প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫
ফিজা সিদ্দিকী

ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকাতেই আঁতকে ওঠে তুর্জয়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে প্রায়। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করতে করতে সবেমাত্র বারোর ঘর ছুঁলো। শরীর জুড়ে চ্যাপচ্যাপে ঘামের আস্তরণ। পরনের শার্টটাও খুলে পাশে রাখা। বিছানা এলোমেলো, শরীর জুড়ে ক্লান্তির ছাপ। পিটপিটে চোখ খুলে অদূরে দাঁড়ানো নন্দিতাকে সদ্য গোসল করে চুল মুছতে দেখে শুকনো ঢোক গেলে তুর্জয়। চোখাচোখি হতেই দুষ্টু এক হাসি উপহার দেয় নন্দিতা। তৎক্ষনাৎ ঝট করে উঠে বসে তুর্জয়। সাথে সাথে পিঠের ব্যাথাগুলো তাদের উপস্থিতি জানান দিয়ে মুষড়ে ওঠে। মাথাটাও ভীষণ রকম ভার।
নন্দিতা দ্রুত এগিয়ে আসে। কাছে এসে তুর্জয়ের বাহু ধরে বসানোর চেষ্টা করতেই খানিকটা পিছিয়ে যায় সে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“ছোঁবেন না আমাকে। লাগবে না কারোর সাহায্য।”
“ছুঁতে ছুঁতে আপনি আমাকে সর্বোচ্চ ছুঁয়ে দিলে বেশ, আর আমি একটু ছুঁতে গেলেই পাপ?”
নন্দিতার কথায় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় তুর্জয়। সামান্য কেশে আগের মতই গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এগুলো কী ধরনের মশকরা? অযথা আমি আপনাকে কেন ছুঁতে যাব? আমার এতো দায় পড়েনি।”
“দায় না পড়ুক, প্রয়োজন তো পড়েছিল। তাইতো গোটা রাত আমাকে একটুও ঘুমাতে দেননি। নিজের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, যেন দুটো নয় একটাই মানুষ শুয়ে।”
“নাহ নাহ নাহ। এটা হতে পারে না। আপনাকে একটা মেয়েকে এভাবে… সম্ভব নয়। কখনোই না। আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, আমি আপনাকে এভাবে!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তুর্জয়ের ভিতিগ্রস্থ, অপ্রাসঙ্গিক, ঘাবড়ে যাওয়া কণ্ঠ শুনে দারুন মজা পেল নন্দিতা। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের হাসি চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে খানিকটা এগিয়ে গেল তুর্জয়ের দিকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
“নাহলে এতো সকাল সকাল গোসল করার মেয়ে নাকি আমি? যাইহোক, রাতটা সুন্দর ছিল, আর আপনার সবকিছুও।”
হনহনিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল নন্দিতা। তুর্জয় বেশ কয়েকবার পিছু ডাকলো তাকে। কিন্তু তার ডাককে তাচ্ছিল্যভাবে তুড়ি উড়িয়ে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তুর্জয় বিছানা ছেড়ে তার পিছু নিতে চাইলো। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজের চ্যাপচ্যাপে ঘর্মাক্ত আধাকা শরীরের দিকে তাকিয়ে করুণ মুখে তাকালো দরজার দিকে। অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

“আপনাকে আমি দেখে নেব। আমার হুঁশে না থাকার সুযোগ নিয়ে এভাবে পাকাপাকিভাবে নিজের আস্তানা গেঁড়ে বসবেন, আমি সেটা কখনোই হতে দেব না।”
নন্দিতার পিছু নেওয়ার চেয়ে এখন সবচেয়ে ফরজ কাজ হলো গোসল করা। তাই তুর্জয় আর দেরী না করে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সেই কাজে। যাওয়ার আগে খোলা দরজার দিকে একবার রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে অবশ্য ভুললো না।
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে হেসে যাচ্ছে নন্দিতা। এতক্ষণের চেপে রাখা হাসিগুলো যেন ফুরফুর করে বের হচ্ছে তার পেট থেকে। এমন এক ভঙ্গিতে পেটে হাত চেপে হাসছে সে। হাসতে হাসতেই তার দুই চোখ ছাপিয়ে খানিকটা জল গড়িয়ে পড়লো গালে। হাসি থামিয়ে বামহাতে চোখ মুছে মৃদু কন্ঠে আওড়ালো,

” আপনাকে আমি এভাবে পেতে চাইনা। যতক্ষণ না নিজে থেকে আপনি আমাকে চাইছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার এক ফোঁটা সান্নিধ্যও আপনি পাবেন না।”
খাবার টেবিলে নাস্তা সাজাতে ব্যস্ত নন্দিতা। যদিও বাড়িতে তারা শুধু দুইজনেই। তাও বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে নাস্তার টেবিল সাজায় সে। এরপর একটা প্লেটে বেশ সুন্দর করে ডেকরেট করে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলে। তারপর সেটা ফেসবুকে পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখে,
“ঘুম থেকে উঠেই যদি দেখি জামাই এতো সুন্দর করে নাস্তা গুছিয়ে রেখেছে, সেই জামাইকে একটা, দুইটা না, বরং ননস্টপ চুমু খেতে মন চায়।”

পোস্ট ডান করার পর ফোনটা রেখে পাশে তাকিয়ে দেখে তুর্জয় তার পিছনে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকটা দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে তার ফোনের দিকে। নন্দিতা তাড়াতাড়ি ফোনটা লুকিয়ে নেয় পিছনে। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
“অন্যের ফোনের দিকে এভাবে উঁকিঝুঁকি মারা ব্যাড ম্যানার্স”
“আমি অন্য কারোর ফোন দেখছিলাম না, আমি তো আমার…..”
“আপনার?”
“কিছুনা”
“না না কিছু মিছু তো একটা। বউ বলে মানেন আমাকে?”
“কখনোই না” তুর্জয়ের ঝটপট উত্তর।
“তাহলে আমি ফোনে কারোর সাথে চ্যাট করি নাকি অন্যকিছু করি এসব এতো উঁকিঝুঁকি কিসের আপনার? মিস্টার হাসবেন্ড কি জেলাস?”

