প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৪১

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৪১
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

হসপিটালে পৌঁছিয়ে যখন সেই সাদা কাপড়ে মোড়ানো দৃশ্যটা সাদের দৃশ্যমান হলো ঠিক তখনই সাদ থেমে গেল। অদ্ভুতভাবে তার মনে হচ্ছিল সে আর পা বাড়াতে পারছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে। বুকের বামপাশে তীব্র ব্যাথা হৃদপিন্ড খুবলে ধরেছে যেন। সাদ সত্যিই নিঃশ্বাস নিতে পারল না। অসম্ভব ভাবে তার হাত পা কাঁপতে লাগল যেন। চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে উঠল ক্রমশ। সুহা কেবল খেয়াল করছিল সাদকে।

চোখজোড়া দেখে সত্যিই শিউরে উঠে। অতঃপর যখনই সাদকে জিজ্ঞেস করতে নিবে ও ঠিক আছে কিনা তখনই দেখল সাদ বুকের বা পাশটায় হাত দিয়ে চেপে রেখেছে। রক্তিম চোখজোড়া বেয়ে ফের পানি গড়াল তখনই। সুহা ছোটশ্বাস ফেলে। সে নিজেও কাঁদছে। পাশে তার শ্বাশুড়ি মাকে সামলাতেও তার হিমশিম খেতে হচ্ছে তবুও কেন জানি পৃথিবীর বুকে থাকা এই সাদ ছেলেটার জন্য তার অদ্ভুত কষ্ট হলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বন্ধু বলে কথা!সাদ জীবনে ভালোবাসা নামক বস্তুটার একটিবারও মুখ দেখল না ভেবে তার দ্বিগুণ কান্না এল যেন। ছেলেটা প্রথমবার নিঃস্বার্থভাবে যাকে ভালোবাসল সে চোখের সামনেই অন্যের হলো, আর যাকে দ্বিতীয়বার ভালোবেসে নিজের জীবনে চাইল তাকে সৃষ্টিকর্তা কেড়ে নিল। কি নিষ্ঠুর! সুহার চিন্তা ভাবনাকে ভঙ্গ করে এই পর্যায়ে সাদ জ্ঞান হারিয়ে আচমকায় লুটিয়ে পড়ল হসপিটালের ফ্লোরে। সুহা চমকে উঠে। শ্বাশুড়িকে ছেড়ে এবারে দৌড়ে গিয়ে ধরতে নিল সাদকে। স্বচ্ছ তখন সাদা কাপড়ে মোড়া লা’শটার কাপড়টা উঠাতে নিবে ঠিক তখনই সাদের এই দৃশ্যটা দেখে তার দিকে এগিয়ে আসতে নিল। ঠিক তখনই তার কল এল। স্বচ্ছ তখন কল ধরার হুশে নেই। দৌড়াদৌড়ি করে সাদের কাছে যেতেই যখন আবারও কল এল তখনই কপাল টানটান করে বিরক্তই হলো। আচমকা কি বুঝে কল তুলল। ঠিক তখনই ওপাশ থেকে সিয়া বলে উঠল,

“ ভাইয়া? কোথায় তোমরা সবাই? আশ্চর্য! বাসায় তালা কেন হু?”
স্বচ্ছর কানে কন্ঠটা যেন চমৎকার কোন যাদু এসে ছুঁয়ে গেল মনে হলো। এক মুহুর্তের জন্য বিশ্বাস হলো না এই কন্ঠটা তার বোনেরই। স্বচ্ছর হঠাৎ চোখ বেয়ে জল গড়াল বোনের কন্ঠ শুনে। হৃদয়ে জেগে উঠল অফুরন্তত আশা আর সুখ সুখ অনুভূতি। স্বচ্ছ মুহুর্তেই উদ্গ্রীব হয়ে শুধাল,
“ সিয়া? এই সিয়া? কথা বল, তুই ঠিক আছিস তো সিয়া? বোন আমার… ”
সিয়া ততক্ষনে ভ্রু কুঁচকাল। ভাইয়ের এমন প্রশ্ন আর স্বর শুনে মুহুর্তেই শুধাল,

“ আমি ঠিক আছি ভাইয়া। তবে সম্ভবত আমার ফোনটা আমি কলেজের এক টিচারের কাছে ফেলে এসেছি ভুলে। উনি ফোন নিয়ে যাননি আজ,হাজব্যান্ডকে কি দরকারে কল দেওয়ার ছিল। আমি আমার ফোনটা দিয়েছিলাম ফেরার সময়ে। তারপর একসাথে বাসায় ফেরার জন্য রিক্সায় উঠলাম। উনিও উনার হাজব্যান্ডের সাথে কথা বললেন। তারপর রাস্তায় কি নিয়ে কথা বলতে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম ফোনটা নিতে, উনিও হয়তো গল্পের মধ্যে প্রতিদিনের মতো নিজের ফোন মনে করে ব্যাগে নিয়ে নিয়েছেন। একদমই ভুলে গেছি ফোনটা নিতে। ”
স্বচ্ছর বুক হালকা হয়ে আসে। সুখ সুখ অনুভূতিতে তারও ইচ্ছে করে মায়ের মতে আহাজারি করে কান্না করতে। তার বোনটা বেঁচে আছে। বেঁচে আছে! ইশশ! এরচাইতে সুখের যেন আজ কিছুই নেই এই পৃথিবীতে। স্বচ্ছ চোখ বুঝে। মুহুর্তেই বোনকে শোনায়,

“ সে টিচার রিক্সায় করে বাসায় ফিরে গিয়েছিল বোন? ”
আজ তার বারবারই সিয়াকে “সিয়া” নয়, বরং বোন বলে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার একটামাত্র বোন। একমাত্র আদুরে বোন!সিয়া ভাইয়ের আদুরে স্বরে কিছুটা বিস্মিত হলেও হাসল। জানাল,
“ বাসায় তো ফেরেনি, তবে মাঝপথে উনার কিছু কেনাকাটা আছে বলে নেমে পড়েছিলেন ভাইয়া। কেন? তুমি কি আমার নাম্বারে আর কল দিয়েছিলে? উনি রিসিভ করেছিলেন? ”
স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর গম্ভীর শান্তস্বরে জানাল,

“ সম্ভবত সে টিচার মা’রা গেছে বোন। তুই একবার হসপিটালে আসবি? উনার কোন আত্মীয়ের নাম্বার থাকলে কল করে জানানো উচিত। ”
সিয়া আকস্মিক খবরটা পেয়ে কেঁপে উঠল যেন। যে মানুষটার সাথে এতটা পথ এত গল্পগুজব করে হেসে হেসে কথা বলে এল সে মানুষটা আর বেঁচে নেই শুনে বিশ্বাস করতে মন চাইল না মেয়েটার। অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
“কিসব বলছো ভাইয়া? জ্বলজ্যান্ত মানুষটা কি করে মারা যেতে পারে? আশ্চর্য! ”
স্বচ্ছ সবটাই খুলে বলল। সিয়া ছোটশ্বাস ফেলে।সবটা বুঝে উঠে তাড়াতাড়ি সে রিক্সা নিল। ভাই এর থেকে হসপিটালের নাম জেনে নিয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য রওনা হলো দ্রুত।

সাদের জ্ঞান ফিরেছে। তার পরপরই তাকে সুহা জানিয়েছে যে সিয়া বেঁচে আছে। সিয়া মারা যায় নি। সাদ বিশ্বাসই করল না সে কথাটা। ভেবে নিল সুহা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেে।পাগলের মতো হসপিটালের করিডোর থেকে হন্তদন্ত পায়ে সেই সাদা কাপড়ে মোড়ানো লা’শটার দিকে যেতে নিতেই আচমকা দেখা মিলল সিয়ার। মাত্রই প্রবেশ করছিল। পরনে বরাবরের মতো শাড়ি, কাঁধে ব্যাগ। কপালে কিছু চুলে ঘামে লেপ্টে আছে। বোধহয় এতোটা পথ ছুটে আসার কারণেই মুখচোখ ঘামে আধভেজা। সাদ দৃষ্টি স্থির রেখেই তাকাল।

এক পাও বাড়াল না আর। বুকের ভেতর জ্বলন্ত সেই আগুন আচমকায় শীতল হয়ে এল। নিভে এল যন্ত্রনা। সাদের চোখ জ্বলজ্বল হয়ে উঠে। এই মেয়েটা বেঁচে আছে এই সত্যটুকু গ্রহণ করে সে চোখ বুঝে ফেলল অতি সুখে। কি সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে তার! সৃষ্টিকর্তা যদি আজ এই দৃশ্যের সম্মুখীন না করত তবে বোধহয় সে টেরই পেত না সিয়াকে এই এা পলক দেখতে পাওয়ার সুখ এতোটা গাঢ়! এতোটা প্রখর! সাদ ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের। অতঃপর সিয়া যখন তাকে অতিক্রম করে চলে যেতে নিবে ঠিক তখনই সাদ চোখ বুঝে থাকা অবস্থাতেই সিয়ার হাতটা আঁকড়ে ধরল। চোখ বুঝেই কি ভীষণ তীব্র আহ্বান নিয়ে ডেকে উঠল,

“ সিয়া? ”
সিয়া চমকায়। এই পুরুষটিকে সে খেয়ালই করেনি। অথচ কন্ঠটা তার চিরচেনা কন্ঠস্বর! সিয়া মুহুর্তেই তাকাল। সাদকে ওভাবে চোখ বুঝে, ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। নিজের হাতটা সাদের হাতের বাঁধনে টের পেয়ে শুধাল,
“ সাদ ভাই? আপনি? এখানে?আপনার কেউ হসপিটালে এডমিট আছে সাদ ভাই?”
সাদ মুহুর্তেই চোখ খুলল। তীব্র লাল রক্তিম চোখজোড়া দেখে সিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকাল। সাদের নাকের অগ্রভাগও কি ভীষণ লাল দেখাল। সাদের কি কান্না পাচ্ছে? ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে? সিয়ার মাথা অতোশত প্রশ্নের ঘুরপাক খেতেই আচমকা সাদ বলল,

“ সিয়া? আমি প্লিজ একবার তোমায় জড়িয়ে ধরব? নিষেধ করো না…”
সাদ জিজ্ঞেস করল ঠিক। তবে অনুমতি টুকু নেওয়ার আগেই সে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল সিয়াকে। এতোটা শক্তপোক্ত ভাবে জড়িয়ে নিল যেন সে পারলে মেয়েটাকে নিজের বুকের ভেতরে ডুকিয়ে রাখবে। সাদ এতোটাই শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরল মেয়েটাকে।মুখ গুঁজল সিয়ার গলার অংশটায়।জড়িয়ে ধরেই তার চোখের পানিটা এবার তীব্র বেহায়ার মতো তৃতীয়বারের মতো নিজের উপস্থিতির জানান দিল। আকস্মিক ঘটনায় সিয়া প্রথমে হতভম্ব হলেও পরমুহুর্তেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল।গলার দিকে উষ্ণ তরলের উপস্থিতি টের পেয়ে সে ভ্রু ও কুঁচকাল। অতঃপর দ্রুত বিরক্তস্বরে বলে উঠল,

