প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২
ফিজা সিদ্দিকী
নন্দিতা শব্দ করে হেসে ফেলে তুর্জয়ের কথা শুনে। হাসতে হাসতেই বলে,
“ডিয়ার হাসবেন্ড, সব কাজ সবার জন্য না। এসব বউপ্রীতি আপনাকে দিয়ে হবে না, আপনি বরং মেল কলিগদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি এনজয় করুন। ইট সুটস ইউ।”
নন্দিতার প্রতিটা হাসির শব্দ যেন তীব্র অপমানের তীরের মত বিঁধছে তুর্জয়ের বুকে। তবুও কিঞ্চিৎ টু শব্দটুকু করলো না সে। বরং বেশ সাবধানী হাতে রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আড়াআড়িভাবে বেশ গভীর একটা ক্ষত হয়েছে বাম পায়ে। হাঁটুর খানিকটা নীচে হওয়া ক্ষতটা আলতো হাতে পরিষ্কার করে দেয় তুর্জয়। অতঃপর ওষুধ লাগিয়ে নতুন একটা গজ কাপড় পেঁচিয়ে দেয়। পুরোটা সময় নন্দিতা ব্যস্ত তার ফোন নিয়ে। তুর্জয় ব্যান্ডেজ করার মাঝে আড়চোখে বেশ কয়েকবার খেয়াল করেছে নন্দিতার দিকে। ঠোঁটে হাসি, হাস্যোজ্বল মুখ, আর আঙুলে চলতে থাকা টাইপিংয়ের গতি তার বুকে জ্বালা ধরানোর জন্য যথেষ্ট। আচমকা পায়ের কাছ থেকে উঠে গিয়ে নন্দিতার হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেললো বিছানার এক কোণে। হকচকায় নন্দিতা। কিছু বলার আগেই তুর্জয় অনেকটা ঝুঁকে পড়ে তার দিকে। ঠিক এতটাই, যেখানে একে অন্যের নিঃশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। শিহরণে শরীর কেঁপে ওঠে তার। লজ্জায় নিভুনিভু হয়ে পড়ে চোখ। নিঃশ্বাসের গতি উত্তাল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তুর্জয় ডানহাতে আলতো করে আঁকড়ে ধরে নন্দিতার কোমর। নিঃশ্বাস আটকে আসে নন্দিতার। মুখ অল্প হাঁ করে থেমে থেমে নিঃশ্বাস টেনে নেয় সে নিজের ভেতর। ডানহাতে আঁকড়ে ধরে তুর্জয়ের কাঁধ। হাতের মুঠোয় পিষ্ট হয় তার শরীরে লেপ্টে থাকা ধবধবে সাদা শার্ট।
তুর্জয় একটানে বসা থেকে শুইয়ে দেয় তাকে বিছানায়। বামহাত এগিয়ে মাথার পিছনের বালিশগুলোকে ঠিক করতে করতে মৃদু কণ্ঠে বলে,
“আই এম সরি”
তুর্জয়কে একইভাবে আঁকড়ে ধরে নন্দিতা ঠোঁট উল্টে বাচ্চাসুলভ কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তার মানে সত্যি সত্যি আপনি ছেলেদের প্রতি…”
তুর্জয়ের আর ধৈর্য রইলো না বাকিটুকু শোনার। তার আগেই ঝট করে সরে এলো সে নন্দিতার থেকে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলে উঠলো,
“সরিটা আপনাকে হার্ট করার জন্য ছিলো।”
নন্দিতা পলকহীন দৃষ্টিতে তাকালো কিয়ৎক্ষণ তুর্জয়ের দিকে। অতঃপর আগের মতোই মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,
“হার্ট তো দুইভাবে করেছেন, কোনটার জন্য সরি?”
টি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে তুর্জয় ভ্রু কুঁচকে তাকালো নন্দিতার দিকে। যেন তার কথার আগামাথা কিছুই বোঝেনি। নন্দিতাও ব্যাপারটা নিয়ে আর খুব বেশি গভীরে না গিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলো,
“বলেছিলাম না, সবাই সবকিছু পারে না। আপনাকে দিয়ে রোম্যান্স পসিবল না, মিস্টার সাইলেন্সার। মেনে নিন।”
“জাস্ট গ্রো আপ। আপনি যখন দুধের শিশু, আমি তখন রোম্যান্সের প্র্যাক্টিকাল ম্যাচ খেলে ফেলেছি। সো ডোন্ট চ্যালেঞ্জ মি। নেভার এভার।”
নন্দিতা এবার আর না হেসে পারে না। শব্দ করে হেসে ওঠে সে। তুর্জয় সেদিকে একপলক তাকিয়ে রাগী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“মিসেস আহসান, শান্ত আছি পছন্দ হচ্ছে না? আমার ওয়াইল্ড রূপ দেখার মতো কোয়ালিটিফুল আপনি না। ট্রাস্ট মি, একটুও ইন্টারেস্ট আসে না।”
চরমে অপমানে বুঁদ হয়েও নন্দিতা হাসলো কেবল। হাসতে হাসতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো কিচেনের উদ্দেশ্যে।
তুর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকলো নন্দিতার দিকে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে দেখা যায়, ততক্ষণই তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর চোখের আড়াল হতেই দুই হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। বড্ডো অস্থির হয়ে ওঠা মনটাকে শান্ত করলো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে। এরপর গায়ের শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে ঢুকে পড়লো ওয়াশরুমে।
খাবারগুলো গরম করে ডাইনিং টেবিলে সবকিছু গুছিয়ে রাখলো নন্দিতা। এরপর ঢুকে পড়লো পাশের স্টাডি রুমে। কিছুক্ষণ আগের হাসিখুশি, উজ্জ্বল ভাবমূর্তির চেহারার বদলে তার মুখে এখন ভর করেছে ফিকে হাসি, তোলপাড় করা এক বিষাদের ঘন কালো ছায়া। কাঁপা হাতে ড্রয়ার থেকে একটা ফটোফ্রেম করে সেদিকে ঠাঁয় তাকিয়ে থাকলো সে। অতঃপর মলিন কণ্ঠে বললো,
“আমাকে হাসতে শেখালে, কষ্ট গিলতে শেখালে, অথচ কষ্ট গিলে হাসতে কিভাবে হয় শেখালে না। আমাকে পারফেক্ট হওয়া শেখালে না। শেখালে না কিভাবে পুরুষ মানুষের মন পেতে হয়। গোটা জীবনটা শুধু হাসতেই শেখালে। হাসি নাকি সব রোগের ওষুধ, এই ওষুধ তবে আমার হতাশার মলম কেন হলোনা? তুমি কি তবে মিথ্যা বলেছিলে মা?”
শাওয়ার শেষে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে তুর্জয়। চোখ ঘুরিয়ে এদিক সেদিকে খোঁজ চালালো কারোর। কিন্তু ঘরের কোথাও সে নেই। খানিকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে কিচেনে উঁকি দিয়েও যখন নন্দিতাকে পেল না আরও খানিকটা উঁকি দিলো স্টাডি রুমের দিকে। দরজার নীচ থেকে ভেসে আসা সাদা আলোতে নিশ্চিত হলো নন্দিতা সেখানেই আছে। তাই ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে নিজের কাপড় বের করার সাথে সাথে নতুন একটা বেডশিট বের করে ফেললো সে। অতঃপর বিছানা গুছিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে পিঠ এলিয়ে দিতেই তার চোখ পড়লো পাশে রাখা নন্দিতার ফোনটার দিকে। তৎক্ষনাৎ পেশাগত ওকালতি ভাব জেগে উঠলো তার মাঝে। দরজার দিকে একপলক নজর বুলিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই যা দেখলো তাতে তার রাগের পরিমাণ আকাশচুম্বি।
নন্দিতার পা কোলে উঠিয়ে ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় তার একটা ছবি তুলেছে নন্দিতা। এরপর সেটাকে ফেসবুকে পোস্ট করে ক্যাপশন দিয়েছে,
“জামাই হলে এমন হওয়া উচিত, নাহলে না হোক। ভুলটা আমি করলেও সে পা ধরে বসে থাকে এভাবে।”
রাগে চিৎকার করে নন্দিতার নাম ধরে ডেকে ওঠে তুর্জয়। স্টাডি টেবিলের ফুলদানির ফুলগুলো চেঞ্জ করছিলো নন্দিতা। আচমকা এমন ডাকে ভয় পেয়ে ফুলদানী হাতেই তড়িঘড়ি দৌড় দেয় সে ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকে বলে ওঠে,
“আপনার পিছে কি বাঘ পড়ছে নাকি সামনে গণ্ডার? এই রাতের বেলায় এভাবে চিল্লাচ্ছেন কেন? উকিল মানুষ কী ম্যানার্সও খেয়ে ফেলেছেন ভাতের সাথে মিশিয়ে?”
তুর্জয় দাঁতে দাঁত চেপে হাতের ফোনটা আছাড় দিতে গিয়েও থেমে যায়। ঠোঁট দুটো গোল করে বেশ জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোনটা আলতো করে ছুঁড়ে দেয় বিছানায়। এরপর বেশ তেড়ে এগিয়ে আসে নন্দিতার দিকে। এতক্ষণে বিপদের আশঙ্কা বেশ আঁচ করতে পেরেছে নন্দিতা। এখন যদি এই লোকটা তার ওই জাঁতার মতো শরীর দিয়ে তাকে চেপে মেরেও ফেলে, খুব বেশি অবাক হবে না সে।
নিজেকে বাঁচাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দুইহাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে অতর্কিতে হাতে থাকা ফুলদানিটা ছেড়ে যায় তার হাত থেকে। নন্দিতা চোখ বড়ো করে তাকায় হাত ফসকে ছেড়ে যাওয়া ফুলদানিটার দিকে। এরপর দুইহাতের তালু দিয়ে মুখ চেপে ধরে মৃদু চিৎকার করে বলে ওঠে,
“আমি কিছু করিনি। আমি নির্দোষ, একদম ইনোসেন্ট।”
ভারী ফুলদানিটা আচমকা এসে আঘাত করে তুর্জয়ের মাথার ডানপাশে। এরপর নীচে পড়ে ভেঙে যায় ছোটো বড়ো বেশ কয়েকটা খন্ডে। আচানক আক্রমণে প্রচণ্ড ব্যথায় টালমাটাল হয়ে মেঝেতে পড়ে যায় তুর্জয়। মেঝেতে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা ফুলদানির বেশ কয়েকটা ভাঙ্গা টুকরো বেপরোয়াভাবে ঢুকে যায় তার পিঠে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে রাগী দৃষ্টিতে তাকায় সে নন্দিতার দিকে। নন্দিতা ততক্ষণে প্রাণ হাতে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই। তুর্জয়ের কাছে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না কোনমতে। বিধায় তাকেই না তুলে আছাড় দেয় ওই ভাঙ্গা টুকরোগুলোর উপর।
কপাল কেটে বেশ অনেকটা রক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। নন্দিতা আর বেশিকিছু না ভেবে বিছানায় ফেলে রাখা তুর্জয়ের সাদা শার্ট এনে চেপে ধরে ক্ষতস্থানে। এবার তুর্জয়ের সত্যিই মন চাইছে এই মেয়েকে তুলে আছাড় দিতে। তার সখের শার্টটাই পেল এভাবে নষ্ট করার জন্য?
পরিস্থিতি বিবেচনা করে আর বেশি কিছু না বলে ক্ষীণ কণ্ঠে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“আপনাকে আমি দেখে নেব। সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরতে দিন শুধু।”
“তাহলে আপনাকে আর ফিরতে হবে না।”
একমাত্র বউয়ের কথা শুনে হাসবে নাকি কাঁদবে তার বিবেচনা না করে তুর্জয় আচমকা নন্দিতার শাড়ির আঁচল টেনে সেটা চেপে ধরলো ক্ষতস্থানে। নন্দিতা আলতো চিৎকার দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে ছড়িয়ে নিলো শাড়িটা। অতঃপর খানিকটা দূরে সরে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“কি যুগ এলো রে বাবা, প্রাচীনযুগের দ্রৌপদীর মতো কলিযুগে নন্দিতার বস্ত্র হরণ করছে তার স্বামী। ছিঃ ছিঃ!”
“আর একটা বাজে কথা না বলে চেঞ্জ করে আসুন, হসপিটালে যেতে হবে আমাদের।”
তুর্জয়ের অবস্থা বুঝে নিজেও আর কথা বাড়ালো না নন্দিতা। বরং চটজলদি একটা চুড়িদার নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে, চেঞ্জ করতে। এই ফাঁকে মাথায় হাত চেপে ধরে কোনরকমে নিজের ফোনটা হাতের নাগালে আনলো তুর্জয়। অতঃপর এসিস্ট্যান্ট আনসারকে ফোন করে মৃদু কন্ঠে বলল,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১
“গাড়ি নিয়ে দ্রুত এসো। হসপিটালে যেতে হবে।”
ফোন কানে চেপে বাধ্য ছেলের মতো গাড়ির দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে আনসার প্রশ্ন করলো,
“কেন স্যার? কার কি হয়েছে?”
তুর্জয় মলিন কণ্ঠে বলল,
“বউ মেরেছে”