প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২০

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২০
ফিজা সিদ্দিকী

তুলার মতোই নরম তুলতুলে বাচ্চাটাকে কোলে নিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় নন্দিতা। এতো নরম কারোর শরীর হতে পারে বুঝি? তার নরম হাতের চাপেই যেন দেবে যাচ্ছে তুলার শরীরের মাংসল অংশ। ধবধবে ফর্সা চামড়ার টান পড়ায় লালচে হয়ে পড়ছে সাথে সাথেই। নন্দিতাকে দ্বিধান্বিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লারা মিষ্টি হেসে একপ্রকার জোর করেই তুলাকে তুলে দেয় নন্দিতার কোলে। হাসতে হাসতেই বলে,
“ওর শরীরটা একটু সেনসিটিভ, কিন্তু এমন কিছু হবে না। নিশ্চিন্তে কোলে নাও তুমি।”

মায়ের কথা শুনে তুলাও হেসে উঠলো খিলখিল করে। অতঃপর তার নরম দুই হাত কৌতূহল নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো নন্দিতার গাঢ় কালো চুলগুলো। কয়েকটা করে চুল হাতে নিয়ে বিজ্ঞদের মত কিছু একটা দেখে আবারও রেখে দিয়ে অন্যদিকের চুল হাতড়াচ্ছে।
“তোমাদের চুল এমন ব্ল্যাক ব্ল্যাক কীভাবে হয়? আমাদের কেন হয়না?”
তুলার নরম, আদুরে ঠোঁট গলে বেরিয়ে আসা শব্দগুচ্ছ ভীষণ মিষ্টি ঠেকলো নন্দিতার কাছে। তুলাকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরের দিক এগোতে এগোতে বললো,
“তুমি বার্ডস দেখেছ?”
“হ্যাঁ”
“কতোগুলো দেখেছ?”
“অনেক অনেকগুলো”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দুইহাত দুইদিকে ছড়িয়ে তুলার অনেকটা বোঝানো দেখে ফিক করে হেসে ফেললো নন্দিতা। তুলাকে কোলে নিয়ে নিজে বসে পড়লো বেডের উপর। অতঃপর হাসতে হাসতেই বললো,
“এতো এতো বার্ড কোথায় পেলে তুমি?”
“এভিয়ারিতে। আর আমি তো ফ্যাসটিভাল অফ দা ওসেতে পার্টিসিপেটও করেছিলাম”
ইতালিতে বেশ কিছু পাখির সংগ্রহশালা বা এভিয়ারি রয়েছে। আর ইতালির স্যাসিলে প্রতি বছর “ফ্যাসটিভাল অফ দি ওসেই” নামে একটি পাখি ও এভিয়ারি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে পাখিদের গান এবং তাদের অনুকরণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
“তাহলে সব বার্ডের কালার কী একরকম হয়?”
“নো নো”
“কেন হয়না বলো তো?”

তুলা যেন এবার ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। ঠোঁটের নীচে আঙুল দিয়ে বিজ্ঞদের মত চিন্তিত ভঙ্গিতে ভাবতে লাগলো সে বিষয়টা। কিন্তু যথপোযোগী কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে হতাশ চোখে নন্দিতার দিকে তাকাতেই পাশ থেকে কেউ একজন বলে ওঠে,
“কারন সবাই তো সেম নেচারে থাকে না, সবার বডি আলাদা, বডি টেম্পারেচার আলাদা, দেখতে আলাদা তাই সবার কালারও আলাদা। কিন্তু সেম সেম বার্ডের কালার সেম সেম হয়।”
আচমকা অপরিচিত কারোর আগমনে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় তুলা। লোকটাকে সে চেনে, কিন্তু কখনও কথা বলেনি। দিদু আর পাপার সাথে কথা বলে শুধু লোকটা। তাই সেও চোখ ফিরিয়ে নন্দিতার গলা জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,

” এই ব্যাড আঙ্কেলটা কে?”
তুলার কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসে নন্দিতা। আড়চোখে একবার তুর্জয়কে পরখ করে ফিসফিসিয়ে বলে,
“এই আঙ্কেলটা ভালো না একটুও, প্রচুর খারুশ।”
ভিনদেশী, ভিন্ন ভাষী তুলা খারুশ শব্দের অর্থ না বুঝলেও নন্দিতার গলায় মুখ গুঁজতে গিয়ে ফর্সা ত্বকে কালচে এক দাগ চোখে পড়ল তার। ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে দাগটাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে অবাক কণ্ঠে বললো,
“ব্যাড আঙ্কেল কী তোমাকে ব্যথা দেয়? এইযে এখানে ব্যথা দিয়েছে না?”

নন্দিতা কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঠোঁট উল্টে সম্মতি জানালে তৎক্ষণাৎ মোচড়ামুচড়ি করে তার কোল থেকে নেমে গেল তুলা। তুর্জয় সামনের সোফায় বসে কিছু পেপার ঘাঁটাঘাঁটি করছিলো। পেপার ঘাঁটাঘাঁটি করলেও তার সবটুকু নজর ছিল তুলা আর নন্দিতার দিকে। তুলাকে জাপটে ধরে আদর করা, তুলার নরম দুই হাতে নন্দিতার গলা জড়িয়ে ধরা, নন্দিতার চোখে মুখে ভেসে ওঠা খুশির ঝলক কোনোটাই চোখ এড়ায়নি তার। কিন্তু আচমকা তুলাকে নিজের সামনে পেয়ে ভড়কালো সে। পেপারটা মুখের থেকে খানিকটা নামিয়ে ভ্রূ উঁচিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকালো তুলার দিকে। তুলা দুই হাত কোমরে গুঁজে তুর্জয়ের থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে খানিকটা রাগী কণ্ঠে বললো,
“তোমাকে পুলিশে দেওয়া হবে, ক্রাইম করেছ।”

“আমার ক্রাইমটা যেন কী?” ভ্রূ উঁচিয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বললো তুর্জয়।
“প্রিটি আন্টিকে ব্যথা দিয়েছ। শি হার্টস টু মাচ। ব্ল্যাক ব্ল্যাক হয়ে গেছে।”
তুর্জয় এবার নড়েচড়ে বসলো খানিকটা। এতক্ষণ মজার ছলে কথাগুলো নিলেও এবার বেশ চিন্তা হচ্ছে তার। সত্যিই কী নিজের অজান্তে ব্যথা দিয়ে ফেলেছে নন্দিতাকে? অথচ মেয়েটা একবার মুখ ফুটে বললো না পর্যন্ত। মনের উশখুশ অবস্থা কমাতে খানিকটা কাশি দিয়ে তুলাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“কোথায় ব্ল্যাক ব্ল্যাক হয়েছে, দেখাও তো আমাকে একটু।”

নন্দিতা বেডে বসে ঠোঁট টিপে হাসছিল এতক্ষণ। ভেবেছিল তুর্জয় বোধহয় সাথে সাথেই ধরে ফেলবে ব্যাপারটা। কিন্তু সে যে এভাবে তেড়েহুড়ে তার ব্যথা নিয়ে গবেষণা করতে ছুটে আসবে, এ কথা কস্মিনকালেও ভাবেনি সে।
শ্বশুর বাড়িতে আসার তৃতীয় দিন আজ নন্দিতার। শাশুড়িকে সরিয়ে নিজের হাতে রান্না বান্না সহ সবটুকু কাজ একাই করেছে সে আজ। তুহিনা বেগম বেশ কয়েকবার রান্নাঘরে উঁকি দিতে গেলে নন্দিতার চরম হুশিয়ারির পিঠে পাল্টা প্রতিবাদ করে উঠতে পারেননি আর।

