বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১+১২

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১+১২
রানী আমিনা

প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরে মীরের কামরার পাশের ছোট্ট সুন্দর কামরাটার ঝিনুক বিছানার ওপর কোলবালিশ জড়িয়ে চিৎপাত হয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে স্বল্পবসনে আবৃত আনাবিয়া।
ভোরের শিশিরে ধোয়া একটি দুর্লভ ফুলের মতো নির্মল, শুভ্র, আর অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারি সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া আনাবিয়ার দীর্ঘ দেহাবয়ব মসৃণ নদীর ধারের ন্যায় আঁকাবাঁকা ঢেউ তুলে লুটিয়ে আছে বিছানার ওপর, শরীরের প্রতিটি বাঁকে যার লুকিয়ে আছে রহস্য।

মসৃণ, প্রশস্ত, সুচিত্র উরুদ্বয়ের মাঝে অবহেলায় পড়ে আছে তুলতুলে কোলবালিশটা। সরু, সুকোমল, লতানো হাত জোড়ার একটি বিছানার ওপর বিছানো, অন্যটা জড়িয়ে আছে কোলবালিশের অগ্রভাগ।
সরু আঙুলগুলোর অগ্রভাগে ছড়িয়ে আছে গোলাপী আভা, মাঝে মাঝেই সুক্ষ্মভাবে নড়ে উঠছে শৈল্পিক আঙুলগুলোর অগ্রভাগ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পাশের জানালা দিয়ে প্রবেশ করা মৃদু বাতাস কামরার পর্দাগুলোয় আলোড়ন তুলছে ধীরে ধীরে। সূর্যের নরম, সোনালি আলো নকশাদার রেশমী পর্দার ফাঁক গলিয়ে এসে পড়েছে কামরার ভেতর।
একফালি রোদ এসে পড়লো আনাবিয়ার তুষার শুভ্র রঙা সরু, পাতলা কোমরের উপরিভাগে থাকা মসৃণ, স্নিগ্ধ, মেদহীন পেটের ওপর। গোধূলি বেলার সোনালি বালি মাখানো সমুদ্রতীরের ন্যায় চিকচিক করে উঠলো ওর কোমল উদরখানা।
আনাবিয়ার ঘুমন্ত মুখে চুম্বন এঁকে দিল মিষ্টি রোদের একাংশ। তীক্ষ্ণ ভ্রু জোড়া কুচকে উঠে জানান দিলো আনাবিয়ার ঘুমের ব্যাঘাতের।

ঘুমে বাধা পেয়ে বিছানার সাথে কিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করে অবশেষে চোখ মেলে তাকালো আনাবিয়া।
ঘুম ভাঙতেই মস্তিষ্কের ভেতর আলোড়িত হলো মীরের নামটা। চোখের ওপর ভেসে উঠলো মীরের সুদৃঢ় দীর্ঘাবয়ব।
সে কি এখন পাশের কামরায় উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে?
না, সে তো রোজ ভোর নামার আগেই কামরা ছেড়ে বেরিয়ে যায় নিজের কাজে। আনাবিয়াকে সময় দেওয়ার মতো ফুরসত তার মেলেই না!

একটা নিরব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অতঃপর ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসল আনাবিয়া। শুভ্র, দীর্ঘ কেশগুচ্ছ দুইটা হৃষ্টপুষ্ট বেণিতে আবদ্ধ, বুকের ওপর দিয়ে নেমে গেছে উরুর উপরিভাগে।
হাতজোড়া ওপর দিকে তুলে আড়মোড়া ভাঙলো আনাবিয়া। মস্তিষ্ক জুড়ে মীরের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ওর।
মীরের সাথে ওর এক অদ্ভুত দুরত্ব তৈরি হয়েছে বহুদিন ধরে, একটু একটু করে। মীর সমস্ত দিন কামরায় থাকেনা, ভোর হওয়ার আগেই বেরিয়ে যায় নিজের কাজে।

দুপুরের খাওয়াটা সপ্তাহের এক বা দুদিন প্রাসাদ করে আর বাকি সমস্ত দিন বাইরে, পারিষদ দের সাথে।
রাতের বেলা কামরাতেও ফেরে অনেক রাত করে। অধিকাংশ রাতেই ঘুমিয়ে থাকে আনাবিয়া, কারণ তাকে মীরের তৈরিকৃত কড়া রুটিনের ভেতরে থাকতে হয়, সময়ে খাওয়া সময়ে ঘুম।
গরমের ছুটির যে কয়টা দিন প্রাসাদে থাকবে সবগুলো দিন ওকে এই কড়া রুটিনেই পার করতে হবে৷ যার দরুন মীরের সাথে আজকাল ওর দেখা হয়না বললেই চলে।
কিন্তু মীরের মনোযোগের কখনো কোনো কমতি হয়না ওর প্রতি, হাজার কাজের ভিড়েও রোজ দুবার খোঁজ নিতে ভোলেনা।

বের হওয়ার আগে নোমান বেলিন্ডাকে কঠোর ভাবে বলে দিয়ে যায় আনাবিয়ার পরিপূর্ণ খেয়াল রাখতে, কারণ মেয়ে অনিয়ম করতে ভালোবাসে, আরও বেশি ভালোবাসে মীরকে জ্বালাতন করতে।
সে যখন তখন মুখ বেকিয়ে খাবারের পাত্র গুলো ঠেলে দিবে দূরে, তারপর আবার ব্যাস্ত হয়ে পড়বে নিজের বইপত্র গুলো নিয়ে। তাই খাওয়ার ব্যাপারে মীর আরও বেশি কঠোর।
আনাবিয়ার শরীর বাড়বে এখন, প্রচুর প্রচুর খাদ্যশক্তির প্রয়োজন ওর এখন, কিন্তু আনাবিয়ার সেসব দিকে খেয়াল নেই, ও ওর বইপত্রেই মত্ত।

ওর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা মীরের চিন্তাযুক্ত চেহারাটা কল্পনা করে স্নিগ্ধ হাসে আনাবিয়া।
আনাবিয়ার মনে এখন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব— মীরের প্রতি ওর অনুভূতিগুলো বিশুদ্ধ, কাঁচের মতো স্বচ্ছ, কিন্তু গভীর জলরাশির মতো রহস্যময়। সেগুলো নামহীন, অজ্ঞাতনামা; শূণ্যে বয়ে চলা বাতাসের মতো, যা অনুভব করা যায় কিন্তু ধরা যায় না।
শৈশব থেকে ওর মস্তিষ্কে গেথে গেছে ওই সুঠাম, দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ সুপুরুষ টি ওর ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী। জীবনসঙ্গী শব্দটা মস্তিষ্কে নড়ে উঠলেই আনাবিয়ার কিশোরী মনে তৈরি হয় এক অদ্ভুত আলোড়ন।
নিজের চতুর্দিকে মীরের নিরব উপস্থিতি সারাটাক্ষন ওকে দেয় এক নিবিড় সান্ত্বনা, অথচ একইসঙ্গে এনে দেয় অস্থিরতাও!