“কি হচ্ছে কি সাদ? ছাড়ুন। আমি আপনার ওয়াইফ নই,ছাড়ুন আমায় সাদ। ”
সাদ ছাড়ল না সিয়ার তীব্র অবহেলা পেয়েও। বরং আরো শক্ত করেই মেয়েটাকে চেপে ধরল নিজের সাথে। যেন খুব খুব করে চাইল এই মেয়েটাকে শক্তপোক্তভাবে জড়িয়ে ধরে নিজের হৃদপিন্ডের ভেতর ডুকিয়ে নিতে। সিয়া যখন ছটফট করল তাকে ছাড়ার জন্য সাদ তখন তার গলার দিকে মুখ গুঁজে কেবল এইটুকুই বলল,
“ আমার এই না পাওয়ার জীবনে অপূর্ণতার অংক বহু সিয়া। তুমি অন্তত আমার পূর্ণতা হয়ে ধরা দাও। তুমি অন্তত আমার হয়ে আমায় পূর্ণতার সুখ দাও। এটুকুই আবেদন তোমার প্রতি সিয়া। আজকের মতো নিষ্ঠুরতা আর কক্ষনো করার সাহস তোমার না হোক। কক্ষনো না! ”

কথাটুকু বলেই সাদ চুপ থাকল। সিয়া ততক্ষনে স্থির হয়ে গেল। বুঝার চেষ্টা করল সাদ কি বলল? কি বুঝাল? সাদ কথাগুলো বলার পরও কতোটা সময় তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ছিল। অতঃপর মুখ তুলল। সিয়াকে আর একটা শব্দও না বলে, সিয়ার দিকে আর একটিবারও না তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরল নিজের মতো করে। সিয়া অদ্ভুত, অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকল। কি হলো এই পুরুষটার? এভাবে জড়িয়ে রাখল কেন এতোটা সময়? লোকটা কি কাঁদছিল? তার গলায় উষ্ণ তরল? মুহুর্তেই সিয়া গলায় হাত রাখল। হ্যাঁ, সত্যিই তো। তরল!তার মানে,,, সাদ কাঁদছিল? কান্না করতে করতে বলছিল কথাগুলো? কেন? সাদ কি বিয়ে করেনি এখনো?

রোহান বিছানায় শুঁয়ে আছে।তার বুকের উপরই বেশ আরাম করে বসে পড়েছে তার একমাত্র মিষ্টিমতো মেয়েটা। অতঃপর দুই হাত বাড়িয়ে নিজের আব্বুর চুলগুলো মুঠো মুঠো করে ধরে যেন আলাদা আনন্দ মিলছে তার। রোহান নিজের একমাত্র কন্যার এহেন কান্ডে ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠছে একটু সময় পরপরই। অথচ তার মেয়ের আলাদাই আনন্দ এতে। একটু সময় পরপরই মুঠোভর্তি চুলগুলো দিচ্ছে টান। রোহান হতাশ হয়ে চোখ ছোটছোট করেই তাকাল। বলল,
“ মা, আব্বুকে ব্যাথা দিয়ে কি মজা পাচ্ছো?”
কথাটা বলামাত্রই রাহা হেসে উঠল খিলখিল করে। বিছানায় রোহানের পাশাপাশিই বসল।মেয়েকে বাহ্ বা দিয়ে মুহুর্তেই বলে উঠল,

“ সাব্বাশ! এইনাহলে আমার মেয়ে? আরো বেশি বেশি করে চুল টানো আম্মু। আম্মু তোমার পাশে আছে। ”
ছয়মাসের এইটুকু মেয়েটা বেশ আগ্রহ নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল মায়ের দিকে৷ মায়েে হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে সেও হাত নাড়িয়ে মুহুর্তেই হেসে উঠল যেন। পরমুহুর্তেই পরম আগ্রহে দুই হাত জোড়া এগিয়ে থাবা বসিয়ে আঁকড়ে ধরল মায়ের লম্বা চুলগুলোর একাংশ। দুইহাতে সেই লম্বা চুলগুলো টেনে নিয়েই যেন সে বড্ড খুশি। মুহুর্তেই প্রফুল্লময় হাসি উপহার দিয়ে বাবার বুকে হাত পা নাড়িয়ে হৈ চৈ করে উঠল সে। আর রাহা তখন বহু কষ্টে মেয়ের হাতের মুঠো থেকে নিজের চুল ছাড়াতে ব্যস্ত। রোহান হাসে রাহার অবস্থা দেখে। অতঃপর মেয়ের গালে হাত রেখে বড্ড মিষ্টি গলায় বলল,

