প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৪

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৪
ফিজা সিদ্দিকী

ঘুম ভাঙতেই তনুজা নিজের মাথার কাছে আবিষ্কার করলো নাঈমকে। যে অবস্থায় বেরিয়েছিল, এখনও একই পোশাকে ঘাড় কাত করে বিছানায় মাথা এলিয়ে শুয়ে সে। হয়তো কিছুক্ষণ আগেই তন্দ্রা লেগেছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো এখন গভীর রাত।
সারাদিন শুয়ে থেকে শরীরটা কেমন যেন ব্যথা করছে তনুজার। খানিকটা নড়েচড়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো সে। নরম গদির বিছানা খানিকটা নড়ে উঠতেই তন্দ্রা কেটে গেল নাঈমের। আধো আধো চোখ খুলে তনুজাকে উঠে বসার জন্য কসরত করতে দেখে ঘুমের রেশ পুরোপুরি ছুটে গেল তার। তড়িঘড়ি উঠে গিয়ে কাঁধ ধরলো তনুজার। পিঠের পিছনে বালিশ দিয়ে আলতো করে বসিয়ে দিলো তাকে।

তনুজা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে নাঈমের মুখের দিকে। এই মানুষটাকে সে চেনে না, জানেও না, অথচ কী ভীষণ যত্ন আর দায়িত্ববোধ নিয়ে আগলে রাখছে সে তাকে। অথচ যার জন্য মন ভাঙ্গে, বুক পোড়ে সে এক নজর ঘুরেও তাকায় না। ভালোবাসা এমন কেন? আমরা যাকে চাই তাকে ছাড়া পুরো দুনিয়া আমাদের আগলে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় কেন? এই অচেনা মানুষটার জায়গায় ওই পরিচিত, চিরসখার মুখটা এতটা কাছে থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো? আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারতো সে। নরম আদরে ছুঁতে পারতো তাকে। উষ্ণ অশ্রুজলে ভিজিয়ে ফেলত তারও গাল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“পছন্দ হয়েছে?”
নাঈমের কথায় হকচকায় তনুজা। নজর ঘুরিয়ে তাকায় অন্যদিকে। নাঈম এতে বেশ মজা পায়। এসির পাওয়ারটা খানিকটা কমিয়ে তনুজার কোমর পর্যন্ত চাদর টেনে দিতে দিতে বলে,
“এতো খুঁটিয়ে খুঁটিতে দেখছিলেন, পছন্দ হয়েছে কিনা বললেন না তো!”
“আমি ওভাবে দেখিনি” তনুজার সোজাসাপ্টা জবাব।
“তো কিভাবে দেখতে চান বলুন। শার্টলেস নাকি একেবারে জামা কাপড়লেস।”
তনুজা রাগী চোখে তাকায় নাঈমের দিকে। কণ্ঠেও সেই রাগের আভাস টেনে বলে,
“আপনার ভদ্রতা সভ্যতা ভীষণ রকমের লেস। ইমপ্রুভ ইট।”
নাঈম ঠোঁটের কোণে আঙুল ঠেকিয়ে ভাবুক কণ্ঠে বলে,
“আপনার থেকে একটু ধার দেওয়া যাবে?”

তনুজা ভ্রু কুঁচকে তাকালো নাঈমের দিকে। তা দেখে নাঈম খানিকটা ঝুঁকে তনুজার কাছাকাছি এসে বললো,
“ট্রাস্ট মি, ভদ্রতা সভ্যতা ধার নিতে নিতে আপনারটাও লেস করে দেব।”
সেই ঘটনার পাঁচদিন পেরিয়েছে। তুর্জয় সামলে উঠেছে খানিকটা। ঠিক যে সামলে উঠেছে এমনটা না, বরং আঘাতপ্রাপ্ত বাঘের মতো গর্জেও উঠেছে। নিজের ভেতরে জ্বলতে থাকা ধুনুচিতে আঁচ দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। যে তাপে সে নিজেও পুড়বে, আর পুড়িয়ে ফেলবে আশেপাশের সবকিছু।
ইন্সপেক্টর আলোক তালুকদারকে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখে উঠে বসে তুর্জয়। আলোক কাছে আসতেই ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে তার। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে,

“সহানুভূতি দেখাতে এসেছেন নাকি উল্লাস?”
আলোক খানিকটা লজ্জিত হলো এ কথায়। প্রত্যুত্তরে বললো,
“এমনটা নয় এডভোকেট তুর্জয়।”
তুর্জয় এবার সরাসরি তাকালো তার চোখে দিকে। উগ্র রোশাদীপ্ত কণ্ঠে বললো,
“এটাই তো চেয়েছিলেন। আপনার স্ত্রী বিয়োগের দুঃখে এতো বেশি কাতর ছিলেন যে ঠিক ভুল বিচার ছাড়াই আমার সর্বনাশ চেয়েছিলেন। এইযে ঠিক এই দৃশ্যই তো দেখতে চেয়েছিলেন আপনি তাইনা?”
আলোক কী বলবে ভেবে পেলো না। খানিকটা নরম সুরে সে বলল,

“সত্যি কখনও চাপা থাকে না স্যার, আর সেই সত্যি আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কেউ। এতগুলো বছর শুধুশুধু আপনাকে দোষারোপ করে গেছি, আর আপনি ভদ্রভাবে সেগুলো সহ্য করেছেন। আমার বোধহয় লজ্জিত হওয়া উচিত, কিন্তু আমার যে লজ্জার চেয়েও বেশি কিছু হচ্ছে। অপরাধবোধ হচ্ছে।”
“আপনার অপরাধবোধ কি আপনার অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে পারে? পারে কি আমার সবকিছু ফিরিয়ে দিতে? যদি পারে তবেই আমার থেকে ক্ষমার আশা করবেন, নয়তো না।”
আলোক আহত চোখে তাকিয়ে রইলো তুর্জয়ের দিকে। অতঃপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
“আমার কিছু বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছে স্যার। আমার মনে হচ্ছে ইনভেস্টিকেট অফিসারের মধ্যে গোপনে কারোর যোগাযোগ রয়েছে শিকদারের সাথে। পারতপক্ষে সে বারবার প্রমাণিত করার চেষ্টা করছে এটা একটা এক্সিডেন্ট, কোনো প্রী প্ল্যানড মার্ডার না।”

তুর্জয় চুপচাপ শুনলো সবটা। কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। তা দেখা আলোক আবারও বলে উঠলো,
“আরও একটা বিষয় আমার সন্দেহ হচ্ছে। এই ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত নই, তাই আপনাকে জানানো সঠিক হচ্ছে কিনা জানিনা। তবে আমার ধারণা ম্যাডামকে আগে থেকেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।”
তুর্জয় চমকে তাকালো আলোকের দিকে। চোখ মুখ তার থমথমে। আলোক থেমে থাকলো না। সে আবারও বলতে শুরু করলো,
“শরীরের একটা অংশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আগুনের তাপে বডি তো একেবারে ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে না। শরীরের হাড় এতো তাড়াতাড়ি পুড়ে ছাইও হয়ে যায়না। আমার সন্দেহ তিনি বেঁচে আছেন, আর শিকদারদের কাছেই আছেন।”

কিছু শব্দ, কিছু কথা যেমন করে মনের আশা জাগায়, তেমন করেই একটা দূর্বল শরীরে মুহূর্তেই শক্তি যোগান দেয়। এজন্যই বোধহয় বলে, কথার চেয়ে বড় ওষুধ আর কিছু নেই দুনিয়ায়। শব্দের মাধ্যমে যেমন মানুষের বুকে ছুরি চালিয়ে তাকে নিঃশেষ করা যায়, তেমনই কারো নির্জীব সত্তায় প্রাণ ঢেলে দেওয়া যায়।
তুর্জয়কে দেখে এখন কোনোভাবেই দূর্বলচিত্তের মানুষ মনে হচ্ছে না। হাতে লাগানো স্যালাইনের ক্যানুলা টেনে ছিঁড়ে ফেলে হসপিটালের কেবিন থেকে বের হতে যায় সে। আলোক তাকে ধরে ফেলে। অত্যন্ত সাবধানী কণ্ঠে বলে,
“আপনার কী মনে হয়না আপনি খুব বড় ভুল করতে যাচ্ছেন?”
“আমাকে যেতে দিন অফিসার, শিকদারদের স্পর্ধা এবার আকাশচুম্বী। আমার স্ত্রীর দিকে যে হাত বাড়িয়েছে, সেই হাত পঙ্গু করে না দেওয়া অবদি আমি থামবো না।”

“শান্ত হন। এখন মাথা গরম করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নয়। আমার সন্দেহ যদি সঠিক হয়, তবে ম্যাডামকে বাঁচানোর জন্য আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। আর এভাবে আপনি তাদের সামনে বাঁচতে পারবেন না।”
নন্দিতার সামনে দাঁড়িয়ে জাওয়াদ শিকদার। তার দিকে নজর রেখে পায়চারি করে চলেছে অনবরত। নন্দিতা চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। হাঁটু মুড়ে বসে আছে সে বহু কষ্টে। শরীরে এত ব্যথা কেন কে জানে?
আচমকা জাওয়াদ শিকদার এগিয়ে এসে নন্দিতার গাল চেপে ধরলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“হারামজাদি, তুই আমাকে ধ্বংশ করবি? পুরো বাপের মতো নিমকহারাম হয়েছিস। বুদ্ধিটাও পেয়েছিস বাপের মতো। তোর বাপকে দেখেও শিক্ষা হয়নি তোর? শালী, আসছিল আমাকে বরবাদ করতে। এখন তাকিয়ে দেখ তোর হাল। মরে, পচে, গলে এখানে পড়ে থাকলেও কেউ দেখতে আসবে না তোকে। কেউ জানতেও পারবে না তোর লাশ কোথায়? সবচেয়ে মজার বিষয় মরার সময় কাফন বুকে জড়িয়ে মরতেও পারবি না।”

জাওয়াদ শিকদারের চেপে ধরা আঙুল গর্ত হয়ে ঢুকে গেছে নন্দিতার গালে। ব্যথায় ছটফট করছে সে। কঠোর, অমানুষের মতো হাতটা নন্দিতার কোমল চোয়াল একেবারে যেন পিষে ফেলবে তার হাতের তালুতে। চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে নন্দিতার। দুইহাতে সে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জাওয়াদ শিকদারের হাত থেকে ছড়ানোর। অবশেষে স্বেচ্ছায় তাকে ছেড়ে দিলেন তিনি। নন্দিতা খানিকটা ঝুঁকে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তেও সামলে নিলো নিজেকে। দুইহাত মাটিতে রেখে ওই অবস্থায়ই জাওয়াদ শিকদারের দিকে চাইলো। চোখে তার কী ভীষণ রকম ক্রোধ। বেশিক্ষণ তাকানো যায়না সেদিকে। সেই কঠোর দৃষ্টি জাওয়াদ শিকদারের দিকে বহাল রেখে কণ্ঠ খানিকটা চওড়া করে বলল,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৩

“পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। তোর পাপ ধ্বংস হবে। আমি পারিনি, আমার বাপ পারেনি তো কী হয়েছে? কেউ না কেউ আসবে ঠিক তোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। প্রতিটা যুগে যুগে পাপ আসবে, ফেরাউনকে আসবে। আর সেই পাপ নির্মূল করতে মুসাও আসবে। তোর মতো পাপীর শাস্তি দেখার জন্য আমার দুই চোখ ঝলসে যাচ্ছে। শাস্তি আসুক, তোর শরীর যেন কোনো কিট পতঙ্গ পর্যন্ত ছুঁয়ে না দেখে। মৃত্যুর জন্য দুই হাত তুলে ভিক্ষা চাস, তবুও মৃত্যু যেন তোর নসিবে না আসে সহজে। এতো মানুষের খালি হওয়া বুকের হাহাকার বৃথা যেতে পারে না কখনও।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৫