প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৮

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৮
ফিজা সিদ্দিকী

রকিং চেয়ারে বসে অজগরের মতো ফুঁসছেন জাওয়াদ শিকদার। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তারই গোপন ডেরার খোঁজ কিভাবে পেলো বাইরের মানুষ? শিকদারদের গর্তে হাত বাড়ানোর মতো সাহস এখনও ওই দুই চুনোপুঁটির হয়নি। যে সর্বনাশী খেলায় তারা নেমেছে, সেই খেলাও তার, খেলার মাঠও তার। কেউ একজন তো নিশ্চই আছে এসবের পিছনে। প্রথমে বাড়ির মধ্যে থেকে ফাইল চুরি, এরপর এখন নওরীনের হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়া তাকে পাগলপ্রায় করে দিয়েছে। বাড়ীর মধ্যে থাকা শত্রুপক্ষের লোককে শনাক্ত না করা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। অথচ বাড়িতে কাজ করা এতগুলো মানুষের প্রত্যেকে অনেক বছর ধরে তাদের সাথে আছে।

এছাড়া তাদের প্রত্যেকের প্রতিটা কদমের খবর পর্যন্ত থাকে তার কাছে। তাহলে এত বড় দুঃসাহস দেখানোর আস্পর্ধা পেল কে?
কোর্ট থেকে সবার ফিরে আসার খবর পেয়ে গেস্ট হাউস বাইরে থেকে লক করে বেরিয়ে এলো ধূসর। বেরোনো আগে ইমপোর্টেড ড্রিংকের বোতল থেকে কিছুটা ড্রিংক হাতে নিয়ে লাগিয়ে নিলো মুখের চারপাশে। কিছুটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলো পরণের টিশার্টেও। বাড়িতে ঢোকার আগে সে ছুটলো বাড়িতে অবস্থিত সিসিটিভির মনিটরিং রুমে। ভাগ্যক্রমে গার্ড তখন টেবিলে মাথা এলিয়ে শুয়ে। ধূসর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। বাড়ির সবগুলো সিসিটিভি ফুটেজের কয়েক ঘণ্টার মেমোরি পুরোপুরি ডিলিট করে আগের মতোই ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো। নিজের বাপ চাচাকে সে চেনে, তাই কোনরকম ফাঁক ফোকর রাখতে চায়না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কোনরকম হেলতে দুলতে সিড়ি বেয়ে বাড়ির দোতালায় উঠলো ধূসর। নিজের ঘরের দিকে যেতে গিয়ে ইচ্ছেকৃত ধাক্কা খেলো জাওয়াদ শিকদারের ঘরের দরজায়। আলতোভাবে লাগানো দরজাটা খুলে গেল তৎক্ষণাৎ। জাওয়াদ শিকদার একপলক চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন ধূসরের দিকে। অতঃপর আগের মতোই রকিং চেয়ারে দোল খেতে লাগলেন।
“এডভোকেট তুর্জয় আহসানের শাস্তি কী শুধু জেল নাকি ফাঁসি?”
জাওয়াদ শিকদার একপলক বিরক্ত চোখে তাকালেন মাতাল ছেলের দিকে। অতঃপর রাশভারী কণ্ঠে বললেন,
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

“এ সময় আমি তো গেস্ট হাউসেই থাকি। লেট নাইট পার্টি থেকে ফিরে হ্যাং আউট কাটেনি এখনও।”
জাওয়াদ শিকদার নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করলেন ধূসরের কথা। কারন তার ওই গোপন ডেরার কথা তারা কয়েকজন ছাড়া কেউ জানত না, এমনকি ধূসরও না। এছাড়া ধূসরের ধ্যান, জ্ঞ্যান, নেশা পুরোটাই পার্টি, ক্লাব আর মেয়েবাজি নিয়ে। এসবের দিকে ঘুরেও তাকায়না সে। তাই তার পক্ষে এমন কিছু করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মুখটা নীচু করে আগের মতো রাশভারী কণ্ঠে তিনি বলেন,
“কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থেকো। আনসার ধরা পড়েছে, পুলিশ এখন আমাদের নজরে নজরে রাখবে।”
“তার মানে এডভোকেট তুর্জয় আহসান শাস্তি পায়নি?”
“শেষ মুহূর্তে খেলা বদলে গেছে। ওই পিদ্দি মার্কা একটা মেয়ে আমাদের বাজিমাত করে দিলো। বাপের মতোই কথা বার্তা, বিচক্ষণতা। তাই তাকে বাপের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে তাড়াতাড়ি।”
“এডভোকেট তুর্জয় তো এমনিতেই বেশিদিন নেই আর। ওর লাশ দেখে মেয়েটা এমনিতেও জীবন্ত লাশ হয়ে যাবে। এতো কষ্ট করতে হবে না আমাদের।”

জাওয়াদ শিকদার চঞ্চল পায়ে রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে ধূসরকে বললেন আজকে কোর্টের সব ঘটনা। ধূসর নিজেও ভীষণ অবাক হলো। নন্দিতার এই রূপ অজানা ছিল তারও। অবশ্য সে কতটুকুই বা চেনে তাকে? কয়েকবার চোখের দেখা আর খানিকটা কাঠকাঠ জবাবের মোহে যেভাবে আটকা পড়েছে, বেশি জানলে আবার যন্ত্রণা বেড়ে যেত কয়েকগুণ। তবে আম্মা কী জানতেন? ভাবনাগুলো মাথায় নিয়েই জাওয়াদ শিকদারের ঘর ছাড়লো সে।
পুরো শিকদার বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। কিন্তু নওরীনকে পাওয়া গেল না কোথাও। পুরো শহরের অলিতে গলিতে পাগলা কুত্তার মতো খোঁজা হচ্ছে এখন তাকে। এসব দেখে ধূসর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। মনে মনে বলে,
“ছোটো ছিলাম, তাই আমার মাকে বাঁচাতে পারিনি তোমার থাবা থেকে। তবে আম্মাকে আমি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবো জাওয়াদ শিকদার। যতো ফোর্স লাগানোর লাগিয়ে নাও, আমিও তোমারই ছেলে।”

ঘরে ঢুকে দরজা লক করে আয়েশ করে কাউচে বসলো ধূসর। অতঃপর ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি ফুটিয়ে ডায়াল করলো পরিচিত একটা নম্বর।
কোর্ট থেকে সোজা হোটেলে গিয়ে উঠেছে তুর্জয় আর নন্দিতা। আপাতত ফ্ল্যাটে ফেরার কোনো ইচ্ছে নেই তুর্জয়ের। যতদিন না শিকদারদের কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি সে দিতে পারছে, কোনোভাবেই নন্দিতাকে রাখা যাবে না ওখানে। ওদের নজরের আড়ালে রাখতে হবে নন্দিতাকে। তাদের ফ্ল্যাটের চেয়ে এই নামী দামী হোটেলের সিকিউরিটি অনেকগুণ উন্নত। প্রয়োজনে স্পেশালি ইনস্ট্রাক্ট করবে তাদের। তবুও নন্দিতা আর তাদের অনাগত সন্তানের উপর একটুও আঁচড় লাগতে দেবে না সে।

ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে নন্দিতা। তুর্জয় কিছু ফাইল নিয়ে স্টাডি করছিলো, নন্দিতাকে দেখে ফাইলগুলো সাইডে রেখে সোজা হয়ে বসে বেডে। অতঃপর দুইহাত বাড়িয়ে ভীষণ আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“কাম ফাস্ট”
সদ্য গোসল শেষ করে আধভেজা আলুথালু চুলে হাত চালাতে চালাতে নন্দিতা এগিয়ে যায় তুর্জয়ের কাছে। এই ডাক উপেক্ষা করার স্পর্ধা তার নেই। কিছু মানুষ হয় স্বল্পভাষী, অথচ তাদের প্রতিটা কথা হয় তীক্ষ্ণ ফলার মতো। যেটুকু বলে ওটুকুই যথার্থ। তারা একবাক্যে একশ শব্দ বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখে। তুর্জয়ও সেই প্রকৃতির মানুষ। অল্প কথায় তার অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করে সে। তার কথা মুখে কম ইশারায় প্রকাশ পেয়ে বেশি। এইযে এতো অল্প কথায় শুধু তাকে কাছে ডাকলো না, বরং ইশারা ইঙ্গিতে বোঝালো এখনই আমার বুকে এসো তুমি। অনেক হয়েছে দূরত্ব, এখন চুপটি করে বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকো। নিজেও শান্তি খুঁজে পাও আর আমাকেও শান্ত করো।
তুর্জয়ের বুকের মাঝে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে নন্দিতা। আর তুর্জয় বেডে হেলান দিয়ে তাকে আগলে ধরে রেখেছে। নিঃশব্দ বহু শব্দের বিচরণ চলছে তাদের মাঝে। একে অন্যের নিঃশ্বাসের শব্দে কতো কথা যে বলে চলেছে একমাত্র তারাই জানে।
আচমকা নন্দিতার ভেজা চুলে নজর পড়তেই খানিকটা রাগান্বিত কণ্ঠে তুর্জয় বলে,

“এই সন্ধ্যায় চুল ভেজানোর কী খুব দরকার ছিলো?”
নন্দিতার উত্তরের অপেক্ষা করল না সে। বরং হাত বাড়িয়ে বেডে পড়ে থাকা আধভেজা তোয়ালেটা তুলে নিলো। নন্দিতাকে সোজা করে বসিয়ে অপরিপক্ব ভঙ্গিতে দুইহাত দিয়ে আলতো হাতে মুছিয়ে দিতে থাকলো তার মাথা। নন্দিতা হেঁসে কুটিকুটি হয়ে ঢলে পড়ছে বারবার। আর তুর্জয় তাকে বারবার ঠিক করে বসিয়ে মাথা মুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
“আমার মাথার উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। চুলগুলো সুস্থভাবে বেঁচে ফিরলে হয়।”
হাসিতে গড়িয়ে পড়তে পড়তে নন্দিতার বলা কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তুর্জয়। জেদি কণ্ঠে বললো,
“ওঠো দেখি, ভালো করে চুলগুলো মোছাতে দাও। একদম বাচ্চামি করবে না।”
তুর্জয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই নন্দিতার ফোন বেজে উঠলো। নম্বর না দেখেই কলটা রিসিভ করে নন্দিতা। হাসির রেশ তার কাটেনি তখনও। হাসতে হাসতেই বললো,

“হ্যালো! কে?”
“হাসিটা বেশি মিষ্টি নাকি আপনার কণ্ঠে বলে বেশি মিষ্টি লাগছে?”
নন্দিতা থেমে গেল তৎক্ষণাৎ। নিজেকে সামলে নিয়ে কাঠকাঠ কণ্ঠে বললো,
“আপনার কল আশা করিনি।”
“আমাকেই বা কবে আশা করেছিলেন?”
“কথা শেষ?”
“নাহ, মাত্র শুরু। শুনলাম আজ সব।”
“তো?”
“ওয়েল ডান। আপনার মতো বাঘিনীর থেকে এমন কিছুই আশা করেছিলাম। কামব্যাকটা দারুন ছিলো।”
“শুধু এটুকুই শুনেছেন? আর কিছু শোনেননি?”
ধূসর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মলিন কণ্ঠে বললো,
“শুনেছি।”

“এখন নিজেকে অসভ্য, বর্বর, কাওয়ার্ড জাতির একজন বলে মনে হচ্ছে না?”
“একদমই না। বরং যাওয়ার আগে আপনার জন্য একটা গল্প রেখে যাচ্ছি। তাকে শোনাবেন, কেউ আপনাকে কতখানি ভালবাসতো। পূর্ণতা না পাক, গল্প হয়েই থেকে যাক নাহয় আপনার জীবনে।”
“বালাই ষাট। তার বাবা মায়ের প্রেমের গল্প শুনতে শুনতে তার গোটা জীবন ফুরিয়ে যাবে। পরপুরুষের কু দৃষ্টির গল্প তাকে আর নাই বা শোনালাম।”
“নন্দিতা!”
“নিজেকে ভিক্টিম প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন না। একজন বিবাহিত নারীর প্রতি উতলে পড়া প্রেমকে ভালোবাসা বলে না, বলে নোংরামি। আর আপনি তো সেই নোংরায় বাস করা একটা কিট, এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাও যায়না আপনার থেকে।”

“আপনাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসার ক্ষমতা আমার আছে, নন্দিতা। আমি চাইনি বলে আপনি আজও আপনার স্বামীর বুকে নিঃশ্বাস ফেলছেন। আপনাকে নিঃস্ব করে দেওয়ার ক্ষমতাও আমার আছে। করিনি বলে আজও আপনি পরিপূর্ণ। আপনার উপর আসা আঘাতগুলো আমি প্রতিহত করেছি বলে টেরও পাননি আপনি। আর আমার সেই ভালোবাসাকে আজ নোংরা বললেন আপনি। ভালোবাসা যদি পাপ হয় তবে অনুভূতি এলো কেন? শত্রুর বউকে ভালোবেসে নিজের ঘরের শত্রু হওয়ার মতো অপরাধে আমাকে কী শাস্তি দেওয়া যায় বলুন তো!”
ধূসরের কণ্ঠ কাঁপছে। নিজের অপমান সে মেনে নিয়েছে মুখ বুঁজে। কিন্তু তার নিখাদ ভালোবাসার অপমান মানবে কিভাবে? সে তো স্বার্থ খোঁজেনি। খানিকটা থেমে নিজেকে শান্ত করে আবারও বলল,
“আপনাকে পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াটাই আমি বেশি ভালোবাসি। কারন একজন দুঃখ পেলে তবেই অপরজন সুখ পায়। নিজের যন্ত্রণা সইতে পারবো, কিন্তু আপনার ভেঙে যাওয়া না।”

অস্বস্তিতে নন্দিতা এদিক সেদিক দৃষ্টি ফেরায়। ফোনটা সে স্পিকারে রেখে তুর্জয়ের বুকে মুখ গুঁজে কথাগুলো বলছিলো। কিন্তু ধূসরের শেষ কথাগুলোতে মুখ তুললো। আড়চোখে তাকালো থমথমে হয়ে থাকা তুর্জয়ের মুখের দিকে। তুর্জয় কী খুব বেশি কষ্ট পেল? তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। প্রসঙ্গ বদলাতে খানিকটা নরম সুরে নন্দিতা বললো,
“মা কেমন আছে?”
“ভালো আছেন এখন কিছুটা। শরীরে ক্ষত বেশ, প্রপার ট্রিটমেন্ট তো এই মুহূর্তে করা সম্ভব নয়। তবে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যাবেন।”
“কোথায় লুকিয়েছেন?”
“এভাবে বলা যাবেনা। কোনোভাবে যদি নম্বর ট্রাক করে ফেলে তাহলে প্রাণের ঝুঁকিটা শুধু আমার একার হবে, আম্মা বেঁচে যাবে।”
“আম্মা?”
ধূসর চওড়া হাসলো। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৭

“থ্যাংক ইউ আপনাকে। কিছু না দিয়েও অনেক কিছু দিয়েছেন আমাকে।”
কলটা কেটে গেছে। নন্দিতা লম্বা একটা শ্বাস ফেলে তুর্জয়ের দিকে তাকালো। ভীষণ শান্ত, বরফের মতো ঠান্ডা চোখে একঠাঁয় তাকিয়ে আছে সে নন্দিতার দিকে। শুকনো ঢোক গিলে নন্দিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো তুর্জয়। থমথমে কণ্ঠে বললো,
“আমাদের বেরোতে হবে।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৯