প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ১১

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ১১
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

স্বচ্ছর বুকে সে ছোট্ট প্রাণটা। নিথর শরীর। নড়চড় নেই এইটুকু বাচ্চাটার। চোখ বুঝে বাবার বুকে পড়ে আছে নিশ্চিন্তে। যেন ঘুমটা কত সুন্দর। স্বচ্ছ বহুক্ষন বুকে আগলে নিয়ে বসে থেকে ড্যাবড্যাব করে দেখল নিজের মেয়েকে। কি মায়াবী তার প্রাণটা। কি সুন্দর পুতুলের ন্যায়। এই পুতুলটা আর জীবিত নেই,তাদের ছেড়ে চলে গেছে এটা যেন স্বচ্ছ মানতেই পারল না। গলা রুদ্ধ হয়ে আসে। দীর্ঘশ্বাসে বুক ভার হয়ে আসে। রক্তিম চোখ জোড়া আরো রক্তিম হয়ে উঠে ভেতরে পুষে রাখা যন্ত্রনায়। স্বচ্ছ তাকিয়েই থাকে। অতঃপর ফুলটাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে এতোটা সময় পর সে মুখ খুলল,

“ কি এত রাগ হয়েছিল আম্মুজান? যে এইভাবে চলে গেলেন আমাদের রেখে? আব্বু কি বেশি পঁচা? আদর দিই নি? বল না আম্মু… ”
এইটুকু বলতে বলতেই স্বচ্ছর লাল রক্তিম চোখজোড়া আবারো জলে পরিপূর্ণ হয়ে আসে। ছোট্ট আদুরে মুখটাতে কয়েকবার চুমু দেয় পাগলের মতো। অতঃপর আবারএ পাগলের ন্যায় রুদ্ধ স্বরে জানায়
“ আম্মুজান? কেন এভাবে চলে গেলি আম্মু? তুই জানিস তুই আমার কতোটা জুড়ে ছিলি এই কয়েকটামাস? কতোটা স্বপ্ন বুনেছি তোকে নিয়ে? কেন এমনটা করলি আম্মুজান? কেন এমনটা হলো? এই আম্মু?একবার তাকা না আম্মু।”
এইটুকু বলতেই স্বচ্ছর মা কেঁদে উঠল। তার ছেলেটা কি পাগলামে করছে।কত ভালোবাসে তার বাচ্চাটাকে। আর বিধাতা কি করল? তার ছেলের সাথেই কেন করল এমনটা? এই যে তার ছেলেটা গত এক সপ্তাহ ঠিকমতো না খেয়ে, না ঘুমিয়ে শুধুমাত্র তার বউ আর সন্তানের চিন্তায় ভীত হয়ে থাকত বিধাতা কি চাইলে এই ছেলেটার প্রতি একটু মায়া দেখাতে পারত না? কেন করল এই নিষ্ঠুরতা? স্বচ্ছর মা ফুঁফিয়ে কাঁদে। স্বচ্ছর মাথায় হাত রাখতেই স্বচ্ছ অসহায়ের মতো করে তাকায়। আকুতি নিয়ে বলে উঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ আম্মু? আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও না আম্মু।ওকে বলো না একটাবার তাকাতে। একটাবার হাত পা নড়াচড়া করতে? আম্মু? দেখো না, আমার মেয়েটা কত মিষ্টি। একদম সুহাসিনীর মতোই। আম্মু…”
স্বচ্ছর মা কাঁদতেই থাকে ছেলের প্রলাপ শুনে। তবুও বহুকষ্টে বলে,
” আব্বু? ও আর নেই আব্বু। আমার নাতনিটা আর বেঁচে নেই। তুমি এমন পাগলামো করলে সুহাকে কি করে জানাব বিষয়টা বলো? কিভাবে সামলাব? মেয়েটাতো আরো দ্বিগুণ পাগলামি করবে। এদিকে জানানো ও প্রয়োজন। কারণ ও তো মা। ”

