প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৬

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৬
ফিজা সিদ্দিকী

আলমারির এক কোণে শাড়ির ভাঁজে চাপা দেওয়া পুরোনো এক ডায়রি চোখের সামনে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে সেটা হতে নিলো নন্দিতা। মাকে সে কখনও ডায়রি লিখতে দেখেনি, আর না বাবার এসবের অভ্যাস আছে। তবে তাদের আলমারিতে এই পুরোনো ডায়রি কিসের? ডায়রির পাতা ওলট পালট করে দেখতে দেখতে নন্দিতা খেয়াল করলো ডায়রির মাঝের দিকে পুরোটা ফাঁকা। এরপর শেষের কয়েকটা পাতায় গুটিকয়েক অক্ষরে কিছু লেখা। কৌতূহলে হোক বা প্রয়োজনে ডায়রিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো সে। অতঃপর খুব বেশি দেরী না করে দুটো ট্রলি ভর্তি করে ফেললো প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব জিনিসে।

গোধূলির আলো নিভেছে অনেক্ষন হলো। চারিদিকে শুধু আঁধারি কালিমা। আজকে রাতটা একটু বেশীই অধকারাচ্ছন, অমাবস্যা বোধহয়। ঘুটঘুটে কালো রাত কী যেন এক অশনি সংকেত দিচ্ছে। তুহিনা বেগম নন্দিতার দুই গাল ধরে সস্নেহে চুমু খান তার ললাটে। চোখ তার অশ্রুসিক্ত। বিদায় বেলা এতো কঠিন কেন হয়? মায়ের পর এই মানুষটাকেই নন্দিতা মা হিসেবে মেনেছে। আজ যেন তার মনে হচ্ছে মায়ের ঘর থেকে বিদায় নিচ্ছে। সত্যিই তো মায়ের ঘর এটা। ওইযে ওই উপরতলায় তো থাকতো মা। শাসাতে শাসাতে নীচতলা অবদি এসে সেই এক হুংকার ছাড়তো। নন্দিতা তখন ভালো মেয়ের মতো চুপচাপ মাথা নীচু করে ফেলত। আর একটু চোখের আড়াল হলেই দাপিয়ে বেড়াতো দুই তলা পুরোটা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাদের সি অফ করতে নীচে নেমে এসেছে সবাই। তুলা মায়ের পাশে দাঁড়িয়েই হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে। বাইরের দেশের বাচ্চারা অল্প বয়স থেকেই হয়ে ওঠে স্বাবলম্বী। অহেতুক মা বাবার কোলে চড়ে ঘুরে বেড়ানো হোক বা গেলে তুলে খাইয়ে দেওয়া, এর কোনোটাই তাদের দেওয়া হয়না। বরং খুব অল্প বয়স থেকেই হাতে তুলে খেতে শেখানো হয়। শেখানো হয় সুইমিং সহ আরও নানান এক্টিভিটিস।
“প্রিটি আন্টি আমাকে টসটসে চুমু দেবে না?”

গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলো নন্দিতা। তুলার কথা শুনে আচমকাই মন ভারী হয়ে পড়ে তার। সাথে ফিক করে হেসেও দেয় তার কথার ধরন দেখে। হাসে বাকি সবাইও। টসটসে শব্দটা মূলত নন্দিতার কাছ থেকেই শিখেছে সে। চুমু খাবার আগে দুই হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে ডাকতে গিয়ে বলতো, “আসো তো সোনা, কয়টা টসটসে চুমু খাই।”
তুলার সামনে পা ভাঁজ করে বসলো নন্দিতা। অতঃপর তার সারা মুখে অজস্র চুমু খেতে খেতে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল,
“ভীষণ মিস করবো আমার তুলা সোনাকে।”
দিনের ধূ ধূ উত্তাপ ছড়ানো বাতাসে শীতলতা ভর করেছে। তাপমাত্রা কমে বাতাসের দাপটে প্রশান্তির ছায়া নেমেছে। জনজীবন যেন ঠিক এই ক্ষণেরই অপেক্ষায় ছিল। গোটা দিনের গা জ্বলা গরমের তাপদাহ শরীর ঝলসে দেওয়ার পর আঁধারি রাতের উন্মাতাল বাতাসেই শীতল দাপট শৈত্যপ্রবাহের চেয়ে কম নয়। মন জুড়ায়, শরীরে প্রশান্তি ডেকে আনে।

