প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৯

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৯
ফিজা সিদ্দিকী

নন্দিতার শত বারণ সত্ত্বেও তুর্জয় গাড়ি বের করলো। কাঁদো কাঁদো মুখে নন্দিতা তুর্জয়ের দিকে তাকাতেই তার রুক্ষ, থমথমে মুখের উপর আর একটা বাক্য আগাতে পারলো না। চুপচাপ গিয়ে বসলো গাড়ির ফ্রন্ট সিটে। নন্দিতা বসতেই গাড়ি টান দিলো তুর্জয়।
দুজনের মাঝে কোনো কথা নেই। তুর্জয় তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটাও জানে না নন্দিতা। তবে তার ভয় করছে। ভয় করছে চারপাশের শত্রুদের। তুর্জয় যদি একবার বুঝতো, আশপাশে শত্রুরা কিভাবে ওত পেতে আছে তাদের জন্য। কিন্তু হায়! রাগ তার নাকের ডগায়, কে ভালো মন্দ আর বোঝায়!

নন্দিতা আড়চোখে একবার করে তাকাচ্ছে তুর্জয়ের দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে তার মুখভঙ্গি। কিন্তু তুর্জয় নির্বিকার। একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে সে। রাস্তা থেকে চোখ সরাচ্ছে না একপলকের জন্যও। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দিতা গাড়ির জানালায় মাথা রাখলো। ফুরফুরে, বেপরোয়া বাতাসের ঝাপটায় উবে গেল সকল দুশ্চিন্তা। মন খারাপের রেশ কেটে গিয়ে জানালায় মাথা এলিয়ে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো সে তুর্জয়ের দিকে। তুর্জয় চোখ ঘুরিয়ে তাকালো একবার। গাড়ির গতি কমাতে কমাতে রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এভাবে কী দেখছেন?”
“দেখিনি, ভাবছি।”
“তার মানে আপনি আমাকে দেখছিলেন না?”
নন্দিতা খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটদুটো ভিজিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো,
“আপনাকে দেখছিলাম। তবে ভাবছিলাম অন্যকিছু।”
“জানানো যায়?”
নন্দিতা হেঁসে ফেললো ফিক করে। এইযে এতক্ষণ তুর্জয় তাকে আপনি করে কথা বলছে, এমনটা তার গাঢ় অভিমানের প্রকাশ। পুরুষ মানুষের বুকে রাগ কিংবা অভিমান জমলে সেটা জমতে দিতে নেই। নাহয় হাওয়া বাতাস পেয়ে পুরু আস্তরণ জমে যায়, এরপর তার উৎখাত করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
আচমকা তুর্জয়ের দুই হাতের মাঝে মাথা গলিয়ে তার বুকে মাথা রাখলো নন্দিতা। নিঃশব্দে শুনতে থাকলো নিরলস ভঙ্গিতে ওঠানামা করতে থাকা তুর্জয়ের হৃদস্পন্দন। তুর্জয় কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

“উঠুন বলছি। পেটে ব্যথা পাবেন। একবিন্দু অসাবধান হওয়া চলবে না আপনার। আপনার মধ্যে এখন আমার ডাবল প্রাণ।”
নন্দিতা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সন্ধিহান কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“মানুষের প্রাণ তো একটাই হয়, আপনার ডাবল প্রাণ কিভাবে?”
“উহু, মানুষের প্রাণ হয় দুটো। একটা আত্মিক আর একটা শারীরিক। এতদিন আত্মিক প্রাণটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের মাঝে বন্দী করে রেখেছিলেন, আর এখন তো শরীরে ধুকপুক করে স্পন্দিত হওয়া এটাকেও ছাড় দিলেন না, নিষ্ঠুর মানবী।”
“আমি নিষ্ঠুর?”

“অবশ্যই। বাংলার বেগম আজিমুন্নেসা যেমন শিশুদের কলিজা খেতেন, আপনি খান আমার প্রাণ।”
“ইশ! এসব উল্টা পাল্টা কথা বললে আমি এখনই নেমে যাব গাড়ি থেকে। মুখে লাগাম টানুন, এগুলো কেমন কথা?”
তুর্জয়ের মেজাজ এখন খানিকটা শান্ত। নন্দিতাকে রাগিয়ে দিয়ে এখন তার মেজাজ বেশ ফুরফুরে লাগছে। সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে ঠোঁটে সামান্য হাঁসি ঝুলিয়ে ফিসফিস সুরে তুর্জয় বললো,
“লাগামটা শুধু মুখেই টানতে বলেছেন কিন্তু, বাকি সবকিছুতে লাগামছাড়া হওয়া যায় তবে।”
নন্দিতা ভ্রুকুটি করে তুর্জয়ের দিকে তাকিয়ে সরে এলো নিজের জায়গায়। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
“গাড়িটা চালান ঠিকঠাক, আর যে জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে জলদি চলুন।”
“জানতে চাইবে না কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?”
“নাহ”
“প্রশ্ন জাগছে না?”
“জাগছে।”
“তাহলে জিজ্ঞাসা করো।”