স্বচ্ছ হুট করেই গম্ভীর চাহনিতে তাকায় এবারে। সুহাসিনীকে কি করে জানাবে এই সত্যটা? মেয়েটা বড্ড খুশি ছিল যে। কি করে বলবে সত্যিটা? সবটা শুনে কিই বা করবে সুহা? এখনও তো পুরোপুরি সুস্থও নয়৷ স্বচ্ছ পারবে মানাতে মেয়েটাকে? স্বচ্ছ শুকনো ঢোক গিলে। হুট করেই নিজের সব কষ্ট ভেতরে চেপে রেখে তার প্রাণটাকে তার আম্মুর কোলে দেয়। অতঃপর যন্ত্রমানবের মতোই পা বাড়িয়ে চলতে লাগল সুহার উদ্দেশ্যে। অবশেষে গেল ও।গিয়েই বেশ মনোযোগ দিয়ে এক নজর তাকাল সুহাসিনীর পানে। বসে আছে একা একা জানালার দিকে মুখ করে। বোধহয় আকাশ দেখছে মেয়েটা। স্বচ্ছ যে কথাটা জানানোর জন্য এখানে এল তা যেন মুহুর্তেই নিরব বার্তায় পরিণত হলো। বলতে পারল না সে। এই মেয়েটাকে এই খবর কিছুতেই বলতে পারবে না সে। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সুহা ততক্ষনে তার দিকে ফিরে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ সকাল থেকে আজ আপনাকে দেখা গেল না।কোথায় ছিলেন স্বচ্ছ? মেয়ের খোঁজ নিয়েছেন? আজ তো কোন নার্সও ওর ব্যাপারে কিছু জানাল না,বলল না, আনল না, কি ব্যাপার বলুন তো?দেখে এসেছেন ওকে?আমার মেয়েটা কি করছে এখন স্বচ্ছ? ও কখন পুরোপুরি সুস্খ হবে? ও সহ বাড়ি ফিরব স্বচ্ছ। ”
স্বচ্ছ শুনল ঠিক। তবে উত্তর করতে পারল না। ভারী হয়ে আসে বুক। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“ হু? ”
সুহা ভ্রু কুঁচকে তাকায় স্বচ্ছর দিকে। চোখজোড়া লাল। মুখচোখ এই কয়দিনে শুকিয়ে এইটুকু হয়েছে। মুখর দাঁড়িগুলো অব্দি বেড়েছে। চুলগুলো উষ্কুখুষ্কু ঠেকছে। স্বচ্ছ এই কয়দিনে কবেই বা বাড়ি গিয়ে ঠিকমতো গোসল করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে এসেছে সুহা জানে না। সর্বক্ষন তার কাছে নয়তো মেয়ের কাছে। সুহা মুহুর্তেই প্রশ্ন করে,
“ বাসায় গিয়েছেন স্বচ্ছ? তাই আজ আসেননি? ”
স্বচ্ছ কি করে বলবে সকাল থেকে মেয়েকে নিয়ে দৌাড়াদৌড়ি করেছে তাই আনতে পারেনি। কি করে বলবে তার এইটুকু পুতুলের ন্যায় মেয়েটা আর নেই? কি করে বলবে এসব? সুহা ফের বলে,
“ কিছু ভাবছেন স্বচ্ছ?আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো? ”
স্বচ্ছ মুহুর্তেই চমকে গিয়ে উত্তর করল,

“ হু? নাহ, না তো, কিছু ভাবছি না। ”
সুহা ফের বলে উঠে,
“ আমার পিচ্চিটা সু্স্থ এখন স্বচ্ছ? ”
স্বচ্ছ এই মুহুর্তে টের পায়, সুহাকে এই কথাটা বলার মতো সাহস তার নেই। সত্যিই নেই। অস্ফুট স্বরে বলে,
“ হ্ হু? ”
সুহা ফের তাগড়া করে বলল,
“ স্বচ্ছ? আমার মেয়েটা ভালো আছে তো? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ”
স্বচ্ছ অন্যমনস্ক । উত্তর যে দিতে সে আসলেই পারবে এমন ও নয়।সুহা ফের ডাকে,
“ স্বচ্ছ? ”
স্বচ্ছ এই মুহুর্তে উত্তর না দিয়েই উল্টো ঘুরে আবারো। বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
“ আমার একটু কাজ আছে সুহাসিনী। আসছি।”
অথচ স্বচ্ছর কাজ নেই। স্বচ্ছ সবসময়ই তার সুহাসিনীর জন্য ফ্রি হয়ে থেকেছে। সব কাজকে পেছনে রেখে গুরুত্ব দিয়েছে কেবল সুহাকে। আর আজ?আজ কাজের অযুহাত দিয়েই তাকে সরতে হলো কাপুরুষের ন্যায়। কারণ সত্যটা বলার সাহস যে তার নেই।

