প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১১

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১১
নওরিন কবির তিশা

হুড়মুড়িয়ে চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটটার সামনে এসে থমকালো তিহু। হতবুদ্ধতার দরুন লিফট ব্যবহারের কথাটাও বেমালুম ভুলে গিয়েছে সে। একসঙ্গে অনেকগুলো সিঁড়ি একবারে পেরিয়ে, নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার মত অবস্থা তার। হাঁটুতে দুহাতে ভর দিয়ে, সামান্য ঝুঁকে ঠোটদুটো গোল করে একসঙ্গে বেশ কয়েকবার জোরে জোরে, শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল সে ।
কিয়ৎক্ষন পর ধীরে সুস্থে কলিংবেল বাজালো সে। সঙ্গে সঙ্গে একটা পরিচিত হাসিমাখা মুখ দেখেই তাকে সর্বশক্তিতে জড়িয়ে ধরল তিহু। বলে উঠলো,,,—“কখন আসছো তুমি?”

অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটিও হেসে বললেন,,,—“এই তো কিছুক্ষণ আগে।”
তিহু মুখ তুলে একবার সম্মুখ পানে চাইল। মা তৈয়িবা জামান, বহুদিন পর মেয়েকে দেখে আদুরে হাত বুলালেন তার মুখে। ঠিক তখনই তৈয়িবা জামানের পিছনে এসে দাঁড়ালো মাহা। তিহু চোখের ইশারায় হাজারবার তাকে ধন্যবাদ জানালো। অতঃপর তিনজন মিলে প্রবেশ করল ফ্ল্যাটে।
কিছুক্ষণ আগে…….
আইসক্রিম পার্লার, থেকে বের হয়ে সেখান থেকে অনতি দূরে একটা নির্জন প্রকৃতি নিবিষ্ট স্থানে কিছুটা সময় পার করছিল তিহু আর নীল। কথোপকথন তত একটা নয়। তবে নিরবতায় হাজারও বাক্যালাপ চলছিল। হঠাৎই ফোন বেজে উঠল তিহুর। ফোন ধরতেই অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো এক বজ্র কন্ঠ,,,—“ভার্সিটি‌ আসিস নি কেন তুই? আর এখন কোথায় আছিস?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিহুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, মাহা মুহূর্ত কয়েকের বিরতি নিয়ে ফের বলল,,,—“যে জাহান্নামেই থাকিস না কেন, যত জলদি পারিস বাসায় আয়। আন্টি এসেছে, হ্যাঁ, তোর মা’ই। তোর খোঁজ করছিল। আমি বলেছি রিশাদের সাথে আছিস, মার্কেটে গিয়েছিস। নোট আর পেন কিনতে। আসার সময় অবশ্যই কিছু কলম আর কাগজ সাথে করে নিয়ে আসিস। বাই। আম্মুও এসেছে। দুজন পাশের রুমে গল্প করছে যত দ্রুত পারিস আয়।”
বলেই ফোনটা কেটে দেয় সে। তিহুর প্রাণ পাখি যেন উড়াল দেবে, তার আম্মু? তিহু আজীবন এই মানুষটাকে যমের মতো ভয় পায়। যদিও তিহুর ফাস্ট বেস্ট ফ্রেন্ডও তিনি, তবে অসম্ভব বিচক্ষণ আর ধূর্ত মহিলা তিনি। তিহু মিথ্যা বলে কখনোই বাঁচতে পারেনা তার থেকে। আজ যদি সে সত্যি সে সবটা জেনে যায়? ভীত তিহু এক ঝলক নীলের পানে তাকায়। নীল তখনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সে সবটা খুলে বলে নীলকে। অতঃপর এখানে আসা।
বর্তমান……..

তিহু রুমে ঢুকেই মাহার আম্মুর উদ্দেশ্যে সালাম দিল। কিছুক্ষণ আলাপচারিতা শেষে,তৈয়িবা জামান তিহুর হাতের দিকে লক্ষ্য করে বললেন,,,—“তোর, নোটস আর পেন কই?”
অতঃপর একবার প্রধান দরজায় তাকিয়ে তিনি বললেন,,,—‘রিশাদ আসেনি?’
ঠিক তখনই দরজা খুলেই রুমে প্রবেশ করল রিশাদ। সবাইকে সালাম দিয়ে,তিহুর উদ্দেশ্যে বলল,,,—“জিনিসপত্রগুলোও ঠিকমতো আনবি না তুই? এই নে ধর।”
তিহু অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। কই সে তো কখনো রিশাদকে ফোন করেনি। রিশাদ এক ঝলক মাহার দিকে তাকালো। মূলত মাহাই তাকে ফোন দিয়ে বলেছিল, কিছু কাগজ আর কলম কিনে রাখতে । কেননা সে খুব ভালো করেই জানে এই কয়েক মুহূর্তের মাঝে তিহুর একার পক্ষে সবটা হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে না। তৈয়িবা জামান আর মাহার আম্মু অর্থাৎ মুবাসশিরা পারভিন রিশাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, তিহু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। অতঃপর মাহা আর রিশাদকে ধন্যবাদ জানিয়ে,সে বলল,,,

———“আম্মুরা কখন আসলো রে?”
মাহা:“আর বলিস না । ভার্সিটি থেকে এসে শুনি আম্মুরা এসেছে। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে সারপ্রাইজ দিতে। তোর আম্মুর নাকি তোর কথা মনে পড়ছিল। আর একা একা কিভাবে আসবে? তাই আমার আম্মুকেও ঝুলিতে পুঁড়ে নিয়ে এসেছে।”
তিহু:“ সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমার টেনশন তো অন্য জায়গায়। আমার আম্মুকে তো চিনিসই। যদি একটু কিছু আন্দাজ করতে পারে!”
মাহা:“এখন আমাকে বলছিস কেন? যা আর একটু গিয়ে বিয়ে কর। আমাকে একদম এসবের ভিতর টানবিনা বাবা। আমি এসবের ভিতরে নেই।”
তিহু আহ্লাদি দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাহার গলা জড়িয়ে বলল,,,—“বড় জা। এভাবে বলছ কেন? আমি তো বলেইছি আমার ভাসুর তোমার। আর আমার ভাসুর যে পরিমাণ স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম না? তুই জাস্ট ফিদা হয়ে যাবি ফিদা!”
মাহা তাকে ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,,,—“ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায় । আর আমার একবার গিয়ে ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আর যেতাম না।”

তিহু:“সেবার ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল, আর কে জানে তুই কোন হাবাগোবার সাথে….”
মাহা তার দিকে কটমটের দৃষ্টিতে তাকিয়ে পড়তেই ।তিহু বোকা হেসে বলল,,,—“না মানে আমি বলতে চাচ্ছি আমার ব্রাদার, আই মিন আমার ভাসুর একদমই ওইরকম না ভাই। মারাত্মক হ্যান্ডসাম, সেই লেভেলের ড্যাসিং। একটা চান্স কিন্তু নিতেই পারিস?”
মাহা তার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে। তবে তার আগেই মায়ের ডাকে থমকালো সে। স্পষ্ট স্বরে কিছু না বললেও, দাঁতে দাঁত পিষে হাজারটা গালি দিলো তিহুকে।
এদিকে……
তিহুকে ছাড়াই নীল ফিরে এসেছে দেখে,মির্জা সূচনা ভ্রু জড়িয়ে বললেন,,,—“নুরাইন কোথায়?”

নীল:“ও যে বাসায় আগে থাকতে সেখানে গিয়েছে. কিছু নোটস থেকে গিয়েছিল সেগুলোই আনতে।”
মির্জা সূচনা:“ও আচ্ছা । কিন্তু তুই ওকে রেখে চলে আসলি?”
নীল:“আজকে ওর একটু গ্রুপ স্টাডি আছে, এজন্যই ও ওইখানে থাকবে।”
মির্জা সূচনা:“ঠিক আছে। তবে, বেশিদিন যেনো থাকে না। আফটার অল এখনো এই বাড়ির বউ। আর খান বাড়ির বউকে অন্য ফ্ল্যাটে রাখা, এটা কেউই পছন্দ করে না এ বাড়ির।”
নীল সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
রাত ৯ টার দিকে…….
খাওয়া দাওয়া শেষ করে। চার মা মেয়ে মিলে বসেছে গল্পের পসরা নিয়ে। বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ চারিতা চলছে সেখানে। হঠাৎ তিহুর আম্মু বললেন,,,—“তিহু?”
তিহু আনমনে কিছু একটা ভাবছিল। মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙল তার। অপ্রস্তুত কণ্ঠে সে বলে উঠলো,,,—“জ্বী আম্মু?”
তৈয়িবা জামান:“তোর আরহামের কথা মনে আছে?”

তিহু সম্মতিসূচক মাথা দাঁড়ালো। আরহামকে তো সে চেনে। বাবার দূরসম্পর্কের আত্মীয় আদ্রিতা ফুফুর ছেলে। তবে হুট করে মা কেন তার কথা বলছে জানা নেই । তৈয়িবা জামান ফের বললেন,,—“ওতো এখন জনস হপকিন্স হসপিটাল এর একজন বড় ডক্টর, সার্জেন্ট।”
তিহু:“তো আমি কি করতে পারি?”
তৈয়িবা জামান:“তুই কি করতে পারিস মানে? তুই আমার সাথে কালকেই বাসায় যাবি। আদ্রিতা বুবু তোকে দেখতে চেয়েছেন। আর তুই কিন্তু খুব ভালো করেই জানিস আদ্রিতা বুবুর সাথে তোর বাবার ছোটবেলা থেকেই অনেক ভালো সম্পর্ক। তাই আমি চাইনা তোর ঘাড় ত্যাড়ামির কারণে, কোনো অশান্তি হোক।”
তিহু মায়ের এহেন কথায় ভ্রু কুঁচকে বলল,,—“আরে আজিব তো। আমি কি কোনো গ্রসারী পন্য নাকি, সে আমাকে দেখতে চাইবে বলেই আমাকে চলে যেতে হবে। আমি যেতে পারব না। আমার সামনে একটা ক্লাস টেস্ট আছে। আর ওনার যদি এত আমায় ইচ্ছা করে তো এখানে এসে দেখে যাক।”

তৈয়িবা জামান রেগে গিয়ে বললেন,,—“তুই যাবি না মানে? তোকে যেতেই হবে । আর ক্লাস টেস্ট থাকে পরে অ্যাটেন্ট করিস। আর তোকে তো আমি থাকতে বলছি না, জাস্ট কালকে যাবি দুদিন পর না হয় ফিরে আসবি।
তিহু জেদ ধরে বসে থাকলো। সে যাবে না মানে যাবেই না। তৈয়িবা জামানও কিছুটা চটে গেলেন মেয়ের এমন ব্যবহারে। মুবাসশিরা পারভিন তৈয়িবা জামানকে অন্য কথা বলে তার মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করলেন। মাহাও তিহুকে এক সাইডে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল,,,—“কি করছিসটা কি তিহু? মাথা খারাপ হয়েছে তোর? আন্টি যদি ঘুনাক্ষরেও কিছু টের পায় না, তোর কিন্তু খবর আছে।”

তিহু:“আরে ধুর, আম্মু কেন এখন আমাকে যেতে বলছে আমি খুব ভালো করেই জানি । আর কি এসব আরহাম না বারহাম, উনাকে আমার শুরু থেকেই পছন্দ নয়। সবচেয়ে বড় কথা আমি এখন যেতে পারবো না।”
মাহা এবার দুষ্টামি করে বলল,,,—“বাব্বা, দুইদিন বিয়ে হয়েছে কি হয়নি, বরের প্রতি এত টান? ভালো ভালো।”
তিহু:“ফাও কথা বলিস না। আর তুই যা ইচ্ছা মনে কর, তবুও আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। একটা ঝামেলা আছে আমি তোকে বোঝাতে পারবো না পরে বলব। ”
মাহা:“আচ্ছা বাবা বুঝেছি। কিন্তু এখন অন্তত ঠান্ডা থাক, কাল যখন আন্টি আর আম্মু যাবে তখন না হয় কিছু একটা বলে ম্যানেজ করা যাবে।”
তিহু:“আচ্ছা!”