শেষোক্ত কথাটা বলতে গিয়ে কিঞ্চিৎ হাসে নন্দিতা। এই কথার সাথে নন্দিতার হাসিটা যেন আগুন ঘী ধালার মতো কাজ করলো। রাগী কণ্ঠে তুর্জয় বললো,
“শুধু চ্যাট কেন, আপনি পার্কে বসে বা কারোর বাইকে চড়ে ঘুরতে গেলে, প্রেম করলেও আমার কিছু যায় আসে না। মা আমার জন্য বউ পাঠালেও আপনি আমার কাজের লোক হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখেন। এর বেশি কিছু না।”
নন্দিতা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে তুর্জয়ের করার পিঠে। হাসতে হাসতেই বলে,
“যাক, নিজের তবে স্বীকার করলেন, আমি কাজের লোক। কিছু কাজে কামে আসি তাহলে লোকের। আপনার মতো দিনরাত শুধু খাইনা বসে বসে।”

“আমি বসে বসে খাই?” তুর্জয়ের কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট।
“নো ডাউট। খাবার না পেলে মাঝে মাঝে আমার মাথাটাও খান চিবিয়ে চিবিয়ে।”
“কে কার মাথা কতটুকু খায়, সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। এমন খাওয়া খেয়েছেন যে কাজ কাম ফেলে আমাকে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে ঘরে বই থাকতে হচ্ছে। অসহ্য।”
“কাল রাতে যে কতবার আপনি আমার ঠোঁটগুলো খেলেন, আরও কতকিছু যে….”
“স্টপ।” তুর্জয়ের মৃদু চিৎকারে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করে যায় নন্দিতা। তুর্জয়ও একপলক সেদিকে তাকিয়ে চেয়ার টেনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে খাবার খেতে। আচমকা ঠোঁটে আঙুল।চেপে ধরা অবস্থায়ই শব্দ করে হেসে ওঠে নন্দিতা। হাসতে হাসতে বসে পড়ে সে পাশের চেয়ারে। তুর্জয় চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে তাকে। অতঃপর হাসতে হাসতেই কোনক্রমে নন্দিতা বলে,

“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে খাবার নয়, আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছেন। বেচারা দাঁতগুলো।”
নন্দিতার বেপরোয়া হাসিতে রীতিমত বিরক্ত তুর্জয়। রাগী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“কথায় কথায় পাগলের মতো হাসতেই পারবে শুধু, ওটুকুই হবে শুধু তোমার দ্বারা। কি দেখে যে এই শো পিসটা মা আমার গলায় ঝোলালো! বিরক্তিকর।”

রাগের মাথায় তুর্জয়ের তুমি ডাক ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে আনলো নন্দিতার। খামখেয়ালী মনে হাসতে হাসতেই নাস্তার প্লেট টেনে নিলো সে নিজের দিকে। তুর্জয় হতবাক। এমন কথার পিঠেও যে কেউ ঠোঁট এলিয়ে হাসতে পারে, তার জানা ছিল না। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে মেয়েটার কাছে গিয়ে সামনে থেকে ছুঁয়ে দেখতে। আদতে মানুষ তো!
নাস্তা করে আসার পর থেকেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে বেশ কিছু কিসের ফাইল ঘাটাঘাটি করছিলো তুর্জয়। নন্দিতা কখনও এ ঘর তো কখনও ও ঘরে ঢু মারছে। কখনও আবার রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে খানিকটা সময় পায়চারি করে কিছু একটা ভাবছে। তবুও কোনমতে তুর্জয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলো না। সে এমনভাবে কাগজপত্রে ডুবেছে, যেন ওটাই বিয়ে করা তার সুন্দরী বউ। যেখান থেকে নজর ফেরানো বারণ। বিরক্তিতে তপ্ত শ্বাস ফেলে ধুপধাপ পা ফেলে এবার ঘরে ঢুকলো নন্দিতা। তাও তুর্জয়কে তার দিকে ফিরে তাকাতে না দেখে কানে ফোন চেপে ধরে বেসুরো কণ্ঠে গাইতে শুরু করলো,

“তুমিই আমার জীবন,
আমার অন্য কোথাও যাওয়া বারণ।
ওগো প্রেমিক, তোমার ঠোঁটের চুমু ,
আমি আর কত খামু।
এবার শুধু কাছে আসো,
একটু ভালোবাসো।
তোমার আদরে লাগে সেকি
আমার আম্মু ডাক বাকি।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪

তুর্জয় ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকায়। নন্দিতা পুরো ঘরে টহল দিতে দিতে তার সামনে দিয়ে চলে গেল ব্যালকনিতে। ফাইলটা সাইডে রেখে তুর্জয় বিছানা ছেড়ে উঠলো। এরপর সোজা চলে গেল ব্যালকনিতে। তুর্জয়কে এগিয়ে আসতে দেখেও নন্দিতা আগের মতোই রসিয়ে রসিয়ে গান গাওয়ার কাজ জারি রাখলো। এদিকে তুর্জয় কোনোদিকে না তাকিয়ে নন্দিতার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে ঘরের মধ্যে আনলো। অতঃপর ঝট করে হাত রাখলো তার টি শার্টের প্রথম বোতামে।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