প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৯
ফিজা সিদ্দিকী
অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সকল তথ্য প্রমাণ হাতে নিয়ে কোর্ট রুমের মধ্যে প্রবেশ করে তুর্জয়। অপোনেন্ট লয়ার তার আগে থেকেই উপস্থিত সেখানে। চোখে মুখে শয়তানি হাসি। এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলি আর তুর্জয়ের মাঝে বিশেষ কোনো শত্রুতা না থাকলেও কোর্ট রুমে তারা একে অন্যের শত্রু বনে যায়। দিব্য গাঙ্গুলি তুর্জয়ের চেয়েও বেশ সিনিয়র একজন এডভোকেট, একে অপরের বিপক্ষে কেস তারা বেশ কয়েকটা লড়েছে। পদের দিক থেকে তারা সমপদস্থ হলেও দিব্য গাঙ্গুলিকে পাতি ভাষায় পয়সাওয়ালাদের লয়ার বলা হয়। যে সে কেস লড়েন না উনি, আর যেগুলো লড়েন কয়েক লাখের উপর চার্জ করেন। ওকালতি ধর্ম বোঝে না, না বোঝে ধনী গরীব। ওকালতি শুধু বোঝে ন্যায় অন্যায়। অথচ এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলি কয়েক লাখ টাকার কাছে নিজের ওকালতি বেচে দেন। তার এই স্বভাবটার জন্যই তুর্জয় বিশেষ পছন্দ করে না তাকে।
বিচারক হাজির হওয়ার সাথে সাথেই চঞ্চল কোর্টরুমের ভোল বদলে গেল। পিনপতন নীরবতায় যার যার জায়গা দখল করে বসে পড়লো সবাই। বিপক্ষ দলের যারা এসেছেন তাদেরকে বিশেষ চেনে না তুর্জয়। তবে সবার মাঝ থেকে একটা পরিচিত মুখ চোখে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। এই চেহারাটা বিষ লাগে তার। কদর্য, কুৎসিত একটা চেহারা। অন্যের বউয়ের দিকে নজর দেওয়া পুরুষকে কাপুরুষ বলেই গণ্য করা যায়। আর এই দুইদিনের ছোকরা তার বউয়ের উপর নজর দিয়েছে। বর্তমানে এই আইনি ঝামেলা না চললে এক মিনিটও সময় নিতো না সে এই ছেলেটার হাত পা ভেঙে বিছানায় শুইয়ে রাখতে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই কাজ সে করতে পারছে না। এতে কেসের জটিলতা বাড়বে। সবটুকু দোষারোপ তার উপর চাপিয়ে বেঁচে যাবে শিকদাররা। সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায়না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তুর্জয়ের চোখে চোখ পড়তেই ধূসর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। সাথে সাথেই মুখ ফিরিয়ে নিলো তুর্জয়। শান্ত মেজাজটা অশান্ত করতে চায়না সে কোনোভাবেই।
বিচারকের অনুমতিতে শুরু হলো দুই দলের বাকবিতণ্ডিতা। তুর্জয় যেখানে শিকদারদের বিপক্ষে একের পর এক প্রমাণ পেশ করছে আদালতে, এডভোকেট দিব্য সেখানে তার কথার মারপ্যাঁচের মাধ্যমে সেসব প্রমানকে মিথ্যা ও ভূঁয়া প্রমাণ করতে চাইছেন। দুজনের কথাকাটাকাটির মাঝে আচমকা এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলি বলে ওঠেন,
“এমনটা তো নয়, যে আপনি ব্যাক্তিগত আক্রোশ মেটানোর জন্য শিকদারদের বিরুদ্ধে মিথ্যা নাটক সাজাচ্ছেন, মিস্টার আহসান।”
তুর্জয় সাথে সাথেই তার কথা কেটে বলে ওঠে,
“ব্যক্তিগত আক্রোশ থাকার জন্য যে ব্যাক্তিগত আলাপ থাকতে হয়, এটা বোধহয় আমার লার্লেড ফ্রেন্ড ভুলে যাচ্ছেন, বিচারক সাহেব।”
“বিচারক সাহেব, আমি আপনার সামনে এমন কিছু ছবি পেশ করতে চাই যেখানে স্পষ্ট যে এডভোকেট তুর্জয় আহসান ও তার পরিবারের লোকজনের সাথে পুরোপুরি মেলামেশা রয়েছে শিকদার বংশের লোকজনের।”
এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলি বেশ কয়েকটা ফটোকপি পেশ করেন আদালতের সামনে। যার প্রথমটাতে রয়েছে সেদিন রাতের ছবি, যেদিন নন্দিতাকে ধূসর শিকদারের সাথে দেখেছিল ক্যাফেতে। দ্বিতীয় ছবিটা নন্দিতা বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে অবস্থিত সুপারমার্কেটে সামনে কারোর সাথে কথা বলছে। চোখে মুখে তার ভয়ের ছাপ। তৃতীয় ছবিটা তারই ফ্ল্যাটের। দরজা খুলে একজন লোকের কাছ থেকে কিছু নিচ্ছে নন্দিতা। আর চতুর্থ ছবিটা দেখে পায়ের তলা দিয়ে মাটি সরে যায় তুর্জয়ের।
শিকদাররা এভাবে ট্রাপে ফেলতে পারে তাকে, দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সে। চতুর্থ ছবিটা তাদের সোনারপুরের বাড়িতে। একদিন রাতে একজন ভদ্রলোক এসে যে তার হাতে একটা আংটি ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেদিনের ছবিটা। অথচ লোকটাকে সে তাদের শুভাকাঙ্খী ভেবেছিলো। আগে থেকেই বিপদ সম্পর্কে আগাহ করছে ভেবে মনে মনে বেশ প্রসন্ন হয়েছিল সে ওই আগন্তুকের প্রতি। অথচ প্ল্যান ছিলো অন্যকিছু।
ছবিগুলো আদালতে পেশ করার পর এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলি তাকান তুর্জয়ের দিকে। ঠোঁটে তার ক্ষীণ হাসি। মনে মনে অনাবিল সুখ। এই প্রথমবার তুর্জয়কে হেনস্তা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এই খুশিতে আত্মহারা হয়ে বিচারকের উদ্দেশ্যে বলেন,
“আমি আদালতকে জানাতে চাই এখানে থাকা প্রথম ছবিতে যে দুইজনকে দেখতে পাচ্ছেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক জাওয়াদ শিকদারের ছোটো ছেলে ধূসর শিকদার ও অন্যজন হলেন আমার বিশিস্ট ফ্রেন্ড এডভোকেট তুর্জয় আহসানের স্ত্রী নন্দিতা আহসান। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ছবিতে থাকা দুই লোকই শিকদারদের কর্মকর্তা। এবং তৃতীয় ছবিতে তো স্বয়ং দেখা যাচ্ছে আমার লার্নেড ফ্রেন্ডকে। সেই সাথে শিকদারদের সবচেয়ে পুরোনো আর বিশ্বস্ত দারোয়ান আজগার জলিল।”
এটুকু বলেই খানিকটা থামলেন তিনি। অতঃপর আবারও বলে উঠলেন,
“এসবকিছু দেখার পরেও কি আপনার মনে হয় তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত আলাপ থাকার কিছু আছে? বিচারক সাহেব, আমরা কী তবে ধরেই নেব এই কেস পুরোটাই ভিত্তিহীন আর মিথ্যা অপবাদের উপর দাঁড়িয়ে?”
“অবজেকশন বিচারক। এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলির বোধহয় বড্ডো তাড়াহুড়ো আছে এই কেসটা ক্লোজ করার। সামান্য কয়েকটা ছবি আদালতের সামনে ছুঁড়ে দিতে তাই তিনি সবাইকে পথভ্রষ্ট করতে চাইছেন। ছবিগুলো সত্য নাকি ভুয়া সেসব প্রমাণ করার কোনো তাড়া দেখা যাচ্ছে না তার। বিচারক সাহেব, ধরুন আমি আপনাকে চিনি না। হঠাৎ করে আপনার বাড়ির কলিং বেল চেপে আপনার কাছে গিয়ে জোর করে আপনার হাতে কিছু ধরিয়ে দিয়ে চলে আসি। তার মানে কি আপনার সাথে আমার ব্যক্তিগত আলাপ রয়েছে? আর সেটা প্রমাণ করে জন্য আমি একটা ছবিও তুলে রাখলাম ধরুন।”
বিচারক ভ্রু কুঁচকে তাকান তুর্জয়ের দিকে। তুর্জয় ঠিক কি বোঝানোর চেষ্টা করছে সঠিকভাবে বোঝেননি তিনি। তাই তার প্রশ্নের জবাবে তিনি শুধু না সূচক মাথা নাড়েন। সাথে সাথেই তুর্জয় আবার বলতে শুরু করে,
“এখানেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। পুরোটাই পরিকল্পনা করে সাজানো গোছানো একটা নাটক। যেখানে আমাকে এবং আমার নির্দোষ স্ত্রীকে ফাঁসানো হচ্ছে।”
