প্রেম ও অসুখ পর্ব ৩
নবনীতা শেখ
-“আমার লিগ্যাল ওয়াইফ শুনুন, আপনার ছোট-বড়ো সকল দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায়। নিজের হক বুঝে নিতে শিখুন।”
-“আপনার মনে হয় আমি এখান থেকে এক পয়সাও খরচ করব?”
-“অলরেডি ১০ টাকা করে ফেলেছো। দুই দফায় সেন্ড মানি করাতে আমার ৫ টাকা করে চার্জ কেটেছে।”
সাঁঝের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সে অযথা তর্ক চালিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে পুনরায় লিখল,
-“আমি দশটাকা এক্সট্রা ফেরত পাঠাব। ওয়েট!”
-“তাই নাকি?”
-“হ্যাঁ, তাই।”
জনাবের আর রিপ্লাই এলো না। সাঁঝ উঠে বসল। আর ঠিক তখন কোনো এক অদৃশ্য চড় এসে সজোরে তার গালে লাগল। রাজধানীতে টাকা নিশ্চয়ই গাছে ধরে? না-হয় উড়ে উড়ে এসে পায়ের নিচে পড়ে যায়। এরকমটা হয় বলেই তো সে শক্ত গলায় বলতে পারল, টাকা ফেরত পাঠাবে!
আহারে! সাঁঝের শ্যামমুখখানি কেমন মলিন হয়ে উঠল। চোখ দুটো সরু ও ঠোঁট উলটে বসে রইল। যেভাবেই হোক, যে করেই হোক, যার সাথেই হোক আর যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন.. বিয়েটা হয়ে তো গেছেই। হিসেবমতো জনাবের টাকায় তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আগামী একবছর অবধি থাকবে। আর নিজের হক আদায়ে আলস্য দেখানো মানে নির্বুদ্ধিতা।
প্রকাশ্যে হোক কিংবা অস্বীকার্যেই হোক না কেন, সাঁঝ যে ধীরে ধীরে এই সম্পর্কের জালে জড়িয়ে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে, তা বোধ করি সে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি…
রুম গোছানো শেষে যখন রেস্ট নিচ্ছিল, দরজায় করাঘাতের শব্দে সচকিত হলো তারা। অদিতি উঠে গিয়ে দরজা খুলল। ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টি হাসির পূর্বিকা। বয়সে পাঁচ বছরের সিনিয়র, অথচ স্বভাবে কী ভীষণ মিশুক! পূর্বিকা ওদের বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“আমি রান্না করেছি, রাতে আমার এখানে খাবে তোমরা। আসো।”
সাঁঝ মিহি হেসে আন্তরিকতার সাথে বলল,
-“এসবের কী প্রয়োজন ছিল, আপু?”
-“ছিল ছিল। বাচ্চা মানুষ তোমরা। বুঝবে না।”
সাঁঝ আর অদিতি পূর্বিকার সাথেই বেরোল। ডাইনিংরুমটা বেশ পরিপাটিভাবে সাজানো। খাবার সময় পূর্বিকা বলল,
-“তোমাদের ওই রুমটাতে আগে আমার ফ্রেন্ড থাকত। ওর বিয়ে হয়ে গেল কিছুমাস আগে। এখন তো আর আমার সাথে থাকতে পারবে না। একা ছিলাম খুব। দিন দিন ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম ভাড়া দেই। জুনিয়র দুয়েকজন মেয়ে পেলে একটু সঙ্গ পেয়ে যেতাম আর কী! সেক্ষেত্রে তোমরা আমায় লোভী বলতে পারো। আই ওয়োন্ট মাইন্ড!”
সাঁঝ সঙ্গে সঙ্গে বলল,
-“না না, আপু। তা কেন মনে করব! আপনি কিন্তু অনেক সুইট!”
-“তাই না? আমার বয়ফ্রেন্ডও তাই বলে।”
পূর্বিকা স্বাভাবিকভাবে এ কথা বলে গ্লাসে পানি ঢালতে লাগল। ক্রমান্বয়ে বিষম খেল সাঁঝ ও অদিতি, কাশ যেন থামার নামই নেই। পূর্বিকা পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। বাচ্চা মেয়ে দুটো লজ্জা পেয়েছে বোধহয়! তাদেরকে আরও একটু লজ্জা দিতে বলে উঠল,
-“তোমাদের বয়ফ্রেন্ড আছে?”
অদিতি মানুষ হিসেবে ভালো-মন্দের মিশেলে হলেও বন্ধু হিসেবে বড়ো চমৎকার কিসিমের। নিজে কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে, সেটা তাকে দুঃখবোধ করাবে না। তার বান্ধবী ছক্কা মেরে উলটে ফেলে দিয়েছে, সে তাতেই খুশি, সে তাই বলে বেড়াবে।
আর তাই সে উল্লাসে বলে উঠল,
-“আপু, সাঁঝ তো বিবাহ করে ফেলেছে।”
অবাক হলো না পূর্বিকা,
-“বিয়ে করে ফেলেছে, ভালো কাজ করেছে। আমাদেরও উচিত বিয়ে করে ফেলা। আমি আজই আমার বয়ফ্রেন্ডকে বলব আমি বিয়ে করতে চাই। তুমিও তাই বলবে, অদিতি।”
অদিতি বড়ো বেজার হয়ে বলল,
-“আমার তো বয়ফ্রেন্ডও নাই, আপু।”
-“কষ্ট পেও না। তুমিও না-হয় আমার বয়ফ্রেন্ডকে বোলো।”
-“না না আপু, আপনারটা বড়োভাই লাগে। ওনাকে কেমনে বলি? এরচেয়ে সাঁঝের জামাইকে বলব। ওর সাথে আমার একটা ভাগাভাগির সম্পর্ক আছে।”
-“ঠিক আছে। এটাও ভালোই হয়।”
আচ্ছা, ধরনীর কি দ্বিধা হচ্ছে না? কিংবা যদি ভূ দু’খণ্ডে ভাগ হয়ে যেত! সাঁঝ তখন তার লজ্জাসহ সেখানে লুকিয়ে পড়ত। আপাতত তা করতে পারছে না বলে খাবারের টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। তার কাছে, সে কাউকে দেখতে পারছে না মানে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। সুতরাং লজ্জাবোধ, তুমি একটু লজ্জা করো, একটু দূরে গিয়ে মরো…
পনেরো মিনিটের খাওয়ায় পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে লজ্জা পেতে সাঁঝ আর না পেরে সেখান থেকে উঠে পড়ল। গাল দুটো ব্যথায় টানটান করছে। নজর হয়ে আছে বিক্ষিপ্ত।
সাঁঝ রুমে এসে প্রথম যেটা নোটিস করল, সেটা হলো শোয়ামির টেক্সট। তিনি লিখেছেন,
-“Dinner Done?”
সাঁঝ থেমে থেমে শ্বাস ফেলল। লজ্জা-শরম কাঁটাবনের এই অষ্টম তলার ফ্ল্যাটের দক্ষিণমুখী জানালা দিয়ে আত্মহত্যা করে মরল। আর তারপর রিপ্লাই সে রিপ্লাই দিলো,
-“মেলা টাকা দিয়েছেন, সাহেব। খাওয়ার জন্যই তো। না খেয়ে পারি? খাচ্ছি আর গিলছি, গিলছি আর খাচ্ছি। সারারাতে খাওয়া থামাব না। দোয়া করবেন আমার জন্য। আমি যেন সকালেও আপনাকে রিপ্লাই দিতে পারি—খাচ্ছি।”
সারাদিনের যথেষ্ট ধকল গেছে তার। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে এলো। আর তারপর সব শান্তি, সব আঁধার। অথচ আঁধারিয়াকে লোকে নাকি দুঃখের সাথে তুলনা করে! কী অদ্ভুতদর্শন!
তার ঘুম ভাঙল ভীষণ মধ্যরাতে। সে অভ্যস্ত হাতে ফোন খুঁজল। পাশে অদিতি ঘুমিয়ে রয়েছে। রয়েসয়ে সে সময় দেখল। চারটা আটত্রিশ বাজে.. না না, ছত্রিশ বাজে তো! আর তারপর দেখতে পেল তার টেক্সটের বিপরীতে জনাবের জবাব,
-“তুমি খাও। পৃথিবী যতদিন টিকে আছে, ততদিন খাবার আছে—তুমি নিশ্চিত থেকো।”
সাঁঝ মনে মনে বিড়বিড় করল, “শালার বিবাহিত ব্যাচেলর লাইফ আমার!” আর তারপর আবার ঘুমিয়ে গেল।
পরদিন সাঁঝ আর অদিতি নীলক্ষেত এসেছে। বইয়ের জগতে প্রবেশ করেই অদিতি কই যে হারিয়ে গেল, তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। বিশেষ খোঁজ যে সাঁঝ নিয়েছে, এমনটাও না।
সাঁঝ ঘুরে বেড়াচ্ছে আনমনে। হাতে বিশাল বড়ো এক ফর্দ। সেই ফর্দে সিরিয়ালি লেখা আছে প্রথম সেমিস্টারের প্রয়োজনীয় বইয়ের নাম৷ আপাতত এগুলোই কেনা লাগবে। বর মহাশয় থেকে প্রাপ্ত “হক” এর পাঁচ হাজার টাকা সে উঠিয়ে নিয়েছে। আর প্রথম খরচটা গেছে সিএনজিতে বেশ বড়োমাপের এক আছোলা বাঁশ খেয়ে।
কাটাবন থেকে নীলক্ষেত! ভাড়া চাইলো একশত পঞ্চাশ টাকা। অদিতি মুখ খোলার আগেই সাঁঝ বলল,
-“মামা, দশ টাকা কম রাখেন?”
দয়ালু সেঞ্জিমামা দশ টাকা কম রাখতে রাজি হয়ে গেলেন। বড়ো উচ্ছ্বাসে, বড়ো আনন্দে তারা সিএনজিতে চেপে বসল। তারপর সাঁঝ ফোন বের করল। বইয়ের লিস্ট গোছাতে গোছাতে অদিতিকে বলল,
-“শোন, রাতে কি রান্না করে খাব নাকি বাইরে থেকে খেয়ে যাব?”
অদিতির যেন উত্তর আগে থেকেই ভেবে রাখা ছিল,
-“দুইদিন ধরে তো বাইরেই খাচ্ছি। বাজারটা করা দরকার।”
-“ঠিকাছে। বই কেনা শেষে গ্রোসারি শপে যাব।”
আর এটুকু কথার মধ্যেই দয়াবান, নিষ্ঠাবান সেঞ্জিমামা হাওয়াইজাহাজ থামিয়ে বলে উঠলেন,
-“এসে গেছি। নামেন।”
সাত মিনিটেরও তো পথ না! ভাড়া এত? এ তো পুরোই স্ক্যাম হয়ে গেল সাঁঝের সাথে! অদিতি একদফায় তর্ক-বিতর্ক করতে যাওয়ার মুড বানিয়ে মুখ খুলে ফেলেছিল প্রায়, সাঁঝ ওকে থামিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলো। এ অবশ্য নতুন না। বিবাহে যেই স্ক্যামটা হয়েছে তার সাথে, সে তুলনায় খুব বেশি চমকানোর মতোও কিছু না।
অবশেষে সাঁঝ মাথা নত করে ফেলে আর অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় একবার কাঁধ উঁচু করে। ছ্যাহ লাইফ! ছ্যাহ সেঞ্জিভাড়া! ছ্যাহ বর! ছ্যাহ একুশ!
সাঁঝ কাঙ্খিত বইটা পেতেই দোকানদারের দিকে এগিয়ে বলল,
-“এটার দাম কত?”
দোকানদারের মাথাটাকে সাঁঝের মাছির সাথে তুলনা করার সাধ জাগল। মাছির চোখ দুটো রাউন্ড শেইপের হয়। তারা প্রকৃতিকে প্যানোরামিক ভিউতে দেখতে পারে বলেই পিছে না ঘুরেই থাপ্পড় পড়ার আগেই উড়ে নাগালের বাইরে গিয়ে গান গাইতে সক্ষমতা রাখে। আর তাই হয়তো দোকানি একবার তাকিয়ে এক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে চোখ সরিয়ে অন্য কাস্টমারের দিকে মন দিলো। বড়ো অবহেলার সাথে বলল,
-“সাড়ে চারশো ট্যাহা।”
প্রেম ও অসুখ পর্ব ২
সাঁঝ এবার আর বোকামি করবে না। সিএনজি ভাড়া দশটাকা কম বলেছিল। এবার পঞ্চাশ টাকা কম বলবে। খুব করে বলতেই যাচ্ছিল, মুখটা খুলল কেবল… আর তখনই তার পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকটা বলে উঠল,
-“এটা দুইশ বিশ টাকা। এর বেশি দিলে বোকা হবেন।”
সাঁঝের নিঃশ্বাস গলার কাছে এসে আটকে গেল, হৃৎপিণ্ডটা হয়ে উঠল বেপরোয়া..