ওর কাছে মীর এক আদরসিক্ত আশ্রয়—যেখানে সে নিরাপদ, কিন্তু এই আশ্রয়ের অর্থ কী সেটা বুঝে উঠতে পারেনা আনাবিয়া; বুঝতে পারেনা মীর তার কাছে শুধুই একজন রক্ষক, নাকি কোনো বন্ধন যা মিশে গেছে ওর হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের সঙ্গে
অথচ মীরকে দেখে সর্বদাই থমকে যায় ওর সময়। ওর চোখে মীর এক মহীরুহ—অপরাজেয়, দৃঢ়, অথচ নীরব কোমলতায় ভরা।
মীরের উপস্থিতি প্রতিমুহূর্তে ওর হৃদয়ে তোলে এক অদ্ভুত সুর; কোনো অজানা গীত যা শুধু ও-ই শুনতে পায়।
মীরের কণ্ঠনিঃসৃত গভীর স্বরে আনাবিয়া হারিয়ে ফেলে নিজের সত্তা, অথচ প্রতিবারই আবার নিজেকে খুঁজে পায় নতুন করে!
মস্তিষ্ক জুড়ে মীরের বিচরণ ঘটাতে ঘটাতে চকিতে, নিজের অজান্তেই একবার দৃষ্টি দিলো মীর আর তার কামরার সংযোগ ঘটানো দরজার দিকে। কিঞ্চিৎ খোলা দরজাটার দিকে তাকিয়ে ভ্রুজোড়া সন্দিহান ভঙ্গিতে কুচকে গেলো সামান্য।

ঘুমানোর সময়ে তো দরজাটা দেওয়াই ছিলো, তাহলে?
এদিক ওদিক নজর ফেরাতেই দৃষ্টি আটকালো বিছানার পাশে থাকা সাইড টেবিলের ওপর।
মীরের ব্যাক্তিগত নোটবুকের আভিজাত্যপূর্ণ পাতা গুলোর একটার ছোট্ট টুকরো ঠেস দিয়ে রাখা টেবিল ল্যাম্পের গায়ে। তাতে মীরের হস্তাক্ষরে লেখা কোনো অজানা বার্তা।
চমকালো আনাবিয়া, মীর ওর কামরায় কখন এসেছিলো? ও তো একটুও টের পায়নি!
তড়িতে একবার নিজের দিকে তাকালো ও৷ লেট্যুস কাটের একটা স্লিভলেস টপ আর শর্টস পরা ওর; পেট, উরু, হাত সবকিছুই উন্মুক্ত।
ঘুমানোর সময় গায়ের ওপর চাদর ছিলো ঠিকই কিন্তু ঘুমের ঘোরে তার বিছানা ভ্রমণের বাজে অভ্যাসে চাদরটা অবহেলায় পড়ে আছে মেঝেতে।
এই এলোমেলো অবস্থাতে কি তবে মীর ওকে দেখে গেছে? ছিঃ ছিঃ! চোয়াল জোড়া লজ্জায় লাল হয়ে গেলো আনাবিয়ার।

শরীরটা এখনো অপরিপক্ক, সেখানে বয়োঃপ্রাপ্তির সামান্য আভাস দেখা যাচ্ছে আজকাল, কিন্তু সেগুলো আহামরি কিছু নয়। তবুও মীর যে তাকে এমন অগোছালো অনাবৃত অবস্থায় দেখে ফেলেছে সেটা ভেবেই কান গরম হয়ে যাচ্ছে ওর।
সাইড টেবিলের ওপর থাকা চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে তার ভেতরে থাকা বার্তাটা ঠিক কি হতে পারে সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ আকাশকুসুম জল্পনা কল্পনা করে দুরুদুরু বুকে চিরকুটটা হাতে নিলো আনাবিয়া। প্রথম ভাজটা খুলতেই চোখের ওপর ভেসে উঠলো মীরের তীক্ষ্ণ, শৃঙ্খলাবদ্ধ হস্তাক্ষরে লেখা নির্দেশ সমূহ,

“ঘড়ির কাটা আট বেজে ত্রিশ পেরোনোর আগেই ব্রেকফাস্ট কম্পলিট করবে। দশ বাজলে টেইলর আসবে, কোনো বাহানা করবেনা, গুড গার্লের মতো ওদেরকে ওদের কাজ করতে দেবে। বেলিন্ডা থাকবে সাথে, ন্যো ওয়্যারিজ ওকে? অ্যান্ড লাস্টলি, ম্যেইক অ্যা উইশ; আ’ম হেয়ার ট্যু ফুলফ্যিল অল অব মা’ শিনজো’জ উইশেশ!”
হতাশ হলো আনাবিয়া, ভেবেছিলো হয়তো মীর তার আজ কোনো ভালোবাসার কথা লিখে রেখে গেছে! কিন্তু নাহ, তিনিতো সময় বেধে টাস্ক দিয়ে গেছেন। আর এখন বাধ্য মেয়ের মতো আনাবিয়াকে টাস্ক গুলো পূরন করতে হবে! উফফ!

অসন্তোষে মনটা ছেয়ে গেলেও পরক্ষণেই আলতো হাসলো আনাবিয়া, ওর চারদিকে মীর; সামনে, পেছনে, ডানে, বায়ে যেদিকেই তাকায় সেদিকেই মীর। মীর ছাড়া ওর পক্ষে একপা আগানোও যেন কোনো অসম্ভব ব্যাপার! জীবনের উনিশটা বছর কেটে গেলো এই লোকটার আদুরে ছায়াতলে।
ঠোঁট কামড়ে হেসে চিরকুটটা সযত্নে ভাজ করে হাতের মুঠিতে ধরে বিছানা ছাড়লো আনাবিয়া। কামরার ডানে থাকা ওয়াল আলমিরার ভেতর থেকে বের করলো নিজের ব্যাক্তিগত ডায়েরি খানা।
ডার্ক পার্পলের ওপর সিলভারের সুক্ষ্ম কারুকার্য শোভিত ডায়েরি টার ওপরে রূপালী অক্ষরে বড়ো বড় করে লেখা,
‘দ্যা ডন অব অ্যান এপিক’।

মীরের দেওয়া ডায়েরি খানা খুলে ভাজ করা চিরকুটটা সযত্নে রেখে দিলো মখমলি পাতার ভাজে। ডায়েরির প্রায় পুরোটা জুড়েই এত যাবৎকাল মীরের দেওয়া সমস্ত ছোট্ট ছোট্ট চিরকুটে ভর্তি, আর নরম পৃষ্ঠা গুলো ভর্তি মীরের আর ওর প্রতিটি মিষ্টি মুহুর্ত দিয়ে।
ডায়েরীটা যথাস্থানে রেখে আনাবিয়া এসে বসলো বিছানায়।
আজকের উইশ! লোকটা ওকে সময় দিচ্ছেনা, ওর থেকে কেমন যেন দুরত্ব বজায় রেখে চলছে ইচ্ছা করেই। পাঁচ বছর আগে সেই যে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো, সমস্ত সময়টুকু নিজের বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ করে রেখেছিলো তারপর থেকে মানুষটা ওর সাথে দুরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠিক কি কারণে মীরের এমন আচরণ সেটা জানেনা ও৷
উইশ নিয়ে কিছুক্ষণ মাথা খাটাতেই দুষ্টু হাসিতে প্রসারিত হলো আনাবিয়ার টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়া। বিছানার অন্য প্রান্ত থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে মীরের উদ্দ্যেশ্যে বার্তা লিখতে বসলো ও, দ্রুত হাতে টাইপ করলো,
“ব্রেকফাস্টটা তোমার হাতে করতে চাই”

সেন্ড বাটনে চাপ দিয়েই পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠলো ও। ব্যাডাকে আজ জব্দ করা যাবে।
আটটা বেজে ত্রিশের আগে ব্রেকফাস্ট করে নিতে বলেছে, এখন বাজে সাতটা তেপ্পান্ন।
মীর প্রাসাদে নেই, আশেপাশে থাকলে চিরকুট রেখে যেতোনা। দূরেই গেছে, এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে গেছে। আজ ব্রেকফাস্ট না করলেও চলবে এবং মীর কিছু বললে সম্পুর্ন দোষটা ওর ঘাড়ে দুড়ুম করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে, হি হি!
দাঁত কেলিয়ে হেসে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল আনাবিয়া। দূরের পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের নরম আলো এসে পড়েছে। সেদিকে চেয়ে মন ওর মীরের সেই কালো-সোনালি আভায় জ্বলজ্বল করা অবয়বকে এঁকে ফেলল কল্পনায়!
ওই ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল, পর্বতের ন্যায় অটল, সুঠাম পুরুষটিকে কল্পনা করা মাত্রই বুকের ভেতর রক্ত ছলকে উঠলো ওর, শরীরজুড়ে খেলে গেলো অদ্ভুত শিহরণ, কানের কাছে যেন ফিসফিসিয়ে উঠলো মীরের পুরুষালি কণ্ঠনিঃসৃত গভীর স্বর! মুহুর্তেই শিড়দাড়া বেয়ে নেমে গেলো এক শীতল অনুভূতি!
আবেশে চোখজোড়া বুজে নিলো আনাবিয়া, মনের গহীনে অবস্থিত মীরের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“দূরে থেকেও জালাচ্ছো, পাগল বানিয়েই ছাড়বে আমাকে নিশ্চিত। এসবের প্রতিশোধ নিবো একদিন। প্রস্তুত থেকো মীরি!”
ঠোঁট কামড়ে হেসে জানালা থেকে সরে এসে ওয়াশরুমে ঢুকলো ও।

