প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫১

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫১
ফিজা সিদ্দিকী

অন্ধকার কুকাপ ঘর। কোথাও একটুকরো আলোর ছিটে পর্যন্ত নেই। সামনে একহাত দূরে দাঁড়ানো মানুষটাকে ঠাহর করতে পারা দায়। তবুও অন্ধকারেরও নিজস্ব একটা আলো আছে বোধহয়। আছে একটা কিরণ, তাইতো অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে স্পষ্ট বুঝতে পারি আশেপাশের জিনিস। কিন্তু এই জায়গার অন্ধকার যেন একটু বেশীই গাঢ়। কেমন গিলতে আসছে যেন।
ব্যাথাতুর শরীর নিয়ে নড়াচড়া করার চেষ্টা করলো নন্দিতা। কিছু হায় একপাশ থেকে অন্যপাশ পর্যন্ত হওয়ার ক্ষমতা নেই তার। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে শুধু আওড়ালো,
“পানি, একটু পানি।”

সাথে সাথেই এগিয়ে এলো দুটো হাত। খুব যে সভ্য ভদ্রভাবে এগিয়ে এলো এমনটা নয়। বরং একহাতে তার চুলের মুঠি ধরে অন্যহাতে দ্রুতবেগে ঢালতে লাগল জগ ভর্তি পানি। পানির সবটুকু নন্দিতার গাল বেয়ে গলা, গলা বেয়ে শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তৃষ্ণা মেটার মতো পানি তার কণ্ঠনালীতে পৌঁছাচ্ছে না। নন্দিতা বহু চেষ্টা করে কয়েকটা ছোট ছোট ঢোক গিলতে পেরেছে, যেটা তার মরুভূমি সম তৃষ্ণার কাছে নিতান্তই সামান্য। অবশেষে হাল ছেড়ে কেমন দম ফুরিয়ে আসার মতো নিঃশ্বাস নিতে থাকলে সামনে থাকা লোকটা ছেড়ে দিয়ে তাকে।
চুলের মুঠি ধরে থাকায় এতক্ষণ নিচানা থেকে উপরে উঠেছিল সে। ছেড়ে দিতেই ধপাস করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। শরীরে কোনো বল নেই। মনে নেই জোর। কেমন যেন কাতরতা ভরা কণ্ঠে কুচি একটা বলতে চাইছে, কিন্তু মুখ থেকে আসছে না একটা শব্দও।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চোখ বুঁজে ফেলল নন্দিতা। মনে করার চেষ্টা করলো সে এখানে কিভাবে? শেষ মুহূর্তে যখন তুর্জয় গাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছে, নন্দিতা গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু যাওয়ার আগে গাড়ির দরজা লক করে দিয়ে গেছে তুর্জয়। তার সেফটির কথা চিন্তা করে এই কাজ করলেও এটাই হয়ে যায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাল। শত ধাক্কা দিয়েও নন্দিতা যখন গাড়ির দরজা খুলতে ব্যর্থ হলো, উঁচু হয়ে গাড়ির ব্যকসিটে খুঁজতে চেষ্টা করলো ভারী কিছু। ভাগ্য এবার খানিকটা সহায় ছিল বোধহয়, তাইতো এমার্জেন্সি টুলবক্সটা গাড়ির পিছনেই রাখা ছিল। সেখানে থাকা গ্লাস ব্রেকার দিয়ে অতি সহজেই গাড়ির কাঁচ ভেঙে ফেলে সে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে কাঁচ ভাঙার ফলে জানালার নিচে অংশ বেশ ধারালো হয়ে পড়ে, এখান থেকে বের হতে গেলে শরীরে ব্যথা তো পাবেই সাথে এতো উঁচু থেকে রাস্তায় পড়লে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।

নন্দিতা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো রাস্তার পাশে নয়, বরং অপরপাশে, যেখানে খনিকতে জঙ্গলা ভূমি, ঘাস বিছানো রয়েছে, সেদিক থেকে বের হলে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। তাই বেশি কিছু চিন্তা না করে বেশ কসরত করে সে উঠে আসে ড্রাইভিং সিটে। অতঃপর খানিকটা দূরে সরে গিয়ে গ্লাস ব্রেকার দিয়ে ভেঙে ফেলে সেদিকের কাঁচ। ঝলঝনিয়ে কাঁচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। নন্দিতা মিরর গ্লাসে দেখে একটা গাড়ি তাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থান করছে। মনে একরাশ ভয় আর শঙ্কা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ঝাঁপ দেয় সে গাড়ির জানালা দিয়ে।
ঘাস, পাতার সাথে কৃষ্ণচূড়া গাছের কিছু শুকনো ডাল পড়ে ছিল জায়গাটায়। শরীরের কো জায়গায় বেশ ক্ষত পায় সে। তবুও মনের জোরে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালাতে চায় সেখান থেকে। তখনই পেছন থেকে কেউ এসে একটা রুমাল চেপে ধরে তার নাকে। এরপর আর কিছু মনে নেই তার। চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করে এই অন্ধকার ঘরে।

