প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫০

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫০
ফিজা সিদ্দিকী

জল বিনা মাছ যেমন তড়পায়, তুর্জয়কে দেখতে ঠিক তেমনই লাগছে। বাতাসে বিদ্যমান ভুরি ভুরি অক্সিজেনের মাঝেও ফুসফুসে অক্সিজেন পাচ্ছে না সে। গাল হা করে নিঃশ্বাস টেনে নিতে ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে হাত পা ছুঁড়ে সবাইকে ঠেলে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। আশেপাশের লোকজন মিলে বহু কষ্টে আটকে রেখেছে তাকে। কিছু কিছু মানুষের চোখের কোলে জল চিকচিক করছে। কে বলেছে পুরুষ ভালোবাসতে জানে না? কে বলেছে পুরুষের ভালোবাসা অগভীর? পুরুষ তার গোটা জীবনে জন্মদাত্রী ব্যতীত একজন নারীকে ভীষণ রকম ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা হয় সমুদ্রের চেয়ে গভীর, খাঁটি হীরার চেয়ে নিখাদ। সেই নারীমূর্তি যে সবসময় জীবনসঙ্গিনী হয়, এমনটা না। পুরুষরা প্রেমে পড়ে, গোটা জীবনে তারা একবারই প্রেমে পড়ে, এরপর বাকি জীবন তারা মোহে পড়ে, মায়ায় পড়ে। কিন্তু প্রেমে আর পড়ে না।

ঘোলা বাতাসের দাপুটে ঝাপটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে রাস্তার ওপারের গাড়ীটায়। সেই আগুনের লেলিহান শিখাটাও বোধহয় প্রেমিকের জ্বলন্ত বুকের আঁচের চেয়ে কম। থার্মোমিটারে তাপমাত্রা মাপতে গেলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলবে বোধহয় দুইজনের, কার উষ্ণতা বেশি এ বিষয়ে।
আচমকা হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো তুর্জয়। দাপাদাপি করতে করতে শরীর তার ভেঙে এসেছে। অদূরের আগুনের শিখাও কমে এসেছে অনেকখানি। স্থানীয় কিছু মানুষ পানি ঢালছে বালতি বালতি। তুর্জয় জমিনে মাথা ঠেকালো। তাকে ধরে রাখা হাতগুলোও আলগা হয়ে এলো অনেকখানি। তারাও বোধহয় বুঝেছে, মানুষটার শক্তি শেষ পর্যায়ে পৌঁছে ভীষণ রকম দূর্বল। দুই হাত জমিয়ে রেখে সিজদায় যাওয়ার মতো করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তুর্জয়। অবশিষ্ট সবটুকু শক্তি দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো। বড্ডো ধীর, ক্লান্ত কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হে জমিন, তুমি ওদের গ্রহণ কোরো না; ফিরিয়ে দাও আমার কাছে। তোমার তো সব আছে; আমি নিঃস্ব, আমি সর্বহারা। আমি তো সবেমাত্র বাবা হওয়ার অনুভূতির সাথে পরিচিত হলাম। এখনও আমার সন্তানকে অনুভব করা বাকি, তাকে দেখা বাকি, তার ছোট ছোট হাত পা নিয়ে খেলা বাকি। হে রব, তুমি তোমার কারিশমা দেখাও, আগুন ফাঁক করে ওদের ফিরিয়ে আনো আমার কাছে। ফিরিয়ে দাও না খোদা ওদের। আমার প্রাণ, আমার জীবন সবটুকু যে মানুষটার মাঝে, তুমি কিভাবে তাকে কেড়ে নিতে পারো আমার থেকে? তুমি পারো না। পারো না তুমি তাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে। আমাকে ডেকে নাও তোমার কাছে, তবুও আমার দুই প্রানকে এভাবে চোখের সামনে শেষ হতে দেখার মতোও দুর্ভাগা বানিও না। আমার যন্ত্রণা হচ্ছে, ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, কলিজাটা টেনে হেঁচড়ে বের করে নাও খোদা। এখানে এত কেন যন্ত্রণা হচ্ছে? আমাকে মৃত্যু দাও, তবু এই যন্ত্রনা দিও না। ”