“অবজেকশন বিচারক সাহেব। আমার বন্ধু নিজেকে যেভাবে ভিক্টিম প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, আসলে তিনি তা নন। জাওয়াদ শিকদারের থেকে একটা মোটা অংকের টাকা তিনি নিয়েছিলেন এই কেসটা থেকে সরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি সেই টাকা সম্পূর্ণ হজম করে আরও বড়ো অংকের টাকা দাবি করেন। আমার ক্লায়েন্ট সেটা দিতে অস্বীকার করায় এডভোকেট তুর্জয় আহসান তাকে বরবাদ করে দেওয়ার হুমকি দেয়।”
“ওবেজেকশন বিচারক সাহেব। জাওয়াদ শিকদার যদি একেবারেই নির্দোষ হন, তাহলে তিনি কেন আমাকে টাকা দিতে যাবেন কেসটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য? এসব করার তো কোনো দরকার ছিল না তবে তার। আদালত যে মন গড়া গল্প বলার জায়গা নয়, এটা বোধহয় অমার বিপক্ষীয় বন্ধু ভুলে যাচ্ছেন। আদালত প্রমাণ চায়”
“অবজেকশন সাস্টেন্ড। আপনি প্রমাণ ছাড়া কাউকে এভাবে দোষারোপ করতে পারেন না। আপনার কাছে প্রমাণ থাকলে সেটা আদালতে পেশ করুন।”
“জি বিচারক সাহেব। আমার কাছে রয়েছে এডভোকেট তুর্জয় আহসানের ব্যাংক স্টেটমেন্ট। যেখানে স্পষ্ট তাদের লেনদেনের অংক।”
চমকে উঠে তুর্জয় তাকালো এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলির দিকে। তার ব্যাংক স্টেটমেন্ট বিপক্ষ দলের উকিলের কাছে গেল কিভাবে? আর সেখানে শিকদারদের সাথে তার লেনদেনের বিষয়টা এলো না কীভাবে? ভাবনার মাঝেই বিচারক তুর্জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,
“এ সম্পর্কে আপনার কিছু বলার আছে নিজের পক্ষে?”
“আমার জানামতে এমন কোনো লেনদেন হয়নি তাদের সাথে আমার। হতে পারে এই স্টেটমেন্টটা পুরোটাই ভূয়া, সাজানো। আমি আদালতের কাছে কিছুটা সময় চাইছি সকল তথ্য প্রমাণ পেশ করার জন্য।”
তুর্জয়ের অনুরোধ মেনে নিয়ে বিচারক আজকের মত এখানেই শেষ করলেন আদালতের শুনানি। পরবর্তী ডেট দেওয়া হলো তিনদিন পর। কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে আনসারের দিকে আড়চোখে তাকালেন তিনি। পুরোটা সময় তার টিকিটা অবদি খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ কোর্টের সময় শেষ হতেই এসে হাজির হয়েছে সে। তার ব্যাংক স্টেটমেন্ট নিয়ে গোলযোগের বিষয়ে একমাত্র সন্দেহভাজন ব্যক্তি আনসার। তবে প্রমাণ হাতে না পেয়ে তার মনোভাব প্রমাণ করলো না সে। বরং কেস নিয়ে তার সাথে নানান আলাপচারিতা করতে করতে বেরিয়ে এলো বাইরে।
দুশ্চিন্তা হচ্ছে নন্দিতার। বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলো সে তুর্জয়কে। কিন্তু একবারও রিসিভ হয়নি সেই কল। এমনকি কোনো ম্যাসেজ পর্যন্ত দেয়নি। কোর্টের টাইম কী শেষ হয়নি এখনো? দুশ্চিন্তায় খাওয়া ঘুম ভুলে সারাঘর পায়চারি করতে করতে মাথা ঘুরে ওঠে নন্দিতার। বিছানায় বসে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করতেই সাথে সাথে বেজে ওঠে কলিংবেল। নন্দিতা দৌড়ে দরজা খুলতে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে তুর্জয়কে দেখামাত্র অভিমানী কণ্ঠে বলে ওঠে,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৮
“কতোগুলো কল দিয়েছি আপনাকে? দুশ্চিন্তা হয়না আমার নাকি?”
তুর্জয় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে নন্দিতার কথায়। মলিন কণ্ঠে বলে,
“দুশ্চিন্তা হয় তো তাদের , যারা শুভচিন্তক। প্রাণঘাতি মানুষের প্রাণের ভয় করতে নেই।”