প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৫
ফিজা সিদ্দিকী
তিনমাস কেটে গেছে। তুর্জয় নিজেকে কোনরকমে ব্যস্ত রেখেছে। রোজ কোর্টে যাওয়া আসা, ল ফার্মে সময় দেওয়া, নতুন নতুন কেস নিয়ে ব্যস্ত রাখছে নিজেকে। তবে এসবের সবটুকুই লোকদেখানো। রাতের আড়ালে আজও সে খুঁজে চলে নন্দিতাকে। নিজের লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে শিকদারদের পিছনে, কোথাও থেকে একটা খবর আসার অপেক্ষা শুধু।
রোজকার মতো আজও সন্ধ্যা করে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে সে। তুহিনা বেগম আর আশরাফ সাহেব এখন তুর্জয়ের ফ্ল্যাটেই থাকছেন। ছেলেকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করতে নারাজ তুহিনা। বিধায় কখন কি করে বসে!
এক গ্লাস স্যালাইন ওয়াটার করে এনে তুর্জয়ের মুখের সামনে ধরতেই স্বেচ্ছায় সেটা হাতে নিলো সে। অতঃপর ঢকঢক করে এক চুমুকেই শেষ করে ফেললো। ফাঁকা গ্লাসটা হাতে নিয়ে তুহিনা দাঁড়িয়ে রইলেন একইভাবে, যেন কিছু একটা বলতে চান। ব্যাপারটা খেয়াল করে তুর্জয় উঠে বসলো কোনক্রমে। সকাল থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তার। বিগত নির্ঘুম রাতগুলোর ফল এগুলো। তবে সেসব কিছুকে পাত্তা দিতে চায়না সে।
“কিছু বলবে?”
“আজ না গেলে হয়না?” তুহিনা খানিকটা আমতা আমতা করে বললেন।
“এমন আবদার কেন করো, যেটা আমি পূরন করতে পারবো না। তোমাদের জোরাজোরিতে আমি আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছি তো, এবার আমার মানুষটার জন্য তার নির্দিষ্ট সময়টা কেড়ে নিতে চাইবে না প্লীজ। ব্যাপারটা তাহলে মোটেই ভালো হবে না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তুমি অসুস্থ। নিজের দিকে খেয়াল না রাখলে মেয়েটাকে খুঁজবে কিভাবে? নিজের দিকে শেষ কবে তাকিয়েছ মনে আছে? পুরো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে শহরে, অলি গলিতে খুঁজে বেড়াও। কখনও কখনও তো আমাদের না জানিয়ে শহরের বাইরে পর্যন্ত চলে যাও। ভোররাতের দিকে এসে কয়েক ঘণ্টা মরার মতো পড়ে থেকে এরপর আবার লেগে পড়ো নিজের দায়িত্ব পালনে। এভাবে শরীর চলে? তুমি দিন দিন কি পরিমান অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ, খেয়াল করেছ? কেন করছো নিজের সাথে এমন অত্যাচার?”