পুড়ে ছাই হওয়া গাড়ির কাছে এক পা দুই পা করে এগিয়ে গেল তুর্জয়। আগুন নিভে গেছে পুরোপুরি। তবুও আগুনে ঝলসে যাওয়া বাতাস ভীষণ গরম। গা পুড়ে যাচ্ছে যেন। পাগলের মতো ছুটে গেল তুর্জয়। সদ্য নিভে যাওয়া ঝলসানো ভস্মের মাঝে দুইহাত ডুবিয়ে কি যেন খুঁজছে। তাপে পুড়ে ছাই এখনও গরম। গাড়ির অংশবিশেষ যা কিছু বেঁচে আছে, সবকিছু থেকে আগুনের লাভা বের হচ্ছে। অথচ সেসবের কিছু তোয়াক্কা নেই তার। উন্মাদের মত দুই হাত ডুবিয়ে খুঁজছে সে, ঠিক যেমন করে অনাহারী কঙ্কালসার মানুষ খাবার খোঁজে ডাস্টবিনে।
রাস্তার ওপারে দাঁড়ানো কয়েকজন লোক এগিয়ে এলো তুর্জয়ের কাছে। বাকিরা কেউ নির্লিপ্ত চোখের পানি ঝরাচ্ছে এই দৃশ্য দেখে, কেউ কেউ এই মর্মান্তিক ঘটনা ক্যামেরাবন্দী করছে শত শত ভিউ আর ট্রেন্ডিংয়ে আসার জন্য। কারোর চোখে সত্যিই মায়া, দুঃখ, ব্যর্থতা। লোকগুলো আছে আসতেই বেপরোয়াভাবে তাদের দিকে রুখে দাঁড়ায় তুর্জয়। গর্জে উঠে বলে,

“বেঁচে থাকতে তো ছুঁতে দিলি না, ধরতে দিলি না, বাঁচাতে দিলি না, পোড়া লাশটা তো খুঁজতে দে।”
লোকগুলো সরে গেল কয়েক কদম। যন্ত্রণার রেশ তাদের চোখে মুখে স্পষ্ট। তন্মধ্যে একজন মধ্যবয়সী লোক ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তোমার হাতে তাপ লাগছে। এমন পাগলামি কোরো না। সরে এসো।”
তুর্জয় আগের মতোই পোড়া অংশ এদিক সেদিক সরাতে সরাতে বললো,
“ওদেরও তাপ লেগেছে, নাজানি কতো কষ্ট পেয়েছে আমার প্রান! কতবার ডেকেছে আমাকে! আমি আসিনি, আমি সাড়া দিইনি। আমার প্রাণটা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে শেষ হয়েছে। আমার তাপ লাগুক, আরও তাপ লাগুক। ঝলসে যাক আমার এই দুটো হাত, যে হাত বাড়িয়ে আমি আমার প্রানকে রক্ষা করতে পারিনি।”
উদ্ধার টিম এসে গেছে ততক্ষনে। এসেছে পুলিশও। স্থানীয় লোকরা খবর দিয়েছিলো তাদের। তুর্জয়কে সরিয়ে জায়গাটা সিল করে দেয় তারা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তুর্জয় ছুটে চলে যায় সেখানে। একজন পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“দেখুন না, আমার স্ত্রী, আমার প্রানটা ওখানে আছে গাড়ির মধ্যে। ওকে বের করে আনুন না প্লীজ। ওর কষ্ট হচ্ছে, যন্ত্রণা হচ্ছে। ব্যথা পেলে আমার বুকে মাথা রেখে ওর মাথায় বিলি কেটে না দিলে ঘুম আসে না ওর। ওকে বের করে দিন না। আমার বুকে আসার জন্য ছটফট করছে আমার প্রাণটা।”
অফিসার তুর্জয়ের কাঁধে হাত রেখে ভীষণ কোমল কণ্ঠে বললেন,
“শান্ত হন। নিজেকে শক্ত করুন। আপনার স্ত্রীর বডি পাওয়া শনাক্ত করা যাচ্ছে না। গাড়িতে ব্লাস্ট হয়েছে, সম্ভবত তার দেহ অবশিষ্ট নেই কিছু। এই একটা ওড়না পেয়েছি শুধু আমরা।”
অর্ধেক পোড়া নীল রঙের ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে ধপ করে বসে পড়ে তুর্জয় রাস্তায়। শেষ বেলায় গগনবিদারি চিৎকারে “নন্দিতা” বলে লুটিয়ে পড়ে সেখানেই।