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সবে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতে যাচ্ছিল নীল। হুট করেই এক রমণীর মুখশ্রী ভেসে উঠল তার সম্মুখে। কোমরে হাত দিয়ে রমণীটি যেন তাকে বলতে লাগলো,,,—“আপনি আমার বিছানায় কি করছেন? এক্ষুনি নামুন বলছি।”
নীল:“সুইমিং পুলের জ্বীনের কথা মনে আছে তো।”
রমণীটি শঙ্কিত দৃষ্টিতে সুইমিং পুলের দিকে তাকালো। এমন দৃশ্যে আনমনে মুচকি হাসলো নীল। সর্বাঙ্গ বিছানায় লুটিয়ে সিলিং এর পানে চেয়ে আনমনে সে বলে উঠলো,,,—“You have become my obsession Nurain Haqe . I’m really obsessed with you!”

আমেরিকার মেরিল্যান্ড রাজ্যের বাল্টিমোর শহরে……..
ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ বেলা বারোটার জানান দিচ্ছে। সবে মাত্র একটা অপারেশন শেষে, নিজের অত্যাধুনিক কেবিনের ইজি চেয়ারটাতে শরীর এলিয়ে দিয়েছে নামকরা সার্জেন্ট আরহাম সিকদার। হঠাৎই সম্মুখের টেবিলে রাখা একটা ফ্রেমে বাঁধানো, কিশোরীর ছবিতে,দৃষ্টি আটকালো তার। মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো গোলাপি অধর জুড়ে।
ছবিটা হাতে নিয়ে ফিসফিসিয়ে সে বলে উঠলো,,,—-“ইউ নো তোতা পাখি? আই এম রিয়েলি মিস ইউ। কতদিন হলো তোমাকে দেখিনি। বাট আই অ্যাম ব্যাক। তোমাকে নিজের করে নিতে, তোমাকে নিয়ে দেখা আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে আমি ফিরব। অতি দ্রুতই ফিরব।”

তবে মুহূর্তেই তার মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় ঘটিত একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা। সঙ্গে সঙ্গে ফর্সা মুখশ্রী ছেয়ে গেল নিকষ কালো আঁধারে। সেই ছোট্ট ঘটনাটার দরুন আজও হয়তো তার তোতা পাখি ভুল বুঝে। কিন্তু? কিন্তু বয়ে গিয়েছে তো বহু সময় । এখনো কি তার তোতা সে কথাগুলো মনে রাখবে? হয়তো রাখবে, কেননা তার তোতাটা যে বড্ড অভিমানী।
সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটার দরুন আর কখনো তো সে, আরহামেরমের সামনেও আসেনি। তবে সেখানে তো দোষ আরহামের কিছু ছিল না? দোষটা তো ওই সৃজা নামের মেয়েটারই….! আরহাম চোখ বুজলো । ভাসমান শিরার হাতগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে, জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টায় সফল হয়ে, ফের আর একবার তাকালো কিশোরীটির ছবিটার দিকে।
এটা সে তুলেছিল লুকিয়ে। অত্যন্ত লুকিয়ে, কিশোরীটি হয়তো এখনো জানেনা যে তার কত শত ছবি অন্য এক সুদর্শন পুরুষের মালিকানায় বন্দি। আরহাম আবারও মৃদু হাসলো। তবে তাতে শুধুই রয়েছে মলিনতা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হঠাৎই বিশাল থাই গ্লাসের বাইরের উজ্জ্বল আকাশের পানে চেয়ে সে গেয়ে উঠলো,,,,

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১০

🎶 আমাকে নে তোর গানে…..
আর মনের দুনিয়ায়….
নে আমাকে অকারণে…..
তোর শব্দ শুনি আয়……
এঁকেছি এক সূর্য দেখ……..
যার উষ্ণতা দারুন…….
আমাকে দে সে বারনে…..
আর তোর আবছায়ায়…
বরবাদ হয়েছি আমি…..
তোর অপেক্ষায়….
চুরমার করে দে আরও…..
কিছু ইশারায়……🎶

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here