প্রেম ও অসুখ পর্ব ২২

প্রেম ও অসুখ পর্ব ২২
নবনীতা শেখ

সাঁঝ স্বামী শ্বশুরের সাথে আজ নাচতে নাচতে হসপিটালে চলে এসেছে। হৃদ একবার বলেছিল,
-“সাঁঝ, তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
সাঁঝ তাতে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন আর একটা নেতিবাচক কথা বলবে আর সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে কেঁদে ফেলবে। সাঁঝের এমন অবস্থা দেখে হৃদ না হেসে পারে না। একটাই বউ তার। আসুক! তার জন্য হসপিটাল তো সামান্য বিষয়, কবরস্থানকেও দর্শনীয় স্থান মানতে রাজি।
এমন মনোভাবে সাঁঝ বড়ো খুশি হলো, ফলস্বরূপ এখন হসপিটালের ওয়েটিং এরিয়াতে শ্বশুরের সাথে বসে। তার পরনে একটা ছাইরঙা সুতির থ্রিপিস, চুলগুলোয় খোঁপায় আটকানো। সাজসজ্জাহীন ছোট্ট মুখটায় যেন গতরাতের লজ্জা জ্বলজ্বল করছে। সবমিলিয়ে স্কুলপড়ুয়া বাচ্চা লাগছে। মজার ব্যাপার হলো, সাঁঝ আজ তার শ্বশুর আর স্বামীর সাথে মিলিয়ে জামা পরেছে। স্পষ্ট ও শুদ্ধভাবে বলা হলে, সাঁঝ আজকে তার স্বামী ও শ্বশুরকে জোর করে ছাইরঙা শার্ট ও পাঞ্জাবি পরিয়েছে। কেবলমাত্র মেয়েটাকে তারা কিছু বলতে পারেন না, আর তাই বলে এভাবে অত্যাচার করে যাবে?

হৃদ রিসিপশনিস্টের সাথে কথা বলছে। সাঁঝ স্মিত হেসে রওশন সাহেবকে বলল,
-“বাবা, আমি আমাদের একটা ছবি তুলি? তারপর সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করব আপনার ছেলেকে ট্যাগ করে। জানেন, আপনার ছেলে এখনো প্রোফাইলে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সিঙ্গেল দিয়ে ঘুরছে৷ কত মেয়েরা কত আজেবাজে কথা যে বলে.. আপনার সামনে সেসব মুখেও আনতে পারব না। আজ আপনার ছেলের সিঙ্গেলশিপ ঘোঁচাব! কত সাহস তার!”
রওশন সাহেব মাথা নাড়লেন,
-“ঠিক আছে।”
-“বাবা? আপনি আমার সাপোর্টে আছেন না?”
-“নিঃসন্দেহে আমি আপনার সাপোর্টে, আম্মা! চোখ বুজে আপনার সাইটে।”
সাঁঝ প্রশস্ত হেসে বলল,
-“বাবা, হাসেন একটু! ছবি তুলি!”
সাঁঝ অনেকগুলো ছবি তুলল। হসপিটালেও যে কেউ এরকম ড্রেস ম্যাচ করে আসে, এসে আবার বত্রিশ দু’গুণে চৌষট্টিটা দাঁত বের করে ছবি তুলতে পারে… সে কথা লোকে বিশ্বাস করত না—যদি না এই দুই নমুনাকে তারা দেখত। এমনই এক ভদ্রমহিলা রওশন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“মেয়ে নাকি, ভাই?”
হাসিমুখে রওশন সাহেব বললেন,
-“জি।”
সাঁঝও হাসল। তারপর রওশন সাহেবকে বলল,
-“বাবা, আমি চা কিনে আনি, হ্যাঁ? এই হসপিটালের ক্যান্টিনের চা-টা মজার।”
-“আচ্ছা, মা।”
সাঁঝ উঠতেই হৃদের সাথে দেখা হয়ে গেল। দেখা না, সাঁঝ ইচ্ছা করে না দেখার ভান করে ধাক্কা খেলো। তারপর লাজুক হাসল। হৃদ তা দেখে জোরপূর্বক হেসে বলল,
-“তোমাকে তো পরে দেখে নেব, ম্যাডাম! গতরাতের হিসেব বাকি আছে।”
একটু যেন ভয়ই পেল, এমন ভাব করে সাঁঝ বলল,
-“তাই না? আপনাকে ফিলিংসে আধডুবিয়ে আমি গতরাতের মতো আজ আবারও ঘুমিয়ে যাব।”
হৃদ হেসে ফেলল। দু-ধারে মাথা নেড়ে বলল,
-“এই দিন তো দিন না ম্যাডাম, আমার দিনও আসবে।”
সাঁঝ চোখ মেরে বলল,
-“মিসটেক! রাত হবে।”

চারপাশে এত এত মানুষের আনাগোনা। তারমধ্যে থেকেও হৃদ খানিকটা ঝুঁকল। পাঁচফুট শরীরের এই মেয়েটা হৃদের বুক বরাবর, নাগাল পেতে হলে মাথাটা একশত ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে বাঁকানো লাগে। হৃদ বেচারিকে দিয়ে এতটা কষ্ট করালো না। নিজ থেকেই ঝুঁকে এলো খানিকটা। চোখাচোখিটা এবার যেন বেশ আকর্ষণীয়ভাবে হলো। দাম্ভিকতার সাথে হৃদ হাসল,
-“আপনি আমার স্ত্রী! আমার হক, আমার ইজ্জত। আপনি ঘরে আমার, বাইরেও আমার। আপনি রাতে যতটা আমার, দিনেও ততটাই আমার। বোঝা গেল?”
শব্দ দিয়ে সম্মোহন বোধহয় এভাবেই করা হয়! সাঁঝ বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল, আবেশিত ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ল ওপর নিচ। হৃদ সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“গুড গার্ল।”

সাঁঝ আর এক সেকেন্ডও ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। একপ্রকার লাফিয়েই চলে এলো ক্যান্টিনে। মেয়েটাকে এভাবে ছুটতে দেখে হৃদ হাসল এবং হাসতেই থাকল। আর তারপর লক্ষ করল আশেপাশে অবস্থানরত ওয়ার্ডবয়, নার্সসহ চেনামুখের বেশ কয়েকজন হৃদকে বিস্ময় ভরা চোখে দেখে গেল। কারণে অকারণে হাসা হৃদের স্বভাববিরুদ্ধ! অথচ সামনে তো সাঁঝ ছিল। জনাব এখানে নরম হবে না তো কোথায় হবে?
হৃদ এসে দেখতে পেল ভদ্রমহিলা রওশন সাহেবের সাথে ভালোই খাতির জমিয়ে ফেলেছে। কোথায় থাকেন তিনি, দেশের বাড়ি কোথায়, স্বামী কী করেন, কয় ছেলে, কয় মেয়ে! নানান কিছু। হৃদ বাবাকে ডাকতেই ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন,
-“ভাইসাব, ছেলে?”
রওশন সাহেব আগের বারের মতো আবারও মুচকি হেসে বললেন,
-“জি।”
ভদ্রমহিলা নিজের ফোনের গ্যালারিতে ঢুকে একটা ছবি দেখিয়ে বললেন,

-“এইটা হলো আমার ছেলে। আপনাদের ফ্যামিলি বন্ডিং অনেক সুন্দর। মেয়েটাকে ভারি পছন্দ হয়েছে। আপনাদের কি আমার ছেলেকে পছন্দ হয়?”
বাপবেটা এখন বাকহারা! ঘটনা যে কী ঘটতে যাচ্ছে, ইতোমধ্যে দুইজনেই তা টের পেয়ে মুখ চাওয়াচাওয়িতে ব্যস্ত। মনের মধ্যে তাদের প্রার্থনা চলছে, ভদ্রমহিলা যেন মুখ না খোলে!
সবার সব প্রার্থনা থোড়াই না পূরণ হয়? এর ব্যাখ্যা স্বরূপ ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন,
-“আপনাদের ঘরের মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি তাকে আমাদের ঘরের বউ করে আনতে চাই।”
যাহ! বলে ফেলল! এরমধ্যে চা হাতে নিয়ে ড্যাংড্যাং করে নাচতে নাচতে সাঞ্জিনা আফরিন তার গাল ভর্তি হাসি নিয়ে হাজির। সেও তাল মিলিয়ে বলল,

-“কী কথা হচ্ছে, আমাকেও বলুন আপনারা!”
সাঁঝ এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, পরিস্থিতি থমথমে। বোঝার চেষ্টা করেও কিছু মাথায় ঢুকল না। ভদ্রমহিলা সাঁঝেত হাত টেনে নিজের পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন,
-“মাশাআল্লাহ! আমার ছেলের পাশে মানিয়ে যাবে।”
চমকে উঠল সাঁঝ, শব্দ হারিয়ে ফেলল যেন। কোনোমতে প্রশ্ন শুধাল,
-“আন্টি? ওই সময় কি আপনি আমাকে সত্যিই বাবার মেয়ে ভেবেছিলেন?”
ভদ্রমহিলার চোখে-মুখে উপচে আসা ইতিবাচকতায় হৃদ ঝট করে সাঁঝের হাত ধরে ফেলল। মেয়েটার চোখ ঠিকরে বিস্ময় বেরিয়ে পারল না। তন্মধ্যে হৃদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
-“সরি, আন্টি। শি ইজ অলরেডি মাইন। পেইড, প্রমিসড, প্রোটেক্টেড।”
বৈবাহিক শর্তমতো দেনমোহর, ওয়াদা, সুরক্ষা—সবক’টা দায় যেন বুঝিয়ে দিলো হৃদ। ভদ্রমহিলার অবুঝ চাহনিতে সাঁঝ হেসে ফেলে বলল,
-“আন্টি, আমি ম্যারিড। এইমাত্র যাকে আপনি আমার বড়োভাইয়া ভেবে ভুল করেছেন, তিনি আমার তিন কবুল করা স্বামী।”

অদিতি আজ তিনদিন ধরে নিজের সাথে যুদ্ধ করে গিয়ে অর্ণবের কল ধরল না। চতুর্থ দিন অর্ণব টেক্সট দিলো,
-“ফ্রি হলে কল দিও।”
অদিতি এবার আর টেক্সটের রিপ্লাই দেওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারল না। বুক ভরে শ্বাস টেনে টাইপ করল,
-“অর্ণব ভাইয়া, সব তো ঠিক হয়ে গেছে। আপনি তাহলে সরাসরি সাঁঝকে কেন কল দিচ্ছেন না?”
তারপর টেক্সটটা সেন্ড করে ইনবক্সেই পড়ে রইল। বিড়বিড় করে গুনতে লাগল সেকেন্ডের হিসেব—এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, দশ, এক মিনিট, দুই মিনিট….
অর্ণব টেক্সটটা দেখতে সময় নিল পাঁচ মিনিট আর আটচল্লিশ সেকেন্ড, রিপ্লাই করতে আরও দুই মিনিট। অদিতি হেসে ফেলল।
কিছু হাসি যন্ত্রণাদের ধারক হয়। কাঁদতে তো উপলক্ষ লাগে, সম্পর্ক লাগে! একপাক্ষিক অনুভূতিতে কান্না জায়েজ নয়। সেক্ষেত্রে বুকে পাথর চেপে পাগলের মতো হেসে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। অথচ চোখ অনুচিত কাজগুলো করে ফেলে নির্লজ্জের মতো অশ্রু গড়িয়ে। ঠোঁট চাপা হাসিটা বিড়বিড়িয়ে পড়তে থাকে অর্ণবের সদ্য পাঠানো টেক্সটটা,

-“প্রতিদিনই একবার করে দেই। সাঞ্জি রিসিভ করে না।”
অদিতি হাসতে হাসতে টাইপ করল,
-“তাহলে হৃদ ভাইয়াকে কল দিয়ে জেনে নিতে পারেন। আপনার সাঞ্জি তো এখন ওখানেই আছে।”
-“আমাকে বলেনি, হৃদ! আচ্ছা। তুমি বলো, কেমন আছো?”
-“ভালো আছি।”
-“মনে হচ্ছে না ভালো আছো। কোনো প্রবলেমে আছো? আমাকে বলতে পারো। আমি তোমার বড়ো ভাইয়ের মতো।”
-“এত খেয়াল রাখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, অর্ণব ভাইয়া। কিন্তু আপনি আমার ভাই নন। আর টেক্সট দেবেন না।”
এই বলে অদিতি হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বের হয়ে গেল। ডেটা অফ করতে যাবে, তখনই অর্ণবের টেক্সট নোটিফিকেশন প্যানেলে ভেসে উঠল,

-“অদিতি?”
যখন যখন অর্ণব তাকে নাম ধরে ডাকে, তখন তখন সাড়া নিতে বাধ্য হয়ে পড়ে অদিতি। সেটা সেই শুরু থেকেই। সাঁঝের সাথে বাড়িতে এসে যখন লুকিয়ে-চুরিয়ে অর্ণবের রুমে উঁকি দিতে যেত, প্রায়শই অর্ণব টের পেয়ে যেত। অদিতি লুকিয়ে পড়ত তৎক্ষনাৎ। অথচ অর্ণব যখন তাকে ডেকে উঠত, সে সাড়া না নিয়ে পারত না। অর্ণব জিজ্ঞেস করত না কিছু৷ অদিতি একাই ভালোমন্দ কথা বলে কেটে পড়ত।
আজ আবারও! আবারও লোকটা নাম ধরে ডাকল। অদিতি মোহগ্রস্তের মতো ইনবক্সে চলে এলো, ছোট্ট করে লিখল,
-“হুঁ?”
অর্ণব ইনবক্সেই আছে এখন, সঙ্গে সঙ্গে টেক্সট দেখছে। রিপ্লাই করতেও সময় নিচ্ছে না। অদিতির অসহ্য লাগল বিষয়টা। কেন সে অন্যের মানুষ হয়ে তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে? কেন মায়ায় জড়াতে দিচ্ছে না, কেন মায়া কাটাতেও দিচ্ছে না? সে কি অদিতিকে মহামানবী টাইপের কিছু ভেবে রেখেছে নাকি? অনুচিত ভাবনা! সে জাগতিক আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধ্বে নয়। তারও মন পোড়ে, তারও বুক ফাটে কান্নায়।

অর্ণব টেক্সট কাটল, মুছল, আবার টাইপ করল, আবার মুছে ফেলল, তারপর আবারও! অবশেষে সেন্ড করা যেই টেক্সটটা অদিতির কাছে এলো, তা হলো,
-“আমার ওপরে কোনো কারণে রেগে আছো?”
অদিতি কান্না আটকানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ঠোঁট কামড়ে ধরল। নোনতা স্বাদ জিভের আগায় পেতেই চোখ গড়িয়ে জল পড়ে গেল টাইপ করতে থাকা ফোনের ওপর। অদিতি এরপর লিখল তার গোটা অনুভূতির সাপেক্ষে একটি মাত্র টেক্সট,

প্রেম ও অসুখ পর্ব ২১

-“অসম্পর্কে না থাকে অভিমান, না থাকে অভিযোগ করার আর্জি। আর রাগ? সেটা তো একতরফা মঞ্জুরনামা, তোমার না থাকলে আমার দাবি করাও গুনাহ!”
তারপর অদিতি ব্লক করে দিলো অর্ণবকে। নিজের জন্য রেখে দিলো অবশিষ্ট পরিমাণ ভালোবাসা ও বেঁচে থাকার ফরমান। সে দু’চোখের অশ্রু মুছে নিল। নিচের ঠোঁটে লেগে থাকা অল্প পরিমাণের রক্তদানাকে বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে মুছে নিল। ডায়ারিতে লিখে ফেলল এই গল্পের সম্ভাব্য শেষ নিদর্শন —
ভালোবাসা নামহীন এক নিকাহ মাত্র, তুমি সাক্ষী না দিলে আমার কসমও অবৈধ….

প্রেম ও অসুখ পর্ব ২৩