ব্যস্ত বেলা শেষে সাঁঝ নামতেই আচমকা কলিংবেলের শব্দে খানিকটা বিব্রত হয় সকলে। এই অসময়ে এ বাড়ির দরজায় আসার মত তেমন কেউ নেই। অথচ দরজা ওপারে থাকা মানুষটা একইভাবে কলিংবেল চেপেই যাচ্ছে। কলিং বেলের ঝাঁ ঝাঁ করা শব্দে বিরক্ত তুর্জয়ও। শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে তড়িঘড়ি দরজা খুলতে এগিয়ে যায় নন্দিতা। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে দেখে তব্দা খেয়ে যায় নন্দিতা।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে নন্দিতা গলা উঁচিয়ে ডাক দেয় তুহিনা বেগমকে। তুহিনা বেগম দরজার কাছে এসেই যেনতেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েন কান্নায়। তার কান্নার শব্দে ভয় পেয়ে দৌড়ে আসেন আশরাফ সাহেব আর তুর্জয়।

সকলের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে ডানহাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে লাজুক ভঙ্গিতে তুহিন বলে ওঠে,
“সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে মারধর খেতে হবে নাকি আম্মা? তোমরা চিনতে পারছ তো আমাদের?”
তুহিনা বেগম ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়েন তুহিনের বুকে। কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা তার। তুহিন মাকে দুইহাতে আগলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তার পিছন পিছন তুলাকে কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো লারা। তুর্জয় এগিয়ে গিয়ে তাদের লাগেজ ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা আটকে দিলো।
মা ছেলের মিলনপর্বের মাঝে খানিকটা স্পেস দিতে ছোটো তুলাকে কোলে নিয়ে রুমে চলে এসেছিল নন্দিতা। বাইরের ঘর থেকে এখনও তুহিনা বেগমের কান্নাভেজা শব্দ শোনা যাচ্ছে। এতগুলো বছরের জমানো অভিমান এতো সহজে গলে নাকি!

ভাবনায় নিমগ্ন নন্দিতার একদম গা ঘেঁষে বসে তুর্জয়। কোলে তুলে নেয় ছোটো তুলাকে। কিন্তু তুলা চোখ মুখ লাল করে তাকিয়ে আছে তুর্জয়ের দিকে। কিছুতেই যাবে না তার কোলে। তুর্জয় অসহায় চোখে তুলার দিকে তাকায়। বলে,
“তোমার ভালো আন্টিকে বলো তো তার ব্ল্যাক ব্ল্যাক দাগ আমাকে দেখাতে। আমিও দেখি কেমন ক্রাইম করে ফেললাম নিজের অজান্তেই।”
তুর্জয়ের কথা শুনে চট করে নিজের কাছের কালচে অংশে হাত চাপা দেয় নন্দিতা। সেদিকে চোখ যেতেই এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় তুর্জয়ের কাছে। আর সাথে সাথেই শব্দ করে হেসে ওঠে সে।
তুলা ভীষণ বিরক্ত। এই খারাপ লোকটা ক্রাইম করে আবার এভাবে হাসছে কেন, ভাবতে ভাবতেই ডান হাতের আঙ্গুল উঁচিয়ে তুর্জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৯

“ক্রাইম করে হাসতে নেই, জানোনা তুমি?”
“ক্রাইম যদি এমন হয়, তাহলে তো আমি আস্ত এক ক্রিমিনাল। এমন অনেক ব্ল্যাক ব্ল্যাক দাগ তো তোমার প্রিটি আন্টির পুরো শরীর জুড়ে আমার অস্তিত্বের জানান দেয়। জানান দেয় আমার অবাধ্য বিচরণের।”
তুলা এতো ভারী ভারী বাংলা কিছুই বুঝল না। শুধু বুঝলো যে এই আঙ্কেল মোটেই ভালো না। তার প্রিটি আন্টিকে ব্যথা দেয় শুধু। তুলাকে একভাবে তার দিকে তাকাতে দেখে তুলার দিকে খানিকটা ঝুঁকলো। অতঃপর মশকরা করার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“তোমার প্রিটি আন্টি যে আমাকে আরও বেশি ব্যথা দেয় তা কী তুমি জানো? আমার পুরো পিঠ জুড়ে খামচি দেয় সে।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২১+২২