মেয়েটা ভীষণ রকম মিশুকে কিনা! অল্প সময়েই যে কারোর মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার বেহায়া মন লাজ লজ্জা ভুলে অপেক্ষা করছে আরও কিছু দেখার। কাঠখোট্টা ছেলের জীবনে নারী সঙ্গের পাকাপাকি উপস্থিতি কী ঘটেছে? তুর্জয় কি সবটুকু দিয়ে আপন করে নিয়েছে নন্দিতাকে? এই ভাবনা তাকে আরও বেশি উদগ্রীব করে তুলছে। তিনি মন থেকে চান ইট পাথরের যান্ত্রিক শহরে থাকা তার যন্ত্রমানব ছেলেটা আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন পাক। আর তাইতো হুট করেই নিয়েছিলেন সেই সিদ্ধান্ত। তার সিদ্ধান্ত কতটুকু সঠিক, সেটুকুই দেখার পালা এখন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

খাবার টেবিলে এলাহী আয়োজন দেখে চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম নন্দিতার। দুই হাত কোমরে রেখে বাঁকা চোখে তাকায় তুহিনা বেগমের দিকে। রাগ রাগ ভাব নিয়ে বলে,
“বারণ করেছিলাম না এতকিছু করতে? নিজেও এই গরমে রান্না ঘরে পুড়ে এসব রান্না করেছ, আবার আব্বাকেও এই শরীর নিয়ে সকালে এতগুলো বাজার করিয়েছ।”
তুহিনা বেগম শুকনো একটা ঢোক গিলে চোরাচোখে তাকান নন্দিতার দিকে। অতঃপর গুটিসুটি পায়ে তুর্জয়ের পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলেন,

“দেখেছিস তো তুই। ছেলের বউ হতেই কেমন চোটপাট করছে আমার উপর এই মেয়েটা। তুই ওকে ওই বাড়িতে পাঠিয়ে দে তো! আমার শ্বাশুড়ির মত খিটখিটে স্বভাব পেয়েছে একদম। ছেলে বউকে শান্তি মতো রান্না করে খাওয়াবো না তো কাকে খাওয়াবো?”
“একদম নাটক করবে না আম্মা। তোমার শরীরের কী অবস্থা করেছ দেখেছ? দাঁড়াতে পারছ না ঠিকমতো। পা দুটো কাঁপছে। এই অবস্থায় তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতগুলো রান্না করেছ।”
তুহিনা বেগম নন্দিতার দিকে মুখ বাঁকিয়ে বাচ্চাসুলভ কণ্ঠে বলে ছেলেকে অভিযোগ জানানোর ভঙ্গিমায় বলে ওঠেন,
“আমি আমার ছেলেকে রেঁধে বেড়ে খাওয়াচ্ছি, তাতে তোমার কী হ্যা? হিংসে হচ্ছে নাকি? তোমার না খেতে ইচ্ছে হলে খেও না বাপু। একদম আমার ছেলের খাওয়ায় বাঁধা দেবে না। আহ! কেমন শুকিয়ে গেছে দেখো আমার ছেলেটা।”

নন্দিতা দুইহাত বুকে গুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“তোমার ছেলেকে তো খাবার দাবার দিইনা কিছু আমি। ধিরিঙ্গীর মতো ছেলে তো হাওয়া খেয়ে বেঁচে আছে। গায়ের যা জোর, সব তো হাওয়া যোগায় তাকে। একবার ধরলে হয়, তার ইচ্ছে না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ে না।”
নন্দিতার লাগামহীন কথায় শব্দ করে কেশে ওঠে তুর্জয়। ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি ফুটে উঠে তুহিনা বেগমের। তবে তিনি বিষয়টাকে আরও বাজিয়ে দেখতে চান। তাইতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলে ওঠেন,
“তুমি কি আমার ছেলেকে জল্লাদ বলতে চাইছো নাকি? ও তোমাকে মারধর করে? এমন ছেলে না আমার। একদম উল্টা পাল্টা দোষ দেবে না কিন্তু।”

“না না মারবে কেন। তার চেপেচুপে আদর করা মারের চেয়ে কম কিসে? দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড়…..”
তুর্জয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলা বেফাঁস কথার অর্থ মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই কথা থেমে যায় নন্দিতার। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে চটজলদি চেয়ার টেনে বসে পড়ে তুর্জয়ের ডানপাশের চেয়ারে। বিড়বিড় করে বলে,
“মা যেমন, তার ছেলেও তেমন। দুটোকেই লজ্জা শরম দিতে ভুলে গেছে খোদা।”
ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে তুহিনা বেগম রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তুর্জয় সুযোগ বুঝে নন্দিতার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আমি বেশি চেপেচুপে আদর করি তাইনা? আজ শুধু রুমে আসো, নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পর্যন্ত দেব না। বউকে আদরে আদরে অতিষ্ট করে তোলা প্রতিটা বরের নৈতিক কর্তব্য।”
“চুপচাপ খাবারটা গিলুন। আপনার মতো এক মোন ওজনের তাগড়া যুবককে আম্মা কোন নজরে যে শুকিয়ে কাঁটা হতে দেখলো আল্লাহ মালুম। কোনো ভিটামিনের তো অভাব দেখিনা আমি।”
তুর্জয় আগের মতো মুখ নামিয়ে আনলো নন্দিতার কানের কাছে। কানের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“ভিটামিন চুমুর বড্ডো অভাব বউ, জলদি রুমে চলো।”
ভিডিওকলে ধবধবে ফর্সা চামড়ার এক নারীমুখ। ঠোঁটের কোণে লেপ্টে আছে ক্ষীণ হাসি। পাশেই অল্প বিস্তর দেখা যাচ্ছে সুদর্শন এক পুরুষকে। ল্যাপটপে কিছু একটা টাইপ করতে করতে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে ফোনের দিকে। কিছুক্ষণ আগেই তুর্জয় বেরিয়েছে কোথাও। একা একা রুমে বসে না থেকে নন্দিতা তাই শ্বাশুড়ির ঘরে আসতেই ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ অবস্থায় পায় তাকে। সেদিকে উঁকি দিয়ে দেখতেই নজরে পড়ে সেই নারী মুখ।
সুমসৃণ চকচকে ত্বক। একেই বোধহয় আমাদের দেশীয় ভাষায় বলে গ্লাস স্কিন। মুখের কোথাও এক রত্তি পরিমানের দাগ নেই। দুইজোড়া আঁকা ভ্রু। চোখের মণিও আমাদের মত সাধারণ না। বরং আমাদের সাধারণ কালচে মণিতে তাকে মানাতো না সম্ভবত। তার চোখ, মুখের প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা রং যেন একেবারে মেপে মেপে বানানো তার জন্য। একটু হেরফের হলেই মন্দ লাগতো। ফোনের দিকে দৃষ্টি ফেলে সাদা চকচকে মসৃণ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখের সামনে আসা তামাটে রঙের চুলগুলো পিঠের দিকে ফেলে দিয়ে ধীরে কণ্ঠে বললো,

“আপনার হেল্থ ওকে, মা?”
লারার বিদেশী মুখে মা ডাক শুনে কেমন যেন এক শান্তি পান তুহিনা বেগম। মনে হয় বিদেশের মাটিতে থাকা সবাই নিষ্ঠুর, স্বার্থপর হয়না। লারার মতো কিছু মেয়েও আছে। যারা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে সামনের মানুষটাকে মানিয়ে গুছিয়ে নিতে জানে। সবদিক খেয়াল রাখে। অতঃপর খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
“খুব ভালো আছি মা। এক ছেলে বউকে কাছে পেয়ে তোমাদের কথা বেশি করে মনে পড়ছে। কিজানি, মরার আগে তোমাদের দেখা পাবো কিনা কে জানে?”

শেষোক্ত কথাটুকু বলতে গিয়ে কন্ঠ খানিকটা কেঁপে উঠলো তার। অভিমানেরা ভীড় জমালো কণ্ঠনালিতে। এই অভিমান লারার পিছনে বসে থাকা তার নিজের সন্তানের প্রতি। স্বপ্ন, ক্যারিয়ার কী তার কাছে এতো বড় যে বাবা মাকে দেখতেও মন চায়না? নিজের দেশে ফিরতে মন চায়না? দেবে আসা কণ্ঠে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে তিনি বলেন,
“তোমরা ভালো থাকো মা। সবসময় ভালো থাকো। বিদেশী টাকার মুখ দেখে আমার ছেলে বুড়ো মা বাপকে এক নজর দেখে না পর্যন্ত। সেখানে যদি সুখে থাকে, তবে থাক। দেশে ফেরার কথা আমি আর বলবো না তাকে। এ দেশ, এ বাড়ি তো এখন তার পর।”

লারা অসহায় চোখে একবার শাশুড়ির দিকে তাকায় তো একবার পিছনে বসে থাকা স্বামীর দিকে। তাদের মধ্যে চলতে থাকা কথপোকথন যার কানে পৌঁছাচ্ছে না বিন্দু পরিমাণ পর্যন্ত। ল্যাপটপে জরুরি এক কনফারেন্সে ব্যস্ত সে। এমন এক আবেগঘন পরিস্থিতি থেকে তাকে উদ্ধার করতে ছুটে এলো তুরা। বড়ো বড়ো চোখে ফোনের দিকে তাকাতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠা পরিচিত মুখ দেখেই খিলখিল করে হেসে উঠলো সে। মায়ের কোলের মধ্যে শান্তভাবে বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে নরম তুলতুলে দুই ঠোঁটের আদল গলিয়ে বের হলো সুমিষ্ট ধ্বনি।
“দিদু, তুমু আসো না কেন? আই মিস ইউ।”

তুলতুলে নরম দেহের গড়নের নাতনিকে দেখে সকল অভিমান এক পলকেই যেন গলে গেল তুহিনা বেগমের। নাতনিটা তার দেখতে একদম পুতুলের মতো। ভাসা ভাসা চোখে হালকা তামাতে চোখের মণি। কোঁচড়া চুলের তামাটে রং, মখমলি ফর্সা বদনে আদুরে আদুরে ভাব। দুই গালে লেপ্টে থাকা গোলাপী আভা, তুলতুলে গোলাপী দুটো ঠোঁট। বাচ্চাটাকে দেখলেই বুকে টেনে নিতে চাওয়ার জন্য আকুপাকু করে মন। ঝাপসা চোখে সেদিকে তাকিয়ে তুহিনা বেগম বলেন,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৮

“আমার তুলতুলা তুলা কেমন আছে?”
“উফ্ দিদু, ইটস তুলা। নট তুত্তুলা তুলা।”
তুলার বিরক্তিমাখা মুখের আধো আধো বুলির সাথে কপাল চাপড়ে বিরক্ত প্রকাশ করার ভঙ্গিমায় হেসে ওঠে উপস্থিত সকলে। নন্দিতা খানিকটা কাছে এগিয়ে গিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে তুলাকে। এমন সময় ফোনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে তুলা। আঙুল উঁচিয়ে ফোনের দিকে তাক করে প্রশ্নমাখা কন্ঠে বলে ওঠে,
“এই বিউটিফুল লেডিটা কে দিদু?”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২০