বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৫+৩৬
রানী আমিনা
কামরায় ফিরে কাজে ব্যাস্ত ছিলো মীর। আনাবিয়া ঘুমিয়ে গেছে এসেই। বাচ্চারা এখনো প্রাসাদে ফেরেনি, রেড জোনে আছে এখনো।
চেয়ারে আরামসে বসে কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছিলো মীর, তখনি ওর স্বর্ণবাধানো টেবিলের ওপরে থাকা একটি ছোট্ট ডিভাইস থেকে ভেসে উঠলো একটি স্বচ্ছ স্ক্রিন, সেখানে ভেসে উঠলো আরহামের মেসেজ,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, হেকিম বাসির দেখা করতে এসেছেন, বলছেন জরুরি।”
মীর ভয়েসে ‘পাঠিয়ে দাও’ বলতেই স্ক্রিনটা মীরের ভয়েস রেকর্ড করে সেন্ড করলো আরহামের নিকট, আর তার কিছুক্ষণ বাদেই কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে এলো বাসির হেকিম।
মীর হাতে থাকা কলমের মুখ আটকাতে আটকাতে চোখ তুলে তাকালো বাসিরের দিকে, তারপর বলে উঠলো,
“এসো বাসির, বসো।”
বাসির হেকিম ধীরগতিতে এসে বসে পড়লো মীরের বিপরীতে থাকা চেয়ারে, তারপর কি বলবে, কিভাবে শুরু করবে বুঝতে না পেরে ইতস্তত ভঙ্গিতে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বসে রইলো।
মীর ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“বলো বাসির, কি জরুরি কথা?”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি……”
বলে আবার চুপ করে গেলো বাসির, মীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে, ওর কথা শেষ করার অপেক্ষায়। বাসির আরও কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে বল্ব উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি…… শেহজাদী সন্তানসম্ভবা!”
বাসিরের কথাটা মীরের কর্ণকুহরে পৌছানো মাত্রই কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো মীর। ওর শিকারির ন্যায় তীক্ষ্ণ চোখজোড়া বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠলো, যেন নিজের কানকে ও বিশ্বাস করতে পারছে না!
উত্তেজনায় কন্ঠরোধ হয়ে এলো ওর, জড়ানো গলায় কোনো রকমে বলে উঠলো,
“স-সত্যিই!”
“জ্বি, ইয়োর ম্যাজেস্টি। শেহজাদীর গর্ভসঞ্চার হওয়ায় ওনার হঠাৎ করেই এই অদ্ভুত উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। আমি শেহজাদীর অগোচরেই তার একটা আলট্রাসাউন্ড করে নিয়েছি গোপনে, ভ্রুণের বয়স সবে দু সপ্তাহ হয়েছে। এখন আপনার কি আদেশ?”
কিন্তু বাসিরের কথার তৎক্ষনাৎ কোনো উত্তর দিতে পারলোনা মীর। ধীরে ধীরে ওর বিস্ময়, স্তব্ধতা রূপ নিলো গভীর আবেগে! ওর দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় বিদ্যুৎ বয়ে গেলো যেন, বুকের ভেতরটা ভরে উঠলো এক অজানা শিহরণে! এই অনুভূতির সাথে ও পরিচিত নয়, একদমই পরিচিত নয়!
নিজের ভেতরে ঝড় তুলতে থাকা সমস্ত প্রবল বেগের উচ্ছাসকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে, কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো মীর, অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,
“শিনজোর শরীরে কি কোনো কম্পলিকেশন্স দেখা যাচ্ছে বাসির?”
“নেগেটিভ ইয়োর ম্যাজেস্টি, এখনো তেমন কোনো গুরুতর কমপ্লিকেশন্স আমি পাইনি, তবে তিনি সামান্য রক্তশূন্যতায় ভুগছেন, এটা হয়তো পর্যাপ্ত খাবার গ্রহণ করলে কমে যাবে। ভ্রুণটা আরও একটু না বাড়লে কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
মীর ভাবলো কিছুক্ষণ।
লাইফট্রি ওদের দুজনকে বেধে দিয়েছে একে অপরের সাথে। এর আগে লাইফট্রি কখনোই দেমিয়ান বংশের দুই সদস্যকে এক করেনি। এবার যখন করেছে তখন নিশ্চয় এর পেছনে কোনো গুরুতর কারণ নিহিত আছে।
শিনজো যদি মীরের বাচ্চা ধারণে অক্ষম হতো, ওর যদি লাইফ রিস্ক থাকতো তবে লাইফট্রি কি ওদেরকে একত্রিত করতো? সে তো চেষ্টা করতো শিনজোকে যে কোনো মূল্যে সুরক্ষিত রাখতে।
তবে ওদেরকে একত্রিত করার কারণ কি? নিশ্চয় শিনজোর গর্ভসঞ্চারের কারণে এবার আর কোনো অসুবিধায় পড়তে হবে না ওদের!
মীর কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিরাবতা ভেঙে উত্তর দিলো,
“এখনি কিছু করার প্রয়োজন নেই বাসির। আমার মন বলছে আমার বাচ্চাটা সুস্থসবল ভাবে এই পৃথিবীতে আসবে। নইলে যেখানে দেমিয়ান বংশের কোনো শেহজাদীকে বংশের কোনো শেহজাদার সাথে বিবাহ সম্পুর্ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে লাইফট্রি সবকিছু জেনে শুনে আমাকে এমন পরামর্শ কখনোই দিতোনা।
হয়তো এবার আমাদের বংশে আমূল পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে বাসির! লাইফট্রির নিশ্চয় আমাদের সন্তানদেরকে নিয়ে ভালো কোনো পরিকল্পনা আছে।”
বাসির হেকিম মীরের কথায় সায় জানালো। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা নিয়মে হঠাৎ পরিবর্তন করতে লাইফট্রি কেন বলবে? নিশ্চয় এর পেছনে কোনো বড়সড় কারণ আছে; পজিটিভ হোক বা নেগেটিভ।
মীরের সাথে আরও কিছুক্ষণ টুকটাক পরামর্শ করে মীরের কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো বাসির৷ বেরিয়ে যাওয়ার আগে মীর ওকে সাবধান করে দিলো যেন এই ব্যাপারটা বাসির ছাড়া অন্য কেউ কোনোভাবেই না জানে, আনাবিয়াও না।
বাসির বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই মীরের এতক্ষণের চেপে রাখা উচ্ছাস আর বাধা মানলোনা, প্রচন্ডরকম ভাবে প্রকট হয়ে উঠলো ওর চেহারায়! অধর যুগল প্রসারিত হয়ে উঠলো প্রবল আনন্দের তোপে, চোখ জোড়া ভরে উঠলো নির্মল আনন্দাশ্রুতে!
ওর পরিবার, ওদের দুজনের ছোট্ট পরিবারে আরও কেউ একজন আসতে চলেছে! ওর বুকের ভেতরের যে সমস্ত জায়গাটুকু ওর প্রাণের জন্য বরাদ্দ ছিলো সেখানে গুটিসুটি মেরে জায়গা করে নিতে চলেছে এক অনাগত ছোট্ট প্রাণ! চলেছে কি, ইতোমধ্যে নিয়েও ফেলেছে!
এই আনন্দ ও কার সাথে ভাগ করবে এখন?
নিজের চেয়ারে বসেই বাচ্চাদের মতো করে একা একাই হেসে উঠলো মীর, নয়ন যুগল ভর্তি হয়ে অবশেষে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো ওর চোয়াল বেয়ে।
বাবা হতে চলেছে ও, বাবা!
সালিম ভাইজান বেঁচে থাকলে নানা হওয়ার খুশিতে সে আজ কি করতো? নিশ্চয় এখন এসে ওর গলায় ছুরি ধরে বলতো তোকে আমার মেয়ের দেখাশোনা করতে বলে গেছিলাম, আর তুই এরকম দেখাশোনা করলি?
তারপর কি করতো? জড়িয়ে ধরতো ওকে?
নির্মল হাসলো মীর, চোখের ওপর ভেসে উঠলো আনাবিয়ার পিতার অত্যান্ত সুদর্শন মুখখানা, আর তার পরমুহূর্তেই ভেসে উঠলো সালিমের মৃত্যুকালীন সময়ে ওর চেহারার ওপরের ফুটে ওঠা সেই ভীষণ যন্ত্রণার ছাপ!
মীরের দুহাত নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে নিজের অনাগত সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেওয়ার সেই নিদারুণ দৃশ্য, স্বামীর শোকে পাগল হয়ে আনাবিয়াকে জন্ম দিতে গিয়ে ইনায়ার সেই মর্মান্তিক মৃত্যু!
চোখ বুজে নিলো মীর, ওর ছোট্ট শিনুর গায়ে ও কখনো কোনো আঁচ লাগতে দেয়নি। নিজের সমস্ত টুকু দিয়ে সালিমের কথা রেখেছে ও৷ ওর শিনু কখনো ওর বাবা মাকে কাছে পায়নি, কিন্তু মীর ওকে কখনো বুঝতে দেয়নি কারো অভাব! চরম আদরে পৃথিবীর সমস্ত কঠোরতা থেকে, সমস্ত কলুষতা থেকে আগলে রেখে দিয়েছে নিজের বুকের ভেতর!
ওর শিনজো কাউকে পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেলেছে, নিজের কাছের মানুষগুলোর মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি ওকে, কিন্তু মীরের সম্মুখে শেষ হয়ে গেছে ওর সম্পুর্ন পরিবার!
ওর প্রাণের আম্মা, ওর দাদাজান, ওর বাবা, ওর বন্ধু; বলা যায় মায়ের পেটের ভাইয়ের থেকেও আপন সেই সালিমকে!
মীরের কি নিজের মায়ের পেটের ভাই ছিলো না? ছিলো। কিন্তু সে কি করেছে?
যে মানুষটার কারণে মীর নিজের সমস্ত কাছের মানুষকে হারালো তার সাথে হাত মিলিয়ে শিনজোকে কেড়ে নিতে চাইছিলো ওর থেকে!
যারা মীরের আপন ছিলো তারা কি তারও আপন ছিলোনা? তাহলে কিভাবে পারলো সে এমনটা করতে? কিভাবে পারলো ওর বাবার, ওর ভাইয়ের খুনীর সাথে হাত মেলাতে!
মীর ঝেড়ে ফেললো সব অতীত। এসব ও আর কখনোই মনে করবেনা, আর না কখনো ওর শিনজোকে জানতে দেবে এসব ব্যাপারে। ওর ওই সুন্দর, মায়াভরা হৃদয়কে ও এসমস্ত নোংরা হৃদয়ের মানুষজনের কথা দিয়ে ভরাতে চায়না মীর।
সুন্দর থাকুক ওর শিনজো সারাজীবন, থাকুক এমন নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ!
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো মীর, চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুকণা গুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা মুছে ফেলে এগোলো আনবিয়ার কামরার দিকে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো বিছানার ওপর এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে থাকা আনাবিয়ার দিকে। ঘুমিয়ে গেলে পোশাক আশাক তার একটা মক্কা একটা মদিনা হয়ে থাকে।
মীর মৃদু হাসলো, এই দুষ্টুর কোলে আর একটা দুষ্টু এসে পড়লে তখন যদি সেও মায়ের মতো প্রতি ওয়াক্তে জিদ ধরে বসে থাকে তবে কিভাবে সামাল দিবে ও?
মীর এগিয়ে এসে সন্তর্পণে বসলো আনাবিয়ার পাশে, এক হাতে আলতো করে ঠিক করে দিলো গায়ের ওপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা পোশাক।
ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওর শিনজোকে খুব! মুখ শুকিয়ে গেছে।
আনাবিয়ার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো মীর। এখনো ওর বিশ্বাস হচ্ছেনা যে ও বাবা হতে চলেছে! স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে ওর কাছে সবকিছু!
হুট করেই আনাবিয়ার পাশে শুয়ে পড়ে আনাবিয়াকে জড়িয়ে ধরলো ও নিজের শক্ত হাতের বাঁধনে, মিশিয়ে নিলো বুকের সাথে! আনাবিয়া ঘুমের ঘোরে নিজের চিরচেনা বুকের স্পর্শ পেয়ে একটুখানি নড়ে উঠে নিজেকে মীরের বুকের আরও ভেতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ঘুমোলো আরও গভীর ঘুম!
মীর স্নেহভরে আনাবিয়ার চুলের ওপর দিয়ে চুমু খেলো একটা। কণ্ঠস্বরে গভীর মমতা আর ভালোবাসা মিশিয়ে ও মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
“আমার জন্য এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপহার তুমি। আর এখন সেই তুমি আমাকে এমন কিছু দিতে চলেছো যা আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি শিনজো!
আমাকে এমন অবর্ণনীয় সুখের অনুভূতির সাথে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য তোমার নিকট আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো প্রাণ আমার।”
আনাবিয়ার ঘুমন্ত মুখখানা নিজের ঠোঁটের স্পর্শে ভরিয়ে দিলো মীর। ওর শ্বাপদসুলভ অস্তিত্বের মাঝে জন্ম নিলো নতুন এক কোমলতা, বুকের ভেতর জেগে উঠলো সম্পুর্ন নতুন এক রক্ষকসুলভ প্রবৃত্তি!
ওর শিনজো আর ওর অনাগত সন্তান—এখন থেকে এই দুইটা প্রাণই হবে ওর সমস্ত অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু।
জঙ্গলের ভেতরে বাচ্চারা এখনো হুটোপুটি করছে। কাল থেকেই হিজ ম্যাজেস্টির অনেস্ট এমপ্লয়ি হয়ে যেতে হবে ওদের, ফাঁকি দেওয়ার আর সুযোগ নেই। তাই আজ রাতটা একটু এনজয় করা যেতেই পারে।
এই মুহুর্তে বাচ্চারা সকলে পাঞ্জা খেলছে।
ফ্যালকন রেফারি, এসব হাতাহাতির ভেতরে যাওয়ার মতো শরীর, শক্তি এবং সাহস কোনোটাই ওর নেই। ওর ভাইয়েরা সব বিশাল বিশাল পালোয়ান, আর সেইখানে ও পাটখড়ির মতো শুকনো!
কোকো বসে আছে ওদের থেকে দূরে এক কোণায়৷ খাওয়া একটু বেশি হয়ে গেছে ওর, এখন আর নড়তে পারছেনা।
শেহজাদীর হাতের রান্না খাওয়ার সময় হুশ থাকেনা ওদের কারো। তার ওপর কোকোকে ছোটবেলা থেকেই গান্ডে পিন্ডে খাইয়ে খাইয়ে আনাবিয়া ওর খাওয়ার অভ্যাস করিয়ে ফেলেছে। এখন তাই প্রতি ওয়াক্তে গামলা গামলা না খেলে ওর পেট ভরেনা৷
কোকো বসা থেকে উঠে ওদের দিকে এলো এমন সময়। এসেই গর্জন দিয়ে বলে উঠলো,
“এই সর সব, এখন আমি খেলবো।”
কোকোর গর্জনের সাথে সাথেই বাচ্চারা সব জায়গা ছেড়ে দিলো ওকে, কোকো জায়গায় বসে পাশে দাঁড়িয়ে রেফারি গিরি করা ফ্যালকনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“হাঁসের বাচ্চা, এদিক আয়। তুই খেলবি আমার সাথে।”
ফ্যালকনের গলা শুকিয়ে গেলো, ঢোক গিলে কাঁদোকাঁদো গলায় উত্তর দিলো,
“ক-কিন্তু আম-আমি তো র-রেফারি!”
“যা বলেছি তাই করবি, সামনে আয়। নইলে তোকে এখানেই কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো মাথায় রাখিস।
না, তোকে কাঁচা খাবোনা, তোর গা থেকে হাঁস হাঁস গন্ধ আসে, আমারতো রুচি বলে একটা জিনিস আছে!
আগে টেনে টেনে তোর পালকগুলো ছিড়বো, তারপর তোকে গরম পানিতে সিদ্ধ করবো, তারপর তোর চামড়া ছিলবো, তারপর বার্বিকিউ করে খাবো।”
ফ্যালকন ঠোঁট ফুলিয়ে এসে বসলো কোকোর সামনে। চোখে পানি এসে গেলো ওর, কোকো ভাইয়া এভাবে ওকে হুমকি দিলো অথচ কেউ ওর হয়ে সামান্য প্রতিবাদ টুকু পর্যন্ত করলোনা!