“আমি খেয়াল করবো, সবকিছুতে নিয়মিত হবো। শুধু তাকে ফিরে পেতে দাও। তুমি শুধু নামাজের পাটিতে কাঁদতে কাঁদতে আমার সুস্থতা চাওয়ার বদলে তাকে ফিরিয়ে দিতে বলো। বিশ্বাস করো আম্মা, তাকে সামনে দেখলেই আমি সুস্থ হয়ে যাব। একদম সেই আগের মতো হয়ে যাব। তুমি শুধু উপরওয়ালাকে বলো না, তাকে যেন ফিরিয়ে দেয়। আর তো কিছু চাইনি আমি।”
চোখের কোলে জল টলমল করছে তুহিনার। ছেলেকে এসব দেখাতে চান না তিনি মোটেও, তাইতো আর কথা না বাড়িয়ে ফিরে এলেন সেখান থেকে। এর পরপরই জ্ঞান হারালো তুর্জয়। দূর্বল শরীর আর বইতে পারল না বেশিক্ষণ, ছেড়ে দিলো ভর বিছানায়।
তুর্জয়ের যখন জ্ঞ্যান ফিরল, গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে তার। শরীর উষ্ণতায় পুড়ে যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত বারোটা দশ। নিজেকে টেনেহিঁচড়ে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে গেল সে। অতঃপর শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো তার নীচে। প্রথম অবস্থায় কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। ঠাণ্ডা পানি তপ্ত শরীরে পড়ায় কেমন যেন শক খেল। কিন্তু ধীরে ধীরে সয়ে গেলে সবটা। খুব অল্প সময়েই শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো সে।
কালো হুডি, কালো ঢিলেঢালা প্যান্ট, সাথে গায়ে জড়ানো পাতলা চাদর। ডাইনিং টেবিল ছেড়ে বের হতে গিয়ে খেয়াল করলো পেট মুচড়ে উঠছে তার ক্ষিদেতে। ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা ব্রেডের প্যাকেট হতে চারটে স্লাইস তুলে নিয়ে শুকনো ব্রেড চিবাতে চিবাতে বের হয়ে পড়লো সে।
শুনশান রাস্তা। গোটা দিনের কোলাহল ছাপিয়ে শহরের রাতটা হয় বড্ডো নির্জীব, প্রাণহীন। যেন কোনো মৃত্যুপুরীতে এসে হাজির হয়েছে। তবে এই নির্জনতা, এই নিঃসঙ্গ তুর্জয়ের বেশ লাগে। এই একাকী সময়ে নন্দিতাকে অনুভব করে সে। মনে হয় যেন তার পাশেই পা মিলিয়ে হাঁটছে সেও। এটা সেটা নানান কথা বলতে বলতে বিরক্ত করে ফেলছে তাকে। তুর্জয় মাঝে মাঝে চোখ রাঙায়। এতে উল্টে সে হেঁসে ওঠে। এই নির্জন রাস্তায় তার হাসির ঝংকার যেন দূর দূর অবদি শোনা যায়। তুর্জয় পরাজিত সৈনিকের মতো সেই হাসির দিকে তাকিয়ে নিজেও হেসে ফেলে।
“স্যার, জাওয়াদ শিকদারের টিকিটাও পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। তবে ধূসর শিকদারের খোঁজ পেয়েছি। আজই বেশ পুরোনো একটা ফ্যাক্টরীর আশেপাশে দেখা গেছে তাকে।”
পাশে এসে উপস্থিত হয় তারই একজন লোক। টাকার বিনিময়ে যারা এসব ডিটেক্টিভ কাজকর্ম করে থাকেন। তুর্জয় কিছুক্ষণ নীরব থেকে কি যেন ভাবলো। তার কেন যেন মনে হচ্ছে এসবের সঙ্গে ধূসর যুক্ত। নন্দিতাকে সে পছন্দ করতো, হয়তো তাকে পাওয়ার নেশায় এমনটা করেছে। কথাগুলো মনে হতেই আগুন জ্বলে ওঠে তার বুকে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,
“তাকে অক্ষত অবস্থায় না পেলে তুমি শেষ ধূসর শিকদার।”
রাত বিরাতে এসব মিশন চালানোর আইডিয়া এই ডিটেক্টিভ টিমের। কারন দিনের আলোতে মানুষ হয় মুখোশধারী। ঝা চকচকে বদনে তার লেপ্টে থাকে না বিন্দু পরিমাণ কোনো দাগ, অথচ রাত হলেই মানুষ হয়ে পড়ে পশু। বন্য জন্তুর চেয়েও অধম এই মনুষ্য জাতি। পশুরা তো মুখোশ পরে না ভালো দেখানোর, অথচ মানুষ নামক জীবের বৈশিষ্ট্যই হলো দিনের আলোয় সালাম ঠুকে রাতের অন্ধকারে আছোলা বাঁশ ঢুকিয়ে দেওয়া পিছন থেকে। আর সেই বন্য মুখোশ খোঁজার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় এই গভীর রাত।
তুর্জয় বাদে আরও দুইজন মানুষ গাড়ি নিয়ে যখন সেই ফ্যাক্টরীর সামনে পৌঁছালো, ততক্ষনে সেখানে তিনটে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। সতর্ক হয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে বেশ দূরেই পার্ক করলো তারা। অতঃপর আড়াল থেকে খেয়াল করলো সেই ফ্যাক্টরিতে গিজগিজ করছে পুলিশের টিম। ভেতর থেকে বের করে আনা হচ্ছে ঢের ঢের বেআইনি জিনিসপত্র। হিসেবটা ঠিক মেলাতে পারলো না তুর্জয়। ধূসরকে আজ সকালেই দেখা গেছে এখানে, অথচ আজই রেড পড়লো এই পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরিতে। যদি এসবের পিছনে ধূসর থাকে, তবে কেন করলো সে এমনটা? নিজেদেরই এতবড়ো একটা ক্ষতি করার পিছনে কারণ কী?
বন্ধ ঘরের মধ্যে দিন কিংবা রাতের খোঁজ পাওয়া মুশকিল। মোটা শেকলের বেড়ির সাথে বাঁধা নন্দিতার হাত পা। নিজেকে কেমন যেন জেলের কয়েদি মনে হয় তার। সময়মতো তিনবেলা শুধু খেতে দেয় তাকে, আর সেসময়ই যতসব তার ভৎসনা, গঞ্জনা শোনায় সে। কিন্তু জাওয়াদ শিকদারের গন্ডারের মতো মোটা চামড়ায় সেসবের কোনো আসর পড়ে না। উল্টে মিচকে হেসে বেরিয়ে যায় সে। প্রথম প্রথম নন্দিতা খাবার ফেলে রাখতো সেভাবেই। কিন্তু নিজের সন্তানের কথা চিন্তা করে কোনমতে খাবারগুলো খায় সে।
পাঁচমাসের উঁচু পেট নিয়ে ঠিকমতো নড়াচড়া করতে কষ্ট হয় তার। তবুও সেই ঘরের মধ্যে পায়চারি করে সে। ভারী শেকল বইতে বইতেই হাঁটে সে। বাচ্চাটা যেন একটু মুভমেন্ট পায়, সুস্থ সবলভাবে দুনিয়ার আলো দেখতে পায়, এই তার শেষ ইচ্ছে। জাওয়াদ শিকদার চাইছে এই সন্তানটা ভূমিষ্ট হোক। এতদিনে এটুকু বেশ বুঝতে পেরেছে নন্দিতা। নইলে এই তিনটে মাস এভাবে বাঁচিয়ে রাখত না তাকে। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখনো অবগত নয় সে।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে বিছানো চটাইয়ের উপর বসে পড়ে নন্দিতা। অতঃপর কান্না বিগলিত কণ্ঠে বলে,
“তোকে বাঁচতে হবে। আমার বাপের অসম্পূর্ণ কাজ আমি শেষ করতে পারিনি, তবে তোকে শেষ করতে হবে। যে অন্যায়ের সাক্ষী তুই জন্মের আগে থেকে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। শিকদারদের নাম নিশান মেটানোর জন্য তোর জন্ম স্বার্থক হোক।”
তনুজাকে একপ্রকার জোর করে নিজের বাড়িতে আটকে রেখেছে নাঈম। প্রতিবার বাইরে বের হওয়ার আগে বাইরে থেকে গেট লক করে দিয়ে যায়, আর ফিরে এসে রণচন্ডি রূপে তনুজাকে দেখতে বেশ লাগে তার। সে সময় তনুজাকে দেখলে স্বয়ং অজগর সাপ অবদি লজ্জা পেয়ে যাবে। নাক, গাল ফুলিয়ে এমনভাবে ফুঁসতে থাকে সে।
এই তিনমাসে সারাদিন বাড়িতে শুধু শুধু বসে থাকতে ভীষণ অস্বতি লাগে তনুজার। তাই আজকাল নিজেই রান্নাঘরে যায় সে। ফ্রিজ খুলে চেক করে কী কী উপস্থিত আছে সেখানে। অতঃপর হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়েই রান্না করে। তনুজাকে খানিকটা স্বাভাবিক দেখে আজকাল নতুন করে একটা জুলুম চালায় নাঈম। রাতে বাড়ি ফেরার সময় রোজ কিছু না কিছু নিয়ে এসে বলে এটা রান্না করে দাও, ওটা বানিয়ে দাও, এটা খেতে ইচ্ছে করছে, এমন কতকিছু। আজও তার অন্যথায় হয়নি।
