বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৭+৮
রানী আমিনা
রেড জোনের জঙ্গলের অসাধারণ সৌন্দর্যের ভেতরে বসে আছে ওরা। লতানো গাছের সবুজ চাদরে ছেয়ে আছে চারপাশ। মাটির গায়ে নরম মসের ছোঁয়া আর তার ওপরে ঝরে পড়ে আছে শুকনো পাতা।
রাতের মায়াবী আকাশে জ্বলে উঠেছে লক্ষ তারার আলো। আর সেই মৃদু আলোয়, গাঢ় বনানীর মাঝে শুরু হয়েছে ওদের বার্বিকিউ পার্টি।
মধ্যমণি হয়ে জ্বলছে উজ্জ্বল এক বনফায়ার, তার তাপ আর আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আগুনের চারপাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বসার জায়গা।
মাটির ওপর বিছানো হয়েছে মেরিনো ভেড়ার পশমের তৈরি বিস্তৃত, নরম আসন যা জমিনের সাথে মিশে থাকা শুকনো পাতার সাথে মেলবন্ধন করে এক অন্যরকম আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আসন গুলোর ওপর ছড়িয়ে রাখা হয়েছে বড় বড় মোলায়েম কুশন। সেখানে বসে একে অপরের সাথে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছে ওরা সকলে।
মীর বসে আছে পশমের ম্যাটের ওপরে, পাশের একটা গাছের সাথে কুশন ঠেকিয়ে সেখানে হেলান দিয়ে। একমনে নিজের ফোনে কিছু জরুরি মেইল দেখে যাচ্ছে ও৷
ওর থেকে কিছুটা দূরে বসে জায়ান; ওর সামনে বসে সমানে কলকলিয়ে গল্প করে যাচ্ছে অ্যানা৷
ওদের ম্যাটের পাশেই আর একটা ম্যাট, সেখানে বসে আছে হামদান, নোমান সহ মীরের খুব কাছের কিছু সহচর।
বনফায়ারের আগুনের গনগনে উত্তাপে তাদের মুখগুলো আলোছায়ায় মাখা, যেন প্রত্যেকটা মুখেই লেগে আছে এক অদ্ভুত মায়াবী আলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগুনের উত্তাপে আলতোভাবে পাক হচ্ছে মশলাদার বার্বিকিউ। কাঠির একপ্রান্তে গেঁথে রাখা হয়েছে মুরগির রসালো টুকরোগুলো, আর সেগুলোর উপর দিয়ে ধোঁয়া উঠে মাংসের সুস্বাদু মিষ্টি ঝাঁজে সবার জিভে জল।
নোমান মাঝে মাঝেই সেগুলোকে উলটে পালটে দিচ্ছে।
মীরের গিটার টা হামদানের হাতে৷ মীরের নির্দেশে সে মৃদু, মিষ্টি সুরে গিটার বাজিয়ে চলেছে, তার সুরে সুরে গাছের ডালপালা গুলোও যেন দুলে উঠছে মৃদুমন্দ গতিতে।
গিটারের মিষ্টি সুরের সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার তীক্ষ্ণ আওয়াজ আর বনের ভেতরের অদ্ভুত সব প্রাণীর ডাক পুরো পরিবেশটাকে রহস্যময় করে তুলছে আরও।
চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজ গাছগাছালির ভেতর দিয়ে মৃদু হাওয়া বইছে যা আগুনের শিখাগুলোর সাথে মিশে শিখা গুলোকে করে তুলছে আরো বেশি লাস্যময়ী।
আর তার সাথে ক্ষণে ক্ষণে মিশে যাচ্ছে আনাবিয়ার খিলখিলে হাসি যা রেড জোনের গাছে গাছে প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে চলেছে কোনো এক অজানার উদ্দ্যেশ্যে।
আনাবিয়ার কলকলিয়ে বলা কথার ঝুড়ি ফুরিয়ে গেলো হঠাৎ। জায়ানের কোল ঘেঁষে বসে ও তাকিয়ে রইলো ঝলসানো মাংসটুকরো গুলোর দিকে।
পরিবেশ টা যেন হঠাৎই থমথমা হয়ে গেলো এই মেয়েটির নিশ্চুপতায়। নোমানের এতক্ষণের কাজ বন্ধ হয়ে গেলো হঠাৎ, হামদানও দ্বিধাভরা দৃষ্টিতে আনাবিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে থামিয়ে দিলো ওর গিটারের মৃদু শব্দ। নিরবতা টাই যেন এবার কানে বাড়ি খেতে শুরু করলো সবার।
পাশ বসা মীর ফোনের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চিন্তিত চোখে আনাবিয়ার দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“সব ঠিক আছে শিনু? তুমি চুপ হয়ে গেলে কেন?
” বার্বিকিউ কখন হবে? আমার ক্ষিদে পেয়েছে!”
মুখটা শুকনো করে অসহায় কন্ঠে শুধালো আনাবিয়া। মীর ওর ছোট্ট মুখ খানার দিকে চেয়ে স্নিগ্ধ হাসি দিলো। তারপর নোমানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই বসা থেকে উঠে অদূরে রাখা ব্যাগ পত্রের দিকে গেলো নোমান।
রাতের আটটা বাজলেই আনাবিয়ার ডিনারের অভ্যাস। রুটিনমাফিক খাওয়া দাওয়া, এর একটু এদিক ওদিক হলেই মীরের রাগ গিয়ে পড়ে নিরীহ ভৃত্য গুলোর ওপর। এই নিয়মের খুব কমই ব্যত্যয় ঘটে।
এখন রাতের দশটা, আনাবিয়ার খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে আরও দু ঘন্টা আগে৷
জঙ্গলের উদ্দেশ্যে প্রাসাদ থেকে বেরোনোর আগেই নোমান কে দিয়ে অল্প কিছু খাবার আনিয়ে রেখেছিলো মীর, যেন ওর শিনুর ক্ষিদে লাগলেই খেতে পারে৷
নোমান ব্যাগ থেকে একটা ছোট খাটো হিটকিপার কিচেন পট বের করে নিয়ে আসলো। মৃদু পায়ে হেটে এসে সেটার ঢাকনা খুলে রাখলো মীরের সামনে।
খাবারের সুস্বাদু সুগন্ধে পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো আনাবিয়ার, চকচকে চোখ জোড়া নিয়ে এগিয়ে এসে ও বসলো মীরের গা ঘেঁষে।
ওর লোভাতুর চোখ আর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজানো দেখে হাসলো মীর। পটের এক পাশ থেকে রুটি ছিড়ে অপর পাশে থাকা সবজি তুলে গালে তুলে দিলো আনাবিয়ার। আনাবিয়া রুটির টুকরোটা চিবোতে চিবোতে আদুরে তৃপ্তিতে চোখ বুজে নিলো।
মীর ওর ফোলা গালটা টিপে দিয়ে আর এক টুকরো রুটি ছিড়ে সবজি নিলো তার সাথে৷
পেছন থেকে জায়ান আর মীরের চোখাচোখি হলো। মীরের গোপন ইশারা পেতেই জায়ান আনাবিয়া কে উদ্দ্যেশ্য করে নরম কন্ঠে শুধালো,
“শেহজাদী, আপনি তো অনেক বড় হয়ে গেছেন। এবার কত বছরে পা দিবেন?”
জায়ানের প্রশ্ন টা কানে আসতেই রুটি চিবানো বন্ধ হয়ে গেলো আনাবিয়ার। চোখ মেলে তড়িৎ গতিতে জায়ানের দিকে ফিরে ভ্রুকুটি করলো ও৷ তারপর এক ঢোকে রুটিটা গিলে নিয়ে তেজি গলায় বলে উঠলো,
“কেন? তুমি জানো না?”
আনাবিয়ার তেজি রূপে থতমত খেলো জায়ান। দমে যাওয়া বাধা গলায় ও অপ্রস্তুত চোখে একবার তাকালো মীরের দিকে। মীর ঠোঁট টিপে হাসছে ওর ভয় পাওয়া দেখে। জায়ান অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
“ইয়ে, মানে….. আমি অবশ্যই জানি শেহজাদী, কেন জানবো না? আপনি কত বছরে পড়লেন সেটা না জানলে তো আমার গর্দান থাকবে না!”
“তাহলে জিজ্ঞেস করছো কেন? তুমি কি ভুলে গেছো চাচাজান? সত্যি করে বলো তো!”
চোখ জোড়াতে ক্রোধ এনে আগের থেকেও তেজি গলায় গর্জন করে উঠলো আনাবিয়া। জায়ান ওর ওই ক্রোধান্বিত দৃষ্টির সামনে মিইয়ে গেলো। দ্রুত গতিতে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না’ বুঝিয়ে বলে উঠলো,
“একদমই না শেহজাদী, আপনি তো এবার তেরো তে পড়েছেন।”
উত্তর শুনে আনাবিয়ার ক্রোধান্বিত দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো কিছুটা, তবুও জায়ানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও৷ আজ যদি জায়ান চাচাজান বলতো যে ওর বয়স তার মনে নেই তবে ও কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিতো নিশ্চিত।
জায়ানের দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে ও মীরের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে উঠলো,
“তুমি বসে আছো কেন? খাবার দাও!”
“ইয়েস ম্যাম”
বলে মীর আর এক টুকরো রুটি ছিড়ে সবজি মিশিয়ে আনাবিয়ার মুখে পুরে দিলো। আনাবিয়ার দৃষ্টির অগোচরে জায়ানের দিকে তাকালো একবার, বেচারা ভোতা মুখে বসে আছে।
মীর ঠোঁট কামড়ে গা কাঁপিয়ে হেসে উঠলো নিঃশব্দে। সতর্ক থাকলো যেন হাসির শব্দ টা ভুলেও বাইরে না যায়, বাঘিনী ক্ষেপে গেছে!
তার বয়স মনে রাখবে না তারই চাচাজান, এটা সে সহ্য করবে? কোনোদিনও না!
জায়ান এক পলক মীরের দিকে তাকিয়ে ওকে হাসতে দেখে অসহায় মুখে বসে রইলো।
মীরের আদেশেই ও আনাবিয়া কে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে রয়ে সয়ে কথা বলতে নিয়েছিলো। কিন্তু তার দফারফা হয়ে গেলো! আর এখন আদেশকর্তা নিজেই মজা নিচ্ছেন!
ধোঁয়া ওঠা, ঝলসানো মুরগীর মাংসের থেকে অল্প অল্প করে ছাড়িয়ে অল্প সল্প ফু দিয়ে ঠান্ডা করে একটু একটু করে আনাবিয়ার মুখে তুলে দিচ্ছে মীর। আনাবিয়া ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে দুর্বল ভঙ্গিতে মাংস চিবোচ্ছে। মাঝে মাঝে টাল খেয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছে। মীর মাংস রেখে এক হাতে ওকে টেনে এনে নিজের বুকের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে দিলো। আনাবিয়া মাথা ঠেকানোর স্থান পেয়ে আবেশে মীরের গায়ে লেপ্টে চোখ বুজে নিয়ে খাবার চিবোতে লাগলো। মীর তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
“খেয়ে ঘুমাও শিনু, এখনই ঘুমিয়ে পড়োনা। আর অল্প একটু খাও।”
মীর আর এক টুকরো মাংস নিয়ে অর্ধেক ঘুমিয়ে যাওয়া আনাবিয়ার বন্ধ ঠোঁটের কাছে নিয়ে ঘষাঘষি করলো, আনাবিয়া মুখটা খুললো অল্প, মীর তার ভেতর দিয়েই মাংসের টুকরোটা ঠেসে দিলো। আনাবিয়া চোখ বুজে তাই চিবোতে লাগলো।
মেয়েটার ঘুম আসছে, অথচ এখনো কত কিছু বাকি। মীর হামদান কে ইশারা করলো প্রাসাদে ফেরার প্রস্তুতি নিতে। মন খারাপ হয়ে গেলো সকলের। অন্যবার বার্বিকিউ পার্টিতে সারারাত ওদের কত গল্প আনন্দ হয়, কিন্তু এবার শেহজাদী ঘুমিয়ে পড়ছেন!
নোমান দুপুরের পর কতবার করে বলল শেহজাদীকে, যে শেহজাদী আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন, রাতে জাগতে হবে। কিন্তু শেহজাদী তার কথা শুনলে তো!
নিজের কামরা আর মীরের কামরা জুড়ে সারাদিন দৌড়ঝাপ করে বেড়িয়েছে, আর এখন ক্লান্তিতে ঘুম এসে যাচ্ছে তার।
জায়ান হামদান, নোমানদের নেমে যাওয়া চেহারা দেখে মীরের বুকে আধোঘুমে থাকা আনাবিয়ার কাছাকাছি এসে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, নোমান নাচবে বলছে। আপনি দেখবেন না?”
নোমানের নাচের কথা শুনে তড়াক করে উঠে বসলো আনাবিয়া। ঘুম ঘুম চোখ জোড়া সজাগ হয়ে গেলো ওর পুরোপুরি।
নোমানের ওদিকে মুখ নেমে গেলো! এত মানুষ থাকতে তাকেই চোখে পড়লো সাদি সাহেবের!
হামদান নোমানের পাশেই বসে ছিলো, নোমানের নেমে যাওয়া চোয়াল দেখে মুখে হাত দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করলো ও, কিন্তু পেরে দিলো না। শব্দ করে হেসে উঠলো। এক পলক বাদশাহর দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো তার মুড কেমন, হাসলে আবার উত্তম মধ্যম দেয় কিনা!
মীর নিজেই ঠোঁট টিপে হাসছে, সেটা দেখে হামদানের আরও হাসি পেলো।
নোমান কটমট করে তাকালো ওর দিকে। মনে মনে হামদান কে কয়েকটা গালাগাল করে ও অসহায় চোখে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, শেহজাদী তার মুখিয়ে আছে নাচ দেখার জন্য।
নোমান কে তখনও চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আনাবিয়া চোখ পাকিয়ে তেজি গলায় বলে উঠলো,
” কি হলো নোমান? নাচো না কেন?”
ওর কথার রেশ ধরে জায়ান হামদান সহ অন্যরাও নোমান কে তাড়া দিতে লাগলো,
“কিরে নোমান, উঠিস না কেন? তোকে কি কোলে করে উঠিয়ে দেওয়া লাগবেরে? শেহজাদী বলছেন শুনতে পাচ্ছিস না?”
হামদান চোখে হেসে বলে উঠলো। জায়ানও চাপা হেসে বলে উঠলো,
“নোমান তাড়াতাড়ি উঠো, শেহজাদীর কিন্তু ঘুম পেয়েছে!”
নোমান আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত উঠে দাড়ালো। নোমান উঠতেই হামদান হাততালি দিলো, অন্যদেরকেও গুতিয়ে গুতিয়ে হাত তালি দিয়ে বাধ্য করে নোমানের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“এইতো, গুড বয়, থোড়া থোড়া গার্ল।”
নোমান হামদানের দিকে একবার তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওকে মনে মনে ‘হামিদানিয়া-সাট্টাফানিয়া” বলে গালি দিয়ে নাচের প্রস্তুতি নিলো। হামদান ওপাশ থেকে মীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনুগত সুরে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি মিউজিক দিবো।”
মীর মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই হামদান ওর সেলফোন টা বের করে খুজে খুজে একটা বেলিড্যান্স এর মিউজিক লাগিয়ে দিলো, তারপর নোমান কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
“নোমান, কোমর দুলিয়ে না নাচলে তোমার নাচ গ্রহণযোগ্য হবে না।”
নোমান ওর দিকে তাকিয়ে মুখ বাকালো, তারপর শুরু করলো নাচ।
মেয়েলি স্বভাবের নোমানের এসব ভালোই লাগে। কোমরেও তার ভালোই তাল উঠে, মাঝে মাঝেই প্রাসাদের বিভিন্ন ইভেন্টে দাসীদের কে নাচের জন্য সে-ই প্রস্তুত করে, অনুশীলন করায়।
এসব হামদানের জানা ছিলো না। মিউজিকের তালে তালে নোমানের কোমর দোলানো দেখে হামদানের মুখ খানা হা হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্য চোখে সে এদিক ওদিক তাকালো আর কারো তার মতো অবস্থা হয়েছে কিনা দেখতে।
হ্যাঁ, হিজ ম্যাজেস্টি, জায়ান সাদী আর শেহজাদী ছাড়া সকলেরই চক্ষু ছানাবড়া।
নোমান নাচছে; হাতে, কোমরে, বুকে ঢেউ তুলে সে নাচছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই হামদান কে অস্বস্তিতে ফেলানোর জন্য চোখের অদ্ভুত ঢেউ খেলানো দৃষ্টি দিচ্ছে হামদানের দিকে। হামদান সেটা খেয়াল করে মনে মনে একবার আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে উঠলো।
আনাবিয়া হাসছে, নোমানের নাচ তার বরাবরই প্রিয়। হেব্বি সুন্দর নাচে। মাঝে মাঝে মীরের পেটে গুতা দিয়ে সে মীরের সাথে নোমানের নাচের ব্যাপারে গোপন আলোচনা করছে, মীরও সোৎসাহে সায় দিচ্ছে সেই আলোচনায়। জায়ান সহ অন্যরা মাঝে মাঝেই নৃত্যরত নোমানের উদ্দ্যেশ্যে কৌতুক পূর্ণ কন্ঠে বলে উঠছে, ‘বহত খুব, বহত খুব!” হামদানের পাশ থেকে অন্য একজন পকেট থেকে এক গোছা টাকা বের করে নোমানের দিকে ছুড়ে মেরে চাপা সুরে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
“নাচ শালা”
চাপা হাসির রোল পড়ে গেলো ওদের সকলের ভেতরে। আর নোমান ওদের কথা বার্তাকে পাত্তা না দিয়ে মুখ বেকিয়ে টাকা গুলো কুড়িয়ে নিলো আলগোছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর শেষ হলো নোমানের নাচ। সকলে হৈহৈ করে উঠে হাত তালি দিলো। নোমান লজ্জা লজ্জা ভাব করে এসে বসলো আবার নিজের জায়গায়। এমন সময় আনাবিয়া মীরের দিকে মুখ খানা পুরোপুরি তুলে বলে উঠলো,
“মীরি, আমরা আজ রাতে এখানেই ঘুমাই?”
মীর আনাবিয়াকে না বলতে যাচ্ছিলো, রাতের বেলা অজস্র পোকামাকড় ঘোরাঘুরি করে ঘাসের ভেতর দিয়ে, দুর্ঘটনা বসত একটা দুইটা আনাবিয়ার গায়ে উঠলে সে ভয়ে চিৎকার করে শিরো মিদোরি মাথায় তুলে ফেলবে৷
তাছাড়া শক্ত মাটির ওপর যতই নরম বিছানা করা হোক না কেন সেটা প্রাসাদের বিছানার মতো হবে না কখনোই। আনাবিয়া এখনো পর্যন্ত কোনোদিন ওর আর মীরের বিছানা ব্যাতিত অন্য কোথাও ঘুমায়নি।
এখন যদি হঠাৎ এই সম্পুর্ন নতুন পরিবেশে ঘুমিয়ে আনাবিয়ার শরীর খারাপ করে!
কিন্তু মীর একটি না বোধক শব্দ উচ্চারণ করার আগেই ওপাশ থেকে জায়ান ইতস্তত কন্ঠে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদী ঠিক বলেছেন। আমরা আজ রাত টা এখানেই কাটাতে পারি জঙ্গলের ভেতর। অনেক অনেক দিন হয়ে গেলো আমাদের রাত কাটানো হয়না বাইরে।”
ওপাশ থেকে নোমান হামদান সহ অন্যরাও আবদারে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে মীরের দিকে চেয়ে রইলো। মীর আর একবার আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে শুধালো,
“খুব শখ হচ্ছে এইখানে ঘুমানোর?”
“হু” বলে সোৎসাহে মাথা ঝাকালো আনাবিয়া। মীর ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
“ঠিক আছে, তোমার যখন এতই ইচ্ছা তখন আজকের রাত টা আমরা এখানেই ঘুমাবো।”
আনাবিয়া আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো। দ্রুতবেগে হামাগুড়ি দিয়ে জায়ানের কাছে গিয়ে জায়ান কে ধরে খুশির চোটে কয়েকটা ঝাকি দিলো।
জায়ান ভড়কালো, আনাবিয়ার ঝাকুনিতে বিদিখাস্তা অবস্থা হয়ে গেলো ওর। এই মেয়ের গায়ে যে শক্তি বাপরে বাপ! নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের ফিমেইল ভার্সন।
জায়ান কে উল্টেপাল্টে যেতে দেখে মীর হাসলো শব্দ করে তারপর বলল,
“অতিরিক্ত আনন্দ পেলে ম্যাম আশেপাশে যাকে পান তাকে ঝাকিয়ে দেন। আমি তো রোজ গেলে ঝাকি খাই। সেদিন হামদান কে ঝাকিয়েছে। গত পরশু নোমান কে।”
মীরের কথা শুনে আনাবিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাসলো হামদান।
তাদের শেহজাদী যেন আস্ত এক মায়ার খনি। আনাবিয়ার ছোট্ট বেলাটা থেকে বাদশাহর সাথে সাথে সেও ওই ছোট্ট মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে গেছে ভীষণ ভাবে। মিহি কন্ঠে যখন হামদান কে নাম ধরে ডাকে হামদানের বুকটাই ঠান্ডা হয়ে যায়, যেন শেহজাদী ওরই রক্তের কেউ, খুব খুব আপন কেউ!
ভাবনা থেকে ফিরে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হামদান আবার মনোযোগ দিলো জায়ান আর আনাবিয়ার খুনসুটির দিকে।
নোমান গেলো দেখতে সবার ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বিছানা আছে কিনা।
হিজ ম্যাজেস্টি বলে দিয়েছেন আনাবিয়ার জন্য বিশেষ ভাবে বিছানা তৈরি করতে যেন কোনোভাবেই মাটির দৃঢ়তা তাকে স্পর্শ করতে না পারে।
হঠাৎ করে এমন নতুন পরিবেশে শক্ত বিছানায় ঘুমালে শেহজাদী অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন৷ পর্যাপ্ত বিছানা না থাকলে প্রাসাদ থেকে নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করতে হবে শিগগিরই।
আনাবিয়া জায়ানের নিকট থেকে আবার মীরের কাছে ফিরে এসেছে। বর্তমানে মীরের বুকে ঠেস দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে নোমানের বিছানার বন্দোবস্ত করা দেখছে ও৷ মীরের দিকে মুখ উঁচিয়ে এক পলক তাকিয়ে ও আবদারের গলায় বলল,
“আমি কিন্তু তোমার কাছে ঘুমাবো মীরি!”
“না শিনু, তোমার জন্য আলাদা বিছানা হচ্ছে তুমি সেখানেই ঘুমাবে।”
“তুমি যদি আমাকে তোমার কাছে ঘুমাতে না দাও তবে আমি সারারাত জেগে থাকবো কিন্তু! আর নইলে মাটির ওপর গিয়ে ঘুমাবো, বিছনায় ঘুমাবো না। একদম সত্যি কথা।”
ঘাড় গুজে বুকে হাত বেধে রুক্ষ গলায় বলে উঠলো আনাবিয়া। মীর ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা। পুচকেটা জন্মের পর থেকে হুমকির ওপর রাখছে তাকে। এসব মানা যায় না।
“ঠিক আছে, আমার কাছেই ঘুমাইয়ো।”
হতাশ কন্ঠে বলে উঠলো মীর৷ আনাবিয়া নিজের আবদার টিকিয়ে রাখতে পেরে নাক কুচকে হিহি করে হাসলো। তারপর কাজ করতে থাকা নোমানের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই ও মীর কে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা মীরি, প্রাসাদের অন্দরমহলে তো ছেলেদের ঢোকা নিষেধ তাহলে নোমান কেন ঢোকে? ওকে কেউ কিছু বলে না কেন? ও-ও তো ছেলে।”
মীর কেশে উঠলো, জায়ান গোফের তলে হেসে মুখ লুকালো অন্য দিকে। বাকিরা চাপা সুরে হেসে উঠলো।
নোমান কাজ করতে করতে আনাবিয়ার প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো তারপর অসহায় মুখে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে।
হামদান ওদিক থেকে কোনোকিছু না ভেবেই ফট করে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, ও ছেলে কিন্তু ওর ইয়া নাই৷”
মীর হামদানের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ওর নাম ধরে ডেকে উঠলো,
“হামদান!”
“ক্ষ-ক্ষমা করবেন ইয়োর ম্যাজেস্টি, মুখ ফসকে বলে ফেলেছি!”
মাথা নিচু করে অপরাধী গলায় বলল হামদান৷ মীর চাপা হিসহিসে কন্ঠে ওর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“তোমাকে আমি পরে দেখে নিচ্ছি হামদান!”
এরপর আনাবিয়ার মুখ খানা ধরে আলতো করে দুলিয়ে দিয়ে বলল,
“নোমানকে অন্দরমহলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে শিনু, তাই ও যেতে পারে অন্যরা পারে না। ঠিক আছে?”
আনাবিয়া ওপর নিচে মাথা নাড়লো৷
নোমান আর অন্য কয়েকজন মিলে বিছানা করলো সবার জন্য। আনাবিয়া মীরের গায়ে নিজের শরীরটা এলিয়ে দিয়ে হাই তুলতে লাগলো থেকে থেকে।
কিন্তু বিছানায় যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে শুকিয়ে গেলো ওর মুখ খানা৷ ঠোঁট উলটে স্থীর হয়ে বসে রইলো ও।
আনাবিয়ার এমন শুকনো মুখ দেখে মীর ওকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে শিনু তোমার? কোনো অসুবিধা হলে বলো আমাকে!”
“হিসু লেগেছে!”
চোখের দৃষ্টি অসহায় করে উত্তর দিলো আনাবিয়া।
মীরের মাথা থেকে এ ব্যাপার টা একদমই আউট হয়ে গেছিলো। এইটা ও কিভাবে ভুলে গেলো যে আনাবিয়ার টয়লেটে যেতে হতে পারে!
এখন রাগ হচ্ছে ওর জায়ানের ওপর, কেন মেয়েটার সাথে মিলে এইখানে রাত কাটানোর বায়না ধরলো শয়তান টা! প্রাসাদ থেকে ওরা এখন অনেক অনেক খানি দূরে। এখন আনাবিয়া কে নিয়ে ওদিকে যাওয়ার সময় হবে না।
মীর প্রাসাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে প্রাসাদের বিপরীত দিকে তাকালো। ওদিকে অ্যানিম্যাল টাউন।
মীর হঠাৎ করেই দুহাতে তুলে নিলো আনাবিয়া কে, তারপর ওকে নিজের ঘাড়ের ওপর পা ঝুলিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ তোমাকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাবো শিনু। আমাকে ধরে রাখো শক্ত করে।”
আনাবিয়া মীরের ঘাড়ের ওপর বসেই দু হাতে মীরের গলা জড়িয়ে ধরলো। ও ঠিকঠাক ধরেছে কিনা সেটা পরখ করে নিয়েই দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে অ্যানিম্যাল টাউনের দিকে আগালো মীর।
শিরো মিদোরি জুড়ে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। আনাবিয়া অঝরে কান্না করে চলেছে নিজের কামরায়, ওর কান্নার শব্দে নিরব হয়ে গেছে প্রাসাদের আর সমস্ত শব্দ গুলো।
বেলিন্ডা হাতে একটা পোশাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনাবিয়ার পাশে, আনাবিয়াকে বাইরের পোশাকটা পরানোর জন্য প্রায় ঘন্টা ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে, কিন্তু আনাবিয়া কিছুতেই বাইরের পোশাক পরবে না। বিছানার এক কোণায় বসে উচ্চস্বরে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে ও৷
মীর থমথমে মুখে বসে আছে ওর কামরায়। ওর বিপরীতে জড়সড় হয়ে বসে আছে নওয়াস জাবিন আর তার ছেলে ফারিস।
ফারিস এই প্রথমবার শিরো মিদোরির প্রাসাদে এসেছে। এসে থেকেই সে বিস্মিত নয়নে দেখে চলেছে প্রাসাদটির চারপাশ। বর্তমানে তার আশেপাশে চলা থমথমে আবহাওয়াও তার কৌতুহলী চোখ দুটোকে থামাতে পারছে না।
নওয়াস কিছুক্ষণ চুপ থেকে অতঃপর মীরের উদ্দ্যেশ্যে গলা খাকারি দিয়ে ইতস্তত করে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদী যেভাবে কান্না করে চলেছেন তাতে তাঁকে এই অবস্থায় বাইরে পাঠানো কি ঠিক হবে? পরে একদিন না হয় বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠাবেন!”
মীর কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে বসে বসে ভাবছিলো। নওয়াসের কথায় মাথা তুলে তাকালো ও।
আনাবিয়ার কান্না এসে জোর কদমে বাড়ি খেয়ে চলেছে ওর বুকে, কিন্তু ও ওর সিদ্ধান্তে অটল। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ও উত্তর করলো,
“এছাড়া আর কোনো উপায় দেখিনা নওয়াস। প্রাসাদে রেখে ওকে অ্যাটিকেট শেখানো অসম্ভব ব্যাপার। ওকে ধৈর্য ধারণ করতে শিখতে হবে, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে; এভাবে মাথা গরম করে যাকে তাকে আঘাত করতে শিখলে ব্যাপারটা মোটেও ভালো হবে না!
যে মেয়েকে ও আঘাত করেছে তার কনুইয়ের জয়েন্ট খুলে গেছে। এখনো যন্ত্রণায় চিৎকার করে চলেছে মেয়েটা। দিনে দিনে শিনজো মিসানথ্রোপিস্ট হয়ে উঠছে, এভাবে চলতে দেওয়া যাবেনা। ওকে আত্মনিয়ন্ত্রণ শিখতে হবে, ভালো মন্দের ভেতর পার্থক্য করতে শিখতে হবে, যে কোনো মূল্যেই হোক।”
নওয়াস দ্রুত গতিতে মাথা ঝাকালো।
ওর ছেলে ফারিসের নিকট আনাবিয়ার সমস্ত দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ছেলেটার বয়স অল্প, সবেমাত্র কলেজে উঠেছে, বয়স এখন তার পঁচিশের কোঠায় কিন্তু চেহারায় দাঁড়ি গোফের কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। বাচ্চা বাচ্চা চেহারা৷
মীর ওকে শকুনি চোখে পরখ করলো কিছুক্ষণ, চেহারা জুড়ে ভদ্রতা ছাপানো। মীরের সামনে বসে আছে বলেই এই ভদ্রতা উঠে এসেছে, নাকি আসলেই ছেলেটা ভদ্র সেটা নিয়ে মীর সামান্য সন্দিহান।
আনুগত্যের সাথে আনত নয়নে মীরের টেবিলের স্বর্ণখচিত নকশা গুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে চলেছে সে৷
“ফারিস জাবিন”
মীরের মেঘের গর্জনের ন্যায় গুরুগম্ভীর কন্ঠে হঠাৎ নিজের নাম শুনে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো ফারিস। তারপর সামনে তাকিয়ে আমতা আমতা সুরে বলে উঠলো,
“ব-বলুন ইয়োর ম্যাজেস্টি”
“আমার শিনুকে আমি রয়্যাল মেম্বার হিসেবে সেখানে অ্যাডমিট করাতে চাইনা। একজন অর্ডিনারি স্টুডেন্ট হিসেবেই তাকে সেখানে থাকতে হবে। ওকে সাধারণের মাঝেই নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখতে হবে৷
তোমার দায়িত্ব শুধুমাত্র শিনুর খেয়াল রাখা, প্রতিমুহূর্তে তার বিহেভিয়ারল কান্ডিশানস অ্যান্ড আদার আপডেটস আমাকে সরাসরি ইনফর্ম করা এবং সে যেন নিজের বা অন্যদের কোনো ক্ষতি করে না বসে সেদিকে কড়া নজর রাখা৷ এর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে জানাবো।”
মীরের শেষোক্ত কথাগুলো ফারিসের আত্মসম্মানবোধে গিয়ে টোকা খেলো। হিজ ম্যাজেস্টি কি তাকে বিশ্বাস করতে পারছেননা এখনো! তাকে কি বখাটে চরিত্রের ভাবছেন? নাকি শুধুমাত্র নিজের ভবিষ্যৎ স্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে তিনি সন্দিহান?
ফারিস তার মাথায় চলা প্রশ্ন গুলোর কোনো ছায়া নিজের মুখের ওপর পড়তে দিলো না। মীরের কথায় সায় জানিয়া তড়িঘড়ি করে উত্তর করলো,
“অবশ্যই ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনি যা বলবেন তাই হবে।”
ওদের কথা শেষ হতে না হতেই পাশের কামরা থেকে কান্নার দমকে লাল হয়ে যাওয়া চোখ আর নাক নিয়ে দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো আলুথালুবেশী আনাবিয়া।
ভীষণ হাহাকারে বুকভরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এলোমেলো চুল গুলো দুলিয়ে ছুটে এসে মীরের নিকট এসে দাড়ালো ও, তারপর নিজের সর্বশেষ অবলম্বনকে আকড়ে ধরার ন্যায় মীরের কোমর জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠে ও বলল,
“আমি কোথাও যাবো না, আমি তোমার কাছে থাকবো মীরি! আমাকে ওখানে পাঠিয়ে দিও না, আমি আর এরকম করবো না প্রমিস করছি আমি ! তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না মীরি!”
আনাবিয়ার আর্তনাদ মীরের হৃদপিণ্ড ভেদ করে চলে গেলো যেন। কিন্তু মীর ওর অবস্থানে ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ়। আনাবিয়াকে এই মুহুর্তে প্রাসাদে রাখা আর ঠিক হবে না। বাইরেই পাঠিয়ে দিতে হবে, নইলে আনাবিয়াকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে বসা নওয়াস আর ফারিসকে নিজের স্বর্ণাভ দৃষ্টির তীক্ষ্ণ ইশারায় বাইরে যেতে নির্দেশ দিলো মীর।
মীরের আদেশ পেতেই ওরা দুজন দ্রুত গতিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে চলে গেলো।
আনাবিয়া শব্দ করে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে তখনো। মীর এবার মেঝে থেকে ওকে দুহাতে উঠিয়ে নিলো নিজের কোলের ওপর।
আনাবিয়া দুহাত মেলে মীরের চওড়া বুকটাকে জড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে মীরের বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলো। তারপর কাতর স্বরে মিনতিপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি আমাকে পাঠিওনা ওখানে, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা মীরি! তোমার জন্য পরাণ পুড়বে আমার! আমি আর কাউকে কখনোই আঘাত করবোনা, প্রমিস। তুমি এরকম কোরোনা আমার সাথে!”
মীর চুপ করে রইলো। আনাবিয়াকে কখনো কড়া কথা বলার বা ওকে শাসন করার মতো সক্ষমতা ওর হয়নি। আজও হচ্ছে না।
আনাবিয়াকে জোর দিয়ে কিছু বলতে গেলেই ভেতর থেকে কেউ যেন প্রস্তরকঠিন বাধা দিয়ে থমকে দিচ্ছে ওকে, বলে উঠছে, ‘সে তো তোমার পুরো পৃথিবী, তাকে তুমি কিভাবে আঘাত করতে পারো!’
নিরুপায় হয়ে তাই নিরাবতাকেই এই মুহুর্তে নিজের একমাত্র ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করতে শুরু করেছে ও।
আনাবিয়া ওর কোলে বসে তড়পাচ্ছে, কান্নাকাটি করতে করতে হাফিয়ে উঠেছে ও। কিছুতেই মীরকে ছেড়ে ও কুরো আহমারে বোর্ডিংয়ে যাবেনা।
অনেক অনেক ক্ষণ ধরে কান্না করার পর একসময় ক্লান্ত হয়ে গেলো আনাবিয়া। মীরের বুকে মাথা ঠেস দিয়ে মীরকে দুহাতে আকড়ে ধরে বসে রইলো ও।
এখন আর ওর কান্নায় শব্দ হচ্ছে না, শুধু ফুলে ফুলে উঠছে থেকে থেকে।
মীর এতক্ষণ ধরে একটা শব্দও করেনি, সামান্য নড়াচড়াও করেনি, স্থীর হয়ে বসে বসে আনাবিয়াকে পর্যবেক্ষণ করে গেছে সারাটাক্ষন।
এতক্ষণে মীর নড়লো, থুতনি ধরে নিজের বুকের ওপর থেকে আনাবিয়ার মুখটা উচু করে নিজের দিকে ফেরালো ও, চোখ জোড়া ভয়ানক লাল, নাকের ডগা লাল হয়ে ফুলে আছে, এখনো নিঃশব্দে ফুপিয়ে চলেছে ওর শিনজো।
মীর দৃষ্টি রাখলো আনাবিয়ার চোখের গভীরে, অতঃপর আনাবিয়ার কপালে ছোট্ট করে ঠোঁট স্পর্শ করে কোমল অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি শিনু, তোমাকে যেতেই হবে সেখানে। না বলার কোনো সুযোগ নেই আর।”
আনাবিয়া স্তব্ধ, বিস্মিত দৃষ্টিতে ওর মীরিকে দেখলো কিছুক্ষণ। মীরের চোখ মুখ নির্বিকার, সেখানে আনাবিয়ার আবদার অনুরোধ রাখার সামান্য সম্ভাবনাও আর বাকি নেই৷ সেখানে এখন এখন ভর করে আছে নিরাশা; কাকে নিয়ে? আনাবিয়া কে নিয়ে? আনাবিয়া কি তবে এখন আর মীরির আপন নেই? মীরি কি তবে ওকে নিজের থেকে সরিয়ে দিতে চায়? এই সামান্য কারণে? ওই সামান্য দাসীটার জন্য?
মুহুর্তেই মীরের চোখের ওপর থেকে দ্বিতীয়বার লোনা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠা দৃষ্টি জোড়া সরিয়ে নিলো আনাবিয়া, তারপর কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে ধীরে গতিতে নেমে গেলো মীরের কোল থেকে, নামার সময় মীরকে অবলম্বন হিসেবে ধরলোও না। নেমে গেলো ওভাবেই।
তারপর মেঝের দিকে চেয়ে ক্লান্ত পায়ে হেটে ও চলে গেলো নিজের কামরায়, ঝরঝরিয়ে কয়েক ফোটা নয়নবারি চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ওর চোখ থেকে, নিঃশব্দে। মেঝের ওপর ফোটায় ফোটায় পড়ে টুংটাং শব্দ করে উঠলো শুধু।
মীর দেখলো সব, কিন্তু নিজের মুখের দৃড়তার সামান্য পরিবর্তনও করলো না। দম ধরে ওভাবেই বসে রইলো নিজের আসনে।
বেলিন্ডাকে রুমের বাইরে বের করে দিয়ে আনাবিয়া তৈরি হলো নিজে নিজে, ব্যাগ গোছালো একা একাই, এলোমেলো চুলগুলো ওভাবেই বেধে ফেললো অপরিপক্ক হাতে; টু শব্দটি করলো না, কাঁদলোনা আর একটুও।
সমস্ত গোছগাছ শেষ করে ভারী ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাহিরের দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো ধীর পায়ে। তারপর দরজার সামনে অপেক্ষারত বেলিন্ডা আর নোমানকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বারান্দায় দাঁড়ানো নওয়াস আর ফারিসের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে দাড়ালো নওয়াস। চোখে পড়লো চোয়াল শক্ত করে কান্না চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকা আনাবিয়ার লাল হয়ে যাওয়া মুখ খানা।
নওয়াসের মায়া হলো প্রচন্ড। কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টির আদেশের ওপরে এখানে ওর কিছুই করার নেই।
মায়াভরা দৃষ্টিতে আনাবিয়ার ছোট্ট মুখখানার দিকে দৃষ্টি রেখে দু কদম এগিয়ে আনাবিয়ার সামনে এসে দাড়ালো ও।
বেলিন্ডা আনাবিয়ার পিছু পিছুই এসেছিলো। দ্রুতপায়ে আনাবিয়ার সামনে হাটু গেড়ে বসে ওর ফোলা গাল দুটো নিজের দুহাতে ভরে নিয়ে কান্না জড়ানো উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, আপনি সেখানে অনেক ভালো থাকবেন। অনেক বন্ধু হবে আপনার, খেলতে পারবেন তাদের সাথে। প্রাসাদের জন্য মন খারাপ করবেন না, কেমন? হিজ ম্যাজেস্টি আপনাকে আপনার ভালোর জন্যই সেখানে পাঠাচ্ছেন। সবসময় মনে রাখবেন উনি কখনো এমন কিছু করবেননা যাতে আপনার কোনো খারাপ হয়, কখনোই না! আপনি সেখানে গিয়ে দয়া করে কান্নাকাটি করবেননা শেহজাদী, শরীর খারাপ করবে তখন আপনার!”
আনাবিয়া কিছুই বললনা, ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে চেয়ে আস্তে করে বেলিন্ডার হাত খানা নিজের মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিলো। বেলিন্ডাকে বুঝিয়ে দিলো আজ থেকে সেও তাকে স্পর্শ করার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে।
তারপর নওয়াসের দিকে এক পলক তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
“চলো”
তারপরই ভারী ট্রলিব্যাগটা এক হাতে টেনে নিয়ে চলল সামনের দিকে, বেলিন্ডা ছুটে গিয়ে ওর হাত থেকে ট্রলিটা নিতে গেলো কিন্তু আনাবিয়া দিলো না। একাই টেনে নিয়ে চলল সামনে।
যাওয়ার আগে কামরায় ওকে বিদায় দেওয়ার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষারত মীরের সাথেও দেখা করলো না। একটাবার বললও না, ‘মীরি, তুমিতো আমাকে চলে যেতে বললে, দেখো এবার আমি সত্যিই চলে যাচ্ছি।’
বুক ভর্তি উথলে পড়ে যাওয়া অভিমান নিয়ে ধীর ভারী পায়ে রয়্যাল ফ্লোর থেকে নেমে গেলো ও।
নোমান ছুটে গিয়ে খবর দিলো মীর কে যে তার শিনু তার সাথে দেখা না করেই চলে যাচ্ছে৷ আনাবিয়ার অপেক্ষায় কপালে আঙুল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা মীর নোমানের কথা শুনে মুহুর্তেই চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে এলো বাইরে।
আনাবিয়া তখনি রয়্যাল ফ্লোর থেকে নিচে নেমে গেলো সিড়ি বেয়ে, মীর দ্রুত পায়ে আগালো সেদিকে, পেছন থেকে উচ্চস্বরে আনাবিয়াকে ডেকে উঠলো কয়েকবার, জোর গলায় বলে উঠলো,
“শিনু, দাড়াও! আমার সাথে কথা বলে যাও শিনু!”
কিন্তু শুনলোনা আনাবিয়া, পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলোওনা মীরের বিচ্ছেদযন্ত্রণায় পরিপূর্ণ মুখ খানা। মাথাটা নিচু করে কারো দিকে মুখ তুলে না তাকিয়ে সে হেটে চলল প্রাসাদের এক্সিটের দিকে৷
“অ্যাই মেয়ে, এত অল্প বয়সে তুমি চুলে রঙ করেছো কেন?”
কুরো আহমারের ইমপেরিয়াল ক্রেস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিশালাকার ডাইনিং রুমের এক কোণায় একা একা বসে খাবার খাচ্ছিলো আনাবিয়া। অবেলায় খেতে এসেছে ও, অন্য সবার খাওয়া শেষ। সবার সাথে বসে খাবার খাওয়ার অভ্যাস না থাকায় খাওয়ার সময় শেষে একা একাই খেতে বসেছে।
ডাইনিং এর খাবার ও শেষ, যেটুকু অবশিষ্ট ছিলো সেগুলোই কোনোরকমে প্লেটে তুলে এনেছে। কিন্তু খেতে গিয়ে খুব বেগ পেতে হচ্ছে ওর।
আজ পর্যন্ত কখনো নিজের হাতে খায়নি ও। মীর বা বেলিন্ডা যেকেউ একজন সবসময় খাইয়ে দিয়েছে ওকে। চামচটা ধরতে খুব অসুবিধা হচ্ছে, খাবার গুলোর একাংশ পড়ে যাচ্ছে ঠোঁটের কার্নিশ বেয়ে। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ও৷ সেই সময়েই পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠে এমন কথা শুনে ঘুরে তাকালো আনাবিয়া।
চোখে ওর কুচকুচে কালো রঙা লেন্স লাগানো, ঝকমকে দৃষ্টি ঢেকে দিয়ে আনাবিয়াকে ভ্রমরকৃষ্ণ নেত্রের অধিকারী করে দিয়েছে লেন্স জোড়া।
পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মেয়ে। মেয়ে দুটো টেন্থ গ্রেডের। আনাবিয়াকে ফারিস মীরের আদেশে ফিফথ গ্রেডে অ্যাডমিট করে দিয়েছে। সে হিসেবে এরা আনাবিয়ার থেকে বেশ অনেক খানিই সিনিয়র।
আনাবিয়া এখানে এসেছে আজ তিনদিন হয়ে গেলো, ফারিস ওকে স্কুলের সমস্ত নিয়ম কানুন বারবার করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আনাবিয়া বিনাবাক্যে সেগুলোকে অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব হিসেবে মস্তিষ্কে গেথে নিয়েছে।
অন্য বাচ্চাদের সাথে এক কামরায় থাকেছে, অন্য বাচ্চাদের সাথে একসাথে খাচ্ছে, বসছে। কত মেয়েরা এসে কৌতুহলী হয়ে ওর শুভ্র চুলগুলো একটু ধরে দেখেছে।
ফারিস প্রিন্সিপালকে পইপই করে বলে দিয়েছে যে আনাবিয়াকে যেন কেউ বেশি বিরক্ত না করে, ওর স্পর্শ পছন্দ নয়।
নওয়াস জাবিনের ছেলে ফারিস জাবিন এসে যখন কাউকে ভর্তি করিয়ে তার সম্পর্কে এত সতর্ক বানী দিয়ে গেছে তখন সে সাধারণ কেউ হবেনা ভেবে প্রিন্সিপালও ব্যাপার টা গুরুত্ব দিয়েছেন, অন্য বাচ্চাদের বলে দিয়েছেন যেন আনাবিয়াকে কেউ অযথা বিরক্ত না করে, অকারণে স্পর্শ না করে।
কিন্তু বাচ্চাদেরকে দিয়ে কথা শোনানো কঠিন। ওরা কেউ আনাবিয়ার চুল ধরছে, কেউ আনাবিয়ার ফোলা গাল টিপে দিচ্ছে, কেউ ওর হাত ধরে বসে থাকছে, কেউ বা বিস্মিত নেত্রে অপলকে তাকিয়ে থাকছে এই পুতুলের মতো মেয়েটির দিকে। সিনিয়র গ্রেডের ছেলেমেয়ে গুলোও উৎসুক চোখে বারবার দৃষ্টি দিয়ে চলেছে ফিফথ গ্রেডের দিকে, ফারিস জাবিনের সাথে সম্পর্কিত এই সাদা চুলের ভয়ঙ্কর সুন্দরী মেয়েটাকে নিয়ে তাদের কৌতুহলের শেষ নেই!
কিন্তু আনাবিয়া কাউকে কিছুই বলেনি, চুপ থেকেছে একদম। কাউকে মুখ ফুটে মানাও করেনি ওকে স্পর্শ করতে! যে কারণে জন্য ওকে প্রাসাদ ছাড়তে হয়েছে সেই কারণই ওর সাথে ঘটুক অহরহ, ও আর কাউকে কিছু বলবে না।
আনাবিয়া মেয়েদুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে এসবই ভেবে চলেছিলো। জীবনে প্রথমবারের মতো বাইরে থাকার এই স্বল্প, তিক্ত অভিজ্ঞতাতে ও সবকিছুর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে আপ্রাণ।
ওকে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েদুটোর ভেতরের ধারালো চেহারার মেয়েটা এগিয়ে এলো কিছুটা, তারপর আনাবিয়াকে আপাদমস্তক পরখ করে নিয়ে বলে উঠলো,
“চেহারা তো মাশাল্লাহ, আসতে না আসতেই কলেজের সমস্ত ছেলেদের নজর কেড়ে নিয়েছো। মাথাতেও কিছু রাখতে, এ জায়গাটা ফাকা রাখলে তো লোকজন এই মাশাল্লাহ চেহারা ছিড়ে খেয়ে ফেলবে। যেভাবে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছো তাতে এই ননীর মতো শরীরের কেউ কিছু করলে তো মুখ থেকে একটা শব্দও বের হবে না!”
“আমি চুলে রঙ করিনি।”
মেয়েটার দিকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রোবটের ন্যায় উত্তর করলো আনাবিয়া।
“আরেব্বাস, পুতুলের মুখে বুলিও ফোটে দেখি। সেটাও আবার শক্ত বুলি! তো তুমি কোন আয়ল্যান্ড থেকে এসেছো শুনি? নাম কি তোমার?”
আনাবিয়া চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। ফারিস ওকে ফেইক নেইক, ফেইক অ্যাড্রেস সব তৈরি করে দিয়ে গেছে।
কলেজের বোর্ডিংয়েই থাকে ফারিস। কিন্তু কলেজ আর স্কুলের বোর্ডিং ভিন্ন হওয়ায় কাটাতারের বেড়ার ওপাশে চলে গেছে ওরা।
আনাবিয়া এবার কাটাকাটা সুরে উত্তর দিলো,
” নূরিয়া তাজদিন, ওয়ারদিচা থেকে এসেছি।”
“তুমি তো দেখি ম্যানার্সও জানোনা, আমরা সিনিয়ররা যে কথা বলছি কিন্তু তোমার কন্ঠে কোনো নমনীয়তা নেই! ওয়ারদিচার মতো ফকিন্নি আইল্যান্ড থেকে আসলে তো এরকমই হবে! কিন্তু তোমার মতো একটা অসভ্য, আনকালচার্ড মেয়ের সাথে ফারিস জাবিনের কি সম্পর্ক? কি হয় সে তোমার?”
আনাবিয়ার দিকে আরও দুকদম এগিয়ে এসে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা।
“উনি আমার চাচাতো ভাই”
মেয়েটার চোখে চোখ রেখে উত্তর করলো আনবিয়া।
“সত্যিই চাচাতো ভাই? যদি তাই হয় তবে সে সারাক্ষণ তোমার এত কেয়ার করছে কেন? তুমি তো আর কচি খুকি নও, যে তোমার সবকিছু ট্যু দ্যা পয়েন্টে বুঝিয়ে দেওয়া লাগবে! সে সারাক্ষণ তোমার আশেপাশে থাকছে কেন? তোমার এত খবরদারী করছে কেন?”
“আমি ওনার বোন হই, তাই।”
“এখন থেকে ফারিস তোমার কোনো কিছু করে দিতে চাইলে তুমি সাফ সাফ মানা করে দিবে। বলবে তুমি একাই করে নিতে পারবে। হাতির মতো একটা মেয়ে, যার এখন সেভেন্থ এইটথ গ্রেডে থাকার কথা সে কিনা ফিফথ গ্রেডে এসে পড়েছে, আবার তাকে বাচ্চাদের মতো ট্রিটও করতে হয়! ন্যাকামি অন্য জায়গায় গিয়ে করবে, এখানে নয়।”
“আপনার এতে অসুবিধা হলে আপনি গিয়ে ফারিসকে বলে আসবেন, আমি পারবোনা।”
নির্বিকার কন্ঠে উত্তর দিয়ে আবার খেতে বসে গেলো আনাবিয়া। ধারালো চেহারার মেয়েটার পাশের মেয়েটা তার বান্ধবী কে খুচিয়ে বলল,
“এই তোকে কি বলল শুনলি! বলে আপনি গিয়ে বলে আসবেন!”
মেয়েটা আনাবিয়ার কথা শুনে শকে ছিলো। পুরো কলেজের ভেতর সবচেয়ে প্রভাবশালী স্টুডেন্টদের ভেতরে সে অন্যতম একজন। আজ পর্যন্ত তার সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলার মতো সাহস কারো হয়নি।
কলেজের ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের দশ সদস্যের ভেতর সে তৃতীয়, ফারিস ওদের লিডার। সেই ওর মুখের ওপর কিনা এই পুচকে মেয়েটা এত বড় কথা বলে!
মেয়টা এবার হঠাৎ করেই ক্ষেপে গেলো, শক্ত করে আনাবিয়ার বাহু ধরে এক ঝটকায় উঠিয়ে নিয়ে এলো চেয়ার থেকে। ধাক্কা লেগে আনাবিয়ার সামনের খাবারের প্লেটারটা এলোমেলো হয়ে এসে পড়লো ওর পোশাকে।
আনাবিয়া এক পলক নিজের নষ্ট হয়ে যাওয়া পোশাকের দিকে তাকিয়ে কঠিন দৃষ্টি দিলো মেয়েটার দিকে৷
আনাবিয়ার এমন দৃষ্টিতে মেয়েটা ভড়কালো সামান্য। কিন্তু সেটা আনাবিয়াকে বুঝতে দিলো না। আনাবিয়ার বাহু ধরে ঝাকি দিয়ে উঁচু গলায় বলে উঠলো,
“অ্যাই তুমি জানো তুমি কার সাথে কথা বলছো? সাফিয়া জাফর আমি, কুরো আহমারের দ্যা গ্রেট বিজনেসম্যান বাসির জাফরের একমাত্র মেয়ে আমি, ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশন তৃতীয় ক্ষমতাধর সদস্য আমি!
তুমি যদি ফারিস জাবিনের সাথে সম্পর্কিত না হতে তবে এখনি এক থাপ্পড়ে তোমার গালের দাঁত ফেলে দিতাম আমি, বুঝেছো?”
আনাবিয়া নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে রইলো সাফিয়া নামক মেয়েটার দিকে। এক ফাকে আবার একবার দেখে নিলো ওর নোংরা হয়ে যাওয়া পোশাকটা।
আনাবিয়ার এমন ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো সাফিয়ার। কোনো কিছু না ভেবেই নিজের ডান হাত টা গুলির বেগে হাওয়ায় উঠিয়ে ও চড় মারতে নিলো আনাবিয়ার চোয়ালে৷
“সাফিয়া জাফর!”
ফারিসের তেজি গমগমে কন্ঠে চমকালো সাফিয়া, হতভম্ব হয়ে তাকালো নিজের ডান দিকে। ভারী, দ্রুত পায়ে কঠিন মুখে এদিকে এগিয়ে আসছে ফারিস, চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে আছে ওর।
সাফিয়া হাত নামিয়ে নিলো দ্রুত। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চুপসে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। লম্বা চওড়া ফারিস এসে দাড়ালো সাফিয়ার একেবারেই সামনে,
“কি করতে যাচ্ছিলে তুমি? ওকে ওভাবে ধরে রেখেছো কেন? কি করেছে ও?
আর তোমাকে আমি বললাম প্রিন্সিপাল ম্যামের অফিসে যেতে সেখানে না গিয়ে তুমি এখানে কি করছো?”
দাঁতে দাঁত চেপে দৃঢ় গলায় বলল ফারিস। সাফিয়া কিছুক্ষণ আমতাআমতা করে উত্তর দিলো,
“ও আমার সাথে বেয়াদবি করেছে ক্যাপ্টেন!”
“কি বেয়াদবি করেছে প্রথম থেকে বলো, আমিও শুনতে চাই।”
সাফিয়া কি বলবে বুঝতে পারলো না, মাথা নত করে থম মেরে দাড়িয়ে রইলো চুপচাপ।
“এই মুহুর্তেই এখান থেকে প্রিন্সিপাল ম্যামের অফিসে যাও, তোমার সাথে আমি সেখানে গিয়ে কথা বলবো, ক্যুইক!”
ফারিসের বজ্রকঠিন কন্ঠে মিইয়ে গেলো সাফিয়া। আনাবিয়ার দিকে এক পলক কটমটে দৃষ্টি দিয়ে সাথের মেয়েটিকে ইশারা করে দ্রুত পায়ে হেটে সেখান থেকে প্রস্থান করলো সে।
ওরা চোখের আড়াল হতেই ফারিস এসে তড়িঘড়ি করে হাটু গেড়ে বসে পড়লো আনাবিয়ার সামনে,
“আপনি ঠিক আছেন শেহজাদী? ওরা কি আপনাকে ব্যাথা দিয়েছে? আপনি কোথাও ব্যাথা পেয়েছেন?”
ভ্রু জোড়া তুলে উদ্বেগ পূর্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ফারিস। শেহজাদীকে মেয়েরা একা পেয়ে উত্যক্ত করছে, এ কথা হিজ ম্যাজেস্টির কানে গেলে তো ও শেষ হয়ে যাবে! ওর তদারকিতে বাইরের মেয়েরা এসে শেহজাদীকে বিরক্ত করার সুযোগ কিভাবে পাচ্ছে!
“আমি ঠিক আছি রুশি ভাইয়া। ওরা কিছু করেনি, আপনি চিন্তা করবেন না।”
স্নিগ্ধ কন্ঠে উত্তর দিলো আনাবিয়া, যেন কিছুই হয়নি, এগুলো দৈনন্দিন ব্যাপার স্যাপার, এরকমটা ওর সাথে অহরহ হয়।
আনাবিয়ার পোশাকের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফারিস নরম কন্ঠে বলে উঠলো,
“রুমে গিয়ে দ্রুত পোশাকটা পাল্টে নিন শেহজাদী, বেশিক্ষণ এই পোশাকে থাকলে স্পাইস গুলোর কারণে আপনার স্কিনে র্যাশ উঠবে, এখনি চলে যান। আর আমি ওদের দেখে নিচ্ছি।”
“তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না রুশি ভাইয়া, ওদের কোনো দোষ নেই। আমি রুমে যাচ্ছি এখন, পোশাক বদলে আমাকে বিশ্রাম নিতে হবে নইলে সন্ধ্যা হতে না হতেই আমার ঘুম পাবে, পড়তে পারবোনা।”
শেষোক্ত কথাটা বলে ফারিশের দিকে একটা নিষ্পাপ হাসি ছুড়ে দিলো আনাবিয়া, বিনিময়ে ফারিসও মিষ্টি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে ওকে রুমে পাঠিয়ে দিলো ঝটপট, তারপর আনাবিয়ার ফেলে রেখে যাওয়া খাবারের প্লেট টা তুলে যথস্থানে রেখে চলে গেলো নিজের কাজে।
সাফিয়া আর তার বান্ধবী আড়াল থেকে এতক্ষন ওদের দুজনকেই লক্ষ্য করছিলো।
এখন মাথার তালু দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে সাফিয়ার, চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে রাগে লাল হতে শুরু করেছে নীলাভ চোখ জোড়া।
বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫+৬
ফারিস জাবিন কোনো মেয়ের সামনে হাটু গেড়ে বসতে পারেনা, কারো এতটা খেয়াল রাখতে পারে না, কোনো মতেই না! এসব শুধুমাত্র ওর পাওয়ার কথা, ফারিসের ওপর অধিকার শুধুমাত্র ওর।
এই আগুন সুন্দরীর নিকট থেকে ওকে নিস্তার পেতে হবে শিগগিরই!
