প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬০
ফিজা সিদ্দিকী
বিগত কয়েকদিন ধরেই অজ্ঞাত মেয়েটা নওরীনের সাথে থাকছে। ধূসর বেশ কয়েকবার মেয়েটার কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলেও সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কোনো উত্তর দেয়না। অবশেষে বিরক্ত হয়ে ধূসর বলে,
“এ কোন আপদ ঘরে টেনে আনলাম। আম্মা, তুমি ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিকানা জেনে নিও।”
এটুকু বলে বেশ তেজ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ধূসর। মেয়েটা এখনো তাকিয়ে তার যাওয়ার পানে। নওরীন আলতো করে হাত রাখলো তার মাথায়। নরম কণ্ঠে বললো,
“এরা মানুষ ভালো না। আর এইযে ছেলেটাকে দেখছ, সে হলো গোবরে পদ্মফুল। আমি নিজেই তার আশ্রয়ে লুকিয়ে থাকছি এখানে। দুজনকে একসাথে লুকিয়ে চুরিয়ে রাখা ছেলেটার পক্ষে বেশ কষ্টকর হয়ে পড়বে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বাড়িতে কী কিছু হয়েছে তোমার?”
মেয়েটা মাথা নীচু করে ফেললো। চোখের কোটর ভরা জল তার। মাথা নামাতেই টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো তা কোলের কাছে। নওরীন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আগের মতো কোমল কণ্ঠে বললো,
“তুমি কি কষ্ট পেলে আমার কথায়? আমি কিন্তু তোমাকে আঘাত দিতে চাইনি। এভাবে কাঁদছো কেন? কী হয়েছে আমাকে বলো। আমি তো তোমার মায়ের মতই।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নওরীনের শেষোক্ত কথাটা শুনে চোখ তুলে তাকালো মেয়েটা। অতঃপর সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো নওরীনের বুকে। কাঁধে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।
আউটহাউজ থেকে বের হয়ে ধূসর সোজা গিয়ে ঢুকলো জাওয়াদ শিকদারের ঘরে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিলেন তিনি। ধূসরকে দেখে বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,
“কিছু বলার ছিল?”
চেয়ার টেনে ধূসর বসলো ঘরের ঠিক মধ্যিখানে। মনে কৌতূহল দাপিয়ে প্রশ্ন করলো,
“ফুলতলার বাগানবাড়িতে আগুন লাগলো কিভাবে?”
জাওয়াদ শিকদারকে বেশ চিন্তিত দেখালো। দুই ভ্রুয়ের মাঝে গভীর খাঁজ তার। খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“কারোর গভীর ষড়যন্ত্র এটা। জলিলকে যে খাবার দেওয়া হয়েছিল সেই খাবারে মারাত্মক পরিমাণে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। যে কারণে খাবার অর্ধেক খেয়েই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। বাকী গার্ডদেরও ছুটি দেওয়া হয়েছিল। আর সেই সুযোগে কেউ ইচ্ছেকৃত এই আগুন লাগিয়েছে। কিন্তু সেই কুত্তার বাচ্চাকে কোনমতে ধরতে পারছি না। কুলাঙ্গার, জারজ কোথাকার। সামনে এসে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই, পিছনে গেম খেলে কুত্তার বাচ্চা।”
জাওয়াদ শিকদারের রাগের অগ্নিকুণ্ড স্পষ্ট টের পাচ্ছে ধূসর। আর সেই অগ্নিকুন্ডের উত্তাপের প্রখরতা স্পষ্ট করতে সাথে সাথে প্রশ্ন করলো,
“পার্টির বেশিরভাগ কাজ ওখানে হতো না? সেসব?”
“কিচ্ছু নেই। সব ছাই। আমার কোটি কোটি টাকা, কাগজপত্র সব পুড়ে ছাই। কুত্তার বাচ্চাকে শুধু একবার ধরতে পারি, কেটে টুকরো টুকরো করে কিমা বানিয়ে কুত্তাকে খাওয়াবো। শালার জানোয়ারের বাচ্চা।”
ধূসর মনে মনে হাসলো ভীষণ। কিন্তু মুখভঙ্গীতে কিঞ্চিৎ পরিমাণে খুশি টের পাওয়া গেল না তার। উপরন্তু বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
“একটা কথা ভেবে দেখেছ? ফুলবাড়ির গার্ডদের স্পেশাল ইন্সট্রাকশনে রাখা হয়। আমাদের বাড়ির কারোর পারমিশন ছাড়া তারা ছুটি নেবে না। আর জলিল চাচার খাবারও কিন্তু এই বাড়ি থেকে অর্ডার করা হয়।”
জাওয়াদ শিকদার পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন ধূসরের দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“কী বলতে চাইছো তুমি? এই কাজ আমাদের বাড়ির কারোর?”