“ আম্মু? মা কষ্ট পায় না? ছেড়ে দাও। আমরা বাইরে থেকে ঘুরে আসব। ”
রোহানের ঐটুকু মেয়ে কথাটা বুঝল না হয়তো, তবে বাবার আদর পেয়ে মুহুর্তেই ছেড়ে দিল মায়ের চুল। রোহান হাসল। রাহা বিড়বিড় করে বলল,
“বাপ বেটি দুইজনই মীরজাফর! ”
রোহান হেসে উঠল উচ্চআওয়াজে। তার মেয়েটা বাবার এমন হাসি খুব আগ্রহ নিয়েই তাকিয়ে দেখল। রোহান অবশ্য পরপরই মেয়েকে কোলে নিয়ে উঠে বসল। রাহাকে ফিসফিস করে বলল,
“ মীরজাফর হলেও আপনার প্রতি ভালোবাসার কোন কমতি নেই মহারাণী।”

সন্ধ্যে হয়ে আসার সময়টাতে ছুটি পায়চারি করছিল রুমে। বিকাল থেকেই পেটে একটু চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছিল তার। এদিকে আবির তখনও বাসায় আসেনি। সে পরিচিত আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছে। যদিও যেতে চায়নি, ছুটি নিজেই নিশ্চিন্ত করে পাঠিয়েছে।অথচ আজই এমন পেটের ব্যাথা হবে কে জানে? ছুটি প্রথমে কাউকে বলবে কি বলবে না বুঝে উঠল না।কিন্তু ক্রমশ যখন ব্যাথা বাড়তেই লাগল তখন আর সহ্য করতে পারল না মেয়েটা। দ্রুত জানাল বাসার লোকজনকে। বাসার সবাইও দ্রুত হসপিটালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আবিরকে জানানো হলো ফোনেই। গাড়িতে রাস্তা থাকায় অবস্থাতেই আবির বারবার কল দিল। ছুটি সবটা সময়ই ব্যাথা সহ্য করে কানে ফোন নিয়ে রাখল। আবির শুধু বলে গেল,

“ ছুটি?তোর খুব কষ্ট হচ্ছে না প্রাণ?খুব বেশি যন্ত্রনা হচ্ছে না? এই ছুটি? কথা বল না?তুই স্ট্রং না? এই ছুটি?”
আবির খবরটা পাওয়ামাত্রই ফেরার জন্য রওনা হয়েছিল। সে ড্রাইভ করছিল নাকি বউয়ের চিন্তায় পাগল হয়ে শুধু এসব বলে যাচ্ছিল কে জানে।ছুটি যদিও কয়েকবার আশ্বাস দিয়ে বলেছে,
“ চিন্তা করবেন না, আমি সহ্য করে নিব। আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি ফিরুন। অপেক্ষা করছি। ”
আবির দ্রুতই ড্রাইভ। যতোটা তাড়াতাড়ি পারে যেন সে পৌঁছানোর চেষ্টা করল। অতঃপর হসপিটালে পৌঁছানোর আর একটু আগেই সম্মুখীন হলে জ্যামের। আবির নিজের মুখেই গা’লি দিল ভাগ্যকে নিয়ে। বারবার ফোন দিয়ে খবর নিচ্ছিল। অতঃপর একটু পর ফিরতি কল এল । আবির দ্রুতই কল তুলল। ছুটি এবারে কেঁদে উঠল আচমকায়৷ ভেজা স্বরে শুধাল,