নন্দিতা চোখ বুঁজে গাড়ির জানালামুখী হয়ে বসে আছে। পাশেই ড্রাইভিং সিটে বসে তুর্জয়। আড়চোখে পরখ করছে নন্দিতাকে। বেখেয়ালি নন্দিতা আজ মায়ের একটা সাদা শাড়ি পড়েছে। বাবার পছন্দের রং বলে বেশ কয়েকটা শাড়ি রয়েছে তার এই রঙে। খোলা জানালা দিয়ে ধেয়ে আসা বাতাসের দাপটে এলোমেলো শাড়ির আঁচল। উন্মুক্ত কোমরের অংশ। তুর্জয় ঠোঁট কামড়ে হাসে। অতঃপর ডানহাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে সাবধানে বাম হাত এনে রাখে নন্দিতার কোমরের কাছে। অতঃপর বড্ডো ধীর গতিতে এক আঙ্গুল দুই আঙুল করে ছুঁয়ে যায় উন্মুক্ত কোমর। আচমকা আক্রমনে শিউরে ওঠে নন্দিতা। তুর্জয় ততক্ষনে পুরোদমে আঁকড়ে ধরেছে তার কোমর। লজ্জায় হাসফাঁস করতে করতে নন্দিতা অহেতুক ছোটাছুটি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তা দেখে মুচকি হেসে তুর্জয় বলে,
“শুধু শুধু এখানে এনার্জি ওয়েস্ট করে লাভ নেই, রাতের জন্য বাঁচিয়ে রাখুন ম্যাডাম। পুরো রাত কিন্তু পড়ে আছে এখনও।”

নন্দিতা রাগী চোখে তুর্জয়ের দিকে তাকায়। তুর্জয় ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে একহাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নন্দিতাকে টেনে নেয় বুকের উপর। নন্দিতা চোখ বড়ো বড়ো করে তুর্জয়ের দিকে তাকালে বামহাতে নন্দিতার কোমর আলতো করে আঁকড়ে ধরে মুচকি হেসে তুর্জয় বলে,
“চুপচাপ আমার হার্টবিট শুনুন। দে ওয়ান্ট টু সে সামথিং।”
নন্দিতা অস্থিরচিত্তে তুর্জয়কে ছাড়াতে ছাড়াতে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“গাড়ি চালানোর সময় একদম এসব নয়। ওদিকে ফোকাস করুন।”
“তাহলে গাড়িটা থামিয়ে দিই এখন? কারন এখন বউকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করছে আমার। গাড়ি তো পরেও চালানো যাবে। দেখি আসুন তো!”

তুর্জয়ের শক্ত বাহুবন্ধনী থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে নন্দিতা করুণ কণ্ঠে বলে ওঠে,
“উফ্! গাড়ী চালাতে চালাতে কিসব করছেন বলুন তো? ওদিকে ফোকাস করুন না। যে কোনো সময় সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।”
“সর্বনাশ তো হয়েছে। আপনি আমার বিরাট সর্বনাশ করে দিয়েছেন।”
তুর্জয়ের আফসোসের সুরে বলা কথা শুনে নন্দিতা চোখ তুলে তাকায়। সন্ধিহান কণ্ঠে বলে,
“মানে?”
তুর্জয় তার স্বভাবসুলভ ঠোঁট কামড়ে হাসে। অতঃপর নন্দিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
“এমন রুপে ধরা দিয়েছেন অথচ আমি আপনার সাজগোজ নষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছি না একটুও। এ কী অন্যায় নয়? আর..”

“আর?”
“আপনার শাড়ির আঁচল সরে গিয়ে কিছুমিছু দেখা যাচ্ছে। গাড়ি চালানোতে ফোকাস থাকে কিভাবে আর?”
লজ্জায় থ বনে যায় নন্দিতা। পাথরের মূর্তির মত ফ্যালফ্যাল করে কয়েকমুহূর্ত তুর্জয়ের দিকে তাকিয়ে সরাসরি আছড়ে পড়ে তারই বুকে। লজ্জায় হাসফাঁস করতে করতে একহাতে টেনে তুলে নেয় বেখেয়ালিতে আলগা হয়ে পড়া আঁচল।
“মিসেস তুর্জয়!”
ডাকটা কেমন যেন বুকে গিয়ে লাগলো নন্দিতার। এই নামে ডাকতে গিয়ে তুর্জয়ের হার্টবিট ফাস্ট হলো কি? বোধহয় হলো। সে তো স্পষ্ট কান পেতে শুনলো। ইশ! কী গভীর আদুরে এক দাম। একটা নামে এতটুকু আদর মিশিয়ে ডাকতে পারে বুঝি কেউ?
“মিসেস তুর্জয়, শুনছেন?” আবারও ডেকে উঠলো তুর্জয়।
“হুম”
“ক্যান আই কিস অন ইওর নেক?”

ইশ! কিআদুরে আবদার। আচ্ছা সব স্বামীদের আবদারই কি এমন লাগে? নাকি তুর্জয়ের কথা, তার কন্ঠ, তার বাচনভঙ্গিতে আলাদা এক মাদকতার ছোঁয়া রয়েছে। যা মাদকাসক্তের মতো মাতাল মাতাল করে ফেলে তাকে। চিন্তা, চেতনা লোপ পেয়ে তার প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার তীব্র সাধ জাগে। নেশায় বুঁদ হওয়ার পর মানুষ যেমন নেশাগ্রস্থ, অবসাদগ্রস্থ আচরণ করে, ঠিক তেমনই মনে হয় নিজেকে নন্দিতার। তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিছু একটা চিন্তা করলো সে। অতঃপর খানিকটা রুক্ষ কণ্ঠে বলে,

“গাড়ি চালাতে চালাতে কোনো আবদার নয়, আগে ঠিকমতো ড্রাইভ করে বাড়িতে ফিরুন।”
কথাটুকু শেষ করে নন্দিতা খানিকটা উঁচু হয়ে চট করে চুমু খায় তুর্জয়ের বুকের খোলা অংশে। ধূসর রঙের ফর্মাল শার্টে তার শ্যামলা বরন ত্বক ভীষণ রকম মানিয়েছে। বুকের কাছের খুলে রাখা দুইটা বোতাম থেকে উঁকি দিচ্ছে তার পুরুষালী লোমশ বুক। নন্দিতা চট করে কাজটা সেরে আগের মতো মাথা রাখে তার বুকে। যেন এইমাত্র কিছুই ঘটায়নি সে। একেবারে নিষ্পাপ একটা চেহারা নিয়ে তুর্জয়ের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো সে। ঠোঁটের কোণে তার ক্ষীণ হাসি।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৫

তুর্জয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় প্রাথমিকভাবে। নন্দিতা নিজে থেকে এমন একটা কাজ করে বসবে এটা তার ধারণাতেই ছিল না। ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে ওঠে সে। লজ্জায় নন্দিতার মরি মরি অবস্থা এবার। ঝোঁকের বশে করে ফেলা তার এই কাজের জন্য নাজানি কতটুকু লজ্জা দেবে তাকে এই অসভ্য লোকটা। তবে তুর্জয় সেসব নিয়ে কিছু না বলে উল্টে দুইহাত স্টিয়ারিংয়ের উপর রেখে গাড়ির স্পিড বাড়াতে বাড়াতে বলে,
“আজ আপনি শেষ, মিসেস তুর্জয় আহসান। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৭