“উহু, যে মানুষটার হাত ধরে আমাকে পরপারে যেতে হবে, সেই মানুষ আমাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করতে নিয়ে গেলেও আমি হাসতে হাসতে চলে যাব।”
তুর্জয়ের হাসি হাসি মুখটা থেমে গেল সহসাই। আগের মত থমথমে করে গাড়ির গতি বাড়ালো। নন্দিতা তুর্জয়ের বাহুর উপর আলতো করে হাত রেখে বলল,
“এভাবে রেগে যাচ্ছেন কেন?”
“রাগ নেই।”
“শুনুন না, আমাকে আজ কিছু দিলেন না আপনি?”
“কী চাইবে বলো। আজ তুমি যেটাতে হাত রাখবে, সেটাই তোমার।”
“কথা দিচ্ছেন?”
“দিচ্ছি”
“ভেবে দেখুন আর একবার।”

“দ্বিতীয়বার ভাবার প্রশ্ন ওঠে না। আমি আজ এ ভুবনের সর্বোচ্চ সুখী মানুষ, এই সুখ অসুখের মতো ছড়িয়ে পড়ুক গোটা দুনিয়ায়। রক্তের প্রতিটা কণিকা জানুক আমি বাবা হতে যাচ্ছি। প্রতিটা রোমকূপ আন্দোলিত হোক এই খুশির জোয়ারে। আমাকে ছুঁয়ে যাওয়া বাতাসও ঈর্ষা করুক, নজর ফিরিয়ে দেখুক আমার সুখ।”
নন্দিতা অপলক চেয়ে রইলো তুর্জয়ের দিকে। ঠিক সেসময়ই তার হাতে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো। স্ক্রিনের উপরে ভেসে ওঠা নামটা দেখে বিরক্তিতে ফোনটা রেখে দিলো পাশে। অতঃপর তুর্জয়ের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বললো,
“যদি কখনো আমি না থাকি, আপনি বাঁচবেন। নিজেকে সর্বোচ্চ ভালো রাখার চেষ্টা করবেন, নিজের জন্য বাঁচবেন। কথা দিন।”

তুর্জয় মারাত্মক রকম রেগে গেল নন্দিতার এমন কথা শুনে। রাগান্বিত স্বরে খানিকটা ধমকের সুরে বলল,
“অযথা আমার মেজাজ খারাপ না করলে চলে না আপনার? এসব প্রলাপ কেন বকছেন আপনি?”
“মানুষ তো চিরদিন বাঁচে না। ধরুন যদি কখনও এমন হলো…”
“স্ত্রীর শোকে স্বামী বেপরোয়া, উন্মাদ হবে, ব্যাপারটা বড্ডো বেমানান। এরচেয়ে বরং স্বামীর শোকে স্ত্রী উন্মাদ হোক, পাগল হোক।”
তুর্জয়ের কথাটা ধরতে পেরে নন্দিতা চোখ রাঙ্গালো। রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“গাড়ি থামান আপনি। এখনই থামান।”
তুর্জয় আচমকা ভড়কে গেল নন্দিতার ব্যবহারে। এতো হঠকারিতা করার মেয়ে সে নয়। ভীষণ শান্ত মস্তিকে সব পরিস্থিতি সামাল দিতে জানে সে। অথচ আজ তাকে লাগছে উন্মাদ, মরিয়া। গাড়ি না থামিয়ে তার বাম হাত বাড়িয়ে নদনতার গাল ছুঁয়ে দিয়ে ভীষণ আদুরে সুরে তুর্জয় বললো,
“তোমার কি খারাপ লাগছে? বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি? এই দেখো কান ধরছি আমি, আর বলবো না এসব। শান্ত হও প্লীজ সোনা।”

কথাটা বলতে বলতে তুর্জয় সত্যিই একহাতে নিজের কান ধরলো। কিন্তু তবুও শান্ত হলো না নন্দিতা। বরং আগের চেয়ে আরও উগ্রভাবে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত মারতে মারতে বললো,
“গাড়ী থামাতে বলছি না আমি? কথা শোনা যায়না?”
তুর্জয় এবার তাই করলো। গাড়ী এক সাইডে করে নন্দিতার দিকে ফিরে তাকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় খানিকটা উগ্র মেজাজে নন্দিতা বললো,

