বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৭+৩৮

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৭+৩৮
রানী আমিনা

মেডিক্যাল জোনের ভেতর চিন্তিত মুখে বসে আছে কয়েকটা শঙ্কিত চেহারা। নিশ্চুপ সকলে। কোনো সুরাহা হচ্ছেনা, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কুলহারা এক সমুদ্রের ভেতর পড়ে গেছে ওরা, বের হওয়ার রাস্তা পাচ্ছেনা কেউ।
নিরাবতা ভেঙে মুখ খুললো জায়ান,
“কোকো, হিজ ম্যাজেস্টি ফেরেননি এখনো?”

“নেগেটিভ মিস্টার সাদি। তবে চিন্তা করবেন না, লিও কাঞ্জি আছে তাঁর সাথে। হিজ ম্যাজেস্টি যদিও ওদেরকে কাছে ঘেঁষতে দেননা, কিন্তু তবুও ওরা হিজ ম্যাজেস্টির আশেপাশেই থাকে, লুকিয়ে।”
উত্তর দিলো জায়ানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কোকো। জায়ান মীরের মানসিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পর থেকে প্রাসাদেই আছে, সাম্রাজ্যের সবকিছু কোনো রকমে সেই সামলাচ্ছে। আর এই সামলানোর চাপেই সে বুঝতে পেরেছে সাম্রাজ্যের গুরুভার ঠিক কতখানি ভারত্ব নিয়ে তৈরি!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কোকো ফ্যালকন, লিও আর কাঞ্জি ছাড়া সকল বাচ্চারাই নিজেদের কাজ প্রচন্ড দায়িত্বশীলতার সাথে করে চলেছে। হিজ ম্যাজেস্টির এমন অবস্থার খবর বাইরের কেউই জানেনা ওরা গুটিকয়েক কাছের মানুষ ছাড়া।
কিন্তু এ খবর কোনো মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমস্ত রাজ্য জুড়ে অরাজকতা দেখা দিবে। সেটা হলেও যেন সবকিছু আয়ত্তে থাকে সেই চেষ্টাই করে চলেছে ওরা সকলে।
জায়ান ভাবুক দৃষ্টিতে মেডিক্যাল জোনের গ্লাসের দেয়াল ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে তার বিপরীতের চেয়ারে বসা বাসিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি করা যায় বাসির? আর কি করার বাকি আছে আমাদের?”
বাসির কোনো উত্তর দিলোনা, নিরাবতাকেই আলিঙ্গন করে নিলো। বাসিরের পাশে বসে ছিলো আর্থার নামক একজন ফার্টিলিটি স্পেশালিস্ট। মীরের আদেশে অনেকদিন ধরেই সে এদের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। জায়ানের কথার উত্তরে সে বলে উঠলো,

“মিস্টার সাদি, আমরা আমাদের সব চেষ্টাই করেছি। হিজ ম্যাজেস্টি কোনো কিছু ট্রাই করতে বাদ রাখেননি।
কোকো তো মহসিন আর ইয়াসমিনের সাহায্যে প্রাসাদের একটা মেয়েকে ম্যানেজও করে ফেলেছিলো টেস্টটিউব বেইবির জন্য।
কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টির স্পার্ম কালেক্ট করার পর সেটা সম্পুর্ন না’ল দেখাচ্ছিলো, টোটাল জিরো। দ্যা সিমেন ওয়াজ ক্লিয়ার, অ্যান্ড নট ইভেন অ্যা সিঙ্গেল স্পার্ম ওয়াজ দেয়ার! বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে আসা মাত্রই স্পার্ম গুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে, মিরাকলের মতো।
হোয়াট শ্যুড উই ড্যু?”
কামরার ভেতর আবারও নেমে এলো নিরাবতা, কোনো উপায় নেই, কিচ্ছু হচ্ছেনা। অথচ সে ব্যাক্তিটির মানসিক অবস্থার দিনে দিনে অবনতি হচ্ছে।
জায়ান নিরবতা ভেঙে আবারও বলে উঠলো,

“কিন্তু এভাবে তো চলতে দেওয়া যাবেনা!
উনি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছেন। গত পরশু রাতের বেলা কোকোকে চিনতে না পেরে রেগে গিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছেন ওর গালে। এখনো কোকোর গালের বা পাশ ফুলে আছে। লিও বলছিলো হিজ ম্যাজেস্টি কাউকে তাঁর কাছে ঘেঁষতেও দিচ্ছেননা, কাউকে আশেপাশে দেখামাত্রই আক্রমণাত্মক আচরণ করছেন। গতকাল আমাকেও কিছুক্ষণের জন্য চিনতে পারছিলেন না!

একমাত্র শেহজাদী ছাড়া আর অন্য কাউকে তিনি চিনছেন না। এভাবে চললে তো আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে যাবে!”
“আপনি ঠিক বলেছেন মিস্টার সাদি, কিন্তু আপনাকে আরও খারাপ খবর দেওয়ার আছে।”
এতক্ষণ ওদের পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে বসে ওদের কথা শুনছিলো সেইফ নামক একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। মীরের মানসিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পর থেকে মীরের চিকিৎসা এবং কাউন্সিলিং সে-ই করছিলো।
ওর কথা শুনে সকলে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে, সেইফ গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“গতকাল হিজ ম্যাজেস্টির সিটিস্ক্যান করেছিলো আমাদের নিউরোলোজিস্ট সেহরান। সেহরান সিটিস্ক্যান রিপোর্ট চেক করে আমাকে জানালো যে হিজ ম্যাজেস্টির ব্রেইনের প্রীফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং অ্যামিগডালা অংশটুকু ধীরে ধীরে ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছে৷

এই দুই অংশ ড্যামেজ হওয়ার অর্থ হিজ ম্যাজেস্টি ক্রমে ক্রমে নিজের ভেতরের মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলবেন। আর আমরা এটা জানি যে তাঁর জন্মটা অন্যরকম ছিলো, তিনি স্বাভাবিক ভাবে জন্মাননি। এমনি এমনি প্রয়াত বাদশাহ হুজায়ফা আদনান তাঁর নাম নামীর আসওয়াদ রাখেননি।
আমার ধারণা ওনার মস্তিষ্কের এই দুই অংশ ড্যামেজ হয়ে গেলে উনি জন্মের সময়ে যে কন্ডিশনে জন্মেছিলেন সেই কন্ডিশনেই ফিরে যাবেন। তাঁর ভেতরে আর কোনো মানবিক গুণাবলি থাকবেনা, এবং উনি ধীরে ধীরে কোনো হিংস্র প্রাণীতে পরিণত হবেন।
এই কারণেই হয়তো উনি হঠাৎ এমন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছেন, কাউকে চিনতে পারছেন না, সময় লাগছে চিনতে।”

সেইফের কথা শুনে ওরা নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলো, কারো কাছে আর কোনো কথা রইলোনা।
জায়ানের মনে বলল, দেমিয়ান বংশের ইতিহাসে হয়তো এই প্রথম কোনো বাদশাহ নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে সিংহাসন তুলে দেওয়ার আগেই সিংহাসন ছেড়ে দিবেন। অন্য কেউ এসে রাজ করবে এই পঞ্চদ্বীপে, শিরো মিদোরির মাটির গভীরে থাকা ডার্ক প্যালেসে অবস্থিত কোনো সুদর্শন পুরুষ। যে কিনা নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানেরই প্রতিবিম্ব, তবে কাজে নয়, রূপে।

কামরায় ফিরেছে মীর ঘন্টা দুই হচ্ছে। এসেই গোসল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আনাবিয়ার কামরায় চলে এসেছে ও। ভেজা কাপড় দিয়ে সময় নিয়ে, সযত্নে মুছে দিয়েছে আনাবিয়ার শীর্ণ হয়ে যাওয়া শরীরটা। চুলগুলো শ্যাম্পু দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছে। এখন শ্যাম্পুর মনমাতানো সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠছে মীর।
আনাবিয়া সেই ছোট্ট বেলাটা থেকে প্রাসাদে ওর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি হওয়া রেড জোনের ভেতরের সাদারঙা অর্কিডের মৃদু অথচ প্রচন্ড মিষ্টি সুগন্ধিযুক্ত শ্যাম্পুই ব্যাবহার করে। এই ঘ্রাণটা তাই মীরের চেনা, খুব চেনা, আত্মার মতো!
আনাবিয়ার ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে যত্নসহকারে মুছে দিয়ে কামরার বেলকনির চওড়া দরজাটা খুলে দিলো মীর।

রেড জোনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত দমকা হাওয়া এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো কামরার ভেতর, হুটোপুটি করে এসে দোলা দিয়ে গেলো আনাবিয়ার ছড়িয়ে রাখা সফেদ চুলে।
মীর নিঃশ্বাস নিলো বুক ভরে, এগিয়ে এলো আবার আনাবিয়ার কাছে। বসলো পাশে। তারপর একে একে সকাল থেকে করা সমস্ত কাজের পূঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে শুরু করলো।
ঠিক আগের দিনের মতো, যখন রোজ রাতে ফিরে এসে ঢুকতো সে আনাবিয়ার কামরায়, তারপর শ্রান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে মাথা রাখতো আনাবিয়ার কোলের ভেতর। শুরু করতো সারাদিনের ফিরিস্ত দেওয়া, আনাবিয়া অতি আগ্রহ নিয়ে শুনতে শুনতে বিলি কেটে দিতো ওর ঝাকড়া চুলের ভেতর।
এখন সামান্য পরিবর্তন এসেছে, এখন বিলি কেটে দেওয়ার দায়িত্ব মীর নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে।
তখন আনাবিয়া ওর কথার প্রতিউত্তরে কখনো হাসতো, কখনো বকতো, কখনো শাসাতো, কখনো বা অভিমান ভরে গাল ফুলিয়ে থাকতো। কিন্তু এখন ওর শিনজো চুপ!

এখন সে আর কোনো কথাই বলেনা। নির্বাক, অত্যন্ত মনোযোগী শ্রোতাটির মতো শুনে যায় শুধু।
ওদের কামরার বাইরের বিরাট বারান্দাটায় সে মুহুর্তে শোনা গেলো পদশব্দ। মীরের কামরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লিও আর কাঞ্জির নিকট ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালো কোকো ফ্যালকন আর জায়ান।
লিও ওদের সবাইকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসালো বারান্দায় রাখা সোফাসেটের ওপর৷ মুহসিনকে নাস্তা দিতে বলে সবাই মনযোগ দিলো আলোচনায়।
কোকো প্রশ্ন করলো,
“মিস্টার সাদি, হেকিম সেইফ আপনাকে কি বলল? গুরুতর কিছু? আমরা কি জানতে পারি?”
লিওরা আরও ঝুকে এলো শোনার জন্য, জায়ান গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠল,
“সেইফ বলেছে হিজ ম্যাজেস্টিকে শেহজাদীর থেকে দূরে রাখতে, আর বার বার তাঁকে অর্কিড বাগানের কবরের কাছে যেতে না দিতে।

শেহজাদীকে তিনি প্রচন্ডরকম ভালোবাসেন, এটা কারো অজানা নয়। এতবছরের অ্যাটাচমেন্টের পর শেহজাদীর সাথের এই বিচ্ছেদ তিনি মেনে নিতে পারছেন না, তার ওপর সন্তান হারানোর শোক জেঁকে ধরেছে তাঁকে।
লাইফট্রি তাঁদের দুজনের ভেতরের অ্যাটাচমেন্টটা এত্ত গভীর করে দিয়েছে যে শেহজাদী হিজ ম্যাজেস্টির মানসিক, শারীরিক সমস্ত শান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেহজাদীকে ছেড়ে থাকার কথা তিনি চিন্তাও করতে পারছেন না।
এখন সেইফ বলতে চাইছে, শেহজাদীকে কাছে না পেলে হিজ ম্যাজেস্টি ধীরে ধীরে সত্যিই পরিবর্তিত হয়ে অন্য কোনো কিছুতে পরিণত হবেন। এখন এর থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায়, হিজ ম্যাজেস্টির সন্তান।
শেহজাদী ঠিক কবে এই কোমা থেকে উঠবেন সেটা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। তাই আমাদেরকে শেহজাদীর জেগে ওঠাত ভরসায় থাকলে চরম বিপদে পড়তে হবে।

এখন দেমিয়ান সাম্রাজ্যের একজন উত্তরাধিকারকে পেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তির আশা করা যায়। শতভাগ নিশ্চয়তা সেইফ দিতে পারেনি যদিও, তবে সে আশাবাদী।”
“কিন্তু কৃত্রিম কোনো পদ্ধতিতে তো এটা সম্ভব হচ্ছেনা মিস্টার সাদি! এখন তবে আমরা কি করবো? এখন যে উপায় বাকি আছে তাতে শেহজাদীর মন ভেঙে যাবে মিস্টার সাদী। তিনি কোমাতে আছেন ঠিকই, কিন্তু তবুও আমরা তার সাথে কিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবো!”
বলে উঠলো কোকো। জায়ান কিছুক্ষণ ভাবুক দৃষ্টিতে কোকর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“যদি শেহিজাদী আর কখনো না উঠেন তাহলে? যদি এভাবেই বাকিটা জীবন তাকে বিছানায় কাটাতে হয়, জ্ঞানহীন অবস্থায়?

এই সাম্রাজ্যের কি হবে তখন? হিজ ম্যাজেস্টির কি হবে?
সেইফ বলেই দিয়েছে ইতোমধ্যে হিজ ম্যাজেস্টির ব্রেইন ড্যামেজ হতে শুরু করেছে, সেটার প্রমাণ আমরা তোর চোয়ালে দেখতে পাচ্ছি৷
এখন আমাদের কাছে আর কোনো উপায় নেই। আমাদেরকে ওই রাস্তাতেই যেতে হবে, দ্যাটস ইট।”
“কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টি কি রাজি হবেন? আপনিই বলেছিলেন শেহজাদী হিজ ম্যাজেস্টির স্ত্রী হবে জানার পর থেকে তিনি কখনো কোনো দাসীকে স্পর্শ করেননি।
এখন শেহজাদীর এমন কান্ডিশানে হিজ ম্যাজেস্টি কি কখনো কোনো মেয়েকে স্পর্শ করতে চাইবেন? আমার তো মনে হয় না।”
বললো কোকো। জায়ান প্রতিউত্তরে বলল,
“তাঁকে রাজি করানোর চেষ্টা করতে হবে। এইভাবে সবকিছু স্রোতের তালে বইতে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কিছুই হবেনা৷

আর তোমাকে বলি, মেয়েরা পারেনা এমন কিছু নেই। ওরা চাইলে পাথরেও ফুল ফুটাতে পারে৷ এখন সেটার জন্য আমাদেরকে একটা মেয়ে জোগাড় করতে হবে, যাকে হতে হবে প্রচন্ড সুন্দরী, প্রচন্ড মায়াবী। যেন হিজ ম্যাজেস্টি একটু সময়ের জন্য হলেও তার ভেতরে বয়ে চলা ঝড়টাকে স্তিমিত করতে পারেন৷”
কোকোর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো একটা। কি করতে চলেছে ওরা? ওর আম্মা কখনো জেগে উঠে ওদের এসব শুনলে কি কখনো ক্ষমা করবেন কাউকে?
কাউকে করবেন না, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিবেন সবকিছু!
এমন সময় কামরার দরজা টেনে বাইরে বেরিয়ে এলো মীর, সোফার ওপর আরামে বসে থাকা সবগুলো দাঁড়িয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ। আনুগত্যের সাথে আনত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইলো সকলে।
স্বর্ণালি আভা ছড়ানো নিষ্প্রভ অক্ষিদ্বয়ের নির্জীব দৃষ্টি ফেললো মীর ওদের ওপর, মনে করার চেষ্টা করলো এরা ঠিক কারা? কেন এখানে এসেছে?

চেনা মুখ, কিন্তু কাউকেই যেন চেনেনা ও। স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যেতে শুরু করেছে সবকিছুই যেন!
চোখ জোড়া বন্ধ করে নিয়ে মাথাটা দ্রুততার সাথে সামান্য ঝাকি দিয়ে ও স্বাভাবিক করে নিলো নিজেকে, তারপর এগিয়ে গেলো সোফার দিকে।
জায়ান বাচ্চাদেরকে ইশারায় ওদের দুজনকে একা ছেড়ে দিতে বললে সকলে জায়গা ছেড়ে ওদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো বারান্দার অন্য কোণার রেলিং ঘেষে। নিজেদের ভেতর চাপা আলোচনায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো ওরা।
মীর ধীর পায়ে এসে বসলো ওর জন্য নির্ধারিত স্থানে, জায়ান অনুমতি নিয়ে বসে পড়লো মীরের বিপরীতে। মনোযোগ দিয়ে একবার দেখলো মীরের মুখখানা; শীর্ণ, কৃশকায় হয়ে উঠেছে চেহারাটা। চোয়ালদ্বয় ধারালো হয়েছে আরও, জ্বলজ্বলে শিকারী চোখ জোড়া অনুভূতিহীন, চুলদাড়ি উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে— অযত্নে, অবহেলায়।
জায়ানের চোখে দৃষ্টি ফেলে মীর বলল,

“বলো জায়ান, পারিপার্শ্বিক অবস্থার ইনফ’মেশন দাও।”
জায়ান সাম্রাজ্যের সার্বিক একটা বিবরণ বলল সময় নিয়ে, মীর মনোযোগ দিয়ে শুনে গেলো সমস্তটা। জায়ানকে কিছু কিছু কাজের জন্য কিছু নির্দেশনা আর পরামর্শ দিয়ে উঠে যেতে নিলো ও সোফা থেকে।
জায়ান ওকে তড়িঘড়ি করে আঁটকে দিয়ে আনুগত্যের সাথে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কথা বলার আছে।”
মীর উঠে যেতে নিয়েও আবার বসে পড়লো, ইশারায় বলতে বলল জায়ানকে। জায়ান ইতস্তত করতে করতে মৃদুস্বরে বলল,

“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনাকে কিছু বলার আছে আমার। দয়া করে আগেই রেগে যাবেন না, আমার কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবেন প্লিজ!”
মীর নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে, জায়ান এটাকেই অনুমতি ভেবে নিয়ে আমতা-আমতা করে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমরা সকলেই আপনাকে নিয়ে চিন্তিত। আজ হেকিম সেইফের সাথে কথা হয়েছে আমার। সে কিছু পরামর্শ দিয়েছে আমাদের। আপনি কো-অপারেট করলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ!”
“বলো।”

গমগমে কন্ঠে বলল মীর। জায়ান গলা খাকারি দিয়ে ইতস্ততভাবে বলল,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি…… শেহজাদীকে আমরা আবার মেডিক্যাল জোনের রয়্যাল এরিয়াতে শ-শিফট করার কথা ভাবছিলাম। তিনি এখানে থাকলে আপনার……”
কিন্তু বাকি কথা শেষ করতে পারলোনা জায়ান, তার আগেই মীরের হুঙ্কারে কেঁপে উঠলো ওরা সকলে, প্রচন্ড ক্রোধে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে মীর গর্জে উঠে বলল,
“জায়ান! দ্বিতীয় বার কখনো আমার শিনজোকে আমার থেলে আলাদা করার কথা ভাবলে তোমার গলার নলি টেনে ছিড়ে ফেলবো আমি, মাইন্ড ইট!”
আর তারপরেই সোফা ছেড়ে উঠে গটগটিয়ে ক্ষিপ্র পায়ে নিজের কামরার ভেতর চলে গেলো ও। দরজাটা সজোরে এসে শব্দ করে বাড়ি খেয়ে বন্ধ হয়ে গেলো আবার।
পেছনে পাঁচজোড়া চোখ অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো সেই বন্ধ দরজার পানে।

আনাবিয়াকে কয়েকদিন হলো আবার মেডিক্যাল জোনে শিফট করা হয়েছে, গত কয়েকমাস ঠিকঠাক থাকলেও সেদিন হঠাৎ করেই ওর অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে।
মীর কামরায় ছিলোনা, সে ছিলো অর্কিড বাগানের ছোট্ট কবস্থানটির পাশে৷ ইয়াসমিন ছিলো আনাবিয়ার কামরায়। আর তখনই হঠাৎ আনাবিয়ার পাল্‌স রেট অস্বাভাবিকরকম ভাবে বেড়ে যেতে থাকে।
অবস্থা ভালোনা দেখে ইয়াসমিন দ্রুত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কোকোকে গিয়ে জানায়। কোকো তখনি মেডিক্যাল জোনে সংবাদ পৌছে দিলে তারা এসে আনাবিয়াকে নিয়ে চলে যায় মেডিক্যাল জোনে।
মীর ফিরে এসে প্রথমে রাগারাগি করলেও পরবর্তীতে আনাবিয়ার অবস্থার অবনতি হয়েছে শুনে চুপ হয়ে যায়, আর তারপর থেকে এখনো পর্যন্ত সে মেডিক্যাল জোনে আনাবিয়াকে রাখা কামরাতেই আছে। কেউ তাকে সরিয়ে নিতে পারেনি সেখান থেকে!

আনাবিয়ার স্ট্রেচারের পাশে একটা চেয়ারটেনে সে বসে থেকেছে সারাক্ষণ। কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখে গেছে ওর শিনজোর শীর্ণ হয়ে যাওয়া চেহারাটা, কখনো করে গেছে গল্প, কখনোবা আদুরে চুম্বনে ভরিয়ে দিয়েছে ওর মুখখানা।
বাসির এসে মাঝে মাঝেই দেখে যাচ্ছে আনাবিয়াকে। এখন তার অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেছে আবারও। কিন্তু মীরকে সেটা জানানো হয়নি। একবার যখন শেহজাদীকে মেডিক্যাল জোনে শিফট করা গেছে তখন তাঁকে আবারও হিজ ম্যাজেস্টির কাছাকাছি রাখতে দেওয়া থেকে ওদেরকেই আটকাতে হবে।
মীর আনাবিয়াকে শিফট করার ব্যাপারে বাসিরের সাথে কথা বললেও বাসির বলেছে যে আনাবিয়ার অসুস্থ শরীর নিয়ে টানাটানি করলে সে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। কিন্তু ওদের এই মিথ্যা কোনো কাজে আসেনি। মীর এখন নিজেই দিনের বেশিরভাগ সময় এখানেই কাটিয়ে দিচ্ছে।
জায়ান আছে প্রচন্ড চিন্তায়, এভাবে চললে ওদের সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। হিজ ম্যাজেস্টির আরও একটা সিটিস্ক্যান করা হয়েছে, কিন্তু রিপোর্ট আগের থেকেও ভয়াবহ!

তার মস্তিষ্কের ড্যামেজ দ্রুততর হয়ে উঠেছে আরও। আগের থেকে প্রচন্ডরকম অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠেছেন তিনি। রেগে গেলে যিনি প্রচন্ডরকম শান্ত থাকতেন তিনি এখন সামান্যতেই ভয়াবহ রকমের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।
প্রাসাদের বেইজমেন্টের প্রিজন গুলো খালি হতে বসেছে, নিজের রাগ মেটাতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামী ছাড়াও অন্যান্য আসামী দেরকে ভয়াবহ রকমের মৃত্যু দিচ্ছেন তিনি নিজের হাতে!
প্রিজনার্স গুলো শেষ হয়ে গেলে তখন কি হবে? রাগ মেটাতে তো তিনি সাধারণের ওপরেই আক্রমণ করে বসবেন! এভাবে কোনোমতেই চলতে দেওয়া যাবেনা।

কিছুদিন পর পরই মীরের কাউন্সিলিং করতে হয় সেইফকে। নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে সে চেষ্টা করে যায় মীরের মানসিক অবস্থার উন্নতি করতে। সামান্য উন্নতি হলেও সে উন্নতি চোখে পড়ার মতো নয়।
যদিও শেহজাদীকে হিজ ম্যাজেস্টির থেকে দূরে রাখায় কিছু উপকার হয়েছে। তিনি নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, সফল না হলেও। সাম্রাজ্যের কাজেও আবার মনোযোগ দিতে শুরু করেছেন, নিজেকে ব্যাস্ত রাখার চেষ্টা করছেন।

জায়ান সাদি বার বার সেইফকে এসে বলে হিজ ম্যাজেস্টিকে দাসীদের ব্যাপারে কনভিন্স করতে, কিন্তু সাহসে কুলায় না ওর। তিনি এখন অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছেন প্রচন্ড। ভালো খারাপ কোনো কথাই যেন শুনতে চাইছেন না। আজকাল তিনি কাউন্সিলিং এর জন্যও আসেননা।
জায়ান, কোকো, ফ্যালকনেরা এক রকম জোর করে, অনুনয় বিনয় করে নিয়ে আসে তাকে, আর নয়তো সেইফ নিজেই হিজ ম্যাজেস্টির কাছে গিয়ে চেকআপ করে আসে।

আজ হিজ ম্যাজেস্টি আসছেন, শেহজাদীকেই দেখতে আসছেন। কিন্তু সকলে মিলে তাকে কাউন্সিলিং এর জন্য রাজি করাবে বলে ঠিক করেছে। সেইফ নিজেও প্রস্তুত হয়ে আছে ঠিক কিভাবে সে হিজ ম্যাজেস্টির নিকট কথাগুলোকে পেশ করবে। বার বার মনে মনে সেগুলো আওড়ে নিচ্ছে সেইফ, কিন্তু ভয়ে এখনি সব ঘুলিয়ে আসছে তার।
ওই প্রচন্ড বিক্ষুব্ধ, বিশালদেহী, রাজকীয় চেহারার ব্যাক্তিটার সামনে বসে কিভাবে সে নিজের প্রাণ হাতে রেখে এতগুলো কথা বলবে, সেটা নিয়ে নিজের সাথে নিজেই দ্বন্দে জড়িয়ে যাচ্ছে সেইফ।
মীর আসলো অবশেষে। মেডিক্যাল জোন ফাঁকা হয়ে গেলো মুহুর্তেই। মীরের কড়া আদেশ, সে এখানে তার শিনজোর সাথে থাকাকালীন সময়টাতে সামান্যতম সাউন্ড চায়না ও এখানে।

ভুলেও যদি কেউ ওকে বিরক্ত করে ফেলে তবে সেখানেই যে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে সেটা সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত। তাই ভুল করেও এই এরিয়াতে কেউ টু শব্দটি করে না।
প্রচন্ড নির্জন কামরায় আনাবিয়ার পাশে এসে বসলো মীর, বেণী করা রাখা আনাবিয়ার স্বাস্থ্যজ্জ্বল চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলো একবার।
চিকিৎসার সুবিধায় চুলগুলো কেটে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিলো বাসির, কিন্তু মীরের এক ধমকে তারপর থেকে এ কথা কেউ আর চিন্তাও করেনি৷ এখন ইয়াসমিন রোজ এসে পরিষ্কার করে দেয় ওকে।
আনাবিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নরম হয়ে এলো মীরের হৃদয়, শুকনো মুখে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি। আনাবিয়ার মাথার সম্মুখে ডান হাতটা রেখে কপালের ওপর বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলিয়ে দিতে দিতে ওর দিকে আরও ঝুকে এলো মীর, মৃদুস্বরে বলে উঠলো,

“এখন আগের মতো তোমার কাছে সারাক্ষণ থাকি না বলে কি রাগ করেছো শিনু? রাগ কোরোনা, জানোই তো আমাকে কত ব্যাস্ত থাকতে হয়, কত দায়িত্ব আমার ওপর!
তুমি তো বুঝো সবকিছুই, তবুও রাগ করে থাকো আমার ওপর। রাগ করে কথা বলোনা, আমার দিকে তাকাওনা পর্যন্ত! এমন অবুঝের মতো আচরণ করলে হয় বলো? তুমি এখন বড়ো হয়েছো না?”
নিরব হয়ে গেলো মীর আবারও, কিয়ৎক্ষণ আনাবিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো এক দৃষ্টিতে। চোখের কোণে বাষ্প জমতে শুরু করলো ধীরে ধীরে।

চেয়ার টেনে নিয়ে আনাবিয়ার আরও কাছাকাছি এগিয়ে এসে আনাবিয়ার রঙ হারানো টেরাকোটা রঙা ঠোঁটের ওপর আলতো করে বসিয়ে দিলো একটা ছোট্ট চুম্বন!
তারপর নিজেকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সন্তর্পণে মাথাটা রাখলো আনাবিয়ার বুকের ওপর, বুক চিরে বেরিয়ে এলো একটা ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় দীর্ঘশ্বাস।
আনাবিয়ার ডান হাতটা টেনে নিয়ে রাখলো নিজের মাথার ওপর, এরপর আনাবিয়ার কব্জির উপরিভাগ মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে নিজেই নিজের মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগলো আনাবিয়ার নিঃসাড় হাতের স্পর্শ! নির্জীব হাতের স্পর্শেই খুঁজে ফিরলো স্বান্তনা।

ঘুম ভেঙে মীর যখন উঠলো তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। আনাবিয়ার বুকের ওপর মাথা রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানেনা। ঘড়ি দেখলো মীর, ছটা বেজে গেছে, এখানে এসেছিলো ও দুপুর দুইটায়।
অনেক অনেক গুলো দিন পর প্রায় তিন ঘন্টা এক নাগাড়ে ঘুমিয়েছে ও।
রাতে কখনোই ঘুম হয়না ওর। কিছু মুহুর্ত পর পরই ঘুম ভেঙে যায়; উদ্ভট উদ্ভট স্বপ্ন দেখে নয়তো মনের ভেতর তাড়া করে বেড়ানো অশান্তিতে।

বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে আনাবিয়ার ললাটে ঠোঁট স্পর্শ করলো ও, তারপর চোখ কচলে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা খুলে বেরোতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সেইফকে।
সেইফ ওকে দেখা মাত্রই আনুগত্য জানিয়ে মাথা নোয়ালো। মীর ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিলো, কিন্তু সেইফ তড়িঘড়ি করে ওর পেছনে গিয়ে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, যদি অনুমতি দিতেন তবে আপনার সাথে কিছু কথা বলতাম।”
মীর না দাঁড়িয়েই বাতাসে হাত নাড়িয়ে না বুঝিয়ে হেটে চলে যেতে নিলো। সেইফ আবারও এগিয়ে গিয়ে ঢোক গিলে বলে উঠলো,

“ইয়োর ম্যাজেস্টি, কথাগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ! দয়া করে শুনুন একবার!”
মীর দাঁড়িয়ে গেলো। সেইফের বুকের ভেতর দুড়ুম দুড়ুম শব্দ শুরু হলো। জায়ান সাদির অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে এবার না ওর প্রাণটাই চলে যায়!
কিন্তু মীর কোনো প্রতিক্রিয়া জানালোনা, সেইফের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল,
“বলো।”
“ব-বারান্দায় গিয়ে বসে কথা বলি, ইয়োর ম্যাজেস্টি?”
মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল সেইফ৷ মীর ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে এগোলো বারান্দায় রাখা সোফাসেটের দিকে। সেইফ এগোলো ওর পেছন পেছন।
মীর গিয়ে বসলে সেইফ এসে দাঁড়িয়ে রইলো ওর সামনে, মীর হাতের ইশারায় বসতে বললে বসলো।
সেইফ বসে পড়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ হাত কচলে আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমার কথা গুলো একটু মনোযোগ দিয়ে শোনার অনুরোধ। দয়া করে রেগে যাবেন না!
আমরা জানি আপনার হারানোর ব্যথা অপার, আপনার শোক অমূল্য। কিন্তু আপনার বেঁচে থাকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আপনার কাঁধে থাকা দায়িত্ব আরও বহু প্রাণের আশ্রয়।
আপনার কাঁধে বিশাল এক দায়িত্বের ভার, ইয়োর ম্যাজেস্টি। আপনার সিংহাসন, আপনার উত্তরাধিকার, আপনার শাসন—সবই আপনার শক্তির ওপর নির্ভরশীল।

আপনার ওপর সৃষ্টিকর্তা বিরাট এক গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন, আপনাকে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও নিজেকে শক্ত রেখে সবকিছু সামলে নিতে হবে ইয়োর ম্যাজেস্টি। আপনি যা হারিয়েছেন তা কখনো আর বদলাবে না। কিন্তু যা আপনার বর্তমান সেটা আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে!
পঞ্চদ্বীপ সর্বক্ষণ আপনার মুখ চেয়ে আশায় বুক বেধে বসে থাকে ইয়োর ম্যাজেস্টি। আপনি, আপনার উত্তরাধিকার, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম; এভাবেই জীবন এগোবে।
আমি জানি, অনাগত সময়ে যে সিদ্ধান্ত গুলো আপনার নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে সেগুলো অনেক নিষ্ঠুর, হৃদয়ের গভীরে বেদনার কারণ। কিন্তু জানেন তো, জীবন কখনও কখনও কঠিন পথ বেছে নেয়।

ভালোবাসার জন্য মানুষকে কখনো কখনো ব্যাতিক্রমী ত্যাগ স্বীকার করতে হয় যেটা মেনে নেওয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আপনি আমাদের ওপর ছায়ার মতো, আপনি ব্যাতিত আমাদেরকে কে দেখবে বলুন!
তাই দয়া করে নিজেকে সামলান, শক্ত হন—কারণ আপনার অস্তিত্ব সমস্ত পঞ্চদ্বীপের মানুষের বেঁচে থাকার ভিত্তি।
আপনি ভেঙে পড়লে শুধু আপনি নন, অনেকেই হারিয়ে যাবে আমাদের ভেতর থেকে! দয়া করে ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা করবেন ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনার নিকট আমার সবিনয় অনুরোধ……”

মীর আর শুনলোনা, উঠে এলো সেখান থেকে। তারপর সোজা চলে এলো নিজের কামরায়৷
এসেই শরীর থেকে পোশাকগুলো টেনে টেনে ছিড়ে খুলে ফেললো এক প্রকার, তারপর ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে, পিঠ ঠেকিয়ে দিলো বিছানায়।
অসহায় ও প্রচন্ড অসহায়! বুকের ভেতরটা ভারী, ভয়ংকর রকমের ভারী! একদিকে অর্কিড বাগানে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকা ওর ছোট্ট অংশ, যাকে আজও সে ভুলতে পারেনি! অন্যদিকে ওর প্রাণপ্রিয় শিনজোর এমন সংকটাপন্ন অবস্থা!
এই সমস্ত কিছুর পর শূলের ন্যায় বিঁধে দাঁড়িয়ে ওর কাঁদে চেপে আছে এক গুরুদায়িত্বের বোঝা—হারিয়ে যাচ্ছে ও, হারিয়ে যাচ্ছে এক শ্বাসরুদ্ধকর শূন্যতার মাঝে।

শোক, অপরাধবোধ, দায়িত্ববোধের টানাপোড়েন, এবং ভবিষ্যতের অজানা শঙ্কা—সব মিলিয়ে ওর বুকের পরতে পরতে দামামা বাজিয়ে চলেছে এক ভয়াবহ যুদ্ধ!
হঠাৎ করেই ওর মনে হতে লাগলো ওর এই অস্তিত্বই অর্থহীন! ও ভেঙে পড়লে ধ্বংস হবে সবকিছু, শক্ত হতে চাইলে হয়ে যাবে হৃদয়হীন!
ওর শিনজো শুয়ে আছে মেডিক্যাল জোনে, গভীর নিদ্রায়। কবে জাগবে জানেনা ও, বা হয়তো কখনো ওর আর দেখা হবেনা ওর প্রাণের শিনজোর সেই ঝকমকে দৃষ্টি! কখনো আর শোনা হবেনা সেই সুমধুর খিলখিলে হাসি।
ওর শিনজো জেগে উঠলেও তার মাধ্যমে ওর আর কোনো উত্তরাধিকার আসবেনা, এই মরমর অবস্থায় ওর শিনজোকে ও আবার কিভাবে দেখবে? কখনোই দেখবেনা আর, কোনোদিনও না!

কিন্তু এই সাম্রাজ্য? ওর পর কে সামলাবে? কার হাতে তুলে দিয়ে যাবে ও এই গুরুদায়িত্ব? যে সাম্রাজ্যের জন্য ও ওর হাসিখুশি পরিবারটাকে নিমিষেই হারিয়ে ফেললো, একের পর এক মৃত্যুশোক ছিন্নভিন্ন করে ফেললো ওকে, যে সাম্রাজ্য দেমিয়ান বংশের একছত্র আধিপত্যের প্রতীক— সেই সাম্রাজ্যের কি হবে?
এত ত্যাগ, এত রক্ত, প্রিয় মানুষ হারানোর এত যন্ত্রণা সমস্তই কি বৃথা হয়ে যাবে?
না, এটা সে কিভাবে হতে দেবে? এই সাম্রাজ্য ওর রক্তে মিশে আছে। এই সাম্রাজ্যের শাসনভার ওর মস্তিষ্কে গাথা। একে ও কিভাবে ছেড়ে দিবে? কার হাতে ছেড়ে দিবে? ইলহান?

কখনোই না, ওর নিজের হাতে গড়া এই সোনার সাম্রাজ্য ও কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন, অহংকারী ব্যাক্তির হাতে তুলে দিয়ে সাম্রাজ্যের এবং দেমিয়ান বংশের অসম্মান করবেনা। অসম্ভব!
দুহাতে মাথাটা চেপে ধরলো মীর, বুকের ভেতরে চলা দুপক্ষের দ্বন্দের এই অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা শেষ করে দিচ্ছে ওকে, শেষ হয়ে যাচ্ছে ও!
হঠাৎ করেই মাথাটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে মানসিক যন্ত্রণা আর ক্রোধের তোপে প্রাসাদ কাঁপিয়ে ভয়ানক রকমের চিৎকার দিয়ে উঠলো মীর।
ওর সে চিৎকারে কেঁপে উঠলো রয়্যাল ফ্লোরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলো। আতঙ্কিত হয়ে প্রাসাদের গা ঘেঁষে থাকা গাছগুলোর ওপর থেকে ডানা ঝাপটে উড়ে স্থান ত্যাগ করলো এক ঝাঁক পাখি!

নিজের কামরায় মেঝেতে বসে আছে মীর। শরীরটা আরও খারাপের দিকে গেছে। খাওয়া দাওয়ার ভীষণ রকম অনিয়ম আর ভয়ানক মানসিক অশান্তিতে বিশাল শরীরটা পাতলা হয়ে এসেছে।
হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ, মস্তিষ্ক হঠাৎ করেই ফাঁকা হয়ে গেছে ওর, মনে পড়তে চাইছেনা কিছু! মুষ্টিবদ্ধ হাত জোড়ার ধারালো নখাগ্রভাগ হাতের তালুতে জখম করে ফেলার উপক্রম। শক্ত, ক্ষিপ্ত মুখশ্রী নিয়ে মেঝের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থেকে অজানা কিছু চিন্তা করে চলেছে ও।
এমন সময় দরজার ওপর পড়লো করাঘাত, সজোরে আঘাতের শব্দের পরপরই কর্ণগোচর হলো কোকোর উত্তেজিত কন্ঠস্বর,

“ইয়োর ম্যাজেস্টি!”
কিন্তু কোকোর কন্ঠস্বর চিনতে পারলোনা মীর, ভয়ানক ক্রোধে ক্রোধান্বিত হয়ে মেঝে ছেড়ে উঠে ক্ষিপ্র গতিতে তেড়ে এলো মীর দরজার নিকট, আর দরজা খুলেই নিজের ইস্পাত সম মুষ্টিবদ্ধ হাতের একটা বিশাল আঘাত বসিয়ে দিলো কোকোর চোয়াল বরাবর।
ছিটকে অন্যপাশে চলে গেলো কোকো, মীর চোখে মুখে ভয়ঙ্কর রাগ নিয়ে আবারও হামলা করতে এলো কোকোর ওপর, কিন্তু কোকো নিজেকে কোনো রকমে বাচিয়ে নিয়ে কেঁদে উঠে উর্ধশ্বাসে বললো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদীর জ্ঞান ফিরেছে, চোখ খুলেছেন উনি! দয়া করে শান্ত হোন!”

কোকোর মুখনিঃসৃত বাক্যটা মীরের কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই থমকে দাঁড়িয়ে গেলো মীর। হতভম্ব, অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কোকোর দিকে কিয়ৎক্ষণ; হয়তো সময় লাগলো পুরো বাক্যটা প্রসেস হতে ওর মস্তিষ্কে।
আর কোকোর কথাটা বোধগম্য হতেই ভ্রুজোড়া এই দুবছরে জমা হওয়া সমস্ত অসহায়ত্ব ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রশান্তির ছোয়ায় কুচকে ওপরে উঠে এলো।
গভীর সমুদ্রের তলায় দম আটকে দিশেহারার ন্যায় সমুদ্রপৃষ্ঠ খুঁজতে থাকা থাকা ডুবুরি নীল পানির উপরিভাগে এসে যেভাবে শ্বাস নেয়, ঠিক সেভাবেই একটা বিরাট শ্বাস নিলো মীর। ডুবতে ডুবতে যেন এবারের মতো বেঁচে ফিরেছে ও!

পর পর কয়েকবার বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ও ঘুরে ছুটে যেতে নিলো আনাবিয়াকে রাখা মেডিক্যাল জোনের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার থমকে দাঁড়িয়ে গেলো ও।
পা জোড়া ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে এসে এগোলো নিজের কামরার দিকে, ভেতরে প্রবেশের আগে দরজার দুপাশে জড়বৎ দাঁড়িয়ে থাকা লিও কাঞ্জিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
“কল মা’ পার্সোনাল বার্বার, আ’ নিড অ্যা হেয়ার কাট।”
লিও কিছুক্ষণ মীরের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অতঃপর দ্রুত কল লাগালো মীরের ব্যাক্তিগত নাপিত কে৷ মীর কামরায় ঢুকে গেলো সাথে সাথে, দরজা ভেজিয়ে দেওয়ার আগে পেছন ফিরে সোফার ওপর মীরের মার খেয়ে উলটে পড়ে চোয়ালে হাত দিয়ে বসে থাকা কোকোর দিকে তাকিয়ে দ্রুত গলায় বলল,
“আমার শিনজো যেন ভুলেও গত দুবছরের একটা কথাও জানতে না পারে, কিচ্ছুটি বুঝতে না পারে। ওকে বলবি কা’র এক্সিডেন্টে স্মৃতিভ্রম হয়েছে। গ্যো, কুইক!”
কোকো হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো মীরের যাওয়ার পানে। বাম চোয়ালটা যেন থেতলে গেছে ওর, সেখানে হাত চেপে রেখে নিজেকে সামলে উঠে দাড়ালো ও।

লিও নাপিতকে কল করতে করতে কোকোর দিকে এগিয়ে এসে শুধালো,
“খুব লেগেছে ভাই? আইসব্যাগের ব্যাবস্থা করবো?”
কোকো কয়েকবার হা করে বাতাস চিবিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ওর দাঁত গুলো ঠিক আছে কিনা, এরপর উত্তর দিলো,
“লাগবেনা। তোরা দুজন এখানেই অপেক্ষা কর, হিজ ম্যাজেস্টির সাথে আসবি। ওইখানে ফ্যালকনকে রেখে চলে এসেছি আমি, হাঁসের বাচ্চাটা কেঁদেকুটে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে হয়তো এতক্ষণে। এখনি না গেলে কি কি বলে ফেলবে আমি জানিনা। থাক তোরা, আমি গেলাম।”
কোকো দ্রুত পায়ে চলে যেতে নিলে কাঞ্জি এসে তাড়াতাড়ি ওকে আঁটকে নিয়ে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“হিজ ম্যাজেস্টি প্রথমে শেহজাদীকে দেখতে না গিয়ে আগেই নাপিতকে ডাকতে বললো কেন?”
ওর এমন প্রশ্নে লিও ওর দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল,
“কাঞ্জি, তুই শুধু নামেই বাঘের বাচ্চা।

হিজ ম্যাজেস্টির চেহারা দেখেছিস? যে পরিমাণে দাঁড়ি গোফের জঙ্গল করে রেখেছেন তাতে শেহজাদী দেখেই বুঝে যাবেন যে এদিকে টর্নেডো বয়ে গেছে। চিনতে না পারার আশঙ্কাও বাদ দেওয়া যায় না।”
কথা শেষ করেই লিও অন্যদিকে ঘুরে কথা বলতে গেলো প্রাসাদের রয়্যাল বার্বারের সাথে। কোকো কাঞ্জির দিকে একবার তাকিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে দ্রুত ছুটলো সেদিকে।
লিওর কলের কিছুক্ষণ পরেই বার্বার চলে এলো।
মীর চুল দাড়ি কেটে ছেটে জংলি থেকে মানুষ হয়ে ভালোভাবে গোসল দিলো।
এতগুলো দিনে ও কি দিয়ে কি করেছে সেটা নিজেও জানেনা৷ কিন্তু এখন আনাবিয়ার সামনে যেতে হলে ওর নিজেকে ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে নিয়ে যেতে হবে, নইলে সন্দেহ করে বসবে মেয়েটা৷

এমনিতেই শরীর ভেঙে গেছে, তার ওপর এমন নির্বাসনে থাকা ব্যাক্তির মতোন জংলী চুলদাড়ি দেখলে এই দিনগুলোতে কি হয়েছে সেটা নিয়ে সংশয়ে পড়বে সে।
আনাবিয়ার মনের ভেতর কোনোভাবেই সন্দেহ ঢুকতে দেওয়া যাবেনা।
রেডি হয়ে মীর বেরিয়ে এলো কামরা থেকে, আর ও বেরিয়ে আসা মাত্রই ওকে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লিও কাঞ্জি হতভম্ব হয়ে গেলো।

একটু আগের হিজ ম্যাজেস্টি আর এই হিজ ম্যাজেস্টির ভেতর যেন আকাশ পাতাল তফাৎ। বুক ভর্তি যন্ত্রণা নিয়েও তিনি দিব্যি হাসিমুখে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন; ওই শাণিত দৃষ্টি, সুদর্শন চেহারার আদল দেখলে কেউ বলবে না যে এই লোকটা কিছুক্ষণ আগেও যাযাবরদের ন্যায় ছিলেন।
শুধু শরীরটা একটু পাতলা হয়ে গেছে— একটু না, অনেক খানি। চোয়াল বসে গেছে কিঞ্চিৎ, চোখ জোড়া দেবে গেছে ভেতরের দিকে, মুখের শুকনো ভাবটা এখনো কাটেনি। সময় লাগবে হয়তো আরও কিছুদিন।
কালো রঙা প্যান্ট আর চারকোল রঙা একটা শার্ট পরিহিত মীর কামরা থেকে বেরিয়েই দ্রুত হেটে চলল মেডিক্যাল জোনের দিকে। আনাবিয়াকে দেখতে যাওয়ার প্রচন্ড তৃষ্ণাটা লুকিয়ে নিলো ভেতরে, যেন ওর হাঁসফাঁস দেখে আনাবিয়া পাছে না বুঝে যায় কিছু!
দু দুটো বছর পর আবার ওর শিনজোর ঝকমকে চোখ জোড়া দেখবে ও, দেখবে সেই ঝলমলে হাসি মাখা মুখ, শুনবে শিনজোর সুমধুর কন্ঠস্বর! ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যেতে, কিন্তু নিজেকে যযথাসম্ভব শান্ত রেখে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে ও৷
লিও আর কাঞ্জি একে অপরের দিকে সাবধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগোচ্ছে ওর পেছন পেছন।
তিন জোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ এগোচ্ছে একটি মায়াময়ী ঝলমলে মেয়েকে দেখার জন্য!

আনাবিয়া বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে মেডিক্যাল জোনের রয়্যাল কেবিনে।
এইখানে কিভাবে এলো কিছুই বুঝতে পারছেনা, শেষবার ও কোথায় ছিলো সেটাও মনে পড়ছেনা— অবুঝের মতো করে তাকিয়ে আছে কোকো আর ফ্যালকনের দিকে।
ওদের দুজনের পাশেই বসে আছে বাসির, বাসিরের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসমিন আর দুজন নার্স৷
খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠছে সকলের চোখ, কিন্তু কেউ ভুলেও প্রকাশ করছেনা নিজেদের ভেতরের উচ্ছাস! মীরের যে কড়া নির্দেশ!

আনাবিয়া এতক্ষণ কোনো কথাই বলেনি, শুধু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থেকেছে। কোকো ফ্যালকন এতক্ষণ ধরে কতবার করে জিজ্ঞেস করলো যে ওর শরীর কেমন লাগছে, ভালো লাগছে কিনা, কোনো অসুবিধা লাগছে কিনা— কিন্তু ও কোনো উত্তরই দেয়নি।
এখনো পুরোপুরি জ্ঞানে আসেনি ও, তবে আশপাশ টা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বোঝার চেষ্টা করছে জায়গাটা কোথায়, ও এখানে কেন এসেছে? ওর কি হয়েছিলো?
কোকো ফ্যালকন এতক্ষণ ধরে ওর সাথে একে একে ওদের সাজানো এক্সিডেন্টের মিথ্যা স্মৃতিভ্রমের ঘটনাগুলো খুলে বলার পর, আনাবিয়াকে নানারকম প্রশ্ন করলেও এখন চুপ হয়ে আছে ওরা বাসিরের ইশারায়।
বাসির বলে দিয়েছে চুপ থাকতে, শেহজাদীকে পুরোপুরি সজ্ঞানে আসার সময় দিতে।
আনাবিয়া সবার বলা সব কথা শুনে বুঝতে পারলেও কিছুই বলতে পারছেনা। ওর কাছে কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন ঠেকছে সব কিছু! কিছুক্ষণ ধীরগতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে অতঃপর কথা বলে উঠলো ও, দুর্বল কন্ঠে শুধোলো,

“আমার মীরি কই?”
আনাবিয়া প্রশ্ন করতে না করতেই কেবিনের দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো মীর, ওকে দেখা মাত্রই শ্রদ্ধাভরে দাঁড়িয়ে গেলো ভেতরে থাকা সকলে।
মীরের তৃষ্ণার্ত চোখ জোড়া প্রথমেই গিয়ে পড়লো আনাবিয়ার মুখের ওপর, শব্দ পেয়ে আনাবিয়াও তাকালো দরজার দিকে, আর তাকানো মাত্রই চোখাচোখি হলো দুজনের।
মীর থমকে দাঁড়িয়ে গেলো আনাবিয়ার হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে।
দম আটকে গেলো হঠাৎ করেই, আর তার পরমুহূর্তেই দুঃস্বপ্নের শেষের সত্যিকারের ভোর এলে মানুষ যেভাবে স্বস্তির শ্বাস ফেলে ঠিক সেভাবেই একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো ওর বুক চিরে! ওর শিনজো, ওর প্রাণ বসে আছে ওর সামনে; সুস্থ, প্রাণবন্ত!

ওর শিনজোর চোখে সেই চিরচেনা আলো— চোখ জোড়া আটকে গেছে আনাবিয়ার ঝলমলে দৃষ্টিতে, যেন আর এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারবে না, সরালেই সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যাবে!
অপলকে থাকা মীরের বুকের ভেতর বয়ে চলেছে ভীষণ ঝড়, কান্না আর উচ্ছাসের এক অদ্ভুত মিশ্রণে গলা আটকে আসছে ওর।
ওকে এভাবে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে পেছন থেকে লিও চাপা সুরে সম্বোধন করলো ওকে,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি……”
লিওর সম্বোধন কানে যাওয়া মাত্রই মীর নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে এগিয়ে গেলো আনাবিয়ার দিকে।
কোকো ফ্যালকনরা এদের দুজনকে নিভৃতে ছেড়ে দিয়ে তড়িতে বেরিয়ে গেলো কামরার বাইরে, লিও বাইরে থেকেই লাগিয়ে দিলো দরজা।

সাউন্ডপ্রুফ কামরাটা এবার সম্পুর্ন নিরব হয়ে গেলো।
মীর অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে ধীর, দুর্বল পায়ে এগিয়ে গেলো আনাবিয়ার দিকে।
ওকে দেখে মুখের এক চিলতে উচ্ছাস ফুটিয়ে আনাবিয়া উঠে যেতে নিলো ওর কাছে, কিন্তু হাতে পরানো সূচের কারণে বাধা পেয়ে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থেকেই মীরের শীর্ণ চেহারায় দৃকপাত করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“মীরি, তোমার শরীরের এ অবস্থা কেন? দেখি, এদিকে আসো তো!”
মীর জবাবে কোনো কথাই বলতে পারবো না, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো শুধু, ধীর পায়ে উঠে এলো আনাবিয়ার স্ট্রেচারের ওপর৷

আনাবিয়া এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে স্পর্শ করলো মীরের শীর্ণ চোয়াল। আনাবিয়ার হাতের আদুরে স্পর্শ পাওয়া মাত্রই দিনদুনিয়া ভুলে গেলো যেন মীর, মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে এলো। সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা ভুলে ওর সমস্ত শরীরটা শুধু, এবং শুধুমাত্র অনুভব করতে লাগলো আনাবিয়ার কোমল হাতের স্পর্শ!
ক্লান্ত, অবসন্ন দেহটা আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আনাবিয়ার কোলের ভেতর এলিয়ে দিলো মীর, শ্রান্ত মাথাটা ঠেকালো বুকে। আনাবিয়াকে জড়িয়ে নিলো দুহাতে, শক্ত করে, যেন ছেড়ে দেওয়া মাত্রই আবার হারিয়ে যাবে ওর প্রাণ!
আনাবিয়া এক হাতে ওর বুকে থাকা মীরের চুলের ভেতর নিজের সরু আঙুল চালনা করতে করতে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে শুধালো,

“মীরি, কি হয়েছে তোমার? এদিকে তাকাও তো, আমার দিকে তাকাও! এমন লাগছে কেন তোমাকে? চোখ মুখের কি হাল করেছো, দেখি?”
মীর মুখ তুললোনা, ওভাবেই পড়ে রইলো। আনাবিয়ার রিনরিনে, মিষ্টি কন্ঠে নিজের নাম শুনে শরীর শিউরে উঠলো ওর, হৃদস্পন্দন থমকে গেলো যেন। আনাবিয়া স্পষ্ট টের পেলো মীরের শরীরের সে কম্পন!
এত এতগুলো দিন পর আনাবিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে গলা ধরে এলো মীরের, চোখ ভিজে গেলো, কণ্ঠ আটকে এলো— কিন্তু প্রসারিত হলো ঠোঁট জোড়া; তৃপ্তিতে, শান্তিতে!
কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনির ন্যায় বেজে চলল আনাবিয়ার কণ্ঠনিঃসৃত মায়াবী স্বর, যেন ওর জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কোনো সুর ফিরে এসেছে আবার ওরই কাছে। ওকে এমন চুপ করে থাকতে দেখে আনাবিয়া ওর প্রশস্ত পিঠের ওপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদুস্বরে ডেকে উঠলো,

“মীরি!”
মীর কেঁপে উঠলো আবারও, নিজের পিঠের ওপর থেকে আনাবিয়ার হাতটা ধরে নিয়ে নিলো ওর হাতের মুঠির ভেতর, হাতের উপর পৃষ্টে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে অতঃপর আঙুলে আঙুল পেঁচিয়ে নিয়ে রোধ হয়ে আসা গলায় ব্যাকুল হয়ে বলে উঠলো,
“আবার বলো… আরেকবার ডাকো আমাকে……!”
মীরের এমন কন্ঠে শঙ্কিত হলো আনাবিয়া। শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে ওর, কিন্তু মীরের এমন চেহারা দেখে ওর বুক পুড়ছে।
কোকো ফ্যালকনের মুখ থেকে সকল কথাই ও শুনেছে, তখন পুরোপুরি না বুঝলেও ধীরে ধীরে সেগুলো বুঝতে পেরেছে।

দুটো বছর ধরে তবে কি ও কাউকে চিনতে পারেনি? ওর মীরকেও কি ও চিনতে পারেনি? তবে ওর মীরি কি করে ছিলো এই দুটো বছর? চোখের সামনে ওকে অচেনা লোকের মতো দেখে কিভাবে ছিলো সে?
দুটো বছরের স্মৃতি এভাবে ওর মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে গেলো সম্পুর্ন রূপে! কেন কিছুই মনে পড়ছেনা?
আনাবিয়া অস্থির হয়ে অন্য হাত থেকে সূচটা খুলে ফেললো। দুহাতে এবার ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো মীরকে, বিচলিত হয়ে ডেকে উঠলো ও আবার,
“মীরি!”
ডাক শোনা মাত্রই বুকের ওপর থেকে মাথা তুলে আনাবিয়ার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো মীর, গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া পথহারা পথিক হঠাৎ আলোর ঝলক দেখে যতটা বিস্ময়, অবিশ্বাস নিয়ে তাকায় ঠিক সেভাবেই আনাবিয়ার চোখে তাকালো মীর।
এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা কেন ওর?

অকস্মাৎ ও উঠে বসে দুহাত দিয়ে আগলে ধরলো আনাবিয়ার চোয়ালদ্বয়, আলতো করে আনাবিয়ার চোয়ালে নিজের হাত ঘষে ও অনুভব করলো সত্যিই ওর শিনজো আবার ওর বুকে ফিরে এসেছে কিনা, নাকি এটা নিছকই কোনো স্বপ্ন!
না, স্বপ্ন নয় কোনো। সত্যি সত্যিই এটা ওরই শিনজো, ওরই প্রাণ! আর তারপর অপলকে অনেক অনেকক্ষণ ধরে ও তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে, যেন গত দুবছরের আনাবিয়ার দৃষ্টি দেখতে না পারার এক বুক তৃষ্ণা, অতৃপ্তি, অপেক্ষা সব এই এক দেখাতেই মিটিয়ে নিতে চায় ও!
হুট করেই আনাবিয়ার মুখখানা নিজের দিকে টেনে নিয়ে এসে কপালে এক গভীর চুম্বন বসিয়ে দিলো মীর, আর তারপর চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে রইলো ওর সমস্ত মুখশ্রী!
মীরের এমন হঠাৎ চুম্বনের পাগলাটে আক্রমণে খেই হারিয়ে ফেললো আনাবিয়া, নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে মীরকে শান্ত করতে উদ্যত হলো ও।

কিন্তু তার আগেই মীর আচমকা জড়িয়ে ধরলো ওকে, জড়িয়ে নিলো দুহাতে, ভরে নিলো ওকে নিজের বুকের মধ্যিখানে। আর তারপরেই আনাবিয়াকে চমকে দিয়ে অচেনা জনসমাগমের ভেতর হারিয়ে গিয়ে হঠাৎ পরিবারের দেখা পেয়ে কেঁদে ওঠা দিশেহারা ছোট্ট বাচ্চাটির ন্যায় ডুকরে কেঁদে উঠলো ও!
আনাবিয়া মীরকে কিভাবে সামলাবে বুঝতে পারলোনা! কোকো ওকে তখনই বলেছিলো কিছু কথা যার ভাবার্থ এই যে মীর ওকে দেখলে অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। এতদিনগুলো দিন সে মীরকে চিনতে পারেনি, অচেনা অজানা অতিথির মতো করে থেকেছে। ফলস্বরূপ আজ হঠাৎ মীর তাকে দেখে, তার মুখে নিজের নাম শুনে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হতে পারে!

আনাবিয়া মীরের বুক থেকে নিজেকে টেনে সরিয়ে নিয়ে এলো মীরের সামনে, মীরের মুখোমুখি হয়ে মীরের কান্নায় ভাসা মুখের দিকে বাড়িয়ে দিলো ওর হাত। মুছে দিলো মীরের চোখের লোনা পানির স্রোত।
আনাবিয়ার হাতের স্পর্শে চোখ জোড়া আবেশে বন্ধ করে নিলো মীর, অনেক অনেক দিন পর এই আদুরে স্পর্শ পেয়ে ভীষণ কান্নায় বুক ভেঙে আসতে চাইলো ওর।

ওকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় আনাবিয়া মীরের গাল স্পর্শ করে মীরের মতো করেই চুমু খেলো মীরের কপালে, কিন্তু এতে মীরের কান্নার বেগ কমার থেকে বাড়লো আরও।
আনাবিয়া ঠোঁট উলটে অসহায় চোখে তাকালো ওর দিকে। মৃদু, স্নিগ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
“হুশশশ, কাঁদে না! এত বড় ছেলে, বাচ্চাদের মতো কাঁদতে আছে বলো? এই দেখো আমি এখানেই আছি, তোমার কাছে। আর কখনোই তোমাকে অচেনা হতে দেবোনা, কসম! আর কাঁদেনা, দেখো আমার দিকে!”
মীর সিক্ত চোখ জোড়া মেললো ধীরে, আনাবিয়া আবারও মুছে দিলো ওর পানিতে পরিপূর্ণ অক্ষি দ্বয়।
মীর অপলক, বিস্মিত, স্নিগ্ধ দৃষ্টি রাখলো আনাবিয়ার মুখের ওপর কিয়ৎক্ষণ, আর এরপর হঠাৎ করেই তীব্র চুম্বনের আক্রমণে দখল করে নিলো আনাবিয়ার টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়া!
মীরের কান্ডে হতচকিত হলো আনাবিয়া, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মীরের উন্মত্ত, বেহিসাবি চুম্বনের আহ্বানে সামিল হলো সেও।

দীর্ঘ চুম্বনের পর আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দিয়ে মীর মাথা নামিয়ে নিলো আনাবিয়ার বুকে, বুকের ভাজে মুখ গুঁজে দিয়ে চোখ বুজে নিলো ও, আনাবিয়ার বুকের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটা শ্বাসের ওঠানামার সাথে অনুভব করতে লাগলো ও আনাবিয়ার অস্তিত্ব— গায়ে মাখিয়ে নিতে থাকলো আনাবিয়ার শরীরের মিষ্টি উষ্ণতা!
আনাবিয়ার গাঢ় ভালোবাসার কোমল স্পর্শে শুকিয়ে এলো ওর বুকে হওয়া সমস্ত ক্ষত, প্রশমিত হলো সমস্ত অসহ্য যন্ত্রণা, শান্তিতে ছেয়ে এলো বুক!
ঘুম আসছে ওর, ভীষণ ঘুম! আনাবিয়ার বুকের ঘ্রাণ, ওর চুলের ভাজে আনাবিয়ার আঙুলের কোমল ছোয়া সেডেটিভের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ওর সারা শরীরে!

চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এলো মীরের, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্বাস প্রশ্বাস গাঢ় হয়ে এলো ওর, সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে সে! আনাবিয়া ভ্রু উচিয়ে মায়া ভরা দৃষ্টিতে দেখলো মীরের ঘুমন্ত, শীর্ণ, চোয়াল বসে যাওয়া চেহারাটা। বুকের ভেতরটা সিক্ত হলো ওর ভালোবাসায়।
ঠোঁট ছুয়ে দিলো ও মীরের চুলের ওপর দিয়ে।
এই মানুষটার শান্তির কারণ ও, ওর বুকেই এই বিশাল শরীরটা শান্তি খুঁজে ফেরে, খুঁজে ফেরে একটুখানি আশ্রয়। এই বিরাট শ্বেত পাথরের প্রাসাদের আভিজাত্যপূর্ণ কামরার নরম বিছানা তাকে যেটা দিতে পারেনা সেটা আনাবিয়ার ছোট্ট বুকে এসে সে নিমিষেই পেয়ে যায়!
স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ মীরের দিকে তাকিয়ে থেকে অতঃপর আবারও নিজের নরম ঠোঁটের মৃদু স্পর্শ এঁকে দিলো ও মীরের কপাল পরে। মৃদু চুম্বনের মিষ্টি পরশে ঘুম গাঢ় হয়ে এলো তার!

আনাবিয়া ঘুমিয়ে আছে নিজের কামরার সুদৃশ্য ঝিনুকের আকৃতির ন্যায় বিছানার বা পাশটা জুড়ে। ডান পাশটা শূন্য, এখনো উষ্ণ। কিয়ৎক্ষণ আগেই মীর উঠে গেছে বিছানা ছেড়ে।
সপ্তাহ খানেক হলো আনাবিয়াকে মেডিক্যাল জোন থেকে রিলিজ দিয়ে দিয়েছে। এই এক সপ্তাহ মীর ওকে রাত দিনের প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই নিজের সাথে লেপ্টে রেখেছে। এতটুকু সময়ের জন্যেও ছাড়েনি।
জায়ান আছে প্রাসাদেই, আনাবিয়া আরও একটু সুস্থ হলে, মীর আরও একটু স্টেইবল হলে তখন সে প্রাসাদ ছাড়বে কিমালেবের উদ্দ্যেশ্যে।

বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রাসাদের হেরেমে গেছে সে, তার সাথে গেছে লিও কাঞ্জি।
মীর দাঁড়িয়ে আছে ওর কামরার সামনের বিশাল বারান্দার রেলিং ধরে। হাতে ওর একটা মোটাসোটা সিগারেট, থেকে থেকে সেটা নিজের কালো রঙা পুরুষ্টু ঠোঁটের ভাজে ফেলে টানছে ও। কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ছে সেটা থেকে৷
নিজের এতবছরের জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো নেশাদ্রব্যে হাত দিয়েছে ও, যেন বুকের ভেতরে বয়ে চলা ভীষণ অশান্তির সাইক্লোনটা একটু হলেও শান্ত হয়!
চোখ জোড়া চাঁদহীন তারাখচিত আকাশের দিকে অপলকে নিবদ্ধিত, আনাবিয়ার প্রেমময়ী বাহুডোর থেকে বেরিয়ে এসে এখন কি করতে চলেছে সে? এই ভার ও কিভাবে বইবে, কিভাবে লুকোবে এই অপরাধবোধ?
কিন্তু ওর যে একটা সন্তান চাই! এই বিশাল সাম্রাজ্যের জন্য উত্তরাধিকার চাই, দেমিয়ান বংশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ওর যে নিজের ঔরসজাত সন্তান চাই!

একটা সন্তানের জন্য ওর শিনজোকে ও মৃত্যুমুখে কিভাবে ঠেলে দিবে আবার? কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ওর শিনজোকে ছাড়া তো ও ওর জীবন কল্পনাও করতে পারেনা!
সিগারেটে আরও একটা টান দিলো মীর, ভেতরটা বিধ্বংসী যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যেতে চাইছে, আজ যেন নিজের অস্তিত্বের সাথেই প্রতারণা করতে চলেছে সে, নিজের হাতেই খুন করতে চলেছে ওর ওপর হওয়া শিনজোর দৃঢ় বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা!
সময় যতো এগোচ্ছে ততই প্রতিটা মুহূর্ত যেন বিষাক্ত হয়ে উঠছে আরও! ভেতরটা ভীষণরকম যাতনায় পুড়ে ছাই হচ্ছে তুষের আগুণের ন্যায়৷

ওর শিনজোকে ছাড়া ও কিছুই নয়, ওর শিনুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার অর্থ নিজের হৃদয়কে নিজেই টেনে ছিঁড়ে ফেলা! এ যন্ত্রণা যে সাধারণ কোনো যন্ত্রণা নয়, এটা যে মৃত্যু যন্ত্রণার থেকেও ওর কাছে বেশি বিধ্বংসী, বেশি বেদনাময়!
সিগারেটে আরও একটা টান দিলো মীর, ধোঁয়া ছেড়ে দিলো খোলা আকাশের বুকে। বাহ্যিক যন্ত্রণা গুলো সকলেই দেখতে পায়, ভেতরের খবর পায় কজন? এক সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কে খবর রাখে? কেউ না!
কি হতো যদি ও সাধারণ কেউ হতো!

থাকতো না ওর কাঁধে কোনো দায়িত্বের চাপ, থাকতো না কোনো বিশাল সাম্রাজ্যের ভার, থাকতো না পূর্বপুরুষদের নির্ধারণ করে দিয়ে যাওয়া কর্তব্যের পাহাড়!
ছোট্ট একটা বাড়ি, কোনো এক নির্জন পাহাড়ের পাদদেশে, যেখানে থাকতো কেবল নিস্তব্ধতা। চারদিকে থাকতো ঘন সবুজ বন, ভেসে আসতো জংলী পাখির ডাক, পাহাড়ি ঝরনার মিষ্টি কলধ্বন!
ভোরবেলা ওর ঘুম ভাঙতো শিনজোর নরম স্পর্শে, চোখ খুলেই ওর শিনজোর মিষ্টি মুখটা চোখে পড়তো ওর! চওড়া জানালা দিয়ে সকালের নরম রোদ এসে পড়তো শিনজোর দীঘল সফেদ চুলে, আর মীর মুগ্ধ হয়ে দেখতো শিনজোর অপরূপ সৌন্দর্য……!

সকালে একসাথে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতো দুজনে, তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে যেতো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায়, হিম বাতাসে উড়তো আনাবিয়ার চুল!
সন্ধ্যায় বসে বসে হয়তো বৃষ্টি দেখতো ওরা কখনো, মীর হয়তো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতো শিনজোর মিষ্টি চেহারাটা। শীতল হাওয়ায় নিচে শিনজো হয়তো মাথা এলিয়ে দিতো ওর কাঁধে, চোখ বুজে নিয়ে নিতো বিশ্রাম।
রাতে ওদের ছোট্ট ঘরটা ভরে উঠতো ভালোবাসার উষ্ণ ছোয়ায়, শিনজো থাকতো ওর বাহুডোরে, বিছানায় শুয়ে চুপিচুপি কতশত গল্প বলতো।

মীর হয়তো ওর বুকের ওপর মাথা রেখে শুনে যেত সে সমস্ত গল্প, আর ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে যেতো শিনজোর হৃদয়ের তালে তালে বয়ে চলা শব্দ শুনতে শুনতে….…! নির্জন এই পৃথিবীতে এক শিনজোই হতো ওর একমাত্র পৃথিবী।
এই অসম্ভব কল্পনার মধ্যিখানে ও নিজের অজান্তেই চাপা সুরে গেয়ে উঠলো,
“আবছায়া চলে যায় হিজলের দিন
অভিমান জমে জমে আমি ব্যথাহীন
আহারে জীবন, আহা জীবন
জলে ভাসা পদ্ম যেমন……” (চিরকুট— আহারে জীবন)
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মীর, এমন সময় রয়্যাল ফ্লোরের প্রবেশপথ দিয়ে এসে চওড়া বারান্দায় হেটে মীরের দিকে এগিয়ে এলো জায়ান, লিও, কাঞ্জি৷

ওদের দেখে সিগারেটের জ্বলন্ত মাথাটা রেলিঙের ওপর পিষে নেভালো মীর। মুখের ভেতর থাকা ধোঁয়া টা ছেড়ে বাইরে বের করে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো জায়ানের দিকে।
জায়ান মীরের সামনে আনুগত্যের সাথে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, মেয়েটিকে আপনার জন্য তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটি যথেষ্ট শক্তিশালী, ল্যাবে তাকে এক্সামিন করার সময়ে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন৷”
মীর প্রতিউত্তরে কিছুই বললনা, শুধুই মাথা নাড়ালো। তারপর আবার ঘুরে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ঝড়ো শ্বাস ছাড়লো একটা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কামরায় চলে গেলো মীর, কামরার বা দিকে থাকা আনাবিয়ার কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ও।

আনাবিয়া ঘুমিয়ে আছে গভীর ঘুম৷ নিঃশ্বাসের তালে তালে পাতলা পোশাকে আবৃত বুকটা মৃদু গতিতে ওঠানামা করছে। মীর হেটে গিয়ে দাঁড়ালো আনাবিয়ার বিছানার পাশে, বিছানার কার্নিশে হাতের ভর দিয়ে সন্তর্পণে ঝুঁকে এলো আনাবিয়ার দিকে। কিয়ৎক্ষণ চেয়ে দেখলো আনাবিয়ার নিষ্পাপ মুখশ্রী।
চোখজোড়া বন্ধ, শান্ত, সুন্দর— তবুও যেন তাতে মায়ার শেষ নেই! টেরাকোটা রঙা ঠোঁটে আলতো ভাজ, তাতে লেগে আছে এক চিলতে প্রশান্তি।
আনাবিয়ার মুখখানা দেখতে দেখতে চোখে বাষ্প এসে ভীড় জমালো মীরের, ঝুঁকে এসে টুপ করে একটা ছোট্ট চুম্বন বসিয়ে দিলো আনাবিয়ার কপালে৷ মনে মনে একবার আওড়ালো,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও প্রাণ আমার…!”
আর তার পরমুহূর্তেই দ্রুত পায়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ও।

কামরায় নিজের বিছানায় গভীর ঘুমে থাকা আনাবিয়ার হঠাৎ করেই ঘুম ভাঙলো তীব্র অস্বস্তিতে, আধো ঘুমে থেকে চিরকালীন অভ্যাসবশত হাতড়ালো নিজের পাশের জায়গাটা।
কিন্তু মীরের দীর্ঘ দেহের বদলে সে স্থানটা ফাঁকা পেলো আনাবিয়া। বালিশের ওপর মীরের মাথার ছাপ এখনো স্পষ্ট, উষ্ণতা হারিয়ে গেছে বিছানা থেকে। হয়তো অনেক আগেই সে বিছানা ছেড়েছে।
যন্ত্রণাটা ক্রমে বেড়ে যেতে লাগলে আনাবিয়ার ঘুম ভাঙলো এবার ভালো ভাবে। মীরের অনুপস্থিতির চাইতে ভেতরে বয়ে চলা অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণাদায়ক অস্বস্তিটা বেশি পীড়া দিতে লাগলো তাকে, হাঁসফাঁস লাগছে ওর প্রচন্ড। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসনালী আঁটকে আসছে!

এমন কেন হচ্ছে? এমন তো কখনো হয়না! ওর কি কোনো অসুখ হলো? কিন্তু অসুখ করলে বুক কেন পুড়বে?
বিছানা ছেড়ে উঠে এলো আনাবিয়া। কেমন দম আটকানো অনুভূতি হচ্ছে, খোলা বাতাসে যেতে হবে ওকে এখুনি।
পাতলা পোশাকের ওপর দ্রুত একটা রোব চড়িয়ে দিলো ও, তারপর এক প্রকার ছুটে বেরিয়ে এলো কামরা থেকে।
চওড়া বারান্দায় এসে বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে খোলা বাতাসে জোরে জোরে দম ছাড়তে লাগলো ও।
বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে, কমার নাম নিচ্ছেনা!
মীর কোথায় গেছে? ওর কি কোনো কাজ পড়েছে? কিন্তু এত রাতে ওর কিসের কাজ?
আনাবিয়াকে এত রাতে এভাবে কামরা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে মীরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোকো ভড়কালো। ফ্যালকন ঘুমিয়ে পড়েছে, কোকো এখনো জেগে আছে মীরের আদেশে। আনাবিয়ার খেয়াল রাখতে ওকে এখানেই দাঁড়া করিয়ে রেখে গেছে মীর।
কোকোর বুকের গতি বাড়ছে, ওর আম্মার অগোচরে ওরা যা করছে সেটা জানতে পারলে কি করবে ওর আম্মা? কিভাবে সহ্য করবে এসব?

কোকো ঢোক গিলে এগিয়ে গেলো আনাবিয়ার দিকে, আনাবিয়াকে এমন অস্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে দেখে ভয় পেলো ও। আবার ওর আম্মার কিছু হবে না তো?
পেছনে এসে দাঁড়িয়ে উৎকন্ঠিত গলায় শুধালো,
“আম্মা, আপনি ঠিক আছেন?”
কোকোর গলা শুনে চমকে পেছনে তাকালো আনাবিয়া, ওকে দেখে এগিয়ে এসে অস্থির কন্ঠে শুধালো,
“আমার মীরি কোথায়? কোথায় গিয়েছে ও?”
কোকো এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে আবার উদ্বিগ্ন কন্ঠে পালটা প্রশ্ন করলো,
“আম্মা, আপনি ঠিক আছেন? আপনার শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে? বসবেন একটু?”
কোকোর প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষা করলোনা, আনাবিয়ার হাত ধরে ধীর গতিতে টেনে নিয়ে গিয়ে বসালো সোফার ওপর, আনাবিয়া পুতুলের মতো গিয়ে বসলো সেখানে।
কোকো দ্রুত হাতে সামনে রাখা টেবিলের ওপর থেকে পানি ভর্তি গ্লাসে নিয়ে ধরলো আনাবিয়ার ঠোঁটের কাছে, বলল,

“পানি খান আম্মা!”
আনাবিয়া সাথে সাথে খেয়ে নিলো সম্পুর্নটা। কিন্তু হাঁসফাঁস কমলোনা ওর, উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।
কোকো ব্যতিব্যস্ত হলো, আনাবিয়ার হাতখানা নিজের মুঠিতে নিয়ে চিন্তিত গলায় শুধালো,
“কি হচ্ছে আপনার আম্মা? বলুন আমাকে!”
আনাবিয়া কথা খুঁজে পেলোনা, নিজের ভেতরের অনুভূতি ও বোঝাতে পারছেনা, অথচ অদ্ভুত যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা ছিড়ে যেতে চাইছে। হাঁসফাঁস করতে করতে কোকোর দিকে অসহায় চোখে তাকালো ও।
সে চোখে কেমন যেন নিঃস্বতা দেখলো কোকো, বুকে খুব বাজলো ওই দৃষ্টি!
আনাবিয়া ওভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রোধ হয়ে আসতে থাকা কন্ঠে কোনোরকমে বলল,
“কেমন যেন অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে কোকো, প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে! এমনটা আগে কখনো হয়নি, হঠাৎ এমন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছিনা! আমার মীর কোথায় গেছে?”

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৫+৩৬

“জ-জরুরী কাজে গিয়েছেন তিনি।”
বলল কোকো। আনাবিয়া আরও প্রশ্ন করতে যাবে, তার আগেই হঠাৎ করেই কমে এলো ওর বুকের ভেতরের যন্ত্রণা, অস্বস্তি। যেমন আকস্মিকভাবে এসেছিলো তেমন ভাবেই যন্ত্রণাটা মুহুর্তেই নেই হয়ে গেলো যেন!
নিজের এমন হঠাৎ পরিবর্তনে আনাবিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে কোকোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কমে গেছে যন্ত্রণা, হঠাৎ করেই!”
আর তার পরমুহূর্তেই খুলে গেলো রয়্যাল ফ্লোরের প্রবেশদ্বারের দরজা, সেখানে দেখা গেলো মীরের সুদীর্ঘ অবয়ব……

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৯+৪০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here