শরীরের ক্ষতগুলো শুকিয়ে গেছে অবহেলায়। কেউ যত্ন করে আঙুল ছোঁয়ায়নি। অবচেতন মনে নন্দিতার মনে পড়ে গেল সেদিনের ঘটনা, যখন রাগের বশে তুর্জয় তার ঠোঁটের বেহাল দশা করেছিল। নিজের শরীরের চেয়ে বেশি ব্যথা তার চোখে দেখেছিল সে। কিছুক্ষণ পর পরই কেমন করে যেন আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই ব্যথা যেন তার শরীরে। এর সবটুকু আঘাত বোধহয় সে সহ্য করছে। জ্বরতপ্ত তাকে কী ভীষণ যত্ন করেই না আগলে রাখতো সে। অথচ আজ তার শরীরের এতখানি ক্ষত, একটু আঙুল ছুঁয়ে দেওয়ার কেউ নেই।
আপনাআপনি পেতে হাত চলে যায় নন্দিতার। বহু কষ্টে হাতদুটো টেনে হিঁচড়ে নিয়েছে সে পেটের উপর। নাহ, ওই প্রাণটার কিছু হয়নি বোধহয়। সে তো মা, সন্তানের কিছু হলে নিশ্চয়ই বুঝতো।

“তোর বাপটাকে বড্ডো সহজ মরণ দিয়েছি রে মেয়ে, তোকে এতো সহজে মারতে মন চাইছে না।”
মুখের উপর ঝুঁকে এসে বলা লোকটার মুখাবয়ব সম্পূর্ন স্পষ্ট না হলেও নন্দিতা বুঝল এটা জাওয়াদ শিকদার ছাড়া আর কেউ নয়। এমন ঘৃণ্য কাজ একমাত্র তার দ্বারাই সম্ভব। নন্দিতা প্রত্যুত্তর করছে না দেখে জাওয়াদ শিকদার তার পাশে থাকা একজনের কাঁধে হাত রেখে বেশ দাম্ভিকতার সাথে তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“মানুষ যখন মরতে চায়, সেই আর্তনাদ শুনেছিস?”

লোকটা কী বললো বোঝা গেল না। তবে জাওয়াদ শিকদার আবারো বলে উঠেন,
“বেঁচে থাকা অনেক সহজ রে বেটা, মৃত্যু কঠিন। মরার জন্য মানুষ পায়ে পড়ে, মৃত্যু ভিক্ষা চায়। মানুষ যেমন কুকুরকে খাবার দিয়ে তৃপ্তি পায়, আমি তৃপ্তি পাই কারোর মৃত্যুর সাধ পূরণ করে।”
শেষের কথাটা বড্ডো হিংস্র শোনালো। নন্দিতার বুকটা ধড়াস করে উঠলো। এই লোকগুলো যে তার সাথে খুব অমানবিক অত্যাচার করতে চলেছে তা বেশ টের পাচ্ছে সে। কিন্তু এখন উপায়? এই মুহূর্তে মনে মনে ধূসরকে স্মরণ করছে নন্দিতা। আচ্ছা, ধূসর কী জানে না? কথাটা মাথায় আসতেই সাথে সাথে মাথায় এলো তুর্জয়ের কথা। এই লোকগুলো কি তাকেও ধরে এনেছে?

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫০

কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বড্ড ক্লান্ত কন্ঠে নন্দিতা জিজ্ঞাসা করলো,
“তুর্জয়, তুর্জয় কোথায়? ওকে কোথায় রেখেছিস জানোয়ারের দল?”
জাওয়াদ শিকদার যেন ভারী মজা পেলেন এই কথায়। তবে কিছু বললেন না মুখে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তৈমুর হাসতে হাসতে বলল,
“দেবদাস হয়ে হসপিটালের কোন বেডে পড়ে আছে কে জানে? কিংবা দেখা গেল লাশটা তার মর্গে পাওয়া গেল।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫২