প্রেমের সমর পর্ব ১৫
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
সন্ধ্যের কিছুটা পরই স্বচ্ছর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর নামল।জ্বরটা ঠিক কেন নামল স্বচ্ছ বুঝে উঠে না। একটু আগেই বিকালে সুহার দাদাজানের সাথে তার কঠিনরকমের এক আলোচনা হয়েছে। যে আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে দাদাজান তাকে নাতজামাই হিসেবে দ্বিতীয় সুযোগটা মোটেও দিবে না। তিনি নাতনির জন্য পাত্র দেখছেন। সুযোগ পেলেই এই ছেলের সাথে ছাড়াছাড়ি করিয়ে অন্যত্র বিয়েটা দিয়ে দিবেন। অপরদিকে স্বচ্ছর পরিবারের সবার সাথে কঠিন রকমের আলোচনা হয়ে গিয়েছে এইনিয়ে। দুই পরিবারের তাদের ডিভোর্স হওয়াতে সম্মতি আছে। এমনকি তার বাবা বিকাল থেকে বার কয়েক কল দিয়ে তাকে হুমকিও দিয়েছে যাতে সে বাসায় ফিরেই পুণরায় দেশের বাইরে চলে যায়। সুহাদের বিরক্ত যাতে না করে। নাহলে স্বচ্ছকে উনি মরা ছেলে হিসেবে গণ্য করবেন।
কেন ছেলের জন্য সব জায়গায় এতটা অপমানিত হবেন উনি? স্বচ্ছ বাবার সাথে খুব ফ্রি হলেও বাবাকে মান্য করে। বাবার কথা মেনে চলে। তবে এইক্ষেত্রে সে ভেবেছে।এই প্রথম বুঝি সুহাকে হারানোর ভয় পেল সে। একটা অস্পষ্ট হারানোর অনুভূতি টের পেল সে। স্বচ্ছ বুঝে না উঠে তার বাবা এবং দাদাজান দুইজনের কাছেই সময় চেয়েছে। জানিয়েছে দিন পনেরো পরও যদি সুহা ডিভোর্সই চায় তবে সে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। এই সম্পর্কের ইতি টানবে। আর আকস্মিক কথাটা বলে ফেলার পর থেকেই স্বচ্ছর মনে হারানোর ভয়টা তীব্র হলো। প্রথমে চ্যালেঞ্জ জেতার যে আক্রোশটা ছিল এখন সে আক্রোশটা আর কাজ করছে না আর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বিকালে সে কথাটা বলে ফেলার পর থেকেই সে ছটফট করেছে। কি ভীষণ অসহ্য এক চিন্তা মাথায় নিয়ে ছটফট করেছে।বারবার ভেবেছে সুহা ঘৃণীত চোখের চাহনী।সত্যিই তো!সুহা তো তাকে ঘৃণা করে, অবিশ্বাস করে, একটুও ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।তবে? তবে কিভাবে স্বচ্ছ দিন পনেরোতে সুহার মন জয় করবে? সদাসর্বদা মেয়েদের মন জিতে আসা স্বচ্ছ এই প্রথম কোন রমণীর প্রেম হারানোর ভয় পেল।আর তারপর থেকেই শরীরের উত্তাপ! স্বচ্ছ চিলেকোঠার ফ্লোরে কোনরকমে পড়ে থেকেই চোখ বুঝে থাকল। মাথাটাও ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে। চোখজোড়া জ্বলছে। জ্বরে আর শরীর ব্যাথায় যখন বেহাল দশা ঠিক তখনই এক মেয়েলি ছায়া অবয়ব এসে দাঁড়াল চিলেকোঠার ঘরের দরজায়। কিয়ৎক্ষন স্বচ্ছকে নিরব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে ছোট শ্বাস ফেলে সুহা৷ হাতের নাস্তাটা এগিয়ে দিতে রুমে ডুকে বলে,
“ চলে যেতে বলেছিলাম স্বচ্ছ। যাননি কেন? এই আবছায়ায় বসে বসে মশার কাঁমড় খাবেন বলে? ”
স্বচ্ছ তাকায়। হলদে লাইটের আলোয় সুহাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। আদুরে চেহারাটা হৃদয়ে হিম স্রোত বইয়ে দিতে সক্ষম। স্বচ্ছ সেভাবেই কপালে হাত রেখে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থাকল।তবে একটুও বুঝতে দিল না সে অসুস্থ। যেন শরীরের ব্যাথাটা সে সয়ে নিতে দক্ষ অনেক! অথচ বাবা মায়ের আদরে আদরে বড় হওয়া বাঁধর ছেলেটা যে একটু থেকে একটুতেই নেতিয়ে যায় তা কি জানা আছে? জ্বরের দরুণ চোখ গুলো ও লাল দেখাচ্ছে একটু।স্বচ্ছ বেশ গম্ভীর গলাতেই বলল,
“ আমিও তো বলেছিলাম মেনে নাও আমায়। মানলে না তো সুহাসিনী। ”
সুহা বিরক্ত স্বরে বলে,
“ সেই এক কথা! ”
স্বচ্ছর তখন শরীর পোড়ানো জ্বর।উষ্ণ শরীরে বিশ্রী এক অনুভূতি নিয়েই সে সুহার দিকে চাইল। অনেকটা সময় চুপ থেকে চোখ বন্ধ করে ফের। ভাবুক স্বরে বলল,
“ আমি বোধহয় ভালোবাসা শব্দটার সাথে পরিচিত হচ্ছি সুহাসিনী। কষ্ট পাচ্ছি। দমবন্ধ লাগে। আমি বোধহয় চারবছর আগে খুব জঘন্য একটা ভুল করেছিলাম সুহাসিনী। সে ভুলের কি আসলেই কোন ক্ষমা হয় না?আসলেই আরেকটা সুযোগ পাওয়ার যোগ্য নই আমি?”
সুহা তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকায়। অথচ সে যদি স্বচ্ছ লাল হয়ে উঠা চোখজোড়ার দিকে চেয়ে সে দৃষ্টির অর্থ বুঝার চেষ্টা চালাত তাহলে বোধহয় বুঝত স্বচ্ছর গহীণেও তাকে হারানোর সহস্র বেদনা লুকিয়ে আছে।সুহা তাচ্ছিল্য করেই বলল,
“ আশ্চর্য!শরীর ঠিকাছে তো আপনার? নাকি আমায় ভুলানোর নতুন কৌশল এটা? ”
স্বচ্ছ আক্ষেপ হয়। কি বাজে অনুভূতি। নিজের ভেতরের কষ্টগুলো প্রকাশ করলেও বিশ্বাস করে না। আক্ষেপ নিয়েই বলল,
“ আমার কোন কথাই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে না তাই না?”
“ কি করে ঠেকবে? পূর্ব অভিজ্ঞতা তো বলে আপনি মিথ্যে বলতে খুব ওস্তাদ অস্বচ্ছ সাহেব।”
স্বচ্ছ এই পর্যায়ে করুণ চাহনিতে তাকায়। জ্বরের উত্তাপে যখন শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুড়ে ছাঁই হচ্ছে ঠিক তখনই নিজের ইগো, অহংকার সব একপাশে রেখে বলে,
“ আমাকে ক্ষমা করে দাও।আরেকটা সুযোগ দাও সুহাসিনী!প্লিজ!”
“ বাদ দিন সে টপিক। আপনার পরিবার, আমার পরিবার কেউই চায় না এই সম্পর্কটা থাকুক অস্বচ্ছ সাহেব।তিক্ততা চলে এসেছে এর ভেতর। দাদাজান এবং আপনার আব্বার মাঝে বিরোধ চলছে। কাজেই এই সম্পর্কটা পুণরায় হওয়ার নয়।”
স্বচ্ছ রুমের ওপরের দেয়াল তাকায়।স্মিত হেসে বলে,
“মাথা ভর্তি তুমিময় জট পাকানো যন্ত্রনা ডুকে গেছে,বুঝলে? আমি বোধহয় ভয়ংকর রকমের অসুস্থ হয়ে পড়ছি সুহাসিনী। ছুঁয়ে দেখো? তোমার উত্তাপে আমি পুড়ছি।”
সুহা ঠোঁট এলিয়ে হাসে। বলে,
“ কাব্যিক হওয়া শিখছেন? ভাবছেন আমি গলে যাব?গলব না। এবার আর ভুলেও গলব না অস্বচ্ছ সাহেব। ”
স্বচ্ছ এই পর্যায় রাগ হলো।এতোটা নির্দয় রমণী তার কপালেই থাকতে হলো? বলল,
“ ভালো।গলতে হবে না। ”
“ গলাটা ফ্যাঁকাশে শোনাচ্ছে। ”
স্বচ্ছ ত্যাড়া গলায় বলে,
“ শোনালে শোনাক।
সুহা ছোট শ্বাস ফেলে বলে,
“ আপনার আম্মু কল দিয়েছেন, ছোটবোন সিয়া কল দিয়েছে। আপনার খেয়াল রাখতে বলল।”
“যাক, ওদের কথা রাখতে হলেও আমার খেয়াল রাখার দায়িত্বটা নিয়েছো। নাহলে তো নিতেই না।”
“ আমাদের বাসাতে থাকছেন । সে হিসেবে অবশ্যই খেয়াল রাখতাম আপনার। অতোটা অমানবিক নই আমরা। ”
স্বচ্ছ চুপ থাকে। তারপর অনেকটা সময় পর বলে উঠে,
“তোমার দাদাজান আমার সাথে খেলায় নেমেছেন। তুমি বলো? এই খেলায় কাকে বিজয়ী করার ইচ্ছে তোমার? ”
“ যাকেই হোক আপনাকে নয়। ”
স্বচ্ছ রাগ এই নির্দয়, পাষন্ড রমণীর উপর। বলে,
“গুড, এখন এখান থেকে চলে যাও। ”
“ নাস্তাটা করে নিবেন,রাতে খাবার দিয়ে যাবে দাদাজান।”
স্বচ্ছ হেসে বলে,
“ বেলায় বেলায় খাবার দেওয়াটা কেমন ভিখিরি ভিখিরি অনুভব করাচ্ছে আমায়। অথচ আমি এই বাসার জামাই। কোথায় জামাই আদর করবে তা নয়! ”
সুহা টানটান স্বরে জানায়,
“ জামাই আদর পাওয়ার মতো কাজ যদি করতেন তাহলে এই বাসার প্রত্যেকটা লোকই আপনাকে মাথায় তুলে রাখত স্বচ্ছ৷ আপনি তো সেটা করেননি। ”
স্বচ্ছর রাগে নাক লাল হয়ে উঠেে।কন্ঠে শীতল রাগ বসিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
“ তো এখন কি করব?নিজের করা সে ভুলটার জন্য এখন মরে যাব? বলছি তো ভুল করেছি। ক্ষমা করে দাও। নতুন করে সুযোগ দাও। ”
” সম্ভব নয়। ”
রাতে সুহার দাদাজান দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করলেন।হলদেটে আলোয় স্বচ্ছকে দেখে বলে,
“এই হতচ্ছাড়া ছেলে? মরার মতো পড়ে আছো নাকি? ”
স্বচ্ছ জ্বরে বেহুশ অনেকটা। দাদাজান ফের বলে,
“ এই ছেলে? শোনো! তোমার খাবার। খেয়ে নিও। পরে না খেয়ে আমাদের বদনাম করো না। ”
স্বচ্ছ এই পর্যায়ে চোখ মেলে তাকায়। মাথা চেপে ধরে হেসে বলে,
“ দাদাজান, আমি বোধহয় আপনার নাতনির অনুপস্থিতিতে অসুস্থ ফিল করছি। আমায় সুস্থ করার ব্যবস্থা করুন। আপনার নাতনিকে পাঠিয়ে দিন না একটু সেবা করতে। ”
দাদাজান চোখ পাকিয়ে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ এই ছোঁকড়া মার চিনেছো? এখানে থাকতে দিচ্ছি এই অনেক। আমি এমনিতেও আমার নাতনির সঙ্গে তোমার সংসার হতে দিব না। নতুন করে বিয়ে দিব অন্য জায়গায়। ”
স্বচ্ছ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“আমি চুপচাপ মেনে নিব নাকি? ”
“ যায় করো, শেষমেষ আমি আমার নাতনির বিয়ে অন্যত্র দিবই! ”
সকাল তখন দশটা। সুহা বোধ করল যে স্বচ্ছ দেরি করেই ঘুম থেকে উঠবে তাই দেরি করেই ছাদের উদ্দেশ্য পা বাড়াল। হাতে মায়ের দেওয়া নাস্তার প্লেট। সুহা অতি যত্ন নিয়েই নাস্তার প্লেট খানা নিয়ে চিলেকোঠার ঘরে গেল। দরজা ঠেলে স্বচ্ছকে দেখতে নিতেই চোখে পড়ল চিৎ হয়ে শুঁয়ে থাকা স্বচ্ছকে। চিলেকোঠার একটা পাতলা ময়লা কাপড় জড়িয়ে আছে। যেন খুব শীত করছে! সুহা কপাল কুঁচকে তাকায়৷ মেঝেতে কালকের সন্ধ্যা এবং রাতের জন্য পাঠানো খাবারগুলো ঠিক একইভাবে পড়ে থাকতে দেখেই কপাল কুঁচকাল। বিরক্ত নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
“ খাবার পাঠিয়েছি কি ফেলে রাখার জন্য? নাকি বড়লোকি মুখে লাগেনি এই খাবারগুলো? খান নি কেন? ”
স্বচ্ছ উত্তর করল না। সুহা ফের বলল,
“এই যে? দিনের দশটা বাজে।এখনও ঘুমে এতোটাই বিভোর যে কথাও কানে যাচ্ছে না।”
এই পর্যায়েও স্বচ্ছ উত্তর করল না৷ সুহা এগিয়ে যায়। স্বচ্ছর কানের কাছে গিয়েই বলে,
“ আশ্চর্য!ডাকছি আমি অস্বচ্ছ সাহেব। কানে কথা ডুকছে না আপনার? ”
স্বচ্ছ চোখ মেলে তাকায় না।তবে জেগেছে। বলে,
“ সুহাসিনী? তুমি? আরেকটু ঘুমাই?শীত করছে অনেক। একটা কম্বল দিবে? ”
সুহা ভ্রু কুঁচকায়। সকাল দশটা হলেও বাইরে ফকফকা রোদ। বলে,
“ শীত করবে কেন। বাইরে ফকফকা রোদ উঠেছে।”
কথাটা বলেই পরমুহুর্তেই কিছু বুঝে উঠতে পেরেছে এমন ভাবে বলে উঠল,
” জ্বর আপনার? ”
স্বচ্ছ এবার তাকায়।অনেক কষ্টে। মাথা যন্ত্রনা করছে তার। এই যন্ত্রনাতেও হেসে মজা করে বলে,
” একটু কপাল ছুঁয়ে দেখোই না। তোমার ছোঁয়ায় হয়তো জ্বরটা সেরে যাবে সুহাসিনী।”
সুহা সত্যিই বসে পড়ে ফ্লোরে। ঝুঁকে গিয়ে স্বচ্ছর কপালে হাত রাখল। মুহুর্তেই অনুভব করল ছেলেটার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তীব্র উত্তাপ। সুহার অনুশোচনা হয়। কাল সন্ধ্যায়ও স্বচ্ছ বলেছিল সে অসুস্থ। সুহা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু সত্যিই স্বচ্ছ অসুস্থ ছিল। সুহা নিরাস স্বরে বলে,
“শরীর পুড়ে যাচ্ছে তো!কবে থেকে? ”
স্বচ্ছর সুহার হাতটা কপালে চেপে ধরে বলে,
“ বললাম তো বিকালে, বিশ্বাস করলে না। নির্দয় রমণী!”
সুহা ছোটশ্বাস ফেলে বলে,
“ কাল থেকে না খেয়ে আছেন? আশ্চর্য! সবকিছুতে মানুষ এতোটা ছন্নছাড়া কি করে হয়? অসুস্থ বোধ করছেন জানার পরপরই তো আপনার উচিত ছিল ঔষুধটা নেওয়া। তা না করে অসুখটাকে আরো জটিল না করলে শান্তি হয় না? ”
স্বচ্ছ তাকায়। মিনমিনে দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে সেভাবেই বলল,
“ সুহাসিনী? আমি বোধহয় তোমাকে চাইছি। আমার বোধহয় তোমাকে লাগবে। আমি কি এক বিশ্রী জালে ফেঁসে গেছি সুহাসিনী! চ্যালেঞ্জ জিততে এসে, তোমাকে জব্দ করতে এসে আমিই বিশ্রী ভাবে ফেঁসে গেছি! তোমার চোখে আমার জন্য ঘৃণা দেখলেই আমার অসহ্য লাগছে। তুমি আর কখনো আমার কাছে ফিরবে না ভাবলেই নিজের উপর সহস্র রাগ জমছে।এটা কি ভালোবাসা? ”
সুহা মুহুর্তেই হাত সরায়। স্বচ্ছ দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরায় তৎক্ষনাৎ।বলে,
প্রেমের সমর পর্ব ১৪
” এটা জেদ। স্রেফ আপনার জেদ। ”
স্বচ্ছ বোকার মতো করে বলে,
“ জেদ? ”
“ হ্যাঁ, জেদ!”