প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৭

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৭
ফিজা সিদ্দিকী

অস্থিরভাবে নিজেকে তুর্জয়ের থেকে আলাদা করে নিয়ে চায় নন্দিতা। কিন্তু বাধ সাধে তুর্জয়। নন্দিতা যতখানি সরে যেতে চায় তার চেয়ে অধিক তাকে আঁকড়ে ধরে তুর্জয়। তুর্জয়ের চোখ বন্ধ। উন্মত্ত উষ্ণ নিঃশ্বাসের উথালপাথাল আনাগোনা বুঝিয়ে দিচ্ছে তার অস্থিরতা। বুঝিয়ে দিচ্ছে কতটুকু বেপরোয়া আজ সে। নন্দিতা চায়না এরচেয়ে বেশি কিছু হোক। চায়না আর এক বিন্দু কাছাকছি সে আসুক। কিন্তু তাকে থামানোর সাধ্য কার? উপায়ান্তর না পেয়ে তুর্জয়ের ঠোঁটের ভাঁজে আলতো কামড় দেয় নন্দিতা। নিয়ন্ত্রণহীন তুর্জয় পরোয়া করে না সেসবের। কোমর প্যাঁচানো হাতটা আরও গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে ব্যাথাতুর ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় নন্দিতার গলার ভাঁজে। নন্দিতা যেন খেই হারিয়ে বসলো। কূল কিনারা খুঁজতে গিয়ে আচমকা বেশ জোরে ধাক্কা দেয় তুর্জয়কে। হতভম্ব হয়ে খানিকটা সময় ঠাঁয় তাকিয়ে থাকে সে নন্দিতার দিকে। রাগে, অপমানে মুখ তার রক্তিম। নন্দিতা অসহায় চোখে তার দিকে তাকালে মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,

“তোমার মত মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকায়না এডভোকেট তুর্জয়। নেহাৎই সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে, নাহয় ক্লাবে এর চেয়ে ভালো ভালো প্রোডাক্ট পাওয়া যায়।”
নন্দিতা কষ্ট পেলো না মোটেও। উপরন্তু মুখে হাসি টেনে প্রত্যুত্তরে বললো,
“ক্লাবে কি মাঝে মাঝেই যাওয়া হয় নাকি আজ প্রথম যাবেন, মিস্টার সাইলেন্সার?”
তুর্জয় ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হাসি আরও খানিকটা চওড়া হলো তার। ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
“খিচুড়ি খাবেন? আপনার অবস্থার সাথে ভালো যাবে কম্বিনেশনটা। ওটা খিচুড়ি আর আপনার মধ্যে চলছে অনুভূতির জগাখিচুড়ী।”
তুর্জয় দাঁত কটমট করে বিক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় নন্দিতার দিকে। নন্দিতা তা দেখে আলতো হেসে ফিসফিস করে বলে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সাথে পোড়া বেগুনের ভর্তাও করি? কারোর হৃদয় পোড়ার গন্ধ ছাপিয়ে যায় যদি।”
দ্রুত কদমে ঘর ছাড়লো তুর্জয়। এই মুহূর্তে মেয়েটাকে নাইট পারছে না একদমই, অসহ্যকর ঠেকছে। তাকে রিজেক্ট করে দূরে দেওয়ার স্পর্ধা নাকি অতিরিক্ত বাচালতা, তাকে চোখের সামনে সহ্য করার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়েছে সে। নারীদের যথেষ্ট সমীহ করে চলা তুর্জয় তাই এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না সেখানে। বিধায় নিজের ভেতরের পুরুষত্ব একজন নারীকে অসম্মান করে বসে।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলেও তুর্জয়ের বাড়ি ফেরার নাম নেই। ডাইনিং টেবিলে মাথা এলিয়ে নন্দিতা তাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। যেন বেল বাজতেই দরজা খুলতে কালবিলম্ব না হয় তার।
সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে, নন্দিতার হাস্যোজ্বল মুখখানি যখন বিষাদী ছায়ায় পাণ্ডুর, আচমকা ডাইনিং টেবিলের উপর অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠলো। নন্দিতা উৎফুল্ল মনে হাত বেরিয়ে ফোনটা কাছে টেনে নিতেই সারা মুখ জুড়ে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো ঘন আঁধার নেমে এলো। যতখানি উৎফুল্ল নিয়ে ফোনটা ধরতে গিয়েছিল, তার চেয়ে অধিক ভয় এই মুহূর্তে জেঁকে বসেছে তাকে। ধরতে না চেয়েও কেটে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ফোঁটা উঠিয়ে কানে চেপে ধরলো সে।

