বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১+২
রানী আমিনা
“ইয়োর ম্যাজেস্টি! শেহজাদী কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
পঞ্চদ্বীপের শিরো মিদোরি নামক রাজকীয় দ্বীপটির ঠিক মধ্যিখানে অবস্থিত, ঝকঝকে শুভ্র মার্বেল পাথরের তৈরি সুউচ্চ দেমিয়ান প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরে নিজের ব্যাক্তিগত কামরায় বসে সাম্রাজ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছিলেন পঞ্চদ্বীপের পরাক্রমশালী বাদশাহ; এক দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ শরীরের অধিকারী সুপুরুষ, নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান।
সাদা আর সোনালি রঙা নকশার রাজকীয় কামরাটি পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ আভায় স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে। তার ঠিক মাঝে, বিছানার পাশ ঘেঁষে, স্বর্ণের নকশা খোদাই করা একটি লাল চন্দনের টেবিলে বসে নিজের কাজ করছিলো মীর৷
সাদা রঙা একটা পাতলা ফিনফিনা শার্ট পরিহিত মীরের ঠোঁট জোড়া শক্ত, অথচ তাতে লেগে আছে কিঞ্চিৎ কোমলতার স্পর্শ, যেন রাজ্যরক্ষা আর স্নেহের মধ্যকার এক রহস্যময় সেতুবন্ধন! এক দুর্বোধ্য হাসি ছড়িয়ে আছে তার কৃষ্ণবর্ণের ঠোঁট জোড়ায়৷ স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়ানো চোখ জোড়ার সম্পুর্ন মনোযোগ নিবদ্ধিত তার হাতের কাগজপত্র গুলোর দিকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু দরজায় দাঁড়ানো তার প্রধান দেহরক্ষী হামদানের মুখে তার ছোট্ট শেহজাদীর নিখোঁজ সংবাদ শুনে তার ঠোঁটে লেগে থাকা এতক্ষণের দুর্বোধ্য হাসি টা মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই৷ ক্রোধ এবং উদ্বিগ্নতায় নিজের পুরু ভ্রু জোড়া কুচকে, বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো মীর। তারপর কঠিন চোখে তাকিয়ে বজ্রকন্ঠে বলে উঠল,
“খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি? কোথায় গিয়েছে আমার শিনজো? কে ছিলো ওর সাথে?”
” ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদী হেরেমের ওদিকের কোনো এক কামরায় ছিলেন। শেহজাদীর খাসবাদী বেলিন্ডা ছিলো তার সাথে! কিন্তু শেহজাদীর জন্য খাবার আনতে রয়্যাল ক্যালিনারিয়ামে যায় বেলিন্ডা, এরপর খাবার নিয়ে ফিরে গিয়ে আর শেহজাদী কে পায়নি! ওনাকে বাইরে বের হতেও কেউ দেখেনি। কামরাটার ব্যালকনির দরজা খোলা ছিলো, হতে পারে তিনি ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছেন!”
মাথা নত করে ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে উত্তর করলো হামদান। এত কড়া গার্ডের পরেও শেহজাদী পালিয়ে গেছেন খবর টা শুনে হিজ ম্যাজেস্টি এখন কি যে করবেন সেটা একমাত্র আল্লাহই জানেন!
হামদান মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো বাদশাহ কি আদেশ করেন সেটা জানার জন্য। কিন্তু মীর মুখে কিছুই বলল না। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে, চোয়াল শক্ত করে নিজের ক্লজেটের দিকে হেটে গিয়ে সেখান থেকে একটা ঢোলাঢালা রোব বের করে নিয়ে,দ্রুত গতিতে গায়ে জড়িয়ে, ভারী পায়ে বেরিয়ে এলো কামরার বাইরে। বেরিয়ে এসেই ভ্রু জোড়া কুচকে ভরাট, উচ্চ কন্ঠে হাঁক ছাড়লো কারো উদ্দ্যেশ্যে,
“নোমান!”
বাদশাহর কন্ঠে নিজের নাম শুনতেই কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো হেরেমের প্রধান গার্ড দের একজন। মীরের সামনে এসে আনুগত্যের সাথে দাঁড়িয়ে নোমান নামক ক্যাস্ট্রেটেড গার্ড টি মাথা নত করে মিহি সুরে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আদেশ করুন!”
“আমার শিনজোকে দেখাশোনা করার জন্য যতগুলো দাসী এবং গার্ড নিযুক্ত করা হয়েছিলো সবগুলোকে এই মুহুর্তে বরখাস্ত করে প্রাসাদ থেকে বের করে দাও। কোনো ইররেস্পন্সিবল সার্ভেন্টের আমার প্রয়োজন নেই!”
প্রচন্ডরকম বিরক্তিতে ছেয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে চেয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বলে গটগট পায়ে দ্রুত গতিতে প্রাসাদের বহির্দ্বার এর দিকে এগোলো মীর৷ ওর পেছন পেছন হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো হামদান সহ আরও কয়েকজন গার্ড৷
শিরো মিদোরির রেড জোনের জঙ্গলের ভেতরকার ঘাস যুক্ত নরম মাটিতে পড়ে থাকা একটি মরা গাছের শক্তপোক্ত; শ্যাওলা জমে যাওয়া গুড়ির ওপর দুপাশে পা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে বছর চারের ছোট্ট আনাবিয়া। এক হাতে নিজের আদরের টেডিবিয়ার ডল টাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে গাছের ওপর কোনো অদৃশ্য আকিবুকি তে ব্যাস্ত ও৷ নরম, ফোলা ফোলা গাল দুটো অভিমানের চোটে আরও ফুলে আছে। শুভ্র কেশগুচ্ছ ছড়িয়ে আছে পিঠময়, কয়েক গুচ্ছ চুল সামনে এসে পড়েছে ঝুকে থাকার কারণে৷
ওর হীরকখন্ডের ন্যায় ঝিকিমিকি করতে থাকা চোখ জোড়াতে অশ্রুর কিঞ্চিৎ আভাস। টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়ার নিচের টা অভিমান ভরে উঁচিয়ে আছে। যেন মনের বিষণ্ণ কোণে আর একটু মেঘ জমলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে সে!
কিছুতেই আজ প্রাসাদে ফিরবে না সে, এই জঙ্গলেই থেকে যাবে। ওকে কিনা বকা দিলো! একটু কোলে নিলে কি এমন ক্ষতি হতো! কাজ কি পরে করা যেতো না? মানে কি মীরি ওর থেকে ওই কাগজ পত্র গুলোকে বেশি ভালোবাসে? তো থাকুক মীরি ওর কাগজ পত্র নিয়ে!
নিজের মনে অভিমানের নিখুঁত বুনট গেথে চলেছে আনাবিয়া। গলা টা ভারী হয়ে আছে প্রচন্ডরকম, কান্না গুলো এসে জড় হয়েছে সেখানে, যেন একটু টোকা লাগলেই অভিমানের পাতিলটা পরিপূর্ণ হয়ে সমস্ত কান্না গুলো ছলকে পড়বে বাইরে!
এমন সময়ে পেছন থেকে ভেসে আসলো একটা মোলায়েম, আদুরে, পুরুষালি কন্ঠস্বর,
“শিনজো!”
দূর থেকে আনাবিয়া কে লক্ষ্য করে, হামদান সহ অন্যদের কে সেখানেই রেখে একাই আনাবিয়ার কাছে এসেছে মীর। কিন্তু মীরের এমন আদুরে কন্ঠেও মুখ ফিরিয়ে তাকালো না আনাবিয়া, বরং নিজেকে অভিমানের খোলশে আরও একটু শক্ত করে আবদ্ধ করে নিয়ে ঠাই বসে রইলো।
মীর ধীর পায়ে এসে বসলো ওর পেছনে, কাঠের গুড়িটার ওপর৷ তারপর আনাবিয়ার শুভ্র কেশগুচ্ছের এক গুচ্ছ হাতে নিয়ে আঙুলে ভাজে পেচিয়ে নিতে নিতে আগের মতো করেই বলে উঠলো,
“আমার শিনুটা না কাউকে না বলে জঙ্গলে এসেছে কেন?”
“মীলি বতলো তেন!”
কান্না জড়ানো আধো আধো গলায় অভিমানি সুরে বলে উঠলো আনাবিয়া। আর এরপর এতক্ষণের কান্না আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টাটাকে সম্পুর্ন বিফল করে ঠোঁট উল্টে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আনাবিয়া। সাথে সাথেই শিরো মিদোরিতে শুরু হলো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি।
মীর হাসলো মৃদু, তারপর হাত বাড়িয়ে আলতো হাতে আনাবিয়াকে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করতে করতে আদুরে গলায় বলে উঠলো,
“এদিকে তাকাও শিনু!”
আনাবিয়া নিজের হাত পা শক্ত করে গুটিয়ে নিয়ে আরও একটু গাল ফুলিয়ে বসলো, যেন মীর ওর অভিমানে ভরা ক্রন্দনরত মুখ খানা দেখতে না পারে।
আনাবিয়ার এমন শক্ত অভিমানে সশব্দে হেসে উঠলো মীর, তারপর এক প্রকার ছো মেরে আনাবিয়া কে দুহাতে তুলে নিজের বুকের ওপর নিয়ে চেপে ধরে ওর ছোট্ট মুখ খানা উটিয়ে বলল,
“এত্ত অভিমান হয়েছে আমার শিনজোর! ঠিক আছে, এই মীরি তোমাকে আর বকবে না। আর আমি বকলামই বা কখন? শুধু একটু বলেছি যে, শিনু আমি কাজ করছি, এখন কোলে নিতে পারবোনা। তুমি একটু বাইরে গিয়ে ঘুরে আসো! এটা কি বকা? বলো।”
আনাবিয়া কোনো উত্তর দিলো না। ওইটুকুই বা মীরি বলবে কিসের জন্য? শুধু তো একটু কোলেই উঠতে চেয়েছিলো! তাই ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিলো!
আনাবিয়ার ফোঁপানোর বেগ বাড়লো আরও। ফোপাঁতে ফোপাঁতে মীরের বুকে নিজের ক্লান্ত মাথাটা এলিয়ে দিলো ও। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোটা আনাবিয়ার চুলের ওপর পতিত হয়ে বিন্দু বিন্দু শিশিরকণার ন্যায় ফুটে উঠলো।
মীর মৃদু হেসে আনাবিয়াকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে ওর চুলের ওপর দিয়ে মাথায় একটা স্নেহপূর্ণ চম্বন বসিয়ে দিয়ে উঠে দাড়ালো, এরপর প্রাসাদের দিকে এগোতে এগোতে আদুরে গলায় বলে উঠলো,
“এমনটা আর কখনো কোরো না প্রাণ আমার! মীরের চিন্তা হয় তো! আর করবে এমন?”
আনাবিয়া মীরের বুকে মুখ লুকিয়ে দুদিকে সজোরে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো যে সে করবে না। আনাবিয়ার এমন সহজ স্বীকারোক্তিতে মীর ওর মাথার সাথে নিজের মাথা ছুইয়ে আদুরে ভঙ্গিতে ঘষে দিলো, তারপর আবার এগোলো নিজের গন্তব্যের দিকে৷
পথিমধ্যে আনাবিয়া মীরের শার্টের বুকের কাছটায় নাক মুছে আধো ধমকে সাবধান করে দিলো মীর কে, দ্বিতীয় বার তাকে বকা হলে সে আবারও পালাবে, এবং এবার পালালে আর কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।
এখন প্রায় মধ্যরাত। আনাবিয়া হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে মীরের বিছানায়। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে ওর। থেকে থেকে চোখের পাতা জোড়া তিরতির করে কাঁপছে। মাঝে মাঝে টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হচ্ছে কোনো মিষ্টি স্বপ্নে, পরক্ষণেই আবার ফুলে উঠছে সে জোড়া; মিষ্টি স্বপ্নে হয়তো বাধা দিচ্ছে কেউ!
মীর টেবিলে বসে নিজের কাজ করছিলো আর বার বার আনাবিয়ার দিকে দেখছিলো৷ আনাবিয়া কে ঘুমের মাঝে ঠোঁট ফোলাতে দেখে কাজ অসমাপ্ত রেখেই উঠে বিছানায় এলো ও। আনাবিয়ার পাশে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে ওর ছোট্ট তুলতুলে দেহ টা দুহাতে টেনে এনে বুকের ওপর তুলে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকের মাঝে। তারপর আনাবিয়ার শুভ্র কেশগুচ্ছের ওপর দিয়ে মাথায় একটা তপ্ত চুমু খেয়ে হাত বুলিয়ে দিলো ওর চুলে। মীরের স্পর্শ পেয়ে ঠোঁট ফোলানো টা আবার কমে গেলো আনাবিয়ার। মিষ্টি স্বপ্ন গুলো আবার ফিরে এসেছে তার!
আনাবিয়ার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে স্বর্ণালি নকশা খচিত সিলিঙের দিকে তাকালো মীর৷ চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিছু স্মৃতি! তার বুকের ওপর থাকা ছোট্ট আনাবিয়া তার প্রাণপ্রিয় চাচাতো ভাই, এবং তার থেকেও বেশি, বন্ধু সালিমের আমানত; শেষ নিঃশ্বাস ফেলার সময় অনাগত মেয়েটির সমস্ত দায়িত্ব ওর কাছে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে সালিম। কিন্তু এখন যে ছোট্ট আনাবিয়ার প্রতি ওর দায়িত্ব বেড়ে গেছে অনেক অনেক বেশি! সে যে এখন তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী!
সিলিঙ থেকে চোখ সরিয়ে বুকের ওপর থাকা ঘুমন্ত আনাবিয়ার দিকে তাকালো একবার মীর৷ কি যে মায়া ওই শুভ্র মুখ খানাতে! বুকের ভেতর টা যেন ছেয়ে যায় এক শীতল স্নিগ্ধতায়! এই মিষ্টি মেয়েটা কোথায় ছিলো এতদিন! আরও আগে কেন আসলো না ওর জীবনে!
হয়তো লাইফ ট্রি ওর হিংস্রতা, রুক্ষতা কমানোর জন্যই এই ছোট্ট মেয়েটাকে বেধে দিতে চেয়েছে ওর সাথে! নইলে কেন এই পুচকুটার কাছাকাছি আসলেই ওর বুক টা ঠান্ডা হয়ে যায়, কেন ওর চিন্তায় গিজগিজ করতে থাকা মস্তিষ্ক টা সমস্ত এলোমেলো চিন্তার পাহাড় ধসিয়ে দেয়, কেন ওর চোখ জোড়া এত্ত শান্তি পায়! কেন ওই মেয়েটাকে বেশিক্ষণ না দেখতে পেলে ওর এত্ত অশান্তি হয়! কি আছে ওই ছোট্ট মুখ খানাতে?
স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে আনাবিয়ার ঘুমন্ত, নিষ্পাপ মুখখানার দিকে তাকিয়ে মীর আর একখানা স্নেহের চুম্বন বসিয়ে দিলো ওর মাথার ওপরে। আর তারপর একসময়ে বুকের ওপর থাকা মেয়েটার স্নিগ্ধতায় ডুব দিলো গভীর ঘুমে।
ভোর সকালে মীরের ঘুম ভাঙলো চোয়ালের ওপর কারো ছোট্ট ছোট্ট হাতের তুলতুলে স্পর্শে। চোখ মেলতেই আনাবিয়ার শুভ্র চেহারাটা ভেসে উঠলো ওর চোখের ওপর। মীরের বুকের ওপর উঠে বসে, মীরের দুকাধের ওপর হাতের ভর দিয়ে ওর মুখের ওপর ঝুকে আছে সে। মীর চোখ মেলতেই চোখ মুখ কুচকে দাঁত মেলে হাসলো আনাবিয়া।
আনাবিয়া কে এমন দুষ্টু হাসি দিতে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো মীর৷ তারপর নরম কন্ঠে শুধালো,
“আমার শিনু এমন ডেভিল হাসি কেন দিচ্ছে? কি করেছে সে?”
আনাবিয়া কোনো উত্তর দিলো না, হাসি টা আরও গাঢ় হলো ওর, হিহি করে হেসে মুখে হাত চাপা দিলো। তখনি মীরের চোখ গেল আনাবিয়ার হাতে থাকা মার্কার প্যেন এর দিকে। সাথে সাথেই যা বোঝার বুঝে গেলো ও। আনাবিয়া কে বুক থেকে নামিয়ে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে কামরায় রাখা ফুল ভিউ মিররের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে গেলো ও।
ওর সমস্ত মুখ আর বুক জুড়ে ছড়িয়ে আছে হিজিবিজি আঁকিবুঁকি! ওর কালো রঙা শরীরের ওপর গ্লিটার মিশ্রিত সাদা রঙা মার্কারের রঙ টা ফুটে পড়েছে দারুণ ভাবে। জানালা দিয়ে টিকরে পরা ভোরের মিষ্টি সূর্যালোক এসে পড়লো সে গ্লিটারের ওপর, চিকচিক করে উঠলো সেগুলো।
বিছানার ওপর থাকা আনাবিয়া মীরের এহেন চেহারা দেখে কুটকুট করে হেসে হাত পা ছড়িয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো বিছানায়! তারপর হাসি থামিয়ে এক ফাকে মীরের দিকে তাকালো,
“থুন্দল!”
বলেই আবার সেই কুটকুটে হাসি। মীরেরও হাসি পেলো এবার, শব্দ করে হেসে ও তেড়ে এলো বিছানায় থাকা আনাবিয়ার দিকে।
“পঞ্চদ্বীপের বাদশাহের গায়ে আঁকিবুঁকি করার সাহস কোথায় পেলো শিনু! দেখি এত সাহস কই থাকে তার, হুম!”
আনাবিয়া কে আদুরে সুড়সুড়ির আক্রমণে উথাল-পাতাল করে দিতে শুরু করলো মীর। আনাবিয়া মীরের এই হঠাৎ আক্রমণে খেই হারিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে সমস্ত কামরাটাকে সচকিত করে তুললো৷
কিছুক্ষণ পর ওকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে আবার ওকে বুকের ওপর তুলে বসিয়ে দিলো মীর, তারপর নরম কন্ঠে বলে উঠলো,
“শিনু, ম্যেইক অ্যা উইশ!”
আনাবিয়া ঠোঁট উলটে ভাবলো কিছুক্ষণ, কি উইশ করা যায় আজ! কিছুক্ষণ ভেবে ও আধো আধো কন্ঠে বলল,
“লাত্তিলে দঙ্গলে নিয়ে দাবা! ঘুত্তে।”
“অবশ্যই নিয়ে যাবো, কেন নিয়ে যাবো না! আমার শিনু উইশ করবে আর আমি পূরণ করবোনা এমন কিছু কখনো হয়েছে নাকি?”
আনাবিয়ার ফোলা ফোলা গাল দুটো দুহাতে মলে দিয়ে বলে উঠলো মীর। আনাবিয়া আবারও প্রচন্ড খু্শিতে দাঁত বের করে হাসলো। মীর ওর হাসির দিকে কিছুক্ষণ স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আনাবিয়ার এখন চার বছর চলছে। দেখতে দেখতে সাতে পড়ে যাবে কবে হুট করেই। তখন আর এই মেয়েটিকে নিজের বুকে নিয়ে ঘুমাতে পারবে না ও৷ ওকে এখন থেকেই আলাদা ঘুমানোর অভ্যাস করাতে হবে, নইলে পরে বিপদ হয়ে যাবে৷
কোনো দাসীর কাছে যে তাকে রাখবে তারও উপায় নেই। এইটুকু মেয়ে, তার মেজাজ দেখলেই হয়ে যায়! মীর ছাড়া অন্য কেউ ওকে স্পর্শ করলে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে পুরাই, চিৎকার চেচামেচি করে প্রাসাদটা একেবারে মাথায় তুলে ফেলে।
ছোট্টবেলায় চাচা ইলহান, আর দাদা আজলান ছিলো বলে মীরের একটু ফুরসত মিলতো। কিন্তু এখন সে উপায়টাও নেই! আনাবিয়ার সবকিছু একা হাতে ওকেই করতে হয়। নইলে তার যে তেজ! এদিক থেকে ওদিক কিছু হলেই অভিমানে গাল ফুলে যায়। সেই সাথে হাতের কাছে যেটা থাকবে সেটাই ছুড়ে ভেঙে ফেলবে। তার এই আনকন্ট্রোলেবল তেজে মীরের ভস্ম হওয়ার উপক্রম।
অভিমান ভাঙাতে রাজ্যের কাজ বাদ দিয়ে মীর কে পড়ে থাকতে হয় ওর কাছে৷ নইলে বিপদ, একটা কথাও সে মুখ থেকে বের করবে না। না মীরের কাছে আসবে, আর না একফোটা খাবার মুখে তুলবে!
চুপিচুপি গিয়ে লুকিয়ে থাকবে কোথাও, আর সমস্ত প্রাসাদের কোণায় কোণায় সমস্ত দাস দাসীরা মিলে হারিকেন জ্বালিয়ে খোঁজা শুরু করবে ওকে।
আর গতকাল তো অভিমান করে পালিয়েই গেলো জঙ্গলে! এরকম হতে থাকলে কিভাবে সামলাবে মীর এতকিছু!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবনা চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে মীর হঠাৎ বলে উঠলো,
“কিছুদিন পর থেকে তুমি আর আমার সাথে ঘুমোতে পারবে না শিনু, তোমার জন্য একটা নতুন কামরার ব্যাবস্থা করা হবে খুব দ্রুতই।”
মীরের কথা টা কানে যাওয়া মাত্রই হাসি হাসি মুখ টা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে এলো আনাবিয়ার।
“তেন? তুমি আমাল থাতে না গুমালে আমাল বয় তলবে তো! দানালায় মনতান!”
মন খারাপ করে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল আনাবিয়া। মীর মৃদু হেসে ওর শেষোক্ত শব্দটাকে শুদ্ধ করে দেওয়ার চেষ্টায় বলে উঠলো,
“মনতান নয়, মনস্টার”
“মনতান”
গলায় জোর দিয়ে মনস্টার শব্দটাকে ভালো ভাবে উচ্চারণ করার চেষ্টা করলো আনাবিয়া। কিন্তু ওর মনতান টা মনতানই রয়ে গেলো। মীর ফিক করে হেসে বলল,
“আচ্ছা, আর কষ্ট করে উচ্চারণ করতে হবে না। কোনো মনস্টার তোমাকে কিচ্ছু করবে না। তোমার মীরি আছে তো! শিনু কে মনস্টার আক্রমণ করতে এলে সব মনস্টার কে মীরি ঢিসুম ঢিসুম দিয়ে দিবে। ঠিক আছে?”
আনাবিয়া বিষণ্ণ মনেই ওপর নিচে মাথা ঝাকালো। মীর ওকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিতে আবার বলল,
“কিন্তু তোমাকে একা ঘুমাতে হবে এখন থেকে শিনু, তুমি বড়ো হয়ে যাচ্ছো যে! কিছুদিন পর থেকে আমার সাথে আর ঘুমানো যাবে না৷”
“কেন? গুমালে কি অবে”
“এসব তুমি বুঝবে না, আরও বড়ো হও তখন বুঝবে”
“আমি এতন বুদবো”
মীর ওর আধো শব্দ টাকে শুদ্ধ করে দেওয়ার প্রচেষ্টায় বলে উঠলো,
“‘এতন’ না ‘এখন'”
“‘এতন'”
মীরের বলা শব্দ টাকে প্রাণপণে শুদ্ধরূপে উচ্চারণ করতে গিয়েও জিভের জড়তার কারণে পেরে উঠলো না আনাবিয়া।
ওর অপারগতায় শরীর দুলিয়ে নিঃশব্দে হাসলো মীর, তারপর আবার আনাবিয়ার উচ্চারিত শব্দ টাকে শুদ্ধ করতে বলল,
” বলো, অ্যা.. ”
“অ্যা…”
“খন”
“তন”
এবার ছাঁদ কাপিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো মীর। ওর হাসির তোপে ওর পেটের ওপর বসা আনাবিয়া দুলে উঠলো। মীর কে এমন হাসতে দেখে রাগ হলো ওর, ভ্রুকুটি করে ও তেজি কন্ঠে বলে উঠলো,
“হাতো কেন? বুদাও!”
মীর কিছুক্ষণ চেষ্টার পর কষ্ট করে হাসিটা থামিয়ে বলল,
“এতন পালবোনা, ততন বুদাবো”
মাঝরাতে শরীরের ওপর কারো তুলতুলে দেহের ভর অনুভব করে ঘুম ভেঙে গেলো মীরের। আনবিয়া হাত পা ছড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ওর খোলা বুকের ওপর। ওর ঘন নিঃশ্বাস মৃদু ছন্দ তুলে বারে বারে ছুয়ে দিচ্ছে মীরের প্রশস্ত লোমশ বক্ষ।
বছর খানেক হলো আনাবিয়া মীরের পাশের কামরাটায় শিফট হয়েছে। মীর চেয়েছিলো ওকে অন্দরমহলের কোনো সুন্দর কামরায় রাখতে। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদলে নিজের পাশের কামরাটাই সিলেক্ট করলো ও।
মেয়েটাকে না দেখে দুদন্ড থাকতে পারবে না ও। ওকে অন্দরমহলে রাখলে বারবার অন্দরমহলে গিয়ে দেখে আসাও সম্ভব না৷ সময় হয়ে উঠবে না ওর।
আনাবিয়াও সময়ে অসময়ে ওকে না পেলে যে ক্ষেপে উঠে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখনো এতটুকুন একটা বাচ্চা তাতেই দাসী গুলো গায়ের জোরে পেরে দেয় না ওর সাথে, মীরের এত কড়া নজরের পরেও সবাইকে তছনছ করে দেয় ও! তাহলে যখন মীর ওর ওপর নজর রাখতে পারবে না তখন দাসী গুলোর যে জানে পানি উঠে যাবে, সে ব্যাপারে মীর ছিলো শতভাগ নিশ্চিত। তাই নিজের পাশের কামরাটাই বেস্ট মনে হলো ওর কাছে। এ ছাড়া অন্য কোথাও আনাবিয়া কে রাখলে না ও শান্তি পেতো, আর না আনাবিয়া।
কিন্তু আনাবিয়াকে পাশের কামরাটায় পাঠাতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে মীরকে।
মীরের কামরা ছেড়ে যাবে না, মীরের কাছে ছাড়া ঘুমাবে না বলে বলে জেদ খাটিয়ে, কান্নাকাটি, লাফালাফি, ঝাপাঝাপি, ভাঙাভাঙি করে আনাবিয়া অস্থির করে ফেলেছিলো মীর কে। শেষ মেশ অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে, ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েটিকে ওখানে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে ও।
কিন্তু কামরা আলাদা করতে সক্ষম হলেও নিজের থেকে আলাদা করতে সক্ষম হয়নি। রোজ রাতে ঘুম ভেঙে ও দেখবে আনাবিয়া ওর বিছানায়, ওর বুকের ওপর উঠে ঘুমিয়ে আছে!
কত চেষ্টা করেছে মেয়েটার এই অভ্যাস পরিবর্তন করার কিন্তু পেরে দেয়নি। ধমক দিতেও ওর মন সায় দেয় না, বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা করে উঠে।
এইটুকুনি একটা আদুরে মেয়ে, যার ভেতরে পৃথিবীর সমস্ত মায়া ঢেলে দিয়েছে সৃষ্টিকর্তা, তাকে কি করে ধমক দেওয়া যায় ওর মাথায় আসে না। সামান্য কন্ঠ উঁচিয়ে কথা বল্লেও যে মেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে তাকে ধমক দিলে তো বন্যা বইয়ে দিবে!
কিন্তু আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে। এই অভ্যাস থেকে গেলে অসুবিধা, ভীষণ অসুবিধা।
মীর চটপট ওর বুকের ওপর ঘুমিয়ে থাকা আনাবিয়ার নরম চোয়ালের ওপর মৃদু চাপড় দিতে দিতে গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে উঠলো,
“শিনু! শিনজো! উঠো, এখনি উঠো।”
মীরের ডাকে কাঁচা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো আনাবিয়ার। বুকের ওপর থেকেই ও চোখ না মেলে ভ্রু জোড়া বিরক্তিতে কিঞ্চিৎ কুচকে নিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় উত্তর করলো,
“উফ! ডাকছো কেন?”
মীর ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই নিজের বুকের ওপর সোজা করে বসিয়ে দিলো ওকে। ঘুমের ঘোরে শোয়া থেকে হঠাৎ উঠিয়ে বসিয়ে দেওয়ায় আনাবিয়া থতমত খেলো, অতঃপর চোখ পাকিয়ে তাকালো মীরের দিকে, তাকাতেই ওর চোখে পড়লো মীরের কঠিন মুখোশ্রি। স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়ানো চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে আবছা অন্ধকারে!
“শিনু, তোমাকে না একদিন বলেছি যে তুমি আমার কামরায় এসে ঘুমোবে না!”
মীরের কন্ঠস্বর গম্ভীর। সারাক্ষণ আদুরে কথা বলা মীরের মুখে এমন স্বর শুনে অভিমানে ঠোঁট ফোলালো আনাবিয়া। কিন্তু ওর ঠোঁট ফোলানোতে গলল না মীর। আগের থেকেও কড়া গলায় বলে উঠলো,
“তুমি কথা শোনো না কেন শিনু? তুমি একজন দেমিয়ান শেহজাদী। শেহজাদীরা খুবই নম্র ভদ্র হয়, বড়দের কথা শোনে, অবাধ্যতা করে না, জেদ খাটায় না, রাগারাগি করে না। তুমি করো কেন? তোমাকে বার বার মানা করার পরেও তুমি একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটাও, এমন কাজ কি কোনো শেহজাদীকে মানায়? বলো! ওস্তাদজীর থেকে কি শিখছো তুমি? তাকে রেখে বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে বলে তো আমার মনে হচ্ছে না। আমি কি তাকে বরখাস্ত করে নতুন কাউকে নিয়োগ করবো?”
আনাবিয়া আনত মুখে তাকিয়ে রইলো মীরের বুকের মাঝখানটায়। মীরের এমন শক্ত কন্ঠে ওর চোখ ফেটে পানি এলো, টুপ টুপ করে দুফোটা পানি পড়লো মীরের বুকের ওপর।
মীর আহত দৃষ্টিতে তাকালো, কি করবে ও এই পুচকে, অবুঝ মেয়েটাকে নিয়ে! একে ধমকাতে গেলে ওর বুক কাঁপে, এর চোখ থেকে এক ফোটা পানি পড়লে সেটা ওর বক্ষভেদ করে যায়!
কিন্তু দিনে দিনে যে মেয়েটা অবাধ্য হয়ে উঠছে! সারাটাক্ষন মীরের কাছে থাকতে চায়, অন্য কাউকে নিজের গায়ে হাত লাগাতে দেয় না! বেলিন্ডা নামক মেয়েটা ছিলো বলে বাঁচা, নইলে মীরের সারাটাক্ষণ যেতো এই মেয়ের পেছনে।
আনাবিয়ার চোখের পানিতে মীর গলে গেলেও সেটা আনাবিয়া কে ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে দিলো না, মুখের কঠিন ভাবটা বজায় রাখলো। তারপর আগের মতোই শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“এখনি তোমার কামরায় যাও শিনু! আমার অনুমতি ছাড়া আর কখনো আমার কামরায় আসবে না।”
আনাবিয়া এতক্ষণ শক্ত হয়ে বসে ছিলো। মীরের এহেন কঠিন কথাতে ঘুম উড়ে গেছে ওর, কান দিয়ে যেন ধোঁয়া উঠছে; রাগে, উত্তেজনায়!
আর এক মুহুর্তও দেরি করলো না ও। ক্ষীপ্র গতিতে মীরের বুকের ওপর থেকে নেমে, বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে এক প্রকার ছুটে চলে গেলো ও নিজের কামরায়, গিয়েই দরজা লাগিয়ে দিলো ধাম করে।
মীর মাথা উচিয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়েছিলো। ও চলে যেতেই মাথাটা আবার বালিশের ওপর ছেড়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও।
কিভাবে যে কি করবে ও বুঝতে পারে না। হাজার হলেও দেমিয়ান ব্লাড, রন্ধ্রে রন্ধ্রে তেজ। তারওপর ছোট বাচ্চাদের কিভাবে সামলাতে হয় মীর জানে না, এমন অবস্থায় কখনো পড়েনি ও কোনোদিন! সালিম টা বেঁচে থাকলে কি আর এমন হতো!
অবশ্য সালিম বেঁচে থাকলে আনাবিয়া হয়তো আর মীরের হতো না, প্রাসাদের অন্য কোণায় বাবা চাচাদের প্রচন্ড আদরে সিক্ত হতো সে প্রতিমুহূর্তে। মীর হয়তো যেত কখনো সখনো, সালিমের হীরকখন্ডের ন্যায় সুন্দরী মেয়েটাকে দেখতে।
সালিমের মেয়ে হওয়ায় আনাবিয়াকে সেও মেয়ে রূপেই দেখতো! কেমন হতো তাহলে তখন? তখন কি আনাবিয়াকে দেখা মাত্রই তার বুকের ভেতরে অজানা শান্তি অনুভূত হতো? প্রচন্ড সুখে বুক জুড়িয়ে যেতো? যেতো না হয়তো!
এই আনাবিয়া তো ওর স্ত্রী! লাইফ ট্রি আনাবিয়া কে ওর সাথে জুড়ে দেওয়ার পর থেকে আনাবিয়া কে স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো ভাবে কখনো দেখা সম্ভব হয়নি ওর পক্ষে। মেয়েটা বাচ্চা এখনো, তবুও তার প্রতি ওর এক আকাশ সমান ভালোবাসা; মুগ্ধ প্রেমিকের নিখাদ ভালোবাসা!
রাত এখন অনেক। সারাদিনের ব্যাস্ততা শেষে রয়্যাল মিটিং রুম থেকে এই মাত্র ফিরলো মীর। আজ পঞ্চদ্বীপের সমস্ত কন্ট্রোলার আর অন্যান্য পারিষদ দের নিয়ে একটা লম্বা মিটিং করেছে দিনভর। সাম্রাজ্যের নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে করতে মধ্যরাত পার হয়ে গেছে কখন! মৃদু ঘামে ভিজে উঠেছে ওর শরীর।
কামরায় এসেই ত্রস্ত ভঙ্গিতে নিজের পোশাক খুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো মীর। তখনি পাশের কামরার দরজাটা ঠেলে, মেঝেতে সুমধুর, মৃদু ঝঙ্কার তুলে মীরের কামরায় এসে উপস্থিত হলো কেউ। শরীরের উর্ধাংশ অনাবৃত মীর পাশ থেকে একটা রোব খুঁজে গায়ে জড়িয়ে নিলো দ্রুত। তারপর পেছন ফিরে তাকালো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা আনাবিয়ার দিকে।
সেদিন বকা দেওয়ার পর মাস দুই পার হয়ে গেছে৷ কিন্তু এখনো পর্যন্ত আনাবিয়া তার কামরায় আসেনি, দিনেও না, আর রাতে তো নয়ই! গত দুমাসটা ধরে আনাবিয়া তার সাথে ভালো করে কথাও বলেনি৷ মীর হাজার বার চেষ্টা করেও আনাবিয়াকে তার সাথে একটু স্বাভাবিক ভাবে কথা বলাতে পারেনি৷
এই কদিন আনাবিয়া মীরের হাতে খায়ওনি, কিছুই করেনি, সমস্তটাই বেলিন্ডা করেছে। মীর কে নিজের কাছেই ঘেঁষতে দেয়নি৷ এত্ত অভিমান হয়েছে তার!
মীর তাকাতেই আনত দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা আনাবিয়া শুধালো,
“বর কি জিনিস, তুমি জানো?”
কোনো সম্বোধন ছাড়াই, মীরের চোখের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্নটা করলো আনাবিয়া। মীর লক্ষ্য করেছে এসব, সেদিনের পর থেকে আনাবিয়া ওর নাম ধরে ডাকে না, ওর দিকে তাকায় না, বিশেষ করে ওর চোখের দিকে।
শক্তপোক্ত অভিমান ধরে রাখতে চোখের দিকে না তাকানো হয়তো বাধ্যতামূলক!
আনাবিয়ার প্রশ্নে ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুচকে ফেললো মীর, তারপর ওর দিকে হাত বাড়িয়ে নিজের কাছে ডেকে নরম কন্ঠে বলল,
“এদিকে আসো শিনু, বসে কথা বলো আমার সাথে একটু।”
আনাবিয়া কিছুক্ষণ ভাবলো৷
সামনে দাঁড়ানো এই দীর্ঘকায় লোকটার সাথে তার আড়ি, প্রচন্ড আড়ি। ওর কাছে গিয়ে আনাবিয়া বসবে না, একদম বসবে না!
সেদিন ওকে বকলো কেন এমন? আর কখনোই মীরির কাছে ঘুমাতে চাইবে না ও। তাই যা হবার হবে! মনস্টার আসলেও ও আর মীরির কাছে আসবে না ও, পারলে মনস্টারের সাথেই চলে যাবে কোথাও।
আনাবিয়া কে তখনও চুপচাপ মাথা নিচু করে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মীর এগিয়ে এসে হাটু ভেঙে বসে পড়লো ওর সামনে,
” তুমি আমাকে আর নাম ধরে ডাকো না কেন শিনু?”
“ওস্তাদজী বলেছেন বড়দের নাম ধরে ডাকতে হয় না”
মেঝের দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝের ওপর অদৃশ্য আঁকিবুঁকি করতে করতে উত্তর করলো আনাবিয়া। মীর ওর দিকে সামান্য ঝুঁকে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
“সেটা তো উনি অনেক আগেই বলেছিলেন, তারপরও তো তুমি আমার নাম ধরে ডাকতে শিনু। তাহলে এখন কি হলো?”
আনাবিয়া এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। মেঝের দিকেই তাকিয়ে রইলো। মনে মনে সে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ, মীরির চোখের দিকে সে তাকাবে না৷ মীরির নাম ধরেও আর ডাকবেনা!
মীর ওর অভিমানে ফুলে ওঠা গাল দুটোর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট জোড়া মিষ্টি হাসিতে প্রসারিত করলো। তারপর বলল,
“তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকবে শিনু! আমি আমার নাম টা তোমার মুখে শুনতে চাই, বার বার৷ পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ পরিচয়ের ভেতরে নিজের নাম টা আমি হারিয়ে ফেলতে চাইনা। আমি চাই তুমি আমাকে ডাকো, সারাক্ষণ ডাকো, যত ইচ্ছা ডাকো! বুঝেছো?”
আনাবিয়া ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো যে সে বুঝেছে, কিন্তু ভুলেও মীরের দিকে তাকালো না৷
মীর এবার স্নিগ্ধ হেসে হাত বাড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিতে গেলো ওকে৷ কিন্তু মীর হাত বাড়াতেই দুকদম পেছন দিকে সরে গেলো আনাবিয়া। তারপর মেঝের দিকে তাকিয়েই তেজি গলায় বলে উঠলো,
“আমাকে ধরবে না, যা জিজ্ঞেস করেছি তাই বলো”
“কাছে না এলে আমিও উত্তর দেবো না। আসো, আমাকে জড়িয়ে ধরো, তারপর বলব।”
দু হাত দুদিকে মেলে দিয়ে ঠোঁট জোড়ায় ফিচেল হাসি ফুটিয়ে বলল মীর।
আনাবিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে হাত কচলিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। উত্তর টা জানা তার খুব দরকার! কিন্তু এই মীরির বাচ্চাটা ওর সাথে কাহিনী করা শুরু করেছে।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মীরের দিকে এগিয়ে এলো আনাবিয়া, ওর নিঃশ্বাস ফেলার এমন নাটকীয় ভঙ্গি দেখে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো মীর।
আনাবিয়া এগিয়ে এসে মীরের থেকে কিছুটা দুরত্ব রেখে মীরের গলা জড়িয়ে ধরে দাড়ালো, তারপর বলল,
“জড়িয়ে ধরেছি, এবার বলো”
“এটা কেমন জড়িয়ে ধরা শিনু, ভালো করে জড়িয়ে ধরো। নইলে কিন্তু বলবো না।”
আনাবিয়া হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো মীরের দিকে। তারপর আর একটু কাছাকাছি এসে শুধালো,
“এবার হয়েছে?”
“উহু, পছন্দ হলোনা”
আনাবিয়ার দিকে হাসি মাখা চোখে তাকিয়ে, দুদিকে মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো মীর। আনবিয়া এবার এগিয়ে এসে মীরের বুকের সাথে মিশে গিয়ে ছোট্ট ছোট্ট হাত জোড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মীর কে।
ও জড়িয়ে ধরতেই মীর দুহাতে ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা।
কত্তগুলো দিন পর, কত্তগুলো অভিমানমুখোর দিনের পর ওর শিনুকে ও একটু জড়িয়ে ধরতে পারলো! অশান্ত বুক টা নিশুতি রাতের ন্যায় শান্ত হয়ে এলো ওর।
আরও কিছুক্ষণ আনাবিয়া কে নিজের সাথে মিশিয়ে রেখে আদুরে গলায় ও বলে উঠলো,
“উম, এবার হয়েছে। এখন বলো, কে কি বলেছে তোমাকে বরের কথা?”
মীরের গলা জড়িয়ে, ওর কাধের ওপর নিজের ছোট্ট মুখ খানাকে বিশ্রাম দিয়ে দাঁড়িয়ে অ্যানা মৃদুস্বরে উত্তর করলো,
“বেলিন্ডা বলেছে। বলেছে তুমি নাকি আমার বর! বর কি জিনিস ওকে জিজ্ঞেস করলে ও বলল তোমার থেকে শুনতে।”
মীর এক হাতে আনাবিয়াকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে আনাবিয়ার দীর্ঘ শুভ্র কেশগুচ্ছের এক গোছাকে নিজের তর্জনী তে জড়াতে জড়াতে বলে উঠলো,
“বর মানে হলো স্বামী, যাকে তুমি বিয়ে করবে, নিজেকে লিখে দিবে যার নামে। যে হবে তোমার জীবনের একমাত্র সঙ্গী, ভালোবাসার মানুষ। সুখ-দুঃখে সারাজীবন পাশে থাকবে এমন একজন।
বর শুধুমাত্র একজন সঙ্গীই নয়, বর হলো সেই আশ্রয়; যেখানে ভাঙা মন, অশ্রু, আর সব গোপন স্বপ্ন একত্রে জড়িয়ে থাকে।
বর হলো সেই ব্যাক্তি যার সাথে তুমি তোমার সবকিছু ভাগ করে নিবে; সেই মানুষটা, যার স্পর্শে থেমে যাবে তোমার হৃদয়ের সমস্ত ঝড়!
বর, এক আকাশের নীচে অবিরাম বয়ে চলা স্নিগ্ধ নদীর মতো, যার স্পর্শে ভেসে যাবে তোমার জীবনের ক্লান্তি, যার ভালোবাসার প্রতিটি স্পর্শে মিশে থাকবে সন্ধ্যার নরম স্নিগ্ধ আলো।
বর মানে সেই একজন, যার হাত ধরা মানেই নিরাপত্তার এক অনন্ত আশ্রয়। যার চোখের দিকে তাকিয়ে তুমি বুঝে যাবে যে ভালোবাসা কেবলমাত্র একটা অনুভূতি নয়, বরং এক অভয়ারণ্য, যেখানে সব দুঃখ হারিয়ে যায়।
বর মানে সেই মানুষ, যার পাশে বসলে তোমার মনে হবে —এই পৃথিবীর সব ঝড়, সব বাঁধা, সব কষ্ট কেবল একটা মুহূর্তের ব্যাপার, কারণ তার ভালোবাসার জোয়ারে সব বাধা ধুয়ে যায়।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বর নামক ব্যাক্তিটার পাশে থাকা তোমার জন্য হবে এক প্রশান্তির ছোঁয়া। তার প্রতিটি স্পর্শ তোমার বুকে এক ভালোবাসার স্পন্দন তুলবে, যেখানে কষ্টের কোনো স্থান নেই, এক বিন্দু পরিমাণ ও না!
বুঝেছো?”
আনাবিয়া মনোযোগ দিয়ে মীরের কথা শুনছিলো। সে কতখানি বুঝেছে সেটা বোঝা গেলো না। মীরের বলা শক্ত শক্ত কথা ওর মাথায় ঢোকেনি, যেটুকু আবছা ঢুকেছে তাতে ওকে সন্তুষ্ট মনে হলো না৷ মীরের কাধের ওপর থেকে মাথা তুলে মীরের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও শুধালো,
“তোমার বর আছে?”
আনাবিয়ার প্রশ্নে মীর চাপা হেসে জবাব দিলো,
“আমার বর নেই, ছেলেদের বর থাকে না, বর থাকে মেয়েদের। ছেলেদের থাকে বউ। আমারও একটা বউ আছে, ভীষণ মিষ্টি! আর তাকে আমি প্রচন্ড, প্রচন্ড, প্রচন্ডরকম ভালোবাসি।”
আনাবিয়ার নাকের সাথে নিজের নাক ঘষে দিয়ে বলল মীর৷ কিন্তু মীরের উত্তর শোনা মাত্রই অ্যানার ঠোঁটে এতক্ষণ খেলে চলা নরম হাসিটা মুহুর্তেই মিলিয়ে গেলো। সেখানে এসে ভর করলো এক অদ্ভুত তেজ। চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠলো তীক্ষ্ণ।
মীরির বউ আছে মানে কি? মীরি তো ওকে কখনো বলেনি যে ওর বউ আছে? তাকে আবার ভালোওবাসে, সেটাও নাকি আবার প্রচন্ড! তবে কি ওর থেকেও বেশি? মীরি কি সেই বউ নামক বেডিরে ওর থেকেও বেশি ভালোবাসে? তাই যদি হয় তাহলে তো ও মীরির কাছে আর কোনোদিনও আসবে না! থাকুকগা ও ওর বউ নিয়ে!
আনাবিয়ার চেহারার এমন হঠাৎ পরিবর্তন দেখে হো হো শব্দ করে হেসে উঠলো মীর।
এত্ত জেলাস, এত্ত জেলাস! এইটুকুনি মেয়ে, তার শিরায় শিরায় জেলাসি!
ক্ষিপ্র গতিতে আনাবিয়া কে দুহাতে জড়িয়ে নিজের সাথে পুরোপুরি মিশিয়ে নিয়ে হেসে বলে উঠলো,
“আর নাক ফোলাতে হবে না প্রাণ আমার! আমার সে ভীষণ মিষ্টি বউটা এখন আমার বুকেই মিশে আছে, আর আমি শুধু তাকেই ভালোবাসি, আর কাউকে না। এক্কেবারেই কাউকে না।”
নিজের কামরার বিছানার পার্শ্ব ঘেঁষে থাকা চেয়ার টেবিলে বসে একমনে বই পড়ছে আনাবিয়া। ছোট্ট ছোট্ট হাতে প্রাসাদের ওস্তাদজীর দেওয়া হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করছে ও মনোযোগ দিয়ে। সফেদ রেশমের ন্যায় চুল গুলো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। পরণে একটা ছোট খাটো ফ্রক। মুখখানা ওর থমথমে। কোনো কারণে ভয়ানক রেগে আছে ও।
এমন সময় নক পড়লো ওর কামরার দরজায়৷ নক পড়া দরজার দিকে তাকালো আনাবিয়া একবার। ওর কামরার দরজা দুইটা। একটা দরজা বাইরের দিকে, অন্যটা মীরের কামরার সাথে সংযুক্ত। এখন নক পড়লো মীরের কামরার ওপাশ থেকে।
আনাবিয়া উঠে গিয়ে গায়ে একটা রোব জড়িয়ে নিলো, ঢেকে দিলো নিজের শরীরের অনাবৃত অংশ গুলো।
মীরের কড়া নির্দেশ, কোনোভাবেই যেন কারো সামনে ও ফ্রক ট্রক পড়ে বেরিয়ে না যায়। বেলিন্ডা বা মীরের সামনেও না৷
ও বুঝেনা মীরের এমন নির্দেশের কি কারণ! এসব রোব ফোব পরতে ওর ভালো লাগে না। ও আগের মতো ফ্লাপি ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াবে সমস্ত প্রাসাদে, কিন্তু তা আর হচ্ছে কই! মাস কয়েক আগে, ওর দশ তম জন্মদিনেই মীর বলে দিয়েছে, যেন ও কোনোভাবেই রোব ছাড়া বাইরে না বের হয়, কামরায় যা ইচ্ছা পরে থাকুক!
যদিও বেলিন্ডা ওকে বলেছে এরকমই নিয়ম। মীর ওর ভালোর জন্যই এমন নির্দেশ দিয়েছে। নিজেকে অন্যদের নজর থেকে আড়াল করে রাখাটাই নাকি ভালো।
বেলিন্ডার মতে আনাবিয়া আগ্নেয়গিরির ন্যায় ঝলসানো, ধ্বংসাত্মক রূপের অধিকারী। পরিণত বয়সে যেতে যেতে নাকি সে বিবর্ণ, খরাগ্রস্ত ভূমীতে ফুটে থাকা একটি রক্তিম গোলাপের ন্যায় আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, যাকে সবাই ছুয়ে দিতে চাইবে, নিজের করে পেতে চাইবে। তাই মীরের এত সতর্কতা, যেন কোনোভাবেই, কেউই তার আনাবিয়ার ওই বেড়ে উঠতে থাকা সর্পিল সৌন্দর্য উপভোগ করতে না পারে!
আনাবিয়া গিয়ে দরজা খুলে দিলো। তারপর আবার এসে বসলো নিজের জায়গায়। ও জানে মীর কেন এসেছে। এতক্ষণের শান্ত হতে থাকা রাগ টা আবার তরতর করে বেড়ে উঠতে চাইছে ওর।
দীর্ঘকায় মীর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, তারপর ভারী ভারী পা ফেলে এসে বসলো আনাবিয়ার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি ঝিনুকের খোলসের ন্যায় আকৃতির বিশাল বিছানার ওপর।
আনাবিয়ার দৃষ্টি নিবদ্ধ রইলো বইয়ের পাতার ওপর, চোখ মুখ শক্ত।
মীর গভীর দৃষ্টিতে তাকালো আনাবিয়ার দিকে। ভয়ানক রকম রেগে আছে ওর শিনু।
মীর আনাবিয়ার দিকে কিছুটা ঝুকে নরম গলায় শুধালো,
“কি হয়েছে শিনু, খুলে বলো আমাকে।”
“ও আমাকে স্পর্শ করলো কেন? ও জানেনা আমি স্পর্শ করা পছন্দ করিনা?”
দাঁতে দাঁত পিষে উত্তর করলো আনাবিয়া। মীর আনাবিয়ার পিঠময় ছড়িয়ে থাকা শুভ্র, রেশমসম কেশগুচ্ছের এক গোছাকে নিজের তর্জনিতে পেচাতে পেচাতে বলে উঠলো,
” হ্যাঁ, ও জানে। কিন্তু আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু তাই বলে তুমি তাকে ছাদ থেকে ফেলে দেবে? এটা অমানবিক হয়ে গেলো না!”
মীর বেলিন্ডাকে হাজার বার সতর্ক করে দিয়েছে আনাবিয়ার ব্যাপারে, যেন কেউ আনাবিয়ার ধারে কাছেও না ঘেঁষে।
ও কারো স্পর্শ সহ্য করতে পারে না। ও বিরক্ত হয় প্রচন্ড। সেই বাচ্চাবেলা থেকেই ওর এই স্বভাব!
বেলিন্ডাকে তবুও একটু নিজের কাজ গুলো করে দিতে দেয়, ওকে স্পর্শ করতে দেয়।
কিন্তু বেলিন্ডার স্পর্শও যে আনাবিয়া খুব পছন্দ করে তা নয়, একপ্রকার বাধ্য হয়ে।
মীর তো আর সারাক্ষণ থাকে না ওর কাছে!
কিন্তু এত সতর্কতার পরও ওই দাসীটা কিভাবে যে আনাবিয়া কে কোলে তুলতে গেলো সেটা মাথায় আসলো না মীরের!
আনাবিয়াটাও দিনে দিনে প্রচন্ড ভায়োলেন্ট হয়ে যাচ্ছে। রাগ, জেদ সবকিছুই চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে ওর দিনকেদিন!
ছোট্ট, গোলগাল, তুলতুলে, তুষারশুভ্র আনাবিয়া কে দেখে একটু ছুয়ে দেওয়ার, কোলে তুলে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারে না কেউ, যার কারণে মীর ওকে এখন আর হেরেমের দিকে যেতে দেয়না৷
মেয়েরা ওকে পেলে ধরতে চায় ওকে বারবার। ওর আদুরে, ফোলা গাল দুটো চেপে দিতে চায়। আর আনাবিয়া এসব একদমই পছন্দ করে না।
মীর নিজেও চায়না ওর শিনজো কে কেউ স্পর্শ করুক, তাই সে যে-ই হোক না কেন?
আনাবিয়া জন্মেছেই নিজের চার্ম নিয়ে, ওকে সকলে ছুয়ে দিতে চাইবে, আদর করে দিতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক, অত্যান্ত স্বাভাবিক।
মীরের নিজেরও ইচ্ছা করে এই আদুরে, ফোলা গালের আনাবিয়া কে বুকের ভেতর নিয়ে আদরে আদরে পিষে ফেলতে, কিন্তু পারেনা। আনাবিয়া যে বড় হয়ে গেছে এখন! এখন যে ওকে ওইভাবে, একান্ত নিজের ভেবে আর ছোয়া যাবে না! ওকে বুকের সাথে চেপে নিয়ে আর দলাই মলাই করা যাবে না!
তবুও নিজের মনের তীব্র বাসনাকে সামান্য স্বস্তি দিতে আনাবিয়ার শুভ্র কেশ গুলোই ওর শেষ ভরসা। সুযোগ পেলেই সেগুলোকে নিজের হাতের আঙুল গুলতে জড়াতে ভোলে না ও! সেটাই যেন একটা মস্ত স্বান্তনা ওর কাছে!
মীরের প্রশ্নের উত্তরে আনাবিয়া কিছুই না বলে যখন বই এর দিকে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ, তখন মীর আবার বলে উঠলো,
“এমন আর কখনো কোরোনা শিনু। আমি ওদের কে আবারও মানা করে দিবো যেন কেউ তোমাকে আর কখনো স্পর্শ না করে। তবে তুমি নিজের রাগকে একটু নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করো শিনু! তুমি একজন শেহজাদী, শেহজাদী দের এত রাগী হলে চলে বলো! শেহজাদীদেরকে উদার মনের হতে হয়, ক্ষমা করার প্রবণতা থাকতে হয়। বুঝেছো?”
“তাই বলে আমার যেটা পছন্দ না সেটা ওরা কেন করবে বারবার? আমি তোমার স্পর্শ ছাড়া আর কারো হুটহাট স্পর্শ পছন্দ করিনা ওরা কি জানে না? জেনে শুনেই যখন স্পর্শ করেছে তখন যা হয়েছে ঠিক হয়েছে।”
মীরের দিকে ফিরে চরম বিরক্তি নিয়ে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল আনাবিয়া৷ আনাবিয়ার এমন আচরণ দেখে ক্ষুণ্ণ হলো মীর। হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে যেতে বলল,
“এসব ঠিক না শিনু, কাউকে শাস্তি দিতে হলে তার একটা শক্তপোক্ত কারণের প্রয়োজন হয়। কাউকে তার প্রাপ্যের অতিরিক্ত কোনো কিছু দেওয়া উচিত নয়। সেটা ভালোর জন্যে হোক বা খারাপ। যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে ততটুকুই দিতে হয়। নইলে নাইনসাফি হয়ে যায়, যেটা আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তা’য়ালা পছন্দ করেন না৷
যাই হোক, আমি বেলিন্ডাকে বলছি তোমার রাতের খাবার নিয়ে আসতে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো দ্রুত।”
“আমি তোমার হাতে খাবো।”
বইয়ের ভেতর মুখ গুজে মৃদুস্বরে বলে উঠলো আনাবিয়া। কিন্তু কথা টা বলেই চোখ খিচে পড়ে রইলো মীরের থেকে একটা না’ শোনার জন্য।
ও আজ যা করেছে তাতে মীর ওর ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। ওপরে ওপরে মীর সেটা না বোঝালেও আনাবিয়া ঠিকই বুঝতে পারছে!
কিন্তু ওরই বা কি করার ছিলো! ও তো বেলিন্ডার সাথে ছাদে গেছিলো একটু ঘুরতে, আর ওই মেয়েটা এসে ওকে হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরলো।
রাগ সামলাতে না পেরে এক ধাক্কায় মেয়েটাকে ছাদ থেকে ফেলে দিলো ও।
কাজ টা ঠিক হয়নি, আসলেই। কিন্তু রেগে গেলে ওর আর হুস থাকে না!
মেয়েটাকে ও বকতে পারতো, প্রাসাদের বেইজমেন্টের প্রিজনে পাঠিয়ে দিতে পারতো! কিন্তু সেটা না করে ও মেয়েটাকে ফেলে দিলো।
কিন্তু এটা নিয়ে এখন আফসোস করে তো আর কোনো লাভ নেই!
আনাবিয়া বইয়ের থেকে মুখটা তুলে সামান্য উঁচু করে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মীরের দিকে এলোমেলো, কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপরাধীর সুরে বলে উঠলো,
“সর্যি, এরকম আর কখনো হবে না! তুমিও ওদের কে বলে দিও, যেন আমাকে একদমই স্পর্শ না করে। এখন আমাকে তোমার হাতে করে খাইয়ে দাও! প্লিজ মীরি!”
মীর আনাবিয়ার এমন সহজ স্বীকারোক্তিতে মিষ্টি করে হাসলো। অন্তত স্বীকার তো করে নিয়েছে যে ও অপরাধ করেছে, এমন টা করা ওর উচিত হয়নি! এটুকু বোধ শক্তি হলেই হচ্ছে।
মীর আবার ফিরে এলো দরজার নিকট থেকে, তারপর ওর ডান গাল টা দু আঙুলের ভেতর নিয়ে নাড়িয়ে আদর কিরে দিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,
“ঠিক আছে, এমন টা আর কখনো কোরোনা শিনু, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো। তোমাকে সবাই প্রচন্ড ভালোবাসে তাই এমন টা করে। তোমাকে কোলে নিতে চায়, আদর করতে চায়! তবে আমি এবার বেলিন্ডা ছাড়া অন্য কাউকে তোমার আশেপাশে ঘেঁষতেও নিষেধ করে দেবো, হবে?”
আনাবিয়ার চোখ জোড়া ঝিলিক দিয়ে উঠলো খুশিতে, মীরি যে ওর ওপর রাগ করেনি এতেই ও খুশি। সবেগে মাথা নাড়িয়ে ও সম্মতি জানালো মীরের কথায়।
“এখন চলো, নোমান খাবার নিয়ে আসবে এখনি। তোমার পছন্দের বাটার চিকেন করা হয়েছে। খেয়েই ঘুমোবে, আর একটুও দেরি করবে না। ঠিক আছে?”
আনাবিয়ার দিকে ঝুকে, চোখের তারায় ঝলক ফুটিয়ে কথা গুলো বলল মীর। আনাবিয়া উচ্ছল হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো মীরের গলা, তারপর আদুরে গলায় আবদার করলো,
“কোলে নাও!”
“ইয়েস ম্যাম!”
বলে আনবিয়া কে কোলে তুলে নিলো মীর। তারপর ওর মাথার সাথে নিজের মাথা ঘষে, সুড়সুড়ি দিয়ে নিয়ে চলল ওকে নিজের কামরায়।
