প্রেমের সমর পর্ব ৩৫

প্রেমের সমর পর্ব ৩৫
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

আবির আর ছুটিকে নিয়ে যখন আবিরদের বাসায় আসা হলো তখন রাত। আবিরদের বাসার সকলের মুখেই তখন উপছে পড়া আনন্দের রেশ।অথচ যে দুইজন ছেলে মেয়ের বিয়ের কারণে তারা এত আনন্দিত সে দুইজনের মুখেই হাসির রেশ অব্দি নেই।তবুও সবাই খুশি। কারণ সবারই ধারণা ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবেন৷ এরমধ্যে স্বচ্ছ,ছোটন, ফিহা এরাও বসে থাকল না ভদ্র বাচ্চার মতো। এতরাতে বাসায় এসেও হুট করে কোথায় থেকে তাড়াহুড়ো করে ফুল নিয়ে আসল। যতটুকু সম্ভব আবিরের ঘরটা সাঁজিয়ে আরাম করে বসল তিনজনে। স্বচ্ছ অবশ্য উঠে গিয়ে আবিরের পাশে বসল। দাঁত কেলিয়ে আবিরকে বলে উঠে,

“বাসর ঘর সাঁজানো ডান বন্ধু। যদিও আমার এখনও বাসরটা কপালে জুটেনি তবে তোর জন্য শুভকামনা। ”
আবির ততক্ষনে ক্ষেপা বাঘের মতো চাইল যেন। হাতে চিনচিনে ব্যাথা তার। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। স্বচ্ছকে মেরে আধমরা করে রাখবে যেন এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠে,
“ তোর কি মনে হচ্ছে আমি বাসর করার মুডে আছি? বেয়াদব!”
স্বচ্ছ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। আবিরের পিঠে চাপড় মেরে বাঁকা স্বরে শুধায়,
” মনে তো হচ্ছে না তুই বউ কাছে পাওয়ার ধান্ধায় নেই। বরং এটাই মনে হচ্ছে যে কাছে পেলেই মেয়েটাকে চেপে ধরবি নিরীহ অবলা প্রাণীর মতো। ”
আবির ফোসঁফাঁস শ্বাস টানে। বড্ড বিরক্ত এমন ভাবে বলে উঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ হুরর!ঐ মেয়ের সাথে আমার কথাই নেই। ও কি ভেবেছে? আমি ওর সাথে নিজে থেকে কথা বলব?জীবনেও বলব না। ওর অন্য ছেলেকে বিয়ে করার শখ জেগেছে যেহেতু থাকুক ও অন্য ছেলে নিয়ে! ”
“ তো এত হম্বিতম্বি করে বিয়ে করলি কেন শা’লা? ঐ ছেলেটার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেই তো হতো তাহলে। ”
আবির এবারেও রেগে তাকাল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠে,
“ ওর ভাগ্য ভালো ঐ ছেলেকে আমি মেরে ফেলিনি। ”
স্বচ্ছ বিদ্রুপ স্বরে শুধায় এবারে,
“ কোথাকার কোন বীরযোদ্ধা এলেন। ঐ ছেলেকে মারতি তুই?আজীবনের ভদ্র ছেলে যে সে আবির?”
আবির বিরক্ত গলায় বলে উঠল,
“ মাথা খারাপ করছিস। বলেছি তোদের ঘর সাঁজাতে? সাঁজালি কেন? ”
স্বচ্ছ ব্যঙ্গ স্বরে ফের বলল,
“ তুই বলবি আর আমরা সাঁজাব এমন মনে হয় নাকি? ”