গায়ে একটা বাথরোব জড়িয়ে, ভেজা চুল গুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে দীর্ঘসময় বাদে ওয়াশরুম থেকে বের হলো আনাবিয়া।
মেঝেতে আসন করে খাবারের থালা সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে বেলিন্ডা। দেমিয়ান রীতি অনুযায়ী প্রাসাদে এখনো মেঝেতে বসেই খাবার খায় ওরা। মীর রাজপরিবারের রীতিনীতি, ঐতিহ্য এসবের ব্যাতিক্রমে যেতে চায়না কখনো, এগুলো ও খুব মানে।
বিছানার ওপর থেকে বেলিন্ডার বের করে রাখা পোশাকগুলো পরে নিতে নিতে বেলিন্ডার উদ্দ্যেশ্যে ও বলল,

“এখন খাবোনা বেলা, একেবারে দুপুরে খাবো। ওগুলো তুমি নিয়ে যাও।”
“ হিজ ম্যাজেস্টি আপনার জন্য কামরায় অপেক্ষা করছেন শেহজাদী! আপনি ওয়াশরুম থেকে বের হলেই তাঁকে জানাতে বলেছেন।”
অর্ধনগ্ন আনাবিয়া পোশাক পরিধান ছেড়ে চমকে তাকালো বেলিন্ডার দিকে। মীর তবে ফিরেছে প্রাসাদে!
দ্রুত হাতে বাকি থাকা পোশাক পরতে পরতে ও শুধালো,
“কোথায় গেছিলো ও জানো?”
“জ্বি শেহজাদী, ভোরে উনি রামাদিসামার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন।”
“শীট”

শিরো মিদোরি থেকে প্রায় সতেরোশো কিলো দূরে অবস্থিত রামাদিসামা, সেখানে পঞ্চদ্বীপের সেনাঘাটি। মীর তবে সেখানেই যাচ্ছিলো! ও কি মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে? না কি করেছে?
দ্রুত পোশাক পরা শেষ করে তোয়ালেটা আবার হাতে নিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে তড়িঘড়ি করে মীরের কামরার দরজার নিকট যেতে নিলো আনাবিয়া। কিন্তু তাড়াহুড়োয় পা বেধে গেলো কার্পেটের সাথে। দুড়ুম করে মেঝের সাথে আছাড় খেতে নিলো আনাবিয়া।
কিন্তু মেঝেতে পড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ঝড়ের গতিতে কেউ এসে নিজের ইস্পাত-দৃঢ়, পেশিবহুল দুহাতে আগলে নিলো ওকে, অতঃপর আবদ্ধ করলো তার বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনীর মাঝে। তারপর স্নিগ্ধ, শক্তিশালী কন্ঠে বলে উঠলো,
“ধীরে, ধীরে চলুন ম্যাম। তাড়াহুড়ো করতে কেউ বলেনি আপনাকে।”

মীরকে কামরায় ঢুকতে দেখে ওদিক থেকে বেলিন্ডা দ্রুত পায়ে সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেলো বাইরে।
মীরের কথা শুনে মীরের বুকের ওপর আছড়ে পড়া মাথাটা তুলে আনাবিয়া তাকালো মীরের দিকে। ভেজা চুলগুলো মুখের ওপর এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মীর এক হাতে চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে কানের পাশে গুজে দিয়ে আনাবিয়ার দৃষ্টির গভীরে নজর ফেলে মোহনীয় গলায় বলল,
“চেষ্টা করতে থাকো আমাকে হারিয়ে দেওয়ার, পেরে দিবেনা কখনো লিখে রাখো। নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানকে হারানো অতটা সহজ নয়। খাবে চলো। ”
আনাবিয়াকে নিজের আলিঙ্গন থেকে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে পাতা নকশাদার চাদরের ওপর সাজানো খাবারের দিকে এগোলো মীর।
আনাবিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা, বুকের ভেতর উড়ছে হাজারো প্রজাপতি! দিশাহীন অনুভূতিতে ছয়ে গেছে ওর সমস্ত শরীর! সময়ের গণ্ডি মিশে গিয়ে শুরু হয়েছে এক নতুন অধ্যায়ের।
কি ছিলো এটা!

মেঝের ওপর বসে মীর দ্বিতীয়বার খাওয়ার জন্য তাড়া দিলো ওকে। কিন্তু পাজোড়া যেন আটকে গেছে মেঝেতে! গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।
ভেতরকার লাজে কাঁপা উত্তেজনা আর অবাক অনুভূতি গুলোকে একত্রিত করে মনের মধ্যে আটকে রেখে ধীর পায়ে আনত দৃষ্টিতে ও এগোলো মীরের দিকে। তারপর বসলো মীরের বিপরীতে।
ওর চুপসে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠলো মীর, হাত বাড়িয়ে তর্জনি আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে আনাবিয়ার থুতনি ধরে চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে আমার শিনজোর, শরীর ঠিক আছে তো তোমার? মুখটা এমন লাগছে কেন?”
আনাবিয়া তড়িতে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো তার কিছুই হয়নি। তারপর একটা ঢোক গিলে মুখে বলল,
“এ-এমনি এমন লাগছে।”

“দ্রুত খেয়ে নাও, আমাকে আবার বেরোতে হবে। কাজ আছে অনেক, দুদিনের আগে ফিরবোনা।”
আনবিয়ার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল মীর। মীরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখে খাবার নিলো আনাবিয়া। ওর পলকহীন দৃষ্টি খেয়াল করে মীর ভ্রু তুলে বলে উঠলো,
“আমাকে দেখার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে, এখন মনযোগ দিয়ে খাওয়া শেষ করো।”
আনাবিয়া চোখ নামিয়ে নিলো মুহুর্তেই, লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো ওর চোয়াল জোড়া। ওকে হঠাৎ এমন লাজুক হয়ে যেতে দেখে ওর লজ্জার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে এবার শব্দ করে স্নিগ্ধ হাসলো মীর।

গরমের ছুটি শেষ। আনাবিয়াকে আবার ফিরতে হবে ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টে। বর্তমানে টেন্থ গ্রেডে আছে ও। ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের প্রধানের আসনে বর্তমানে বসে আছে সে নিজেই।
ফারিশ অনেক আগেই কলেজ পেরিয়ে চলে গেছে ভার্সিটিতে। প্রায়ই ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টে আনাবিয়ার সাথে দেখা করতে আসে ও।
এই কয়েক বছরে ফারিশের সাথে দারুণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওর। বড় ভাইয়ের মতো সর্বদা সবখানে ফারিশ থেকেছে ওর সাথে, ওর খেয়াল রেখেছে টুকটাক।

