বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩+২৪

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩+২৪
রানী আমিনা

প্রাসাদে নিজের কামরায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বিছানার ওপর বসে আছে আনাবিয়া, হাতে ওর ফোন। ওর উন্মুক্ত তলপেটের ওপর মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে মীর, চোখ জোড়া ওর বন্ধ৷
ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের গ্রুপে কল করছে ও। ইম্পেরিয়ালের ইভেন্টটা নিয়ে অন্যদের সাথে কথা বলা দরকার৷ ইতোমধ্যে ইভেন্টের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়ে গেছে, ইভেন্টের জন্য বাজেটও দিয়ে দিয়েছে মীর, কিন্তু বাজেটের টাকাটা যে মীরই দিয়েছে সেটা এখনো জানানো হয়নি ওদের কাউকে, সময় পায়নি আনাবিয়া।
ফোনটা সামনে রেখে আনাবিয়া ওর পেটের ওপর শুয়ে থাকা মীরের মাথায় একটা চাটি মেরে বলল,

“আমি কথা বলবো এখন, তুমি একটু এখান থেকে উঠোনা!”
মীর তড়িতে মাথা নেড়ে না বুঝিয়ে আরও শক্ত করে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে পড়ে রইলো।
ফোস করে হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়লো আনাবিয়া। ও যদি আগে জানতো যে শালার বেডা বাসর রাতের পর থেকে ওর সাথে এভাবে চব্বিশ ঘন্টা চিপকে থাকতে চাইবে তাহলে ও কোনোমতেই ওইদিন বাসর করতে দিতোনা, কি এক যন্ত্রণা!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে একে একে গ্রুপ কলে জয়েন হলো আরিশ, ব্যারন সহ অন্যরা৷
আনাবিয়াকে দেখতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো ওদের। এক্সামের পর থেকে আনাবিয়াকে কেউ আর দেখেনি, এক্সামের সময়েও আনাবিয়াকে দেখার সুযোগ পায়নি ওরা। দুম করে এসে পরীক্ষা দিয়ে দুম করে আবার ইম্পেরিয়াল থেকে বেরিয়ে গেছে সে৷
যত আয়োজন করার সব এখন ওরাই করছে, আর আনাবিয়া শুধু প্রাসাদে বসে বসে তদারকি করে গেছে, এছাড়া ওর আর কিছু করার নেই। মীর ওকে কোথাও যেতেও দিবেনা।
কল রিসিভ হওয়ার পরই সানা নামের আনাবিয়ার এক মেয়ে ক্লাসমেট বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“নূর, এটা কি তোর কামরা?”

আনাবিয়া উপর নিচে মাথা নাড়ালো। সানা নামের মেয়েটার কথায় বাকিরাও এবার মনোযোগ দিলো আনাবিয়ার কামরার দিকে, সানা মেয়েটা আবারও মুগ্ধ কন্ঠে বলল,
“কি সুন্দর রে, মনে হচ্ছে যেন কোনো প্যালেসের কামরা। তোর কামরাটা আমাদের একটু ঘুরিয়ে দেখানা!”
আনবিয়া পড়লো বিপদে, ইতস্তত চোখে একবার ওর পেটে শুয়ে থাকা মীরের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ তুলে নিলো, কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“আজ না অন্যদিন, এখন আমার কোলের ভেতরে একটা বড়সড় বাঘ শুয়ে আছে, এখন উঠতে চাইলে আমাকে বিছানায় ফেলে আঁচড়ে কামড়ে উদ্ধার করে ফেলবে!”
আনাবিয়ার কথায় ব্যারন বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,
“তুমি কি বাঘও পালো নাকি নূর? অবশ্য যে মেয়ে কুমির পালতে পারে সে বাঘ পালে শুনে অবাক হওয়ার কিছুই নেই, আমি হুদাহুদি অবাক হচ্ছি!”

সানা হেসে উঠলো ওর কথায়। ওপাশ থেকে আরিশ বলে উঠলো,
“ তুমি বাঘ নিয়ে বেডরুমে এসেছো? বিছানা নষ্ট করে দেয় যদি? আর অতো বড় প্রাণি কেউ বেডরুমে নিয়ে আসে?”
আনাবিয়া বিড়বিড় করে বলল,
“বিছানা নষ্ট করেনা, বিছানায় ফেলে আমাকেই নষ্ট করে দেয়!”
ওদিকে আরিশের কথায় পাত্তা না দিয়ে সানা বলে উঠলো,
“তাহলে তোমার বাঘটাকে একটু দেখাওনা নূর!”
আনাবিয়া সেন্টি খেলো। ওর কোলের ভেতর শোয়া মীর গা কাঁপিয়ে হেসে উঠলো নিঃশব্দে, মাথা তুলে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো ও।

আনাবিয়া এক হাতে ওর মাথার চুলগুলো জোর হাতে টেনে ধরে ফোনে বলে উঠলো,
“তিনি আমার ফোনকে পছন্দ করেননা, আমার ফোনের সাথে তার বিশেষ শত্রুতা আছে। ফোনটা তার বেশি কাছাকাছি নিয়ে গেলে তিনি আবার রেগে যাবেন।
আমার বাঘ পরে দেখিস তোরা, আগে বল ইভেন্টের কাজ কতদূর?”
“সব ঠিকঠাক, ইম্পেরিয়াল সাজানো প্রায় শেষের দিকে, অতিথি দের জন্য স্টেজ করাও প্রায় কম্পলিট। কিন্তু আমাদের প্রধান অতিথি কে সেটাই তো এখনো বললেনা নূর! তার জন্য আমাদের আলাদা করে প্রস্তুতি নিতে হবে তো! উনি আমাদেরকে যে বিশাল বাজেট দিয়েছেন তাতে তাঁকে একটা বিরাট আপ্যায়ন না করলে তো ইম্পেরিয়ালের সম্মানই থাকবে না!”

বলল আরিশ।
“আমাদের প্রধান অতিথি আসলে একজন নয়, দুজন।”
বলে সেন্টি খাওয়া মুখে ঠোঁট বেকালো আনাবিয়া। আরিশ বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,
“দুজন? আচ্ছা ঠিক আছে সমস্যা নাই, প্রধান অতিথির থেকে আমরা যে বাজেট পেয়েছি তাতে দুজন কেন, দশজন প্রধান অতিথি এলেও আমাদের কোনো অসুবিধা হবেনা। প্রধান অতিথিদের জন্য আমাদের প্রস্তুতি এখনো নেওয়া হয়নি।

এখন যেহেতু তারা দুজন আসবে সে হিসাবে আমাদের আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, প্লাস ব্যানার তৈরি করতে হবে। ঝটপট নাম আর প্রফেশন বলে ফেলো নূর, আমি লিখে রাখি৷”
আরিশ নোটপ্যাড বের করে বসে রইলো। আনাবিয়া দুবার গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,
“বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান, আর তার বেগম আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান।”
আনাবিয়ার কথা কানে যেতেই সকলে একসাথে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ওরা আনাবিয়ার দিকে ।
ওরা বাদশাহ কে প্রধান অতিথি করতে চাইছিলো ঠিকই কিন্তু বাদশাহ খুব কমই প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করেন।
সেখানে ইম্পেরিয়ালের মতো একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হোক সেটা শহরের সবচেয়ে নামকরা, সেখানে যে তিনি অ্যাটেন্ড করতে সম্মতি জানাবেন সেটা ওরা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি, তার ওপর তাঁর সাথে কিনা তাঁর ওয়াইফও আসছেন, এটা তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার স্যাপার!

ওদের সবাইকে এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নূর আবার গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,
“আমি মী…… ইয়া মানে হিজ ম্যাজেস্টির অফিসিয়াল মেইলে তাঁকে ইনভিটেশন জানিয়ে মেইল পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু উনি রিপ্লাই দিয়েছিলেন যে তাঁর সাথে যদি তাঁর স্ত্রীকেও ইনভাইট না করা হয় তবে তিনি ইভেন্টে কোনোভাবেই অ্যাটেন্ড করবেন না।
তাই আমি আবার বেগমকে ইনভিটেশন মেইল সেন্ড করেছিলাম, উনি সেটা অ্যাক্সেপ্ট করলে তারপর হিজ ম্যাজেস্টি আমাদেরকে বাজেট দিয়েছেন।”

আনাবিয়ার মুখে ‘হিজ ম্যাজেস্টি’ শব্দটা শুনে মীর মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। বিছানায় কনুই ঠেকিয়ে হাতে মুখ ভর দিয়ে, মুখে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে ও শুনতে লাগলো আনাবিয়ার কথপোকথন।
এদিকে আনাবিয়ার কথা শুনে যেটুকু বিস্মিত হওয়া ওদের বাকি ছিলো সেটুকুও এবার পূর্ণ হয়ে গেলো। হতভম্ব দৃষ্টিতে ওরা তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। আরিশ অবিশ্বাস্য কন্ঠে থেমে থেমে শুধালো,
“হিজ ম্যাজেস্টিকে তুমি মেইল দিয়েছো! সেটাও তার অফিসিয়াল মেইলে? তার অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছেও নয়? আর তিনি মেইলের রিপ্লাইও করেছেন! সত্যি?”

আনাবিয়া মনে মনে কোমরে হাত দিলো, এদের সমস্যা কি? বিশ্বাস করতে চাইছেনা কেন?
আনাবিয়া ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। ওপাশ থেকে সানা সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো,
“সস দেতো দেখি, হিজ ম্যাজেস্টির রিপ্লাই সহ সস দিবি। নইলে বিশ্বাস করতেছিনা৷”
“আরে ভাই তোরা বিশ্বাস করতে চাইছিসনা কেন? নূর তো ফারিশ জাবিনের রিলেটিভ তাইনা? সে হিসাবে হিজ ম্যাজেস্টি তাকে কোনোভাবে চিনতেও পারে! তাই হয়তো নূর সরাসরি তাকেই মেইল দিয়েছে! তাইনা নূর?”
ভ্রু কুচকে বিরক্তির সুরে বলল ব্যারন। আনাবিয়া তড়িতে উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। সানা আনাবিয়ার পাঠানো স্ক্রিণশট দেখতে লাগলো মনোযোগ দিয়ে। তারপর কিছুক্ষণ চোখ লাগিয়ে রিসার্চ করে উচ্ছসিত হয়ে লাফিয়ে উঠে বলল,

“এই এটা তো সত্যিই হিজ ম্যাজেস্টির অফিসিয়াল মেইল! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা! হিজ ম্যাজেস্টি আসবেন, সাথে হার ম্যাজেস্টি, ওমাগো! আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাবো এখানেই, আমাকে কেউ বাচাঁও!”
সানার কথায় কেউ পাত্তা দিলোনা, আরিশ শুধালো,
“তুমি হিজ ম্যাজেস্টিকে কখনো বাস্তবে নিজের চোখে দেখেছো নূর?
শুনেছি সে নাকি খুব ভয়ঙ্কর দেখতে, কিন্তু আবার মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন; আমি লোকের মুখে শুনেছি।
কিন্তু সেটা ঠিক কেমন আমায়ার মাথায় আসেনা, ভয়ঙ্কর দেখতে হলে সে সুদর্শন কিভাবে হয়?”
সানা ওপাশ থেকে আরিশের কথার মাঝখানে বলে উঠলো,
“হিজ ম্যাজসেটির কথা পরে, তোমরা হার ম্যাজেস্টির কথা বলো। তিনিতো শিরো মিদোরির শেহজাদী! ওনার কি জীবন দেখো! জন্মেছেন দেমিয়ান বংশে শেহজাদী হয়ে, আর এখান সেই বংশেরই সন্তান, বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের বউ হয়ে তিনি এখন বেগম! ওয়াও!

শুনেছি তিনি নাকি প্রচন্ড পরিমাণ সুন্দরী! আমার এক আন্টি প্রাসাদে ফেব্রিক সাপ্লাইয়ের কাজ করতেন, তিনি একদিন দেখেছিলেন শেহজাদীকে, যদিও শেহজাদী তখন অনেক ছোট ছিলেন, সেটা প্রায় বছর দশ আগের কথা। কিন্তু তিনি বলেন শেহজাদীকে যখন উনি প্রথম দেখেন তখন উনি নাকি পুরো থমকে গেছিলেন!
ওনার চোখ জোড়া নাকি প্রচন্ড সুন্দর, সেখানে থেকে নাকি আলো টিকরে পড়ে! আর ওই চোখের দিকে যে তাকায় সে নাকি সম্পুর্ন শেহজাদীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়! শেহজাদী তখন তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করাতে পারে৷”
শেষোক্ত কথাটা শুনে সেন্টি খেলো আনাবিয়া, ওর নামে এমন অদ্ভুত কথাবার্তা তবে সবখানেই হয়?
আরিশ ওদের কথায় কান দিচ্ছেনা, ও তাকিয়ে আছে আনাবিয়ার দেওয়া মেইলের সস টার দিকে। মেইলটা বারকয়েক পড়ে সে বলে উঠলো,

“শোনো তোমরা সবাই, যেহেতু প্রধান অতিথি স্বয়ং হিজ ম্যাজেস্টি সেহেতু তাদের আপ্যায়নে বিন্দুমাত্র কমতি হতে দেওয়া যাবেনা৷ তাঁকে তাঁর মতোই ম্যাজেস্টিক ভাবে আমাদের আপ্যায়ন করতে হবে অবশ্যই।
আর যেহেতু তিনি তাঁর বেগমকে ছেড়ে ইভেন্টে আসতে রাজি হননি তাতে তিনি তাঁর বেগমকে কতটা শ্রদ্ধা করেন সেটা আমরা বুঝতে পারছি।
তাই হার ম্যাজেস্টির আপ্যায়ন টা আরও বেশি জোরালো হতে হবে, বেশি ভালো হতে হবে।
হার ম্যাজেস্টি যদি আমাদের আপ্যায়নে খু্‌শি হয়ে যান তবে হিজ ম্যাজেস্টিও খুশি হয়ে যাবেন। আর যদি তিনি অখুশি হন তবে হিজ ম্যাজেস্টিও অখুশি হবেন, তাই কোনো ভাবেই তাঁকে অসন্তুষ্ট হতে দেওয়া যাবেনা।
সব দিক থেকে পারফেক্ট হতে হবে, কোনো রকম ভুল ত্রুটি যেন না হয়। আর যেহেতু হিজ ম্যাজেস্টি আসবেন, তাঁর সাথে প্রচুর গার্ডও থাকবে, তাদের কথাটাও মাথায় রাখতে হবে৷”
আরিশের কথায় ব্যারন বলে উঠলো,

“তাহলে তো আমাদের উচিত কলেজ কর্তৃপক্ষকে প্রধান অতিথিদের ব্যাপারটা জানানো, নইলে শুধু আমাদের পক্ষে এত কিছু ম্যানেজ করা তো সম্ভব হবে না৷
কর্তৃপক্ষ জানলে তারা নিজেরাই বাদশাহ আর বেগমকে আপ্যায়নে আমাদেরকে সাহায্য করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। আর ইম্পেরিয়ালে হিজ ম্যাজেস্টির পদধূলি পড়া মানে ইম্পেরিয়ালের চাহিদা বেড়ে যাবে হুড় হুড় করে, এতে কর্তৃপক্ষেরই লাভ, তাইনা?”
ব্যারনের কথা শেষ হলে এবার আরিশ বলল,
“ঠিক আছে তবে, আমরা কর্তৃপক্ষকে জানাই আর বাদশাহ এবং বেগমকে আপ্যায়নের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিই।
আর নূর, তুমি ডিউ ডেটে সময় মতো চলে এসো। তুমি আমাদের ক্যাপ্টেন, তোমাকে ছাড়া কাজ গুলো এমনিতেই অগোছালো হচ্ছে। আমি তোমার মতো করে সবকিছু মেইনটেইন করতে পারছিনা। ইভেন্টের দিনে দ্রুত চলে এসো, নইলে আমাদের দিশেহারা অবস্থা হবে তখন।”
আনাবিয়া মৃদু হেসে বলল,

“ঠিক আছে আজ তবে মিটিং এ পর্যন্তই। এরপর যদি ইভেন্টের ম্যানেজমেন্টে কোনো সমস্যা হয় তবে আমাকে জানাবে। এখন তবে রাখি, ভালো থাকো তোমরা৷”
বলে কল রাখলো আনাবিয়া, ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ও একটা। মীর কনুইয়ে ভর দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
“তোমার মুখে হিজ ম্যাজেস্টি শুনতে খুব ভাল্লাগছে, আরও কয়েককবার বলোতো শুনি?”
আনাবিয়া ওর দিকে শকুনি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, মীর ওকে আবার খোচাতে থাকলো হিজ ম্যাজেস্টি বলার জন্য। অবশেষে অতিষ্ঠ হয়ে আনাবিয়া দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,

“দাঁড়াও তোমাকে আমি আমার দেওয়া নামে ডাকছি; মীরির বাচ্চা মীরি, শালার ঘরের শালা, হতচ্ছাড়া কালাভু……!
পরের নাম গুলো আর বলতে পারলোনা ও, তার আগেই এই অদ্ভুত নামকরণের শাস্তি হিসেবে ওর এক বিশাল চুম্বনের আক্রমণে আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া বন্ধ করে দিয়ে ওর ওপর এক সমুদ্র আদর নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো মীর।

ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট আজ ভীষণ সরগরম। সম্পুর্ন ইম্পেরিয়াল জুড়ে বিশাল উৎসবের আমেজ। মূল ভবনের সামনে বিছানো লাল রঙা বিরাট কার্পেট, সেখানে একের পর এক এসে থামছে বিলাসবহুল গাড়ি।
প্রত্যেক অতিথির জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে সুশৃঙ্খল অভ্যর্থনা কমিটি। তাদের সকলের পরনে ফরমাল স্যুট। বিরাট বিশাল স্টেজের সামনে টানানো বিশাল ব্যানারে বড় বড় করে লেখা, ‘ডোমিনেন্সঃ দ্যা ইন্টেলিজেন্স ওয়ারফেয়ার’।
স্বেচ্ছাসেবকরা ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে চারদিকে, থেকে থেকে মাইক টেস্টিং চলছে, ক্যামেরা সেট আপ হচ্ছে প্রতিটি কোণ থেকে।

ফুল দিয়ে সাজানো রাজপথ দিয়ে দর্শকরা ইম্পেরিয়ালে ঢুকছে অতি উৎসাহ নিয়ে। সবার মুখেই একরাশ কৌতূহল, স্বয়ং বাদশাহ আর তার বেগম আসবে শুনে মানুষের ঢল নেমেছে আজ ইম্পেরিয়ালে।
ইম্পেরিয়ালের বিশাল মাঠটায় টানানো হয়েছে রঙিন রঙিন ফেস্টুন, স্টলগুলোতে ম ম করছে খাবারের সুগন্ধ, চারপাশটা ছেয়ে গেছে আনন্দপূর্ণ চিৎকার চেচামেচিতে।
গেটের বাইরে হৈচৈ করছে অন্যান্য স্কুল কলেজ থেকে আসা স্টুডেন্টরা, ওরা ব্যস্ত সেলফি তুলতে। ইম্পেরিয়ালের মতো বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে একটা সেলফি তুলতে না পারলে যে জীবনই বৃথা!
আরিশ, ব্যারন, সানা সহ সবাই ফরমাল পোশাক পরে ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে। আয়োজনের সমস্ত ভার ওদের এপর।

নূর মেয়েটা এখনো আসেনি, বলেছে ও চলে আসবে সময় মতো, কিন্তু তার সে সময় এখনো হয়নি।
আরিশ ওর কানে থাকা ব্লুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে সানার সাথে যোগাযোগ করে জিজ্ঞেস করলো,
“সানা, নূর কি এখনো আসেনি?
“না ভাইয়া, আসলে তো জানতেই পারতেন। ও তো এসেই আমদের সাথে যোগাযোগ করতো!”
“ওর কাছে কল করো এখুনি, আসতে বলো দ্রুত।
নইলে একা একা সব ম্যানেজ করতে গিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে রীতিমতো, আমি কোনো কিছুই অর্গানাইজ করতে পারছিনা।
অনেক হেল্পিং হ্যান্ড পেয়েছি এদিকে, কিন্তু ক্যাপ্টেন না থাকলে কোনো কিছুই গোছালো হতে চায়না।”
“ঠিক আছে আমি কল করে দেখছি ও কোথায়।”
সানা ফোন হাতে নিয়ে কল করলো আনাবিয়ার কাছে, দুবার রিং হতেই ওপাশ থেলে কল রিসিভ করলো আনাবিয়া। সানা সাথে সাথে বলে উঠলো,

“কিরে নূর, কই তুই? তোর জন্য আরিশের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!”
“আমি গাড়িতে আছি সানা, পৌছে যাবো কিছুক্ষণের মধ্যেই।”
“তুই কিছুক্ষণ কিছুক্ষণ করতে করতে ওদিক থেকে হিজ ম্যাজেস্টি তাঁর বেগমকে নিয়ে ইম্পেরিয়ালে পৌঁছে যাবে দেখিস!”
“চিন্তা করিসনা সানা, হিজ ম্যাজেস্টি ইম্পেরিয়ালে ঢোকার সাথে সাথে আমিও ঢুকে যাবো, নো টেনশন। তোদের প্রস্তুতি কতদূর?”
“আমাদের প্রস্তুতি ঝাক্কাস! হিজ ম্যাজেস্টি এসে টাস্কি খাবেন শিওর, দেখিস তুই! তাঁর আর তাঁর বেগমের জন্য আমরা বয়েজ বিল্ডিং এর নিচতলার কনফারেন্স রুম সম্পুর্ন খালি করে সুন্দর করে এক্কেবারে প্রাসাদের মতো করে সাজিয়ে ফেলেছি, এক্কেবারে নো প্রবলেম।
হার ম্যাজেস্টি যেন সম্পুর্ন কম্ফোর্টেবল থাকে তার জন্য শতভাগ নিশ্চিতকরণ চলছে। হার ম্যাজেস্টি এত সুন্দর পরিবেশ দেখে খুশি না হয়ে থাকতেই পারবেনা না!”
“ঠিক আছে, তোরা প্রস্তুতি নিতে থাক। হিজ ম্যাজেস্টি খুব দ্রুতই চলে আসবেন হয়তো।
“আচ্ছা, তুই দ্রুত আয়।”

বলে কল কেটে দিলো সানা। তারপর আবার ছুটলো আরিশের দিকে, আনাবিয়ার সাথে হওয়া কথা গুলো বলতে।
আনাবিয়া কল রেখে ফোনটা রেখে দিলো ওর ঝকঝকে স্টোনের পার্সের ভেতর। নিজের গায়ের অত্যাধিক জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকের দিকে তাকালো একবার। এই প্রথমবার ও এভাবে মীরের সাথে বের হচ্ছে। সাজুগুজুও করেছে টুকটাক। মীর থেকে থেকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ওর দিকে।
হামদান ড্রাইভ করছে একমনে, আনাবিয়ায়ার মীর বসে আছে গাড়ির ব্যাকসিটে। আনাবিয়া গাড়ির দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে পা জোড়া লম্বা করে তুলে দিয়েছে ব্যাক সিটের অন্য কোণায় থাকা মীরের কোলে। কাল রাতে ভালো ঘুম না হওয়ায় এখন পায়ে ব্যাথা করছে ওর।
মীর এক হাতে আলতো করে টিপে দিচ্ছে ওর পায়ের পাতা থেকে গোড়ালির পর্যন্ত।
কিছুক্ষণ পর মীর বলে উঠলো,

“ইম্পেরিয়ালে পৌছে সারাক্ষণ আমার সাথে থাকবে, আমার নজরের বাইরে যেন তোমাকে না যেতে দেখি। ইভেন্ট ওরাই ম্যানেজ করে ফেলতে পারবে, তোমার চাপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আজ যেহেতু সকলেই জানে আমরা সেখানে যাচ্ছি তাই আজকের লোকসমাগম খুব অসুবিধার হবে। তাই ভুলেও আমার থেকে দূরে যাবেনা। ওকে?”
আনাবিয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালো, কেনযে মীরের বাচ্চা ওকে নিজের সাথে নিতে চাইলো!
আজ ও একটা অর্ডিনারি স্টুডেন্ট হিসেবে ইম্পেরিয়ালে পৌছালে অন্যদের সাথে মিলে কত মজাই না করতে পারতো!
ভাবনা বাদ দিয়ে মীরের দিকে আড়চোখে ও তাকালো একবার, তারপর গলা খাকারি দিয়ে নরম সুরে বলল,
“শুনোনা মীরি, আমি আলাদা যাই? অন্যদিনের মতো? আমি সেখানে গিয়ে ম্যানেজ না করলে কিছুই হতে চাইবে না। পরে না হয় তোমার সাথে গিয়ে যোগ দিবো!”

“না।”
সামনে তাকিয়ে এক কথায় উত্তর দিলো মীর। ওর উত্তরে হতাশ হলো আনাবিয়া!
কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে মীরের কোলের ভেতর থেকে পা গুটিয়ে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ও এগিয়ে গেলো মীরের কাছে, তারপর দুপাশে পা দিয়ে বসলো ও মীরের কোলের ওপর।
মীরের পেটের সাথে নিজের পেট বুকের সাথে বুক লাগিয়ে এক্কেবারে কাছাকাছি মিশে গিয়ে মীরের ঠোঁটের কাছে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে নরম, নেশালো গলায় বলে উঠলো,
“আমাকে আমার মতো করে আলাদা যেতে দিলে আজ রাতে তোমাকে সারারাত আদর করতে দিবো, তুমি যতক্ষণ চাইবে ততক্ষণ! একদম মানা করবো না, প্রমিজ!”

মীর নির্বিকার মুখে ওর দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
“ভালোই তো ট্রিক্স শিখছো দিনে দিনে!”
পরমুহূর্তেই আনাবিয়ার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ঠিক আছে, তোমাকে আলাদা যেতে দিবো।
তবে হ্যাঁ, আজকের রাতের পুরো সময়টা তুমি আমাকে দিবে, পালাতে পারবেনা কোনোমতেই। বিছানার নিচে পা রাখলেই খবর আছে। পালানোর চেষ্টা করলে বিছানার সাথে বেঁধে রেখে আদর করবো, মাইন্ড ইট।”
মীরের কথায় উচ্ছসিত হয়ে উঠলো আনবিয়া, ঝটপট মীরের কোল থেকে নেমে গিয়ে হামদানের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,

“হামদান, আমার ব্যাগটা কই?”
হামদান এতক্ষণ চোখ কান নাক সব বন্ধ করে ছিলো, আনাবিয়ার মুখে নিজের নাম শুনে দ্রুত পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা এগিয়ে দিলো পেছনে।
ব্যাগ দেখে মীর ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি তবে আলাদা যাবে বলে সবরকমের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলে?”
আনাবিয়া প্রতিউত্তরে মীরের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলালো। মীর ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা। আনাবিয়া বলে উঠলো,

“হামদান, গাড়ি থামাও!”
সাথে সাথেই গাড়ি থামালো হামদান। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো মীরের গাড়ির আগে পিছে এগোতে থাকা গার্ডবাহী সমস্ত গাড়িগুলো৷ মীরের গাড়ি থামতেই চারপাশ থেকে এসে গাড়িটাকে ঘিরে ধরে দাড়ালো ওরা।
রয়্যাল পাস হিসেবে শিরো মিদোরি থেকে কুরো আহমারের ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট পর্যন্ত রাস্তা সম্পুর্ন ফাঁকা। কিন্তু রাস্তায় লোকজনের অভাব নেই৷
হাজার হাজার উৎসুক জনতা রাস্তার দুপাশ ঘিরে চেপেচুপে দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ আর তার বেগমকে এক পলক দেখার জন্য৷ লোকের ভীড়ে এখন এখানে প্রচন্ডরকম বাজে অবস্থা!
হামদান গাড়ি থামিয়েই নেমে গেলো গাড়ি থেকে। হামদান বেরিয়ে যেতেই আনাবিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিলো মীর। তারপ্র নিজের হাতে একে একে খুলে দিলো আনাবিয়ার রুপোলী রঙের ঝকমকে গাউন আর সমস্ত অ্যাক্সেসরিজ।

আর তারপর পরিয়ে দিলো ইম্পেরিয়ালের ফরমাল পোশাক; সাদা রঙা ঢিলাঢালা শার্ট, নেভি ব্লু রঙা ফরমাল প্যান্ট, সাথে নেভি ব্লু টাই।
লম্বা চুলগুলো পোনিটেল করে বেধে দিলো। শার্টের বোতামগুলো ঠিকঠাক করে দিতে দিতে মীর বলল,
“ক্রিস্টিনা থাকবে তোমার সাথে সারাক্ষণ। ক্রিস্টিনাকে কোনোভাবেই নিজের থেকে সরাতে চাইবেনা, বুঝতে পেরেছো? আমি কিন্তু সব শুনবো, মনে থাকে যেন।
আর হ্যাঁ, আমার যখনই চাইবো তখনি সমস্ত কাজ ফেলে, কোনো অজুহাত ছাড়াই আমার কাছে চলে আসবে।
এমনিতেই তোমার পায়ে ব্যাথা আর আজ পরিশ্রম করলে তোমাকে আর দেখা যাবে না।”
ক্রিস্টিনা ওর সাথে থাকবে শুনে মুখ নেমে গেলো আনাবিয়ার। মুখ গোমরা করে বসে রইলো ও মীরের কোলে। ওকে চুপ মেরে যেতে দেখে মীর বলল,

“মন খারাপ করে কোনো লাভ হবেনা শিনু, ক্রিস্টিনাকে না নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ও তোমার সাথে সাথেই থাকবে সমস্ত সময়। দূরেও নয়, একদম সাথে সাথে।”
“ঠিক আছে, থাকবে। আমি আগে চলে যাচ্ছি, তুমি আরও পরে যাবে। আমি আগে ওখানটা সামলে নিই তারপর।”
বলে মুখ বেকালো আনাবিয়া। মীর ওর বেকানো ঠোঁটের ওপর ঠেসে চুমু খেলো কয়েকটা। তারপর ওকে নিজের কাছে আরও টেনে নিয়ে ওর কাঁধের ওপর থেকে শার্ট সরিয়ে শব্দ করে চুমু খেলো সেখানের ছোট্ট কাটা দাগের ওপর।
সেদিন খোলা মাঠের ভেতর বিছানায় আনাবিয়াকে কোলে নিয়ে বসে বসে আনাবিয়ার কাঁধে ও ইমপ্লান্ট করে দিয়েছে একটা ছোট্ট ট্রাকিং ডিভাইস, সেখানে দাগ হয়ে আছে সামান্য। কাধের ওপর থেকে ঠোঁট উঠিয়ে মীর আনাবিয়ার চোয়ালে নাক ঠেকিয়ে বলল,

“আ’ উইল হিয়ার এভরিথিং শিনু, স্যো বি কেয়ারফুল।”
আনাবিয়ার চোয়ালে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে মীর ছেড়ে দিলো ওকে। তখনি আনাবিয়ার জন্য গাড়ি এসে দাড়ালো ওদের গাড়ির পাশে।
মীর দরজা খুলে দিলো ওর জন্য, গার্ডবাহী গাড়ি গুলো থেকে গার্ডরা বেরিয়ে এসে লোকসমাগমের দৃষ্টি থেকে বাঁচাতে ঘিরে ধরলো আনাবিয়াকে, আর তারপর সবার নজর এড়িয়ে ওকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো ক্রিস্টিনার সাথে।

ইম্পেরিয়ালে পৌছে আনবিয়া সামনের দিকে হাটতে হাটতে কল করলো আরিশের কাছে। আরিশ ফোন উঠিয়েই ব্যাস্ত গলায় বলল,
“তুমি পৌঁছেছো নূর?”
“হ্যাঁ, কেবলই এলাম।”
“থ্যাংক গড! আমি যে কি বিপদে আছি এখানে তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা৷ দ্রুত চলে আসো, আমি বয়েজ বিল্ডিংয়ের নিচতলায় আছি।”
আনাবিয়া কল কেটে এগুলো বয়েজ বিল্ডিং এর নিচ তলার দিকে। সেখানে পৌছাতেই ওকে দেখে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এলো সানা। উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
“তোকে কি সুন্দর লাগছেরে নূর! হিজ ম্যাজেস্টি আজ তোকে দেখে তার প্রাসাদে উঠিয়ে না নিয়ে গেলেই হলো!”
আনাবিয়া সোজা হেটে কনফারেন্স রুমের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল,

“মাতালের মতো কথা বলা বন্ধ কর সানা! আমাকে নিবে কেন? ওর সাথ…. মানে হিজ ম্যাজেস্টির সাথে তাঁর বউ আসবে। তাঁর দিকে ছাড়া হিজ ম্যাজেস্টি আর অন্যকারো দিকে তাকাবেন না।”
কামরায় ঢুকে চারপাশটা ভালোভাবে দেখলো আনাবিয়া। সুন্দরই সাজিয়েছে সকলে মিলে।
আরিশ পেছন থেকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে আনাবিয়াকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলো কিছুক্ষণ। মেয়েটা এতক্ষণে এলো, নূরকে ফরমালে দেখার জন্য ওর দম বেরিয়ে যাচ্ছিলো এতক্ষণ! মুগ্ধ চোখে আনাবিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ও বলল,

“তোমাকে তো একদমই চেনা যাচ্ছেনা নূর, অন্যরকম লাগছে সম্পুর্ন!”
আনাবিয়া ওর দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি হাসলো। তারপর আবার নজর দিলো কামরার দিকে। আরিশ নিজেও একবার সাজানো কামরাটা দেখে নিয়ে আনাবিয়াকে শুধালো,
“কেমন হয়েছে নূর? হিজ ম্যাজেস্টি সন্তুষ্ট হবেনতো এতে? দেমিয়ান প্রাসাদের মতো তো কখনোই হবেনা জানি, তবুও চেষ্টা আরকি।”
“না আরিশ, ভালোই লাগছে। হিজ ম্যাজেস্টি পছন্দ করবেন আশা করি।”
তখনি বাইরে থেকে শোনা গেলো ব্যারনের কন্ঠস্বর। উচ্চস্বরে সে এদের উদ্দ্যেশ্যে বলছে,
“এই তোরা দ্রুত আয়, হিজ ম্যাজেস্টি চলে এসেছেন! জলদি!”
ব্যারনের কথা শোনা মাত্রই সানা আর আরিশ দৌড়ালো সেদিকে। আর আনাবিয়া ধীরেসুস্থে এগোলো ওদের পেছন পেছন।

ফর্মাল পোশাক পরিহিত সকল হাই প্রোফাইলের শিক্ষার্থীগুলো দাঁড়িয়ে গেলো ইম্পেরিয়ালের রেড কার্পেট বিছানো রাজ পথের দুধার ঘেঁষে। হাতে ওদের গোলাপের পাপড়িতে পরিপূর্ণ বাস্কেট, হিজ ম্যাজেস্টি গাড়ি থেকে বের হয়ে এলেই তাকে সংবর্ধনা জানাতে এগুলো ছড়ানো হবে।
আনাবিয়া, আরিশ, ব্যারন, সানা এরা সবাই রেড কার্পেটের অন্যপ্রান্তে দাঁড়ানো, ওদের হাতেও বাস্কেট। সংবর্ধনা শেষে হিজ ম্যাজেস্টি আর তার বেগমকে তাঁদের জন্য সাজানো গোছানো কনফারেন্স রুমে বিশ্রামের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। এত লম্বা জার্নি করেই তো আর সে স্টেজে উঠতে পারবেনা!
ইম্পেরিয়াল লোকে লোকারণ্য! সকলে উৎসুক চোখে চেয়ে আছে ইম্পেরিয়ালের গেটের দিকে। আর কিছুক্ষণ পরেই সকলের কৌতুহল, উত্তেজনা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে ইম্পেরিয়ালের বিশাল গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করলো সুসজ্জিত, সারিবদ্ধ গাড়ির এক বিরাট বহর। গার্ডবাহী গাড়ি গুলো একে একে ধীর গতিতে ঢুকলো ইম্পেরিয়ালে।

শুধু গার্ডের গাড়ি দেখেই যেন সেখানের সমগ্র সমাগমের ভেতর শিহরণ বয়ে গেলো, উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলো ওরা।
আর তার কিছু মুহুর্ত বাদেই গার্ডবাহী গাড়িগুলোর ঠিক মাঝ বরাবর দৃষ্টিগোচর হলো একটা বিলাসবহুল, কুচকুচে কালো রঙা, চকচকে গাড়ি যার লাইনিং গুলো স্বর্ণবাধানো, ঝিকিমিকি করে উঠছে রোদের আলোতে।
মীরের গাড়ির সামনের গাড়িগুলো একে একে দুপাশে সরে গিয়ে মীরের গাড়িকে জায়গা করে দিলো সামনে যাওয়ার। মীরের গাড়িটা গিয়ে থামলো রেড কার্পেটের সূচনাস্থলে। গার্ডবাহী গাড়িগুলো যার যার নির্দিষ্ট অবস্থানে দাড়ালো, পরমুহূর্তেই অস্ত্রসজ্জিত গার্ডগুলো হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ির ভেতর থেকে। সতর্ক দৃষ্টিতে প্রখরতার সাথে অস্ত্রহাতে নিয়ে ওরা সুসজ্জিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো নিজেদের নির্ধারিত স্থানে।

কলেজ কর্তৃপক্ষ মীরকে সংবর্ধনা দিয়ে নিয়ে যেতে ছুটে এলো সেখানে। মীরের গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এলো হামদান। তারপর ঘুরে এসে খুলে দিলো ব্যাকসিটের দরজা।
আর সেই মুহুর্তেই নিরবতা নেমে এলো সম্পুর্ন ইম্পেরিয়াল জুড়ে, প্রচন্ড কৌতুহল নিয়ে উপস্থিত জনতা উত্তেজিত চিত্তে তাকিয়ে রইলো কালো রঙা গাড়িটার দরজার দিকে।
তার কিছু মুহুর্ত বাদেই এক দুর্দান্ত ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের সাথে গাড়ির ভেতর থেকে বীরদর্পে বেরিয়ে এলো মীর।
ওর বিশাল, শক্তিশালী চেহারা, রাজকীয় শ্যামরঙা ত্বক, সাদা শার্টের নিচে দৃশ্যমান পেশির গঠন মুহুর্তেই বিমোহিত, মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেললো সবাইকে!
ওর এই মার্জিত, শক্তিশালী উপস্থিতিতে স্তব্ধ হয়ে গেলো চারপাশের সমস্তকিছু, ভীষণ শ্রদ্ধাবোধে নত হয়ে গেলো ওরা!

গার্ডগুলো ছুটে এসে সাধারণ মানুষের থেকে ওকে আগলে নিয়ে ঘিরে ধরলো মুহুর্তেই। ওর সামনে পেছনে চারপাশে থাকা গার্ডগুলো সতর্ক দৃষ্টিতে দৃঢ় ভাবে নজর রাখলো চারদিকে।
ক্যামেরার ক্লিকের ধ্বনিতে মুখোরিত হয়ে উঠলো চারপাশ! ইম্পেরিয়ালের স্টেজে সেট করা বিশাল স্ক্রিনে ফুটে উঠলো মীরের শক্তিশালী অবয়ব, স্বর্ণোজ্জল চোখ জোড়া চকিতে একবার পড়লো ক্যামেরার ফোকাসে, স্ক্রিণে ভেসে উঠলো ওর ঈগলের ন্যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি!
এরপরেই এক একক মহাকাব্যের ন্যায় রাজকীয় পায়ে সামনে এগোলো মীর। এক অদৃশ্য আকর্ষণ এসে ঘিরে ধরলো সেখানে উপস্থিত সমগ্র জনতাকে।

চোখের দীপ্তি স্নিগ্ধ। সাদা রঙা শার্টটা সামান্য খোলামেলা, তার ওপর চড়িয়ে দিয়েছে একটা ক্যাপে কোট, কোটটির খোলা বুকের ফাক গলিয়ে, শার্টের ওপর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে আছে ওর ইস্পাত-দৃঢ়, পেশিবহুল শরীর।
গভীর, তীক্ষ্ণ স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়ানো চোখ জোড়া নির্ভীক চিত্তে ঈগলের ন্যায় দৃষ্টি ফেলছে চারপাশে। ওর নীরব, শক্তিশালী, ধারালো মুখাবয়বে ফুটে আছে এক বিশাল শাসকী শক্তির ছোপ।
ওকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সবার প্রথমেই দাঁড়িয়ে গেছে হাই প্রোফাইলের ছেলে মেয়ে গুলো। চরম উৎসাহে রেড কার্পেটের দুপাশে দাঁড়ানো অতীব সুন্দরী মেয়ে গুলো পারলে ছুটে আসে মীরের কাছে, কিন্তু গার্ড গুলো কড়া পাহারায়!
ছেলেমেয়ে গুলো রেড কার্পেটে মীরের সামনে ফুল ছড়াতে নিলেই মীর ইশারা দিলো হামদানকে, হামদান সাথে সাথেই উচ্চ, গমগমে স্বরে বলে উঠলো,

“ন্যো ফ্লাওয়ারস!”
মেয়েগুলোর মন খারাপ হয়ে গেলো সাথে সাথে। বাস্কেটগুলো নামিয়ে নিয়ে তবুও ওরা বিমুগ্ধ, অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো ওদের সামনে দিয়ে, শিকার ধরার পূর্ব মুহুর্তে সন্তর্পনে শিকারের দিকে নিরব, ভারী পা ফেলে এগোতে থাকা বাঘের ন্যায় মীরের হেটে চলার ভারী দৃশ্যের দিকে।
নিজেদেরকে আরও সুন্দর দেখানোর প্রচেষ্টায় সচেতন হলো ওরা, যদি একবার বাদশাহের নজরে চলে যায় তবে দেমিয়ান প্রাসাদের আভিজাত্যপূর্ণ জীবন যাপনে ওদের আর আটকায় কে?
এদিকে হামদান ন্যো ফ্লাওয়ারস বলায় ক্ষেপে গেলো আনাবিয়া। ন্যো ফ্লাওয়ারস মানে? এত কষ্ট করে যে ফুলগুলো ওরা কালেক্ট করলো তার কি কোনো দাম নেই?

“ফুল দিবোনা মানে? ফুল দিয়ে আজ তোমাকে গোসল করিয়ে দিবো!”
তেজি কন্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলল আনাবিয়া। মীর শুনতে পেলো সেটা, সকলের অগোচরে মৃদু হাসলো ও। ওর আশেপাশে দাঁড়ানো মেয়েগুলোকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে ও দৃষ্টি দিলো রেড কার্পেটের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা আনাবিয়ার দিকে৷ সে এখন ব্যাস্ত আরিশ, ব্যারন আর সানার বাস্কেটের ভেতর থেকে গোলাপের পাপড়ি নিয়ে নিজের বাস্কেট ভরতে। তবে সত্যি সত্যিই বউ তাকে আজ ফুল দিয়ে গোসল করাবে?
মীরের আগে পিছে থাকা গার্ডগুলো আশ পাশ ঠেকাতে ব্যাস্ত! মেয়েগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়তে চাইছে সামনে। পরিবেশ পরিস্থিতি খেয়াল করে হামদান এগিয়ে গেলো মীরের কাছাকাছি। তারপর চাপা সুরে বলল,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, মেয়েগুলোর ভাবসাব ভালো নয়। শেহজাদী কিন্তু ক্ষেপে যাচ্ছেন।”
মীর এবার ভালোভাবে খেয়াল করলো আনাবিয়াকে, অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে মীরের দিকে হামলে পড়তে থাকা মেয়েগুলোর দিকে, যেন কাছে পেলে এক্ষুনি কানের কার্নিশ বরাবর একটা বিরাট থাবড়া বসিয়ে মেয়েগুলোকে ও ঠান্ডা করে দিতো!
মীর হাসলো, হামদানকে বলল,

“মাঝে মাঝে বউকে জেলাস হতে দেখলে ভালোই লাগে হামদান, আ’ম এনজয়িং দিস!”
মীর চাপা হেসে এবার এগোলো সামনের দিকে, চোখ জোড়া ওর এখনো নিবদ্ধিত রেড কার্পেটের অন্য প্রান্তে দাঁড়ানো আনাবিয়ার তেজি মুখাবয়বের দিকে।
আনাবিয়াকে এমন শকুনি দৃষ্টিতে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সানা এসে যোগ দিলো ওর রাগের আগুনে ঘী ঢালতে। মুখ বেকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে ও বলে উঠলো,
“দেখ দেখ, মেয়েগুলো কেমন হাচড় পাচড় করছে, মনে হচ্ছে যেন জীবনে ব্যাডামানুষ দেখেনাই, এই প্রথম! যদিও হিজ ম্যাজেস্টি কে দেখে আমি নিজেও টাস্কি খেয়েছি, কিন্তু এদের মতো কাহিনী তো করছিনা। মনে হচ্ছে হিজ ম্যাজেস্টিকে ওদের ভিত্রে ছেড়ে দিলে একদম চেটে শেষ করে দেবে!”
আনাবিয়া কটমট করে ফিরে তাকালো সানার দিকে, সানা দমে গিয়ে বলল,

“তুই আমার দিকে অ্যামনে তাকাচ্ছিস কেন? আমি কি করেছি? আমি তো ভদ্র মেয়ে!”
আনাবিয়া আবার ফিরে তাকালো সামনে। মীর হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে, শয়তানি হাসি। চোখে মুখে খচ্চরগীরি উপচে উপচে পড়ছে!
আনাবিয়া ওর ফুলের পাপড়িতে ঠাসা বাস্কেটটা ঠিক ঠাক করে ধরলো, সত্যিই এবার গোসল করিয়ে দেবে ও মীরকে।
মীর যখন হেটে প্রায় আনাবিয়াদের কাছাকাছি চলে এলো তখন লাফিয়ে উঠল সানা, উত্তেজনায় আনাবিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ও বলে উঠলো,

“আইতাছে রে আইতাছে! আমাদের হ্যান্ডসাম, হার্টথ্রব হিজ ম্যাজেস্টি এদিকে আইতাছে! আরে দেখ তোর দিকে তাকাই আছে! বলে ছিলাম না তোরে পছন্দ হইবে, ওই দেখ, তোর দিক থেকে হিজ ম্যাজেস্টির চোখ সরছেনারে নূরিয়ায়ায়ায়ায়া!”
পেছন থেকে ব্যারন এসে সানার মাথায় চাটি মেরে সরিয়ে দিলো ওকে আনাবিয়ার থেকে, তারপর আনাবিয়ার পাশে এসে বলল,

“হিজ ম্যাজেস্টি তার বেগমকে আনলেন না কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?”
“আমি কি করে বলবো? আমার সাথে কি তার পার্সোনালি কথা হয়েছে? নাকি সে আমাকে বলেছে যে শুনো নূর, আমি আমার বেগম কে নিয়ে আসবোনা এই এই কারণে!”
তেজি গলায় বলল নূর, ওর এমন কথায় ভ্যাবাচেকা খেলো ব্যারন। কি ব্যাপার, এই মেয়ে হঠাৎ করে ক্ষেপে গেলো কেন এমন? ব্যারন তাড়াতাড়ি সানাকে টেনে এনে আবার আনাবিয়ার সাথে চিপকে দিয়ে সটকে গেলো।
আর সেই মুহুর্তেই ওদের সামনে দিয়ে হেটে চলে যেতে নিলো মীর। সানা ঠান্ডা হয়ে গেলো, হাত পা কাঁপতে লাগলো ওর। আনাবিয়াকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভাই ধর আমাকে, মাথা ঘুরতাছে আমার। এ আমি কাকে দেখিলাম! এত কাছ থেকে হিজ ম্যাজেস্টিকে দেখলে আমার এমন অবস্থা হবে জানলে আমি ইভেন্টেই আসতাম নাহ্‌!”
আনাবিয়া সানার মদন মার্কা কথায় পাত্তা না দিয়ে সামনে দিয়ে হেটে চলে যেতে থাকা মীরের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,

“হোই মিয়া, দাড়ান!”
আনাবিয়ার এহেন বাক্যে সানা জমে স্থীর হয়ে গেলো পুরোপুরি, আর ওদিকে ব্যারন আরিশ সহ সেখানে উপস্থিত অন্যান্য ছেলেমেয়ে গুলো তব্দা মেরে গিয়ে বিস্ময়ে হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে।
আনাবিয়ার মুখনিঃসৃত কথাটা প্রসেস হতে সময় লাগলো ওদের। বলল কি এই মেয়ে? ‘হোই মিয়া!’ মানে সত্যিই ‘হোই মিয়া!’

আনাবিয়ার ডাকে মীরের পা জোড়া থেমে গেলো তৎক্ষনাৎ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ও আনাবিয়ার দিকে।
সানা আর আরিশ মিলে মনে মনে আনাবিয়ার জন্য ইন্না-লিল্লাহ পড়তে শুরু করলো। ব্যারন অন্যদিকে ফিরে চোখ বন্ধ করে আনাবিয়ার জান বাচানোর জন্য প্রার্থনা শুরু করে দিলো সৃষ্টিকর্তার কাছে।
সানা ভয়ে জমে গিয়ে আনবিয়ার কানের কাছে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
“আল্লাহ তোকে জান্নাত নসিব করুন, আমিন!”
কিন্তু ওদের সবার আতঙ্ককে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে মীর প্যান্টের পকেটে বা হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে এলো আনবিয়ার দিকে, তারপর মাথাটা আনাবিয়ার দিকে সামান্য ঝুকিয়ে অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে বলে উঠলো,

“জ্বি বলুন, কি বলতে চান!”
“আমি আপনার মাথায় এখন এই ফুলের পাপড়ি গুলো ছুড়ে মারবো, পাপড়ি গুলো শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনি এখান থেকে সামনে এগোতে পারবেন না।”
নির্বিকার মুখে বলে উঠলো আনাবিয়া। মীরের পাশে দাঁড়ানো হামদান ঠোঁট টিপে হাসলো। হিজ ম্যাজেস্টি সুন্দর মতো ফেসে গেছেন।
এদিকে আনাবিয়ার কথা শুনে সানার অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়, এই মেয়েকি হিজ ম্যাজেস্টিকে কেবল মাত্র অর্ডার করলো, ‘সামনে এগোতে পারবেন না!’

ব্যারন আরিশের পাশে গিয়ে আরিশের হতভম্ব চেহারাটার দিকে দৃকপাত করে ওর হাত ধরে টানতে টানতে বলল,
“ভাই, এখান থেকে সটকে পড়ি চল, নইলে এই নূরের সাথে সাথে আমাদের মাথা গুলোও যাবে, চল ভাই চল!”
কিন্তু ওদের কথার মাঝেই ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে মীর দু কদম এগিয়ে এলো আনাবিয়ার দিকে। তারপর নিজের মাথাটা নিচের দিকে সামান্য ঝুকিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, দিন।”
আনাবিয়া নির্বিকার মুখে বাস্কেটের ভেতর থেকে অল্প অল্প করে ফুলের পাপড়ি নিয়ে স্বল্প গতিতে ছুড়ে দিতে লাগলো ওর মাথার ওপর। মীর মাথা ঝুকিয়ে রেখেই চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে, ঠোঁট জোড়া ওর প্রসারিত হলো আনাবিয়াকে জেলাস ফ্যিল করানোর খুশিতে।
ওর হাসি দেখে গা জ্বলে গেলো আনাবিয়ার, পাপড়ি ছোড়ার জোর বেড়ে গেলো ওর৷ মীরের হাসি পেলো প্রচন্ড, কিন্তু হাসিটা চেপে রেখে ও তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। মুহুর্তেই এই মুহুর্তটা ক্যামেরা বন্দি করে ফেললো ক্যামেরা ম্যান গুলো!

স্ক্রিনের পর্দায় ভেসে উঠলো নূরিয়া তাজদিনের সামনে মাথা নত করে ফুল নেওয়ার দৃশ্য, উপস্থিত জনতা পৌছে গেলো অবাকতার চরম সীমায়!
যে ব্যাক্তিটা একটু আগেই ন্যো ফ্লাওয়ারস ঘোষণা দিলো সেই কিনা এখন এই মেয়েটির থেকে মাথা পেতে ফুল নিচ্ছে!
সংবর্ধনা লাইনের প্রথম দিকে দাঁড়ানো মেয়ে গুলো প্রচন্ড ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো! নূরিয়া তাজদিনের থেকে তাদের কিসে কমতি আছে?

নূরিয়ার মতো হয়তো তারা অতোটাও সুন্দর নয়, কিন্তু স্ট্যাটাসের দিক থেকেতো তাদের কোনো অংশে কম নেই, বরং নূরিয়া তাজদিনের থেকে তাদের স্ট্যাটাস অনেক বেশিই উপরে। শুধুমাত্র ফারিশের সংস্পর্শে থাকে বলে নূরিয়া অন্যদের থেকে মনোযোগ বেশি পাবে কেন?
ফুল ছোড়া শেষ হলে আনাবিয়া কটমটে চোখে মীরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“চলুন, আপনাকে আপনার জন্য নির্ধারিত কামরায় পৌছে দিয়ে আসি, ইয়োর ম্যাজেস্টি!”
‘ইয়োর ম্যাজেস্টি’ কথাটা দাঁতে দাঁত পিষে উচ্চারণ করলো আনাবিয়া। মীর রাস্তার দিকে হাত ইশারা করে আনাবিয়াকে ওর আগে এগোতে বলল।

আনাবিয়া ওর দিকে শকুনি দৃষ্টি ফেলে এগোলো সামনে, মীর এগোলো ওর পেছন পেছন। আরিশ, ব্যারন, সানা এরা সকলে গার্ড দের সাথে সাথে ঢুকলো মীরের পেছন পেছন।
আরিশ ব্যারন দের সাথে কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট কিছু ব্যাক্তি ঢোকা মাত্রই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো গার্ডরা৷ মীর কামরার সোফার দিকে এগোতে এগোতে আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“নূরিয়া তাজদিন, আমাকে আপনার সুন্দর হাতে একটু পানি পান করান। আমি প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত।”
আনাবিয়া নির্বিকার মুখে কামরার টেবিলের ওপর থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঝুকে দিলো মীরের হাতে। মীর কামরায় রাখা বিশাল বিছানাটার দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে আনাবিয়ার দিকে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

“শুধু পানিতে আমার তৃষ্ণা মিটবেনা মিসেস! এখানের বিছানাটা শক্তপোক্ত মনে হচ্ছে, আজকের রাতটা আমাকে এখানেই দিও, কেমন?”
আনাবিয়া চোখ তুলে ওর দিকে কটমটে দৃষ্টি ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পিছিয়ে চলে গেলো সানা, আরিশদের পাশে। ও যেতেই আরিশ চাপা সুরে শুধালো,
“হিজ ম্যাজেস্টি তোমাকে কিভাবে চিনলেন নূর? আর এইমাত্র বিছানার কথা কি বললেন উনি? ওনার কি পছন্দ হয়নি?”
আনাবিয়া মনে মনে কপাল চাপড়ালো! গলা খাকারি দিয়ে উত্তর করলো,

“ওনাকে মেইল দিয়েছিলাম যে, আমার মেইলে আমার পিকচার দেওয়া আছে, সেখান থেকেই চিনেছেন। আর উনি বলছিলেন যে উনি এখন বিছানায় বিশ্রাম নিতে চান।”
“হিজ ম্যাজেস্টি বিশ্রাম নিবেন? আমরা কি তবে বাইরে চলে যাবো?”
সানা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো চাপা সুরে। ব্যারন সানার অর্ধেক কথা শুনে পেছন থেকে দুম করে এসে বলে উঠলো,
“কোথায় চলে যাচ্ছিস তোরা? হিজ ম্যাজেস্টি কি আমাদেরকে ইভেন্ট থেকে বের করে দিচ্ছেন? উনি কি আমাদের শাস্তি দিতে চান?

সব হয়েছে এই নূরের জন্য, ও হিজ ম্যাজেস্টিকে হোই মিয়া ডেকেছে। এখন ওর জন্য আমাদেরও বনবাসে যেতে হবে! ওহ্‌ গড, কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে আমাদের কে জানে? শিরো মিদোরির জঙ্গলে নিয়ে যাবে?”
আরিশ ওর মাথায় একটা চাটি মেরর চুপ করতে বললো ওকে। ব্যারন চাটি খেয়ে চুপ হয়ে গেলো। আরিশ চাপা সুরে বলল,
“হিজ ম্যাজেস্টি হয়তো একা সময় কাটাতে চাচ্ছেন। ওনার সাথে যে লোকটা আছেনা ওনাকে ডেকে শোনা যায়, কি বলো!”
নূর মাথা দোলালো, ব্যারন গিয়ে চুপিসারে ডেকে নিয়ে এলো হামদানকে। হামদান এসেই আনাবিয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

“জ্বি, শেহ……”
কেশে উঠলো আনাবিয়া। হামদান দ্রুত গতিতে থেমে গিয়ে গলা খাকারি দিয়ে উঠলো। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ বলো, তোমরা কি বলতে চাও।”
আরিশ এগিয়ে এসে শুধালো,
“হিজ ম্যাজেস্টি কি এখন একাকী বিশ্রাম নিতে চান? আমরা কি বাইরে চলে যাবো?”
“হ্যাঁ, উনি কিছুক্ষণ একা থাকতে চান।”
“তাহলে উনি অনুমতি দিলেই আমরা বেরিয়ে যাবো সকলে।”
হামদান আরিশ দের থেকে চলে গেলো মীরের কাছে। মীরের সাথে চাপা সুরে আলোচনা চলতে লাগলো ওর।
সানা সেদিকে দেখে আনাবিয়াকে গুতিয়ে বলল,

“দ্যাখ নূর, তোর দিকে হিজ ম্যাজেস্টি তাকাচ্ছেন বার বার। তোকে নিয়েই হয়তো ওখানে কথা হচ্ছে এখন।
বলেছিলাম না হিজ ম্যাজেস্টি তোকে পছন্দ করেছেন! নইলে উনি হোই মিয়া শোনার পরও তোকে কিছু বললেন না কেন? আবার নিজে থেকে মাথায় ফুলও ছুড়তে দিলেন, সামথিং ইজ ফিশি নূর!”
সানার মুখ খানা ক্রমে ক্রমে ডিটেকটিভ চেহারা ধারণ করলো। আরিশ ওদের কথা আবছা শুনে এগিয়ে এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“নূরকে হিজ ম্যাজেস্টি পছন্দ করেছেন? মানে কি? নূরকে সাথে করে নিয়ে যাবেন তিনি? প্রাসাদে থাকবে নূর?”
আনাবিয়া বিরক্তিতে মুখ কুচকে আরিশের দিকে তাকালো, সানাও আরিশের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচিয়ে বলে উঠলো,

“অর্ধেক কথা শুনে নেচে বেড়ানোর স্বভাব আপনার আর ব্যারন ভাইয়ার কখনো যাবেনা!”
ব্যারন নিজের নাম শুনে পেছন থেকে এগিয়ে এসে তেজি গলায় শুধালো,
“এই আমার নামে তোরা কি বলছিস? আমি কখন নেচে বেড়ালাম, সেই থেকে কাজ করছি দেখছিস না?”
আনাবিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা, গত পাঁচ বছর ধরে এই মেন্টাল গ্রুপের সাথে থেকে থেকে ও যে এখনো মেন্টাল হয়ে যায়নি তাতে শুকরিয়া আদায় করলো।
আরিশ নূরের দিকে এগিয়ে এসে সিরিয়াস কন্ঠে বলল,
“হিজ ম্যাজেস্টি কি সত্যিই এমন কিছু বলেছেন নূর? তোমাকে নিয়ে যাবেন?”

“হিজ ম্যাজস্টি নূরকে নিয়ে যাবেন বলতে? আমি এখানে একটুখানি ছিলামনা আর এর ভেতরেই এত কিছু হয়ে যাচ্ছে? নূরকে কে হিজ ম্যাজেস্টি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, প্রাসাদে? তবে কি নূর এখন থেকে শিরো মিদোরির প্রাসাদে থাকবে? তারমানে আমরা প্রাসাদে ওর সাথে দেখা করতে যেতে পারবো?”
উত্তেজিত কন্ঠে বলল ব্যারন। সানা সেন্টি খেলো, একটা কথা থেকে কোথায় নিয়ে চলে যাচ্ছে এরা!
এমন সময় হামদান এসে বলে উঠলো,
“হিজ ম্যাজেস্টি এখন বিশ্রাম নেবেন। উনি সবাইকে কামরা খালি করে দিতে বলেছেন, শুধু মাত্র নূরিয়া তাজদিনকে থেকে যেতে বলেছেন।”
এ কথা শোনা মাত্রই সানা আরিশ আর ব্যারন একে অপরের দিকে তাকালো। হামদান কথাটা বলেই প্রস্থান করলো। আরিশ উত্তেজিত গলায় বলল,

“নূরকে এইখানে একা থাকতে বললেন? নূরের সাথে কি করবেন উনি? একা থাকতে বললেন কেন?”
“আরে রাজা বাদশাহদের সবসময় মেয়ে লাগে জানিস না? নূরকে দিয়ে হাতপা টেপাবেন শিওর। দেখিস তোরা!”
ভাবুক কন্ঠে বলে উঠলো ব্যারন। সানা এদিকে ভয়ে সাদা হয়ে গেলো, আনাবিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ও চাপা সুরে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“ভাই, আমার মনে হচ্ছে তোকে, এহেম… মানে তোকে উনি এহেম… ওই ইয়া করবেন। কিন্তু আমি সে কথা ভাবছিনা, আমি ভাবছি ওনার যে সাইজ, তুই তো মরে যাবি দোস্ত!”
আনাবিয়া বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল,
“মরে মরে বেঁচে আছি!”

তখনি গার্ড এসে বেরিয়ে যেতে বলল ওদের সবাইকে, সানা আনাবিয়ার দিকে কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরিশ ব্যারনদের সাথে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে।
কামরা থেকে সবাই বেরিয়ে গেলে গার্ডগুলো বের হয়ে গিয়ে দরজা টেনে দিলো বাইরে থেকে। গার্ড দরজা টেনে দিতেই মীর সোফা থেকে ঝড়ের গতিতে উঠে আনাবিয়ার কাছে এসে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে উঁচু করে ধরে ঝড়ের গতিতে এগোলো বিছানার দিকে।
বিছনার কাছে এসে আনাবিয়াকে ধাম করে বিছনার ওপর ফেলে দিয়ে নিজেও ঝাপিয়ে পড়লো আনাবিয়ার ওপর৷ মীরের এহেন কর্মকাণ্ডে তব্দা মেরে গেলো আনাবিয়া। ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

“কি শুরু করেছো?”
“ইভেন্টের বিজয়ীদের নাম অ্যানাউন্স হতে এখনো তিন ঘন্টা বাকি। এই তিন ঘন্টা যদি তুমি এখন আমাকে দাও তাহলে রাতের গাড়ির ভেতর হওয়া ডিলের বারোঘন্টা থেকে তিন ঘন্টা মাইনাস করে ওই সময়টুকু তোমাকে ঘুমোতে দেবো।”
আনাবিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে নেশালো গলায় বলল মীর। আনাবিয়া ওকে নিজের ওপর থেকে সরানোর চেষ্টা করতে করতে ঝাঝালো গলায় উত্তর দিলো,
“না৷”
“ভেবে দেখো! এখন তিনঘন্টা সময় এখানে শুধু শুধু নষ্ট করবে নাকি রাতে তিনঘন্টা ঘুমোবে। অফার দিলাম তোমাকে, অফার গ্রহণ না করলে লস কিন্তু তোমারই!”
“তুমি এই জন্য আমাকে এইখানে রেখেছো? তুমিতো আসলেই খারাপ! সানা তবে ঠিকই বলেছিলো, তুমি ইয়া করার জন্য আমাকে রাখতে চাইছিলে!”

মীরকে ঝটকা মেরে নিজের থেকে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বলল আনাবিয়া, কিন্তু মীরের দৃঢ় বাহুবন্ধনী থেকে নিজেকে আলগা করতে পারলোনা। মীর নিজের বন্ধনী আরও শক্ত করে বলল,
“অফার অফার! ভেবে দেখো, তাত্তারি। উইলিংলি রাজি হলে রাতে তিন ঘন্টা ঘুমোতে পারবে, আর জোর করলে এখনও ছাড়া পাবেনা, রাতেও ঘুমোতে পারবেনা।”
“তুমি তো ভালোই খারাপ! রীতিমতো স্বৈরাচার শুরু করেছো! সুন্দর অপশন দাও।”
“সুন্দর অপশনের আর কোনো অপশন নেই, রাজি হলে বলো না রাজি হলেও বলো। রাজি হলে তিনঘন্টা পাবে, রাজি না হলে এক সেকেন্ডও পাবেনা।”
এক ভ্রু উঁচু করে বলল মীর। ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো আনাবিয়া, তারপর মীরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মুখ বেকিয়ে বলে উঠলো,
“রাজী।”

“নূর এখনো বের হয়না কেন ব্যারন? তিন ঘন্টা হতে চলল! হিজ ম্যাজেস্টি ওর সাথে কি করছে কে জানে!”
কনফারেন্স রুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে উদ্বেগপূর্ণ কন্ঠে বললো আরিশ। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ইভেন্টও প্রায় শেষ। ইভেন্টের ফলাফল আলোচনা করা হচ্ছে ইম্পেরিয়ালের মেইন অফিসে।
মীরের পরিবর্তে সেখানে উপস্থিত আছে হামদান। কর্তৃপক্ষ হামদানের নিকট মীরকে উপস্থিত হবার অনুরোধ জানালেও হামদান সোজাসুজি বলে দিয়েছে হিজ ম্যাজেস্টি প্রচন্ড ব্যাস্ত আছেন।
তাই ওরাও আর হিজ ম্যাজেস্টিকে ডাকার সাহস করেনি, ফলাফল ঘোষণা করার সময়েই তাকে ডাকা হবে। কিন্তু হার ম্যাজেস্টি আসবেন বলেও আসলেননা এই ব্যাপারটা নিয়ে ওরা চিন্তিত ছিলো, হামদানকে জিজ্ঞেস করলে হামদান বলে দিয়েছে তাঁকে আপনারা সময় মতো পেয়ে যাবেন।

আরিশ ব্যারন আর সানা শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে কনফারেন্স রুমের বন্ধ দরজার দিকে, ওদের সাথে সাথে আরও অনেক উৎসুক দৃষ্টি চেয়ে আছে সেদিকে। সেই যে হিজ ম্যাজেস্টি ঢুকলেন, তারপর সবাইকে বের করে দিলেন। একমাত্র নূরিয়া তাজদিন রয়ে গেলো সেখানে, তার আর কোনো খোঁজই নেই!
আরিশদেরকে এর মাঝেই অনেকবার অনেকে এসে জিজ্ঞেস করে গেছে যে নূরিয়া তাজদিন ভেতরে একা কেন? সানা প্রত্যেকবার কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিয়েছে,
“হিজ ম্যাজেস্টি চেয়েছেন তাই নূরিয়া তাজদিন ভেতরে একা।”
আরিশ ব্যারনের কাধে ভর দিয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে, আনাবিয়ার জন্য ওর একটা প্রচন্ড সফট কর্ণার ছিলো, কিন্তু আজ একি হচ্ছে!

ব্যারন থেকে থেকে স্বান্তনা দিচ্ছে ওকে, যে যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন ওদিকে তাকিয়ে কোনো লাভ নেই। কিন্তু আরিশ বিশ্বাস করতে চাইলোনা, বলে উঠলো,
“আরে নূর দেমিয়ানদের রিলেটিভ হয়, হিজ ম্যাজেস্টি কখনোই এমন করবেন না। নূর খ্রিস্টান হলেও কথা ছিলো, কিন্তু তা তো নয়। অন্য কোনো ব্যাপার আছে এখানে, ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হবে। কিছু একটা হচ্ছে আমাদের আড়ালে!”
ওদের কথার মাঝেই হামদানকে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেলো কনফারেন্স রুমের দিকে। বাইরে দাঁড়িয়ে ও ভেতরে যোগাযোগ করলো ফোনে, আর তার কিছু মুহুর্ত পরেই সেখানে আবার হাজির হলো কলেজ কর্তৃপক্ষ। আরিশ, সানা দেরও ডাক পড়লো আবার।
আরিশ চাপা গলায় বলল,

“এবার ওরা বের হবে, বের হলেই নূরের থেকে জানা যাবে সব৷”
দ্রুত পায়ে এগোলো ওরা সামনের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে যে যার স্থানে দাঁড়িয়ে রইলো স্থীর হয়ে। কর্তৃপক্ষের একজন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমাদের নূরিয়া তাজদিন কোথায়?”
“সে হিজ ম্যাজেস্টির সাথে ভেতরে আছে।”
শুকনো মুখে উত্তর দিলো ফারিশ। প্রশ্ন করা ব্যাক্তিটি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে। হামদান তখন গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“ওনারা দুজন একত্রে বের হবেন। হার ম্যাজেস্টির ধারে কাছেও যেন কেউ না ঘেষে সেটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব তোমাদের।”
তারপর গার্ডগুলোর দিকে নির্দেশ করে বলল,

“লোকসমাগম সরিয়ে নাও তোমরা, কোনোভাবেই যেন লোকজন এদিকে চলে আসতে না পারে। রাস্তাটা খালি করো এখুনি। ক্যামেরা ম্যান দের বলে দাও কেউ যেন ভুলেও কোনো ক্লিক না করে, একটা ক্লিকের শব্দ শুনলেই কিন্তু তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেওয়া হবে৷ পুরুষগুলোকে এক স্থানে যেতে বলো, কেউ মাথা তুলবে না।”
গার্ডরা লেগে পড়লো যে যার কাজে। রেড কার্পেটের সমস্ত এরিয়াটা ফাকা হয়ে গেলো মুহুর্তেই। সানা আরিশ ব্যারন দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো একে অপরের দিকে, হার ম্যাজেস্টি তো আসেননি! তাহলে ওনার জন্য কিসের প্রস্তুতি নিতে হবে!

ওদের চাপা আলোচনার ভেতরেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড গুলো ভেতর থেকে আদেশ পেয়ে খুলে দিলো কামরার দরজাটা, তার পরমুহুর্তেই কামরার ভেতর থেকে বের হয়ে এলো আনাবিয়া আর মীর! আর ওদের উপসস্থিতির সাথে সাথেই স্তব্ধ হয়ে গেলো সেখানে বিদ্যমান সমগ্র জনতা!
সানা, আরিশ, ব্যারন আর সেখানে উপস্থিত অন্যরা বিস্মিত, হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দরজা দিয়ে বের হওয়া আনাবিয়ার দিকে। চোখ জোড়া মুগ্ধতায় ছেয়ে গেলো ওদের!
আনাবিয়ার পরনের সিলভার রঙা ফ্লাপি গাউনটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে ওর লম্বা, আকর্ষণীয় দেহের প্রতিটি ভঙ্গিমা। মসৃণ সিল্কের ফ্লাপি গাউনটা ঝলমল করছে সন্ধ্যার কৃত্রিম আলোতে!
একটুকরো চাঁদের ন্যায় স্নিগ্ধ আলো ছড়াচ্ছে ও। ওর লম্বা, সফেদ চুলগুলো সেজে আছে এক বিরাট খোপায়। চুলের কয়েকটি ছোট ছোট গোছা এলোমেলো ঢেউ খেলে এসে পড়েছে ওর গালের ওপর, টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়া কে করে তুলেছে আরও বেশি আকর্ষণীয়!

হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জোড়া এক গভীর মহাবিশ্বের ন্যায় ঝিকিমিকি করছে, এক অদ্ভুত মায়া লুকিয়ে আছে ওর দুচোকজের তারায়! চোখের পাতায় বুলিয়ে দেওয়া সিলভার শ্যাডোর সামান্য ছোয়ায় অপ্সরার ন্যায় দেখাচ্ছে ওকে। গলার পাতলা প্লাটিনামের নেকলেসে ঝুলছে ছোট্ট একটি ডায়মন্ড।
এক রাজকীয় আত্মবিশ্বাসে হেটে এগিয়ে চলেছে ও সামনের দিকে। ওর প্রতিটি পদক্ষেপ মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে, বিমুগ্ধ চোখে ওকে দেখে চলেছে সকলে!
সানা, আরিশ আর ব্যারন হা হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, সানার মনে হলো যেন জীবনে প্রথমবারের মতো আজ ও বুঝতে পারেছে প্রকৃত সৌন্দর্যের সংজ্ঞা!

হামদান আরিশ আর ব্যারনকে মাথা তুলে আনাবিয়ার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে দুজনকে দুটো চাটি মেরে মাথা নিচের দিকে দিয়ে দিলো।
সানা তখনোও তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার ওই অদ্ভুত সৌন্দর্যের দিকে, ওর বুঝতে আর বাকি নেই হিজ ম্যাজেস্টির সাথে নূরিয়া তাজদিনের ঠিক কি সম্পর্ক!
যে মেয়েগুলো এতক্ষণ মীরের কামরা থেকে বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো, অপেক্ষায় ছিলো নূরিয়া তাজদিন ভেতরে কি করছে সেটা জানার, তারা রেড কার্পেটের দুপাশে দাঁড়িয়ে রইলো স্তব্ধ হয়ে!
অলৌকিক বিস্ময় নিয়ে ওরা দেখতে থাকলো হিজ ম্যাজেস্টির পাশে পাশে চলতে থাকা এই চোখ ধাধানো সুন্দরী মেয়েটাকে!

আনাবিয়ার পাশে দাঁড়ানো মীর আনাবিয়ার কাছ ঘেঁষে এসে নিজের বা হাতটা দিয়ে শক্ত করে ধরলো আনাবিয়ার কোমর যেন কোনো অদৃশ্য বিপদ ওকে স্পর্শ করার সাহস না পায়। ওর দীর্ঘ, রাজসিক শরীর দিয়ে ঘিরে ধরলো ও আনাবিয়াকে, চোখে ফুটে উঠলো সতর্কতা।
একবার নিজের শিকারি দৃষ্টি ঘুরিয়ে মুহুর্তেই দেখে নিলো ইভেন্টের প্রতিটি মানুষের মুভমেন্ট!
আনাবিয়ার কোমরটা আরও দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে নিয়ে ওর আশেপাশে ওদেরই দিকে তাকিয়ে থাকা জনসমাগমকে বুঝিয়ে দিলো এই রূপসীর প্রতি অধিকারটা শুধুমাত্র তার!

আনাবিয়া মীরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হাসলো মিষ্টি করে, নিজের ডান হাত দিয়ে মীরের বাহু আকড়ে ধরলো আলতো করে। কোমরের উপর রাখা মীরের শক্ত হাতে ও অনুভব করলো এক অদ্ভুত নিরাপত্তা।
ইভেন্টের ফাইনাল রেজাল্ট অ্যানাউন্স করতে ওরা দুজন কলেজ কর্তৃপক্ষ আর আরিশ, সানা দের সহায়তায় উঠতে নিলো স্টেজে। মীরের এক হাতে তখনো শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা আনাবিয়ার কোমর।
আনাবিয়া ওর লম্বা, ফ্লাপি গাউনটা দুহাতে উঁচু করে স্টেজের সিড়ি বেয়ে উঠতে গেলো ওপরে, কিন্তু এত ফ্লাপি গাউন সামলানো কষ্টকর হয়ে পড়ছে ওর জন্য!

মীর সেটা খেয়াল করে ঝুকে পড়ে উঁচু করে নিলো আনাবিয়ার গাউনটা, তারপর মুখে বলল,
“এগোও এবার। যেটা পরে হাটতে পারোনা সেটা পরো কেন?”
মীরের কথায় ভ্রু কুচকে তাকালো আনাবিয়া, তেজি গলায় বলে উঠলো,
“কে গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়েছে এই ড্রেস? আমি?”
মীর আর কিছু বললনা। যা-ই হোক না কেন দোষ ওরই, শুধু শুধু তর্ক করে সংসারে ঝামেলা বাধানোর ওর কোনো শখ নেই, এখন তর্ক করলে তখন রাতের ব্যাপারটা মিস হয়ে যাবে৷

স্টেজের সেন্টারে এসে মীর আর আনাবিয়া বসলো ওদের জন্য নির্ধারিত স্থানে। সানা, আরিশ আর ব্যারন এসে দাঁড়ালো ওদের পেছনে, হিজ ম্যাজেস্টি আর তাঁর বেগমের সার্বিক দেখাশোনার দায়িত্ব ওদের ওপর বর্তেছে।
আনাবিয়া পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো একবার, হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো ওদের তিনজনকে। আনাবিয়া ডাকছে দেখে হার্টবিট বেড়ে গেলো ওদের। নূরিয়া তাজদিন আর হার ম্যাজেস্টির ভেতর যে বিস্তর ফারাক! দুজনের ভেতর যে আকাশ পাতাল তফাত!

তবুও ওরা এগোলো ধীরে পায়ে, আনাবিয়ার কাছে এসে দাড়ালে আনাবিয়ে মিষ্টি হেসে স্নিগ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
“সঙ্গত কারণে ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমাকে অব্যহতি নিতে হচ্ছে, আজ ইম্পেরিয়ালে আমার শেষ দিন। আমার পর ডোমিনিয়নের ক্যাপ্টেন কে হবে সেটা নিজেদের ভেতর ভোটিং করে নিও।
আর হ্যাঁ আমি ওনার বউ বলে যে তোমাদের সাথে আর যোগাযোগ করবোনা এমনটা ভেবোনা, তোমরা আমার অনেক ভালো বন্ধু, সঙ্গী। পাঁচটা বছর তোমাদের সাথে হেসে খেলে কাটিয়েছি, তোমাদেরকে স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলা কখনো সম্ভব নয়।
আমি যোগাযোগ রাখবো তোমাদের সাথে সবসময়, আর তোমরাও আমাকে কল করতে কখনো দ্বিতীয়বার ভাববে না। ওকে?”

তড়িতে মাথা নাড়ালো ওরা তিনজন। সানা কেঁদে ফেললো হঠাৎ, ওর এত সাধের বান্ধবী কিনা শেষ মেশ হিজ ম্যাজেস্টির বেগম হয়ে বেরোলো, তার ওপর আর নাকি তার সাথে দেখাও হবেনা! এটা কি মানা যায়?
ওকে কাঁদতে দেখে মীরের দিকে ভ্রু তুলে তাকালো আনাবিয়া, মীর ওকে চোখের ইশারা দিতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে ও জড়িয়ে ধরল সানা কে। সানা এবার কেঁদে উঠলো ফুপিয়ে! আনাবিয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

“পাগলী মেয়ে, কাঁদছিস কেন? তোর কখনো আমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছা হলেই বলবি, আমি তখনি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো। শিরো মিদোরির প্রাসাদে নিয়ে এসে নামিয়ে দেবে তোকে, এখন কান্না থামা!”
আনাবিয়া আরও কিছুক্ষণ স্বান্তনা দিয়ে কান্না থামালো সানার৷ ইভেন্টের ফলাফল ঘোষণা শুরু হলো তার কিছু মুহুর্ত পরেই। আনাবিয়া ওর রিনরিনে কন্ঠে মাইকে ঘোষণা দিলো বিজয়ী দের নাম, মীর ওদের হাতে তুলে দিলো ক্রেস্ট।
কাজের ফাঁকে মীর ওর পাশে বসা আনাবিয়ার দিকে সামান্য ঝুঁকে ওর কানে কানে বলল আসন্ন রাতের কোনো গোপন কথা, আনাবিয়া লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো মুহুর্তেই, মাথা নিচু করে ফেলে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করলো এক মিষ্টি হাসিতে।

উপস্থিত সকলে নিঃশব্দে দেখলো এই দৃশ্য, নিজেদের ভেতর এই কপোত-কপোতীর ভীষণ প্রেম নিয়ে জল্পনা কল্পনা করলো প্রচন্ড।
ফলাফল ঘোষণা শেষে শুরু হলো কনসার্ট! কিন্তু মীর থাকলো না সেখানে, স্টেজ থেকে ফ্লাপি গাউনে আবৃত লাজরাঙা আনাবিয়াকে কোলে উঠিয়ে নেমে গেলো ও স্টেজ থেকে, তারপর ওকে কোলে নিয়েই হেটে গেলো কনফারেন্স রুমের দিকে, হামদানকে বলে দিলো আগামী বারো ঘন্টার আগে কেউ যেন ওদেরকে বিরক্ত না করে!

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২১+২২

আরিশ তখনো তাকিয়ে রইলো কনফারেন্স রুমের দরজার দিকে। সানা আর ব্যারন এসে ওকে স্বান্তনা দিয়ে বলল,
“বাদদে ভাই, যে মেয়ে হিজ ম্যাজেস্টির মতো বিশাল শরীরের পুরুষ মানুষ সামলাতে পারে সে তোর কপালে জুটলে তোকে সকালবেলা খুজে পাওয়া যাবেনা। বাদ দেহ্‌!”

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৫+২৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here