বাড়ি ফিরে নাঈমের নজর যায় প্রথমেই কিচেনের দিকে। আজ একটু সন্ধ্যা সন্ধ্যা বাড়ি ফিরেছ সে। রোগীর চাপ কম ছিল বিধায় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে পেরেছে আজ। ফেরার পথে রোজকার মতো বাজারের পথ দিয়ে ফেরার সময় সামনেই এক বয়স্ক লোককে ছোটো মাছ বিক্রি করতে দেখল। খানিকটা এগিয়ে যেতেই লোকটা গ্রাম্য ভাষায় উচ্চকন্ঠে বলে উঠলো,
“এক্কেরে তাজা চুনো মাছ ভাইজান। লিয়া যান, বউডা এট্টু চিল্লামিল্লি করলা নাহয়, কিন্তু রান্না করলি যা টেস। মুখি আঙুল দিয়া চাটবার লাগব। বাইছা খুইচা এক্কেরে পেঁজ, লঙ্কা আর মশলা দিয়া ঘষামাজা কইরা চুলায় বসাই দিবেন এক গামলা ভাত খাই ফেলতি পারবেন গো সাহেব। শহরের লোক এইসব দেখছেন নি আগে?”
লোকটার কথা আধো আধো যা বুঝলো, তাতে যে এই রাতের বেলায় এই মাছ নিয়ে ঘরে ঢুকলে বউ পেটাতে পারে, এটা নিশ্চিত। বউ! এই শব্দটা কেমন যেন শিহরন জাগালো তার তনে মনে। তার ঘরেও তো একজন আছে। কাগজে কলমে না হোক, তার মনে মনে বিয়ে করে স্বীকৃতি পাওয়া বউ। আর তাইতো এই মার খাওয়ার সুযোগ লুফে নিতে এক কেজি ছোট মাছ কিনে নিলো সে।
তনুজা ঝাল ঝাল করে মুরগী রান্না করেছে। নাঈমের ঝাল খাবার পছন্দ বিধায় এভাবেই রান্না করে সে আজকাল। তবে সে যে একদম ঝাল খেতে পারে না। তাই রান্না শেষে তরকারি থেকে মাছ মাংস ধুয়ে নিয়ে এরপর খায় সে। সেটা অবশ্য নাঈমের অগোচরে। কারন এই লোক একবার এই বিষয় জানতে পারলে ঘর থেকে ঝাল জিনিসটাই উঠিয়ে ফেলবে। নাঈমের এই নিব্বি মার্কা পাগলামির জন্যই তাকে সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগে তনুজার।
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৪
রান্না শেষে সবকিছু গুছাতে গুছাতে তনুজা মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছে। নাঈমের এই অদ্ভূত বাড়াবাড়ি রকমের অধিকারবোধ খাটানো বন্ধ করবে সে। এটা কেমন ধরনের পাগলামি? যেখানে এভাবে ঘরবন্দী করে রেখে দেওয়া হয় তাকে। তার নিজস্ব জীবন নেই? ক্যারিয়ার নেই? সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে এখানে এভাবে পড়ে থাকার মানে কি?
Ar part gula koi diccan na kno
Next part please