হিঁচকি তুলে চোখের পানি ফেললো ও। কোকো আঙুল তুলে বলল,
“শালা হাঁসের বাচ্চা এখানে বসে ন্যাকা কান্না কেঁদেছিস তো তোকে……”
এমন সময়ে হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনে কথার মাঝেই থেমে গেলো কোকো। আর তার পরমুহূর্তেই সেখানে আগমন ঘটলো মীরের।
দুড়ুম দাড়াম করে সবগুলো উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রইলো। হিজ ম্যাজেস্টি হঠাৎ প্রাসাদ ছেড়ে জঙ্গলে এলেন সেটাও একা, ভেবে ওরা চিন্তিত হলো কিছুটা।
ঢোলাঢালা পাতলা একটা ফুল স্লিভ টি শার্ট আর ট্রাউজার পরিহিত মীর ধীর পায়ে হেটে এসে দাড়ালো ওদের সামনে, রেড জোনের ভেতরকার মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খেতে লাগলো ওর ঘাড় বাবরি ঝাকড়া চুল। স্বর্ণোজ্জল চোখ জোড়া নিবদ্ধিত রইলো বাচ্চাগুলোর মুখের ওপর।
এই বাচ্চা গুলোকে আনাবিয়া ভালোবাসা, মায়া মমতা দিয়ে নিজের হাতে করে গড়ে তুলেছে, এদেরকে দেখা মাত্রই আনাবিয়ার সেই সুন্দরতম মাতৃসত্ত্বার কথা মনে পড়ে যায় মীরের, ভালো লাগে ওর প্রচন্ড!
মীর বাচ্চাদের কাছাকাছি এগিয়ে এসে বসতে নির্দেশ দিলো সবাইকে। বিনা বাক্যব্যয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়লো ওরা। মীর চারদিকে নজর বোলালো একবার, সব ক্লিয়ার, কোথাও কোনো নোংরা অবশিষ্ট নেই।
মীর নিজেও এবার এসে বসলো ওদের বিপরীতে। তারপর নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে ও মৃদু, গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“তোদের সাথে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।”
বাচ্চারা সকলে কৌতূহল নিয়ে আড়চোখে তাকালো কয়েকবার মীরের দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা, যে হিজ ম্যাজেস্টি সেটা বলার জন্য সোজা রেড জোনে চলে এসেছেন!
একে অপরের দিকে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে ওরা দেখলো, ভাব বিনিময় করার চেষ্টা করলো। তার ভেতরেই ভেসে এলো মীরের কন্ঠস্বর, কোকোর উদ্দ্যেশ্যে সে বলে উঠলো,
“কোকো, তোর আম্মা এখন আর শুধুই তোর আম্মা থাকছেনা।”
মীরের কথায় চমকে উঠলো কোকো, হিজ ম্যাজেস্টি এ কথা দ্বারা ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন বোঝার চেষ্টা করলো ও কিছুক্ষণ। কিন্তু কিছুই মাথায় এলোনা ওর।
বাচ্চাদের এমন দ্বিধাভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে মীর নরম হেসে বলে উঠলো,
“আমার পরিবারে একজন নতুন সদস্যের আগমন ঘটতে চলেছে, আমি বাবা হচ্ছি।”
মীরের কথা ওদের কানে যাওয়া মাত্রই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মীরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওরা, আর তার পরমুহূর্তেই প্রচন্ড উচ্ছাসে ফেটে পড়ে আনন্দে চিৎকার নাচানাচি শুরু করে দিলো, মীর যে ওদের সামনে বসে আছে সেটা যেন এই মুহুর্তে ভুলেই গেলো ওরা!
কোকো আর ফ্যালকন পাশাপাশি বসে ছিলো, দুজন নেচে উঠে দাঁড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো একে অপরকে, একটুখানি আগে হওয়া হুমকি ধামকি সব ভুলে গেলো নিমিষেই। ফ্যালকন কোকোকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলল,
“কোকো ভাইয়ারে, আমাদের একটা ভাই আসতে চলেছে!”
“চুপ থাকা হাঁসের বাচ্চা, ও শুধু আমার ভাই। কারণ আম্মা শুধু আমার আম্মা, তোদের শেহজাদী! তাই তোরা আমার ভাইকে শেহজাদা ডাকবি বুঝেছিস?”
বলে ফ্যালকনকে আদরের আলিঙ্গনে পিষে দিলো কোকো, ফ্যালকন কান্না চোখেই হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। বাচ্চারা সব এ ওকে জড়িয়ে ধরে চিল্লাপাল্লা করতে শুরু করলো, কোকো গিয়ে লিও কে খানিক ঝাকালো আনন্দের চোটে।
এটা ও আনাবিয়ার থেকে শিখেছে, আনাবিয়াও অতিরিক্ত খুশিতে সামনে যাকে পায় তাকে ধরে খানিক ঝাকিয়ে দেয়।
মীর কপাল চাপড়ালো, কাদেরকে এসে ও এই খবর দিলো! মনে মনে আফসোস হলো ওর। হঠাৎ করেই ও উচ্চস্বরে ধমকে বলে উঠলো,
“সাইলেন্স!”
বাচ্চারা থেমে গেলো সাথে সাথেই, এতক্ষণে ওদের হুশ হলো যে ওদের সামনে স্বয়ং হিজ ম্যাজেস্টি বসে আছেন। অপ্রস্তুত হয়ে ওরা আবার এসে বসে পড়লো নিজেদের স্থানে, মুখে লেপ্টে রইলো প্রচন্ড খুশি। মীরের পরবর্তী আদেশের জন্য মুখিয়ে রইলো ওরা।
মীর ওদেরকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিয়ে বলে উঠলো,
“এই ব্যাপারে আমার শিনজো এখনো কিছুই জানেনা, আর ওকে আমি জানাতেও চাইনা। আমি চাই ও এই ব্যাপারটা নিজে বুঝতে পেরে আমাকে জানাক।
ওর মাতৃত্বের এই মিষ্টি মুহুর্ত থেকে আমি ওকে বঞ্চিত করতে চাইনা, ওকে আমি এই খুশিটা দিতে চাই। তাই তোরাও এই ব্যাপারে ওকে কিছুই জানাবিনা।”
বাচ্চারা মনোযোগ দিয়ে শুনলো মীরের কথা, মীর কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
“এই ব্যাপারে হেকিম বাসির ছাড়া প্রাসাদে অন্য কেউই জানেনা। আর দুজন ব্যাক্তি এই ব্যাপারে জানবে, ইয়াসমিন আর জায়ান ভাইজান৷
আমি সর্বক্ষণ আমার শিনজোর পাশে উপস্থিত থাকতে পারবোনা। তাই এই পুরোটা সময় আমি কোকো আর ফ্যালকনকে আমার শিনজোর পাশেই দেখতে চাই। বাকিরা কাল থেকেই কাজে জয়েন করবে। আর ইয়াসমিনকেও সংবাদটা তোরা দুজন দিবি।”
শেষোক্ত কথাটা কোকো ফ্যালকনকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল মীর। মীরের কথায় ওরা দুজন খুশি হয়ে গেলো, শেহজাদীর সেবাযত্ন করার ওছিলায় ওরা আরও কিছুদিন আরামে থাকতে পারবে। দুজন সোৎসাহে সমস্বরে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনার আদেশ শিরোধার্য।”
মীর উঠে দাড়ালো এবার, তারপর ওদের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“এখন সবগুলো প্রাসাদে ফিরে যাবি, আর রাতেই ইয়সামিনকে জানিয়া রাখবি। সকাল থেকেই আমার শিনজোকে যেন বাসিরের সাজেস্ট করা প্রপার ম্যিল দেওয়া হয়।”
বাচ্চারা সব মীরকে আনুগত্য জানিয়ে উচ্ছসিত হয়ে নাচানাচি মারামারি করতে করতে এগোলো প্রাসাদের দিকে। নতুন সদস্যের আগমনের প্রস্তুতি কে কিভাবে নিবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে করতে চোখের আড়াল হয়ে গেলো ওরা৷ মীর তখনো রয়ে গেলো রেড জোনের ভেতর।
আর এরপর সকলে চলে গেলে জঙ্গল যখন আবারও নিরব হয়ে উঠলো তখন বাবা হওয়ার খুশিতে আত্মহারা হয়ে মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো ওর। রেড জোনের মাটিতে শুয়ে পড়লো ও পিঠ ঠেকিয়ে, হাত জোড়া বাড়িয়ে দিলো দুদিকে। রাতের আকাশে স্বর্ণের থালার ন্যায় বিশাল জ্বলজ্বলে চাঁদটা আলো ছড়াতে লাগলো ওর ভ্রমরকালো শরীরের ওপর।
অধর যুগলে ভীষণ সুখের উল্লাস বার বার এসে হানা দিতে রইলো, আর এরপর হঠাৎ করেই মীর প্রচন্ড খুশিতে এই জনমানবহীন প্রকৃতির উদ্দ্যেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“হে শিরো মিদোরি, শুনেছো তুমি? আমি বাবা হতে চলেছি, বাবা!”
সমুদ্রের ধ্রুপদী গর্জনের সাথে তাল মিলিয়ে ঝড়ো বাতাসে উড়ে চলেছে আনাবিয়ার শুভ্র কেশগুচ্ছ। প্রাসাদের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ছুটে আসা ঢেউ দেখছে ও গভীর মনোযোগ দিয়ে।
ছাদের ঠিক মাঝখানে বাধানো এক বিশাল, আয়নার মতো চকচকে, স্বচ্ছ জলাধার— দিনের আলোয় টলমল করছে। আকাশের নীলিমা প্রতিবিম্বিত হচ্ছে সেখানে।
মাঝেমধ্যেই সামুদ্রিক পাখিরা নির্ভয়ে এসে বসছে ছাদের ওপর, জলাধারের কিনারে ঠোঁট ছুঁইয়ে নিজেদের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে। সমুদ্রের বাতাসে ছাদের অন্য কোণায় থাকা ছোট্ট বাগানের সাদা আর নীল ফুলের গাছগুলো দুলছে থেকে থেকেই, তাদের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
এই ছাদ আনাবিয়ার অত্যন্ত প্রিয় জায়গা গুলোর একটি। এখানে বসে বসে সে সমুদ্র দেখে, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আকাশের নীলে চোখ রাখা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, আর নিচে তাকালেই দেখা যায় শিরো মিদোরির বিস্তৃত সবুজ বনানী, যার গা ঘেঁষে নীল সমুদ্রের অসীম বিস্তার।
কখনো মীরের সাদা শার্ট পরে বাতাসের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে ও, শুভ্র চুলগুলো উড়তে থাকে দিকহীন বাতাসে। কখনো মীরের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে রাতের আকাশ দেখে, কখনোবা বসন্তের হাওয়ার ছোঁয়ায় চুল উড়িয়ে মীরের বাহুতে লীন হয়!
জলাধারের চারপাশে ছড়িয়ে আছে বিশাল নরম সোফাসেট, সেখানে বসে ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়ানো আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে কোকো আর ফ্যালকন। সামনে ওদের এক বাটি টুকরো করা ফল।
পেছন থেকে কোকো আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে অনুরোধের সুরে বলে উঠলো,
“আম্মা, এগুলো শেষ করুন প্লিজ! নইলে হিজ ম্যাজেস্টি চটকাবে আমাকে!”
কোকোর কথা শুনে পেছনে ফিরে ওর দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আনাবিয়া বলল,
“তুই মীরের হাতের টাইগার পাঞ্চ খেলেও আমি আর এক টুকরো ফলও খাবোনা!”
বলে আবার সমুদ্রের দিকে ফিরলো ও। সবাই মিলে ওকে আজ এক সপ্তাহ ধরে খাইয়ে খাইয়ে আধমরা করে ফেলার চেষ্টায় আছে৷
মীর এসে ওকে খাওয়াবে, ইয়াসমিন এসে খানিকক্ষণ সাধবে, আর এই দুটো সারাক্ষণ চারপাশে ঘুরঘুর করবে আর জ্বালিয়ে মারবে ওকে!
এমন সময় ছাদের অন্যপাশের প্রশস্ত ধাতব সিঁড়িতে শোনা গেলো মীরের পদধ্বনি। জোর কদমে উঠে আসছে সে। আনাবিয়া না দেখেও বলে দিলো এটা মীর ছাড়া অন্য কেউ নয়! মীর ওর আশেপাশে এলেই ও টের পেয়ে যায়, ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রচন্ডভাবে ধাক্কা দিতে থাকে ওর হৃদপিণ্ডে— বুঝিয়ে দিতে চায় যে সে আসছে তোমার কাছে!
আনাবিয়া দ্রুতপায়ে রেলিং ছেড়ে এগিয়ে গেলো সিড়ির দিকে। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই মীরকে দেখেনি ও, তিনি ব্যাস্ত লোক! এখন শেষ বিকেলে ব্যাস্ত মানুষের বউয়ের কথা মনে পড়েছে বোধ হয়!
আনাবিয়া সিড়ির কাছে পৌছাতেই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো মীর, এসেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে আনাবিয়াকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিজের শক্ত বাহুর অবলম্বনে উঁচিয়ে ধরলো ও। তারপর ওর শুভ্র চোয়ালে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে এগোলো সোফার দিকে।
কোকো আর ফ্যালকন সটান দাঁড়িয়ে আনত নয়নে তাকিয়ে ছিলো মেঝের দিকে। হাতে কোকোর এখনো ফলের বাটি। মীর এগিয়ে এসে আনাবিয়াকে সোফার ওপর বসিয়ে দিয়ে কোকোর হাতের বাটির দিকে দৃকপাত করলো, সেখানে অর্ধেকের বেশি ফল থেকেই গিয়েছে, কিচ্ছু খায়নি আনাবিয়া।
মীর কটমট করে তাকালো কোকোর দিকে, কোকো সেটা টের পেয়ে আনত দৃষ্টিতে থেকেই কাতর কন্ঠে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আম্মা খেতে চাইছেন না!”
মীর ওর হাত থেকে বাটিটা কেড়ে নিয়ে এসে বসলো আনাবিয়ার সামনে, তারপর কাঁটাচামচে এক টুকরো ফল গেথে ঠেসে দিলো আনাবিয়ার মুখের ভেতর, আনাবিয়া সেটা জিভ দিয়ে ঠেলে ফেলে দিতে চাইলে মীর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে আবার ঠেলে সেটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
“একদম দুষ্টুমি করবেনা শিনজো, চুপচাপ এগুলো শেষ করবে।”
বলে আর এক টুকরো ভরে দিলো ওর মুখের ভেতর। আনাবিয়ার হলো রাগ, সবাই কি পেয়েছে কি ওকে? এমনে কেউ গাদিয়ে গাদিয়ে খাওয়ায়?
নাকের পাটা ফুলিয়ে মুখ ঝামটা মেরে মীরের সামনে থেকে উঠে চলে যেতে নিলো ও, কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে দু কদম যেতেই আর এগোলোনা ওর পা জোড়া, মাথা ঘুরে ছাদের শক্ত মেঝের ওপর তখনি শব্দ করে আছড়ে পড়লো ও!
প্রাসাদের মেডিক্যাল জোনের বাইরের বিরাট বিশাল বারান্দার রেলিং ঘেঁষে অস্থির চিত্তে বার বার এদিক ওদিক পায়চারী করে চলেছে মীর। কোকো আর ফ্যালকনও চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়।
ছাদ থেকে আনাবিয়াকে তখনি কোলে তুলে নিয়ে ছুটে সোজা মেডিক্যাল জোনে চলে এসেছিলো মীর।
এখন ও অপেক্ষায় আছে কখন ওর শিনজো জ্ঞান ফিরে বাইরে বেরোবে, কখন নিজে থেকেই বলবে ওকে ওদের মাঝে সেই ছোট্ট সদস্যের আগমনের খবর!
ব্যাপারটা চিন্তা করেই মীরের বুকের ভেতর অন্যরকম অনুভূতি ঝড় তুলে দিচ্ছে!
মেয়েটার কত্ত শখ ছিলো ওদের বাচ্চার!
আমাজনে থাকাকালীন সাফওয়ানের বাচ্চা দুটোকে কোলে রেখে ও কতবার বলেছে নিজেদের বাচ্চার কথা।
মীর তখন শুধু দেখতো ওর হাসিমুখ খানা, চকচকে হয়ে ওঠা চোখের ঝকমকে তারা জোড়া!
আনাবিয়ার ভেতরের প্রখর মাতৃসত্ত্বা কি ও অনুভব করেনা? অবশ্যই করে! মীর সামান্য কাশলেও আনাবিয়ার ঘুম হয়না সে রাতে, সারাটাক্ষণ ও মীরকে এমন ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখে যে মীরের মনে পড়ে যায় ওর মায়ের কথা!
ওর মা যেমন ও বাইরে থেকে আসা মাত্রই ছুটে আসতো ওর কাছে, হাত বুলিয়ে দিতো ওর ঘর্মাক্ত দেহে, বার বার করে জিজ্ঞেস করতো খেয়েছে কিনা, পেট ভরেছে কিনা!
ওর শিনজোও কি তেমনটা করেনা?
মীরের পেট ভরা নিয়ে সেওকি বরাবরই শঙ্কিত নয়? সেই ছোট্ট বেলাটা থেকে মীর সামান্য অসুস্থ হলেই ওর ছোট্ট বউটি পালন করে মমতাময়ী গুরুগম্ভীর অভিভাবকের ভূমিকা, যার শাসনের নজর এড়িয়ে মীরের এক বেলার খাবার, এক বেলার ঔষধ স্কিপ করার কোনো সূযোগ ছিলোনা!
মৃদু হাসে মীর, বার বার অধীর আগ্রহে ও তাকায় মেডিক্যাল জোনের রয়্যাল এরিয়ার দিকে; এই বুঝি মুখে বিশ্বজয়ীর হাসি মাখিয়ে বেরিয়ে এলো ওর শিনজো, এসেই উচ্ছসিত হয়ে জড়িয়ে নিলো ওকে!
কিন্তু বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেলেও দেখা মিললোনা আনাবিয়ার, তার পরিবর্তে প্রচন্ড শঙ্কিত চেহারা নিয়ে, অস্থীর, ক্ষিপ্র পায়ে মেডিক্যাল জোনের বাইরে বেরিয়ে এলো বাসির।
চোখ জোড়াতে ফুটে ওঠা ভীষণ রকম উদ্বিগ্নতাকে আড়াল করে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে মীরের দিকে দ্রুত পায়ে এগোলো সে।
ওকে এমন চেহারায় এভাবে আসতে দেখা মাত্রই বুক কেপে উঠলো মীরের, অজানা এক দুঃসহ শঙ্কা ভীতিসঞ্চার করে বসলো ওর বুকের ভেতরটায়।
তড়িৎ পায়ে সেও এগিয়ে গেলো বাসিরের দিকে, দুঃশ্চিন্তায় কুচকে যাওয়া ভ্রু জোড়াকে যথাসম্ভব সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে উৎকন্ঠিত স্বরে ও শুধালো,
“কি হয়েছে বাসির? তোমাকে এমন লাগছে কেন? আমার শিনজো কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে ওর?”
“ই-ইয়োর ম্যাজেস্টি! শেহজাদী মাত্রাতিরিক্ত রক্তশূন্যতায় ভুগছেন! তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক, ব্লাড প্রেশার ক্রমাগত কমছে, এবং তিনি কোনো রিফ্লেক্স প্রদর্শন করছেন না। তাঁর চেতনা ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাও দেখছিনা না।মস্তিষ্কের কার্যক্রম ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোনো ভাবেই তাঁর মস্তিষ্ক সচল হচ্ছেনা! চব্বিশ ঘন্টা না গেলে আমরা কিছুই বলতে পারছিনা, তবে আমার ধারণা তিনি কোমায় চলে যেতে চলেছেন!”
এক নিঃশ্বাসে ঝড়ো বেগে কথাগুলো বলে বাসির দম নিতে থাকলো জোরে জোরে, প্রচন্ড দুঃশ্চিন্তায় বুকটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে ওর। এই সম্পুর্ন ডাক্তারি জীবনে কোনো রোগী কে কোমায় যেতে দেখে এই প্রথমবার ওর নিজেরই মস্তিষ্ক বন্ধ হওয়ার উপক্রম!
কিন্তু বাসিরের কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্রই স্তব্ধ হয়ে গেলো মীর, বাকরুদ্ধ হয়ে এলো ওর কন্ঠ! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে বাসিরের দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে ও অস্ফুটস্বরে শুধোলো,
“এ-এরকমটা কেন হচ্ছে বাসির?”
বাসির সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকালো একবার, তারপর মীরের আরও কাছাকাছি এগিয়ে এসে নিচু, শঙ্কিত স্বরে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি! শেহজাদীর শরীরে যে অংশটা বেড়ে উঠছে সেটা অস্বাভাবিক, শেহজাদীর শরীরের সমস্ত ব্লাড সেই শুষে নিচ্ছে। শেহজাদীর শরীর থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে এনার্জি, অতিরিক্ত পুষ্টিগুণ শুষে নিচ্ছে সে।
ভ্রুণটির বয়স তিন সপ্তাহের সামান্য অধিক হলেও তার গড়ন দুমাস বয়সী ভ্রূণের থেকেও বড়, অল্প কয়েকদিনেই অস্বাভাবিক রকমের আকৃতি নিয়েছে সে।
ভ্রুণটাকে এভাবে বাড়তে দিলে অচিরেই সে অত্যাধিক আকৃতি নিয়ে শেহজাদীকে ভেতর থেকেই জখম করতে শুরু করবে, আর এরকমটা চলতে থাকলে আমরা শেহজাদীকে খুব দ্রুতই হারিয়ে ফেলবো!
ভ্রুণটি এখন থেকেই ব্লাড শুষে নিতে শুরু করেছে, তাই আমরা ধারণা করছি রক্তের অভাব বোধ করলে কিছুদিন পর থেকে সে ভেতর থেকেই তার মাতৃ শরীর ভক্ষণ করা শুরু করবে। এখন আপনার কি আদেশ? কি করবো আমরা?”
মীরের হৃৎপিণ্ড থেমে যেতে নিলো যেন, হতভম্ব দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে রইলো বাসিরের দিকে! ওর চারপাশের সমস্ত পৃথিবীটাই যেন অন্ধকার হয়ে যেতে নিলো। সুতীব্র টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে পিষে যেতে লাগলো ওর হৃদয়।
কোথায় আশ্রয় নেবে ও এখন? কার কাছে গিয়ে স্বান্তনা চাইবে? যার বক্ষে মাথা রেখে ও স্বান্তনা খুজে পায় সে তো নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে ভেতরে! কি করবে ও এখন?
ওর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি, ওর আনাবিয়া, ওর শিনজো, ওর প্রাণ— যে ওকে দিয়েছে ওর অস্তিত্বের অর্থ; সে নিঃশেষ হয়ে যেতে চলেছে! এটা ও কিভাবে মেনে নিবে?
মীরের সমস্ত শক্তি যেন হঠাৎ করেই নিভে এলো, চোখ জোড়ায় ফুটে উঠলো ভয়ানক রকম অসহায়ত্ব।
পেছনে কোকোর সাথে দাঁড়ানো ফ্যালকন কেঁদে উঠলো ডুকরে, কোকো দ্রুত হাতে ফ্যালকনের মুখে হাত চাপা দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করলো ওর কান্নার শব্দ লুকানোর, কিন্তু ব্যর্থ হলো!
কোকোর চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো, হিজ ম্যাজেস্টির কি হবে এখন? কি করবেন তিনি? কিভাবে সামলাবেন নিজেকে? এই মানুষ টা নিজের স্ত্রীর গর্ভসঞ্চার হওয়ার খুশিতে যে ছোট্ট শিশুটির মতো হেসেছিলেন, লুকিয়ে দেখে ছিলো ওরা!
কি হবে তাঁর এখন? একই সাথে স্ত্রীর এমন মুমূর্ষু অবস্থা, সাথে সদ্য গর্ভে আসা ছোট্ট প্রাণটার এমন দশা! কিভাবে সহ্য করবেন তিনি এসব?
বাসিরের কথা শুনে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো ফ্যালকন। কোকো সজোরে বুকে জড়িয়ে নিলো ওকে, চাপাস্বরে বার বার করে বলল ‘কাঁদিস না ফ্যালকন, চুপ কর ভাই আমার! হিজ ম্যাজেস্টির জন্য অন্তত নিজেকে শক্ত রাখ!’
কিন্তু ফ্যালকনের দুর্বল হৃদয় এসব বাধা মানলোনা, উচ্চস্বরে আরও একবার কঁদে উঠে, ওর আদুরে মায়ের এমন অবস্থা সহ্য করতে না পেরে তখনি জ্ঞান হারিয়ে কোকোর গায়ের ওপর ঢলে পড়লো ও!
মীর কোনো কিছু শুনতে পেলোনা যেন, অচল হয়ে যেতে নিলো ওর শরীর, ওর মস্তিষ্ক! বুক ভরে দম টেনে নিয়ে ভেতর থেকে হাহাকার করে বেরিয়ে আসতে চাওয়া আর্তচিৎকারকে ভেতরেই দাফন করে দিলো আর তারপর চোখ ফিরিয়ে নিলো সমস্ত কিছু থেকে।
আনাবিয়াকে দেখতে মন চাইলো ভীষণ, কিন্তু মস্তিষ্ক বলে উঠলো এখন আনাবিয়াকে দেখলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে তার!
বুকচিরে বেরিয়ে আসতে থাকা একটা ঝড়ো দীর্ঘশ্বাসকে খুব ধীর গতিতে বের হতে দিলো মীর, তারপর ধীর পায়ে প্রস্থান করতে নিলো সেখান থেকে, যাওয়ার আগে বাসিরের উদ্দ্যেশ্যে মৃদু, অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
“অ্যাবর্শন করিয়ে ফেলো, আমার শিনজোর শরীরে এক অনু পরিমান আঘাতের চিহ্নও আমি দেখতে চাইনা।”
রেড জোনের ভেতর দিয়ে কাঠের তৈরি খাটিয়ার সামনের ডান দিকের কোণটা কাঁধে তুলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে মীর। ওর পাশে জায়ান সাদি, পেছনে আরমান আর বাসির। সবার পেছনে ধীর পায়ে হেটে হেটে এগোচ্ছে বাচ্চাগুলো!
দেমিয়ানদের পারিবারিক কবরস্থান ছেড়ে চলেছে ওরা অন্য কোনো এক দিকে।
আনাবিয়া মাঝেই মাঝেই ওখানে ওর বাবা মায়ের কবর দেখতে আসে, তাই সেখানে ভ্রুণটাকে কবর দেওয়ার ব্যাপারটা বাতিল করলো মীর। যদি কখনো ওর শিনজো টের পেয়ে যায়? এই অবর্ণনীয় কষ্ট ও ওর শিনজোকে কোনো ভাবেই পেতে দিবেনা!
হাটতে হাটতে ওরা এক সময় এসে পৌছালো রেড জোনের বিরাট বিশাল সাদা রঙা অর্কিডের বাগানের নিকট। মীর এতক্ষণ নিজেকে শক্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা জারি রাখলেও এবার ভেতর থেকে সমস্তটা ভেঙে গুড়িয়ে যেতে নিলো ওর!
এই অর্কিড বাগান, এই সাদা রঙা অর্কিড বাগান ওদের দুজনার কত শত ভালোবাসার স্মৃতি আকড়ে ধরে আছে! ওদের কত রাত, কত নির্ঘুম প্রেমময় রাত কেটেছে এখানে। এই অর্কিড বাগানের ভেতর ওর শিনজো রাতের আকাশের তারার ন্যায় ঝিকিমিকি করতো, চাঁদের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো ওর সফেদ চুল, চোখ জোড়া যেন ধারণ করতো তারাখচিত আকাশের একাংশ!
ঝাপসা হয়ে এলো মীরের চোখ জোড়া, ঠোঁট চেপে ও নিজের ভেতর থেকে দমকা হাওয়ার ন্যায় জোর কদমে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কান্নার দমকটাকে আঁটকে রইলো!
যে প্রাণটা খুব গোপনে, সন্তর্পণে ওর শিনজোর গর্ভে স্থান করে নিয়েছিলো, ঠিক তেমন গোপনেই আবার এই পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি দিলো মহাকাশে।
এই নির্মম সত্যটা সহ্য করতে পারছিলোনা মীর, এক অসহ্য যন্ত্রণায় বুক ভেঙে আসতে চাইলো ওর। কষ্টগুলোর মুখোমুখি হতে এই প্রথমবার ভয় পেলো ও!
জীবনে এই প্রথম বারের মতো ওর পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো এই সমস্ত নির্মম সত্য থেকে, এই পৃথিবীর সমস্ত নিষ্ঠুরতা থেকে!
ভ্রূনটাকে যথাযথ নিয়মে কবর দেওয়া হলো। পুরোটা সময় স্তব্ধ রইলো মীর, বাবা হওয়ার যে প্রচন্ড সুপ্ত বাসনাটা এতদিন ওর বুকের ভেতর অল্প অল্প করে নিজের স্থান তৈরি করে নিয়েছিলো সেটা ভেঙে যেতে চাইলো হুড়মুড়িয়ে, হয়তো ভেঙে গেলোও।
কিন্তু তৈরি হওয়া সে স্থানের রেশ যেন রয়ে গেলো মীরের বুকের কোথাও না কোথাও! সমস্ত বুকখানা জুড়ে হাহাকার করে বেড়াতে শুরু করলো কোনো ছোট্ট প্রাণের আধো বোলে বাবা ডাকার ক্ষীণ শব্দ!
একে একে ঝলমলে অর্কিড বাগান ছেড়ে প্রস্থান করলো সকলে, রইলো শুধু মীর৷
লিও আর কাঞ্জি থেকে যেতে চাইলো ওর সাথে, কিন্তু মীর পাঠিয়ে দিলো ওদেরকেও।
সকলে প্রস্থান করলে সদ্য মাটির তলে লুকিয়ে ফেলা ওদের ভালোবাসার প্রকট অস্তিত্ব টার পাশের মাটিতে ধীর গতিতে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লো মীর। আকাশের দিকে কিয়ৎক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে অবশেষে বাষ্প জমে ভারী হয়ে ওঠা চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো ও, চোখের কোণা বেয়ে টুপ টুপ করে শিরো মিদোরির বুকে ঝরে পড়লো কয়েক ফোটা যন্ত্রণা।
বন্ধ চোখেই ডান হাত টা বাড়িয়ে স্পর্শ করলো ও সামান্য উচু হয়ে থাকা কাচা মাটির ঢিবিটার ওপর।
এক মুহুর্তে ওর মনে হলো যেন ঘুমিয়ে আছে ওর বাচ্চাটা, একটু আগেই হয়তো আনাবিয়া খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে রেখে গেছে ওর পাশে, হাত পা ছড়িয়ে মীরের পাশেই সে মায়ের বুকের ওমের রেশে ঘুমিয়ে আছে আদুরে ভঙ্গিতে!
ওর বাচ্চা, ওর সন্তান, ওর অস্তিত্ব! চলে গেলো ওকে ছেড়ে, নিয়ে গেলো ওকে সৃষ্টিকর্তা! হঠাৎ করেই ডুকরে কেঁদে উঠলো মীর, বুকের ভেতরটা বিধ্বংসী যন্ত্রণায় ছিড়ে যেতে চাইলো যেন।
শুধু ওরই কেন সব হারিয়ে যায়? কেন ওরই বার বার বুক ফাঁকা হয়ে যায়? সমস্ত পৃথিবী হাতড়েও এ প্রশ্নের কোনো উত্তর পেলোনা মীর!
আনাবিয়ার জ্ঞান ফেরেনি এখনো। দুটো দিন পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই, সে জাগেনি। বাসির ভেবেছিলো ভ্রূণটা শেষ করে ফেললেই হয়তো শেহজাদী সুস্থ হয়ে উঠবেন আবার। কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আগের মতোই নিঃসাড় হয়ে প্রাসাদের মেডিক্যাল জোনের রয়্যাল এরিয়ার ভেতরের নরম বিছানায় চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে সে।
নিঃশ্বাস পড়ছে প্রচন্ড ধীরে, যেন এদিক ওদিক হলেই এই শ্বাস টুকুও আর বেঁচে থাকবেনা!
মীর বসে আছে আনাবিয়ার বিছানার পাশে থাকা সোফাতে। স্তব্ধ হয়ে থাকা মুখ খানা দুঃশ্চিন্তায় মোড়া, মর্মযন্ত্রণায় কাতর হওয়া চোখ জোড়াতে শূণ্যতা! বুকের ভেতরে জমা ঝড়ো দীর্ঘশ্বাস। নির্জীব দৃষ্টি নিবদ্ধিত আনাবিয়ার শুষ্ক মুখের দিকে।
টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়া রঙ হারিয়েছে, ফ্যাকাশে হয়ে আছে টলটলে অধরদ্বয়। চোখের পাতা নিস্তব্ধ, যেন ভুল করেও সেজোড়া একটু নড়তে চাইছেনা!
হাতের শিরাতে লাগানো নিউট্রিশন সরবরাহকারী স্যালাইনের সূচ। নাকের ভেতর দিয়ে পাকস্থলীতে চলে গেছে দুইটা নরম, সরু টিউব! প্রচন্ডরকম বিধ্বস্ত হয়ে শুয়ে আছে ওর শিনজো!
লিও, কাঞ্জি দাঁড়িয়ে আছে মীরের পাশে৷ কোকো আর ফ্যালকন ওদের থেকে কিছুটা দূরে, দরজার কাছে দাঁড়ানো। সকলের চোখে নির্ঘুম, ক্লান্ত রাতের ছাপ। ওদের আম্মা এখানে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, কখন কি হয়ে যায় সে চিন্তায় ঘুম হয়নি ওদের কারো!
তার চেয়ে বেশি চিন্তা ওদের সামনে উপবিষ্ট এই দীর্ঘকায় ব্যাক্তিটাকে নিয়ে। যে শিনজোকে ছাড়া তার সকাল শুরু হয়না, রাত শেষ হয়না তাকে এভাবে দেখে এই শক্ত ব্যাক্তিটি কিভাবে আছে? সদ্য মাটি চাপা দিয়ে আসা প্রাণটাকে হারিয়ে সে কেমন আছে? কিভাবে শান্ত আছে?
বাসির কেবিনে ছিলোনা, কয়েকজন নার্সকে নিয়ে ও ভেতরে এলো তখনি। মীর নিষ্প্রাণ চোখে তাকালো বাসিরের দিকে।
বাসির স্তম্ভিত হয়ে গেলো ওই চোখের দৃষ্টি দেখে, চোখ সরিয়ে মাথা নোয়ালো তখনি।
হিজ ম্যাজেস্টির প্রচন্ড শাণিত দৃষ্টির এমন নিষ্প্রাণ চাহনি বুকে গিয়ে লাগলো ওর। এক মুহুর্তে ওর মনে বলে উঠলো পরিস্থিতি মানুষকে কোথায় নিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়!
বাসির কেবিনের ভেতরে আসা নার্সদেরকে আবার বাইরে বেরিয়ে যেতে বলে মীরের কাছাকাছি এসে দাড়ালো, তারপর দুঃশঙ্কাগ্রস্থ চেহারায় মৃদুস্বরে বলল,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমি সকাল বেলা আপনার সাথে দেখা করতে গেছিলাম, কিন্তু আপনি কামরায় ছিলেন না৷ যথাসময়ে খবরটা আপনাকে দিতে পারিনি, ক্ষমা করবেন আমাকে!”
মীর প্রতিউত্তরে কিছুই বললনা, হাতের ইশারায় বসতে বলল ওকে। পাশ থেকে লিও একটা চারপায়া ওয়ালা অটোমান এগিয়ে দিলো বাসিরের দিকে। বাসির সেটা নিয়ে বসলো মীরের ডানদিন ঘেঁষে।
মীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নির্জীব, শুষ্ক কন্ঠে বলে উঠলো,
“বলো বাসির!”
বাসির ছোট করে গলা খাকারি দিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো মেঝেতে, হিজ ম্যাজেস্টির চোখে তাকিয়ে এ কথাগুলো বলার মতো সাহস আর বেচে নেই ওর।
বাচ্চাগুলো অধীর হয়ে তাকিয়ে রইলো বাসিরের দিকে, সে কি বলে জানার জন্য!
মীর অসহায় দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলো বাসিরের মুখ পানে। একটি আশার কথা শোনার জন্য মুখিয়ে রইলো ও, একটিবার বাসির বলুক ওর শিনজো, ওর প্রাণ এখুনি জেগে উঠবে! আবার হাসবে আগের মতো, আবার খলবলিয়ে কথা বলবে, আবার দুষ্টুমি করবে ওর সাথে!
হুটোপুটি করে ঝড় তুলে ফেলবে ওর বুকের ওপর আবার, বাচ্চাদেরকে নিয়ে যখন তখন রেড জোনে গিয়ে পিকনিক পার্টি করবে, আবার বায়না ধরবে ওকে নিয়ে কোথাও একটু ঘুরতে যাওয়ার জন্য, আবার গাল ফুলোবে রাতে ঘুমের ঘোরে ওকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করার অপরাধে!
একটিবার বলুক বাসির, একটিবার!
তখনি বাসির দীর্ঘশ্বাস ফেলে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি…… শেহজাদী আবার কবে জেগে উঠবেন সে সম্পর্কে এখন সৃষ্টিকর্তা ব্যাতিত আর কেউ জানেন না। শী’জ ইন ডীপ কোমা!”
মাথাটা আরও নিচে নেমে গেলো বাসিরের, মাথা সোজা রাখার মতো সাহস, শক্তি কোনোটাই পেলোনা ও! বাচ্চাগুলো বাসিরের কথায় নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো বাসিরের দিকে, শুধু কোকোর দৃষ্টি গিয়ে বেধে রইলো মীরের ওপর!
এই মানুষটা ওই শয্যাশায়ীনীকে নিজের কতখানি দিয়ে ভালোবাসে সেটা ওর থেকে ভালো আর কে জানে? এই মানুষটাকে কিভাবে স্বান্তনা দেওয়া যায় আর? কিভাবে তার বুকের ভেতর বয়ে চলা ঝড়কে একটু হলেও প্রশমিত করা যায়? কিভাবে তাকে বলা যায় ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, আপনি ধৈর্য ধরুন!”
মীর প্রতিক্রিয়া দেখালোনা কোনো, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে রইলো আগের মতো করেই। বাসির অস্ফুটস্বরে আবার কোনোরকমে বলল,
“শেহজাদীর দুর্বল শরীর এই সার্জারীর ধকল সইতে পারেনি ইয়োর ম্যাজেস্টি! ওনার মস্তিষ্ক সম্পুর্ন ব্লাংক হয়ে আছে। শ্বাসপ্রশ্বাস আর শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলো ছাড়া আর কোনো রেস্পন্স আসছেনা।
উনি ঠিক কবে কোমা থেকে জেগে উঠবেন সেটা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানেন না! হয়তো কয়েকদিনের ভেতরেই বা হয়তো দশ বছর পর, বা হয়তো আর কখনোই না……!”
মীর উঠে দাড়ালো হঠাৎ করেই, ঝড়ো দম ছাড়লো একটা। অতঃপর কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে দরজার নিকট দাঁড়ানো কোকোর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“আমার শিনজোকে ওর কামরায় নিয়ে আসার ব্যাবস্থা কর।”
বলেই আর এক মুহুর্ত দেরি না করে ও গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো প্রাসাদ থেকে।
রেড জোনের ঘন সবুজের বিস্তীর্ণতার মাঝে শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে লাইফ ট্রি। মাথা উঁচিয়ে যেন আকাশ ছুঁয়ে দিতে চাইছে সে।
বিশাল শাখাগুলো মেলে আছে প্রকৃতির রাজদণ্ডের ন্যায়, শেকড় গুলো প্রবাহিত শিরো মিদোরির গভীরে— ধরিত্রীকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে এক অবিচল প্রতিজ্ঞায়।
বাতাস বয়ে যায় তার সোনালী পাতা ছুঁয়ে, কিন্তু সে নড়ে না, সে ভাঙে না। সে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে, শাশ্বত এক প্রতীক হয়ে; সময়ের অতল গভীরে হারিয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া এক কিংবদন্তির মতো।
রেড জোনের ভেতরের লতাপাতা, গুল্ম মাড়িয়ে দিয়ে ঝড়ো পায়ে লাইফ ট্রির দিকে এগোচ্ছে মীর। নিষ্প্রাণ চোখ জোড়া এখন জ্বলে আছে প্রখর হিংস্রতায়! প্রচন্ড রাগে, ক্ষোভে, যন্ত্রণায় দাঁতের পাটি জোড়া শক্ত হয়ে লেগে আছে এক অপরের সাথে।
ক্ষিপ্র পায়ে হেটে এসে ও এবার দাড়ালো লাইফট্রির সম্মুখে, আর তারপরেই রাগে, ক্ষোভে, বিতৃষ্ণায় ও গর্জে বলে উঠলো,
“কেন ওকে আমার সাথে বেধে দিয়েছিলে তুমি? কিসের জন্য বেধে ছিলে? ওর প্রাণ নেওয়ার জন্য? নাকি আমাকে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা ভোগ করানোর জন্য? কেন?
জেনে শুনে তুমি কেন করলে এরকমটা?
কি লাভ হয়েছে তোমার? কি সুফল পেয়েছো তুমি ওকে কষ্ট দিয়ে, আমাকে কষ্ট দিয়ে? উত্তর দাও!”
শেষোক্ত কথাটা হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো মীর, নিস্তব্ধ হয়ে এলো রেড জোনের ভেতরটা। শুধুমাত্র গাছের গায়ে বাড়ি খেয়ে খেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো মীরের গর্জন! এ ছাড়া আর সামান্য মর্মরের শব্দও পাওয়া গেলোনা সেখানে।
মীরের কথা শেষ হওয়ার ক্ষণ বাদেই নড়ে উঠলো লাইফট্রির সরু নরম ডাল-পালা গুলো, অত্যন্ত সাধারণের ন্যায় গাছটা হঠাৎ করেই ছড়াতে শুরু করলো উজ্জলতা, ধীরে ধীরে সেটা গোড়া থেকে উজ্জ্বল হতে হতে উঠে এলো ওপরের দিকে, ছড়াতে লাগলো সোনা রঙা ঝকঝকে আভা মিশ্রিত আলোর ঝলকানি।
নরম ডালগুলো নড়েচড়ে উঠে একিয়ে বেকিয়ে শূন্যের ওপর মেলে ধরলো কয়েকটি শব্দ খচিত একটা ছোট্ট বার্তা,
“ব্রিং হা’র ট্যু মি”
ক্রোধে মীরের মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম হলো এবার, লাইফট্রি সত্যি সত্যিই ওর শিনজোকে চাইছে? সত্যিই ওকে নিতে চাইছে? তবে কি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মীর আর আনাবিয়াকে ব্যাবহার করেছে সে?
একটাবার তার এটা মনে হয়নি যে এই মানুষটা ওই ছোট্ট মেয়েটিকে ছাড়া কিভাবে থাকবে? বারংবার নিজের কাছের মানুষ গুলোকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা সে কিভাবে সহ্য করবে?
ক্রোধান্বিত হয়ে আবারও গর্জে উঠলো মীর,
“আমার প্রাণ থাকতে আমার শিনজোকে আমি তোমার হাতে তুলে দেবোনা। ও যদি সারাটা জীবনও কোমাতে থাকে তবুও ওকে আমি আমার কাছেই রাখবো, এই নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের কাছেই থাকবে ও!
আমার শিনজোর শরীর নিয়ে কাউকে আমি স্বার্থসিদ্ধি করতে দেবোনা, তাই সে যে-ই হোক না কেন! এবং আজ থেকে তোমার কোনো পরামর্শ আমি গ্রহণ করবোনা।
আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিতে চাও তুমি! এই সুযোগ আমি তোমাকে কখনোই দেবোনা। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কেউ আমার শিনজোকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা! আমি কেড়ে নিতে দিবোনা।”
শেষোক্ত কথাগুলো বলতে গিয়ে কন্ঠরোধ হয়ে এলো মীরের, তবুও গর্জন কমলোনা ওর। আর এরপর লাইফট্রিকে পেছনে ফেলে ও আবার এগোলো প্রাসাদাভিমুখে।
একটি বারের জন্যও আর ফিরে তাকালোনা পেছনে, লাইফট্রির ওর উদ্দ্যেশ্যে দ্বিতীয় বার লেখা বার্তাটা ওর অদেখাই রয়ে গেলো!
মীর দাঁড়িয়ে আছে কোথাও, জায়গাটা ওর অচেনা। আশেপাশের সবকিছু কেমন যেনো ঝাপসা, ধোঁয়াসায় মোড়া! কাউকে খোঁজ করছে ও, কিন্তু কাকে? কে আছে এখানে যে ওর খুব চেনা?
কৌতুহলী চোখে ও ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। দাঁড়িয়ে আছে কেউ সেখানে, ছোট্ট কেউ!
মীরের মনে হলো সে ওর খুব কাছের, পায়ের গতি দ্রুত হলো ওর, এগোলো সামনের দিকে জোর কদমে। কিন্তু ধোঁয়াসা যে শেষ হচ্ছেনা, ছায়াটা মিলিয়ে যাচ্ছে, ছোট্ট ছায়াটা! মিলিয়ে যেতে যেতেই সে আধো সুরে ডেকে উঠলো,
“বাবা!”
মীর ছুটলো সেদিকে, কে বাবা বলে ডাকলো ওকে? কে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে? কাকে ওর থেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে এই ধোঁয়াসা?
কিন্তু পা যে এগোচ্ছেনা ওর, আটকে যাচ্ছে ও, তলিয়ে যাচ্ছে কোথাও, টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ ওকে অতলে!
সেই মুহুর্তেই ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো মীর, ঘাম ছোটা শরীরে হাপরের মতো ওঠানাম করতে থাকলো ওর বুক। ক্লান্তি মিশ্রিত, কোটরে বসে যাওয়া চোখ জোড়ায় অজানার দিকে তাকিয়ে ও দম ছেড়ে বোঝার চেষ্টা করলো ও কোথায় আছে!
পরক্ষণেই পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলো আনাবিয়ার শীর্ণকায় শরীরটা, শ্বাস প্রপশ্বাসের মৃদু শব্দ আর হৃদপিণ্ডের সামান্য ধুকপুকানি নিয়ে জড়বস্তুর মতো পড়ে আছে সে বিছানায়, নিশ্চুপ!
কতদিন হলো? এক বছর চার মাস! অনেক দিন, অনেক অনেক দিন!
আনাবিয়ার নিস্তব্ধ চেহারার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো মীর, তারপর আনাবিয়ার শীর্ণ মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চুমু খেলো ছোট্ট করে, খুব সন্তর্পণে, যেন নাকের ভেতর দিয়ে পাকস্থলী তে চলে যাওয়া টিউব দুটোয় ভুলেও স্পর্শ না লাগে। এরপর ওর সফেদ চুলগুলোর ভেতর আঙুল চালিয়ে দিয়ে স্বান্তনার সুরে বলে উঠলো,
“আমি ঠিক আছি শিনু, চিন্তা কোরোনা। বাজে স্বপ্ন দেখেছিলাম। কি দেখেছিলাম জানো? দেখেছি আমাদের বাবুটাকে। কিন্তু ওকে আমি দেখতে পাইনি, ও দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো।
জানো, ও আজও বাবা বলে ডেকেছে আমাকে। আমি ওকে ভুলতে পারিনা শিনজো, রোজ ঘুমের মাঝে এসে আমাকে বাবা বাবা বলে ডাকে। আমার ভালো লাগেনা, মনে হয় ওর হয়তো ভয় লাগে অর্কিড বাগানে একা একা থাকতে। তোমার যেমন ছোট বেলায় ভয় লাগতো, বলতে ‘দানালায় মনতান’ তেমন।”
বলে শব্দ করে হাসলো মীর। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ ঘরে ওর সে হাসি বেজে উঠলো আতঙ্কের মতো। আনাবিয়া রইলো বরাবরের মতোই নিরুত্তর, শুধু শব্দ এলো ওর নিঃশ্বাসের, ক্ষীণ শব্দ!
মীর কিছুক্ষণ আনাবিয়াকে দেখলো অপলক, তারপর আপনমনে বলল,
“তোমাকে আমি কত্ত ভালোবাসি, আর তুমি?
তুমি শুধু ঘুমিয়েই থাকো, আমার সাথে একটা কথাও বলোনা, একটুও দুষ্টুমি করোনা। আমার কি কষ্ট হয়না?”
আনাবিয়া উত্তর দিলোনা, দিবেনা সে উত্তর। মীর তবুও আশা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু সে আশা ওর রোজকার মতোই নিষ্ফল হলো।
কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে ও আবার বলে উঠলো,
“একবার কথা বলো শিনু! কথা দিচ্ছি তোমাকে, আর কখনো বিরক্ত হয়ে আমি তোমাকে চুপ করতে বলবোনা। আর কখনো কাজের চাপে ব্যাস্ত হয়ে তোমাকে বলবোনা ‘আজ তুমি একা একা ঘুমাও শিনু, আমার কাজ আছে।’ তুমি যখন যেখানে ঘুরতে যেতে চাইবে আমি নিয়ে যাবো তোমাকে, তুমি যতক্ষণ আমার বুকের সাথে লেগে থাকতে চাইবে ততক্ষণ রাখবো তোমাকে; ব্যাস্ততার অজুহাতে আর তোমাকে একা বিছানায় ফেলে রেখে যাবোনা৷ একটা বার কথা বলো, শুধু একটা বার!”
বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৩+৩৪
গলা ধরে এলো মীরের, ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখ জোড়া দিয়ে আরও অনেক অনেক ক্ষণ দেখলো ও আনাবিয়াকে। তারপর ওর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে উঠে এলো বিছানা ছেড়ে।
ভোর হতে এখনো অনেক দেরি, ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে গায়ের ওপর একটা শার্ট চড়িয়ে ও বেরিয়ে এলো কামরা থেকে, উদ্দ্যেশ্য ওর রেড জোন।
বাচ্চাটা ওর ভয় পাচ্ছে, একা একা ওই অন্ধকারের ভেতর কি অতোটুকু প্রাণটা থাকতে পারে?