স্বচ্ছ আবিরদের বাড়িতে আবিরকে বাসর ঘরে ডুকানো পর্যন্ত ছিল। শেষমেষ ওদের বাড়ির লোকেদের জোরজবরদস্তি স্বরূপ খেয়েও নিল। অবশেষে ওখান থেকে যখন বাসায় এল তখন রাত একটা। স্বচ্ছ উশখুঁশ করে। অবশেষে পুরোটা দিন কাঁটিয়ে বউকে জড়িয়ে ধরতে পারবে। অবশ্য সে যাওয়ার সময় সুহাকে বলে যায়নি। কারণটাও বলে যায়নি। সারাদিনের ব্যস্ততায় সুহার সাথে ফোনেও কথা বলা হয়ে উঠে নি তার। তবে একটা চিরকুট লিখে গিয়েছিল পাশ দিয়ে। সুহা কি তা দেখেছে? যদি না দেখে? এসব ভাবতে ভাবতেই সুহা দরজা খুলল। স্বচ্ছ আগাগোড়া দেখে নিয়ে টানটান স্বরে উত্তর করল,
“রাত কটা বাজে স্বচ্ছ? ”
স্বচ্ছ বেখেয়ালি ভাবে উত্তর দিল,
“ হু? কটা বাজে? খেয়াল করিনি তো। ”
এই পর্যায়ে এসে সুহার কান্না পেল। রাগে চোখ লাল হয়ে উঠল মেয়েটার। দুদিন আগে ও এই ছেলে অসুস্থ ছিল। এইতো কয়েকটা সপ্তাহ আগে এত বড় একটা এক্সিডেন্ট ঘটাল। সুহার বুঝি চিন্তা হয় না? হারানোর ভয় হয়না? স্বচ্ছর কি উচিত ছিল না এবার একটু দায়িত্ববান হওয়া? উচিত ছিল তাকে একটু জানানো কোথায় যাচ্ছে, কখন ফিরবে। সুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শুধায়,

“ আপনি আসলেই ছন্নছাড়া স্বচ্ছ। সবসময়ই ছন্নছাড়া!
স্বচ্ছ বোকা বোকা হাসে। পায়ের জুতো খুলতে খুলতে শুধায়,
“ বুঝিনি। ”
সুহা নিরবে তাকিয়ে থাকে। শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর করে,
“বুঝতে হবে না। খেয়েছেন? খাবার বাড়ছি, আসুন। ”
“ আমি তো…. ”
কথাটা স্বচ্ছ সম্পূর্ণ করার আগেই সুহা বুঝে নিল উত্তরটা কি হতে পারে। এই পর্যায়ে যেন কান্নাটা আরো দলা পাকিয়ে আসল। ভ্রু উঁচিয়ে স্মিত হেসে বলল,
“ খেয়ে এসেছেন? ”
স্বচ্ছর কেন জানি না এবারে বোধবুদ্ধি ফিরে এল। সুহার মুখের দিকে তাকিয়েই হুট করে মনে হলো এই মেয়ের চোখ জোড়ায় হাজার দুঃখ। স্বচ্ছ এগোয়। সুহার মুখ আগলে নিয়ে সর্বপ্রথম চুমু বসায় সুহার কপালে। উত্তরে বলে,
“ আমার জন্য খাও নি সুহাসিনী?আসলে আবি্… ”
এবারও পুরো বাক্যটা সম্পূর্ণ করার আগেই দৃঢ় গলায় উত্তর এল,

“ খেয়েছি। ”
“ মিথ্যে বলো কেন সুহাসিনী? ”
সুহা হাসে। বলে,
“ যখন আপনি ছিলেন তখন কি আমি খেতাম না? নাকি না খেয়ে এতবছর কাঁটিয়ে এসেছি আমি? ”
স্বচ্ছ মুখ গোল করে শ্বাস ছাড়ে। সুহার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,
“ মনে হচ্ছে রেগে আছো। মিস টিস করলে বুঝি আমায়? ”
সুহা হেসে শুধায়,
“ মিস করার প্রয়োজন বোধ করিনি। ”
“ সত্যিই?”
সুহা এই পর্যায়ে সরে দাঁড়ায়। রুমের দিকে পা বাড়িয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,
“ মিথ্যে বলে লাভ? ”