মীর যদিও ওকে খুব একটা পছন্দ করে বলে মনে হয়না, ওকে দেখা মাত্রই মীরের দৃষ্টি পরিবর্তন হয়ে যায়, কাঠিন্য এসে ভর করে ওর চোখে। ওর দৃষ্টির সামনে কোনো অজানা কারণে একটু বেশিই মিইয়ে থাকে ফারিশ।
আগামীকাল রাতে প্রাসাদ ছেড়ে কুরো আহমারের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিবে ও। মীর গিয়ে দিয়ে আসবে। দিনের বেলা মীরের সময় হবেনা, তাছাড়া হঠাৎ শহরের ওপর ওর গাড়ি দেখা গেলে জনমনে আতঙ্ক বয়ে যাবে।

এদিকে আনাবিয়াও মীরের সাথে যাবে বলে জেদ ধরে আছে। তাই রাত্রে বের হয়ে আনাবিয়াকে রেখে আসবে ও৷
দুপুর বেলা গোসলের জন্য ওয়াশরুমে ঢুকলো আনাবিয়া। বেলিন্ডা এসে আগেই ওর জন্য বাথটাব প্রস্তুত করে রেখে গেছে। গোসলের পর পরিধানের জন্য পোশাক নিয়ে আসতে গেছে বাইরে, রয়্যাল টেইলর্স দের থেকে।
পরণের পোশাক গুলো একে একে শরীর থেকে খুলতে খুলতে গোলাপ জল আর সুগন্ধি তেল মিশ্রিত নীল রঙা ফেনা তোলা পানির ভেতর গোলাপ, জুঁই এবং লিলির ভেসে বেড়ানো সাদা পাপড়ি সমৃদ্ধ বাথটাবের দিকে তাকালো ও৷
এমন সময় শব্দ করে খুলে গেলো ওর ওয়াশরুমের দরজা, ভেতরে নরম পদক্ষেপে প্রবেশ করলো কেউ।
আনাবিয়া সেদিকে না তাকিয়েই আগন্তুকের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,

“পোশাক রেখে আমাকে কিছু ফল কেটে দিয়ে যাও বেলা। আর বাইরেই থেকো, আমার তোমাকে প্রয়োজন হতে পারে।”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালো আনাবিয়া। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নতুন মেয়ে। এর আগে কখনো এদিকে একে দেখেনি ও।
মেয়েটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে। মুখখানা কিঞ্চিৎ খুলে আছে তার। হাতে আনাবিয়ার সদ্য তৈরি পোশাক।
বিরক্ত হলো আনাবিয়া, বেলিন্ডাকে কতবার করে বলেছে নতুন কাউকে যেন ওর কামরায় কোনো ভাবেই না পাঠায়। কিন্তু বয়স হচ্ছে বেলার, আজকাল কথা শুনলেও মনে রাখতে পারছেনা।
আনাবিয়া ওকে চাইলেও বাদ দিতে পারেনা, ছোটবেলা থেকে যে ওর কাছেই বড় হয়েছে। মাতৃস্নেহের অভাব বেলিন্ডাই পূরণ করেছে ওর।

ওর প্রতি এক অদ্ভুত মমতা কাজ করে আনাবিয়ার, এই যে কথা বুঝেনা ভালোভাবে, যখন তখন ভুলে যায় সবকিছু, একটা করতে বললে আর একটা করে বসে তবুও আনাবিয়ার ওকেই ভালো লাগে।
মেয়েটার দিকে এক পলক তাকিয়ে পোশাকগুলো রেখে বাইরে যেতে বলল আনাবিয়া।
মেয়েটা অবাক চোখে তখনো দেখে চলেছে আনাবিয়াকে। আনাবিয়ার আদেশ পেয়ে পোশাক গুলো নির্দিষ্ট স্থানে রেখে যাওয়ার জনা পা বাড়ালো ও।
আনাবিয়া শরীরের বাকি পোশাকগুলো খুলে রেখে নেমে পড়লো বাথটাবের ভেতর, ডুবিয়ে দিলো আবক্ষ।
মেয়েটি গিয়েও যাচ্ছেনা দেখে আনাবিয়া বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,

“ বাইরে গিয়ে বেলা কে পাঠিয়ে দাও।”
“শেহজাদী, বেলিন্ডা ব্যাস্ত আছেন, আজ আমি আপনাকে গোসলে সাহায্য করে দিই?”
আনুগত্যের সাথে আবদারের সুরে বলে উঠলো মেয়েটা।
আনাবিয়া চোখ জোড়া বন্ধ করে নিয়ে শরীরে ঠান্ডা পানির স্পর্শ অনুভব করতে করতে বলল,
“ প্রয়োজন নেই, বেলিন্ডাকে দ্রুত আসতে বলো।”
কিন্তু সেই মুহুর্তেই, আকস্মিকভাবে নিজের শরীরের উর্ধাংশে কারো হাতের অসংযত স্পর্শ টের পেলো আনাবিয়া!

ঝড়ের গতিতে এসে বজ্রাঘাতের ন্যায় আনাবিয়ার কামরার দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো মীর। ভ্রু জোড়া কুচকে আছে ভীষণ ক্রোধে, ধারালো চোয়াল জোড়া হয়ে আছে ইস্পাত-দৃঢ়, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ!
ওকে দেখা মাত্রই বেলিন্ডার বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ ভীত কপোতীর ন্যায় তিরতির কাঁপতে থাকা আনাবিয়া কেঁদে উঠলো ফুপিয়ে৷ শরীর ভেজা, গায়ে থাকা বাথরোবের ওপর বেলিন্ডা চড়িয়ে দিয়েছে আর একটা ঢোলাঢালা পুরু কাপড়ের রোব।

দ্রুত, শঙ্কিত পায়ে ছুটে এসে ওর সামনে হাটু মুড়ে বসে পড়লো মীর, ও বসা মাত্রই বেলিন্ডার আলিঙ্গন ছেড়ে আনবিয়া ঝাপিয়ে পড়লো মীরের বুকের ভেতর! ওর অসহায় আর্তনাদে ভারী হয়ে এলো কামরার স্তব্ধ পরিবেশ।
কান্নাজড়ানো অস্ফুটস্বরে ও বলে উঠলো,
“ বাইরে নিয়ে চলো আমাকে! আমার দমবন্ধ লাগছে এখানে, বাইরে নিয়ে চলো আমাকে!”
আনাবিয়ার কথা শেষ না হতেই ওপাশ থেকে নোমানের শক্তহাতের তলায় মেঝেতে চেপে থাকা, ডান হাতের কব্জির নিকট থেকে মুচড়ে, ভেঙে অন্যদিকে চলে যাওয়া, আনাবিয়ার পোশাক নিয়ে আসা মেয়েটা অপরাধী গলায় উচ্চস্বরে কেঁদে মিনতিপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,

“ইয়োর ম্যাজেস্টি ক্ষমা করুন আমাকে আমি ভুল করে ফেলেছি! আমি জানিনা আমার কি হয়েছিলো, আমি হুশ হারিয়ে ফেলেছিলাম! দয়া করে ছেড়ে দিন আমাকে, ক্ষমা করুন, দয়া করুন!”
মীর ঘৃণাভরে তাকালো মেয়েটির দিকে, পরক্ষণেই চোখের দৃষ্টি কঠোর হয়ে উঠলো ওর। মেয়েটির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেঝেতে ওকে ঠেসে রাখা নোমানের দিকে নিজের অগ্নি দৃষ্টি ফেললো মীর।
মীরের ক্রোধে পরিপূর্ণ আদেশসূচক ইশারা পাওয়া মাত্রই নোমান ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে থাকা মেয়েটিকে এক ঝটকায় মেঝে থেকে টান দিয়ে, ঘেষতে ঘেষতে নিয়ে গেলো বাইরে।