আবির গুণে গুণে আঠারোটা শাড়ি কিনেছে। তাও এই সন্ধ্যাবেলায়।অতঃপর শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে ছুটির জন্য চুড়ি, বেলিফুলের মালা সহ সবই কালেক্ট করল৷ ছুটিকে আজ সবটা বলা যাবে। অভিমান ভাঙ্গানে যাবে সময় নিয়ে৷ ছুটি কি ভেবেছে? সে এই অবহেলা মেনে নিবে? রাগ ভাঙ্গাবে না?বরং দূরত্ব বাড়াবেই? আবির চাইলে আগেই বলে দিতে পারত সবটা যখন এর আগেও ফোনে যোগাযোগ হয়েছিল। কিন্তু সে তো চেয়েছিল নিজ চোখে প্রেয়সীর অভিমান দেখতে। অভিমান ভাঙ্গিয়ে প্রেয়সীর তুলতুলে কান্নাময় মুখটা বুকে নিয়ে আদরময় চুমু দিতে ললাটে। একদম প্রত্যক্ষভাবে ভালোবাসা দিয়ে সবটুকু রাগ, অভিমান ভুলিয়ে দিতে। আবির মনে মনে এতদিন তাই ভেবে রাখল এত আরাম করে। অথচ আবির কি জানে সময়ের গুরুত্ব কতোটা? যে সময়টায় বসে সে এসব ভেবেছিল সে সময়টাতেই তার প্রেয়সী ভেবেছিল তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা, ভুলে যাওয়ার কথা৷ আবির যেটাকে উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করেছে সেটা যে আসলে সুযোগ হারানো তা আবির বুঝেই উঠল না। এমনকি এখনও বুঝে উঠছে ছেলেটা। নিজের মতো করে প্রেয়সীর জন্য কেনাকাটা করে সে গিয়ে উঠল শ্বশুড়বাড়িতে। শ্বশুর আব্বা হতে শ্বাশুড়ি আম্মু সবাইকে সালাম দিয়ে মুহুর্তেই শুধাল,

“ আপনাদের মেয়ে কি আমার সামনে আর দেখা দিবে না? না দিলে বলুক সে, আমি দরজা ভেঙ্গে হলেও তাকে দেখে আসি। ”
ছুটির বাবা গলা ঝাড়লেন। আবিরের দিকে তাকিয়ে হুট করে গম্ভীর স্বরে জানালেন,
“ আবির? তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার। ”
এই পর্যায়ে আবির সন্দেহী চোখে তাকায়। ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,
“কথা তো পরেও বলা যাবে। কিন্তু বউ দেখা করাটা বেশি ইম্পোর্টেন্ট শ্বশুড় আব্বু। ”
এবার আবারও উনি বললেন,
” সে বিষয়েই কথা ছিল। ”
আবির ভ্রু বাঁকিয়ে মুহুর্তেই বলে,
“ আপনারা যে ধান্ধাবাজ আঙ্কেল। আগের বারের বিষয় কি ভুলে গিয়েছি নাকি আমি? হয়তো আপনারাই দিচ্ছেন না ওকে আমার সামনে আসতে। হতেই পারে।”
কথাগুলো বলেই সে গটগট পায়ে ছুটির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজায় টোকা না দিয়ে ধমকের স্বরে বলে উঠে,

“ ছুটির বাচ্চা ছুটি? দরজা খুল নয়তে খুব খারাপ হবে। ”
যখন এই ধমক দেওয়ার পরও ভেতর থেকে কেন রেসপন্স এল না তখন আবিরের দ্বিগুণ মেজাজ খারাপ হয়। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে সে পুণরায় শুধায়,
“ এই ছুটি, দরজা খুলবি নাকি ভেঙ্গে ফেলব আমি? মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু। ছুটি…. ”
এইটুকু বলেই দরজায় একটা লাথি বসাতে নিল সে। ঠিক সেই মুহুর্তেই দেখা গেল লাথির ধাক্কায় দরজাটা খুলে গেল। আবির অবাক হয়। তার মানে দরজা আটকানো ছিল না। আবির যখন চমকে গিয়ে রুমের ভেতরে গিয়ে তাকাল ঠিক তখনই দেখল রুম খালি। রুমে কারো উপস্থিতি না দেখেই আবির সরু চাহনিতে চাইল। মুহুর্তেই জিজ্ঞেস করল,