“বেশী চালাকি করতে যেও না, এক ঝড়ে সব কুপোকাত।”
ওপাশ থেকে ভেসে আসা হিমশীতল লঘু কণ্ঠস্বরে যেন খানিকটা কেঁপে উঠল নন্দিতা। সর্বাঙ্গ হতে হয়ে চললো উত্তাল তরঙ্গ। ফ্যানের তলায় বসেও বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল কপালে। কানে চেপে ধরা হাতটাও কাঁপছে রীতিমত। নন্দিতা শুকনো ধক গিললো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আমি চেষ্টা করছি। একটু সময় দিতে হবে আমাকে।”
“সময়টা বরং লাশের পাশে বসে কান্নাকাটি করার কাজে লাগিও।”
“এমন করবেন না প্লীজ। আপনার সাথে তো আমার কথা হয়েছিল, ছয়মাস সময় দেবেন আমাকে।”
“কাজ আমার, শর্তও আমার। যখন তখন সেটা পরির্বতন করার ক্ষমতাও আমার।”
“কিন্তু আমি তো এসবের কিছু জানিনা। আমাকে একটু সময় দিন। আপনার কাজ আপনি বুঝে পেয়ে যাবেন। শুধু ওনাদের….”

অসহায় কণ্ঠে নন্দিতা কিছু বলতে গেলে তাকে মাঝপথে থামিয়ে অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি বলে ওঠে,
“দুইমাসের মধ্যে যেন রিপোর্ট আমার কাছে পৌঁছে যায়। আমাকে খুশি করতে পারলে বোনাস কিছুও পেয়ে যেতে পারো আমার থেকে। আর না পারলে লা……”
“পারবো আমি। এসব বলবেন না প্লীজ। আপনার কাজ হয়ে….”
নন্দিতার কথা অসম্পূর্ণ রেখেই অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে কল কেটে দিলো। আচমকাই নন্দিতা যেন মূর্ছা পড়লো একেবারে। শরীরে শক্তি লুকিয়ে উঠছে না। ভার ভার লাগছে মাথা। বুক ফেটে কান্না আসছে। অথচ কাঁদতে পারছে না একটুও। মনে মনে ভাবলো,

মা, কেন কান্না আটকাতে শেখালে? কেন দুনিয়ার সামনে এতো স্ট্রং হতে বললে? কেন কষ্ট লুকিয়ে শুধু হাসতে বললে? মিথ্যা অভিনয় আর কত? আমার যে ক্লান্ত লাগে, ওজন লাগে বুকে। এরচেয়ে একটা গোটা পাহাড় শরীরে চাপলে কষ্ট কম লাগতো বোধহয়। এইযে এই ছোট্ট বুকটা, জ্বলছে, পুড়ছে, খান খান হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ কেউ টেরই পায়না। বুঝতে পারেনা পাশে শুয়ে থাকা মানুষটা কতখানি যন্ত্রণা নিয়ে একটা একটা নিঃশ্বাস গুনছে। আঁচ করতে পারে না এই ছোট্ট বুকে কতখানি ক্ষত জমা তার। আমিও যে বোঝাতে পারিনা। বোঝাতে পারিনা আমি ভালো নেই। বোঝাতে পারিনা কান্না করতে না পেরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আচ্ছা, কি করলে একটু কান্না পাবে? আমি একটু কাঁদতে চাই। হু হু করে কেঁদে দুঃখগুলো ভেতর থেকে বের করে ফেলতে চাই। আর পারছি না জমাতে। আর পারছি না বইতে। আমি ক্লান্ত, আমি বিধ্বস্ত। দিনশেষে আমি নিঃসঙ্গ।
প্রকৃতিও বাঁধভাঙ্গা উন্মত্ত আজ নন্দিতার বুকে জমানো গল্প শুনে। তাইতো এ অসময়ে আচানক গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ডাক দিলো তাকে। যেন এ ডাক তাকে বুকে জাপটে নেওয়ার। এ ডাক তার দুখবিলাসের সঙ্গী হওয়ার। এ ডাক তার দুঃখগুলো শুষে নেওয়ার।

ঝমঝমিয়ে নেমে আসা বৃষ্টির তালে মৃদুমন্দ বাতাসের ঝাপটা। আকাশে ঘন কালো মেঘের বুক চিরে নেমে আসা অসম বারিধারার নীচে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে নন্দিতা। বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে ময়ূর যেন করে পালক মেলে ধরে নৃত্য করার উদ্দেশ্যে, তেমন করেই বৃষ্টির ঝমঝম করা ডাক নন্দিতাকে আহ্বান জানিয়েছে নিজেকে মেলে ধরতে। সকল ক্লেদ, ক্লান্তি বৃষ্টির জলের সাথে ধুয়ে মুছে একাকার করে দুঃখগুলো শুষে নিতে এ যেন প্রকৃতির এক নান্দনিক আয়োজন।
ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছে তুর্জয়। এতোটা সময় ইচ্ছে করেই কাছাকাছি এক পার্কে বসে ছিল সে। কিন্তু আচমকা ধেয়ে আসা ঝড় বৃষ্টির তোপে নিজেকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরতে গিয়েও অনেকখানি ভিজে যায় সে। মেইন ডোর খোলা পেয়ে প্রথমদিকে বেশ অনেকটা ভয় পায় সে। ঘরে ঢুকে এদিক সেদিক সবার আগে খোঁজ করে নন্দিতার। সব ঘরে ভালো করে লক্ষ্য করে কোনো জিনিস এলোমেলো কিনা! নাহ কেউ বাড়িতে ঢোকেনি ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অতঃপর কি যেন মনে করে পা বাড়ায় ছাদের দিকে।

বৃষ্টির দিকে মুখ উঁচু করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে নন্দিতা। প্রতিটা বৃষ্টিকণা তার চোখে, মুখে আছড়ে পড়ে ধীরে ধীরে তা গলা বেয়ে নেমে পড়ছে। ব্যাপারটাতে এক অদ্ভুত রকমের শান্তি রয়েছে। দুইহাত দুইদিকে মেলে তাই বেশ খানিকটা সময় সে দাঁড়িয়ে রইলো এভাবে। এরপর আচমকা হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো মেঝেতে। দুইহাতে মুখ ঢেকে কী বিড়বিড় করে বললো,
“তুমি কেন থাকলে না? কতোকিছু শেখার যে বাকি ছিলো আমার। শুধু হাসতে শেখালে, কাঁদতে কেন শেখালে না? আমাকে পাথর বানিয়ে নিজেই দূরে চলে গেলে, এখন এ পাথর গলাবে কে?”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬

ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে বেশ খানিকটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে রইলো তুর্জয়। অজানা এক কারণে তার ভালো লাগছে ছাদের দৃশ্যটুকু। শুভ্র পোশাকে জড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে ভীষণ রকম স্নিগ্ধ লাগছে আজ। সকালের পর থেকেই কেমন যেন এক টান অনুভব করছে সে মেয়েটার প্রতি। ওইযে ছোঁয়া, সেটা পাওয়ার তৃষ্ণা আমরণ তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত করে দিয়েছে তাকে। এতটা সময় জেদ ধরেই তাই দূরে ছিলো সে। কিন্তু আচমকা তাকে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়তে দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না তুর্জয়। এগিয়ে গিয়ে আলতো করে হাত রাখলো তার কাঁধে। আর তখনই উল্টো ফিরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নন্দিতা।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৮