ধূসর খানিকটা আমতা আমতা করে বলল,
“তোমার ব্যবসার বিষয়ে আমি কিছু বুঝিনা বলেই এসব জয়েন করি না। কিন্তু ওই বাগানবাড়ি কতটা সিকিউরিটিতে রাখা হতো এটা সবাই জানি। আমি এসব বিষয়ে জানিনা, তাও মনে যে সন্দেহ হলো সেটা তোমাকে বললাম। বাকিটা বের করা তোমার কাজ। জলিল চাচার খাবার যেখান থেকে এসেছে শুরুটা তোমার ওখান থেকে করা উচিত।”
কথা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ধূসর। পিছনে ফেলে রেখে গেল চিন্তাগ্রস্থ, ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া জাওয়াদ শিকদারকে।
কাঁদতে কাঁদতে ফোঁপানি খানিকটা কমে আসতেই নওরীনকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা। আশেপাশে খুঁজতে থাকে কিছু একটা। ছোটো ঘর, আসবাবপত্রও নেই খুব বেশি। এদিকে সেদিকে খুঁজেও কিছু না পেয়ে দৌড়ে যায় পাশের ঘরে। টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা বেশ কিছু কাগজ থেকে একটা কাগজ তুলে নেয় সে। নেয় একটা কলমও। সাথে সাথে সেখানে বসে লিখতে শুরু করে কিছু।
কোনো কারণে মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে ভেবে নওরীন একা ছেড়ে দেয় মেয়েটাকে। আসলে কিছু কিছু আঘাত আমাদের হৃদয়ে এতো গভির ক্ষত দিয়ে যায় যে আমাদের একাকীত্ব প্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষের সঙ্গের চেয়ে অন্ধকার ঘর, শূন্য জীবন বেশি ভালো লাগে। এটা প্রয়োজন। একাকীত্ব অর্থাৎ নিজস্বতা। অন্যের সাথে মুখোমুখি না হয়ে বরং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সত্তার মুখোমুখি হওয়ার মতো। এখানে নিজেকে চেনা যায়, নিজের দূর্বলতা টের পাওয়া যায়। নিজেকে প্রশ্ন করে সেই উত্তর নিজেকেই দিতে হয়, ফলে মনোবলও বাড়ে। তাই একাকীত্ব প্রয়োজন। ভীষণ রকম প্রয়োজন।
ঘরের জানালা দিয়ে সোনালী রোদ এসে পড়ছে বিছানায়। নওরীন নির্নিমেষ তাকিয়ে সেদিকে। আগের চেয়ে শরীরের বেশ উন্নতি হয়েছে তার। শারীরিক আঘাটগুলো শুকিয়ে গেছে সেই কবেই। তবে কিছু মানসিক আঘাত দগদগে ঘায়ের মতো দগ্ধ আজও। স্বামী, ফলফলে সংসার বিয়োগের শোক, বেঁচে থেকেও নন্দিতাকে একটা ঝলক দেখতে না পাওয়ার শোক, নওরীনকে দিনে দিনে অতিষ্ট করে তুলছে। এই চার দেয়ালের বন্দীত্ব থেকে কবে মুক্তি পাবে সে জানে না। নিজেকে অনেকটা ইংরেজ শাসনের সময়কার নাগরিক মনে হয়। ঘরকুনোয় লুকিয়ে অপেক্ষা করছে এই দাপট, এই শাসন কবে শেষ হবে। কবে ইংরেজরা বিদায় নেবে দেশ থেকে।
হসপিটালে প্রচণ্ড রকম প্রেশার যাচ্ছে নাঈমের। বিগত কয়েকরাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি তার। পরপর বেশ কিছু ক্রিটিকাল সার্জারি শিডিউল করা একের পর এক। আজ একটা বাচ্চার হার্টের সার্জারি করেছে সে টানা দশ ঘণ্টা ধরে। কেসটা প্রচণ্ড রকম ক্রিটিকাল ছিলো। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ের হার্টে বেশ মেজর সাইজের ফুটো ধরা পড়ে। ওপেন হার্ট সার্জারির নানান জটিলতার কারণে কোনোভাবেই রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিলো না। টানা সাড়ে নয় ঘণ্টা শেষে অবশেষে নাঈম সাকসেসফুলি সম্পন্ন করে কাজটা। এরপর বাকি সব টুকিটাকি কাজগুলো সারতে সারতে দশ ঘণ্টা পর হয়ে যায়।
কোমর, পিঠ এমনকি শরীরের প্রতিটা গাঁটে গাঁটে ব্যথা টের পাচ্ছে নাঈম। কয়েক রাত না ঘুমানোর জন্য শরীরও কেমন যেন ছেড়ে দিতে চাইছে। ঘরে ঢুকে তাই ডাইনিংয়ের টেবিলের উপর মাথা এলিয়ে দেয় সে। ধীর কণ্ঠে বলে,
“খালা, পানি দাও তো একটু।”
তনুজা রান্নাঘরে ছিল। আজকাল কোনো না কোনো একটা পদ নিজে রান্না করে সে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো নাঈম কখনোই তাকে রান্না করতে দেখে না, তবুও খাবারের প্লেটে যে পদটা চেটেপুটে শেষ হয় সেটা থাকে তারই বানানো। অনেক সময় দেখা যায় ওই এক পদ দিয়েই পুরো ভাত খেয়ে ফেলে সে।
তনুজাকে বিশেষ একটা ভঙ্গিতে ইগনোর করে নাঈম। আর সেটা হলো নীরবতা। তনুজা সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও একেবারে নীরবে নিজের কাজ করতে থাকে নাঈম। যেন এখানে সে ছাড়া অন্য কেউ নেই। আজও তার অন্যথায় হলো না। খালাকে আসতে না দিয়ে তনুজা নিজের গ্লাসে পানি নিয়ে বেরিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। গ্লাসটা নাঈমের সামনে ধরলে হাত বাড়িয়ে সেটুকু নিয়ে একঢোকে পুরোটা শেষ করে সে। অতঃপর ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঢুকে পড়ে নিজের ঘরে।
জঙ্গল ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেছে তুর্জয়। জাওয়াদ শিকদার এই কয়টা দিন নিজের ধ্বংস ঠেকাতে মরিয়া। এদিকে বিশেষ হুশ নেই তার। আর ঠিক সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তুর্জয় বেরিয়ে পড়ে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে।
শুনশান নিরবতা ছাপিয়ে খসখস করে পাতার শব্দে তুর্জয় এগিয়ে যাচ্ছে জন্মগলের অভ্যন্তরে। কোনরূপ দিক নির্দেশনা ছাড়াই মনের জোরে এগিয়ে যাচ্ছে সে সামনে। জয় সামনে এগোচ্ছে নীরবতা আরও গাঢ় হচ্ছে যেন। দুপুর থেকে এখন গোধূলি, একটা গোটা বেলা জঙ্গলের মধ্যে গোলকধাঁধার মতো ঘুরে বেড়িয়েছে তুর্জয়ে। অবশেষে সূর্য যখন তার রক্তিম আভা ছড়াতে ব্যস্ত প্রকৃতিতে, ঠিক সে সময় বেশ হিংস্রভাবে ডেকে ওঠে একটা কুকুর। তুর্জয় সতর্ক হয়। শোদবের উৎসের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বিড়বিড় করে বলে,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৯
“মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রাণী কুকুর। যেখানে কুকুর আছে, সেখানে মানুষের গন্ধও আছে।”
অন্ধকার ধেয়ে আসছে দেখে দ্রুত পা চালায় তুর্জয়। সেই সাথে বাড়তে থাকে খসখস পাতার শব্দ। কোথাও গিয়ে মড়মড়িয়ে শব্দ করে ওঠে। আচমকা তুর্জয়ের পা বাঁধা পড়ে কিছুতে। হোঁচট খেয়ে পড়ে মাটিতে। ব্যথা পায় পায়ে বেশ খানিকটা। মাটিতে বসে সামনে তাকাতেই খেয়াল করে বিশালাকার এক কুকুরকে। তার হিংস্র চোখ, ধারালো দাঁত, শরীরের ক্ষমতা সাধারণ কুকুরের চেয়ে কয়েকজন প্রশিক্ষণীয়, তা এক ঝলকে টের পাওয়ার মতো। অনেকগুলো দিন অভুক্ত থাকার পর খবর পেলে শেয়াল যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে খাবারের উপর, কুকুরটাও একই ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো তুর্জয়ের উপর।