“ আমি একটাবার আপনার দেখা পেতে চেয়েছিলাম।আপনি তো এলেন না। আমি আপনি না আসা পর্যন্ত ভেতরে যাব না।”
আবিরের কলিজাটা যেন কেমন করে উঠল। এই সময়টা ছুটির তাকে প্রয়োজন। খুব করে প্রয়োজন। অথচ সে নেই। আবিরের যে কি দমবন্ধ লাগে সে বুঝাতে পারে না যেন। আবির ঠান্ডাস্বরে বুঝানোর চেষ্টা করে বলল,
“ বোকাপাখি? আর একটু, এইতো চলে আসছি আমি। আর একটু অপেক্ষা কর প্রাণ। ”
ছুটি ব্যাথা সহ্য করতে পারে না। আহাজারি করে উঠে। আবির সে আহাজারি শুনে চোখ বুঝল। বুকে তীব্র যন্ত্রনাময় একটা অনুভূতি নিয়ে বলল,

“ তোর খুব কষ্ট হচ্ছেনা? আমি, আমি যদি তোর কষ্টটা ভাগ নিতে পারতাম…. আমার পাগল পাগল লাগছে ছুটি। আমি আর কক্ষনো বাবা হতে চাইব না, কক্ষনো না৷ আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বোধহয় তোকে এভাবে দেখলে সত্যিই সহ্য করতে পারতাম না। ”
কথাগুলো বলতে বলতেই আবির ফোনের ওপাশ থেকে অন্য কারোর কন্ঠ শুনল,
“ মিঃ আবির? উনাকে বুঝান। উনি এক্ষুনি ও.টি. রুমে না গেলে ক্ষতি হবে। উনার এবং উনার বাচ্চার দুইজনেরই। আপনি কখন আসবেন তা তো শিওর নই আমরা, প্লিজ উনাকে বুঝান। ”
আবির রিস্ক নিতে পারল না। ফোনটা ছুটিকে দিতে বলে বুঝিয়ে গেল কতোটা সময়৷ বলে গেল অনবরত সে দ্রুত ফিরছে, ছুটি যাতে ভেতরে নিয়ে যেতে নিষেধ না করে। সে দ্রুতই ফিরছে! ছুটি শেষমেষ মেনে নিল। যন্ত্রনায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে শেষবার শুধু আবিরকে বলল,

“ শুনুন, আমার শেষ কথাটা…যদি আমার কিছু হয়, আমার মেয়েকে আপনি কখনো অনাদর করতে পারবেন না। কখনোই না। দ্বিতীয় বিয়ে করার হলে আমার মেয়েটাকে আমার আম্মুর কাছে দিয়ে যাবেন। আমার মেয়েকে কখনো কষ্ট দিবেন না।”
আবির থম মেরে থাকল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল হৃদয় থেকে। বলল,
“ তোর কিছু হবে না ছুটি। তোকে অবশ্যই আমার মেয়েসহ ফিরতে হবে। আমার মেয়েসহ ফিরে না এলে আমিও মেয়েকে আদর করব না। তুই সহ একসাথে আদর করব।মাইন্ড ইট। ফিরতে হবে তোকে। ”

শেষ বাক্যটা আবির কিছুটা শক্ত স্বরেই বলল৷ আবির অতিরিক্ত চিন্তায় অস্থির হয়ে কপালে আঙ্গুল চালিয়ে শিথীল করার চেষ্টা করল। বারবার সৃষ্টিকর্তাকে বলে গেল তার স্ত্রী এবং সন্তানকে যাতে সুস্থ রাখে।
অতঃপর আবির যখন হসপিটালে এল তখন ছুটিকে ভেতরে নেওয়া হয়েছে। ছুটি নাকি অনেকবার তার সাথে দেখা করার জন্য পাগলি করেছে। তাকে কল করার আগেও অনেকবার জানতে চেয়েছে আবির কখন আসবে। আবিরের পাগল পাগল লাগল যেন নিজেকে। কেন তাকে ঐ পরিচিতের ইনভাইটেশন রক্ষার্থে সে বিয়েটায় যেতে হলো? কেন? আবির ছটফট করে। অস্থিরতায় অস্থির হয়ে বারবার মাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল আর কতক্ষন লাগবে?

তার ছুটিটা ফিরবে তো? তার আম্মুটা ঠিকমতো জম্মাবে তো? আবির চিন্তায় অস্থির হয়ে বারবার যখন পায়চারি করছিল ঠিক তখনই অপর পাশ থেকে ভেসে আসল তীব্র আহাজারি আর ক্রন্দনের আওয়াজ। আবির ফিরে চাইল। একটা মেয়েলি শরীর পড়ে আছে চোখ বুঝে, নিথর দেহ! আর তাকে আঁকড়েই কেঁদে যাচ্ছে এক যুবক। বারবার বলছিল কি করে তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারল? আবির বুঝল, যুবকটি মেয়েটির স্বামী। এবং মেয়েটি যে মা’রা গেছে তাও বুঝতে পারল। আবির সেই দৃশ্যটা দেখার পর আচমকাই টের পেল তার বুকের ভেতর তীব্র মোঁচড়! একটাবার ঐ যুবকের জায়গায় সে নিজেকে বসিয়ে অস্থিরতায় অস্থির হয়ে উঠল। না, সে বাঁচতে পারবে না। ছুটিকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা সম্ভবই নয়। কি করে বাঁচবে সে?

আবিরের শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে এল।হৃদয়ের ভেতর কি তীব্র ব্যাথা, যন্ত্রনা, চাপা অস্থিরতা!এই এইটুকু সময়, মাত্র কয়েক মিনিট! এই কয়েক মিনিটকেও তার কাছে এই মুহুর্তে বিশাল সময় লাগছে। যেন সময় ফুরিয়ে আসছেই না।আবির বারবার প্রার্থনা করল কেবল তার জীবনের বিনিময়ে হলেও তার স্ত্রী এবং কন্যার জীবনটা যাতে সুরক্ষিত রাখে তার জন্য। অতঃপর একটা সময় পর আবিরের কানে আরো একটা ক্রন্দনরত স্বর ভেসে এল। তবে এটা নবজাতকের কান্নার আওয়াজ। চিকন সরু কন্ঠের কান্না। আবির বুঝে উঠল না তার হৃদয়ে কি বয়ে গেল। তবে তখনও তার অস্থির হৃদয় শান্ত হলো না। জ্বলন্ত শিখার ন্যায় তখনও বুকের ভেতর কি যেন দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল। আবির দ্রুতই তার আম্মুকে জিজ্ঞেস করল,

“ আম্মু? কান্নাটা? আমার মেয়ের না? ছুটি আর ও ঠিক আছে না আম্মু? ডক্টর আসছে না কেন? আমি একবার ছুটির কাছে যাব আম্মু,একবার…আমার ছুটিটা কতোটা যন্ত্রনায় ছিল আম্মু। কতোটা কষ্ট হচ্ছিল আমার ছুটিটার আম্মু। ”
এইটুকু বলতে বলতেই একজন নার্স এলেন। কোলে সদ্য জম্মানে বাচ্চাটিকে নিয়ে আবিরের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন,

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৪০

” আপনার মেয়ে। মাশাল্লাহ , কি মিষ্টি! ”
আবিরের দিকে এগিয়ে ধরলেও আবির কোলে তুলল না তার মেয়েকে। বরং তীব্র আগ্রহ আর ব্যাকুলতা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“ ছুটি? ছুটি কেমন আছে? আমি ওর কাছে যাব নার্স। আমার ছুটিকে আমায় দেখতে হবে…”

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৪২