“ ছুটি কোথায়?”
“ ও নেই। ”
উত্তরটা পেয়েই আবির যেন বুঝে নিল অজানা আশংকা। এই মেয়েটাই সবই পারে। মিথ্যে মিথ্যে ভেবে প্রতিবারই তার থেকে দূরে মরে যেতে ওস্তাদ এই মেয়েটা। আবিরের কলিজায় মোচড় দেয়। পুণরায় গম্ভীর গলায় শুধায়,
“নেই মানে? ”
“ বাসাতে নেই। ”
“ কোথায় আছে এখন? ”
এই পর্যায়ে ছোটন এসে উত্তর দিল,
“ অন্য দেশে। ”
কথাটা বলেই ফের বলে,

“ আপু স্কলারশিপ পিয়ে অন্য একটা কান্ট্রিতে পড়তে গিয়েছে আবির ভাই। তোমার জন্য একটা চিঠি রেখে গিয়েছে আপু। বলেছে, যদি কখনো তুমি ফিরো তাহলে দিতে। ”
আবির ছোটনের কথাগুলে শুনে চুপ থাকে। এই ছোটনকে সে সত্যিই অনেকটুকু বিশ্বাস করেছিল। অনেকখানি ভালোবাসত। সে ছোটনই তাকে মিথ্যে বলেছে এতদিন বুঝতে পেরে বলল,
“ তুই ও ছোটন?বিশ্বাসঘাতক! তোরা সবকয়টাই বিশ্বাস ঘাতক। ”
কথাটুকু বলেই আবিরের হাত থেকে চিঠিটা নিল। চোয়াল শক্ত করে মেলে ধরল মুহুুর্তে,

আবির ভাই? আপনি যখন চিঠিটা পড়বেন তখন আমি আপনার থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থানরত থাকব। সম্ভবত আপনিও এটাই চেয়েছিলেন। দূরত্ব!আমার মতে গুরুত্বহীন মানুষরা কাছে থাকলেও গুরুত্ব আর কোথায় বা পায় বলুন? এর চাইতে বরং দূরেই থাকলাম। আচ্ছা আবির ভাই?গুরুত্ব পেতে একটা মেয়েকে ঠিক কেমন হতে হয়? সুন্দরী হতে হয়?আচ্ছা? আর কতটুকু সুন্দরী হলর আপনি আমায় অবহেলা করবেন না আবির ভাই?আপনার লিজার মতো সুন্দরী? আবির ভাই,লিজাকে বউ বানানোর ইচ্ছে হলে বানাতেই পারেন, আমাকে ইনভাইট করতে ভুলবেন না। যদি অন্য কোন মেয়েকেও বউ বানাতে চান তাও অনুমতি দিয়ে রাখলাম। আর হ্যাঁ, যদি কখনো মনে হয় বিচ্ছেদ প্রয়োজন? ছোটনকে বলবেন। আমি অবশ্যই বিচ্ছেদের দিন হলেও আপনার মুখোমুখি দাঁড়াব। আর এমনিতে বোধহয় আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনাটা ক্ষীণ।যায় হোক, যেটুকু ভালোবাসা আমি আপনার দিক থেকে পেয়েছি সেইটুকু আমি আজীবন মনে রাখব। আজীবন সেই স্মৃতিটুকু আমি মাথায় নিয়ে ঘুরব। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে ঐটুকু ভালোবাসা দেওয়ার জন্য। যাক, তবুও সৌভাগ্য আমার। অবহেলার শহরে একটু হলেও ভালোবাসার দেখা মিলেছিল!

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ১০

ইতি,
ছুটি
আবির পুরোটায় পড়ল। রাতে চোখমুখ লাল করে মুহুর্তে একটাই শব্দ কেবল উচ্চারণ করল,
“ স্টুপিড!”

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ১২