দরজার বাইরে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা হামদানের নিকট হস্তান্তর করলো মেয়েটিকে, আর হামদান তার লোকবলের সাহায্যে মেয়েটিকে নিয়ে আগালো প্রাসাদের বেইজমেন্টের দিকে!
বেলিন্ডা দ্রুত পায়ে উঠে একটা পুরু চাদর এনে জড়িয়ে দিলো আনাবিয়ার গায়ে, সেই মুহুর্তেই মীর ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে উঠে গেলো কামরার বেলকনির নিকট, তারপর সুউচ্চ বেলকনি থেকে লাফিয়ে নেমে গেলো নিচে, রেড জোনের ভেতর।

রেড জোনের ভেতরকার এক বিস্তৃত খোলা মাঠের ভেতরের উন্মুক্ত বাতাসে চোখ জোড়া বন্ধ করে বসে আছে আনাবিয়া, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে ওর, ঠোঁট জোড়া কাঁপছে এখনো মৃদুভাবে। ওর বিপরীতে ওর দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর হাত জোড়া নিজের প্রশস্ত হাতের থাবার ভেতরে শক্ত করে ধরে আছে মীর৷
সূর্য এখন মাথার ওপরে, মেঘলা আকাশের কারণে চাপা পড়ে আছে সূর্যের প্রখর তাপ। ভর দুপুরে মাথার ওপর দিয়ে ওড়াউড়ি করছে কাক আর শকুনের ঝাক।

দূরে কোথাও কোনো প্রাণী সদ্য মরণের কোলে ঢলে পড়েছে, তার দেহাবশেষ নিয়েই কাড়াকাড়ি চলছিলো এতক্ষণ।
কিন্তু হঠাৎ করেই সেখানে বাদশাহ আর শেহজাদীর উপস্থিতিতে একটু অসুবিধা হয়ে গেছে। শিকারী পাখি গুলো দূর আকাশে নিঃশব্দে উড়ছে এদিক থেকে ওদিকে৷
আনাবিয়া মীরকে ঘিরে নিরব, উৎসুক চাহনিতে দাঁড়িয়ে আছে এক ঝাক অদৃশ্য সত্তা, ওদের কৌতুহলী ফিসফিসানি থেকে থেকে কানে আসছে আনাবিয়ার।
এই বিরান ভূমিতে হঠাৎ এই দুই রয়্যাল মেম্বারের আকস্মিক আগমন চিন্তায় ফেলে দিয়েছে অশরীরীদেরকে।
এমন সময়ে আনাবিয়া নিরবতা ভেঙে ক্লান্ত গলায় আচমকা বলে উঠলো,

“পানি, আমাকে পানি খাওয়াও।”
আনাবিয়া পানি চাইতেই মীর আদেশের সুরে ডেকে উঠলো,
“অ্যাবিসোরা!”
মুহুর্তেই ঝড়ের গতিতে কেউ একটি নীল রঙা স্ফটিকের গ্লাসে এক গ্লাস পানি নিয়ে হাজির হলো সেখানে। পানির গ্লাস টা অ্যাবিসোরার হাত থেকে নিয়ে আনাবিয়ার মুখে আলতো করে ধরলো মীর। ঢক ঢক করে গ্লাসের পুরোটা পানি খেয়ে শেষ করলো আনাবিয়া।

“কেমন লাগছে এখন শিনু, ভালো লাগছে একটু?”
মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো মীর। আনাবিয়া ওপর নিচে মাথা নেড়ে উত্তর দিলো মীরের প্রশ্নের, পরমুহূর্তেই নালিশের সুরে কান্নাজড়ানো গলায় বলে উঠলো,
“ও আমাকে…..ও আমাকে এখানে…… এখানে……
“ হুসস, চুপ! ওগুলো আর মনে কোরোনা। ”
নিজের দু আঙুল আনাবিয়ার ঠোঁটের ওপর ছুইয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো মীর। পরমুহূর্তেই দাঁতে দাঁত পিষে চিবিয়ে বলল,

“ওই অসভ্য জানোয়ারটা ওর উপযুক্ত শাস্তি পাবে, চিন্তা কোরোনা! সব ঠিক আছে শিনু, এভরিথিং ইজ অলরাইট! ”
আনাবিয়ার চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোটা তরল গড়িয়ে পড়লো গালের ওপর। তড়িতে পানিটকু মুছে ফেলে আনাবিয়ার চোয়ালজোড়া নিজের শক্ত দুহাতের ভেতরে নিয়ে ওর নরম চোয়ালে বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলিয়ে দিতে দিতে ওর চোখের গভীরে দৃষ্টি দিলো মীর।
সেখানে ও ঠিক কি দেখলো সেটা অজানা, কিন্তু আনাবিয়ার হীরকখন্ডের ন্যায় দৃষ্টির অতলে হারিয়ে ও হঠাৎই জোর গলায় বলে উঠলো,

“আমাকে বিয়ে করবে শিনু? আজ, এখনি, এই মুহুর্তে, এখানেই!
তোমাকে অন্য কারো দায়িত্বে আমি রাখতে চাইনা আর, তোমার সমস্ত দায়িত্ব আমি আমার ওপর নিতে চাই। হবে তুমি আমার দায়িত্ব, আমার কর্তব্য? এখনি!

তোমাকে আর রাতের বেলা একা বিছানায় ঘুমাতে হবে না, আমার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমাবে; একা গোসল দিতে হবেনা, আমার সাথে একত্রে গোসল দিবে; একা খেতে হবেনা, আমার কোল ঘেঁষে আমার হাতে খাবে; দিনের বেলা কাজের স্তুপে ডুবে থাকলেও সমস্ত রাত আমি সঙ্গ দিবো তোমাকে, জড়িয়ে রাখবো বুকের মধ্যিখানে!
ভয় নেই, আমার সকল দায়িত্ব এখনি নিতে হবেনা তোমাকে, আপাতত আমার মানসিক শান্তির ব্যাবস্থাটুকু করলেই চলবে, বাকি দায়িত্ব গুলো সময় হলে একটু একটু করে বুঝিয়ে দেবো! করবে আমাকে বিয়ে?”
মীরের এমন আকস্মিক প্রস্তাবে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো আনাবিয়া। কি উত্তর করবে ভেবে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে।

ওকে দিশেহারা চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্নিগ্ধ হাসলো মীর, মৃদু বাতাসে মুখের ওপর এসে পড়া এক গোছা শুভ্র চুল আঙুলের আলতো ছোয়ায় কানের পাশে গুজে দিয়ে বলল,
“মস্তিষ্কে এত চাপ দিওনা। তুমি এখন যেমন আছো বাকিটা জীবন তেমনই থাকবে।
তুমি আমার স্ত্রী হয়েছো বলে তোমার স্বাধীনতায় আমার কোনো হস্তক্ষেপ কখনোই থাকবেনা শিনু!
তোমার যখন যা ইচ্ছা হয় তুমি তাই করবে, আমি কখনইো কিছু বলবোনা, শুধু তোমার মন মস্তিষ্কের পুরোটা জুড়ে আমাকে রেখো, আর কাউকে না; কোনো কিছুকেই না! শুধুই আমি।
করবে বিয়ে? আজই?”

আনাবিয়া দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে। মীরের এই হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্ত বুঝে উঠতে পারছেনা ও! কি করবে এখন ও? বিয়ের পর কি হবে? সবকিছু কি বদলে যাবে?
ওর আর মীরের এখনের সম্পর্কের নামই বা কি! তার তো কোনো নাম নেই।
ওর হৃদয়ে মীরের জন্য যে অসংজ্ঞায়িত
দুর্বলতা আছে সেটা নামহীন। এতটুকুন বয়সে মীরের প্রস্তাবিত বিরাট সম্পর্কটাকে ঘাড়ে নিলে ও কি শ্বাস নিতে পারবে?
বুকের ভেতর দম বেধে রইলো আনাবিয়ার, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা মুখখানা অসহায়ের ন্যায় ঠেকলো। মীর সেটা লক্ষ্য করে তড়িতে বলে উঠলো,

“ ভেবোনা আমি তোমার ওপর চাপ প্রয়োগ করছি শিনু, তুমি চাইলেই বিয়েটা এখন হবে, না চাইলে নয়।
জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তের অর্থ হলো একটা নতুন পথে পা বাড়ানো। কিন্তু তুমি এর জন্য প্রস্তুত না থাকলে প্রয়োজন নেই!
তবে আমি শুধু এটুকু বলতে চাই— যতদিন আমি এই পৃথিবীতে থাকবো ততদিন আমার কাছে তুমি নিরাপদ, ভালোবাসায় পূর্ণ, আর যথাযোগ্য সম্মানের স্থানে থাকবে।
বিয়েটা আমাদের জন্য কোনো বন্ধন নয়, বরং দু’জনের ভালোবাসার এক শুদ্ধ প্রতিশ্রুতি।
যে সম্পর্কটা এতদিন ধরে একটু একটু করে আমাদের ভেতরে গড়ে উঠছে তাকে একটা নতুন আদল, নতুন নাম দেওয়া!

আমি চাই আমাকে নিয়ে তোমার সমস্ত দ্বিধা আর সংশয় আমার ভালোবাসার ভারে হালকা হয়ে যাক।
আমি চাই আজ এই মুহুর্তে তুমি চিরজীবনের জন্য আমার হাত ধরো, কথা দিচ্ছি তোমার পরমাণু পরিমান অযত্নও কখনো হবে না!
করবেনা আমাকে বিয়ে?”
শেষোক্ত প্রশ্নটা আনাবিয়ার দিকে ভ্রু তুলে অসহায়ের ন্যায় ছুড়ে দিলো মীর। আজ ওর সামনে বসা এই তুলতুলে মেয়েটা একবার শুধু ‘হ্যাঁ’ বলুক, ওকে হৃদয়ের গোপন কোণে লুকিয়ে রাখবে, যেখানে ওর শিনুর নাগাল আর কেউ পাবেনা!

মীরের আকুলতা পূর্ণ দৃষ্টির দিকে তাকালো আনাবিয়া, ওর মুখ থেকে হ্যাঁ শব্দটা শোনার জন্য দুচোখে এক সমুদ্র পরিমাণ প্রত্যাশা নিয়ে বসে আছে মীর৷
আনাবিয়া আর আগে পিছে ভাবলোনা!
পৃথিবীর বুকে আসার পর থেকে যার দৃঢ় হাতের আদুরে স্পর্শে ওর শৈশব, কৈশর কেটেছে তার হাতে বাকি জীবনটা চোখ বন্ধ করে নির্দ্বিধায় সমর্পণ করা যায়।
মীরের ব্যাকুল দৃষ্টিতে অপলক দৃষ্টি রেখেই ও ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলো,
“করবো বিয়ে!”

বহুলআকাঙ্ক্ষিত বাক্যটা শোনামাত্রই ওদের আশেপাশে হুলস্থুল পড়ে গেলো! এতক্ষণ ওখানের সমস্ত অশরীরী গুলো উন্মুখ হয়ে ছিলো বাদশাহের বিয়ের প্রস্তাবে শেহজাদী কি উত্তর করবেন জানার জন্য!
ওদের চঞ্চলতা মিশ্রিত দ্রুত গতির চলনে বৃদ্ধি পেলো খোলা মাঠের বাতাসের প্রবাহ! ওরা ছুটলো চারদিকে, একদল খবর নিয়ে চলল অ্যানিম্যাল টাউনে, অন্যদল ছুটলো বিয়ের জোগাড়যন্ত্র করতে!
আশেপাশের আবছা ছায়া গুলোর এমন হুটোপুটিতে তটস্থ হলো আনাবিয়া, মীর ওর হাতের ওপর হাত রেখে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,

“ রিল্যাক্স! নিজের ওপর চাপ দিওনা, চাপ নেওয়ার জন্য তোমার মীরি আছে।”
তারপরেই আশেপাশের পরিবেশের দিকে নজর দিয়ে মীর উচ্চস্বরে হাক ছাড়লো,
“গার্লস!”
মীরের হাক শোনা মাত্রই আশেপাশ থেকে দ্রুত গতিতে কারা যেন এক ঝাকে উড়ে এসে ঘিরে দাড়ালো আনাবিয়াকে, ওদের মুখনিঃসৃত রিনরিনে মৃদু আবছা স্বর ঘুরে বেড়াতে লাগলো বাতাসের পরতে পরতে!
“আমাকে কিছু সময়ের জন্য নিরুদ্দেশ হতে হচ্ছে, সে সময়টুকু এরা তোমাকে সঙ্গ দিবে।
এরা ঘেউল, তোমার সামনে আসবে না কারণ ওদের দেখলে তুমি ভয় পাবে, বুঝেছো?”
আনাবিয়ার থুতনি ধরে বলল মীর।
‘হুম’

আনাবিয়ার কাছে এখনো সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে, যেন কোনো স্বপ্নের দেশে ঢুকে পড়েছে ও মীরের সাথে! এখান থেকে ও বের হতে পারবেনা স্বেচ্ছায়, মীর ছাড়া কেউ ওকে বের করতে পারবেনা!
মীর ওকে মেয়ে ঘেউল গুলোর তত্ত্বাবধানে রেখেই প্রস্থান করলো সেখান থেকে, পুরাই গায়েব হয়ে গেলো, ওর আর টিকি পাত্তা পাওয়া গেলোনা৷
আর এরপর আনাবিয়ার চোখের সামনেই খোলা প্রান্তরটা অশরীরী আর অ্যানিম্যাল টাউনের বাসিন্দাদের দ্রুত হাতে সেজে উঠলো মুহুর্তেই।

কাজে হাত লাগিয়ে কলকলিয়ে গল্প করতে লাগলো ওরা সবাই মিলে। কেউ একজন এসে আনাবিয়ার দুহাতের ভেতর গুজে দিয়ে গেলো পাটায় বাটা মেহেদী পাতা, আনাবিয়া মুঠির ভেতরে ধরে বসে রইলো সেগুলো।
কিছু মুহুর্ত বাদেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো নোমান, বেলিন্ডা সহ আরও দুজন দাসী। অ্যানিম্যাল টাউনের মেয়েদের সহোযোগিতায় পাশেই তৈরি হলো একটি অস্থায়ী অন্দরমহল। অস্থায়ী হলেও তার আভিজাত্যের কোনো কমতি রইলোনা।

বেলিন্ডাদের নিকট আনাবিয়ার জন্য পাঠানো পোশাক আর অ্যক্সেসরিজ পরিয়ে আনাবিয়াকে প্রস্তুত করার জন্য হিড়িক পড়ে গেলো অন্দরমহলে। অন্দরমহলের এক গোপন কোণে আনাবিয়াকে নিয়ে গেলো বেলিন্ডা, অতঃপর মীরের সদ্য বাছাই করা অফ হোয়াইটের অসাধারণ নকশাদার হালকা পাতলা পোশাক পরানো হলো ওকে।
পোশাক পরার আগ মুহুর্তে আনাবিয়া চাপা গলায় শুধালো,

“আমি গোসল দিবোনা বেলা?”
“হিজ ম্যাজেস্টি বলেছেন বিয়ের পর্ব সেরে গেলে উনি নিজের হাতেই আপনাকে গোসল দেওয়াবেন।”
কথাটা বলেই ঠোঁট টিপে হেসে নিজের কাজে লেগে গেলো বেলিন্ডা। আনাবিয়ার কান গরম হয়ে গেলো, লজ্জায় জ্বালা করছে গাল দুটো।
মীর তবে সত্যি সত্যিই…..!

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নকশাদার কাঠ, ফুল লতাপাতা দিয়ে সাজানো খোলা প্রান্তরটার এক কোণের সাজানো পুরু পর্দা ঘেরা ছোট্ট স্টেজের ওপর টানানো পাতলা পর্দার এপাশে বসে আছে আনাবিয়া। ওর পাশে ওকে ঘিরে বসে আছে বেলিন্ডা আর অ্যানিম্যাল টাউনের কিছু মেয়ে।
পর্দার ওপাশে বসে আছে একটা ধবধবে সাদা রঙা জমিনের ওপর সোনা রঙা সুক্ষ্ম কারুকার্য শোভিত পাতলা পাঞ্জাবী পরিহিত মীর। চোখ জোড়া ওর পর্দার ওপাশে থাকা আনাবিয়ার আবছা অবয়বের দিকে।
মীরের এপাশে অনেক লোক! জায়ান, নওয়াস, হামদান, কাজী সাহেব সহ আরও বেশ কয়েকজন।
জায়ান, নওয়াস আর হামদান মিলে নিজেদের ভেতর চুপিসারে কথা বলছে। বিয়ে শাদির সময়ে পাত্রকে একটু আধটু খোচাখুচি না করলে জমে না, কিন্তু এই পাত্রের সাথে বিবাহপূর্ব ঠাট্টা করার মতো সাহস ওদের হচ্ছেনা।
জায়ানের পেটের ভেতর গুড়ুগুড়ু করছে কিছু বলার জন্য, এই কথা হামদান শুনতেই বলল,

“আপনি কথা চেপে রেখেছেন দেখে আপনার কথা গুলো পেটের ভেতর ফেরত গিয়ে মারামারি লাগাইছে, তাই এরম শব্দ হচ্ছে সাদি ভাই।
যা বলবেন বলে ফেলেন প্লিজ! আপনি শুরু না করলে অন্য কেউ সাহস পাবেনা, আর বিয়েটাও পানসে থেকে যাবে।”
ওপাশ থেকে নওয়াস হু হা করে সায় জানিয়ে জায়ানের পিঠে একটা ছোট খাট চাপড় মেরে আর একটু তাল দিলো।
পেছনে এদের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর শুনে ঘাড় বাকিয়ে তাকালো মীর।
মীর তাকাতেই ওদের ফিসফিসানি থেমে গেলো পুরোদমে। তড়িঘড়ি করে স্টিলের ন্যায় সোজা হয়ে বসে রইলো ওরা।
মীর ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে জায়ান নওয়াস দের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,

“আমার বিয়ে উপলক্ষে আজকের দিনে তোমাদেরকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হলো। আমি বউ নিয়ে প্রাসাদে ফেরার আগে পর্যন্ত আমাকে পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ না ভেবে নিজেদের সুহৃদ ভাই ভাবতে পারো।”
ওদের এই হৃদয়ে লালিত ইচ্ছাটাকে মীর এভাবে ধরে ফেলায় অপ্রস্তুত হয়ে ঘাড় চুলকালো জায়ান, তারপর ইতস্তত কন্ঠে বলল,

“ই-ইয়োর ম্যাজেস্টি…..”
“ভাইজান, ভাইজান ডাকো জায়ান। নেক্সট থ্রি আওয়ার্স আমাদের ভেতরকার সমস্ত ইনফর্মালিটি বাদ দিয়ে আমাকে সহজভাবে নাও, অল অব ইয়্যু। ধরে নাও আমরা জাস্ট কাজিন্স, দাদাজান বেচে থাকাকালীন ঠিক যেমন ছিলাম তেমন।”
জায়ানের কথা শেষ হওয়ার আগেই ভারিক্কি কন্ঠে বলল মীর। জায়ান ঢোক গিললো, শেষ কবে হিজ ম্যাজেস্টি কে ভাইজান ডেকেছে মনে পড়েনা ওর! এখন হঠাৎ করে ডাকতে গিয়ে কেমন জড়তা এসে ভর করছে মুখে।
ওদেরকে সহজ করার জন্য মীর এবার হামদানের পিঠে চাপড় দিলো,

“হামদান, তুমি অনেক্ক্ষণ ধরেই দেখছি কিছু বলার জন্য ছটফট করছো, ঠিকভাবে বসতেও পারছোনা। যা বলার আছে বলো, আমি শুনছি।”
“ইয়োর ম্যাজ….”
ডাকতে গিয়েও মীরের ভ্রু তোলা দৃষ্টি দেখে থেমে গেলো হামদান, পরক্ষণেই শুধরে নিয়ে বলল,
“ভা-ভাইজান! আমার একটা আবদার আছে আপনার কাছে।”
“বলো, আমি শুনছি।”
“আমাদের শেহজাদীকে আমি সেই ছোট্টবেলাটা থেকেই নিজের মেয়ের মতো দেখেছি, উনিও সময়ে অসময়ে আমার কাছে বাবার মতোই আহ্লাদ নিয়ে বসতেন। তাই, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আজ শেহজাদীর অভিভাবকের আসনের আমি একজন হতে চাই।”

মৃদুস্বরে, আনুগত্যের সাথে বলল হামদান।
হামদানের এমন আবদারে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হলো মীরের।
“তোমার আবদার অবশ্যই রাখা হবে হামদান।”
ওপাশ থেকে নওয়াস ইতস্তত করে বলে উঠলো,
“ভাইজান, কাজী সাহেব জিজ্ঞেস করছেন উনি বিয়ে পড়ানো শুরু করবেন কিনা!”
মীর সম্মতি দিতেই কাজি সাহেব এগিয়ে এলেন। মীরের ডান পাশে বসলেন তিনি। কিন্তু জীবনে প্রথমবারের মতো পঞ্চদ্বীপের বাদশাহের পাশে বসে তার অবস্থা খারাপ। রীতিমতো ঘেমে একাকার হয়ে গেছেন, কথা বলতে গেলে বারবার গলা কেঁপে যাচ্ছে।

মীর জায়ানের দিকে দৃষ্টি দিতেই জায়ান কাজি সাহেবের পিঠে দুই একটা স্বান্তনার চাপড় দিয়ে আশ্বস্ত করলো যে তারা সবাই আছে এখানে, নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই!
কাজী সাহেব নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
“পাত্র পক্ষের সাক্ষী দিবেন কে কে?
মীরের পেছন থেকে নওয়াস আর মীরের সহচর দের একজন হাত তুললো। কনে পক্ষের সাক্ষী হলো জায়ান আর হামদান। মীরের সাথে আলোচনা করে দেনমোহর নির্ধারণ করা হলো। অতঃপর কাজি সাহেব আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলা শুরু করলেন,

“আজকের মজলিশে শিরো মিদোরির দেমিয়ান প্রাসাদের শেহজাদা শান আরহাম দেমিয়ানের পুত্র বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের সহিত পঁচিশ হাজার ব্লু কয়েন্স এবং কুরো আহমারে একটি রাজমহল দেনমোহর ধার্য্য করে আপনার বিবাহ নির্ধারণ করে হয়েছে, আপনি কবুল করছেন? কবুল করলে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ কবুল করছি।”
পর্দার ওপাশ থেকে মীরের আবছা চেহারার ওপর ফুটে থাকা জ্বলজ্বলে সোনালি চোখের ব্যাকুল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থমকে রইলো আনাবিয়া।
ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা যে ও সত্যিই আজ মীরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে!
একটা শুকনো ঢোক গিললো ও, মাথার ভেতর কেমন যেন অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে ওর। আশেপাশের অন্য কোনো শব্দ আর ওর কানে আসছে না। সবকিছু যেন থমকে আছে ওর চারপাশে! চোখের সামনে সবকিছু যেন ঝাপসা, অস্পষ্ট!
গরম হতে শুরু করেছে কান আর মাথা।

এতটা নার্ভাস লাগছে কেন ওর? সবকিছু খুব দ্রুত হয়ে যাচ্ছে বলে? কিন্তু এই কি হওয়ার ছিলো না?
আজ হোক বা কাল ওর জীবন তো ওই স্বর্ণোজ্জল চোখের পুরুষটির সাথেই বাধা পড়তো, তাহলে?
বেলিন্ডার মৃদু ঝাকুনিতে হুস ফিরলো ওর, শঙ্কিত চেহারা নিয়ে বেলিন্ডা ওকে ডেকে চলেছে অনেক্ষণ যাবৎ, কিন্তু ওর কানে পৌছায়নি বেলিন্ডার কথা।
পর্দার ওপাশ থেকে মীর উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, চোখ জোড়ায় দুঃশ্চিন্তা ছাপানো প্রকটভাবে!
কাজী সাহেব আরও একবার বলে উঠলেন,
“শেহজাদী, বলুন আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
আনাবিয়া পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আবার মীরের দিকে, ওর সামনে উপবিষ্ট এই অত্যাধিক সুদর্শন পুরুষটি ওর সব, ওর সমস্ত কিছু!
দ্রুত গতিতে বুকের ভেতর বাতাস টেনে নিয়ে পরক্ষণেই সেটা ছেড়ে দিয়ে আনাবিয়া বলে উঠলো,

“ আলহামদুলিল্লাহ, কবুল!”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো মীর, এখন যদি আনাবিয়া এই হঠাৎ বিয়ের মানসিক চাপ সইতে না পেরে অন্যরকম কিছু করে বসতো তবে দিশেহারা হয়ে পড়তো ও, খেই হারিয়ে কোথায় পড়তো তা ও নিজেও জানেনা!
কাজী সাহেব এবার মীরের দিকে ফিরে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফাকা ঢোক গিললেন একটা, তারপর বলতে শুরু করলেন,
“দেমিয়ান প্রাসাদের প্রয়াত শেহজাদা সালিম আরাবী দেমিয়ানের একমাত্র কন্যা শেহজাদী আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ানের সহিত আপনার বিবাহ নির্ধারণ করা হয়েছে, আপনি কবুল করছেন? কবুল করলে বলুন আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

“আলহামদুলিল্লাহ, কবুল!”
মীরের কণ্ঠনিঃসৃত বাক্যটি শোনা মাত্রই চোখ বুজে নিলো আনাবিয়া। দুফোটা রহস্যময় লোনা পানি টুপ করে ঝরে পড়লো ওর আঁখিদ্বয় থেকে!
আজ, এই মুহুর্ত থেকে সামনে বসা রাশভারী পুরুষটির সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলো ও, বেধে গেলো পবিত্র বন্ধনে। এ বাধন আর কখনোই ছুটে যাবেনা; মীর ছুটে যেতে দেবেনা, কখনোই না!
বিয়ের পর্ব শেষ হতেই হই হই করে উঠলো সকলে, নোমান বিগলিত বদনে খেজুর ভর্তি পাত্র নিয়ে এসে ছড়িয়ে দিতে লাগলো সবার ভেতরে। বেলিন্ডা মিষ্টি হেসে টিপে দিলো আনাবিয়াল লাল হয়ে যাওয়া গাল।
পর্দার অপর পাশে থাকা মীর আনাবিয়ার মেরুণ রঙা পাতলা ওড়নায় ঢাকা চেহারার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

“আমি আমার স্ত্রীর সাথে একা কথা বলতে চাই।”
মীরের মুখনিঃসৃত বাক্য শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সকলে শৃঙ্খলার সাথে দ্রুত পায়ে উঠে স্টেজের বাইরে বেরিয়ে গেলো নিরবে।
পুরু পর্দা আবৃত স্টেজটা ফাকা হতেই নিজের সামনে এতক্ষণ আনাবিয়ার শুভ্র, মোলায়েম মুখ খানা আড়াল করে রাখা পাতলা পর্দা টা দৃঢ় হাতের বলিষ্ঠ স্পর্শে দুভাগ করে দিয়ে আনাবিয়ার পাতলা কোমরখানা এক হাতে ধরে হ্যাচকা টানে নিজের কোলের ওপর তুলে নিয়ে এলো মীর।
আনাবিয়ার হীরকখন্ডের ন্যায় উজ্জ্বল চোখ জোড়ার দিকে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো ওর কপালে।

আর তার পরমুহূর্তেই আনাবিয়ার টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়া তড়িতে নিয়ে নিলো নিজের দখলে, দুষ্প্রাপ্য অমৃত সুধার ন্যায় আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া থেকে কেড়ে নিলো একটি চুম্বন, বহুল প্রতিক্ষিত চুম্বন!
সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো আনাবিয়ার, শিউরে উঠলো সমস্ত শরীর, প্রথম প্রগাড় চুম্বনের সংবাদ ছড়িয়ে গেলো দেহের সমস্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে!
কিছু মুহুর্ত বাদে ওর ঠোঁট জোড়ার দখল ছেড়ে দিয়ে, কপালে কপাল মিশিয়ে, নাকে নাক ঠেকিয়ে চোখ জোড়া বুজে নিয়ে নেশালো কন্ঠে মীর বলে উঠলো,
“পাঁচ বছর পূর্বে ফেব্রুয়ারীর দুই তারিখে, কুরো আহমারের ডাস্কমায়ার জঙ্গলে গাড়ির ভেতর তোমার শীতলতায় ছেয়ে যাওয়া ছোট্ট শরীরটাকে এই বুকের ওপর রেখে উষ্ণতা দেওয়ার সময়ে হওয়া ভীষণ, তীব্র ইচ্ছেটা পূরণ করে নিলাম আজ!”

আনাবিয়া চোখ জোড়া বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে নিজের শরীরের ভর ছেড়ে এলিয়ে দিলো মীরের বুকের ওপর। ওর শরীর মন মস্তিষ্কের সমস্ত ক্লান্তি হঠাৎ করেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়েছে! অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে গেছে ওর বুক।
মীর ওর মুখের ওপর এসে পড়া শুভ্র চুল গুলোকে একে একে মুখের ওপর থেকে সরিয়ে কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে মোহনীয় কন্ঠে বলল,
“ওই কাগজে সই এর সাথে সাথে এই আমাকে আমি তোমার নামে লিখে দিয়েছি প্রাণ আমার, তোমার যখন যেটা মন চাইবে তুমি সেটাই করবে আমার সাথে!
তোমার যত স্বাধ, আহ্লাদ, যত রাগ অভিমান সব এই নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই বহন করবে।

তোমার ওপরে কোনো বাধানিষেধ নেই শিনু, তুমি মুক্ত স্বাধীন, বরাবরের মতো।
তোমাকে আমি সমুদ্রের স্বচ্ছ, নীল পানির ন্যায় বিশ্বাস করি! আমার থেকে কখনো কোনো কাজে অনুমতি নেওয়ার কোনো প্রয়োজোন নেই তোমার, আমার এক্সিস্টেন্সই তোমার অনুমতি৷
তোমার অতীত, তোমার বর্তমান, তোমার ভবিষ্যৎ সব কিছু এই আমাকে ঘিরেই, আমিই তোমার পৃথিবী।
এই পঞ্চদ্বীপ আর তোমার হৃদয় জুড়ে শুধু আমি রাজত্ব করতে চাই, আর কেউ না, কোনো কিছুইনা, কখনোই না! মনে থাকবে?”

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯+১০

আনাবিয়া মীরের কাঁধের ওপর মাথা ঠেকিয়ে চোখ তুলে তাকালো মীরের দিকে, মীর ওর নাক টিপে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
“বলো, মনে থাকবে?”
আনাবিয়া মাথা নাড়ালো ওপর নিচে। মীর ওর কপালে দ্বিতীয় বার ঠোঁট স্পর্শ করে স্বগতোক্তি করলো,
“এ দুই স্থানের কোনোটা আমার নাগালের বাইরে গেলে আমি ধ্বংস কিরে দেবো সবকিছু, সমস্ত কিছু…..!”

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৩+১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here