“পানি আনুন। আরও যতো ধরনের খাবার পাওয়া যাবে আশেপাশে সব আনুন। আমার খিদে পেয়েছে খুব।”
আচমকা নন্দিতার মেজাজের পরিবর্তনে ভীষণ রকম অবাক হচ্ছে তুর্জয়। তবুও বিনাবাক্য ব্যয়ে বেরিয়ে পড়ল সে গাড়ি থেকে। যাওয়ার আগে নন্দিতা তাকে একবার পিছু ডাকলো। বড্ডো কাতর কন্ঠে বললো,
“আমাকে দেওয়া প্রথম আর শেষ কথাটা রাখবেন কিন্তু!”
তুর্জয় কিঞ্চিৎ হেসে ব্যাঙ্গ করে বলল,
“খিদেতে তোমার মাথা ঠিক নেই। আমি এসে তোমার সঙ্গে হিসেবটা বুঝছি দাঁড়াও।”
তুর্জয় আর অপেক্ষা করল না। ছুটলো সে বড় রাস্তা পার হয়ে ওপাশের ফুটপাতের দিকে। মনে মনে ভেবে নিলো এসব প্রেগনেন্সির সময়ের মুড সুইং। নন্দিতা ফ্রন্ট মিরর দিয়ে তাকালো পিছনে তাদের থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আরও দুটো গাড়ি। এই গাড়িটা বহুক্ষণ ধরে ফলো করছিলো তাদের। নন্দিতা নিজেও ব্যাপারটা খেয়াল করতো না, যদি ধূসর না তাকে জানাতো।
পাশ থেকে ফোনটা কোলে তুলে নিয়ে সে আবারও চোখ বোলালো স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ম্যাসেজটার দিকে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা গুটিকয় শব্দ,

“নন্দিতা, আপনি এত বড় ভুল কিভাবে করলেন? বারণ করেছিলাম আপনাকে গাড়ি নিয়ে বের হতে। আপনাদের গাড়িতে বম্ব, টার্গেট আপনি। পিছনে ফলো করা দুটো গাড়িতে শিকদারের লোক। আপনাদের মারার পুরো প্ল্যানিং নিয়ে বের হয়েছে ওরা। আপনি ভুল করেছেন, বড্ডো ভুল। নেমে পড়ুন গাড়ি থেকে, এখনই।”
নন্দিতা সিটে গা এলিয়ে দিলো। চোখের কোল বেয়ে তার জল গড়িয়ে পড়ছে। ডান হাত পেটে আলতোভাবে ছুঁয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“আমাকে মাফ করে দিস জুনিয়র। আমি তোকে বাঁচাতে পারলাম না। তোকে এমন পরিস্থিতিতে আমার গর্ভে আনতেই চাইনি। কিন্তু তোর যে বড্ডো তাড়া ছিল আমাদের কাছে আসার, এতো তাড়াহুড়ো কেন করলি জুনিয়র? মাফ করে দিস তোর মাকে। সে পারল না তোকে রক্ষা করতে, পারলো না তোকে বাঁচাতে।”

পানির বোতল হাতে নিয়ে তার বিল পরিশোধ করছিলো তুর্জয়, এমন সময় জোরালো এক শব্দ পেয়ে দোকান থেকে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকালো সে। সামনে তাকাতেই থম মেরে গেল। ভুলে গেল পা নাড়াতে পর্যন্ত। থরথর করে কাঁপতে থাকা হাত থেকে পড়ে গেল খাবারের প্যাকেট আর সদ্য কেনা পানির বোতলটা। উন্মাদের মতো ছুটে যেতে চাইলো আগুনের লেলিহান শিখায় দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা তার গাড়িটার দিকে। কয়েকজন লোক মিলে দৌড়ে এসে জাপটে ধরলো তাকে। তুর্জয় তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লোকগুলোকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। পাগলের মতো হাত পা ছুঁড়ে বলে উঠলো,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৮

“ওখানে আমার নন্দিতা আছে, আমার বাচ্চা আছে। আমাকে যেতে দাও ওর কাছে। আমার প্রাণটা ব্যথা পাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে সে। ডাকছে আমাকে। আমার বাচ্চাটা চিৎকার করছে, আমাকে খুঁজছে। আমাকে যেতে দাও। দোহাই লাগে তোমাদের, আমাকে যেতে দাও। ওরা কষ্ট পাচ্ছে খুব।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫০