প্রেম ও অসুখ পর্ব ১৯
নবনীতা শেখ
হৃদ দরজা খুলেই সম্মুখে রওশন সাহেব ও উদয়কে কঠিনমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো তাদের ভেতরে প্রবেশ করার। বাবা গম্ভীরমুখে বিনা শব্দ ব্যয়ে ভেতরে চলে এলেন। উদয় আসতে গেলে হৃদ পথ আটকে ফেলল। কৈশোরের টাওয়ারে উদয়মান উদয় মুখটাকে পেঁচার মতো বানিয়ে বলল,
-“এক ছিনতাইকারী আজ ব্যাগ ধরে টেনেছিল।”
-“তারপর?”
-“আমি তার চুল ধরে টেনেছি।”
-“কিছু নিয়েছে?”
-“আমি নিয়ে এসেছি।”
-“কী?”
উদয় নিজের মুঠোবন্দি বামহাতটা হৃদের সামনে মেলে ধরল। বেরিয়ে এলো একমুঠো সবুজ ও গোলাপি রঙের মিশ্রণে চুল। হৃদ বিহ্বল হয়ে শুধাল,
-“এগুলো কী?”
-“ছাপড়ির ছাপড়া।”
-“কী করবি এ দিয়ে?”
-“কালা জাদু। ওরে তো আমি ছাড়ব না। শ্লা! ভাইয়া, সরো সামনে থেকে। আমাকে মাথায় পানি ঢালতে দাও। আগুন জ্বলে। দেখা যাচ্ছে?”
-“দেখা যাচ্ছে না।”
-“যাবে কীভাবে? ভালো মানুষ হইলে না দেখতে পারতে।”
হৃদ এবার আর না হেসে পারল না। উদয়ও হেসে ফেলল। রওশন সাহেব গেস্টরুমে গিয়ে ফ্রেশ হচ্ছেন। উদয় হৃদের বেডরুমের দিকে পা বাড়াতেই হৃদ সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল,
-“উঁহু। কমনটা ওয়াশরুমে যা।”
-“না, কেন?”
-“গাঁধার বাচ্চা! তোর ভাবি ঘুমাচ্ছে ভেতরে।”
চোখ বড়ো বড়ো হয়ে এলো উদয়ের,
-“ওহ ভাইয়া! ভাবি এখানে থাকে? আমি ভেবেছিলাম আলাদা থাকে।”
-“তোকে কে বলেছে?”
-“আন্দাজ করেছিলাম।”
-“ওহ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
উদয় ভালোই বিস্মিত হয়েছে আজ। এমনিতে ঢাকা তার ভালো লাগে না। এলে সারাদিন ফ্ল্যাটেই থাকা লাগে, নয়তো একা একা ঘোরা। ভাই তো মহাব্যস্ত তার। এবারও সেরকমই হবে ভেবে খুব উদাসমনে এসেছিল। ভাবিকে যে এখানেই পেয়ে গেল, এটা ভেবে তার উদাসীনতা আকাশ সমান আনন্দে ঝঙ্কার তুলে উঠল।
সবাই ফ্রেশ হয়ে এলে হৃদ বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নিল। খেতে বসে রওশন সাহেব প্রথম কথা বললেন,
-“বউ কই?”
কেশে উঠল হৃদ। উদয় পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“ঘুমায়।”
রওশন সাহেব চোখ রাঙালেন,
-“বউ কি তোর, ব্যাটা? যার বউ সে প্রশ্নের উত্তর দিক।”
হৃদ পানি খেয়ে বলল,
-“জি আব্বা, ঘুমায়।”
-“কয়টা বাজে?”
-“এগারোটা।”
-“কোন হারামজাদার বউ এগারোটা অবধি ঘুমায়?”
-“তোমার বাড়ির বউ।”
-“কী?”
-“আমার বউ।”
রওশন সাহেব অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় মাথা নাড়লেন কেবল। কিছু বললেন না আর। খেয়ে বাড়িতে কথা বললেন, বিশ্রাম নিলেন। এসবের পরও বাড়ির বউয়ের ঘুম ভাঙল না। রওশন সাহেব এবার কঠোর গলায় বললেন,
-“বউ কি আসলেই আছে? নাকি হাওয়া হয়ে ভাসে?”
-“তা কেন হবে, আব্বা?”
-“আমি দেখব।”
-“শিওর।”
রওশন সাহেব আর উদয় হৃদের রুমের সামনে আসতেই হৃদ দুইজনকে থামিয়ে দিলো। এরপর একাই রুমে ঢুকল। শাড়ির আঁচল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে রয়েছে মেয়েটা। হৃদ গুছিয়ে দিলো তাকে। কম্ফোর্টারটা গলা অবধি তুলে দিয়ে কপালে ছোট্ট করে চুমু খেলো। দুনিয়ার কেউ এই ছোট্ট ব্যাপারটা জানল না।
তারপর হৃদ দরজা সামান্য খুলে বাবা ও ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আপনাদের আসার এক্সাইটমেন্টে সারারাত ঘুমায়নি। একটু আগেই ঘুমিয়েছে। ঘুমোতে দিন। বিকেলে কথা হবে ওর সাথে।”
রওশন সাহেব বউকে দেখে শান্ত হলেন। ছেলের প্রতি এখন দয়া, মায়া, মোহাব্বত সব উথলে উঠল। বউ আছে মানে ছেলে লক্ষ্মী, পানির তলের পক্ষী! খুশি মনে নিজের রুমে ফিরে গেলেন তিনি।
দরজার সামনে এখনো উদয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। হৃদ তার চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল,
-“কী সমস্যা?”
-“ভাবি অনেক সুন্দরভাবে ঘুমায়। একটা ছবি তুলি?”
-“লাত্থি খাস না কতদিন?”
-“বহুদিন।”
-“আজ খাবি?”
-“না।”
-“তাহলে চোখের সামনে থেকে সর।”
উদয় বিড়বিড় করতে করতে চোখের সামনে থেকে সরে গেল। সাঁঝের ঘুম ভাঙল বিকেলে। হৃদ তখন তাকে পাহারা দেওয়ায় ভীষণ ব্যস্ত। সম্মুখে একটা বই তুলে ক্ষণে ক্ষণে বাঁকাচোখে মেয়েটাকে দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিলো পরবর্তী ঘন্টা। তারপর ম্যাডাম জাগ্রত হলেন। আর হৃদকে বোঝালেন, তার পৃথিবী কতটা আনন্দময়!
সাঁঝ শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে হৃদকে রুমে পেল না। দরজার সামনে একটা স্টিকি নোট লাগানো। সেদিকে খেয়াল করে দেখল, মহাশয় বাজারে গেছেন।
সাঁঝ পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরোল। আর বসার ঘরেই শ্বশুরমশাই, দেবর আর বিড়ালকে একসাথে পেয়ে গেল। সাঁঝ যতই পা টিপে টিপে আসুক না কেন, নূপুরের ঝুমঝুম শব্দে তার উপস্থিতি সকলেই টের পেয়ে গেল। একযোগে তাকাল বেচারির মুখের দিকে।
সাঁঝ থেমে গেল। মেকি হাসির সাথে সুবিশাল সালাম। চোখ-মুখে অস্বস্তি। সব মিলিয়ে পা জমে গেল মেঝের সাথেই। রওশন সাহেব আর উদয় একসাথে সালামের জবাব নিল। পাশ থেকে ইভও “মিয়াঁও” শব্দে সাড়া নিল। থমথমে পরিবেশটা আরও গম্ভীর হয়ে উঠল।
সাঁঝ গুটিগুটি পায়ে রওশন সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। স্মিত হাসির সাথে বলল,
-“সরি, বাবা৷ ঘুমোচ্ছিলাম। ভালো আছেন?”
-“আলহামদুলিল্লাহ, আম্মাজান। ভালো আছি। আমার পাশে বসেন।”
সাঁঝ বসল। রওশন সাহেবের দুইছেলে। সাঁঝের আগমনে একটা মেয়ের শখও পূরণ হলো। তার সংসার পরিপূর্ণ হলো। এই মেয়ে যতই অন্যায় করুক না কেন, তিনি অসন্তুষ্ট হতে পারেন না। রক্তের সম্পর্কের ঊর্ধ্বে আত্মার সম্পর্ক। এই যে, মিষ্টি করে হেসে কথা বলে, ভুলভাল কাজ করে, ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে, অন্যরকম প্রশান্তি দিয়ে “বাবা” ডাকে! এসব কিছু তিনি কখনো এড়িয়ে যেতে পারেন না।
সাঁঝ বলল,
-“বাবা, আপনার সাথে ঠিকমতো কথা হয়নি আমার। শরীর ভালো আছে?”
-“ডাক্তার দেখাতেই তো এসেছি।”
-“আচ্ছা, বাবা। আজ রেস্ট নিন৷ আগামীকাল আপনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব।”
-“আপনি যাবেন, আম্মু?”
-“জি।”
-“ভালো হয়।”
প্রসন্ন হাসলেন রওশন সাহেব। উদয় বলল,
-“ভাবি, তোমার দিনকাল কেমন যায়? আর পড়াশোনা?”
-“সব ভালো যায়। আর তোমার?”
-“আতঙ্ক দিও না। সামনে পরীক্ষা।”
-“আচ্ছা। পড়াশোনা কতদূর?”
-“আমায় ছেড়ে বহুদূর।”
ফিক করে হেসে ফেলল সাঁঝ। একইসাথে হাসলেন রওশন সাহেবও। সাঁঝ অনেক অনেক কথা বলল। সেই কথার ফাঁকে এ-ও জানাল যে, আজ রাতে সে রান্না করে খাওয়াবে। কী যে খুশি হলেন রওশন সাহেব।
হৃদ বাজার করে নিয়ে আসতেই রওশন সাহেব পূর্বের গাম্ভীর্যে লেপটে গেলেন। বললেন,
-“আজ তোর বউ রান্না করবে।”
বিষম খেল হৃদ, সরু চোখে একবার সাঁঝের দিকে তাকাল। পরপর নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
-“বাবা, ও রাঁধতে পারবে না।”
-“কেন পারবে না?”
-“আমার বউকে দিয়ে রান্না করাব না। বুয়া আসবেন। এসে রেঁধে যাবেন।”
-“না। বউ রাঁধবে।”
-“তোমার বউকে এসে রাঁধতে বলো। আমার বউকে দিয়ে কষ্ট করাবো না।”
রওশন সাহেব সাঁঝের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় জানতে চাইলেন,
-“কষ্ট হবে, আম্মু?”
সাঁঝ বিস্তৃত হাসির সাথে বলল,
-“মোটেও না।”
হৃদ শক্ত চোখে তাকাল সাঁঝের দিকে,
-“অমৃত খাওয়াতে চাও?”
মন খারাপ করল সাঁঝ,
-“অমন বলেন কেন? অতটাও খারাপ রাঁধি নাকি? একটু নুন-হলুদ-ঝাল বেশি হয়, এই যা! এছাড়া কিছু না তো। আমি সাবধানে রাঁধব।”
রওশন সাহেব বললেন,
-“নুন-ঝাল কম-বেশি হলেও সমস্যা নেই। আমরা মানিয়ে নেব। ঠিক না, উদয়?”
-“জি, আব্বু।”
হৃদ এ পর্যায়ে হেসে ফেলল। তারা তো খাল কেটে কুমির আনছে না। বরঞ্চ কুমিরভর্তি খালে যাওয়ার জন্য লাফাচ্ছে। সমস্যা নেই। সবার জীবনেই শখ-আহ্লাদ থাকে।
সন্ধ্যে হয়েছে। সাঁঝ রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ভাবছে, কী করবে! শখ করে বলল তো রান্না করার কথা। এখন কী রান্না করা যায়? ভাত, ডাল বাদে তো কিছু পারেও না!
এমতাবস্থায় সে কিচেনের দরজার সামনে হৃদকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খামোখা ক্ষেপে গেল। চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
-“কী?”
-“আপনার রান্নার বিরাট বড়ো ফ্যান, ম্যাডাম। দর্শন নিচ্ছি।”
-“চুপ থাকেন।”
-“হু-উম, ওকে!”
সাঁঝ বড়ো ভাব নিয়ে রান্নার জিনিসগুলো গুছিয়ে দেখছিল। তবে খুব বেশিক্ষণ অমন আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকতে পারল না। দুই মিনিটের ভেতর কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঠোঁট উলটে হৃদের সামনে দাঁড়াল।
সাঁঝের নকল করে পূর্বের ভঙ্গিমায় হৃদ জিজ্ঞেস করল,
-“কী?”
-“সাহায্য করুন। স্ত্রীকে ঘরের কাজে সাহায্য করলে আল্লাহ আয়রোজগারে বরকত দেন।”
-“তাই না?”
-“হ্যাঁ।”
-“আমি সাহায্য করব। তবে একটা শর্ত আছে।”
-“কী শর্ত?”
-“পরে বলব।”
-“ঠিক আছে।”
হৃদ চুলায় গরম পানি দিয়ে আটা বের করতে লাগল। সাঁঝ জিজ্ঞেস করল,
-“রুটি বানাবেন? আমার জন্য পরোটা বানায়েন তাহলে।”
ঠোঁট চাপা হাসির সাথে হৃদ জানাল,
-“আমি না ম্যাডাম, আপনি বানাবেন।”
-“আমি পারি না।”
-“শিখিয়ে দেবো।”
-“এখন শিখিয়ে এরপর রান্না করে নিয়ে যাওয়া অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। দরকার নেই পরোটার। আপনি রুটি বানান।”
হৃদ আটা গোলানো শেষে সবজি কাটতে লাগল। সাঁঝ বলল,
-“ওমা! কী ফাস্ট কাটছেন! একদম আম্মুর মতো। কীভাবে করেন? হাত কাটে না?”
-“না। হাত ধুয়ে আসো তুমি।”
-“আমি কেন? পারি না.. আচ্ছা, ধুয়ে আসি।”
সাঁঝ হাত ধুয়ে এসে বলল,
-“তারপর?”
হৃদ চুলায় গরম তেলের ওপর পেয়াঁজ-মরিচ দেওয়ার আগেই সাঁঝ কয়েক হাত দূরে সরে গেল। হৃদ পেয়াঁজ ছাড়তেই সে বলল,
-“ওমা! তেল ছিটে আসে না? ভয় করে না?”
-“না!”
-“কী জোশ!”
-“তুমিও জোশ, এদিকে আসো।”
সাঁঝ এগিয়ে এলে হৃদ তাকে দু’হাতে আগলে নিয়ে দাঁড়াল। আচমকা অদ্ভুত এক শিরশিরানো অনুভূতি সাঁঝের মেরুদণ্ড বেয়ে ওপরে উঠে গেল। লক্ষ করল হৃদ ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে। তাকে আগলে রেখেছে। তার বাঁ হাত সাঁঝের বাঁ হাতের ওপর, ভাজি নাড়ছে। ডান হাত দিয়ে সবজিতে নুন-মশলা দিচ্ছে। সামান্য ঝুঁকে আছে ডাক্তার সাহেব। তার মুখটা সাঁঝের ডান কাঁধের ওপর। সে কথা বলে যাচ্ছে স্বাভাবিকভাবে। তাকে জানিয়ে যাচ্ছে কোন মশলাটা কী কাজে ব্যবহৃত হয়। লবণ কখন দেওয়া লাগে। কোন তরকারিতে কী দেওয়া লাগে না।
আচমকা সাঁঝ টের পেল সে হৃদের কথা শুনতে পাচ্ছে না। বুকের ভেতরে দ্রিম দ্রিম করে যাচ্ছে। গায়ের শক্তি সব ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সে ভার ছেড়ে দিলো। সোজা গিয়ে হৃদের বুকের বাঁ পাশে পিঠ ঠেকাল। মাথা এলিয়ে দিলো পেছনের দিকে।
হৃদ কথা বলতে বলতে থেমে গেল সেকেন্ড দুয়েকের জন্য। পরপরই সাঁঝের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
প্রেম ও অসুখ পর্ব ১৮
-“এত দূর্বলতা ম্যাডামের জন্য ঠিক না, বি স্ট্রং।”
দূর্বলতা না ছাঁই! এমন জায়গায় সাঁঝ দূর্বল হবে না তো কোথায় হবে? তিন কবুল করা স্বামী তার। বড়ো আয়েশ করে গায়ের ভার ছেড়ে দিলো, কাঁধের ওপর গিয়ে মাথা ঠেকল।
উত্তরের প্রেক্ষিতে সাঁঝের নিস্তেজ আওয়াজটা এলো তার কিছু সময় পর,
-“উঁহু।”
হৃদের আওয়াজ শীতল ও অশান্ত হয়ে উঠল,
-“জ্বালিয়ো না, মেয়ে। আমি কিন্তু খুব বেশিক্ষণ ভালো হয়ে থাকতে পারব না।”