বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৪

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৪
রানী আমিনা

পাশের কামরার দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সজাগ হয়ে উঠলো কাঞ্জি আর ওকামি। দুজনে শুয়ে ছিলো পাশাপাশি বিছানায়, একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় তথ্যাদি আদান প্রদান করে নিঃশব্দে উঠে বসলো ওরা। লিও নিজের জন্য হলরুমের অন্য পাশে আলাদা কামরা নিয়েছে। কিছুদিন পর লিন্ডাকে বিয়ে করবে সে, তাই নিজেদের কামরাতে এখন থেকেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে প্রাকটিস করে নিবে বলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেছে সেখানে৷
দুজনে নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে সন্তর্পণে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলো কামরা থেকে। লিওর কামরার সামনে এসে চাপা স্বরে ডাকলো,

“লিও, লিও! শালা ঘুমিয়ে পড়েছিস? হিজ ম্যাজেস্টি আজ আবার বেরিয়েছেন, উঠ দ্রুত। নইলে শেহজাদী কাল সকালে আমাদের কচুকাটা করবেন নিশ্চিত!”
ভেতর থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ার শব্দ পেলো ওরা, ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় দরজা খুলে ঘুম ঘুম রক্তিম চোখে সামনে দাঁড়ালো লিও। হাতের টি শার্ট খানা শরীরে গলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“চল যাই।”
“দৈনিক শুধু শুধু যাওয়া হয় আমাদের। হিজ ম্যাজেস্টি অন্ধকারে কোন দিক দিয়ে কোথায় হারিয়ে যান আমি চোখে মেলাতে পারিনা ভাই! আর পরদিন শেহজাদী জিজ্ঞেস করলে কিচ্ছু বলতে পারিনা, হাবার মতো তাকিয়ে থাকি। কোকো ভাইজান থাকলেও একটু সুবিধা করা যেতো, কিন্তু তাকেও শেহজাদী পাঠিয়ে দিয়েছেন বর্ডারে! জীবনটা বেদনা।”
ক্লান্ত গলায় বলল ওকামি। লিও ওদেরকে পাশ কাটিয়ে এগোতে এগোতে চাপা স্বরে ধমকে বলে উঠলো,
“কথা কম বল, তোদের এই তর্কাতর্কির কারণেই হিজ ম্যাজেস্টিকে রোজ গেলে হারিয়ে ফেলি। চল দ্রুত।”
মহলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে হাটতে হাটতে রাতের ঘন জঙ্গলের নিকষ কালো আঁধারের ভেতর ওরা মিশে গেলো সম্পুর্ন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জোভি শালাটা পোলার আব্বা হয়ে গেলো! ওর পোলা এক ঘন্টা পর পর ট্যা ট্যা করে উঠে। আর আমাকে দেখ, আমি এখনো পিউর ভার্জিন!”
“বকিস না তো, চুপচাপ হাট। হিজ ম্যাজেস্টি আজ চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলে শেহজাদী তোকে বার্বিকিউ করে কোকো ভাইজানকে দিয়ে খাওয়াবেন দেখিস৷”
“তুই চুপ থাক, তোর তো লিন্ডা আছে কোনো চিন্তা নেই। আমার কি হবে? লায়রা টা বড় হচ্ছে না কেন সেটাই বুঝতে পারছিনা! আচ্ছা, বর্নভিটা খাওয়ালে ও বড় হবে তাড়াতাড়ি?”
রাগে লিওর নাকের পাটা ফুলে উঠলো, পাশে ফিরে ওকামি কে বলল,

“ওকে এখন এসব কথা বলতে মানা কর ওকামি, নইলে কিন্তু আমি উলটা সিধা কিছু করে ফেলবো!”
ওকামি ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা। মনোযোগী চোখে এতক্ষণ সে হিজ ম্যাজেস্টির চলনের ওপর নজর রাখছিলো। এমনিতেই অন্ধকারে কম দেখছে তার ওপর হিজ ম্যাজেস্টি গাছ পালার ভেতর দিয়ে রকেটের গতিতে হেটে এদিক থেকে ওদিক চলে যাচ্ছেন ভূতের মতোন, নজর রাখাই কষ্টকর!
তার ভেতরে এই দুইটার তর্কাতর্কি থামছেই না! ওকামি ঘুরে ওদের দুজনের মাঝখানে এসে দুজনকে দুদিকে সরিয়ে দিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“তোরা দুডা আপাতত কোনো কথা কইস না, এখন আমাদের ঘাড়ে হিজ ম্যাজেস্টির ওপর নজর রাখার গুরুদায়িত্ব পড়েছে, দায়িত্বে অবহেলা করলে শেহজাদীর হাইয়ার লেভেলের ধমক শুনতে হবে। আগের দিনের ধমক শুনে আমার হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে উঠেছিলো, আজ আর শুনতে চাইনা। তোদের যদি শুধু ঝগড়াই করতে হয় তবে মহলে ফিরে যা, আমি একাই নজরদারি করবো!”
বলে তাকালো সে আবার মীরের গমন পথে, তাকাতেই চমকালো ও, ঝটিতি এদিক ওদিক তাকিয়ে বিস্মিত গলায় শুধোলো,

“হিজ ম্যাজেস্টি কোথায় গেলেন?”
ওর প্রশ্নে টনক নড়লো লিও আর ওকামির। কাঞ্জি মীরের চলে যাওয়ার পথের দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আরে… এই মাত্রই দেখলাম উনি ওইদিকে মোড় নিলেন! সেকেন্ড না পেরোতেই মানুষ কিভাবে হাওয়া হয়ে যায়!”
দু কদম এগিয়ে গিয়ে চোখ কুঁচকে অন্ধকারে কিছু দেখার চেষ্টা করলো লিও। ওকামি চড়চড় করে রেগে গিয়ে বলে উঠলো,
“আরও কর ঝগড়া, ফাজিলের দল! তোদের সাথে আসাই আমার ভুল হয়েছে। এখন শেহজাদী জিজ্ঞেস করলে কি জবাব দিবো? আমি আজ গিয়েই বলে দিবো যে তোরা দুডা কাজ কম ঝগড়া করিস বেশি, তোদের যেন মহল থেকে বের করে দেয়!”

ঠিক সেই মুহুর্তেই নিজেদের ঠিক পেছনে ওরা টের পেলো কারো নিঃশব্দ, ভারী উপস্থিতি। তার গুরুগম্ভীর নিঃশ্বাস এসে বার বার আছড়ে পড়তে লাগলো ওদের মাথার ওপর। যেন কোনো অদৃশ্য দানব ঝুঁকে আছে ঠিক মাথার ওপর!
মুহুর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলো তিনজনে! ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সশব্দে ঢোক গিললো লিও, কাঞ্জির কানের গোড়া বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়লো সন্তর্পণে! গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো ওকামির, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো একটি ঠান্ডা স্রোত!
পেছনে না তাকিয়েও স্পষ্ট টের পেলো কারো শীতল, শকুনি চাহনি ভেদ করে দিচ্ছে ওদের ঘাড়! সেই দৃষ্টির ভারত্বেই যেন আটকে আসছে ওদের নিঃশ্বাস!
ঠিক তখনই চারপাশ কাঁপিয়ে একটি গমগমে, ভারী কন্ঠস্বর উপহাসভরে বলে উঠলো,
“তোমাদের মতো এমন কাঁচা, নাদান বাচ্চাদেরকে আমার ওপর নজরদারি করতে যে পাঠিয়েছে তাকে বলে দিও, শিকারীদের শিকারে পাঠানোর পূর্ব শর্ত তাদেরকে ভালোভাবে ট্রেইন করা। নইলে শেষ পর্যন্ত এমন নির্বোধ শিকারীরা গুলোকেই পরিণত হতে হয় শিকারে!”
তিনজনে দাঁড়িয়ে রইলো স্থীর হয়ে, সামান্য নড়াচড়া করার দুঃসাহস টুকু করলোনা৷ মীর ঠোঁটের কোণা বাকিয়ে অবজ্ঞার হাসি হাসলো, তারপর শুকনো পাতার ওপর মর্মর ধ্বনি তুলে, বড় বড় পে ফেলে হেটে ধীর গতিতে এগোলো কোথাও৷

তিনজনে মূর্তির মতো নিঃশ্বাস আঁটকে ধরে পড়ে রইলো তখনো, যেন এখন নিঃশ্বাস ফেললেই আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে যা আটকানোর সাধ্য নেই ওদের কারো!
কিন্তু সেই মুহুর্তে ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মীর তড়িৎ গতিতে এসে উপস্থিত হলো ওদের একেবারেই সামনে! ভয়ে আতঙ্কে হঠাৎ আঁতকে উঠলো ওরা। মীরের সুদীর্ঘ অবয়বের সম্মুখে সাথে সাথে মিইয়ে গেলো তিনজনে, মাথা নুয়ে গেলো সম্মুখের ব্যাক্তিটির দুর্দমনীয় আধিপত্যের তীব্র প্রভাবে!

মীর ঝটিতি নিজের ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আলগা করে নিয়ে ক্ষিপ্র বেগে রাখলো লিওর চোখের ঠিক সামনে! যেন আরেকটু হলেই ওর ধারালো নখের সাথে সংঘর্ষ হবে লিওর চোখের পিঙ্গল লেন্সের!
কেঁপে উঠলো লিও, চোখের এত কাছে ধারালো নখ জোড়া দেখেও পলক ফেলানোর সাহসটুকু করলো না! প্রচন্ড ভয়ে ঘুরে উঠলো ওর মাথার ভেতর! মীর দাঁতে দাঁত চেপে চাপা হিসহিসে গলায় বলে উঠলো,
“আ’ নিড প্রাইভেসি, অ্যান্ড দ্বিতীয় বার আমার প্রাইভেসিতে সামান্য টোকা দিতে এলেও এই চোখ দুটোকে তার খেসারত দিতে হবে, মাইন্ড ইট!”
বলেই আবার চোখের পলকে আঁধারে মিলিয়ে গেলো সে, দম ধরে পড়ে থাকা ওকামি আর কাঞ্জি দম ছাড়লো ভীষ্ণ জোরে! আর লিও দাঁড়িয়ে রইলো ভীতসন্ত্রস্ততায় হতভম্ব হয়ে, চোখের ওপর তখনও ভাসতে রইলো মীরের ধারালো নখরের অগ্রভাগ!

রাতের নিস্তব্ধ আকাশের এক কোণে ঝুঁকে আছে চাঁদ, তার রুপালি আলো গলে পড়ছে গাঢ় সবুজ পাতার ওপর। ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকির হলদে আলো জ্বলে উটছে পাতার ফাঁকে ফাঁকে। দূর থেকে ভেসে আসছে কোনো ঝরনার অবিরাম বয়ে চলার ঝমঝম শব্দ। গাছগাছালির আঁড়ালে নিঃশব্দে হেটে চলেছে কয়েকটি সাম্বার হরিণ, চোখ হতে তাদের নির্গত হচ্ছে নীলচে আলো।
নিগুঢ় নিঃস্তব্ধতার ভেতর কারো ভারী পদশব্দ পেয়ে উঁচু গাছের মগডালে বসে থাকা একটি হুতোম প্যাঁচা হুম হুম করে ডেকে উঠে সতর্ক করে দিলো তার সঙ্গী সাথিদের। নিজেও হুঁশিয়ার হয়ে বসে মনোযোগী দৃষ্টি রাখলো ঘাসের উপর ক্ষীণ শব্দ তুলে হেটে যাওয়া দীর্ঘাবয়বটির দিকে।
মীর হাটছে, নিঃশব্দে। চোখে এক নিরন্তর সন্ধানী দৃষ্টি, সুচারু রূপে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে তার চারপাশ। মহলকে পেছনে ফেলে সে সোজা এগিয়েছে পূর্ব দিকে। মাসের নির্দিষ্ট দিনটিতে মোহনীয় সেই সুরধ্বনিটি এদিক থেকেই ঢেউ খেলিয়ে ভেসে আসে বাতাসে।

ওই সুরে কি আছে, কে তার মালকিন তা সে জানেনা! শুধু জানে সেই সুর ওর ভেতর জাগায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যা সে কোনোদিন কখনো পেয়েছে বলে মনে পড়েনা! ও সুরে কেন তার বক্ষমাঝে নিঃশব্দে কেঁপে উঠে এই প্রশ্নের উত্তর তাকে জানতেই হবে!
ক্ষনিক পর হাটতে হাটতে হঠাৎই ওর পায়ে বাধলো কোনো ধাতব বস্ত, ঠন শব্দে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো বস্তুটি। মীর থামলো, ঘাড় নিচু করে ঘাসের ফাঁকে পড়ে থাকা বস্ত টার দিকে নজর দিতেই চোখে পড়লো একটি সুদীর্ঘ তালওয়ার!
চাঁদের আলোর ম্লান রশ্মি এসে ছুয়ে দিচ্ছে সেটাকে, ঝকমকিয়ে উঠে রহস্যময় এক নীল রঙা দ্যুতি বেরিয়ে আসছে যেন ধারালো বস্তুটির শরীর হতে।
কিয়ৎক্ষণ সেটিকে নিবিষ্ট চিত্তে দেখে নিয়ে তৎপর হয়ে তাকালো সে চারদিকে। অতঃপর হাতে তুলে নিলো তালওয়ার খানা৷ অগ্নি দীপ্ত তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো চকচকে, ধারালো, ধাতব তলের পৃষ্ঠে। সামান্য মরিচা নেই তাতে, কোথাও কোনো খুঁত পর্যন্ত নেই!
পরক্ষণেই ওর চোখ গেলো তালওয়ারের সাদা রঙা হাতলের দিকে, যেখানে স্বর্ণখচিত সুক্ষ্ম খোদাই করে লেখা- ‘আসওয়াদ’।

পুরনো এক গোপন সত্তা মীরের শিরায় শিরায় যেন জেগে উঠলো তৎক্ষনাৎ! সে আগ্রহী চোখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো ধাতব ব্লেডের দ্যুতি, চোখে ভেসে উঠলো কিছু ঝাপসা, রক্তাক্ত স্মৃতি! হীমশীতল চাহনি রাখলো সে ধারালো ব্লেডের ধারে। এক সুক্ষ্ম, নির্মম হাসির রেখা দেখা দিলো ওর রুক্ষ ঠোঁটের কিনারায়।
ঝকঝকে, চকচকে, ভারী সোর্ডখানা শক্ত মুঠি করে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো সে ধীরে ধীরে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ঘুরিয়ে পিছিয়ে নিয়ে এলো নিজের বাম পা টি।
তারপর….

শূন্যে বিদ্যুতের মতো ছুটে গেলো হাতে ধরা ধারালো তলোয়ারের ক্ষীপ্র আঁচড়, মুহুর্তেই বাতাস কেঁপে উঠলো ধাতব -‘শ্যাং’ শব্দে! তলোয়ারটা যেন ছুঁয়ে গেলো কোনো অদৃশ্য কাল্পনিক শত্রুর কণ্ঠনালি!
স্থীর হয়ে দাঁড়ালো মীর, মনে হলো এই তালওয়ার সে এর আগে বহুবার চালিয়েছে, বহু প্রাণের নাশ হয়েছে এই ধারালো অংশের নিষ্ঠুরতম আঘাতে।
একাগ্র, বিচক্ষণী চোখে সে আবারও কিয়ৎক্ষণ পরখ করলো ব্লেডের চকচকা অংশটি, পরিক্ষণেই আবার দৃষ্টি রাখলো নিজের খোদাই কৃত নামের ওপর।
হঠাৎই ওর মুখাবয়বে নেমে এলো এক অদ্ভুত কাঠিন্যতা! তীক্ষ্ণ চোয়াল দ্বয় শক্ত হয়ে জানান দিলো তার কংক্রিটের ন্যায় শক্ত নির্দয়তার! প্রখরতায় পূর্ণ শকুনি দৃষ্টি ফেলে নিজের চতুর্দিকে এঁকে নিলো এক কল্পিত যুদ্ধক্ষেত্র, এক ঝাঁক কাল্পনিক শত্রুর বহর।

পরক্ষণেই তালওয়ারটি ঘুরিয়ে ছুড়ে দিলো শূণ্যে, বিদ্যুৎ গতিতে স্পিন করে সেটা অভিকর্ষের টানে ভূমিতে পড়তে নিতেই দক্ষ হাতে ঝটিতি ধরে নিলো নকশাদার হস্তি দন্তে তৈরি হাতল। পরমুহূর্তেই এক তুখোড়, তেজস্বী, সুদক্ষ তালওয়ালকরের ন্যায় শুরু করলো তার নিখুঁত, নির্ভুল সুনিপুণ যুদ্ধশিল্প!
তড়িৎ গতিতে শ্যাং শ্যাং শব্দে বাতাস কেঁটে কেঁটে সে ছিন্ন করলো কাল্পনিক শত্রুর মস্তক, গুড়িয়ে দিলো বক্ষ পাঁজর, আলগা করে দিলো কারো উদর, ধড় হতে বিচ্ছিন্ন করলো কারো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ!
নিস্তব্ধ রাত্রির ভেতর তালওয়ায়ের গুমরে গুমরে ওঠা গর্জন যেন বাড়ি খেতে লাগলো রেড জোনের সুউচ্চ গাছগুলোর সুবিশাল শরীর গুলোয়! তালওয়ালকরের প্রতিটি নিখুঁত, দক্ষ, অনবদ্য, কৌশলী আঘাতে খোদিত হলো কাল্পনিক শত্রুর মৃত্যুর স্বাক্ষর!

তার শরীর ভিজে উঠলো ঘামে! শরীরের প্রতিটি পেশি যেন ছুটে চলেছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে, মস্তিষ্কের ঝাপসা অঞ্চলে লুকিয়ে গেঁথে থাকা পূর্বের সমস্ত অনুশীলনের স্মৃতি যেন আত্মস্থ করে নিয়েছে তার পেশিবহুল, ইস্পাত-দৃঢ় দেহসত্তা! দক্ষতায় পরিপূর্ণ প্রতিটি বর্বর আঘাতে তারা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলছে কাল্পনিক শত্রুর দেহ!
আচমকা থমকে দাঁড়ালো মীর। ঘন, ভারী শ্বাস ফেলতে ফেলতে নিগুঢ় দৃষ্টিতে আবারও দেখলো সে তালওয়ালটিকে। নিজের এই ত্রুটিহীন অদম্য দক্ষতা উপলব্ধি করে কিঞ্চিৎ বিস্মিতও হলো বোধ হয়!
মুহুর্তেই যেন ওর ঘটলো এক অজানা আত্মপ্রকাশ। শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রক্ত যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠলো হঠাৎ, টগবগিয়ে ছুটে চলল শিরা, ধমনী জুড়ে!

সেই মুহূর্তে নিজেকে নিয়ে হঠাৎ এক অদ্ভুত ভীতি ছড়িয়ে পড়লো মীরের মননে, মুখশ্রী তে দেখা দিলো গাম্ভীর্যতা। কিন্তু পরক্ষণেই জ্বলে উঠলো তার স্বর্ণাভ চোখ, ঠোঁট জোড়া চওড়া হলো এক অস্বাভাবিক, গোপন, পৈশাচিক হাসিতে। ধীরে ধীরে জোর বাড়লো ওর হাসির, মুখ থেকে বেরিয়ে এলো শিরদাঁড়া ঠান্ডা করা এক ভয়াল অট্টহাসি! নিঃস্তব্ধ জঙ্গলের ভেতর ওর হাসি শোনালো ভয়ঙ্কর, বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার মতো!
ক্ষণিক পর আচমকা হাসি থামিয়ে দিলো মীর, ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের স্বর্ণাভ শকুনি দৃষ্টি রাখলো ডানদিকের আঁধারে আচ্ছাদিত শূন্যে! একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শূণ্যে অবস্থিত কোনো আবছা অবয়বের দিকে!
গলা শুকিয়ে এলো অ্যাবিসোরার। ঠিক চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছেন হিজ ম্যাজেস্টি, নিঃশব্দ, নিস্পন্দ! অদৃশ্য থাকার গর্ব যেন মুহুর্তেই চূর্ণ হলো, ওই চোখের সম্মুখে কেউ অদৃশ্য থাকতে পারেনা… কেউ না!
শুকনো ঢোক গিললো সে। সম্পুর্ন ধরা পড়ার আগেই বিদ্যুৎ গতিতে ওই শকুনের ন্যায় তীক্ষ্ণ শিকারি দৃষ্টির সামনে থেকে পলায়ন করলো তৎক্ষনাৎ!

শীত শুরু হবে খুব শীঘ্রই, ভোর বেলা বেশ কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে আজকাল। আনাবিয়া রোজকার মতোন আজও সূর্য ওঠার আগেই উঠে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে কিছু হালকা নাস্তা তৈরি করে খেতে বসলো টেবিলে।
দ্রুতই মহলে পৌছতে হবে। মীরের ঘুম ভাঙার আগেই ওর সকালের খাবার তৈরি করে দিয়ে বেরিয়ে আসবে আজও। মীরের থেকে দুরত্ব বজায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা সে। কিন্তু যতই এড়িয়ে যেতে যায় ততই কেমন করে যেন ঠিক পড়ে যায় তাঁর সামনে!

তারপর শুরু হয় সেই পরিচিত অস্বস্তি! তার শকুনি চোখ- শিকারীর মতো তীক্ষ্ণ অথচ নিঃশ্বব্দ, বক্ষভেদী দৃষ্টি! ভয় হয় ওর, ওকে না চিনে ফেলে, ধরে না ফেলে ওর এই ছদ্মবেশ! ওই চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন, ভয়াবহ কঠিন। ওর ভেতরটা পড়ে ফেলার আগেই তাই বারবার পালিয়ে বাঁচতে চায় আনাবিয়া!
মীরের রোজকার রুটিন আত্মস্থ করে নিয়েছে ও। কখন ঘুম থেকে উঠে, দুপুরে কখন গোসলে যায়, সন্ধ্যায় কখন জঙ্গল থেকে ফিরে, সবই। তার অনুপস্থিতির সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তার খাবারের ব্যাবস্থা করে দিয়ে আবার চলে আসে লুকিয়ে।

খাওয়া শেষ হলে উঠলো আনাবিয়া। সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে সবেমাত্র। এখনি তৈরি হয়ে মহলে পৌছতে হবে, নইলে তিনি ঘুম থেকে উঠে গেলে ওই দৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়া আর সম্ভব হয়ে উঠবে না।
এমন সময় বাইরে শোনা গেলো কারো পদশব্দ, পরক্ষনেই ভেসে এলো কারো পুরুষালি কন্ঠস্বর- “শেহজাদী”
আনাবিয়া প্লেট গুলোকে কিচেনে রাখতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, পরিচিত কন্ঠের সম্বোধন শুনে ওভারসাইজ হুডির হুডখানা মাথায় গলিয়ে দিয়ে এগিয়ে এসে দরজা খুললো। ট্রি হাউজের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো একটি চমৎকার পুরুষকে, পরনে ঢিলাঢালা আলখেল্লা, চোখ জোড়া তার কাজল কালো। আনাবিয়াকে দেখে আনুগত্যের সাথে মাথা নোয়ালো সে।
তাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো আনাবিয়া, বলল,

“উপরে উঠে এসো অ্যাবিসোরা।”
অ্যাবিসোরা ইতস্তত করলো একটু। তারপর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো ওপরে। ওকে সোফায় বসতে দিয়ে টেবিল থেকে প্লেট গুলো নিয়ে কিচেনের দিকে যেতে যেতে বলল,
“আপডেট বলো।”
“হিজ ম্যাজেস্টি তাঁর অনুশীলনের সোর্ডটা সাদরে গ্রহণ করেছেন। আজ আমি তাঁকে আবার সেই পুরোনো রূপে দেখেছি, ঠিক পূর্বের মতো, যখন তিনি এই মহলের খোলা স্থানে এসে নিয়মিত তালওয়ালবাজি করতেন।”
আনাবিয়া প্লেট রেখে কিচেনের দরজায় এসে দাঁড়ালো। অ্যাবিসোরা একটু থেমে বলল,
“বাবার থেকে শুনেছি হিজ ম্যাজেস্টি তাঁর দাদাজান হুজায়ফা আদনান দেমিয়ানের থেকে এই তুখোড় তালওয়ারবাজি শিখেছিলেন। হিজ ম্যাজেস্টিকে দেখে কখনো কখনো ভাবনায় আসে, হুজায়ফা আদনান নিজে ঠিক কত দক্ষ তালওয়ালকর ছিলেন!”

আনাবিয়া শুনছিলো, দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে বলল,
“মীরের থেকে হুজায়ফা আদনানের কথা আমি অনেক শুনেছি। অমায়িক মানুষ ছিলেন, মীরকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন, খুব চাইতেন মীরকে তাঁর মতো করে তৈরি করতে। সাম্রাজ্যের প্রতি এই অতিরিক্ত অবসেশন, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে স্বচ্ছ থাকার স্বভাব, প্রয়োজনে দয়াশীলতা আবার প্রয়োজনেই প্রচন্ড নিষ্ঠুর হওয়ার স্বভাব এ সমস্তই হুজায়ফা আদনানের থেকে পেয়েছে ও। ঠান্ডা মস্তিষ্কে সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতম কাজটি করতেও ওর কখনো এতটুকু বাঁধেনি। জায়ান চাচাজান বলতেন হুজায়ফা আদনান মীরকে সব ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, বিশেষ করে অনুশীলনের ক্ষেত্রে। তালওয়ার অনুশীলনের জন্য ও সর্বদা মৃত্য দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদেরকেই বেছে নিতো। ওদের হাতে ধরিয়ে দিতো তালওয়ার, বলতো বেঁচে ফেরার এটাই তাদের শেষ সুযোগ! আর এই অনুশীলন শেষ হতো খণ্ডবিখণ্ড দেহ আর রক্তের স্রোতে!”

অ্যাবিসোরা পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে হাসলো, বলল,
“জ্বি, আমি তখন ছোট ছিলাম অনেক। এ কাজ করতে তাঁকে আমিও দেখেছি। কিন্তু আপনার জন্মের পর তিনি তার সবরকম নিষ্ঠুরতা চেপে গেলেন। আপনার দৃষ্টি থেকে সবকিছু লুকিয়ে রাখতেন তিনি। আসামীদের সাথে তালওয়ার অনুশীলনের ব্যাপারটি যখন আর হয়ে উঠতে চাইলোনা তখন তিনি ওদেরকে নিয়ে এসে ছেড়ে দিতেন রেড জোনে, আমাদের ওপর আদেশ ছিলো ওদেরকে ছুটিয়ে মেরে ফেলার। অ্যানিম্যাল টাউনের প্রাণীগুলো তো রীতিমতো জীবন্ত ছিড়ে খেতো ওদের! রেড জোন জুড়ে প্রাণ বাঁচানোর দায়ে শয়ে শয়ে ছুটে বেড়ানো মানুষ, আর তাদের পেছনে আমরা। ওদের মুখে মৃত্যু ভীতি আর আমাদের উল্লাস! যদিও আমরা বেশ উপভোগ করতাম। এই দিনিটার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, ঠিক একটা রাজকীয় ফেস্ট এর মতোন।”

আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হলো। মীর ওর থেকে লুকানোর চেষ্টা করলেও একসময় ধরা পড়েই গেছিলো। সে ভেবেছিলো এবার আনাবিয়া তার সাথে এক দফা বিস্তর ঝগড়া করে রেগেমেগে শিরো মিদোরি ছেড়ে জায়ান সাদির বাসায় গিয়ে উঠবে। কিন্তু তা হয়নি, আনাবিয়া বরং প্রস্তাব দিলো ওই নিষ্ঠুর, আনন্দদায়ক খেলায় ওকেও শামিল করতে। ব্যাস, তার খুশি দেখে কে!
কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে আনাবিয়া শুধোলো,
“ফোমার কি মনে হয়? ও কিছু স্মরণ করতে পেরেছে?”
“নেগেটিভ, শেহজাদী। তবে উনি কিছু স্মরণ করতে না পারলেও খুব ভালোভাবেই জানেন উনি কে, তাঁর পরিচয় কি! এবং প্রতিনিয়ত নিজের সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য অনুসন্ধানে তিনি উন্মত্ত, বলা যায় বেপরোয়া হয়ে উঠছেন! এবং এখন তাঁর দৃষ্টি আপনার ওপর, তিনি আপনাকে মনে মনে খুঁজে চলেছেন। আপনাকে কখনো বাগে পেলে তিনি ছেড়ে দিবেন বলে মনে হয় না।”

“আ-আমাকে? আমাকে কেন?”
আনাবিয়ার কন্ঠে ভীতির ছোয়া, ভ্রু জোড়া উঠে গেলো ওপরে। অ্যাবিসোরা দৃষ্টি নত রেখে উত্তর করলো,
“হিজ ম্যাজেস্টি আপনাকে সন্দেহের চোখে দেখেন, তাঁর ধারণা আপনি তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। তাঁর অতীত পরিচয়, পরিবার, বাসস্থান; এসব সম্পর্কে আপনিই সবচেয়ে বেশি ধারণা রাখেন। এবং তিনি এটাও বিশ্বাস করেন যে আপনি তাঁর খুব পরিচিত কেউ।”
আনাবিয়া প্রমাদ গুণলো, এই তবে ওর দিকে শকুনি চোখে তাকিয়ে থাকার কারণ? এই জন্যই তবে অমন ধ্বংসাত্মক চাহনি দিয়ে শেষ করতে চায় ওকে?
আনাবিয়াকে চুপ হয়ে যেতে দেখে অ্যাবিসোরা বলল,
“শেহজাদী, ঔদ্ধত্য ক্ষমা করবেন। কিন্তু আপনি কেন হিজ ম্যাজেস্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন? আমার ধারণা উনি… আপনাকে পেলে…. মানে আমি বলতে চাইছি.. আপনার স্পর্শ পেলে উনি সবই স্মরণ করতে পারতেন।”

“আমি ওর জীবন হতে নিরাপদ দুরত্বে থাকতে চাই অ্যাবিসোরা। আর সত্যি কথা বলতে আমি চাইনা ও কখনো ওর স্মৃতি ফিরে পাক। আমি শুধু চাই ও ওর পরিচয় অনুসন্ধান করুক, ওর স্থান কোথায় সেটা জানুক। ওর স্মৃতি ফিরে এলে, আমাকে মনে পড়লে সেটা ওর আমার দুজনের জন্যই ক্ষতিকর।
আমাকে পেতে গেলো ওর সাম্রাজ্য আবারও হাতছাড়া হবে, কারণ আমি ওকে অন্য নারীর পাশে কখনো মেনে নিতে পারবোনা। এতে দুজনের ভেতর সংঘাত তৈরি হবে, এতে সে না পারবে সাম্রাজ্যের কাজে মনোযোগ দিতে, না পাবে মানসিক শান্তি। আর আমার কথা বাদই দিলাম!”
অ্যাবিসোরা শুনলো, মাথা নত করে বসে রইলো চুপচাপ। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে আনাবিয়া আবার বলল,
“তার চাইতে ওর ওপর হতে সমস্ত দাবি ছেড়ে দিয়ে আমি ওর অগোচরে ওর থেকে যোজন যোজন দুরত্ব বজায় রেখে দিনাতিপাত করবো৷ এতে সেও ভালো থাকবে, আমিও। সে জানবেও না আনাবিয়া নামে কোনো অস্তিত্ব ছিলো। তার সাম্রাজ্যের জন্য নতুন উত্তরসূরী আসবে, নতুন নতুন ভাবে উপভোগ করবে জীবন, সাম্রাজ্যের প্রতি মনোযোগ দিবে, এতেই ভালো।

সবাইকে যে একজীবনে সবকিছু পেতে হবে তার কি মানে? কখনো কখনো কোনো অবলম্বন ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। এত চাহিদা থাকলে এই জীবনে কখনো হয়তো সুখী হতে পারবোনা। আমার এখন যা কিছু আছে যেটুকু আছে সেটুকু নিয়েই আমি সন্তুষ্ট, অ্যান্ড দ্যাট’ল বি গ্যুড ফ’ মি।”
বলে মিষ্টি করে হাসলো আনাবিয়া। অ্যাবিসোরার চোখে ধরা পড়ে গেলো মিষ্টি হাসির তলে লুকিয়ে থাকা বেদনার সুক্ষ্ম নীল রঙা সুতো গুলো।

ভরসন্ধ্যা বেলা।
গোসল শেষে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে গোসলখানা থেকে বের হলো মীর। টেবিলের ওপর খাবার সাজানো দেখে এগিয়ে এসে বসলো চেয়ার টেনে৷ খাবারের ট্রের পাশেই উঁকি দিয়ে আছে কয়েকটি কাগজপত্র। ট্রে সরিয়ে সেগুলো হাতে নিলো মীর৷
কিছু ডকুমেন্টস, চোখ বুলোতেই কোথাও একটা দেমিয়ান শব্দটা সম্মুখে পড়তেই থামলো মীর। জাজীব ইলহান দেমিয়ান নামটা জ্বলজ্বল করছে সেথায়। সময় নিয়ে, খুব মনোযোগ দিয়ে সম্পুর্ন ডকুমেন্টস গুলো পড়ে শেষ করলো সে। পুরোটা জুড়ে জাজীব ইলহান দেমিয়ান নামক লোকটির গত পাঁচ বছর ধরে করা প্রতিটি ছোট বড় অপরাধের উপযুক্ত প্রমাণ সহ বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া৷

মীর উঠে দাঁড়ালো, বিছানার বা দিকের দেওয়ালের সাথে লাগোয়া ওয়াল আলমিরা টা সরিয়ে ফেললো এক টানে। সরাতেই চোখে পড়লো দেয়াল পুরো ভর্তি! নোটপ্যাড, পিনবোর্ড, এবং রঙিন পিন দিয়ে আটকে দেয়া ডকুমেন্টস আর নানা সময়ে সংগ্রহ করা ছবিতে পরিপূর্ণ দেয়ালটি। প্রত্যেক কাগজে নানা দাগ, সরলরেখা আর তীরচিহ্ন দিয়ে মিলিয়ে দেয়া তথ্যের অসংখ্য জটলা।
তারের মত করে সুতো বাঁধা দেয়ালজুড়ে, এক ফটো থেকে আরেক ইভেন্ট, তা থেকে অন্য ব্যক্তির ছবিতে ছড়িয়ে পড়েছে তা। সদ্য পাওয়া ডকুমেন্টস গুলোর সাথে নিজের অনুসন্ধান মেলাতে তাঁর চোখ ঘুরে চলল এসব সুতো বয়ে।
কিয়ৎক্ষণ পর আলমিরার নিকট এসে একটি কম্পার্টমেন্ট খুলে বের করলো বেশ কিছু ডকুমেন্টস। সেখানে জাজীব ইলহান দেমিয়ান নামক লোকটির করা অপরাধ গুলো সংঘটিত হওয়ার সময়কার সাময়িক অরাজকতার ব্যাপারগুলো বিস্তারিত লেখা।

সেগুলো নিয়ে এসে একে একে দেয়ালে পিন আপ করলো মীর। কিয়ৎক্ষণ স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দেয়ালের সম্মুখে, অতঃপর মনে মনে ছক কষে নিলো নিজের পরবর্তী পদক্ষেপের।
ক্ষণ পরে আলমিরাটা আবার পূর্বের স্থানে রেখে দিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো খাবার টেবিলে। হাত বাড়িয়ে ট্রে খানা টেনে নিয়ে একটা রুটি তুলল। ঠিক তখনি শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত ক্ষীণ জ্বালাপোড়া অনুভব করলো মীর!
পরক্ষণেই তা বিশ্রামহীন ক্লান্তির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভেবে উপেক্ষা করে স্বাস্থ্যবান রুটি খানা তরকারি সমেত পুরে দিলো মুখে। সেই মুহুর্তেই আচমকা তার শরীরের ক্ষীণ জ্বালাপোড়া রূপ নিলো তীব্র অগ্নিগর্ভ যন্ত্রণায়! এক অসহ্য ব্যাথা ছড়িয়ে পড়লো সম্পুর্ন শরীর জুড়ে, যেন ভেতর থেকে কিছু একটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দিতে চাইছে ওকে!
মীর স্থীর হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে রেখে হজম করতে চাইলো যন্ত্রণা টুকু। কিন্তু ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলল সেটা, বাড়তে বাড়তে সহ্য শক্তির বাইরে টেনে নিয়ে এলো মীরকে! ভ্রু জোড়া বিধ্বংসী যন্ত্রণায় কুচকে এলো হঠাৎ, তীব্র দহন জ্বালায় মুখ থেকে বেরিয়ে এলো চাপা, হিংস্র গর্জন!

ঝটিতি উঠে দাঁড়ালো ও, চেয়ারটা শব্দ করে আছড়ে পড়লো মেঝেতে। পায়ের আঘাতে সেটাকে রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত বেগে এগোলো ও স্নানঘরের দিকে। তড়িঘড়ি শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে ছেড়ে দিলো পানি। দম পড়তে লাগলো ওর ঘন ঘন।
অনেক অনেক ক্ষণ ধরে ঠান্ডা পানিতে সারা শরীর ভেজানোর পর অবশেষে একটু একটু করে কমে এলো ওর জ্বালাপোড়া। সহনীয় পর্যায়ে এলে শাওয়ার বন্ধ করে বেরিয়ে এলো ও বাইরে। তোয়ালে দিয়ে নিজেকে শুকিয়ে নিয়ে গায়ে একটা ট্রাউজার আর টি শার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৩

আঁধার জমে এসেছে, বারান্দায় একটা বাতি জ্বালানো হয় রাত নামলেই। আজ আর কেউ বাতিটা জ্বালেনি। মীর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো চারদিকে। উচ্ছৃঙ্খল ছেলে মেয়ে গুলোর একটাকেও পাওয়া যাচ্ছে না এদিকে। সেগুলো কোথায় গিয়ে মরেছে কে জানে?
মহলের অন্য পাশের খোলা প্রান্তর হতে ভেসে আসছে উচ্চস্বরে হাসাহাসির ক্ষীণ শব্দ। মীর ভেজা চুল গুলোকে হাতের সাহায্যে ঠিক করে নিতে নিতে ভারী ভারী পা ফেলে নেমে গেলো মহলের চওড়া কাঠের সিঁড়ি বেয়ে।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here