স্বচ্ছ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। আবারও তার বউ রেগে গিয়ছে। আবারও আগের ফর্মে!কিভাবে রাগ ভাঙ্গাবে?এতসব ভাবনা যখন মাথার ভেতর তখনই এসে দাঁড়ালেন শাহরিয়ার সাহেব। গম্ভীর স্বরে শুধালেন,
“ এত রাত অব্দি কোথায় ছিলে? কোন রাজকার্যটা উদ্ধার করলে সারাদিনে? ”
স্বচ্ছ মুহুর্তেই উত্তর করে,
“ আবিরের বিয়ে দিয়ে এলাম। ”
শাহরিয়ার সাহেব ব্যঙ্গ স্বরে বললেন,
“ নিজের বিয়েটাই তো এখনো পাকাপোক্ত করলে না। আবার অন্য জনের বিয়ে নিয়ে নাচ করছো? ”
স্বচ্ছ কটমট করে তাকায়। শুধায়,
“ অপমান করছো আব্বু?”
উনি দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলেন,
“তোমার উচিত ছিল না কোথায় যাচ্ছো বলা যাওয়া? ওভাবে ভোর ভোর চলে গিয়েছো, তাও কাউকে না জানিয়ে। চিন্তা হয় না কারোর? ”

“ তোমরা কেউ তো জানতেও চাও নি।জানতে চাইলে তো অবশ্যই বলতাম আব্বু।”
“ তোমাকে আমরা যেতে দেখিইনি স্বচ্ছ যে জিজ্ঞেস করব। দুদিন আগে এক্সিডেন্ট করেছো, বেঁচে এসেছো মৃত্যুর সাথে লড়াই করে। চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল না আমাদের? ”
স্বচ্ছ এবারে কৌতুহলি হয়ে তাকায়। হেসে কৈাতুহলি স্বরে বলে উঠে,
“ তোমাদের একমাত্র বউমা চিন্তা করেছে কি আব্বু? ”
“ কি মনে হচ্ছে? ”
“ বুঝে উঠছি না ঠিক! ”
উনি এবারে থাপ্পড় বসালেন ছেলের গালে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“ গর্দভ! তোমার আসলেই সংসার করা উচিত না স্বচ্ছ।”
স্বচ্ছ গালে হাত দিয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। এভাবে মারাটা কি প্রয়োজন ছিল? কান ঝা ঝা করছে তার। স্বচ্ছ মুুখ বাঁকিয়ে নিজের ঘরে এল। সুহাকে ঘুমিয়ে থাকার ভান করতে দেখে ছোট শ্বাস ফেলে। কাছে গিয়ে ডাকে,
“ সুহাসিনী? খাবার খাব। খাবার বেড়ে দাও৷”
সুহা ওভাবেই উত্তর করে,

“ খেয়ে এসেছেন আপনি।মিথ্যে নাটক করবেন না। ঘুমোলাম। ”
স্বচ্ছ কথা বাড়াল না। কোনমতে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসলটা সেরে এসেই পা পেলে রান্নাঘরে গেল। কাঁচা হাতে থালায় খাবার বেড়ে নিয়ে ঘরে এল।শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
”খাবারও বেড়ে নিতে পারি না৷ সুহাসিনী? দেখোতো হলো কিনা? ”
সুহা চোখ মেলে তাকায়। খাবার বাড়ার নকশা দেখে ভ্রু কুুচকে বলে উঠে,
“ মা বাবার আদরের ছন্নছাড়া ছেলে ছিলেন বলে কথা। ”
স্বচ্ছ ফোঁস করে শ্বাস টানে। ভাতের গ্রাস সুহার দিকে এগিয়ে দিয়েই নতমুখী হয়ে বলে,
“ আমার কিন্তু দোষ নেই সুহাসিনী। তুমি কি একটা চিরকুট পেয়েছো? রেখে গিয়েছিলাম আমি পানির গ্লাস নিচে। ”
কথাটা বলেই স্বচ্ছ আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখাতেই সুহা সেদিকে তাকায়। চিরকুটই তো৷ স্বচ্ছ কি এটা এখন রাখল? হয়তো না। সুহা এগিয়ে নিল। গুঁটি গুঁটি অক্ষরে লেখা,

“ সুহাসিনী? তোমায় ঘুমন্ত দেখে চুমু দেওয়ার ইচ্ছেটা সামলানো গেল না। বড্ড আদুরে যে তুমি। এই আদুরে বউকে রেখে যাওয়াটা কষ্টকর! তবুও যেতে হচ্ছে। শত হোক তোমর বান্ধবী তো তোমারই মতো হবে তাই না? আমার বন্ধুটিকে আজীবন দেবদাস হয়ে কাটানোর প্ল্যান বানিয়েছে। আমি কি তা হতে দিতে পারি? তাই যাচ্ছি। নয়তো বউ ছেড়ে আমি এক পাও নড়তাম না। বিশ্বাস করো। ”
সুহার কেন জানি না শেষের পড়াটুকু পড়ে হাসি পেল।কিন্তু হাসল না। গম্ভীর মুখ করে স্বচ্ছর বাড়িয়ে দেওয়া খাবারটুকু মুখে নিল শুধু। স্বচ্ছ নিজেও মুখে খাবার নিল। বলল,
“ আমাদের বিয়ের কত বছর হলো সুহাসিনী?”
সুহা মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ে,
“ হুট করে এই প্রশ্ন? ”
স্বচ্ছ মুখটা ফাঁটা বেলুনের ন্যায় করে বলে,
“কারণ এত বছরেও আমার বাসর করা হলো না।”

তখন মধ্যরাত। ছুটি বহুক্ষন ধরেই আবিরের দিকে সূক্ষ্ম নজর ফেলে চেয়ে আছে।কি সুন্দর ফুলগুলো একপাশ করে টানটান হয়ে কপালে হাত রেখে শুঁয়ে আছে ছেলেটা। যেন সে ছাড়া এই ঘরে আর দ্বিতীয় কোন জীব অবস্থিত নেই। ছুটি বেশ কিছুটা সময় সেভাবে চেয়ে থাকে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে তার।মাথাটা যন্ত্রনা হচ্ছে যে বড্ড!শরীর চাপিয়ে কেবল ক্লান্তি। ছুটি আচমকাই ফোঁস ফোঁস শ্বাস টানল। তার অকারণেই কান্না পাচ্ছে। কেন পাচ্ছে বোধহয় সে নিজেও জানে না। চোখ টলমল করছে। এই মুহুর্তে এসে দাঁড়িয়ে তার নিজেকে একটা খেলার পুতুল পুতুল লাগছে কেবল! সামনের পুরুষটির প্রতি চাপা ক্ষোভ কাজ করছে। কান্নায় টলমল করছে চোখ। হয়তো যেকোন সময়ই কেঁদে ফেলবে। তাই তো দ্রুত পায়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নিরবে চোখের পানি ফেলে বহুটা ক্ষণ!কাঁদতে কাঁদতে ফুঁফিয়ে উঠতেই আচমকা টের পেল তাকে কেউ কোলে তুলে নিচ্ছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে যখন ভয়ে চোখ কুঁচকে নিবে তখনই বোধ হলো এটা আবির। কোলে তুলে এনে বিছানায় রেখেই নিজেও শুঁয়ে পড়ল অন্য পাশে। একদম অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই মুখ ঘেষে রাখল ছুটির ঘাড়ে। দুইহাতে জড়িয়ে নিয়ে সেভাবেই চোখে বুঝে নিয়ে শাসিয়ে বলে উঠে,

প্রেমের সমর পর্ব ৩৪

“ এভাবে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে কি বুঝাতে চাইছিস? আমি তোকে মেরেছি? অত্যাচার করেছি? চুপচাপ ঘুমা বেয়াদব! ”
ছুটি তখন যান্ত্রিক রোবটের মতো তাকিয়ে থাকল অন্যদিকে। কি হচ্ছে? আবির ভাই তাকে জড়িয়ে ধরেছে?ঘাড়ে মুখ ঘেষছে?অথচ তার কোন অনুভূতি হচ্ছে না!

প্রেমের সমর পর্ব ৩৬