চোখ মেলতেই চারিদিকের সাদা ধবধবে সবকিছু বড্ডো চোখে লাগলো তুর্জয়ের। সিলিং থেকে শুরু করে দেয়াল, সব জায়গা সাদায় মাখামাখি। চারপাশ থেকে কেমন গা গোলানো অদ্ভূত এক গন্ধ ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে ভালোভাবে নিজের চারপাশে তাকাতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো হসপিটালে। চারপাশ থেকে ভেসে আসা সেই উদ্ভট গন্ধটা ফিনাইলের। চোখ মেললেও তন্দ্রা কাটেনি তার পুরোপুরি। এখানে কিভাবে এলো মনে করছে পারছে না সে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই মাথার পাশে তুহিনা বেগমকে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সেদিকে। তার থেকে খানিকটা দূরে বসে আশরাফ সাহেব। হাত, পা নাড়াতে গিয়ে ভীষণ জ্বালা যন্ত্রনা টের পেতেই ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো তুর্জয়। মনে পড়ে গেল তার ফেলে আসা সবকিছু। দুই হাতে প্যাঁচানো ব্যান্ডেজ নিয়েই উঠে বসার বৃথা চেষ্টা চালাতে চালাতে তুহিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“মা, তোমার মেয়েটাকে দেখলে? ওরা আমাকে দেখতে দিচ্ছে না একটুও। ভাবছে আমি মনে হয় ভয় পাব। তোমার মেয়েটাও কি পাজি ভাবো, ওর শরীর একটু পুড়ে গেছে বলে কী আসবে না আমার সামনে? ওর পুরো শরীর পুড়ে গেলেও আমি ওকে ভালোবাসি। ওকে আমার সামনে আসতে বলো না। আমি একটুও ভয় পাব না, নিয়ে আসো না ওকে।”
তুহিনা বেগম আঁচল মুখে চেপে কেঁদে উঠলেন হু হু করে। ছেলেটাকে কিভাবে বোঝাবেন তিনি, মেয়েটা যে আর নেই। তার দেহের একটা অংশও আর অবশিষ্ট নেই। কিভাবে বুঝ দেবেন তিনি ছেলেকে জানেন না। তবুও বহু কষ্টে তাকে সামাল দিতে চট করে বলে বসলেন একটা মিথ্যা কথা।
“তুই আগে সুস্থ হ, ও পাশের ঘরেই আছে। তুই সুস্থ হলে আসবে এখানে।”

তুর্জয় বোধহয় খুব একটা বিশ্বাস করলো না তার কথা। তাইতো ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো পোড়া হাত, পা নিয়েই উঠে বসলো। ধীরে ধীরে পা ফেলে রাখলো মেঝেতে। হাতের চেয়ে পায়ের পোড়া নিতান্তই সামান্য, তাও কেন যে এই মোটা মোটা ব্যান্ডেজ প্যাঁচিয়ে রেখেছে ডাক্তার কে জানে? আশরাফ সাহেব উঠে এসে ধরলেন ছেলেকে। বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলেন তাকে নানাভাবে। কিন্তু বদ্ধ উন্মাদের মতো খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে। হাতড়াতে হাতড়াতে ধাক্কা দিলো পাশের কেবিনে।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৯

তারপর তারপর একে একে সবগুলো কেবিন চেক করছে সে। তার পিছু ছুটছেন আশরাফ সাহেব আর তুহিনা বেগমও। ছেলেকে ধরে রাখার আজ তাদের সাধ্যি নেই। সবকিছু উপেক্ষা করে সে উন্মাদের মতো খুঁজে চলেছে একজনকে। তাকে না পাওয়া পর্যন্ত এই যাত্রার রেহাই নেই।
ডাক্তার ছুটে এলেন। সাথে এলেন আরও দুইজন নার্স। জোর করে তার বাহু চেপে ধরে সাথে সাথেই একটা ইনজেকশন পুশ করলেন তুর্জয়ের শরীরে। খানিকটা সময় উগ্র মেজাজে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থেকে সাথে সাথেই কেমন যেন চোখ ভারী হয়ে এলো তার। ভেঙে এলো পা।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫১