বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৭+২৮

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৭+২৮
রানী আমিনা

কুরো আহমারের নোভারা এরিয়াটা সম্পুর্ন দাপুটে লোকজনে ঘেরা। শহরের সবচেয়ে বিলাশবহুল অঞ্চল এটাই। আর এখানের বিলাশবহুল বাসাবাড়ি গুলোর ভেতর সবচেয়ে আভিজাত্যপূর্ণ বাড়িটা কুরো আহমারের কন্ট্রোলার নওয়াস জাবিনের।
অত্যাধুনিক, বিশালাকার প্রাসাদসম দোতলা বাড়িটার চারপাশ ঘিরে উঁচু প্রাচীর। বাড়ির সামনের প্রশস্ত বাগানটিকে আজ সাজানো হয়েছে গোলাপ, অর্কিড, আর লিলির সংমিশ্রণে, সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।
বাড়ির ভেতর প্রবেশের পথজুড়ে লাল গালিচা বিছানো।

বিয়ের আসর সাজানো হয়েছে নওয়াসের বাড়ির নিচতলার বিশাল ড্রয়িংরুমে। বাড়ির প্রতিটি কোণ থেকে যেন ছড়িয়ে পড়ছে আভিজাত্য আর আনন্দ। বাড়ির এমন রাজকীয় সাজসজ্জায় বিয়েতে আমন্ত্রিত অতিথিরা মুগ্ধ চোখে নওয়াসের এমন পছন্দের প্রশংসা করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে ভেতরের দিকে।
এমন সময়ে নোভারার প্রশস্ত রাস্তার ওপর দৃষ্টিগোচর হলো গাড়ির এক বিরাট বহর। সুসজ্জিত শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থাতে নওয়াসের বাড়ির দিকে এগোচ্ছে ছাই রঙা গাড়ির বহরে ঘেরাও করে রাখা একটা বিলাশবহুল কালো রঙা গাড়ি, যার স্বর্ণবাধানো লাইনিং গুলো সূর্যের আলো পড়ে চকমকিয়ে উঠছে।
এই কালো রঙা স্বর্ণ বাধানো গাড়িটা এক দুর্দমনীয় আতঙ্কের মতো উপস্থিত হয়ে চুপসে দিলো বিয়ের অনুষ্ঠানে হয়ে চলা এতক্ষণের বিরাট হৈ-হুল্লোড়!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গার্ডবাহী গাড়িগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে একে একে এসে থামলো নির্দিষ্ট স্থানে। নওয়াস দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো বাড়ির ভেতর থেকে। আসার আগে অন্দরমহলের উদ্দেশ্যে বলে এলো শেহজাদীর আপ্যায়নে যেন বিন্দুমাত্র ত্রুটি না হয়, নইলে হিজ ম্যাজেস্টি কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিবেন!
মীরের কালোরঙা আতঙ্কখানা এসে থামলো মেঝেতে বিছানো লাল গালিচার সামনে। ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে এসে আরমান খুলে দিলো গাড়ির দরজা।
সিকিউরিটির জন্য মীরের কড়া নিষেধাজ্ঞায় মিডিয়ার কাউকেই এই এরিয়ায় ঢুকতে দেয়নি নওয়াস, তাই পরিবেশটা আজ শান্ত।
আরমান এসে দরজা খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সিলভার রঙা আভিজাত্যপূর্ণ পাঞ্জাবীতে আবৃত শ্যামরঙা মীর! ওর স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়ানো ঈগলের ন্যায় শাণিত চোখ জোড়া তড়িতে পর্যবেক্ষণ করে নিলো আশপাশের পরিবেশ।

নওয়াসের পেছন পেছন বাড়ির ভেতর থেকে কৌতুহল দমাতে না পেরে ছুটে এসেছে প্রায় সমস্ত আত্মীয়রা, হিজ ম্যাজেস্টি ঠিক কেমন দেখতে সেটা জানার লোভ সামলাতে পারেনি ওরা৷
মীর বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালো একবার নওয়াসের দিকে, নওয়াস ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুহুর্তেই গার্ডদের সহায়তায় সরিয়ে ফেললো সমস্ত লোকজন, ভেতরে পাঠিয়ে দিলো তাদেরকে সাথে সাথেই।
লোকজন পুরোপুরি পাতলা হলে মীর ঘুরে গিয়ে খুলে দিলো আনাবিয়ার পাশের দরজাটা, তারপর হাত বাড়িয়ে দিলো ভেতরের দিকে। পরক্ষণেই ওর হাতের ওপর এসে স্পর্শ করলো একটা শুভ্র দ্যুতি ছড়ানো সরু হাত, ওর হাতে ভর দিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মেরুণ রঙা লেহেঙ্গায় আবৃত চোখ ধাধানো শুভ্র, সুন্দর আনাবিয়া!
আনাবিয়াকে অন্দরমহলে নিয়ে যাবার জন্য নওয়াসের পিছু পিছু সেখানে এসে উপস্থিত হওয়া নওয়াসের দুই মেয়ে স্থীর হয়ে গেলো ওকে দেখা মাত্রই!

ফারিশের মুখে এতদিন ধরে ওরা শুনেছে ওদের শেহজাদীর সৌন্দর্যের কথা, ফারিশ আনাবিয়ার পূঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছে ওদের যখন তখন। কিন্তু তাদের শেহজাদী যে এমন হিপনোটাইজ করা সুন্দরী হবেন সেটা ওরা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি!
নওয়াস ওদের দুজনকে ইশারা দিলো আনাবিয়াকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নিজেদেরকে ধাতস্থ করে নিয়ে ওরা আনুগত্যের সাথে এগোলো আনাবিয়াকে আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে যেতে, কিন্তু মীর তার আগেই হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলো ওদের। নওয়াসের দিকে ফিরে বলল,

“আমার স্ত্রী আমার সাথেই থাকবে নওয়াস, তার জন্য যে ব্যাবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন হয় করো।”
মীরের এমন আদেশে চুপসে গিয়ে মেয়েদুটো পিছিয়ে গেলো ধীর পায়ে। নওয়াস দ্রুত ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা হেল্পিং হ্যান্ড মেয়েগুলোকে বলল যত দ্রুত সম্ভব কামরা প্রস্তুত করতে। মেয়েগুলো সাথে সাথেই ছুটলো ভেতরে।
নওয়াসের মেয়েদুটোর চুপসে যাওয়া চেহারা খেয়াল করে আনাবিয়া পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার প্রয়াসে মীরের দিকে ফিরে বলল,
“কামরা প্রস্তুত হওয়া পর্যন্ত আমি ওদের সাথে থাকছি, তুমি চাচাজানের সাথে কথা বলো।”
মীর ওর দিকে তাকিয়ে চোখে সায় মানলো। আনাবিয়া মেয়েদুটোর দিকে ফিরে মুখে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গেলো ওদের কাছে। তারপর রিনরিনে গলায় বলল,

“চলো ভেতরে।”
মেয়েদুটো খুশি হলো প্রচন্ড! চোখ জোড়ায় আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠলো ওদের। আনাবিয়ার হাত ধরে ওকে ভেতরে নিতে চাইলো ওরা, কিন্তু তার আগেই মীরের শকুনি দৃষ্টি পড়লো ওদের দিকে।
মেয়েদুটো ওর এমন দৃষ্টি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে নামিয়ে নিলো আনাবিয়ার দিকে বাড়ানো হাত জোড়া।
আনাবিয়া বুঝলো মীর ফারিশের ওপরের রাগ থেকে এসব করছে।
শুধুমাত্র নওয়াসের ছেলে বলে ফারিশকে সে কোনোদিন সরাসরি কিছুই বলেনি, কিন্তু বলতেও ছাড়েনি। কোনো না কোনো ভাবে ফারিশকে সে চাপে রেখেছে সর্বক্ষণ! প্রতিমুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছে ওর স্ত্রীর দিকে নজর দেওয়ার ফলাফল!

আনাবিয়া মাঝে মাঝে ভাবে এই লোকটাকে যদি আজ লাইফট্রির সিদ্ধান্তে ডার্ক প্যালেসে রাখা হতো, আর এ যদি এমনই গোঁয়ার থাকতো তবে এই সাম্রাজ্যের কপালে দুঃখ ছিলো! ওর হিংস্রতা, রাগ, জেদ, অধ্যবসায়, ধৈর্য, সংযম, শক্তি এ সমস্ত কিছু এই সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট ছিলো!
লাইফট্রি হয়তো এই হিংস্র মানুষটার হাত থেকে এই সাম্রাজ্য রক্ষার করার জন্য, সাম্রাজ্যটাকে সহিহ সালামতে রাখার জন্য পুরো সাম্রাজ্যটাকেই এই লোকটার হাতে তুলে দিয়েছে, যেন জেদের বসে ক্ষতি না করে বসে কোনো!
কিন্তু মীর যে জিনিসটাকে একবার আপন করে নেয় সেটাকে ও জান প্রাণ দিয়ে প্রটেক্ট করে!

নওয়াসকে ভালোবাসে বলেই ফারিশকে ও কখনোই প্রত্যক্ষ কোনো ক্ষতি করেনি, নওয়াসকে ভালো না বাসলে আজ ফারিশকে ও কোনো মতেই বাঁচিয়ে রাখতো না, অনেক আগেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতো!
আনাবিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা! তারপর মেয়েদুটোর দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে এগোলো ভেতরের দিকে। মেয়েদুটো চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দ নিয়ে এগোলো ওর পেছন পেছন।
আনাবিয়া ভেতরে পা রাখতেই আশপাশটা যেন আলোকিত হয়ে উঠলো ওর রূপের ঝলকানিতে। অন্দরমহল থেকে নিঃশব্দ, কৌতুহলী পায়ে ছুটে এলো মেয়েরা; শিরো মিদোরির পরমাসুন্দরী যে আজ নওয়াসের বাড়িতে তার পদধূলি রেখেছেন!

কামরার কোণা কোণা থেকে উঁকি মেরে মুগ্ধ, উৎসুক দৃষ্টিতে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। আনাবিয়া রাজকীয় পায়ে কোমরে ঢেউ তুলে হেটে এগিয়ে গেলো ওদের সামনে দিয়ে। নওয়াসের মেয়ে দুটো সাবধানি ভঙ্গিতে সতর্ক করে দিলো ওদের যেন ভুলেও নিজেদের জায়গা থেকে কেউ বেরিয়ে না আসে, শেহজাদীর শরীরের যেন ভুলবসতও কারো একটা পশমের স্পর্শও না লেগে যায়!
আনাবিয়াকে নিয়ে ওরা পৌছালো রাজকীয় সাজসজ্জায় সজ্জিত একটা কামক্রায়। কামরার ভেতরে রাখা মখমলি সোফার ওপর গিয়ে বসলো আনাবিয়া, চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে মিষ্টি স্বরে বলে উঠলো,
“সুন্দর সাজিয়েছো তো তোমরা!”

“শিরো মিদোরির প্রাসাদের কাছে আমাদের এ সাজসজ্জা কিছুইনা শেহজাদী!”
বলে উঠলো নওয়াসের বড় মেয়েটি। আনাবিয়া ওকে হাতের ইশারায় নিজের পাশে বসতে বলল। কিন্তু আনাবিয়ার ইশারায় আতঙ্কিত হয়ে উঠলো ওরা, হিজ ম্যাজেস্টি কোনোভাবে জানতে পারলে রেগে যাবেন নিশ্চিত!
হিজ ম্যাজেস্টি যে শেহজাদীর ছোয়াছুয়ির ব্যাপারে প্রচন্ড খুতখুতে এটা জানতে বাকি নেই ওদের কারো! বউকে পারলে উনি নিজের বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখেন! আর একটু আগের ঘটনার পর ওদের আর সাহস নেই আনাবিয়ার কাছে ঘেঁষার!

ওদের আতঙ্কিত চেহারা দেখে মনে মনে হাসলো আনাবিয়া, একটা মানুষ কতটা ভয়ঙ্কর না হলে তার বউয়ের পাশে মেয়েরাও বসতে ভয় পায়! অথচ ওই ভয়ঙ্কর মানুষটিই সর্বক্ষণ ওকে ভরিয়ে দেয় আদর আর ভালোবাসায়! ওর কমফোর্টের জন্যই চোখের পলকে জোগাড় করে ফেলে সমস্তকিছু!
আনাবিয়া আর বসতে বললনা ওদের, নিজের অজান্তেই গর্বে বুক টা ভরে উঠলো ওর! ওর স্বামী, ওর একান্ত নিজের মানুষটাকে সকলে যমের মতো ভয় পায়! আর সেই ভয়ানক মানুষটার আদুরে ছায়াতলে নির্দ্বিধায় দিনাতিপাত করে ও।
আনাবিয়া বড় মেয়েটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে শুধালো,

“কি নাম তোমার?”
“ আমার নাম ফারহিন জাবিন, শেহজাদী!”
আনুগত্যের সাথে নরম গলায় উত্তর দিলো মেয়েটা, আনাবিয়া পাশের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে শুধালো,
“আর তুমি?”
“ফিয়ারা জাবিন।”
বলেই ফিয়ারা আনাবিয়ার দিকে ভ্রু তুলে তাকিয়ে উচ্ছাসপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
“ফারিশ ভাইজানের কাছে আপনার কথা আমরা অনেক শুনেছি। উনি বলতেন আপনি নাকি ভয়ঙ্কর সুন্দরী, এতটা সুন্দরী যে আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারবোনা!
আজ আপনাকে দেখার পর সত্যিই মনে হচ্ছে ভাইজানের কথা সঠিক, আপনি যে এতটা সুন্দরী হবেন সেটা আমি কখনো কল্পনাও করিনি!”

ফারহিন দ্রুত ফিয়ারার মাথায় চাটি মেরে থামিয়ে দিলো ওকে, আনাবিয়া হেসে উঠলো। ফারহিন লজ্জা পেয়ে বলল,
“ওর কথায় কিছু মনে করবেন না শেহজাদী, ও একটু বেশি বকে।”
ফারহিনের কথায় অসন্তুষ্ট হলো ফিয়ারা। ঠোঁট বেকিয়ে তাকিয়ে রইলো ও নিচের দিকে।
ফারিশ নওয়াসের প্রথম স্ত্রীর সন্তান। ফারিশের মা মারা যাবার পর নওয়াস বিয়ে করেছিলেন আবার, এই দুই মেয়ে সেই স্ত্রীরই।
ফারিশ বয়সে বড় ওদের থেকে অনেক। মেয়েদুটোর বয়স বিশ থেকে পঁচিশের ভেতর। অন্যদিকে ফারিশের বয়স এখন প্রায় ষাটের কাছাকাছি। আনাবিয়ার থেকে ফারিশ প্রায় বছর বিশের বড়। মেয়েদুটো ওর মধ্য বয়সের।
ফিয়ারা কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে আবারও কৌতুহল পূর্ণ গলায় শুধালো,
“শেহজাদী, ভাইয়ার থেকে শুনেছি আপনি নাকি কুমির পালেন? সত্যিই? ও আপনাকে কামড়ে দেয়না?”
ওর ছেলেমানুষী প্রশ্নে মিষ্টি করে হাসলো আনাবিয়া, দুদিকে মাথা নেড়ে বলে উঠলো,
“না, ও অনেক শান্তশিষ্ট।”

“জানেন শেহজাদী, ফারিশ ভাইয়া তো বিয়েই করতে চাইছিলেননা, এত জন মিলে আমরা এতবার করে বললাম কিন্তু তিনি কিছুতেই বিয়ে করবেননা!
উনি যে এখন বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন এটাই অনেক! কত্ত সুন্দর, মিষ্টি দেখতে মেয়েটা কিন্তু ফারিশ ভাইজানের তার প্রতি কোনো ইন্টারেস্টই নেই! ওনার মুখে সারাটাক্ষণ শুধুমাত্র আপনা…”
ফিয়ারা আরও কিছু বলে ফেলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ফারহিনের হাতের চিমটি খেয়ে থেমে গেলো ও। এমন সময় বাইরে থেকে ফারহিনের উদ্দ্যেশ্যে কেউ বলে উঠলো বাইরে বের হতে।
ফারহিন নিজে না গিয়ে ফিয়ারাকে পাঠিয়ে দিলো, ও এই জায়গা থেকে সরলে সমস্যা। ফিয়ারা কোথায় কি বেফাঁস কথাবার্তা বলে দেয় তার কোনো ইয়ত্তা নেই, মাথামোটা মেয়েটার জন্য তখন বিপদে ওদের সবাইকে পড়তে হবে৷
ওদের ফারিশ ভাইজান যে শেহজাদীর প্রেমে এক প্রকার পাগল সেটা ওদের পরিবার, আত্মীয়স্বজন কারোরই জানতে বাকি নেই! জন্মের পর বুঝতে শিখলে ধরে ফারিশ ভাইজানের মুখে এই একটি নারীর কথাই সর্বক্ষণ শুনে গেছে ওরা, শেহজাদী।

যাকে কখনো নাম ধরে সম্বোধন করেননি তিনি, সারাজীবন শেহজাদিই বলে গেছেন।
কিন্তু সে যে অন্যকারো স্ত্রী, সেটাও যে সে কারো নয়, স্বয়ং বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের! যে দেমিয়ান শব্দটা শোনা মাত্রই বুকে কাঁপন ধরে যায় সকলের!
ফিয়ারা কিয়ৎক্ষণ বাদে ফিরে এসে ফারহিনকে নিচু স্বরে বলল কিছু একটা। ফারহিন শুনে আনাবিয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“আপনার আর হিজ ম্যাজেস্টির জন্য কামরা প্রস্তুত হয়ে গেছে শেহজাদী, হিজ ম্যাজেস্টি ডেকে পাঠিয়েছেন আপনাকে।”

আনাবিয়া উঠে দাঁড়ালো, তারপর ফিয়ারার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর দু আঙুলে ওর চোয়াল টিপে দিয়ে বলল,
“তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে ফিয়ারা। কিন্তু কথার কোথায় লাগাম টানতে হয় সেটা শিখে নিও দ্রুত, নইলে কখন কোথায় কিভাবে বিপদে পড়ে যাবে নিজেও টের পাবেনা, ঠিক আছে?”
বলে মিষ্টি করে হাসলো আনাবিয়া, তারপর এগোলো সামনের দিকে। আনাবিয়া কামরা থেকে বের হয়ে চলে যেতেই ফারহিন কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসালো ফিয়ারার গালে, তারপর ঝাঝিয়ে বলে উঠলো,
“কোথায় কার সামনে কি বলতে হয় এটা কবে শিখবি তুই? উনি কে সেটা ভুলে যাচ্ছিস? হিজ ম্যাজেস্টির বিবাহিতা স্ত্রী উনি, নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের ওয়াইফ!

উনি নিজেও একজন দেমিয়ান এটা ভুলে যাসনা, দেমিয়ানদের শিরায় শিরায় খুনের নেশা! আজ তোর বেফাঁস কথাবার্তার জন্য যদি ফারিশ ভাইজানের কিছু হয় তবে সে দ্বায় কে নিবে? তুই নিবি?”
“উনি এই সামান্য কথার জন্য ফারিশ ভাইজানের ক্ষতি করবেন কেন আপা? আর উনি যদি হিজ ম্যাজেস্টিকে এ কথা না জানান তবে তো উনি কিছুই জানতে পারবেন না, তাই না? তুমি শুধু শুধুই আমাকে মারলে আপা। আমি তো মিথ্যা কথা বলিনি কোনো!”

চোয়ালে হাত দিয়ে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো ফিয়ারা। ফারহিন দ্বিগুণ তেজে বলে উঠলো,
“দেমিয়ান ওনারা, দেমিয়ান! জানিস তুই দেমিয়ানদের ইতিহাস? দেমিয়ানের শেহজাদীরা যতই সুন্দরী, মায়াবিনী হোক না কেন এরা প্রয়োজন পড়লে কতটা ভয়ঙ্কর আর নৃশংস হতে পারে জানিস তুই?
উনি চাইলে এই মুহুর্তে তোর জিভ টেনে ছিড়ে ফেলতে পারতেন! আজ শুধু নওয়াস জাবিনের মেয়ে বলে বেচে গেলি!

দেমিয়ানের শেহজাদীরা জন্মগত ভাবেই প্রচন্ড প্রচন্ড কনজার্ভেটিভ হন, ওনাদের চরিত্রের সাথে বাইরের কাউকে মিলিয়ে কথা বলা মানে জান খোয়ানো! আজ যদি হিজ ম্যাজেস্টির কানে উনি তোর বলা কথগুলোা তুলেন তখন কি হবে জানিস তুই? আমরা আমাদের ভেতরে ফারিশ ভাইজান আর শেহজাদীকে নিয়ে গসিপ করি জানলে উনি কি করবেন তোর ধারণা আছে কোনো? হিজ ম্যাজেস্টি ওনার ব্যাপারে কতটা পজেসিভ জানিস না তুই?”
রক্তচক্ষু নিয়ে ধমকে বলল ফারহিন। ফিয়ারা কেঁদে ফেললো ফারহিনের ধমকে। ফারহিন ক্রোধ আর বিরক্তির দৃষ্টিতে ওর দিকে একবার তাকিয়ে হেটে এগোলো সামনের দিকে। এই মেয়েকে ও পরে দেখে নেবে৷

দরজা ঠেলে আনাবিয়া ঢুকলো ওদের জন্য প্রস্তুত করা কামরায়। মীর আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলো ওর জন্য। আনাবিয়া ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলো। মীর ওকে দেখে ওর কাছে এগিয়ে এলো। ওকে দুহাতে আলতো করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ওর কপালে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে বলে উঠলো,
“তুমি এখানে বসে বিশ্রাম নাও, আমি জায়ান ভাইজানের সাথে কথা বলে আসি। ফিরে আসবো দ্রুতই।”
জায়ানের নাম শুনেই খুশি খুশি হয়ে উঠলো আনাবিয়ার চেহারাটা, ও উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
“জায়ান চাচাজান এসে পৌছেছেন? আমি দেখা করবোনা ওনার সাথে?”
“করবেই তো, কিন্তু পরে। এখন সেখানে অনেক লোকজন, আমার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। লোকজন ফাকা হলে তোমাকে ডেকে নেবো আমি, তখন দেখা করে নিও। হবে?”
শেষোক্ত প্রশ্নটা স্নিগ্ধ গলায় ভ্রু তুলে শুধালো মীর। আনাবিয়া ওর প্রশ্নের উত্তরে ওপর নিচে মাথা নাড়লো। মীর ওর কপালে আর একবার ঠোঁট ছুইয়ে এগোলো বাইরের দিকে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ও চলে গেলো জায়ানদের সাথে দেখা করতে।

মীর চলে গেলে আনাবিয়া এসে বসলো বিছানায়। গায়ের অ্যাক্সেসরিজ গুলো খুব অসহ্য লাগছে। লেহাঙ্গার সাথে মিলিয়ে আজ ভারী গহনা পরেছে ও, এত ভারী ভারী গহনা পরার অভ্যাস নেই ওর। এখন এগুলো খুলে ফেলার প্রয়োজন, নইলে দম আটকে আসছে ওর!
কামরায় থাকা মিররের সামনে গিয়ে আনাবিয়া একে একে খুলে ফেললো ওর গলা, কান, কোমর, হাতের সমস্ত অ্যাক্সেসরিজ গুলো। খোপা করা চুলগুলোকে একটু বিরতি দেওয়া প্রয়োজন, চুলগুলো খোপা থেকে ছাড়াতে নিলো ও। তখনি দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো ফারিশ!
মিররে ফারিশের চেহারাটা দেখা মাত্রই চমকালো আনাবিয়া, নিজের অপ্রস্তুত হয়ে থাকা পোশাকটা দ্রুত হাতে ঠিক করে নিয়ে ওড়না দিয়ে দ্রুত ঢেকে নিলো নিজের শরীর। পেছনে ফিরে অপ্রস্তুত কন্ঠে ও শুধালো,
“রুশি ভাইয়া, আপনি হঠাৎ এখানে?”

“আপনি এসেছেন শুনে আপনাকে দেখতে এসেছি শেহজাদী!”
আনাবিয়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাধো বাধো গলায় বলল ফারিশ। আনাবিয়া ভ্রু জোড়া বিরক্তিতে কুচকে নিয়ে বলে উঠলো,
“ভেতরে আসার আগে অনুমতি তো নিবেন!”
ফারিশ প্রতিউত্তরে কিছুই বলল না, আনাবিয়ার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে এগিয়ে এলো ও দুকদম, মুখে বলে উঠলো,
“আপনাকে আজ প্রচন্ড সুন্দর দেখাচ্ছে শেহজাদী!”

আনাবিয়া ঢোক গিললো, মীর শুনছে সব, সব! ফারিশ আজ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই অনুমতি ছাড়াই ওর কামরায় ঢুকে পড়েছে আর এখন এসমস্ত কথা বলছে! ফারিশের অস্বাভাবিক দৃষ্টি দেখে আনাবিয়ার বুক কাঁপলো, মীর একে এভাবে তাকাতে দেখলে সত্যি সত্যিই আজ শেষ করে ফেলবে একে!
আনাবিয়া ওকে কামরা থেকে দ্রুত বের করতে কড়া গলায় বলে উঠলো,
“ফারিশ, একটু পরেই আপনার বিয়ে। আপনি এখান থেকে এখনি বেরিয়ে যান, গিয়ে নিজের বিয়ের প্রস্তুতি নিন।”
ফারিশ গেলোনা, আনাবিয়ার দিকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মৃদু, অসহায় কন্ঠে ও বলল,
“শেহজাদী! আমি ওই মেয়েটাকে কোনোদিনও ভালবাসতে পারবোনা জানেন? কারণ আমার মন জুড়ে শুধু একটি মাত্র নারী অবয়বের বিচরণ, আর সেটা আপনি, শুধুমাত্র আপনি। আর কেউ নয়!
আমি আপনাকে ছাড়া আর কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারবোনা শেহজাদী! আমি ওই মেয়েটাকে আজ বিয়ে করবো ঠিকই কিন্তু তাকে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে নিজের হৃদয়ে স্থান দিতে পারবোনা কখনো! সে স্থানটা আমি ইতোমধ্যেই আপনাকে দিয়ে দিয়েছি শেহজাদী……”

“ফারিশ! মুখ সামলে কথা বলুন। ভুলে যাবেন না আপনার সামনে বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের বিবাহিতা স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। আপনি এই মুহুর্তে এই কামরা থেকে বেরিয়ে যান!”
বজ্রকঠিন গলায় ধমকে বলে উঠলো আনাবিয়া। কিন্তু ফারিশের কোনো ভাবান্তর হলো না আজ! নিজের বিষাদে পরিপূর্ণ দৃষ্টিদ্বয় আনাবিয়ার শুভ্র মুখখানার ওপর ফেলে এগিয়ে এলো ও দুকদম, মৃদুস্বরে আবারও বলল,
“আপনার জন্য আমার অনুভূতি এক বিন্দু পরিমাণও মিথ্যা নয় শেহজাদী! আপনি যদি আমার স্ত্রী হতেন তবে আমি হিজ ম্যাজেস্টির মতো আপনাকে ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ করতে না পারলেও ভালোবাসায় একটা অনু পরিমাণ কমতিও রাখতাম না কখনো! আদর ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখতাম আপনাকে সারাটাজীবন……”

ফারিশের কথার মাঝেই বাইরে শোনা গেলো কারো প্রচন্ড ভারী, হিংস্র পদধ্বনি! আর তার পরমুহূর্তেই একটা বিশাল বজ্রাঘাতে কামরার দরজা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকলো মীর!
ওকে দেখা মাত্রই ভড়কাল আনাবিয়া! প্রচন্ড ক্রোধে স্পষ্ট হয়ে ওঠা ওর কপালের শিরা, আগুনের লেলিহান শিখার ন্যায় জ্বলে থাকা হিংস্র পশুর ন্যায় শাণিত দৃষ্টি, ক্রোধে শক্ত হয়ে কুচকে থাকা ভ্রুদ্বয়, দাঁতের সাথে পিষে থাকা দাঁত এ সমস্ত কিছুই বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিলো আনাবিয়ার, আজ ও ফারিশকে ঠিক কি করবে সেটা ভেবেই আতঙ্কিত হয়ে উঠলো ও!

শব্দ শুনে চমকে দরজার দিকে তাকালো ফারিশ, আর তাকানো মাত্রই ঝড়ো গতিতে একটা বিরাট বিশাল বজ্রমুষ্ঠির আঘাত এসে পড়লো ওর মুখের ওপর! মুহুর্তেই মাড়ি থেকে দুটো দাঁত ছিটকে বেরিয়ে গেলো বাইরে। ফারিশ ছিটকে গিয়ে পড়লো বিছনার এক কোণায়। কাঠের সাথে আঘাত লেগে ফেটে গেলো ওর কপাল, সেখান দিয়ে ফিনকি দিয়ে পড়তে শুরু করলো রক্ত! ঠোটের কোণ ফেটে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো সেখান থেকে কল কল করে।
মীর আসন ছেড়ে হঠাৎ করেই ক্রোধান্বিত চেহারায় ক্ষীপ্র পায়ে উঠে চলে আসায় নওয়াস জায়ান সহ বাকি দুই দ্বীপের কন্ট্রোলারও ছুটে এসেছিলেন ওর পেছন পেছন। এসেই এই কামরায় ফারিশকে দেখা অবাকই হলেন তারা।
নওয়াস ভড়কালেন, একটা মাত্র ছেলে ওর! জায়ানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। জায়ান নিজেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন! ফারিশকে তো কিছুক্ষণ আগেও ওর কামরায় দেখে এলেন, এই ছেলে সুযোগ পাওয়া মাত্রই এখানে চলে এসেছে।

বিছানার ওপর বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ফারিশের নিকট ঝড়ো পায়ে এগিয়ে গেলো মীর, আর তার পরেই ফারিশের গলা ধরে উঁচু করে নিয়ে এসে ঠেসে ধরলো পাশের দেয়ালের সাথে! দাঁতে দাঁত পিষে রেখে ফারিশের গলার ওপর ও একটু একটু করে বাড়াতে লাগলো চাপ!
ওর ইস্পাত-দৃঢ় হাতের থাবার ভেতরে ফারিশের গলা আটকে যেতে লাগলো, দম বেরিয়ে যেতে লাগলো ওর ক্রমে ক্রমে, চোখ জোড়া বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো, শ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতে শুরু করলো ও! পা জোড়া শূণ্যে, হাত জোড়া মীরের কঠোর হাতের মুষ্ঠি থেকে নিজের গলা ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যাস্ত!
চোখের মণী উলটে যেতে লাগলো ফারিশের, জিভ বেরিয়ে আসলো খানিকটা, মুখের দুপাশ থেকে কষ বেরিয়ে আসলো! নওয়াস ছেলের এমন অবস্থা দেখে আর্তনাদ করে উঠে ছুটে এসে পড়লো মীরের পায়ে, উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে ও মিনতিপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,

“ইয়োর ম্যাজেস্টি! আমার ফারিশকে ছেড়ে দিন ইয়োর ম্যাজেস্টি, এবারের মতো ক্ষমা করে দিন ওকে। ও আর কখনো আপনার সামনেও যাবেনা, শেহজাদীর সামনে তো না-ই! ক্ষমা করুন ইয়োর ম্যাজেস্টি, এবারের মতো ছেড়ে দিন আমার ছেলেটাকে, আমি ওয়াদা করছি ও আর কোনো দিন শেহিজাদীর নাম মুখেও নিবেনা! ক্ষমা করুন ইয়োর ম্যাজেস্টি, ছেড়ে দিন আমার ফারিশকে!”
পেছনে দাঁড়ানো জায়ান, নাহিয়ান, ইসফান তিনজনেই ছুটে এলো তড়িৎ পায়ে। আতঙ্ক এসে ভর করলো ওদের বুকে। মীরের হাত থেকে ফারিশকে ছাড়ানোর ক্ষমতা ওদের নেই, মিনতিপূর্ণ সুরে ওরা অনুরোধ করতে শুরু করলো ফারিশকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মীরের খেয়াল নেই কোনোদিকে, ওর তৃপ্ত দৃষ্টি ফারিশের দম বেরিয়ে যাওয়া প্রচন্ড যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ চেহারাটার দিকে!

আনাবিয়া দাঁড়িয়ে ছিলো এক পাশে চুপচাপ, ও ভেবেছিলো নওয়াস বা জায়ান চাচাজনের অনুরোধে মীর ছেড়ে দেবে ফারিশকে, কিন্তু মীরের ছেড়ে দেওয়ার কোনো নাম নেই। উত্তরোত্তর ওর হাতের চাপ বেড়েই চলেছে!
আনাবিয়া পাশ থেকে এবার এগিয়ে এলো দ্রুত পায়ে, মীরের পাশে দাঁড়িয়ে এক হাতে ওকে জড়িয়ে নিয়ে অন্য হাতে ফারিশের গলা ধরে রাখা হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে ও জোর গলায় বলে উঠলো,
“মীর, ছেড়ে দাও ওকে৷ মরে যাবে ও!”

কিন্তু আনাবিয়ার বলা কথাগুলো মীরের কর্ণকুহরে পৌছালোনা! দাঁতের সাথে দাঁত আরও হিংস্র ভাবে চেপে নিয়ে ফারিশের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে যাওয়া চেহারাটার দিকে তাকয়ে রইলো ও!
ফারিশের হাতপা অসাড় হয়ে আসলো, চোখের মণি উলটে গেলো আরও! এতক্ষণ ওর গলা ধরে রাখা মীরের বজ্রমুষ্ঠি কে প্রতিহত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকা হাত জোড়া শিথিল হয়ে এলো, মীরের ইস্পাত-দৃঢ় হাতের ওপর থেকে সেগুলো দম হারিয়ে অভিকর্ষের টানে পড়ে গেলো নিচে
মীরের ছাড়ার কোনো লক্ষণ না দেখে ভড়কালো আনাবিয়া, দ্রুত পায়ে মীরের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ও দুহাতে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো ওকে পেছন থেকে, তারপর অনুরোধের সুরে বলল,
“মীর ছেড়ে দাও ওকে! বিয়ে ওর একটু পর, প্লিজ ছেড়ে দাও ওকে! চাচাজান তো বললেন ও আর কখনো তোমার সামনেও আসবনা, ছেড়ে দাও ফারিশকে প্লিজ!”

সেই মুহুর্তেই ওকে ছেড়ে দিলো মীর। ওর ক্রোধান্বিত ভারী নিশ্বাস তখনও প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো কামরার দেয়ালে দেয়ালে! শূন্যে ভেসে থাকা ফারিশ ধাম করে পড়ে গেলো মেঝেতে। নওয়াস দ্রুত গতিতে গিয়ে আগলে নিলো ফারিশকে।
কপাল, ঠোটের কোণ, আর মুখের ভেতর থেকে বের হওয়া রক্তে ভিজে গিয়েছে ওর গায়ের সোনালী শেরওয়ানি, মুখ দিয়ে স্রোতের মতো বের হচ্ছে রক্ত!
নওয়াস ফুপিয়ে উঠল, আনাবিয়া মীরকে ছেড়ে নওয়াসের সামনে এসে দ্রুত গলায় বলে উঠলো,
“চাচাজান, ওকে নিয়ে দ্রুত হেকিমের কাছে যান, এখনি যান এখান থেকে!”

মীরের ওপর ওর বিশ্বাস নেই, হয়তো এক্ষুণি আবার রাগ সামলাতে না পেরে ফারিশের ওপর হামলা করে বসবে ও! পেছন থেকে নাহিয়ান আর ইসফান এসে নওয়াসের সাথে ধরাধরি করে ফারিশকে নিয়ে চলে গেলো বাইরে। লোকচক্ষু আড়াল করে ফারিশকে যতদ্রুত সম্ভব হেকিমের কাছে নিয়ে সুস্থ করতে হবে!
জায়ান তখনও রইলো মীরের সাথে, রাগের মাথায় আবার উল্টোপাল্টা কিছু যেন করে না বসে সেটার খেয়াল রাখতে। মীর হাত জোড়া ঝাড়া দিয়ে আনাবিয়ার দিকে ফিরে কড়া গলায় বলে উঠলো,
“প্রাসাদে চলো!”
জায়ান তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে ইতস্তত করে বলল,

“ইয়োর ম্যাজেস্টি! এখনি চলে যাবেন না প্লিজ! আপনি এখন শেহজাদীকে নিয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে সেটা মানুষের চোখে পড়বে। বিয়ে পড়ানো হয়নি এখনো, এ অবস্থায় বিয়ে বাড়ি থেকে সকলের সামনে দিয়ে এভাবে চলে গেলে লোকে বুঝে যাবে যে কোনো না কোনো সমস্যা হয়েছে। আর যদি এই ব্যাপারগুলো কোনোভাবে জানাজানি হয়ে যায় তবে সেটা প্রচন্ড দৃষ্টিকটু হবে ইয়োর ম্যাজেস্টি!
দয়া করে নিজেকে এখনকার মতো শান্ত করুন ইয়োর ম্যাজেস্টি! বিয়ে টা হয়ে গেলেই না হয় চলে যাবেন!”
মীর এতক্ষণ জায়ানের দিক থেকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলো৷ জায়ানের কথায় ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না! আনাবিয়া জায়ানের দিকে তাকিয়ে ইশারা দিলো বাইরে চলে যাওয়ার জন্য। বাকিটা ও সামলে নেওয়ার চেষ্টা করবে।
জায়ান মীরের দিকে আর একবার দৃষ্টি দিয়ে ধীর পায়ে চলে গেলো বাইরে। মীর তখনো হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে, রাগ পড়েনি ওর, ইচ্ছে করছে ফারিশটাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে, ওর সাহস কত বড়ো!
জায়ান চলে যেতেই মীর আনাবিয়াকে বলল,

“প্রস্তুত হও শিনজো, আমরা প্রাসাদে ফিরবো।”
আনাবিয়া আবারও ওর কাছে এগিয়ে এসে ওর হাতটা নিজের হাতের ভেতর নিয়ে অনুরোধের সুরে বলল,
“শুনো, রাগারাগি কোরোনা প্লিজ। এবারের মতো মাফ করে দাও ওকে! নওয়াস চাচাজান তো বললেন ফারিশ আর কখনো এরকমটা করবে না। এখনও বিয়ে পড়ানো হয়নি ওদের৷ এই মুহুর্তে বিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলে ব্যাপারটক প্রচন্ড দৃষ্টিকটু হবে মীর, বোঝার চেষ্টা করো!”

মীর বুঝতে চাইলোনা কিছু, রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে ওর! আনাবিয়া ভাবসাব ভালোনা দেখে মীরের বাহু ধরে ওকে টেনে এনে বসালো বিছানার ওপর, তারপর ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওর মুখখানা নিজের দুহাতে ধরে বলল,
“এবারের মতো মাথা ঠান্ডা করো মীরি, ও আর এমন করবেনা। প্লিজ মীরি!”
“মাথা ঠান্ডা হচ্ছেনা আমার! ওর সাহস কিভাবে হয় তোমার সাথে এভাবে কথা বলার! ওকে এর আগে কতবার ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে ও কি ভুলে গেছে? ওকে আমার এখন এখানে ফেলে টুকরো টুকরো করতে ইচ্ছে করছে শিনজো!”

দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে বলল মীর। আনাবিয়া মীরের চুলের ভাজে হাত বুলিয়ে, ওর চোয়ালে হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে নরম গলায় বলে উঠলো,
“এবারের মতো ওকে মাফ করে দাও মীরি। নওয়াস চাচাজানক্ব তুমি কতো ভালোবাসনা বলো! ফারিশের কিছু হলে ওনার কি হবে তুমি ভাবতে পারছো? মাথা ঠান্ডা করো মীরি। কুল, বি কুল!”
মীর ওর দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে ক্রোধে পরিপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“মাথা ঠান্ডা করতে পারবোনা, ঠান্ডা করে দিতে হবে।”

আনাবিয়া ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো একটা। ওর মীরের সমস্ত সমস্যার ওই একটাই সমাধান, আদর পেলে সে সব ভুলে যায়। আনাবিয়া ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎই হ্যাচকা টানে খুলে ফেললো ওর লেহেঙ্গার ওপরের অংশ।
ওর উন্মুক্ত বক্ষে দৃষ্টি যেতেই মীরের ক্রোধ মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই, ক্ষীপ্র গতিতে আনাবিয়াকে টেনে নিলো ও নিজের কাছে, তারপর মুখ ডুবালো আনাবিয়ার সুডৌল বক্ষ বিভাজিকার মধ্যিখানে৷

ফারিশের বিয়ে হয়ে গেছে খানিকক্ষণ আগে। লোকজনের দৃষ্টি এড়িয়ে হেকিমের থেকে কোনো রকমে চিকিৎসা নিয়ে বিয়ে পড়ানো হয়েছে ওর।
মীর কামরা থেকে বেরই হয়নি, আনাবিয়াকেও বের হতে দেয়নি। সারাটা সময় ধরে নিজের মুড ঠিক করেছে। আর এরপর বিয়ে পড়ানো হলে না খেয়েই আনাবিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ও নওয়াসের বাড়ি থেকে, তারপর গাড়িতে উঠেই রওনা দিয়েছে ওদের বিয়ের সময়ে দেনমোহর বাবদ আনাবিয়াকে দেওয়া রাজমহল টার দিকে।
আরমানকে গার্ডদের সাথে প্রাসাদে পাঠিয়ে দিয়ে মীর নিজে ড্রাইভিং করে এগোচ্ছে ডাস্কমায়ার জঙ্গলের দিকে। ওর পাশের সিটে বসে আছে আনাবিয়া। মুখ শুকনো ওর সকালের পর থেকে পেটে কিছুই পড়েনি, ক্ষিদেতে এখন পেটের ভেতর ইদুর দৌড়াচ্ছে ওর৷
মীর একহাতে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে তাকালো একবার আনাবিয়ার দিকে৷ ওর শুকনো মুখ দেখে হাত বাড়িয়ে ওর থুতনি স্পর্শ করে নরম গলায় শুধালো,

“ক্ষিদে পেয়েছে?”
আনাবিয়া শুকনো মুখে ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো ওপর নিচে। মীর অল্প হাসলো তারপর বাড়িয়ে দিলো গাড়ির গতি।
ডাস্কমায়ার নামক বিশাল জঙ্গলটার ভেতর দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলতে লাগলো ওর কালো রঙা গাড়িটা। আর তার বেশ কিছু মুহুর্ত পর এসে ওরা থামলো এক বিরাট রাজবাড়ির বিশাল ফটকের সম্মুখে৷
আনাবিয়া এই প্রথমবারের মতো রাজবাড়িটায় এসেছে। এই বিশ বছরে ও একটিবারের জন্যেও শিরো মিদোরি ছেড়ে বের হয়নি। সমস্ত দিনগুলো কাটিয়ে দিয়েছে রেড জোন ঘুরে, প্রাসাদে নিজের কামরয়া আর বাচ্চাদের সাথে।
অনেক অনেক গুলো দিন পর আজ ওর খুব খুব ভালো লাগছে। রাজবাড়ীটার চেহারা দেখা মাত্রই ওর এতক্ষণের তাড়া করে বেড়ানো ক্ষিদেটা উড়ে গেলো। খুশি এসে হানা দিলো ওর চেহারায়৷

বাইরে গাড়ির শব্দ পেয়ে ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো এতদিন ধরে রাজবাড়ীটার দেখাশোনা করা দাসদাসী গুলো। হঠাৎ করে, কোনো আগমনী বার্তা ছাড়াই ডাস্কমায়ারের ভেতর স্বয়ং বাদশাহর উপস্থিতি পেয়ে আজ ত্রাস লেগে গেলো ওদের সকলের। যে যার স্থান থেকে ছোটাছুটি শুরু করলো। এতদিন এই রাজবাড়ি দেখা শোনার সাথে সাথে নিজেরাও খুব আরাম আয়েশেই দিনাতিপাত করেছে, আর আজ হঠাৎ করে মালকিন চলে আসায় ওরা হতবাক।
দাসগুলো কেউ সামনে এলোনা, দাসীদের কয়েকজন এগিয়ে এলো গাড়ির কাছে। এসে আনুগত্যের সাথে দাঁড়িয়ে রইলো, কি করবে বুঝে উঠতে পারলোনা ওরা৷

