প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৯
ফিজা সিদ্দিকী
সকালের প্রথম রোদের কিরণ চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় তুর্জয়ের। আলতো চোখ খুলে সামনে তাকাতেই গত রাতে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনা ভেসে ওঠে তার দৃশ্যপটে। চোখ বন্ধ করে জোরে এক নিঃশ্বাস টেনে নেয় নিজের মধ্যে। অতঃপর নিজের সাথেই বেশ খানিকটা সময় নিয়ে দ্বন্দ্ব চালিয়ে অবশেষে নন্দিতাকে বুকের উপর থেকে সরিয়ে উঠে চলে যায় সে। রাতের ঘটনার জন্য আফসোস নেই তার মাঝে, তবে নন্দিতার অনুমতি ছিল না ভেবে অনুশোচনা কাজ করে।
বৃষ্টিস্নাত শীতল বাতাসের স্পর্শে বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙ্গে নন্দিতার। শীতল বাতাসের দাপটে গায়ের চাদরটা আরও খানিকটা জড়িয়ে ঘুমাতে গিয়ে শুনতে পায় তুর্জয়ের মৃদু কন্ঠস্বর।
“সিকদারদের কেসটা আমার জিম্মায় আছে। সিক্রেটলি এটার ইনভেস্টিগেশন করছে পুলিশ। দেশের একজন নামকরা নেতার বিষয়ে এই ধরনের এলিগেশন আনা খুব সহজ কিছু নয়। মেয়েটার জীবনের ঝুঁকি হতে পারে, তাই তাকে পুলিশ কাস্টডিতে রাখা হয়েছে সুরক্ষার খাতিরে। আপনি চিন্তা করবেন না, শিকদারদের এই কালো অতীত আমার হাতেই শেষ হবে। কেসের প্রতিটা শুনানির দিন প্রেস, মিডিয়ার ভিড় জমবে। আপনি শুধু নিজেকে সুরক্ষায় রাখবেন।”
শিকদারদের নাম শোনামাত্র আচমকা মৃদু কেঁপে উঠলো নন্দিতা। মানসপটে ভেসে উঠলো এক নৃশংস হত্যার দৃশ্য। ভয়ে খিঁচে বন্ধ করে ফেললো তার চোখ। শরীর এখনো মৃদু কাঁপছে। হ্যাঁ দিয়ে ঘাম ছাড়ছে অনবরত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তুর্জয় রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে করতে কথা বলছিলো কারোর সাথে। অতঃপর খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে গেল সে কাজের উদ্দেশ্যে। কোর্টটা নেওয়ার বাহানায় রুমে ঢুকে একপলক নন্দিতার দিকে তাকাতে অবশ্য ভুললো না সে। উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে থাকা, বুক পর্যন্ত চাদরে ঢাকা তার স্ত্রীকে দেখে আজ প্রথমবারের মতো ঠোঁটের কোন মৃদু হাসি ফুটে উঠল তার। পরপরই দরজা লক করে বেরিয়ে পড়লো কাজের উদ্দেশ্যে।
তুর্জয় চলে গেছে বুঝতে পেরে চোখ খুলে তাকায় নন্দিতা। বিছানার পাশে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিতেই চোখ পড়ে আজকে তারিখের দিকে। আজ থেকে আর মাত্র একমাস সময় আছে তার কাছে। পরপরই কিছু একটা ভেবে হাসি চওড়া হয় তার। পুরো ঘরের কোনায় কোনায় তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে ঠিক কোথায় হিডেন ক্যামেরা লাগানো থাকতে পারে। শিকদাররা যে তাদের গোটা ঘরে হিডেন ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই নন্দিতার। পরপরই মনে পড়লো তাদের কেসের ডেট এগিয়ে আসছে। তার মানে এই কেসের ব্যাপারে টুকটাক আলোচনা তুর্জয়কে করতে হবে বিভিন্ন কল মারফত। আর ঠিক এই কারণেই তুর্জয়ের প্রতিটা কথা, কাজের উপর নজর রাখছে তারা। যাতে কেসের ব্যাপারে প্রতিটা তথ্য আগে থেকেই জেনে যায় তারা। এতে তাদের এই কেস জিতে যাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না।
তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয় নন্দিতা। বাড়ীর পাশের একটা ক্যাফেতে গিয়ে নিজের জন্য এককাপ কফি অর্ডার করে চলে যায় ওয়াশরুমে। সেখানে গিয়ে পার্স থেকে একটা সিম বের করে ফোনে সেট করে। সিমটা অনেক পুরোনো। বন্ধুদের সাথে একবার প্রাংক করার জন্য এই চিন্তা নিয়েছিল সে। অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে সবাইকে যেভাবে ভয় দেখিয়েছিলো, আজও সেই সোনালী দিনগুলোর স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠলে ঝংকার দিয়ে হেসে উঠে সে।
বাড়ীর সামনের বাগানে বসে চা খাচ্ছিলেন তুহিনা বেগম। এমন সময় টেবিলের উপর রাখা ফোনটা সশব্দে বেজে ওঠে। চায়ের কাপটা প্লেটের উপর রেখে ফোঁটা হাতে নিয়ে অপরিচিত নম্বর দেখে বেশ খানিকটা হতাশ হন। গতকাল তাকে ফোন করেনি নন্দিতা। সারাদিনে অন্তত একবার হলেও মেয়েটা খোঁজ নেয় তার। এটা ওটা নানান গল্প করে ফোনের ওপাশ থেকেই ভীষণভাবে মাতিয়ে রাখে তাকে। কিন্তু কাল কী হলো কে জানে? তিনি নিজেও অভিমান করে ফোন দেননি আর। যদি আজও তার ফোন না পায়, তবে নিজেই ফোন দিয়ে ভালো করে কথা শোনাবেন তাকে। ঠিক যেমনটা দজ্জাল শাশুড়িরা করে।
কেটে যাওয়ার আগেই ফোঁটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ভেসে ওঠে নন্দিতার হাস্যোজ্বল কন্ঠস্বর। তুহিনা বেগমের রাগ যেন নিমেষেই পানি হয়ে গেল এই কন্ঠস্বর শুনে। মেয়েটা তার কথার মায়ায় সহজেই কাবু করে ফেলতে পারে কাউকে। এতো মিষ্টভাষী, চঞ্চল মেয়ে তার জীবনে কমই দেখেছেন তিনি। একেবারে যাকে বলে নিখাদ সোনা। তার ছেলেটা কবে যে এর কদর বুঝবে কে জানে।
“আম্মা, রাগ করে আছো জানি। এখন ঝটপট তোমার ছেলেকে বলো তো তোমার কাছে নিয়ে যেতে, কতোদিন দেখিনা তোমাদের। সামনে গিয়ে একেবারে রাগ ভাঙ্গাবো তোমাদের।”
তুহিনা বেগম আলতো হেসে মশকরা করে বলে ওঠেন,
“আমার ছেলে তোর কেউ হয়না বুঝি? তোর জামাইকে তুই বল। আমি কেন বলতে যাব?”
“তোমার ছেলে তো খারুশ। নিরামিষ ব্যটা। কথা বলতে তো জানে না, যেটুকু মুখ খোলে শুধু ঝগড়া করতেই খোলে। জন্মের সময় তার মুখে মধুর বদলে তিতকরলা দিয়েছিলে নাকি?”
নন্দিতার এমন কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠেন তুহিনা বেগম। হাসতে হাসতেই খানিকটা কাশি ওঠে যায় তার। তা শোনামাত্র নন্দিতা চিন্তিত সুরে বলে ওঠে,
“তুমি ওষুধ ঠিকমতো খাওনা তাইনা? ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে, আগের সপ্তাহে ডেট ছিলো তো।”
তুহিনা বেগম জিভে আলতো কামড় দিয়ে কথা ঘোরাতে গিয়ে বলেন,
“আমার ছেলে আগে ছিলো, এখন তোর জামাই।”
“নিজে রিটায়ার্ড নিয়ে আমার মত নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ের উপর তোমার ওই গাধা ছেলেটাকে চাপিয়ে দিচ্ছ, এসব কিন্তু একদম ঠিক না শ্বাশুড়ি আম্মা। দজ্জাল শাশুড়ির মতো ছেলের ভাগ নিয়ে টানাটানি না করলে এই শ্বাশুড়ি বয়কট।”
“এই বুড়িকে এভাবে বয়কট কোরো না বৌমা, একটা নাতি নাতনির মুখ দেখলে অবশ্য এসব বয়কট মেনে নেওয়া যায়।”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৮
“তুমি আগে দজ্জাল শ্বাশুড়ি হওয়ার ট্রেনিং নাও ইউ টিউব থেকে, যেভাবে আমি জামাইয়ের আদর পাওয়ার ট্রেনিং নিই রোজ। এরপর নাতি নাতনির কথা নাহয় তোমার ছেলেকেই বোলো, সব তো তার হাতে।”
নন্দিতার বোকা বোকা কোথায় তুহিনা বেগম ঝট করে ফোন কেটে দেন। অতঃপর শব্দ করে হাসতে হাসতে বলেন,
“পাগলের প্রলাপ সহ্য করে সংসার টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা হোক আমার ছেলেটার।”