মীর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো গাড়ির ভেতর থেকে। দাসীগুলো ওকে দেখা মাত্রই আনত দৃষ্টিতে সটান দাঁড়িয়ে গেলো। আবার মীরকে দেখার লোভও সামলাতে পারলোনা। দুরুদুরু কাঁপতে লাগলো তাদের বুক। আড়চোখে দৃষ্টি উঁচিয়ে ও চাইলো মীরের বিশাল দেহাবয়বের দিকে।
মীর এবার ঘুরে এসে খুলে দিলো আনাবিয়ার পাশের দরজাটা, আর তারপরই গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মেরুণ রঙা লেহাঙ্গায় আবৃত আনাবিয়া।
আনাবিয়াকে দেখা মাত্রই হতভম্ব হয়ে গেলো দাসী গুলো! বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে ওরা তাকিয়ে রইল আনাবিয়ার দিকে, ভুলে গেলো দৃষ্টি নত করার কথা।
সেই মুহুর্তেই বাড়ির ভেতর থেকে লাঠি ভর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রাজবাড়ির দাসীদের প্রধান ষাটোর্ধ জুলেখা ফারহাত। মীর তাকে দেখা মাত্রই বলে উঠলো,

“কেমন আছো জুলেখা?”
জুলেখা ফারহাত মিষ্টি হাসলেন, ধীর পায়ে হেটে এগিয়ে এসে তিনি উত্তর দিলেন,
“আলনার দোয়ায় ভালো আছি ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনি সুস্থ আছেন দেখে খুবই ভালো লাগছে। আপনারা আসুন ভেতরে, আপনাদের কামরা তৈরি আছে৷”
জুলেখা ফারহাত এবার এগোলো আনাবিয়ার দিকে, অবাক চোখে আনাবিয়ার কাছে এসে সে দৃষ্টি নত করে বলল,
“আপনাকে স্বাগতম শেহজাদী! আপনার জন্মের সময়েই আপনাকে আমি প্রথমবার দেখেছিলাম, যেদিন হিজ ম্যাজেস্টি আপনাকে আপনার মায়ের পেট থেকে টেনে বের করে এনে ছিলেন সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলাম আমিও। আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো সেদিন আপনাকে প্রথম দেখার, আর তারপর এই দ্বিতীয়বার আমি আপনাকে দেখছি।”

আনাবিয়া মিষ্টি হাসলো, ওর জন্মের সময়কার সমস্ত কিছুই ওর কাছে ভালো লাগে খুব ঝুব! কেউ ওকে ওর ছোটবেলার স্মৃতি গুলো মনে করিয়ে দিলে, ওর জন্মের সময়কার স্মৃতিচারণ কারলে ওর তাকে খুব আপন আপন মনে হয়।
জুলেখা প্রচন্ড খুশি মনে স্পর্শ করলো আনাবিয়ার হাতখানা, তারপর ওকে ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আসুন শেহজাদী, ভেতরে আসুন!”
আনাবিয়া জুলেখার এমন আগ্রহে পিছু ফিরে মীরের দিকে তাকালো একবার, ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বোঝালো সে এই বৃদ্ধার আতিথেয়তায় ভালোমতো ফেসে গেছে।
মীর মিষ্টি হেসে ওকে জুলেখার সাথে ভেতরে চলে যেতে ইশারা করলো। তারপর গাড়িটা রাখতে গেলো রাজবাড়ীর গ্যারাজে৷
আনাবিয়া ফটক পার হয়ে ঢুকলো ভেতরে।

বিশাল রাজবাড়িটা শিরো মিদোরির প্রাসাদের মতোই সাদা রঙা মার্বেল পাথরে তৈরি। বাড়ির প্রবেশ পথের বিরাট দরজাটার ঠিক ওপরে দেমিয়ান রাজ পরিবারের প্রতীক হিসেবে বসানো সোলারা রিগালিস নামক এক নক্ষত্রের চিহ্ন। এই একই চিহ্ন শিরো মিদোরির প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরের বাইরের দিকেও খোদাই করা।
আনাবিয়া মুগ্ধ হলো। মীর শিরো মিদোরির প্রাসাদের মতোই সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে ওর রাজবাড়িটি। দরজা ঠেলে আনাবিয়াকে ভেতরে যাওয়ার জায়গা করে দিলো দরজার পাশে দাড়ানো দাসী গুলো।
আনাবিয়া ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ চোখে দেখতে লেগে গেলো সমস্ত কিছু। নিচতলার বিরাট হলরুমের মধ্যিখান দিয়ে উপরের তলায় উঠে গেছে বিশাল রাজকীয় সিঁড়ি, তার ধাপে ধাপে লাল রঙা মখমলের কার্পেট বিছানো।
হলরুমের সিলিংয়ে ঝোলানো সোনা রঙা ক্রিস্টালের বিরাট ঝাড়বাতি, ভেতরে সাদা রঙা দেয়ালের ওপর তার স্বর্ণালি আলো পড়ে ঝলমলিয়ে উঠে আলোকিত করে ফেলেছে সমস্ত বাড়িটা।

জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসা বাতাসে মৃদুমন্দ গতিতে উড়ছে জানালার মখমলি পর্দা গুলো।
চন্দনকাঠের তৈরি স্বর্ণবাধানো আসবাবপত্র গুলো সুসজ্জিত হয়ে অবস্থান করছে যার যার নির্দিষ্ট স্থানে।
জুলেখা আনাবিয়াকে নিয়ে এলো ওর আর মীরের জন্য তৈরি শয়নকক্ষে। মৃদু পায়ে হেটে কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আনাবিয়া, আর ঢুকতেই ওর চোখে পড়লো এক বিলাসবহুল শয্যা।
সাদা রঙা নরম সিল্কের চাদরের ওপর সোনালি সুতোর সুক্ষ্ম নকশা করা বিছানা পাতা সেখানে। বালিশগুলোও সাদা, মখমলি আভা ছড়িয়ে নিজেদের আরামদায়িকতার খবর ওরা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা কক্ষে।
জুলেখা আনাবিয়ার দিকে ঝুকে এসে বললেন,

“এই বিছানাটা হিজ ম্যাজেস্টি নিজে তদারকি করে বানিয়েছেন তার আর আপনার জন্য, শক্ত পোক্ত করে!”
বলেই আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন তিনি। আনাবিয়ার লজ্জা লাগলো, শয়তান লোকটার জন্য কারো আর জানতে বাকি নেই যে সে কোন জিনিসটা নিয়ে বেশি খুতখুত করে!
ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কামরার ডান দিকে নজর দিলো আনাবিয়া, দেয়ালের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে একটা বিরাট আয়না, কিনারাগুলো মুক্ত বাধানো। আনাবিয়া আগ্রহী পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। আয়নাতে সমস্ত বিছানাটা প্রতিফলিত হচ্ছে।
মুহুর্তেই লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠলো ওর। এই লোকটা ইচ্ছে করেই আয়নাটা এমন জায়গায় লাগিয়েছে, অসভ্য একটা!

আয়নার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ও জুলেখার দিকে ফিরে বলল,
“আমাকে ফ্রেশ হতে হবে জুলেখা, এই ভারী পোশাকে থাকতে আমার আর ভালো লাগছেনা৷”
জুলেখা ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো কামরার অপর পাশের দেয়ালের দিকে। তারপর দেয়ালের নির্দিষ্ট স্থানে আনাবিয়ার ডানহাত টা তুলে ধরে স্পর্শ করাতেই দেয়ালটা সরে গেলো অন্যপাশে। পর মুহুর্তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ঝকমকে আলো। আনাবিয়া কৌতুহলী পায়ে এগোলো ভেতরে।
জুলেখা বাহির থেকে বলল,

“ভেতরে আপনার প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু রাখা আছে শেহজাদী। ওখানে আমার বা অন্য কোনো দাসীর প্রবেশ সম্পুর্ন নিষেধ করে দিয়েছেন হিজ ম্যাজেস্টি, তাই আমি ভেতরে আসতে পারছিনা। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিন, আমি এখানেই আছি।”
আনাবিয়া জুলেখার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার ভেতরের দিকে পা বাড়ালো। দেয়ালটা আবার ফিরে এলো নিজের জায়গায়।
আনাবিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে এগোলো সামনের দিকে, এতকিছু মীর কবে করেছে ওর মাথায় এলোনা। এই লোকটা কিভাবে ওর সমস্ত প্রয়োজনকে মাথায় রাখে বুঝে আসেনা ওর। ওর চাইতেও ওর প্রয়োজন সম্পর্কে মীর বেশি জানে, বেশি ধারণা রাখে!
নিজের পরিপূর্ণ বিশাল ক্লজেটে পার হয়ে সামনে এগোলো আনাবিয়া, এগোতেই ওর চোখে পড়লো এক বিলাশবহুল রেস্টরুম।

ক্ষুদ্রক্ষুদ্র আলোক কণা বসানো ঝলমলে আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ও। চারপাশটা একবার মুগ্ধ চোখে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ও হাত লাগালো ওর লেহাঙ্গাটা খুলে ফেলার কাজে।
ওপরের অংশ খুলে ফেলে নিচের অংশ খোলার সময়েই ওর কোমরে পড়লো মীরের শক্তপোক্ত হাতের মৃদু স্পর্শ। আনাবিয়া চমকে তাকালো পেছন দিকে, মীর তখন ব্যাস্ত আনাবিয়ার লেহাঙ্গা খোলায়। খুলতে খুলতে ও বলে উঠলো,
“তোমাকে গোসল করিয়ে দেবো চলো। গোসল সেরেই খেতে হবে।”
আনাবিয়া আয়নার দিকে তাকালো আবার, তারপর মীরের দিকে দুকদম পেছনে সরে গিয়ে নিজের উন্মুক্ত পিঠটা ঠেকালো মীরের অনাবৃত বুকে। মীর লেহাঙ্গা খোলা বাদ দিয়ে দুহাতে আগলে নিলো আনাবিয়ার মসৃণ সরু কোমর, তারপর আয়নাতে আনাবিয়ার দিকে চেয়ে ওর মাথায় মাথা ঠেকিয়ে শুধালো,
“কি হয়েছে আমার শিনুর? মুখটা এমন লাগছে কেন?”
আনাবিয়া কিছু বললনা, কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো আয়নাতে ওরই দিকে তাকিয়ে থাকা মীরের চোখের দিকে। তারপর হঠাৎ করেই বলল,

“আমরা এখানে থাকি কিছুদিন?”
“তোমার যতদিন ইচ্ছা হয় ততদিনই থাকবো।”
বলে আনাবিয়ার চুলের ওপর দিয়ে মীর শব্দ করে চুমু খেলো একটা। আনাবিয়া একহাত উঁচিয়ে মীরের কাঁধ স্পর্শ করে আদুরে গলায় বলল,
“শুনোনা!”
“বলোনা প্রাণ আমার!”
আনাবিয়ার অনাবৃত কাঁধে ঠোঁট স্পর্শ করে আনাবিয়ার মতো করেই বলল মীর। স্নিগ্ধ হেসে আনাবিয়া মীরের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমরা বাইরে বেরোবে? ঠিক সাধারণ মানুষদের মতো করে? আমি ঘুরবো বাইরে, ঠিক স্বাভাবিক মানুষের মতো করে, তোমার সাথে। অন্য সবার মতো বাজার ঘুরবো, সবজি কিনবো, বাসায় ফিরবো, রান্না করবো দুজনে মিলে! করবে?

শেষোক্ত প্রশ্নটা ঘাড় ঘুরিয়ে মীরের দিকে চোখ উঁচিয়ে শুধালো আনাবিয়া। মীর ওর টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়ার ওপর আলতো করে একটা চুম্বন বসিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি যা চাইবে তাই হবে শিনজো! এখন গোসল দিয়ে নাও, গোসল শেষ করেই বেরোবো। হবে?”
আনাবিয়া উচ্ছসিত হয়ে মাথা নাড়ালো ওপর নিচে। মীর ওর হাসি মাখা মুখে আর একটা চুমু দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে গেলো বাথটাবের দিকে।

“আইস্ক্রিম খাবো মীরি!”
“বাইরের আইসক্রিম তুমি খেতে পারবেনা শিনু, তোমার পেট খারাপ করবে। প্রাসাদে ফিরে খেয়ো।”
“না! আমি এইখানের আইসক্রিমই খাবো, তুমি কিনে দাও!”
মাঝরাস্তায় জেদ ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো আনাবিয়া। সন্ধ্যা নেমে গেছে ঘন্টা দুই হলো, আনাবিয়ার আবদার রাখতে রাতের বেলা ওকে নিয়ে কুরো আহমারের শহরে ঘুরতে বেরিয়েছে মীর। পায়ে হেটে দুজনে এগোচ্ছিলো জনাকীর্ণ শহরের ফুটপাত ধরে। তখনি আইস্ক্রিম কার্ট দেখে আনাবিয়া দাঁড়িয়ে গেছে, তাকে আইস্ক্রিম কিনে দিতেই হবে।
সারাজীবন প্রাসাদের রয়্যাল কুকের তৈরি পিউরিফাইড খাবার খেয়ে খেয়ে সে অভ্যস্ত, হঠাৎ করে বাইরের খাবার খেলে যে ওর পেটে সইবেনা সেটা মীর ভালোভাবেই জানে। কিন্তু তার শিনু তো আর এসব বুঝেনা, বুঝাইলেও বুঝেনা, হুদাই চিল্লায়!

শেষ মেশ মীর সেখান থেকে আইস্ক্রিম কিনে দিলো আনাবিয়ার হাতে, আনাবিয়া বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে গেলো সাথে সাথে। উচ্ছসিত হয়ে আইস্ক্রিমের মাথায় জিভ দিয়ে অল্প অল্প করে লেহন করতে করতে সে এগোলো মীরের হাত ধরে।
পরনে ওর সাদা রঙা ট্রাউজার আর বেবি পিংকের হুডি, হুডির হুডটা মাথায় তুলে দেওয়া, সাদা রঙা চুলগুলো লুকিয়ে গেছে তাতে। কপালের ওপর কয়েকটি চুল এসে পড়েছে।
হুডির মাথার ওপর দুইটা খরগোশের কান। আনাবিয়ার হাটার সাথে সাথে তালে তালে দুলছে সে দুটো। মীর মাঝে মাঝেই সে দুটোকে টেনে দিচ্ছে, বাস্তব কানজোড়া টানতে না পারার অভাব ওর অবাস্তব কান জোড়া টেনে ও মিটিয়ে নিচ্ছে।

মীরের পরনে আপাদমস্তক কালো রঙা হুডি আর ট্রাউজার। আনাবিয়া জোর করে ওর গায়ের রঙের সাথে ম্যাচিং করে পরিয়ে দিয়েছে। এখন কোনটা হুডি আর কোনটা মীর সেটা চেনার উপায় নেই।
চোখ জোড়া কালো লেন্সে ঢেকে রাখায় ওকে বর্তমানে একটা চলমান খাম্বার মতো দেখাচ্ছে। আনাবিয়া মজা পাচ্ছে প্রচন্ড। কারণ রাস্তার লোকজন প্রথমে বিস্ময় নিয়ে দেখছে আনাবিয়াকে, পরক্ষণেই ওদের চোখ যাচ্ছে আনাবিয়ার পাশে হেটে চলা চলমান খাম্বার দিকে। আঁতকে উঠছে ওরা, কেউ কেউ ভয়ে পেছন দিকে ছুটে পালিয়ে চলে যাচ্ছে।
ওদের এসব কীর্তিকলাপ দেখে আনাবিয়া হেসে গড়িয়ে পড়ছে মীরের গায়ের ওপর। আর মীর নির্বিকার মুখে সামনে তাকিয়ে হেটে চলেছে ওদের গন্তব্যের দিকে।

আইস্ক্রিম খেতে খেতে ওরা গিয়ে পৌছালো শহরের সবজি আর মাছ মাংসের বাজারে। আনাবিয়ার শখ হয়েছে সে এই কয়েকদিন অন্য সব স্ত্রীদের মতো স্বামীকে রান্নাবান্না করে খাওয়াবে৷ মীরিও আনাবিয়ার এমন সিদ্ধান্তে এক পায়ে খাড়া!
গত বিশ বছরে আনাবিয়া অনেক অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। মীর ওকে সবসময় বলতো স্কিল ডেভেলপ করো, নতুন কিছু শেখো সবসময়, সময় গুলো কাজে লাগাও।
এই বিশ বছরে তাই এতটুকু সময়ও নষ্ট করেনি আনাবিয়া। মীরের যখনই সময় হয়েছে তখনি আনাবিয়াকে শিখিয়েছে নিজের শেখা সমস্ত ফাইটিং স্কিল!
নিজের অস্ত্রাগারের সমস্ত রকমের অস্ত্র চালনা করা হাতে ধরে ধরে ও শিখিয়েছে আনাবিয়াকে। সবকিছুতে দক্ষ না হওয়া পর্যন্ত নিজেও থামেনি, আনাবিয়াকেও থামতে দেয়নি।

বউয়ের পড়াশোনার দিকে কোনো মনই নাই, তাকে বই পড়তে বললে তার মেজাজ মাথার এক হাত উপরে উঠে যায়। তাই মীর বই থেকে ওকে আপাততের জন্য ইস্তফা দিয়ে এসমস্ত শিখিয়েছে। বইয়ের দিকে মনোযোগ না দিলেও যেন নেচে বেড়িয়ে সময় গুলো নষ্ট না করে।
এর ভেতরে রান্নাটা আনাবিয়ার প্রচন্ড পছন্দ! রয়্যাল কুকের থেকে রান্নাটা ভালোভাবে রপ্ত করার পর থেকে যখন তখন নতুন নতুন রেসিপি ট্রাই করে করে মীর আর বাচ্চাদের খাওয়ায় ও। প্রতিবারই আনাবিয়ার দক্ষ হাতের রান্নায় চমৎকৃত হয় ওরা সকলে।
বাচ্চাদেরকে তো শুধু বলার প্রয়োজন যে তাদের শেহজাদী আজ রান্না করবে, ব্যাস! বাচ্চাগুলো তখন থেকেই আনাবিয়ার পেছন পেছন ঘুরে ফিরবে কখন তাদের শেহজাদী রান্না শুরু করবে আর কখন তারা খেতে পারবে সেই সুস্বাদু খাবার!

সবজি বাজারের গিজগিজে লোকজনের ভেতর দিয়ে ঠেলেঠুলে বাজারের ভেতরে ঢুকলো ওরা। সবজি গুলো সরাসরি ওয়ারদিচা থেকে সাপ্লাই হয়, একদম টাটকা! রোজ সকাল বেলা ট্রাক ভর্তি করে মালামাল আসে পানিপথ দিয়ে। সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকেই কিনে নেয় বিক্রেতারা, তৃতীয় কোনো পক্ষের প্রবেশ তাদের মাঝে সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।
ভীড়ের মধ্যে সবজি বাজারটা যেন পরিণত হয়েছে এক জীবন্ত কোলাহলে৷ চারদিকে লোকজনের ঠেলাঠেলি। রোজ সকালবেলা ওয়ারদিচা থেকে সবজি নিয়ে রওনা দেয় মালবাহী গাড়ি, পৌছায় বিকেলে। তাই বিকেলের পর থেকে এখানে ক্রেতাদের প্রচন্ড ভীড় হয় তাজা সবজি আর ফলমূলের লোভে।

লোকজনের কোলাহলে মীর আনাবিয়াও মগ্ন হয়ে গেলো একসময়। মানুষের হাঁকডাকে এক অন্য জগতে চলে এলো যেন ওরা। ছদ্মবেশের আড়ালে ঢাকা থাকা সত্বেও যারাই ওদের পাশে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তারাই তাকিয়ে ওদের দেখছে দ্বিতীয়বার, এক অদ্ভুত আকর্ষণ ওদেরকে টেনে ধরছে এই জুটির দিকে। যেন ওরা বুঝতে পারছে এই দুজন নরনারী বহন করছে এক সম্পুর্ন ব্যাতিক্রম মহিমা।
বাজারের এক মাথা থেকে অন্য মাথা হেটে বেড়াচ্ছে ওরা দুজন। আনাবিয়া এক হাত দিয়ে মীরের হাত ধরে আছে শক্ত করে। ওর চলার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ও এমন জায়গায় আসতে একদমই অভ্যস্ত নয়। মীর ওর হাত ধরে নিজের সাথে চেপে রেখে ভীড়ের থেকে সুরক্ষিত করে রেখে চলেছে সারাক্ষণ।
কিছুদূর এগোতেই ভীড় বাড়লো আরও, হাটতে গেলেই একবারে গায়ের সাথে গা ঘেঁষে যাবে৷ মীর আনাবিয়াকে টেনে নিয়ে এলো নিজের সামনে, তারপর ওর পিঠটা নিজের বুকের সাথে ঠেকিয়ে দুহাতে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে হাটা শুরু করলো সামনের দিকে।

সামনে কেউ অহেতুক দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে চাটি মেরে মেরে সরিয়ে দিলো ও। আনাবিয়া পুরোটা সময় খিলখিল করে হাসলো! ওকে এমন হাসতে দেখে মীরের মুখেও ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি।
এই মেয়েটা যতক্ষণ হাসে ততক্ষণ ওর মনে কোনো বিষাদ থাকেনা, ওর সমস্ত মন খারাপ নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। দিন শেষে ঘরে ফিরে এই মেয়েটির বুকে মুখ গুজতে পারলেই ওর সমস্ত বিষাদ, সমস্ত চিন্তা কর্পূরের মতো উড়ে যায় আকাশের নীলে!

ভীড় ঠেলে সামনে যেতে যেতে মীর নরম গলায় শুধালো,
“এই ভিড়ে কষ্ট হচ্ছে তোমার? কষ্ট হলে ফিরে যাই চলো।”
“না মীরি, মজাই লাগছে! তুমি সাথে আছো তাই আরও ভালো লাগছে, আমি খুব খুব এনজয় করছি!”
উচ্ছসিত হয়ে মিষ্টি হেসে বলল আনাবিয়া, চোখে ওর মুগ্ধতার ঝলক। মীর ভীড়ের ভেতরেই অভ্যাসবশত আনাবিয়ার হুডির কানের মাঝ বরাবর বসিয়ে দিলো একটা চুমু।
কিছুক্ষণ বাদে ভীড় ঠেলে সামনে এসে ওরা দাড়ালো একটা স্টলের সামনে। এক বৃদ্ধ এক গাদা সবজির স্তুপ নিয়ে বসে আছে সেখানে, পাশেই বসে আছে তার ব্যাক্তিগত বৃদ্ধা, একটু পর পর বুড়োর সাথে ভাব বিনিময় করছে সে।
মীর আনাবিয়ার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“চলো, এই লাভবার্ডের থেকে একটু দামাদামি করে সবজি কিনে বাড়িতে ফিরি।”
আনাবিয়া মজা পেলো অনেক৷ এভাবে বাজারে আসার কোনো অভিজ্ঞতাই ওর কখনো হয়নি, তাই আজ ওর বেশ মজা লাগছে। মীরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে নাক কুচকে হাসলো ও। মীরও ঠোঁট টিপে হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে।

ওদের দুজনকে এইভাবে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করতে দেখে বৃদ্ধা বলে উঠলো,
“থোমরা দুইডা কি সুদু ফেরেমই করবা নাকি তরকারি কিনবা?”
আনাবিয়া বৃদ্ধার কথা শুনে হেসে উঠলো। মীর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনাবিয়ার রেসিপিতে কি কি লাগবে শুনে শুনে বলতে লাগলো বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ এক এক করে সেগুলো এনে এনে রাখতে লাগলো ঝুড়িতে৷
মীর বৃদ্ধকে শুধালো,
“ব্যাবসা কেমন চলে চাচা?”

“ভালো চলে বাজান, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর অশেষ রহমত আছে আমাদের ওপর তাই তিনি আমাদের বাদশাহকে আমাদের বাদশাহ করে পাঠিয়েছেন। ওনার জন্যই আমরা ন্যায্য দাম পাচ্ছি এখন।”
“আপনি কি ওয়ারদিচার বাসিন্দা চাচা?”
“জ্বি বাজান, আমি ওইখান থেইকাই আসছি। গাড়িতে মাল লইয়া আর আমার বুড়িরে লইয়া। আসলে পোলা মাইয়া কেউ নাই তো! আমার কোনো সন্তান নাই। তাই বুড়া বুড়ি থাকি একসাথে, যা পাই তাই খাই। বাদশাহ আমাদেরকে অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘজীবী করুন।”
মীর হাসলো মৃদু। আনাবিয়া বৃদ্ধের কথার শেষে নিঃশব্দে আমিন বলে উঠলো।
বুড়োর পাশে বসে বসে বৃদ্ধা ওদের দুজনকে এতক্ষণ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিলো৷ হঠাৎ করেই সে এবার মীরের উদ্দ্যেশ্যে বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,

“বাজান, তুমি এই অমাবস্যার মতোন বদন লইয়া এই চান্দের লাহান মাইয়া ক্যাবা করে পাইলা?”
বৃদ্ধার এমন প্রশ্ন শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো আনাবিয়া। মীর সেন্টি খাওয়া চোখে তাকিয়ে রোইলো আনাবিয়ার খিলখিলিয়ে হাসা চেহারার দিকে। আজ কালো বলে বুড়ি ওকে আমাবস্যা বানিয়ে দিলো!
মীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“আসলে চাচি, এই চাঁদটার রোশনী একটু বেশি তো! চোখে লাগলে ঝিলমিল করে, তাই আমি তার ব্যালান্স!”
মীরের এমন কথায় হেসে উঠলো বৃদ্ধা, দেখা গেলো তার ফোকলা দাঁত। আনাবিয়া মীরের কথা শুনে হাসির চোটে এবার হাঁপিয়ে গেলো। হাসি থামানোর প্রয়াসে মীরের বুকে মুখ রেখে দম নিলো ও৷
বৃদ্ধ এতক্ষণ ওদের জন্য ভালো দেখে একটা কুমড়ো খুজছিলো। কিছুক্ষণ পর একটা স্বাস্থ্যবান কুমড়ো নিয়ে ওদের সামনে রাখলো। মীর বৃদ্ধের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এটার জন্য কত দিতে হবে দাদু?”
“পঁঞ্চাশ দাও দাদু।”

আনাবিয়া মীরের দিকে চকিতে এক পলক তাকিয়ে আবার বৃদ্ধের দিকে ফিরে ভ্রু তুলে বলে উঠলো,
“কুমড়ো এত দাম কেন চাচা? একটু কমিয়ে রাখুন না!”
বৃদ্ধ ওর দিকে তাকিয়ে প্রাণখোলা হেসে বলল,
“এটাই বাজারের দাম মা জননী, তুমি রাজকন্যার মতো দেখতে হলেও আমরা তো আর রাজা না!”
বৃদ্ধার কথায় লজ্জা পেলো আনাবিয়া, মিষ্টি হাসিতে ভরে উঠলো ওর মুখ খানা। মীরের চোখে খেলল এক অদ্ভুত গর্ব। আনাবিয়ার দিকে একবার পূর্ণচোখে চেয়ে ও নিজের মনে নিরবে বলল,
“চোখ জোড়া তো দেখোইনি চাচা! চোখ জোড়া দেখলে বাকি পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যই তোমাকে আর টানতোনা।”
ওকে এভাবে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বৃদ্ধা আবার ফোকলা দাঁতে হেসে বলে উঠলো,
“চাঁন্দের ওপর থেকে দেহি তোমার নজরই সরেনা!
তুমি পাশে আছো বলেই এই চাঁন্দের এত ঝলকানি, আমাবস্যার কালো ছাতির পরেই তো চাঁন্দের আলো বেশি জমে!”

বৃদ্ধা এবার ফোকলা দাঁতে হেসে আনাবিয়ার শুভ্র, লাজরাঙা চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“এই আমাবস্যার চাইতে ভালো মরদ তুমি আর দুইডা পাইবানা মাইয়া, ওই ভীড়ের মইধ্যে তোমারে কেমনে জড়াইয়া আনছে আমি দেখছি। সারাজীবন এই আমাবস্যার চাঁন্দের ঝলকানি হইয়াই থাইকো।”
আনাবিয়া লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি নত করলো। মীর তাকিয়ে রইলো ওর লাজরাঙা মুখের দিকে, এই সুন্দর মুখখানার দিকে ও জনম জনম তাকিয়ে থাকতে পারে!
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ওরা এগোলো সামনের দিকে, ওপাশের এক্সিট থেকে বেরিয়ে চলে যাবে৷ বাজারের শেষ মাথায় গিয়ে আনাবিয়া বায়না ধরলো ওর হাতেও একটা প্যাকেট দিতে হবে, নইলে ওর বাজার বাজার ফ্যিল হচ্ছে না।
মীর খুঁজে খুঁজে নিজের হাতের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট তুলে দিলো ওর হাতে। আনাবিয়া সেটা নিয়ে নাচতে নাচতে এগোলো মীরের আগে আগে। ওর খরগোশের কান দুইটা লাফাতে লাগলো৷

ভীড় কমে গেছে অনেক, রাস্তায় এখন লোকজন অল্প। সবজি বাজার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, সবাই যার যার গন্তব্যে ফিরছে নয়তো হেটে চলেছে মূল শহরের ব্যাস্ততার দিকে৷
আনাবিয়া আর মীর হাটতে হাটতে এগোচ্ছে ডাস্কমায়ারের জঙ্গলে দিকে যাওয়ার রাস্তার ধরে। চওড়া রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই চলছে গাড়ি, ফুটপাত দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে হেটে চলেছে পথচারীরা।
আনাবিয়া মাথা থেকে হুড নামিয়ে দিয়েছে। ওর সফেদ রেশমি চুলগুলো উঁচু পোনিটেলে বাধা। সেগুলো কোমর ছাড়িয়ে নিচে এসে পড়েছে। মীর নিজেও ওর হুডির হুড নামিয়ে দিয়েছে। ওর ছাই রঙা ঘাড় বাবরি ঝাকড়া চুলগুলো হাটার গতির সাথে তাল মিলিয়ে দুলে চলেছে। ফুরফুরে বাতাসে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওর ফুলে থাকা কিঞ্চিৎ কোকড়া চুলের ঝাপি।

ওদের সামনে দিয়ে একটা দম্পতি তাদের মেয়ে বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে হেটে চলেছে সামনের দিকে। মেয়েটি বাবার কোল থেকে বারবার পেছন ফিরে দেখছে আনাবিয়াকে।
আনাবিয়া সেটা খেয়াল করে মীরের কানে ফিসফিস করে বলল কিছু। মীর এবার নিজেও দৃষ্টি দিলো বাচ্চা মেয়েটার দিকে। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটার নজর আনাবিয়ার শুভ্র মুখ খানার দিকেই, থেকে থেকেই এদিকে তাকিয়ে এক পলক করে সে দেখছে আনাবিয়াকে৷

মেয়েটি পরেরবার তাকালে আনাবিয়া মিষ্টি হেসে হাত নাড়ালো মেয়েটির দিকে। মেয়েটি খুশি হলো অনেক, আনন্দ উপচে পড়লো ওর চেহারায়। নিজেও হাত উঁচু করে আনাবিয়ার দিকে হাত নাড়ালো।
আনাবিয়া এবার পাশ থেকে মীরের হাতটা নিয়ে উঁচু করে নাড়িয়ে দিলো মেয়েটির দিকে, কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি মীরকে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি, হঠাৎ করে অন্ধকারের ভেতর থেকে মীরের হাত বেরিয়ে আসতে দেখে মায়ের কোলেই আতঙ্কে লাফিয়ে উঠলো মেয়েটা, চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে উঠলো! তারপরেই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেললো সে।
মীর সেন্টি খেয়ে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, আনাবিয়া প্রচন্ড কষ্টে হাসি চেপে আছে দুহাত দিয়ে। বাচ্চা মেয়েটির মা বিরক্তি নিয়ে পেছনের ব্যাক্তিবর্গকে ধমক দেওয়ার জন্য এক পলক পেছনে তাকিয়েই আনাবিয়াকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ।
তারপর আবার সামনে তাকিয়ে বাচ্চাটার কান্না থামাতে থামাতে এগোলো জোর কদমে৷
আনাবিয়া বাচ্চা মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিরব হয়ে গেলো হঠাৎ। ওর পাশে পাশে ওকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে হেটে চলা মীরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“আমাদেরও একদিন এমন বাবু হবে বলো মীরি!”
“আল্লাহ তা’য়ালা চাইলে অবশ্যই হবে প্রাণ আমার।”
বলে আনাবিয়ার কপালে একটা চুমু খেলো ও। আনাবিয়া মিষ্টি হেসে আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে নিজের মনে বলতে লাগলো,

“ আমাদের একটা না, অনেএএএক গুলো বাচ্চা হবে! সারাদিন ওরা ছোটাছুটি করে খেলবে প্রাসাদের বারান্দা জুড়ে। চিৎকার চেচামেচি করে প্রাসাদ মাথায় তুলে রাখবে কোকো, হাইনা, ওকামি দের জান জ্বালিয়ে ছারখার করে দেবে! তোমাকে দেখে ভয় পাবে ভীষণ, এক্কেবারে শান্ত হয়ে যাবে সবগুলো। তোমার ভয়ে লুকোবে এসে ওরা আমার কাছে। আর আমাকে ওরা খুব খুব ভালোবাসবে, আমি যে ওদের আম্মা! তাইনা বলো?”
“হুম, তোমাকে ওরা ভালো না বেসে কোথায় যাবে বলো? তোমাকে কি ভালো না বেসে থাকা যায়?”
আনাবিয়ার কপালের ওপর আসা বেবি হেয়ার গুলোকে হাতের সাহায্যে কানের পাশে গুজে দিয়ে বলল মীর। আনাবিয়া মিষ্টি হেসে আদুরে ভঙ্গিতে সরে এলো মীরের কাছাকাছি। মীরের সাথে এমন মিষ্টি স্বপ্ন ও সারাক্ষণ দেখতে চায়!

হাটতে হাটতে হঠাৎ করেই ওর চোখ গেলো রাস্তার পাশে থাকা একটা দোতলা বাড়ির কলিং বেলের দিকে।
মীরের দিকে এক পলক তাকিয়ে মীরের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো আনাবিয়া।
মীর একবার জিজ্ঞেস করতে নিলো ও কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই ওকে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে কলিং বেলের দিকে এগোতে দেখে ফিক করে হেসে উঠলো মীর৷
আনাবিয়া পা টিপে টিপে, সন্তর্পণে গিয়ে দাড়ালো কলিংবেলের সামনে, আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে দিলো কলিং বেলের দিকে।

মীর আর একটু সামনে গিয়ে দৌড় দেওয়ার পোজ দিলো। আনাবিয়া কলিং বেল টিপলেই ও পগার পাস হয়ে যাবে।
আনাবিয়া ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো চাপবে কিনা। মীরও ভ্রু নাচিয়ে বুঝিয়ে দিলো চেপে দিয়েই ছুট দাও।
আনাবিয়া তড়িৎ গতিতে দুবার কলিং বেলে চাপ দিয়েই ছুটে এলো মীরের কাছে। মীর হেসে উঠে ওকে এক হায়ে টেনে নিজের সামনে দিয়ে ওকে নিয়েই ছুটে চলে গেলো সামনের দিকে।
কিন্তু বাড়ির মালিক উঠে এসে দরজা খুলে দূর থেকেই দেখে ফেললো ওদের। দুজনে তখনো খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে ছুটে চলেছে সামনের দিকে।
আনাবিয়া আর মীরের উদ্দ্যেশ্যে দরজার ওপার থেকেই সে তেজি গলায় কয়েকটা কটু বাক্য বলে আবার ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতর।

মীর আর আনাবিয়া ছুটতে ছুটতে এসে থামলো রাস্তার এক কোণে। থামা মাত্রই আনাবিয়া আবার হেসে উঠলো খিলখিল করে। ওর হাসির সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো মীরও।
এরপর রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে যতগুলো বাড়ির কলিংবেল পেলো সবগুলো বাজিয়ে দিয়ে, কারো বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে, কারো বাড়ির সামনে বসে পাহার দেওয়া কুকুরটাকে ছেড়ে দিয়ে, বাড়ি গেট ধরে ঝাকিয়ে দিয়ে ঘুমন্ত মানুষ গুলোর ঘুম ছুটিয়ে ওরা দুজন প্রাণখুলে হাসতে হাসতে ছুটে চলল রাতের আঁধার কেটে!
ছুটতে ছুটতে একসময় থামলো ওরা দুজন। আনাবিয়া হাপিয়ে গেছে। জোরে শ্বাস নিতে নিতে ও হাটুতে হাত ঠেকিয়ে ঝুকে দাঁড়িয়ে পড়লো। মীর কোমরে হাত দিয়ে দম ছাড়তে লাগলো জোরে। তারপর কিছুক্ষণ নিজেদেরকে ধাতস্থ করে নিয়ে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো শব্দ করে।
মীর বলল,

“অনেক দুষ্টুমি হয়েছে আজ, ফিরে চলো এবার।”
“আর একটা বেল টিপবো, মাত্র একটা!”
আবদারের সুরে বলল আনাবিয়া। মীর ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছেড়ে আশেপাশে দেখলো, তারপর একটা বাড়ির দিকে আঙুলের ইশারা করে বলল,
“ওইযে ওইটার বেল টিপে আসো, একবার টিপেই দৌড় দিবে। ওরা কিন্তু এখনো ঘুমায়নি, কামরায় লাইট অন আছে এখনো, কুইক!”

আনাবিয়া আচ্ছা’ বলে ছুটলো সেদিকে। বাড়ির সদর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে কলিং বেলে পরপর কয়েকটা চাপ দিতেই খট করে দরজা খুলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক মধ্যবয়সী নারী।
আনাবিয়ার মুখের হাসি উবে গেলো মুহুর্তেই, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ও মহিলাটির দিকে। শালার একটা চাপ দিয়ে ছুট দিলেই হতো, মীরের কথা না শুনে ভুল হয়ে গেছে, মিসটেক!
মহিলাটিও স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে বিস্মিত চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।
এদিকে বউ ধরা পড়ে গেছে দেখে মীর অন্ধকারের ভেতরে থেমে গেলো, আনমনে বলে উঠলো,
“সেরেছে রে!”
মহিলা কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে খিচিয়ে বলে উঠলো,
“অ্যাই মেয়ে……!”

কিন্তু বাকি কথাটুকু আর শেষ করতে পারলোনা সে, তার আগেই ঝড়ের গতিতে এসে তার সামনে থেকে আনবিয়াকে নিজের সাথে জড়িয়ে চোখের পলকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেলো মীর, তারপর ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেলো ডাস্কমায়ার জঙ্গলের ভেতর।
চোখের সামনে এমন অদ্ভুত কাজকর্ম হতে দেখে বারান্দায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সী নারীটি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আর এরপর জ্ঞানে এসে সে ভড়কে গিয়ে বাড়ির ভেতরে থাকা বাকি জনগনের উদ্দ্যেশ্যে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

“আরে কে কোথায় আছিস! পরী দেখছি আমি পরী, কলিং বেলে চাপ দিয়ে ভাগছে!”
৬১. দেমিয়ান প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরে নিজের কামরায় সেদিনের পাওয়া বাঁজ পাখিটাকে কোলের ওপর নিয়ে বসে আছে আনাবিয়া। হাতে ওর একটা বই৷
একহাতে বই নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়তে পড়তে অন্য হাতে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ও। বাচ্চাটার নাম ও রেখেছে ফ্যালকন। সেদিন বাচ্চাটাকে পাওয়ার পর কি নাম রাখবে বুঝতে পারছিলোনা, তাই ফ্যালকনের বাচ্চাটাকে ফ্যালকন নামই দিয়ে দিয়েছে।

ফ্যালকন ঝিমুচ্ছে, চোখ জোড়া মাঝে মাঝে পিটপিট করে মেলে আবার বুজে নিচ্ছে৷ গায়ে পালকে ভর্তি হয়ে গেছে ওর, এখনো উড়তে শিখেনি। আর মাসখানেকের পরেই আকাশ কাঁপাতে পারবে ও৷
কিন্তু আনাবিয়ার চিন্তা ওর স্ট্যামিনা নিয়ে, কারণ অন্য শিকারী পাখিদের মতো ফ্যালকন অতোটা স্ট্রং নয়। মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়া এই বাচ্চাটি যে বেঁচে উঠেছে তাতেই আনাবিয়া খুশি, যে অবস্থা এর ছিলো তাতে ওর বাঁচার কোনো সুযোগই ছিলোনা!

আনাবিয়া সেদিন ওকে প্রাসাদে নিয়ে এসে রোজ অল্প অল্প করে শুশ্রূষা দিয়ে একটু একটু করে খাবার খাইয়ে সুস্থ করে তুলেছে। বাচ্চাটা এখন লাফিয়ে লাফিয়ে নেঁচে বেড়ায়, কিন্তু একটু জোর বাতাস হলেই তাকে আর খুজে পাওয়া যায়না, উলটে পড়ে পেছন দিকে।
আনাবিয়া বইয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে পাশে রাখা ফোনটার স্ক্রিন টাচ করে সময় দেখলো, রাতের এখন দশটা বেজে পনেরো। ওর আসছে ঘুম, কিন্তু মীরের গায়ের সাথে মিশে থাকতে না পারলে ও ঘুমোতে পারেনা, মীরকে ওর পাশে লাগবেই।

যে রাত গুলোতে মীর বাইরে থাকে সে রাত গুলো ওর কাটে দুর্বিষহ! চোখে বালতি বালতি ঘুম নিয়েও সারারাত বিছানার এ কোণা থেকে ও কোণা গড়াগড়ি করেও ওর ঘুম আসেনা!
সে কালামানিক নিজের কামরাতেই আছেন কিন্তু তিনি এখন বিজি! সন্ধ্যা থেকে এক গাদা কাগজ পত্র এনে টেবিলে সাজয়ে রেখেছেন তিনি, সবগুলো খতিয়ে দেখছেন। কিন্তু তার যে একটা বউ আছে সেটাই ভুলে গেছেন!
আনাবিয়া আগে একবার গিয়ে বলে এসেছে যে ওর ঘুম লাগছে, সে উত্তর দিলো যে আসছে, কিন্তু এখনো তার কোনো টিকিপাত্তা নেই!

আনাবিয়া এবার ধৈর্যহারা হলো। বইটা ধাম করে রাখলো ও বিছানার ওপর, বই রাখার শব্দে ওর কোলে শুয়ে থাকা ফ্যালকন লাফিয়ে জেগে উঠলো ঝিমুনি থেকে।
ওকে এক হাতে ধরে নিচে নামিয়ে রেখে আনাবিয়া বিছানা থেকে নেমে গটগটিয়ে চলে গেলো মীরের কামরায়।
গায়ে একটা সিলভার কালারের রোব জড়িয়ে মীর তখনও এক মনে কাগজ পত্রের দিকে তাকিয়ে।
একটা শর্টস আর তার ওপর মীরের সাদারঙা ফিনফিনা শার্ট পরিহিতা আনাবিয়া তেজস্বী চেহারায় ফুলতে ফুলতে এসে দাড়ালো মীরের সামনে, তারপর রাগান্বিত গলায় ঝাঝিয়ে বলে
“তোমার যে একটা বউ আছে সেটা কি তুমি ভুলে গেছো?”

“উহু, একটা বিশেষ প্রাণী ক্ষণে ক্ষণে ফণা তুলে জানান দিচ্ছে যে আমার বউ আছে।”
কাগজের দিকে দৃষ্টি রেখেই উত্তর দিলো মীর। আনাবিয়া কিছুক্ষণ সেন্টি খাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে, পরক্ষণেই বুকের ভেতর থেকে মীরের দেওয়া খঞ্জর টা বের করে খাপ খুলে ঝড়ের বেগে ঝুকে এসে ধরলো মীরের গলায়! মীর স্থীর হয়ে গেলো সম্পুর্ন, হাতে থাকা কাগজপত্র গুলো ওভাবেই ধরে রেখে স্থীর হয়েই শুধুমাত্র চোখ তুলে ও তাকালো আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়া ওর দিকে তাকিয়ে হুমকির স্বরে বলল,

“এখনি বিছানায় চলো, নইলে তোমার গলার নলি কেটে দেবো!”
মীর ওভাবেই স্থীর থেকে ওর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,
“আমার অনেক কাজ শিনু, একদম সময় নেই! তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকো, আমি কাজ শেষ করেই চলে আসবো, প্রমিজ।”
আনাবিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা। তারপর মীরের গলার ওপর থেকে খঞ্জরটা সরিয়ে সামনে থেকে ঘুরে মীরের কাছে এসে বসলো ওর কোলের ভেতর, বলল,
“তাহলে আমি এখানেই ঘুমোবো।”
“তুমি এই অবস্থায় আমার কোলে বসে থাকলে আমি কাজ করতে পারবো বলে তোমার মনে হচ্ছে?
আনাবিয়ার খোলা চুলের এক গোছাকে নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে খেলাচ্ছলে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল মীর৷
“আমি কিছু জানিনা! আমি এখন এখানে ঘুমাবো, তুমি কি করবে আমি জানিনা।”

নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল আনাবিয়া।
“জেদ ধরেনা শিনজো! কামরায় গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো প্লিজ, আমি কাজ শেষ করেই চলে আসবো। তুমি এখানে থাকলে আমি স্থীর হয়ে বসতেই পারবোনা শিনু, আর কাজ করা তো দূরের কথা!”
আনাবিয়ার চোয়ালের সাথে নাক ঠেকিয়ে বলল মীর৷ আনাবিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো আবারও, তারপর মীরের কোলের ভেতর থেকে উঠে যেতে যেতে বলল,
“ঠিক আছে, তাহলে আমিও ঘুমোবোনা। তুমি করো কাজ৷”
বলেই ও হেটে চলে গেলো কামরার বাইরে, নিজের কামরাতেও ঢুকলোনা। মীর পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলেও ফিরে তাকালোনা।
মীরের এখন এসব দেখার সময় নেই, ওর অনেক কাজ। বউকে পরে মানানো যাবে ভেবে আবারও কাগজপত্রে মন দিলো ও।

আনাবিয়া গটগটিয়ে বাইরে এসে আশেপাশে তাকালো একবার। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে ওর, কিন্তু বিছানায় গেলেই এই ঘুম উধাও হয়ে যাবে। আনাবিয়া এদিক ওদিক কিছুক্ষণ তাকাতাকি করে এগলো মীরের কামরার থেকে কিছুটা দুরত্বে থাকা বিরাট বিশাল লাইব্রেরিটার দিকে।
বইয়ের ওপরে জমা বিতৃষ্ণা থেকে আনাবিয়া এই লাইব্রেরিতে কখনো আসেনা, কিন্তু এখন মীরের ওপর হওয়া রাগের কারণে সময়টুকু এই লাইব্রেরি ঘুরেই কাটিয়ে দিবে ও।
লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে কামরার বিশাল নকশাদার দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুললো আনাবিয়া, খুলতেই দরজার ভারী পাল্লা দুইটা দুদিকে চলে গেলো, জ্বলে উঠলো লাইব্রেরি ভেতরের সমস্ত কৃত্রিম আলোর পসরা।
আনাবিয়ার চোখে পড়লো লাইব্রেরীর অসাধারণ নকশা খোদাই করা সিলিং, এক মহাকাব্যের অংশের ন্যায় সমস্ত লাইব্রেরীটা যেন জানান দিয়ে চলেছে নিজের উপস্থিতি!
আনাবিয়া নজর বুলালো লাইব্রেরীটির চারপাশে।

দেওয়ালজুড়ে নকশাদার শেলফে ঠাসা পুরোনো আর দুষ্প্রাপ্য বই, প্রতিটি বই রাজকীয় নকশার চামড়ায় বাঁধিয়ে মোড়ানো। পার্সিয়ান কার্পেটে ঢাকা লাইব্রেরির বিরাট মেঝে, তার ঠিক মধ্যিখানে বসানো একটি দীর্ঘ টেবিল, টেবিলের চারপাশে গাঢ় লাল রঙা মখমলের চেয়ারের সারি।
আনাবিয়া এগোলো ভেতরের দিকে। শেলফগুলো সব সিলিং পর্যন্ত বিস্তৃত। আনাবিয়া মাথা উচু করে ওপরের তাকের বইগুলোর দিকে নজর বুলাতে লাগলো। এখান থেকে একটা ভালো বই নিয়ে পড়া দরকার, যেন মীরের চিন্তা এই মুহুর্তে ওর মস্তিষ্কে এসে হানা না দেয়, আর ঘুমটাও চলে যায়।
কিছুক্ষণ চোখ বুলানোর পর আনাবিয়ার নজর গেলো লাইব্রেরির এক কোণার শেলফের সবচেয়ে উপরে অবস্থিত লাল রঙা তাকের দিকে। তাকের ওপর বড় বড় করে লেখা, ‘দ্যা দেমিয়ানস’।
এই শেলফে শুধুমাত্র রয়্যাল মেম্বার ছাড়া অন্য কারো স্পর্শ করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ, দাস দাসী দেরকে এই শেলফ মীর পরিষ্কার করার উদ্দ্যেশ্যেও কখনো স্পর্শ করতে দেয়না। আনাবিয়াকেও এখনো স্পর্শ করতে দেয়নি, বলে ওর বয়স পঞ্চাশে পড়লে তখন ও এই বইগুলো পড়বে, তার আগে না।
আনাবিয়া রোলিং ল্যাডার না নিয়েই এগোলো সেদিকে, তারপর খালি হাতেই তাকের ফাঁকে ফাঁকে পা দিয়ে দিয়ে উঠে গেলো ওপরের দিকে।

মীরের মতো এখনো ও শূন্যে ভাসতে পারেনা, পারে কিন্তু অল্প অল্প, দক্ষভাবে নয়। মীর বলেছে পঞ্চাশের পর সব ঠিক হয়ে যাবে, ওর এখনো বয়স কম।
তাকের সেই রেড জোনে গিয়ে ও চোখ বুলালো সেখানের বই গুলোর দিকে। হঠাৎ করেই ওর নজরে বাধলো একটা সবুজ রঙা চামড়া বাধানো মোটা বইয়ের দিকে। তার ওপর বড় বড় করে লেখা ‘দ্যা লাইফ ট্রি’।
আনাবিয়া হাত বাড়িয়ে বইটা নিয়ে নেমে এলো নিচে। তারপর লম্বা টেবিলের পাশ থেকে চেয়ার টেনে বসলো তাতে৷ বইটা টেবিলের ওপর রেখে এক এক করে পাতা মেলালো ও। তারপর পড়তে শুরু করলো লাইফট্রির জন্মের ইতিহাস।

অনেক অনেক শতাব্দী আগে পৃথিবীতে ছিল এক স্বর্ণযুগ। পৃথিবী তখন পৌঁছেছিল এক অত্যাধুনিক সভ্যতায়। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় পৃথিবী পৌঁছেছিল এক অনন্য শিখরে। সমগ্র পৃথিবীর মানুষের আয়ু তখন ছিল অস্বাভাবিক দীর্ঘ।
সেসময় পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে রাজত্ব করতো বিরাট বিশাল দেমিয়ান বংশ। তারা ছিল সেসময়ের শক্তি এবং জ্ঞানের চূড়ান্ত প্রতীক। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক গোষ্ঠীসমূহের ভেতর তারা ছিলো অন্যতম। তাদের ক্ষমতা, জ্ঞান, এবং প্রযুক্তি ছিলো পৃথিবীর অন্য সব জাতির চেয়ে অগ্রগামী। তবে তাদের বর্তমান ক্ষমতার মূল রহস্য লুকিয়ে আছে এক বিপ্লবী গবেষণায়, জিন কোডিং।
সেসময়ের দেমিয়ান বংশের বাদশাহ এবং শেহজাদারা চেয়েছিলেন তাদের এই দীর্ঘায়ু ও শারীরিক সক্ষমতা পরবর্তী প্রজন্মগুলোতেও ধরে রাখতে।

তাই তৎকালীন বাদশাহের আদেশে দেশের নানা প্রান্ত থেকে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে আসা বিশেষজ্ঞ, গবেষক এবং সায়েন্টিস্টদেরকে লাগিয়ে দেওয়া হলো কাজে। আর বাদশাহর আদেশেই তৎকালীন বিজ্ঞানীরা শুরু করেন এই যুগান্তকারী গবেষণা।
মানুষের জিনে স্থায়ীভাবে এই দীর্ঘজীবন, অতিমানবীয় শারীরিক শক্তি, এবং বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা বেঁধে দেওয়াই ছিলো তাঁদের গবেষণার মূল লক্ষ্য।
তবে এই কোডিং প্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্যের তরফ থেকে বিজ্ঞানীদেরকে দেওয়া হয় একটি শর্ত। দেমিয়ান সন্তানদের দেহ মায়ের গর্ভে বড় হলেও, তাদের জিনে মায়ের কোনো বৈশিষ্ট্য থাকবে না। কেবল বাবার বৈশিষ্ট্যই সন্তানের জিনে স্থান পাবে।

কারণ সেই যুগে নারীদের গুরুত্ব ছিল নগণ্য, এবং সমাজে পুরুষদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য।
তাদেরকে বলা হলো সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে দায়ী পুরুষদের Y জিনকেই শুধু কর্মক্ষম রাখতে, X জিনকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে। তবে প্রতি দশজন দেমিয়ান শেহজাদার মধ্যে একজনের X জিন যেন ক্রমধারা অনুসারে কর্মক্ষম হয়ে ওঠে, নইলে কখনো পৃথিবীর অন্য প্রান্তের সাথে সুসম্পর্ক করতে গেলে বংশের মেয়েকে ব্যবহার করার আর সুযোগ থাকবে না।

এই বিপ্লবী গবেষণা চালানোর জন্য দেমিয়ান বংশের তৎকালীন বাদশাহ বিজ্ঞানীদের জন্য নির্ধারণ করে দেন একটি নির্জন দ্বীপ। পৃথিবীর অন্য অংশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই বিরাট দ্বীপটা ছিলো প্রসান্ত মহাসাগরেরঠিক মধ্যখানে। সেখানে ছিলোনা কোনো জনমানসের চিহ্ন!
চারদিকে ঘন জঙ্গল, হিংস্র প্রাণী আর গভীর নীল পানিতে ঘেরা এই দ্বীপটি ছিল সাধারণ মানুষের পদচিহ্নের একেবারে বাইরে, সম্পূর্ণ নিরাপদ।
আর এখানেই সায়েন্টিস্টরা গড়ে তোলে এক অত্যাধুনিক গবেষণাগার, যেটাকে আরও গোপন রাখতে স্থাপন করা হয় মাটির গভীরে!

সেখানে অসংখ্য জিন কোডিং পরীক্ষার ফলস্বরূপ দেমিয়ান বংশের ভবিষ্যৎ শেহজাদাদের বাছাইকৃত জেনেটিক কোষগুলো সংরক্ষণ করা হয়, যেগুলোতে ধরে রাখা হয়েছিলো তাঁদের এই দীর্ঘায়ু, তাদের শক্তিমত্তা। সেই সাথে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মানুষদের ভেতরকার অন্যান্য দৈহিক শক্তিমত্তার ব্যাপারগুলো, যেগুলো চমৎকৃত করেছিলো তৎকালিন বাদশাহকে, সেসব মানুষদেরকে বাছাই করে এনে তাদের জিন কাটিং করে যোগ করা হলো শেহজাদাদের জন্য নির্ধারিত সেই জিনে।
নির্জন দ্বীপটিতে গবেষণার জন্য যাওয়া সায়েন্টিস্টের সেই বিশাল দলের ভেতরে ছিলো একজন বিশেষ ব্যক্তি, নাম ছিলো তার ইলিয়ান সেলেস্টো।
শেহজাদাদের জিন কাটিংয়ের পাশাপাশি তিনি সকলের অগোচরে শুরু করেন নিজের এক অদ্ভুত গবেষণা!
তার ছিলো ওয়্যারউল্ফের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ। তিনি সবসময় চাইতেন রূপকথার কাল্পনিক ওয়্যারউল্ফের মতো তিনি এমন এক জাতি আবিষ্কার করবেন যারা নেকড়ে থেকে পরিণত হতে পারবে মানুষে।
মাটির গভীরে থাকা ল্যাবের বাইরে গিয়ে তিনি জঙ্গলের গভীরের দিকে গিয়ে নিজে নিজেই তৈরি করে ফেললেন তার নিজস্ব ল্যাব।

সেখানে জঙ্গল থেকে ধরে এনে তিনি বিভিন্ন প্রাণীর ওপর চালাতে শুরু করলেন গবেষণা। চোরাই মাধ্যমে তাঁর কাছে সাপ্লাই হতো জীবিত মানুষ, সেসব মানুষের ওপর প্রাণির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অ্যাপ্লাই করে তিনি তৈরি করার চেষ্টা করলেন এক বিশেষ হাইব্রিড, যারা চাইলে যে কোনো মুহূর্তেই আসতে পারবে মানুষের আকৃতিতে।
কিন্তু তিনি হয়ে গেলেন ব্যর্থ! তার করা গবেষণায় কোনো প্রাণী সৃষ্টি হল না, কোনো পরিবর্তনও হল না।
লংটার্মের এক গবেষণায় তিনি একদিকে তৈরি করার চেষ্টা চালালেন ওয়্যারউল্ফ, অন্যদিকে অন্য সহকর্মীদের সাথে মাটির নিচের ল্যাবে লেগে রইলেন দেমিয়ান বংশের জন্য বিশেষ শেহজাদা তৈরিতে।
ভিন্ন ভিন্ন দেমিয়ান পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন জিন নিয়ে তারা ল্যাবে তৈরি করে ফেললেন বিশেষ জিন সম্বলিত পাঁচজন দেমিয়ান শেহজাদাকে।

তারা ছিলো সম্পূর্ণ পরিপক্ক ভ্রুণ। তাদেরকে রেখে দেওয়া হলো ল্যাবের ভেতরেই, ক্রায়ো চেম্বারের রাখা বিশেষ ফ্লুইডের ভেতরে যেন তারা এখানেই বেড়ে উঠে।
তাদের পুষ্টির কোনো ঘাটতি যেন কখনো না হয় তার জন্য ল্যাবের ওপরে অবস্থিত গাছপালা গুলোর সাথে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংযোগ করে দেওয়া হলো শেহজাদাদেরকে রেখে দেওয়া ক্রায়ো চেম্বারগুলোর সাথে, যেন গাছগুলোর তৈরিকৃত শক্তির একাংশ প্রবাহিত হয় এই ফ্লুইডের ভেতর।
বাইরের ল্যাবে সেলেস্টোর কাজগুলো ভালো হচ্ছিলো না। নিজের গবেষণায় সফল হতে না পেরে দিনে দিনে সে হয়ে উঠছিল ডিপ্রেসড। আর এই ডিপ্রেশন থেকেই একসময় সে হয়ে ওঠে মানসিক বিকারগ্রস্ত।
এরপর থেকেই সে জঙ্গলের সমস্ত হিংস্র জন্তুগুলোকে ধরে ধরে এনে তাদের ওপর শুরু করে গবেষণা, নেকড়ে না হোক অন্য কোনো কিছু একটায় তার সফল হতেই হবে!

ওয়্যারউল্ফ না হয়ে ওয়্যারটাইগার হলেও সে সফল। আর এই মানসিক সমস্যা থেকেই শুরু হয় তার প্রাণিদের ওপর নির্যাতন, সেই সাথে শুরু হয় তার কতিপয় মানুষের জিনের সাথে সেসব হিংস্র প্রাণিদের জিন মেলানো।
কিন্তু তবুও সে তার গবেষণার কোনো ফল দেখতে পেলোনা। সফল না হতে পারার ক্রোধে সে তার এই গবেষণা করা সমস্ত অপ্রকৃতস্থ প্রাণীগুলোকে নিয়ে এবার ছেড়ে দিলো জঙ্গলের ভেতর।
কিন্তু তখনও তার জানা ছিল না যে সে তার গবেষণায় ইতোমধ্যেই সফলতা অর্জন করে ফেলেছিলো। শুধু তার নতুন সৃষ্ট প্রাণীগুলোর শরীর সময় নিচ্ছিলো এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটা প্রসেস করার!
আর এরপরেই এই প্রাণীগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে ধীরে ধীরে পরিণত হতে শুরু করলো মানুষে। কিন্তু তারা দেখতে মানুষের মতো হলেও তাদের ভেতর ছিল না কোনো মানবিক বোধ বা গুণাবলী! যা সম্পর্কে সেলেস্টো ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন।

সেলেস্টো এবার নিজের সমস্ত মনোযোগ দেন দেমিয়ান বংশের ওপর। শেহজাদাদের শরীরগুলো সম্পূর্ণ তৈরি হতে, সমস্ত ক্ষমতাগুলো তাদের শরীরে কনজ্যুম হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন ছিলো। তাই দেমিয়ান বাদশাহর আদেশে তারা এই সম্পূর্ণ গবেষণা মাটির গভীরের ল্যাবে রেখেই চলে আসে।
একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর শেহজাদাদের শরীরের বৃদ্ধি যেন থেমে যায় এমনি একটি প্রোগ্রাম ক্রিয়েট করে রেখে, সমস্ত প্রক্রিয়াটাকে কয়েক শতাব্দীর জন্য ফ্রিজ করে সিল করে রেখে তারা সকলেই চলে যায় এই নির্জন দ্বীপ ছেড়ে।
যদি এর ভেতরে কখনো প্রয়োজন হয় তবে দেমিয়ানরা যখনই চাইবে তখনই নির্দিষ্ট প্রসেসের মাধ্যমে ফ্লুইড ছেড়ে বেরিয়ে আসবে পূর্ণবয়স্ক দেমিয়ান শেহজাদারা।

কিন্তু যদি কেউই তাদেরকে বের না করে তবে ফ্রোজেন টাইম শেষ হলে শেহজাদারা নিজেরাই সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে নির্দিষ্ট সময়ের পর।

শেহজাদারা বের হয়ে যেন তাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন তার জন্য ল্যাবের ভেতর রেখে আসা হয় স্বর্ণ ও প্লাটিনামের সংমিশ্রণে তৈরি এক বিরাট বাক্স, যেটাকে ভেতর থেকে সিলিকন দ্বারা সিল করে তার ভেতরে এসিডমুক্ত কাগজে তৈরি দেমিয়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস এবং ল্যাবে তৈরি শেহজাদাদের পরিচয় সংক্রান্ত তথ্যাদি সহ এক গাদা বই রেখে, সোনার বাক্সটাকে বন্ধ করে বাইরে থেকে সম্পূর্ণ সিল করে শক্ত কাঁচের তৈরি বর্ম দিয়ে সেটাকে আবারও সম্পূর্ণ বন্দি করে বাক্সটাকে রেখে এলো ল্যাবের ভেতরে, যেন কোনোভাবেই এর ভেতরের কাগজগুলো নষ্ট না হয়ে যায়।

কালের পরিক্রমায় সভ্যতার উত্থান-পতন ঘটতে থাকে, দেমিয়ান বংশের প্রভাবও ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে।
একটু একটু করে অস্তিত্ব একটু একটু করে পৃথিবী থেকে মুছে যেতে দেমিয়ান বংশের চিহ্ন। তৎকালীন যে বাদশাহ সায়েন্টিস্ট দেরকে জিন কোডিং এর আদেশ দিয়েছিলেন তিনি তার কিছু বছর পরেই তাঁর ভাইয়ের হাতে খুন হন, যার কারণে এই ল্যাব আর ল্যাবের ভেতরে সৃষ্ট দেমিয়ান সন্তানদের কথা বাকিরা কেউ কখনো জানতেই পারেন না।
আর এরপর ধীরে ধীরে একসময় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে পরম ক্ষমতাধর দেমিয়ান বংশ। পৃথিবী একসময় ভুলতে শুরু করে তাদের অস্তিত্ব।

এরপর অনেক অনেক বছর ধরে এই গবেষণাগার চাপা পড়ে থাকে জঙ্গলের গভীরে। ল্যাবটি ধীরে ধীরে গাছপালার নিচে ঢাকা পড়ে যায়, আর এরপর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাটির নিচে থাকা গবেষণাগারটি একসময় পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। ঘন জঙ্গলে ছেয়ে যায় সম্পূর্ণ দ্বীপ। সেলেস্টোর ছেড়ে দেওয়া সেই বিশেষ ধরণের জ্ঞানহীন প্রাণীগুলো হিংস্র হয়ে উঠে আদিম কালের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে থাকে জঙ্গল জুড়ে। রাজত্ব শুরু করে বর্তমানে রেড জোন খ্যাত জঙ্গলের সমস্ত এরিয়া জুড়ে।

এই সময়ে ক্রমে ক্রমে সৃষ্টি হয় পঞ্চদ্বীপের আরেক বিস্ময়! গাছপালায় আবৃত ল্যাবটিতে রাখা ক্রায়ো চেম্বারগুলোর সাথে সংযুক্ত গাছগুলো ল্যাবের প্রযুক্তির সাথে এক অদ্ভুত কারণে ধীরে ধীরে মিশে যায়।
সেখানের গাছগুলো একত্রিত হয়ে ধীরে ধীরে কনজ্যুম করে ফেলে সেখানের অন্যান্য সমস্ত কিছু! ক্রায়ো চেম্বারে থাকা শেহজাদা দেরকে রক্ষা করা হয়ে ওঠে তাদের বিশাল দায়িত্ব।
সূর্য থেকে শক্তি এবং মাটি থেকে খনিজ শোষণ করে তারা সারাক্ষণ পাওয়ার সাপ্লাই দিতে থাকে ক্রায়ো চেম্বারগুলোতে। ধীরে ধীরে মাটির গভীরে থাকা ল্যাব এবং গাছগুলো মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়ে একসময় হয়ে পড়ে অবিচ্ছেদ্য।

একে অপরের সাথে মিশে গিয়ে তারা তৈরি করে ফেলে এক জীবন্ত গাছ, যা ছিল একদিকে প্রযুক্তি আর অন্যদিকে প্রকৃতির মেলবন্ধন।
দেমিয়ান বংশের এই মাত্রাতিরিক্ত শক্তিশালী সদস্যগুলোর রক্ষক হিসেবে তারা নিয়ে নেয় দায়িত্ব। কিসে তাদের ভালো, কিসে খারাপ, এগুলো নিজেদের সহজাত প্রবৃত্তি দিয়েই তারা নির্ণয় করতে শুরু করে, আর সেই অনুযায়ী করতে থাকে পাওয়ার সাপ্লাই।
ক্রমে ক্রমে এর শিকড় ছড়িয়ে পড়তে থাকে দ্বীপের প্রতিটি কোণায় কোণায়! নিজেদের মাধ্যমে তারা প্রযুক্তিকে মিশিয়ে দেয় প্রকৃতির সাথে।

সময়ের সাথে সাথে বেড়ে যায় গাছগুলোর বুদ্ধিমত্তা! তারা নিজেরাই এবার শুরু করে দেয় জিন কোডিং। কোনো সাহায্য ছাড়াই সক্রিয় হয়ে প্রয়োজন অনুসারে তারা করতে থাকে আশেপাশের সমস্ত পরিবেশকে পরিবর্তন।
ধীরে ধীরে ল্যাব শুদ্ধ গাছটা এমন শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, দ্বীপের সমস্ত পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, প্রাণীদের জীবনযাপন, সবকিছুকেই তারা ক্রমে নিয়ে আসে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে। করতে শুরু করে সবকিছু আরও সুন্দর, আরও উন্নত!
কিন্তু এরপরেই সময়ের পরিক্রমায় একদিন জেগে ওঠে ল্যাবের ভেতরে যুগযুগ ধরে ঘুমিয়ে থাকা জিন কোডিং করা শেহজাদারা।

অত্যাধুনিক মেধা ও ক্ষমতাসম্পন্ন শেহজাদারা সকলে জেগে ওঠে একত্রে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাদের কাউকে কারো চিনতে অসুবিধা হয় না।
ল্যাবটাকে কনজ্যুম করে ফেলা গাছগুলোর কারণেই তাদের নিজেদের ভেতর হয়ে গিয়েছিলো সম্পর্ক। তাদের দেহে মজুদ ছিলো তাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান, মেধা, আর প্রযুক্তি সম্পর্কে সমস্ত তথ্য। ল্যাবের ভেতর রেখে যাওয়া স্বর্ণের বর্মে মোড়ানো বাক্সটা খুলে ভেতরের সমস্ত তথ্য তারা নিয়ে নেয় নিজেদের মাথায়।
আর এরপর তারা বেরিয়ে আসে জঙ্গল থেকে। পর্যবেক্ষণ করে আশেপাশের সমস্ত পরিবেশ। ল্যাবটাকে কনজ্যুম করে ফেলা গাছগুলো ততদিনে হয়ে গেছে একসাথে। একত্রিত হয়ে তারা পরিণত হয়েছে একটি গাছে। শেহজাদারা তখন গাছটির নাম দেয় লাইফট্রি।

এরপর তারা সকলে মিলে ঘুরে দেখে পুরো জঙ্গলটা। তাদের সাথে তখন সাক্ষাৎ হয় জঙ্গলের ভেতর ঘুরে বেড়ানো, সেলেস্টোর সৃষ্টি করা সেই অদ্ভুত প্রাণীকুলের সাথে।
ততদিনে তারা শারীরিকভাবে হয়ে উঠেছে ওদের সৃষ্টির সময়কার থেকে অনেক অনেক উন্নত। আদিম মানুষের মতো অর্ধনগ্ন অবস্থায় নিজেদের দিনাতিপাত করছে। ভাষা জানে না, নিজেদের ভেতর হাতের ইশারায়, মুখ থেকে অদ্ভুত শব্দ বের করে করে তারা করতো ভাব বিনিময়!
তাদের পরখ করে নিয়ে শেহজাদারা এবার তাদেরকে পুরো জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে এনে বন্দি করে রাখে জঙ্গলের একটি নির্দিষ্ট স্থানে।
এরপর তারা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে, খুঁজতে শুরু করে দেমিয়ান বংশের অবশিষ্টাংশ! খুঁজে খুঁজে তারা একসময় পেয়েও যায় গুটিকয়েক ব্যক্তিকে। ততদিনে দেমিয়ান বংশ হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের ক্ষমতা। পৃথিবী নিয়েছে অন্য মোড়!

পুনর্জাগ্রত শেহজাদারা পুরুষগুলোকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া দেমিয়ান বংশের মেয়েদেরকে খুঁজে খুঁজে নিয়ে চলে আসে তাদের দ্বীপে। এরপর তাদের সাথে বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে সূচনা করে এক নতুন সভ্যতার, গড়ে তোলে নতুন এক রাজত্ব।
ধীরে ধীরে লাইফট্রি হয়ে ওঠে দেমিয়ানদের শাসনের একটি অঙ্গ। লাইফট্রি তখন হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী। তার শিকড় সমগ্র দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে গভীরভাবে। তার নিয়ন্ত্রণে দ্বীপের পরিবেশ ও প্রযুক্তি হয়ে ওঠে আরও উন্নত।
শেহজাদাদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য শেহজাদাকে করা হয় বাদশাহ। আর বাকি শেহজাদাদেরকে দেওয়া হয় অন্যান্য দায়িত্ব। ক্রমে ক্রমে এই বিশাল দ্বীপটি পরিণত হতে থাকে একটি অত্যাধুনিক সাম্রাজ্যে।

তবে প্রকৃতি আবারও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় তাদের রাজত্বে। একের পর এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে দ্বীপটি একসময় বিভক্ত হয়ে যায় পাঁচ ভাগে, যা একত্রে পরিচিত হয় পঞ্চদ্বীপ নামে, শিরো মিদোরি হয়ে ওঠে পঞ্চদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র।
লাইফট্রি এই সম্পুর্ন পঞ্চদ্বীপকে তার শেকড়ে আচ্ছাদিত করে নিয়ে, দ্বীপটিকে বাইরের পৃথিবীর থেকে করে ফেলে সম্পূর্ণ অদৃশ্য।

বাইরের পৃথিবীর কেউ যেন এখানে প্রবেশ করতে না পারে, তার জন্য তৈরি করে দেয় সুরক্ষিত ঢালের ন্যায় এক অদ্ভুত আবরণ, যার কারণে বাইরের কেউই দ্বীপটির অস্তিত্ব সম্পর্কে টের পায় না।
আর মূল পৃথিবী থেকে অনেক দূরে হওয়ায় এই অঞ্চলে বহির্বিশ্ব থেকে কিছু আসেনা বললেই চলে। তবে ভুলবসত যারাই চলে আসে, তাদেরকেই করে রাখা হয় বন্দি, তারপর তাদেরকে দাস-দাসী করে রেখে দেওয়া হয় দ্বীপে।
পঞ্চদ্বীপবাসীরা বাইরের পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানলেও, বহির্বিশ্বের কোনো মানুষই পঞ্চদ্বীপের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না।

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৫+২৬

আর এই রহস্যময় গোপন সাম্রাজ্য তখন থেকেই দেমিয়ান শেহজাদাদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে তাঁদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান, প্রযুক্তি, এবং লাইফট্রির সহায়তায়।
সেই থেকে এখনো পর্যন্ত পঞ্চদ্বীপ তার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে গর্বিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে।
আর শিরো মিদোরির লাইফট্রি নিজের সমস্ত টুকু দিয়ে প্রাণপণে এই দ্বীপ এবং তার মালিককে রক্ষা করে চলেছে সমস্ত দুর্যোগ, ক্ষয়ক্ষতি থেকে।

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৯+৩০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here